১৮. হোস্টেলে ফিরে এসে অনিমেষ দেখল

আঠারো

হস্টেলে ফিরে এসে অনিমেষ দেখল ওর ঘরে বেশ ভিড়। তমাল আর পাশের ঘরের দুটি ছেলে বেশ মেজাজে আড্ডা জমিয়েছে দাদুর সঙ্গে। সরিৎশেখর ডুয়ার্সের পুরনো দিনের গল্প বলছেন। তমাল চেয়ারে বসেছে আর দু’জন জানলার কাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে।

অনিমেষ দরজায় দাঁড়াতেই বিছানায় বসা সরিৎশেখরের নজর পড়ল প্রথম, কথা থামিয়ে বললেন, ‘এখানে ডাক্তারকে বোধহয় সহজে পাওয়া যায় না!’

অনিমেষ হেসে ঘাড় নাড়ল। দাদুর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে হলে এ প্রশ্নটা করতেনই না। দেরি হলে বকাঝকা করে বাড়ি মাথায় করতেন। হঠাৎ অনিমেষের মনে পড়ল এই লোকটার ভয়ে এককালে স্বর্গছেঁড়ায় বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত। অনিমেষ ওষুধগুলো টেবিলে রাখল, ‘এখন শরীর কেমন আছে?’

‘ভাল, বেশ ভাল। এই যে তোমার বন্ধু আমাকে সন্দেশ খাওয়াল, চমৎকার খেলাম।’ ফোকলা মুখে হাসলেন সরিৎশেখর।

তমাল অনিমেষকে বলল, ‘দাদুর কাছে তোমাদের ওখানকার গল্প শুনছি। দারুণ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। চা-বাগান কী করে পত্তন হল তার জীবন্ত সাক্ষী দাদু। আমরা তো সেই ‘দুটো পাতা একটা কুঁড়ি’ থেকেই যেটুকু জেনেছি।’

অনিমেষের এত ভিড় ভাল লাগছিল না। একেই ঘরটা ছোট তার ওপর এত লোক একসঙ্গে হলে ভাল করে দাঁড়ানো যায় না। সে বলল, ‘বাবাকে চিঠি দেওয়া হল না। ভাবছি কাল সকালে একটা টেলিগ্রাম করে দেব!’

‘হোয়াই?’ সরিৎশেখরের ভুরু কুঁচকে গেল।

অনিমেষ দাদুর দিকে তাকাল। এরকম প্রশ্ন কেন? উনি এই অবস্থায় অসুস্থ হয়ে কলকাতায় এসেছেন এ খবর জানানোয় অন্যায়টা কী? ‘বাবা নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছেন!’

‘আমার মনে হচ্ছে চিন্তাটা তোমারই বেশি হচ্ছে। তা ছাড়া তোমার টেলিগ্রাম যাবার আগেই আমিই পৌঁছে যাব। ওসব করতে যেয়ো না।’ সরিৎশেখর ঘাড় নাড়লেন।

‘আপনি পৌঁছে যাবেন মানে?’

‘আমি ঠিক করেছি কাল নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেসে চলে যাব।’

‘সে কী! এই শরীর নিয়ে আপনি যাবেন কী করে! পথেঘাটে কিছু হয়ে গেলে আর দেখতে হবে না। শরীর ঠিক করে তারপর যাবেন।’ অনিমেষ খুব অসন্তুষ্ট গলায় বলল। যে লোকটা সকালবেলায় ওরকম ধুঁকেছে সে-ই সন্ধেবেলায় এরকম কথা বলছে?

সরিৎশেখর হাসছিলেন, ‘আমার শরীরকে আমার চেয়ে বেশি নিশ্চয়ই কেউ বুঝবে না। যেটুকু দুর্বলতা আছে তা বয়সটার জন্যে। জলপাইগুড়িতে ফিরে গেলে সেটা ঠিক হয়ে যাবে।’

এতক্ষণ ওরা চুপচাপ কথা শুনছিল। এবার তমাল বলল, ‘কিন্তু দাদু, আরও দু’-তিন দিন থেকে গেলে দোষটা কী। শরীর ফিট হয়ে গেলে কালীঘাট দক্ষিণেশ্বর ঘুরে পুজোটুজো দিয়ে তবে যান। আমাদের কাছে যখন এসেছেন তখন তাড়াতাড়ি ফিরে যাবেনই বা কেন?’

সরিৎশেখর বললেন, ‘বেঁচে থাকি যদি নিশ্চয়ই আবার আসব ভাই, অনিমেষ চাকরি বাকরি করে ঘরদোর করুক তখন এসে থাকব। এখন এই খাঁচায় আমার পক্ষে থাকা অসম্ভব।’

‘খাঁচা?’ অনিমেষ অবাক হল।

‘খাঁচা নয়! স্বর্গে আছি পাতালে যেতে হবে পায়খানা করতে। তাও যদি একই সঙ্গে কয়েকজনের প্রয়োজন হয় তা হলে লাইন দিতে হবে সেখানে। আমি মনে করি মানুষের শোয়ার ঘর আর পায়খানা একইরকমের আরামদায়ক হওয়া উচিত। তার ওপর এইরকম কানের কাছে দিনরাত ট্রামের ঢং ঢং আওয়াজ অসহ্য।’ সরিৎশেখর মুখ বেঁকালেন।

অনিমেষ হেসে বলল, ‘তা হলে বুঝুন আমি— আমরা কীরকম আরামে থাকি!’

সরিৎশেখর উত্তেজিত হলেন, ‘এটা তোমাদের কী দুর্ভাগ্য তোমরা বুঝছ না। একটি ছাত্রকে যদি ন্যায্য পয়সা দিয়েও এইরকম নরকে থাকতে হয় তা হলে তার কাছ থেকে দেশ কী আশা করবে? এইভাবে তোমাদের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’

পাশের ঘরের আর-একটি ছেলে বলল, ‘বিশৃঙ্খলা মানে?’

সরিৎশেখর কঠিন মুখে বললেন, ‘এখন কত রাত? এই সময় প্রতিটি ছাত্রের কী করা উচিত? আর তোমরা আমার সঙ্গে গপ্পো করছ, এটা বিশৃঙ্খলা নয়?’

কথাটা শুনে ছেলেদের মুখ কালো হয়ে গেল। অনিমেষ খুব অস্বস্তিতে পড়ল। দাদু যে এরকম মুখের ওপর ওদের কথা শোনাবেন সে ভাবতে পারেনি। অবশ্য এটাই সরিৎশেখরের আসল চরিত্র। রেখে-ঢেকে কথা বলতে পারেন না।

তমাল উঠে দাঁড়াল, ‘আমি কিন্তু আপনার কথা মানছি না। আমরা যারা হস্টেলে থেকে পড়ি তারা জানি আমাদের পাশ করতেই হবে। এটা আমাদের দায়িত্ব। নিজেদের পড়াশুনো আমরা নিজেদের সুবিধেমতো সময়ে করে নিই। আপনার কাছে যেটা পড়াশুনার সময় বলে মনে হচ্ছে সেটা আমার কাছে জিরোবার মনে হতে পারে। ধরুন সারাদিন ক্লান্তির পর ট্রামে-বাসে ঝুলে হস্টেলে ফিরে পড়তে বসলে আমার ব্রেন তা অ্যাকসেপ্ট করবে না। অথচ দশটার পর পড়লে ওটা আমার বুঝতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। কোনটা বিশৃঙ্খলা এবার বলুন?’

সরিৎশেখর কিছুক্ষণ তমালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বোঝা যাচ্ছিল তিনি বেশ অবাক হয়েছেন। তারপর অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘আমি তোমাদের ঠিক বুঝতে পারি না। প্রায়ই কাগজে ছাত্রদের ট্রাম-বাস পোড়ানোর কথা পড়ি। তখন মনে হয় তোমরা যাতে পড়াশুনো ছাড়া সবকিছু করো তার জন্যে একটা প্ল্যান চলছে। হয়তো তোমরা ভাল ছেলে তাই এভাবে থেকেও একটা পথ বের করে নিয়েছ। কিন্তু যারা বুদ্ধিমান নয় তারা তো তলিয়ে যাবে।’

এরপর আর কথা জমল না। দাদুর কথার সুর ওদের কানে লেগে আছে অনিমেষ বুঝতে পারছিল। এক-একটা অজুহাত দেখিয়ে বা না-দেখিয়ে ওরা চলে গেল। ঘর নির্জন হয়ে গেলে অনিমেষ বলে ফেলল, ‘আপনি ওভাবে না-বললেই পারতেন!’

‘কীভাবে?’

‘এই সরাসরি— মুখের ওপর।’

‘আমি তো অন্যায় কিছু করিনি। তোমার কি অন্যায় মনে হচ্ছে?’

‘আমরা অপ্রিয় সত্যি বলতে চাই না।’

‘অপ্রিয় সত্যি!’ সরিৎশেখর হাসলেন, ‘তা হলে তুমি এটাকে সত্যি বলতে চাইছ?’

‘হয়তো, আবার তা নাও হতে পারে। দাদু, আমরা জলপাইগুড়িতে সবকিছু যেরকমভাবে দেখতাম এবং ভাবতাম, কলকাতায় এসে জানলাম সেটাই অন্যভাবে দেখা যায় বা ভাবা যায়। তাই এখানে সবকিছুই অন্যরকম। আসলে জলপাইগুড়ি আর কলকাতার পরিবেশ একদম আলাদা, সবাই পরিবেশ অনুযায়ী নিজেকে তৈরি করে নেয়।’

সরিৎশেখর নাতিকে ভাল করে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘লন্ডনে দুপুরবেলায় বরফ পড়ে, সাহারায় আগুন জ্বলে আর কলকাতায় ঘাম হয়। কিন্তু ওই একই সময়ে তিনটে জায়গার মানুষের বোধগুলোর কিন্তু পরিবর্তন হয় না। থাক ছেড়ে দাও এসব কথা। তোমার ডাক্তার কী বলল?’

অনিমেষ ডাক্তারের কথা জানাল। সরিৎশেখর শুনে বললেন, ‘ওসব আর দরকার হবে না। রাত্রে যদি ঘুম হয় তা হলেই হবে। এই বয়সে ওষুধপত্র শরীরকে কাহিল করে দেয়। তা হলে কাল সকালে আমাকে ট্যাক্সি ডেকে দিয়ো।’

‘আপনি কালকে যাবেনই?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু কেন?’

‘আমার ফিরে যাওয়া দরকার, তাই।’

‘তা হলে ট্যাক্সি ডেকে দিতে বলছেন কেন? আমি তো স্টেশনে গিয়ে সিট রিজার্ভ করিয়ে আপনাকে বসার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আমার তো তাই করা উচিত।’

‘কী দরকার। আমি তো এতটা রাস্তা একা একা ঘুরলাম, তুমি তো সঙ্গে ছিলে না। এখানে এসে আমি অকর্মণ্য হয়ে পড়েছিলাম বলেই তোমাকে বিরক্ত করেছি। আবার শরীরটা ঠিকঠাক হয়ে গেলে নিজেই চলে যেতে পারব। এইজন্যে মিছিমিছি তোমার একটা দিন নষ্ট হয়ে গেল। কাল স্টেশনে গেলে তোমার আর-একটা দিন কলেজ নষ্ট হবে। সেটা আমি চাই না।’ সরিৎশেখরের গলা কেমন নিরাসক্ত লাগছিল।

অনিমেষের মনে হচ্ছিল দাদু অনেক দূরের মানুষ। সকালে দাদুকে দেখে বুকের মধ্যে যে আবেগের জোয়ার এসেছিল তা এই মুহূর্তে নিঃসাড়। এই মানুষটার বুকে হামাগুড়ি দিয়ে ওর শৈশব কেটেছে। রিটায়ার করে যখন সরিৎশেখর স্বর্গছেঁড়ার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে জলপাইগুড়িতে চলে এলেন তখন সে সাত-আট বছরের বালক, বাবা-মাকে ছেড়ে ওঁর সঙ্গ ধরেছিল। স্কুলের ক্লাসগুলো একটা একটা করে ডিঙিয়েছে এই মানুষটার কড়া নিয়মের মধ্যে থেকে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে সরিৎশেখরকে কোনওদিন চিনতে পারেনি। একথা ঠিক, এরকম ঘরে থাকার অভ্যেস দাদুর নেই। হস্টেলের বারোয়ারি ব্যবস্থায় দাদুর অসুবিধে হবে। কিন্তু তা হলেও এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না অনিমেষ। হঠাৎ তার খেয়াল হল দাদু কোথায় গিয়েছিলেন, কেন গিয়েছিলেন তা জিজ্ঞাসা করা হয়নি।

সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কিছু বলবে?’

নিচু গলায় অনিমেষ বলল, ‘আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?’

‘গয়া।’

‘গয়া? গয়াতে কেন?’

‘শ্রাদ্ধ করতে।’

‘কার শ্রাদ্ধ?’

‘আমার নিজের।’

স্তব্ধ হয়ে গেল অনিমেষ। সরিৎশেখরের মুণ্ডিত মস্তকে গুঁড়ি গুঁড়ি সাদা চুলের আভাস হঠাৎ তার চোখে কেমন অপ্রাকৃত বলে মনে হচ্ছিল। কোনও মানুষ জীবিত অবস্থায় নিজের শ্রাদ্ধ করে আসছে এটা কল্পনাতেও ছিল না তার। বিশেষ করে সেই লোক যিনি বৃদ্ধ বয়সেও ধর্মকর্ম মানেননি, দীক্ষাটিক্ষা নেননি। যা সত্যি মনে হয়েছে তাই করেছেন, আপোস করার জন্যে কোনও দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি। সে কোনওরকমে বলতে পারল, ‘আপনি এমন করলেন কেন?’

‘তোমার খারাপ লাগছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেন?’

‘আমি আপনাকে-!’ অনিমেষের কণ্ঠে আবেগের প্রাবল্য হল। সে কোনওরকমে বলতে পারল, ‘শ্রাদ্ধের পর মানুষের জাগতিক সুখ দুঃখ—।’

‘রাইট।’ সরিৎশেখর সোৎসাহে ঘাড় নাড়লেন, ‘ঠিক বলেছ। আমি এখন এক অর্থে মৃত। কিছুদিন থেকে ব্যাপারটা ভাবছিলাম। সারাজীবন ধরে আমি অনেক কিছু করেছি। একজন সাধারণ মানুষের যা যা করা উচিত সব। ইদানীং আমার কোনও আকাঙ্ক্ষা ছিল না। খেতে ভালবাসতাম খুব, আজকাল শরীর খাবার নিতে পারে না। তোমার পিসিমা চাল-ডাল গলিয়ে একটা পিন্ডির মতো করে দেয় তাই আধ ঘণ্টা ধরে গলায় ঢালি। গিলতেও কষ্ট হয়। যতদিন নিজের শক্তি ছিল ততদিন কারও পরোয়া করিনি। কিন্তু অথর্ব হওয়ামাত্র অন্যের করুণা প্রত্যাশা করা ছাড়া আর কিছুই অসম্ভব। অর্থ কষ্ট বড় কষ্ট অনিমেষ। আমার মতো মানুষ যতদিন বাঁচবে ততদিন সেটা অভিশাপের মতো মনে হবে। তোমার বাবা আমাকে টাকা দেয়। দু’-তিন দিন দেরি হলে মনে হয় সে আমাকে অবহেলা করছে। এই মনে হওয়াটা থেকে আমাকে কে উদ্ধার করবে! যেহেতু সংসারে আছি তাই অথর্ব হলেও লোভ মোহ ক্রোধ থেকে আমার মুক্তি নেই। এগুলো যত থাকবে তত আমি জর্জরিত হব। ক’দিন আগে তোমার জেঠামশাই সস্ত্রীক আমার কাছে চলে এল। অত্যন্ত জীর্ণ দশা তার। খেতে পায় না। এসে এমন ভাব দেখাল যেন আমার সেবা না-করলে তার ইহকাল নষ্ট হয়ে যাবে। যে ছেলেকে এককালে আমি ত্যাজ্যপুত্র করেছিলাম, বারংবার যার ছায়া আমি এড়িয়ে চলেছি তাকেই আমি মেনে নিলাম। আমি বুঝতে পারছি আমাকে সেবা করার নাম করে সে আমারই অন্ন ধ্বংস করতে চায়। আমি মরে গেলে ঘরবাড়ির দখল নিতে চায়, তবু আগেকার সেই শক্ত ভাবটা কোথায় চলে গেল আমার। আমাকে সে তেল মালিশ করে দেয়, হাতে ধরে কালীবাড়ি নিয়ে যায়, এই বৃদ্ধ বয়সে আর একা থাকতে হয় না আমাকে, এটাই আমার কাছে এত বড় যে আমি তার অতীতের সব অন্যায় ভুলে যেতে পারলাম। তোমার বাবার সেটা পছন্দ হল না। এককালে যে আমাকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, আমার সম্মান পাঁচজনের কাছে লুটিয়ে দিয়েছিল, আবার তাকে আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি সেটা সে মানতে পারছিল না। অনিমেষ, নিজে উপলব্ধি করলাম, যখন রক্তের জোর চলে যায় তখন মানুষ খুব লোভী হয়ে পড়ে। নিজেকে আমি এককালে যতটা কঠোর ভাবতাম এখন আবিষ্কার করলাম আমি আদপেই তা নই। শুধু জেদের বশে অন্যরকম চলার চেষ্টা করেছি মাত্র। এইসময় তোমার পিসিমা বলল, সে নাকি শুনেছে— ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে আমি চলে গেলেই বাড়িটা পেয়ে যাবে। কবে যাব তাই চিন্তা। মুহূর্তেই আমি অন্যরকম হয়ে গেলাম। সেইদিনই ওদের আবার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। যাওয়ার সময় আমার মুখের ওপর অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে গেল ওরা। পরে মনে হল এরকমটা কেন আমি করলাম? ওই বাড়িটাকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালবাসি বলেই কি ওটা নিয়ে কোনও লোভ সহ্য করতে পারলাম না? তা হলে ভালবাসাটা তো একটা লোভেরই অন্য পিঠ। হঠাৎ মনে হল পৃথিবীতে যে-ক’টা দিন একটা মানুষের বেঁচে থাকা দরকার তার থেকে অনেক বেশি দিন আমি বেঁচে আছি। দীর্ঘজীবন বড় অভিশাপের!’ এক নাগাড়ে কথা বলে হাঁপিয়ে পড়েছিলেন সরিৎশেখর। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বললেন, ‘পিছুটান মুছে ফেলব ঠিক করলাম। এক রাত্রে কাউকে কিছু না-বলে চলে গেলাম গয়া। আমার মৃত্যুর পর লোকে ঘটা করে শ্রাদ্ধ করবে আর লোকজন ডেকে খাওয়াবে এটা সহ্য হবে না। নিজের পাট নিজেই চুকিয়ে দিয়ে এলাম। এখন নিজেকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। যেন আকাশ থেকে মাটির দিকে তাকিয়ে সবকিছু দেখার মতো মজা লাগছে। তোমার বন্ধুরা আমাকে দক্ষিণেশ্বর-কালীঘাট দেখার কথা বলেছিল। ওসব জায়গায় যাবে যারা আমি তো তাদের দলে নই। আমার তো সব প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন যে ক’দিন থাকব চোখ চেয়ে দেখব আর কান খুলে শুনব। কিন্তু এই দেখা বা শোনা আমার মনে কোনও রেখাপাত করবে না। মানুষ বেঁচে থাকে আশা নিয়ে। আমি সেই ইচ্ছেটুকু গয়ায় রেখে এসেছি। জলপাইগুড়িতে ফিরে যাচ্ছি কারণ আমাকে এখনও কিছুদিন এই শরীরটাকে টানতে হবে। তোমার পিসিমা সেই বালবিধবা হবার পর থেকে আমার ঘাড়ে আছে। সে আমাকে বোঝে।’

অনিমেষ মানুষটার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল। এখন সরিৎশেখরের ভঙ্গিতে, কণ্ঠস্বরে কেমন অন্যরকম চেহারা প্রকাশ পাচ্ছে। সে কিছুক্ষণ সময় নিল নিজেকে সংযত করতে। সরিৎশেখর ঊর্ধ্বমুখে বসে আছেন এখন। কিছুক্ষণ ঘরে কোনও শব্দ নেই। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি রাত্রে কী খাবেন?’

‘কিছু না। সন্দেশটা খেয়ে পেট ভার হয়েছে। তুমি বরং এক গ্লাস জল দাও।’

সরিৎশেখর উঠলেন। এখন থেকে পদক্ষেপ অনেকটা স্বাভাবিক। অনিমেষ দেখল উনি ছাদের কোনায় একা একা হেঁটে গেলেন। টেবিলে জল রেখে অনিমেষ দ্রুত বিছানাটা ঠিক করে দিল। ইচ্ছে করলে সে আজ রাতে অন্য কোনও ঘরে শুতে পারে। কিন্তু দাদুকে একা রেখে দিতে মন চাইছে না। সে একটা চাদর বিছিয়ে মেঝেতে শুয়ে থাকবে বলে ঠিক করল।

রাতের খাওয়া নীচে সেরে এল অনিমেষ। এসে দেখল সরিৎশেখর চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। ঘুমুচ্ছেন ভেবে নিঃশব্দে সে মেঝেতে বিছানা করছিল নিজের, সরিৎশেখর বললেন, ‘কোনও ঘরে খাট খালি নেই?’

‘কেন?’

‘মেঝেতে শুলে অসুস্থ হতে পারো। যদি খাট খালি থাকে সেখানে শোও।’

‘না, আমার কোনও অসুবিধা হবে না।’

‘তুমি কি ভাবছ একা থাকলে রাত্তিরে আমি মরে যেতে পারি?’

‘একথা কেন বলছেন।’

‘তুমি তো শুনলে আমার জন্যে ভাবনা করা নিষ্ফল। অবশ্য তোমার অসুবিধা হবে তেমন হলে। কিন্তু যে ছেলে পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে তার এমন মন থাকা উচিত নয়।’

আচমকা ইলেকট্রিক শক খাওয়া অনুভূতি হল অনিমেষের। ও মুখ তুলতে পারছিল না। দাদু একথা এতক্ষণ পরে কেন বললেন? পুলিশের সঙ্গে লড়াই তো সে কখনও করেনি। করতে যাওয়ার মতো কোনও পরিস্থিতিও হয়নি। অবশ্য ক’দিন আগে ইউনিভার্সিটির সামনে যে ঘটনা ঘটেছিল সেটায় সে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল। কিন্তু তাকে কি পুলিশের সঙ্গে লড়াই বলা যায়? কিন্তু প্রশ্ন হল দাদু সে-কথা জানলেনই বা কী করে? কলকাতায় সে এসেছে পড়াশুনা করতে। সে যে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে, বামপন্থী রাজনীতিতে সে বিশ্বস্ত এবং ইউনিয়নের জন্য অনেকখানি সময় ব্যয় করে— এসব ব্যাপার তো সরিৎশেখরের জানার কথা নয়। পরীক্ষায় ফেল করেনি মানে বাবার পাঠানো টাকার অপব্যয় হয়নি। ছুটিতে সে যখন জলপাইগুড়িতে গিয়েছে তখন চুপচাপ বাড়িতে বসে থেকেছে। তার আচরণ দেখে কারও বোঝার অবকাশ ছিল না যে সে কলকাতায় এসব ব্যাপার করছে। অনিমেষ বুঝতে পারছিল তার মুখের ওপর সরিৎশেখরের দুটো চোখ স্থির হয়ে আছে। অতএব তাকে এক্ষুনি একটা জবাব দিতে হবে। দাদুর কাছে মিথ্যে কথা বললে ছেলেবেলায় বুক কেঁপে যেত, কখনওই পারত না। সরিৎশেখরের মুখের দিকে না-তাকিয়ে অনিমেষ হাসবার চেষ্টা করল, ‘এ-খবর আবার কোথায় পেলেন! পুলিশের সঙ্গে আমি লড়াই করতে যাব কেন? আর সেরকম হলে আমাকে ওরা ছেড়ে দিত?’

‘তুমি কমিউনিস্ট পার্টিতে নাম লিখিয়েছ এ-কথা মিথ্যে?’

‘আপনি কোত্থেকে জানলেন?’

‘আগে বলো মিথ্যে কি না?’

‘কমিউনিস্ট পার্টিকে সমর্থন করি মানেই পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করছি?’

‘আজ করছ না, কাল করবে, পরশু করবে।’ সরিৎশেখর দৃঢ় গলায় বললেন, ‘তুমি এখন ছাত্র। তোমার কর্তব্য ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে তৈরি করা, যোগ্য করা। তা না-করে তুমি কমিউনিস্ট হয়েছ। দেশে বিপ্লব আনতে চাও? এরকম একটা নেশায় তোমাকে ধরবে আমি চিন্তাও করিনি। যেদিন তুমি জলপাইগুড়ি থেকে প্রথম এসেছিলে সেদিন আমি তোমায় বলেছিলাম, তুমি কৃতী হয়ে ফিরে এসো, আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব। কিন্তু তোমার স্কুলের এক মাস্টার যখন আমায় বলল যে তুমি ইউনিয়ন করছ, দিনরাত পার্টি নিয়ে মত্ত আছ, আমার আর অপেক্ষা করার কোনও প্রয়োজন থাকল না। বলতে পারো এটাও একটা জাগতিক আকাঙ্ক্ষা। তোমার জন্যে একটা স্বপ্ন দেখা সেটা ভেঙে গেলে কষ্ট হচ্ছিল খুব। তা গয়া থেকে ঘুরে এসে আমার সেই কষ্টটা আর নেই। এখন তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আর আমার মাথা ঘামানোর প্রয়োজন দেখি না।’

‘আপনি বোধহয় একটু অতিরঞ্জিত সংবাদ পেয়েছেন। তা ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ করলেই যে একটা ছেলের ভবিষ্যতের বারোটা বেজে গেল— এ ধারণা এখন অচল।’ অনিমেষ সরিৎশেখরের শেষ কথাটার কোনও গুরুত্ব দিতে চাইল না। ও চাইছিল দাদুকে কমিউনিজমের আলোচনার মধ্যে নিয়ে আসে যাতে ওঁর বদ্ধ ধারণা কিছুটা পালটে দিতে পারে।

কিন্তু সরিৎশেখর সেদিকে গেলেনই না। অনিমেষের কথা শুনে চুপচাপ শুয়ে থাকলেন।

রাত বেশি হলে ট্রামের শব্দ আরও বিকট হয়ে ওঠে। আলোচনাটা উঠেও থেমে গেল বলে অনিমেষ অস্বস্তি বোধ করছিল। আগে দাদুর কাছে খোলাখুলি মনের কথা বলতে পারত সে। আজকাল সেই ইচ্ছেটা আছে কিন্তু সরলতাটুকু কখন হারিয়ে গেছে। তাই যুক্তি দিয়ে তর্ক করে বোঝাতে হয়।

একসময় সরিৎশেখর বললেন, ‘তুমি কি এখন পড়াশুনা করবে?’

অনিমেষ বলল, ‘আজকে ভাল লাগছে না দাদু।’

‘তা হলে আলোটা নিবিয়ে দাও।’ সরিৎশেখর পাশ ফিরে শুলেন।

সকালে সরিৎশেখর অন্য মানুষ। একদিনের বিশ্রামের পর শরীর একটু স্থির হওয়ায় আবার আগের ফর্ম ফিরে পেয়েছেন। জ্বর আসেনি আর। সেই ভোররাতে যখন সবাই ঘুমুচ্ছে তখন অনিমেষকে ডেকে তুলেছেন। ঘুম-চোখে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এই সময়ে উঠছেন কেন? অন্ধকার আছে বাইরে।’

‘দেরি নেই ভোর হবার; প্রাকৃতিক কাজকর্মগুলো সেরে নিই। আশা করি এখন লাইন পড়েনি।’

সরিৎশেখরের কথা শুনে হেসে ফেলল অনিমেষ। দাদুর মাথায় ওই একটাই চিন্তা পাক খাচ্ছে।

তখন ঠাকুর-চাকরও ওঠেনি। নির্বিঘ্নে নীচের কাজ সেরে ওপরে উঠে এসে সরিৎশেখর বললেন, ‘তোমাদের বাথরুম পায়খানায় কি চব্বিশ ঘণ্টা আলো জ্বলে? ওরকম স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে সবসময়?’

অনিমেষ বলল, ‘পুরনো বাড়ি তো, তাই আলো ঢোকে না।’

‘তুমি কলকাতার জন্য উপযুক্ত হয়েছ।’

কথাটা হয়তো সরিৎশেখর অন্যমনস্ক গলায় বললেন, কিন্তু অনিমেষের মনে হল এর চেয়ে সত্যি আর কিছু নেই। কলকাতায় বাস করতে গেলে কতগুলো যোগ্যতার খুব দরকার। বিবেক ভদ্রতা স্নেহ অথবা সৌজন্যের চিরাচরিত সংজ্ঞাগুলো এখানে প্রয়োজন মতো অদলবদল করে নেওয়া হয়। যে মানুষ এসব বোঝে না তাকে প্রতি পদক্ষেপে ঠোকর খেতে হয়। অনিমেষ এই কয় বছর কলকাতা বাসের পর এসবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বোঝাপড়া করে ফেলেছে।

এখন আকাশে প্রচুর তারা। চারধার এত বেশি চুপচাপ যে মনে হয় এটা কলকাতা নয়। ঘুমের মধ্যে শেষ ট্রাম চলে গেছে আর প্রথম ট্রাম চলার এখনও সময় হয়নি। অদ্ভুত করুণ এবং বিষণ্ণ লাগছিল আকাশ। সারারাত জ্বলার পর এইসময় রাস্তার আলোগুলো এমন হলদে হয়ে যায় কেন? ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল অনিমেষ এমন সময় সরিৎশেখর লাঠি হাতে ঘর থেকে বের হলেন। যে ময়লা পোশাকগুলো গতকাল খুলে রেখেছিলেন ঘরে ঢুকে আজ সেগুলো পরনে।

অনিমেষ এগিয়ে এল, ‘এখন কোথায় যাচ্ছেন?’

‘একটু বেড়িয়ে আসি। কেন, তুমি মর্নিং ওয়াক করো না?’

ঠোঁট কামড়াল অনিমেষ। জলপাইগুড়ির সেই দিনগুলো! বছরের পর বছর এই মানুষটা প্রত্যেক ভোরে তাকে নিয়ে হেঁটেছেন তিস্তার পাশ দিয়ে। ওটা তো অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কথা। কথায় বলে বাল্যের অভ্যেস আমৃত্যু থাকে। কিন্তু কলকাতায় আসার পর ওটা কখনও মনেই আসেনি। এখন ভোরে বরং ঘুম গাঢ় হয়। কলকাতায় যে যত দেরিতে ওঠে সে তত প্রতিভাবান।

অনিমেষ বলল, ‘সে অভ্যেসটা চলে গেছে। কিন্তু এখানে মাঠ বা নদী খুব কাছাকাছি নেই, হাঁটবেন কোথায়?’

‘কেন? এতবড় রাস্তা আছে। গাড়িঘোড়া না-থাকলে ওখানে হাঁটতে তো কোনও অসুবিধা নেই। তোমাদের সদর দরজা খোলা আছে?’

অনিমেষ ভেবে পাচ্ছিল না গতকাল ওরকম ধুঁকতে ধুঁকতে আসা মানুষটি এরকম তাজা হয়ে যান কী করে। সে বলল, ‘না গেট বন্ধ। আপনি চলুন আমি দারোয়ানকে ডেকে তুলি।’

একটা শার্ট গলিয়ে নীচে নেমে দারোয়ানকে তুলতে একটু ঝামেলা করতে হল। এই কাকভোরে কেউ বাইরে যায় না।

ওরা বেরিয়ে গেলে দারোয়ান আবার দরজা বন্ধ করে দিল। সরিৎশেখর বললেন, ‘তুমি এলে কেন?’

শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে অনেক দিন বাদে অনিমেষের এইসময় ভাল লাগছিল। একবার ঘুম চলে গেলে এরকম কাকভোরকে খুব আপন মনে হয়। সে কোনও উত্তর না-দিয়ে সরিৎশেখরের সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে লাগল।

এখন পথ নির্জন। রাস্তার হলদেটে আলো ছাড়া আকাশে কোনও আয়োজন শুরু হয়নি। ফুটপাতে কিছু ঘুমন্ত মানুষ ছাড়া লোকজন দেখা যাচ্ছে না। সরিৎশেখর লাঠি ঠুকে হাঁটছেন। এখন ওঁর চলা অত্যন্ত মন্থর। এককালে যাঁর সঙ্গে সে হেঁটে তাল রাখতে পারত না এখন তাঁর সঙ্গে পা মেলাচ্ছে হাঁটি হাঁটি করে। সরিৎশেখরের যে কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে এটা বুঝতে পারল অনিমেষ। নেহাত জেদের বশেই হাঁটছেন তিনি। কী করবে বুঝতে পারছিল না সে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ছাড়িয়ে ডান হাতি একটা পার্কের সামনে দাঁড়াল ওরা। অনিমেষ বলল, ‘এখানে একটু বসবেন?’

সরিৎশেখর স্বীকার করলেন, ‘হ্যাঁ, বসলে একটু ভাল হত।’

পার্কে ঢুকে বিব্রত হল অনিমেষ। অনেকগুলো বেঞ্চি পার্কময় ছড়ানো কিন্তু তার একটাতেও বসার পাটাতন নেই। কেউ বা কারা সযত্নে পার্কটাকে নেড়া করে রেখে দিয়েছে। দাদুকে নিয়ে একটা বেঞ্চির কাছে গিয়ে এ-দৃশ্য দেখে অনিমেষ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছিল। এরজন্যে তার কোনও দায়িত্ব না-থাকলেও মনে হচ্ছিল কলকাতার মানুষ হিসাবে সে কতগুলো লজ্জার মুখোমুখি হচ্ছে।

সরিৎশেখর বললেন, ‘আর চেষ্টা কোরো না। এবারে বরং ফেরা যাক।’

খুব ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন সরিৎশেখর। এখন ওঁর ক্লান্তি অত্যন্ত পরিষ্কার। কোনও রকে বসলে হয়। কথাটা বলতে সাহস পাচ্ছে না অনিমেষ।

সরিৎশেখর বললেন, ‘এই ন্যাড়া মাঠটাকে তুমি পার্ক বললে? ফুল নেই গাছ নেই এমনকী মাটিতে ঘাস নেই, বসার জায়গার কথা ছেড়েই দিলাম। কোন সংজ্ঞায় একে পার্ক বলা যায়? তবু তোমরা বলছ। বলছ অভ্যাসে। আসল জিনিসটা কখন হারিয়ে গিয়ে তার জায়গায় নকল জুড়ে বসল কিন্তু তোমরা টের পেলে না। আশ্চর্য!’

অনিমেষ জবাব দিল না। ওর মনে হচ্ছিল দাদুর কথার কোনও প্রতিবাদ আর এই মুহূর্তে সে করবে না। তর্ক করে এই বৃদ্ধকে আঘাত দিয়ে কী হবে। একটা অনুভূতি ক্রমশ ওকে অধিকার করছিল— দাদুকে আর দেখতে পাবে না সে। ভবিষ্যতের কথা সে জানে না। হয়তো ভবিষ্যৎ তাকে অনেক কিছু দেবে। যেসব কল্পনা তার বুকে মুখ খোঁড়ে সেগুলো হয়তো সত্যিকারের চেহারা নেবে। কিন্তু যাঁর কাছ থেকে সে দু’হাত ভরে পেয়েছে সেই মানুষটি অতীত হয়ে যাবেন। এতদিন পরে যে সরিৎশেখরকে সে দেখেছে তাঁর সঙ্গে অতীতের সেই চেহারার কোনও মিল নেই। যে-মানুষ নিজের শ্রাদ্ধ করে এসেছেন তিনি যে-কোনও মুহূর্তেই চলে যেতে পারেন। অনিমেষের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।

হঠাৎ সরিৎশেখর কথা বললেন, ‘অনিমেষ, তোমার কুষ্ঠিতে আছে রাজদ্রোহের জন্য জেলবাস অনিবার্য। তুমি রাজনীতি করবেই। কিন্তু যাই করো নিজের কাছে পরিষ্কার হয়ে কোরো। আমি জানি না সকাল থেকে রাত্তিরে একবারও তোমার নিজেকে ভারতবাসী বলে মনে হয় কি না। চারধারে যা দেখি তাতে কেউ সে চিন্তা করে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষ নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। নেতারা রাজনীতিকে সম্বল করে ক্ষমতা দখল করছে। এই দেশে বাস করে কেউ দেশটার কথা চিন্তা করে না। একটা যুবক নিজেকে ভারতবাসী বলে ভাবে না বা তা নিয়ে গর্ব করে না। তা হলে কী জন্যে তুমি রাজনীতি করবে? কেন করবে? আমি ঠিক বুঝি না তোমাদের। কিন্তু মনে হয়, তোমরা নানান জিনিস দিয়ে প্রতিমা বানাও শুধু প্রতিমার জন্যে, ভক্তিটুকুই তোমাদের নেই।’

অনিমেষ নাড়া খেল। সেই সময় দূরে অন্ধকারের ফিকে আলোয় প্রথম ট্রাম চলার সাড়া পাওয়া গেল। একটা আলোর পিণ্ড থরথরিয়ে ছুটে আসছে ওর দিকে। কান-ফাটানো শব্দে ঘণ্টা বাজাচ্ছে ড্রাইভার। চকিতে দাদুর হাত ধরে ফুটপাতে উঠে এল অনিমেষ। যেন বুকের মধ্যে সপাং সপাং চাবুক মেরে শব্দের ঝড় তুলে ট্রামটা মিলিয়ে গেল ওদিকে।

সরিৎশেখর বললেন, ‘চলো। তোমার কলকাতা জাগল।’

অনিমেষ চুপচাপ নিজের অতীতকে নিয়ে হাঁটা শুরু করল। না, দাদুর কথা শুনবে না সে। নিজে স্টেশনে গিয়ে ভাল জায়গা দেখে ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে আসবে দাদুকে। কর্তব্য বা ঋণস্বীকার নয়, এ আর এক ধরনের দীক্ষা-যা বোঝানো যায় না, যে বোঝে সে বুঝে নেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *