1 of 2

১৮. সূর্য ঘন্টাখানেক ধরে রাস্তায়

সূর্য ঘন্টাখানেক ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল উদ্দেশ্যহীন ভাবে। যেন তার কোনও কাজ নেই, সে নগর দর্শনে বেরিয়েছে। কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, শিয়ালদা, আবার মানিকতলা ঘুরে সে মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের কাছে ব্ল্যাক স্কোয়ারের পাশে এসে দাঁড়াল রেলিংয়ে ভর দিয়ে।

তখন সকাল দশটা। এই সময় পথে বেশ ভিড় থাকে। ধুতির মধ্যে শার্ট গুঁজে, তার ওপর কালো কোট চাপিয়ে কেরানিবাবুরা হুড়োহুড়ি করে অফিস যায়। কারও পায়ে পাম্পশুর সঙ্গে মোজা হাঁটু পর্যন্ত। ফেরিওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালাদের খালি গা। সামনেই একটা দশকর্ম ভাণ্ডারের গুড়ের হাঁড়ির মুখে কয়েক হাজার মাছি।

সূর্য এক পয়সার কড়াইভাজা কিনে নিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিয়ে মুখ দিয়ে লুফে নিয়ে কটর মটর করে চিবোচ্ছে। প্রথমেশ বড়ুয়া মুক্তি’ ছবিতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মুড়ি খাওয়া দেখানোর ফলে সবাই তখন সেই অনুকরণে মুড়ি ভোলা খায়।

রাস্তা দিয়ে যত মানুষ যাচ্ছে, কারওর প্রতি কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই সূর্যর। শুধু সে মাঝে মাঝে অভ্যেসবশত বাঁ হাতের কবজির দিকে তাকাল ঘড়ি দেখার জন্য, যদিও ঘড়ি নেই সেখানে। পার্কের অন্য দিকে বেশ ভিড় ও হইহল্লা চলছে, একজন পকেটমার ধরা পড়েছে সেখানে সূর্য সে-দিকে যাওয়ার জন্য কোনও উৎসাহ বোধ করল না।

খানিক বাদে একজন রোগা মতন লোক, গায়ে চাদর জড়ানো, সূর্যকে জিজ্ঞেস করল, রাজবল্লভ পাড়াটা কোন দিকে বলতে পারেন?

সূর্য আন্দাজে হাত তুলে বলল, সে অনেক দূরে–ওই দিকে!

এক্ষুনি না গেলে চলবে না। কী করে যে যাই!

আপনার কি সেখানে আর্জেন্ট বিজনেস আছে?

আমার মেজদা মরণাপন্ন!

চলুন আপনার সঙ্গে আমি যাচ্ছি।

সূর্য ও সেই লোকটি পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। আর্জেন্ট বিজনেস ও মেজদা মরণাপন্ন–এগুলো কোড। কিছু দূর যাবার পর সেন্ট্রাল এভিনিউতে এসে রোগা লোকটি বলল, তুমি এখান থেকে সোজা খিদিরপুর চলে যাও। সেখানে বাজারের পাশে সিরাজুল তারিখ-এর ডেকরেটার্সের দোকান আছে। ওখানে গিয়ে তারিখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করে বলবে, মেজদার অসুখ সেরে গেছে। তা হলেই তিনি তোমাকে চিনতে পারবেন। তখন উনি যা করতে বলবেন, সে রকম করবে।

সূর্য বলল, খিদিরপুরে কী ভাবে যেতে হয়, আমি তো জানি না।

রোগা লোকটি এতক্ষণ পরে ভালো করে সূর্যর দিকে তাকাল। তারপর বলল, তুমি কি ব্ল্যাক স্কোয়ার আগে চিনতে?

সূর্য বলল, না।

সেই রকম, খিদিরপুর কোথায়, সেটাও তোমাকে খুঁজে নিতে হবে।

আজকেই যাওয়া দরকার?

হ্যাঁ, ধর্মতলায় চলে যাও, ওখান থেকে খিদিরপুরের ট্রাম ধরবে। এই ধরো, এখান থেকে এক ঘণ্টা পরে পৌঁছেলেই চলবে।

অকস্মাৎ কথা বলা শেষ করে লোকটি বাঁ দিকে হাঁটতে আরম্ভ করল। সূর্য হাঁটতে শুরু করল তার বিপরীত দিকে। এটাই নিয়ম। আর একবারও পিছনে না তাকিয়ে সূর্য হেঁটে গেল অনেক দূর পর্যন্ত। তারপর একটা ট্যাক্সি ধরল।

খিদিরপুরে একটা মাংসের দোকানের পাশে সিরাজুল তারিখ অ্যান্ড সন্সের ডেকরেটার্সের দোকান। একটা ঠেলাগাড়ি থেকে তেরপল আর চেয়ার নামানো হচ্ছে। দ্বিধা না করে দোকানের ভেতরে ঢুকে গেল সূর্য। একজন ফরসা টুকটুকে চেহারার লোক একমনে খাতায় হিসেব লিখছিলেন, সূর্য তাকে জিজ্ঞেস করল, তারিখ সাহেব আছেন?

লোকটি মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করলেন, হুঁ, কী খবর?

সূর্য ফের জিজ্ঞেস করল, তারিখ সাহেব আছেন কি?

লোকটি হিসেব শেষ করে ধীরে-সুস্থে খাতা বন্ধ করলেন। তারপর সূর্যর চেহারার দিকে চোখ রেখে বললেন, ওনার সঙ্গে আপনার কিছু দরকার আছে কি? কী খবর?

সূর্য বলতে যাচ্ছিল যে তারিখ সাহেবের সঙ্গেই আমি কথা বলতে চাই, কিন্তু সেই সময় সে একাধিকবার ‘কী খবর’ এই প্রশ্নের মানে বুঝতে পারল। এই লোকটিই তারিখ সাহেব। তখন সে তাড়াতাড়ি বলল, মেজদার অসুখ সেরে গেছে!

ফরসা লোকটি উল্লসিত মুখে বললেন, সেরে গেছে? বাঃ!, তা হলে আর চিন্তা কী! আসুন, ভেতরে আসুন!

দোকানের পিছন দিকে পরদা টাঙানো, সেটা সরালে আর একটা ছোট ঘর। দিনের বেলাতেও সেখানে অন্ধকার। আলো জ্বেলে দিয়ে লোকটি বললেন, এই গরিবেরই নাম সিরাজুল। আপ তসরিফ রাখিয়ে, আরামসে বৈঠিয়ে। আরও আধ ঘণ্টা দেরি আছে। আমি একটু বাদেই আপনার জন্য এসে যাচ্ছি।

সেই ছোট ঘরে চুপচাপ বসে রইল সূর্য। ঘরখানায় কাপ, ডিস, কাঁচের গেলাস– এইসবে ঠাসা। চেয়ারগুলো ভেলভেটে মোড়া সিংহাসনের মতন, সেই রকম একটা চেয়ারে সূর্য বসে আছে। বসে বসে আকাশপাতাল ভাবতে লাগল। আধ ঘণ্টা দেরি আছে, এর মানে কী? ঘরে একটা কোনও কাগজপত্র নেই যে চোখ বুলোনো যায়।

তারিখ সাহেব একটু বাদে দু’কাপ চা নিয়ে ফিরে এলেন। ঘরে আরও দুটি সিংহাসন টাইপ চেয়ার থাকতেও তিনি টেবিলের তলা থেকে একটা টুল বার করে তাতে বসলেন। চায়ে চুমুক দিলেন বেশ আরাম করে। লোকটিকে দেখলেই মনে হয়, জীবনরসে বেশ মজে আছেন। মুখে কোনও রেখা নেই। যে কটা দিন বেঁচে আছি, হাসিখুশিতে থাকা যাক, এই রকম একটা ভাব।

সূর্য চা খায় না। কিন্তু তারিখ সাহেব তাকে জিজ্ঞেস না করেই চা নিয়ে এসেছেন– এ-ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান করা যায় না। সূর্য ভদ্রতা করে দু-একটা ছোট চুমুক দিল।

তারিখ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার উমর কত্ত হবে? সিক্সটিন? সেভেনটিন!

সিক্সটিন।

দেখুন, ঠিক ধরেছি। আমার একটা হোবি আছে কী জানেন, মানুষ দেখলেই আমি তাকে স্টাডি করি। বহুত জিনিস মিলে যায়। আচ্ছা, আপনার ফাদার কি রেল কোম্পানিতে নোকরি করেন?

সূর্য চুপ করে রইল। এই সমস্ত কন্ট্রাক্টে পরস্পরের কাছে পরিচয় দেওয়া নিষিদ্ধ, হরকুমার তাকে বার বার এই কথা বলে গেছেন। তারিখ সাহেবের আন্তরিক ব্যবহার সত্ত্বেও সে এই নিয়ম ভাঙতে পারে না। তারিখ সাহেবের প্রশ্নে সে অনায়াসেই ঘাড় নেড়ে দিলে ল্যাটা চুকে যেত–কিন্তু সূর্য তাও দিল না।

তারিখ সাহেব ওদিকে আর না গিয়ে অন্য প্রসঙ্গ তুললেন। বললেন, হরবাবুর ডেথ হয়ে গেল, এমন মানুষ আর মিলবে না! আপনি তার জন্য যা সেওয়া করেছেন–কোনও ছেলে তার বাপের জন্য এমন করে না!

সূর্যের মুখ ভাবলেশহীন। প্রশংসায় বিচলিত হবার ছেলে সে নয়। লাজুক, বিনীত ভাবও তার মুখে ফোটে না।

হরবাবুর মালপত্তর সব আপন হেপাজতে রেখেছেন তো?

হরদার তো মালপত্তর কিছু ছিল না।

ছিল না?

আমি কখনও দেখিনি কিছু। একটার বেশি দুটো জামা ছিল না, মাদুরে শুতেন।

একটা মাল ছিল।

একটুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর তারিখ সাহেব আবার বললেন, আপনি আমার ছোটা ভাইয়ের মতন। আপনি আমাকে জানেন না–আমি দাদালোকদের সঙ্গে বহুতদিন ধরে কাম করছি। পুলিশ আমায় ছুঁতে পারে না। এই বিজনেসটায় ওদের চোখে ধুলো দিই। আমার টাকাপয়সা সব আংরেজ হটাবার জন্য। আপনাকে আমি এল্ডার ব্রাদার হিসেবে অ্যাডভাইস করছি, আপনি বহুত ছেলেমানুষ, হরবাবুর মালটা আপনার কাছে রাখবেন না!

সূর্য উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই সময় যে ব্যক্তিটি ঢুকল, তাকে দেখে সূর্য অবাক হয়ে গেল আরও বেশি। এই সেই রোগা লোকটি যার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেই সূর্যর দেখা হয়েছিল পার্কের সামনে।

লোকটি একই জায়গায় আসবে, অথচ সূর্যকে সঙ্গে আনেনি। সূর্য এক ঘণ্টার অনেক আগেই এসে পৌঁছেছে।

তারিখ সাহেব খাতির করে বসালেন লোকটিকে? বললেন, শংকরবাবু, চা খাবেন?

শংকরবাবু হাতের ইঙ্গিতে বললেন, না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, জিনিস পেয়েছেন?

হ্যাঁ, কিছু কিছু। দেখি! এক্ষুনি দেখবেন? আমার বেশি সময় নেই।

তারিখ সাহেব কাপ-ডিস-ভরতি র‍্যাকটা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিলেন। উলটো দিকে আর একটা র‍্যাক। সেখান থেকে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স এনে বললেন, এই নিন। তিন ডজন।

শংকরবাবু বাক্সটা খুলে একনজর দেখেই আবার বন্ধ করে দিলেন। বললেন, আর কিছু পেলেন না?

না। বহুত টিকটিকির হুজ্জোত!

কত দাম?

সে আপনাকে ভাবতে হবে না।

না, না, আপনি নিজে কত টাকা খরচ করবেন? আমার কাছে কিছু টাকা আছে—

এখন থাক।

শংকরবাবু এবার ফিরলেন সূর্যের দিকে। এতক্ষণ ওর সঙ্গে একটাও কথা বলেননি। এবার জিজ্ঞেস করলেন, হরদা’র জিনিসটা তোমার সঙ্গে এখন আছে?

সূর্য বললে, না।

কাল এই রকম সময় ওটা এই দোকানে পৌঁছে দিয়ে যেয়ো!

হরদা ওটা আমার কাছেই রাখতে বলেছেন।

তখন রাখার দরকার ছিল, আর নেই। এখন ওটা আমাদের দরকার।

হরদা ওটা তো আমার কাছছাড়া করতে বলেননি।

ও জিনিসটা হরদার নিজের নয়। আমাদের দলের। আমাদের দলের প্রয়োজনে লাগবে।

হরদা আমার ওপর ভর দিয়ে গেছেন ওটা কাজে লাগাতে।

শংকরবাবু এবার খানিকটা বিরক্ত হয়ে তাকালেন সূর্যর দিকে। কড়া গলায় বললেন, হরদা তোমাকে আমার নির্দেশ মেনে চলতে বলেছেন কি না?

দলের নির্দেশ মানতে বলেছেন।

আমিই দলের হয়ে কথা বলছি। আমরা ওই জিনিসটা ফেরত চাই।

কিন্তু হরদা আমাকে একটা বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। অন্য কারওর কথা শুনে আমি তা অগ্রাহ্য করতে পারব না!

তুমি ওটা দেবে না?

না!

সূর্যর দিকে একনজর তাকালেই বোঝা যায়, এ ছেলে কারওর কথায় নতি স্বীকার করবে না। ভয়ডরের চিহ্নমাত্র এর মুখে নেই। এক হিসেবে সূর্যকে খানিকটা নির্বোধও বলা যায়, কারণ পরিস্থিতি অনুযায়ী কৌশল অবলম্বন করার মনোবৃত্তিও তার নেই। গোয়ারের মতন বিপদের ঝুঁকি নেওয়াই তার শখ।

চলে আসার জন্য সূর্য চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াতেই অপর দু’জন বললেন, বসো, বসো! ব্যস্ত হচ্ছ কেন?

সূর্য বসল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

তারিখ সাহেব ও শংকরবাবু আরও কিছুক্ষণ ধরে নানা ভাবে সূর্যর কাছ থেকে হরকুমারের পিস্তলটা আদায় করার চেষ্টা করলেন। সূর্যকে একটুও বাঁকানো গেল না।

শংকরবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, শিগগিরই একটা বড় অ্যাকশন শুরু হবে–আমাদের এখন অস্ত্র বিশেষ দরকার!

কার্ডবোর্ডের বাক্সটা খুলে সূর্যকে দেখিয়ে বললেন, এই দেখো, তারিখ সাহেব আমাদের টোটা যোগাড় করে দিয়েছেন। শুধু শুধু জিনিসটা তোমার কাছে আটকে রাখছ। ঠিক আছে, তোমাকেই একটা অ্যাকশানে পাঠাব–তুমি পারবে?

তারিখ সাহেব বললেন, শংকরবাবু, এ তো একদম লেড়কা, একে ছেড়ে দিন! আর একটু বড় হোক।

ও নিজেই তো কারওর কথা শুনতে চাইছে না!

তা হোক, তবু আপনি দুসরা কারোকে পাঠান।

শংকরবাবু স্থির নয়নে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, ওকে শেষ বারের মতন বলছি, ও যদি কাল দুপুরের মধ্যে জিনিসটা এখানে দিয়ে যায়–ওকে এবারের মতন ছেড়ে দিতে পারি। কী দেবে?

না!

তা হলে তুমি যেতে রাজি?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে, তোমাকে চন্দননগরে যেতে হবে। সেখানে আমাদের বাড়ি ঠিক করা আছে, আপাতত কয়েক দিন সেখানে লুকিয়ে থাকবে। যথাসময়ে আমাদের নির্দেশ। পাবে।

কবে যেতে হবে?

কাল! কিংবা ধরো পরশু?

কালই যাব।

শংকরবাবু তারিখ সাহেবের দিকে ফিরে বললেন, তারিখ সাহেব, এক গেলাস পানি খাব।

ইঙ্গিত বুঝে তারিখ সাহেব বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। শংকরবাবু তখন বললেন, কাল ঠিক দেড়টার সময় হাওড়া স্টেশনে ঘড়ির নীচে দাঁড়িয়ে থাকবে। সেখান থেকেই একজন তোক তোমাকে নিয়ে যাবে চন্দননগরে। কালকে তোমার কোড হবে জিনিস আর দাম। ওদিকে কোড হবে মুলো আর বাঁধাকপি। চন্দননগরে কেউ তোমার নাম জিজ্ঞেস করলে, তুমি বলবে, তোমার নাম অমর! অমর পালিত কিংবা লাহিড়ী। তুমি বেকার, তোমার মাসিমার বাড়িতে বেড়াতে গেছ। ফরাসি চন্দননগর ছাড়া ইংরেজ চন্দননগরে কখনও পা দেবে না! ঠিক আছে?

সূর্যর একবার মনে হল তার বাবার নাম অমর, সুতরাং এই ছদ্মনাম তার পক্ষে নেওয়া ভালো দেখায় না। কিন্তু সে কথা প্রকাশ করল না। নামে কী আসে যায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *