১৯০৫। বয়স ৬ বছর
খুব ছেলেবেলা থেকেই জীবনানন্দের ওপর মা-বাবার প্রভাব পড়েছিল নিবিড়ভাবে। বাবা- মায়ের জীবনযাপন রীতি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জীবনানন্দকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করেছিল। সত্যানন্দ জীবনানন্দকে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। অন্যদিকে মায়ের কাছ থেকে জীবনানন্দ পেয়েছিলেন—
‘পাখির পালকের চাইতেও নরম অনুভবের মেদুরতা। বাবা যদি দিয়ে থাকেন তাঁকে সৌরতেজ, প্রাণবহ্নি, তবে মা তাঁর জন্যে সঞ্চয় করে রেখেছিলেন স্নেহ- মমতা বনচ্ছায়া, মৃত্তিকাময়ী সান্ত্বনা। তাঁর জন্যে মা একটি নিরিবিলি পরিবেশ, শান্ত মধুর আবহাওয়া রচনা করে দিতেন সর্বক্ষণ, যাতে সেই ঘন একান্ততাকে খণ্ডিত করে না দেয় আমাদের বৃহৎ পরিবারের কোলাহল, কর্মব্যস্ততার কলরব, তার দিকে মার সজাগ দৃষ্টি ছিল প্রতিটি মুহূর্তের। [‘কাছের জীবনানন্দ’, সুচরিতা দাশ, ‘জীবনানন্দ স্মৃতি ময়ূখ’, পৌষ-জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬১-১৩৬২]
রবীন্দ্রনাথের বয়স ৪৪। ‘অন্ধকারের কাব্য’ নামে খ্যাত ‘খেয়া’র কবিতাগুলো লিখছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ভাণ্ডার’ পত্রিকার সম্পাদক হলেন তিনি। ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি লিখলেন। তাঁর জীবনের সামাজিক ব্রত হয়ে দাঁড়াল পল্লী উন্নয়ন ও বিশ্বভারতীর বিকাশ সাধন। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ সংকলনে ব্রতী হলেন।
১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হল। লর্ড কার্জন শাসনকার্যের সুবিধার জন্যে রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ—তিনটিকে আসাম প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশ গঠন করেন। রাজধানী হয় ঢাকা এবং গভর্নর নিযুক্ত হন স্যার র্যামফিল্ড ফুলার। বঙ্গের অবশিষ্ট দু’টো বিভাগ, দার্জিলিং জেলা, বিহার, ছোটনাগপুর ও উড়িষ্যাকে নিয়ে করা হল পশ্চিমবঙ্গ। শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুরা তীব্রভাবে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা শুরু করেন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ২২ মাসে বাংলায় ৩ হাজার সভা হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের দিন অরন্ধন ও হরতাল পালিত হয়।
কার্লাইল সার্কুলার ঘোষিত হল। ছাত্রদের রাজনীতিতে যোগদান নিষিদ্ধ করা হল। এ বছরেই সরকারি দমন-পীড়ন বিরোধী ‘অ্যান্টিসার্কুলার সোসাইটি’ গঠন করা হল। ভারতে প্রথম কাগজের মুদ্রা বাজারে এল। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুবোধচন্দ্র মল্লিক, বিপিনচন্দ্র পাল, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখের সাহায্য-সহযোগিতায় সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই পরিষদ গঠন করেন।
তৎকালীন স্টেট সেক্রেটারির সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় ১৭ নভেম্বর লর্ড কার্জন পদত্যাগ করেন। ১৮ নভেম্বর লর্ড মিন্টো বড়লাট হয়ে আসেন। ঢাকা কার্জন হলের নির্মাণ কাজ শুরু হল; ১৯০৪-এ লর্ড কার্জন এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
প্লেগরোগে ভারতে এক সপ্তাহে ৩৪ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে। উত্তর ভারতে ভূমিকম্পে ২০ হাজার লোকের প্রাণনাশ হয়।
জাপানিসৈন্য পোর্ট আর্থার দখল করে। জাপান সাগরের জলযুদ্ধে নৌ-সেনাপতি অ্যাডমিরাল তোগো রুশীয় বাল্টিক নৌবাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের চেষ্টায় সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হলে রুশ-জাপান যুদ্ধের অবসান ঘটে। রাশিয়ায় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে ৫০ হাজার ইহুদি নিহত হয়। রাশিয়ায় সংঘটিত হল ‘ব্লাডি সানডে’র ঘটনা। এই ঘটনায় শান্ত মিছিলের ওপর জারের পুলিশ গুলি চালালে কয়েকশ’ মিছিলকারী নিহত হয়। রাশিয়ার কলকারখানায় ধর্মঘট পালিত হয়। ফলে রাশিয়ান শাসনতন্ত্র প্রণীত হল, প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি হল।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিমিয়ার হীরকখনিতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হীরকখণ্ড ‘দ্যা কলিনান’ পাওয়া যায়। আইনস্টাইনের ‘রিলেটিভিটি তত্ত্ব’ আবিষ্কৃত হয়।
এ বছর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেছেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯ জানুয়ারি) যোগেন্দ্রচন্দ্র বসু।
জন্মালেন কথাসাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল, জাঁ পল সাত্রে।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান এইচ. সিয়ন কিয়েউইৎস (১৮৪৬–১৯১৬)। উপন্যাসকার, পোল্যান্ডের অধিবাসী। কিয়েউইৎসকে পুরস্কার দেওয়ার পক্ষে নোবেল কমিটি লেখেন—
‘Beause of his outstanding merits as an epic writer’.
তাঁর বিখ্যাত রচনাগুলি হল— Quo vadis’, ‘The Lights of the Cross’, ‘The Lighthouse keeper.’
প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রিকা : প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মশক্তি’ ও ‘বাউল’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘প্রতাপ সিংহ’, জ্যোতিরিন্দ্র নাথের ‘প্রবন্ধমঞ্জরী’, রজনীকান্ত সেনের ‘কল্যাণী’। প্রকাশ পেল শ্রীম কথিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’; সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘সন্ধিক্ষণ’ বের হল। বার্নার্ড শ’র ‘Man and Superman’, সরোজিনী নাইডুর কাব্য ‘The Golden Threshold’, জলধর সেন সম্পাদিত ‘স্বদেশীগান সংগ্রহ’, ‘জাতীয় উচ্ছ্বাস’, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ সম্পাদিত ‘স্বদেশী সংগীত’ প্রকাশিত হল।
প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় ‘ভাণ্ডার’ নামক পত্রিকাটি।