সুদীপ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছিল। পুরো রাস্তাটা আনন্দ ওদের বোঝাতে বোঝাতে এসেছে। ওরা কেউ কথা বলেনি। জয়িতা এবং কল্যাণ খুব গম্ভীর মুখে শুনছিল, কিন্তু সুদীপের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল সে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে। আনন্দ সেটা লক্ষ্য করলেও কিছু বলেনি। তার ধারণা ছিল যে শিস দিচ্ছে কিংবা রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে, মানে এই নয় যে কিছুই তার কানে যাচ্ছে না। জয়িতা শেষ পর্যন্ত পারল না, সে আনন্দকে ইশারায় থামতে বলে রাগত গলায় বলল, সুদীপ, ইউ মাস্ট বি সিরিয়াস!
সুদীপ শিস থামিয়ে বলল, তাই? তারপর আবার শিস দিতে শুরু করল।
জয়িতা কাঁধ ঝাঁকাল, সব কিছুর একটা লিমিট আছে!
কি করব বল, আমার বেশ খিদে পেয়েছে! সুদীপ বাঁদিকে আচমকা গাড়িটা পার্ক করল, আনন্দ, আমরা মিনিট পনেরো পরে স্পটে পৌঁছালে খুব অসুবিধে হবে? এবার আনন্দ হতাশ হল। ওরা রাত্রের খাওয়া সেরেছে ঘণ্টা দেড়েক আগে। এখন প্রায় সওয়া এগারোটা। রাস্তাঘাট ফাঁকা। দোকানপাট বন্ধ হলেও সুদীপ যেখানে গাড়ি থামিয়েছে সেখানে একটা পাঞ্জাবী হোটেল তখনও চালু।
কল্যাণ বলল, আমরা তো একটু আগে খেলাম, তোর আজ এখনই খিদে পেয়ে গেল?
খিদে লাগলেই শুধু খেতে ইচ্ছে করে একথা তোকে কে বলল? অনেক সময় মনের শান্তির জন্যেও ললাকে খায়! ওই দোকানে দারুণ কাবাব করে। অনেকদিন ভেবেছি কিন্তু খাওয়া হয়নি। আজ যদি কিছু হয়ে যায়, হয়তো এক জীবনের জন্যে বড় দেরি হয়ে যাবে। সুতরাং ইচ্ছেটা পূর্ণ করে নিতে আপত্তি কি? অবশ্য আনন্দ যদি অ্যালাউ করে!
আনন্দ সুদীপের দিকে তাকাল। তারপর হেসে ফেলল, তোর কি মনে হচ্ছে এটাই অগস্ত্যযাত্রা?
হুঁ নোজ। তারপর সুর করে গাইল, এ খাওয়াই শেষ খাওয়া হয় তো।
আনন্দ বলল, ঠিক আছে, চটপট খেয়ে আয়।
সুদীপ কথা না বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করল, তোরা খাবি না? আহা, কি জিনিস হারাচ্ছিস জানলি না। ও দোকানের দিকে পা বাড়াল।
জয়িতা নিঃশ্বাস ফেলল, কোনদিন যে জিনিস জিতে দেয়নি তার হয়ে বিজ্ঞাপন করছে। কেউ কোন কথা বলল না।
কল্যাণ পেছনের সিটে শরীর এলিয়ে বসেছিল। বাড়ির সঙ্গে তার আজ সম্পর্ক চুকল। কিছু জামাপ্যান্ট, একটা বই এবং টুকিটাকি কিছু জিনিস নিয়ে সে চলে এসেছে নিঃশব্দে। একবার মনে হয়েছিল বাড়ির সবাইকে ডেকে বলে যে সে চলে যাচ্ছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে মায়ের সঙ্গে বড় বউদির ঝগড়া লাগল। এটা একটু অভিনব ব্যাপার। কেননা মা এতকাল বড় বউদির ক্যাম্পেই ছিলেন। মেজদা ফিরে আসার পর এমন কি ঘটনা ঘটল, কিংবা তারকেশ্বর থেকে এসে মায়ের কোন কারণে মানসিকতা পান্টাল তা সে বুঝতে পারেনি। কিন্তু চিৎকারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, আর আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেবার ইচ্ছেটা রইল না। কল্যাণের একটা ধারণা জন্মেছে যে যাদের হাতে পয়সা থাকে না তারাই অকারণে ঝগড়া করে নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে চায়।
এই সময় জয়িতা বলল, গাড়িটাকে এভাবে সেন্ট্রাল অ্যাভির ওপরে দাঁড় করিয়ে রাখা অন্যায় হচ্ছে। পুলিশ যে কোন সময় নাম্বারপ্লেট দেখে ফেলতে পারে।
আনন্দ বলল, এখনও তার সময় হয়নি। লাইটহাউসের সামনে ড্রাইভারটা গাড়ির খোঁজ করে না পেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করবে। তার মালিক সিনেমা দেখে বের হবে পৌনে বারোটা নাগাদ। ড্রাইভারের কাছে খবর পেয়ে থানায় যাবে লোকটা। থানার অফিসার যদি সেই সময় চেয়ারে থাকেন তাহলে তিনি ডায়েরি নেবেন। নিয়ে লালবাজারে রিপোর্ট করবেন। লালবাজার সেই খবর ওয়ারলেসকে যখন জানাবে তখন খুব কমপক্ষে সাড়ে বারোটা বেজে যাবে। কাল সকাল হলেও অবাক হব না।
জয়িতার পছন্দ হল না ব্যাখ্যাটা। বলল, আমরা অকারণে ঝুঁকি নিচ্ছি। এই গাড়িটাকে চেনে এমন কেউ আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। সুদীপকে তাড়া দে।
আনন্দ তাকাল পাঞ্জাবীর দোকানটার দিকে। সুদীপ ভেতরে ঢুকে গেছে। ও হয় সত্যিকারের সহজ কিংবা এই মুহূর্তে অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়েছে। এখন ওকে বাধা দিয়ে কোন লাভ হবে না। ওকে ওর মত ভাবেই স্বাভাবিক হতে দেওয়া উচিত। রাতটা কলকাতায় ধীরেসুস্থে গড়াতে গড়াতে যেন আচমকা ছুটতে থাকে। রাস্তার আলোর রঙ যেন পালটে যায়। শান্ত হয়ে যায় শহরটা কয়েক ঘণ্টার জন্যে। আনন্দ দরজা খোলার শব্দ শুনল। কল্যাণ নামতে যাচ্ছিল, জয়িতা বাধা দিল, কোথায় যাচ্ছিস?
সিগারেট স্টক করে রাখি। যদি ওখান থেকে সরাসরি ঠাকুরপুকুরে যেতে হয় তাহলে অসুবিধে হবে।
কল্যাণ জবাব দিল। তার গাড়িতে বসে থাকতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। যখন চলছিল তখন একরকম ছিল কিন্তু সুদীপ পার্ক করার পর থেকেই অস্বস্তিটা হচ্ছিল। ডায়মন্ডহারবার রোডে সেই কেসটা করার সময় তার এই রকম অনুভূতি হয়নি।
জয়িতা বলল, ঠাকুরপুকুরটা কোন গভীর জঙ্গল নয় যে সিগারেট পাওয়া যাবে না। সবাই মিলে নামাওঠা করলে ঝামেলা বাড়বে। কে কখন দেখে ফেলবে তারই জের চলবে। সেদিন আগাথা ক্রিস্টির একটা লেখায় পড়ছিলাম, সবরকম সতর্কতা নিয়েও শুধু সিগারেটের টুকরো এলোমেলো ফেলার জন্যে অপরাধী ধরা পড়ল। সুদীপটাকে ডাকলি না আনন্দ?
কল্যাণ দরজাটা বন্ধ করল। আনন্দ বলল, ওকে ওর মত থাকতে দে। তোকে হঠাৎ নার্ভাস লাগছে!
নার্ভাস? আমি-হাসল জয়িতা। হাসলে ওকে হঠাৎ খুব সুন্দর দেখায়। পাশে বসে কল্যাণের মনে হল।
আজ সারাদিন সীতা রায় বাড়ি থেকে বের হননি। টেলিফোন রিসিভ করেননি। বলা যায় ঘর থেকেই দুবার মাত্র বেরিয়েছিলেন। অত্যন্ত স্বেচ্ছায় বন্দী হয়ে আছেন তিনি। যে দুবার বেরিয়েছিলেন তার একবার রবীন সেনের জন্যে। সেই বিশালবপু মানুষটি এসেছিলেন কোন একটি দরকারি কথা বলতে। কিন্তু সীতা রায়, যার পরনের শাড়িটাকে মনে হচ্ছিল সালোয়ার-পাঞ্জাবি, খোলাচুলে একটু রুখু রুখু ভাব নিয়ে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন, বড় মাথার যন্ত্রণায় ভুগছি আজ, কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছে না। আর একদিন বসা যাবে, কেমন? বলার সময় মাথাটা একপাশে হেলিয়ে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু ওই একটু আর কেমন শব্দ দুটো এমন আদুরে গলায় উচ্চারণ করেছিলেন যে সঙ্গে সঙ্গে রবীন সেন পুলকিত হয়ে ঠিক আছে, ঠিক আছে বলে চলে গিয়েছিল। সীতা রায় যে এইভাবে ভেবেচিন্তে কথা বলেন না তা নয়, কিন্তু এটা তার অভ্যেসে এসে গিয়েছে। দ্বিতীয়বার বেরিয়েছিলেন রামানন্দ রায়ের ডাকে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ থাকায় রামানন্দ নক করেছিলেন। খানিকবাদে একটা হাউসকোট শরীরে রেখে দরজায় এসে দাঁড়িয়ে কোন কথা না বলে চোখের কাজে প্রশ্ন ছুঁড়েছিলেন তিনি। রামানন্দ ব্যর্থ হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সীতা, কি হয়েছে তোমার?
আমার? আমার আবার কি হবে? নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন সীতা রায়, আমাকে একটু একা থাকতে দাও তোমরা, নিজেকে কি ভীষণ প্রতারিত মনে হচ্ছে আমার!
রামানন্দ বিস্ময়ে বলে উঠেছিলেন, কি বলছ? আমি তোমাকে প্রতারণা করেছি?
মাথা দুলিয়ে হেসেছিলেন সীতা রায়, তুমি করলে তো বেঁচে যেতাম। জানতাম তবু কিছু করলে। বলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন নিঃশব্দে। টেলিফোনের পাশের চেয়ারটায় বসে চুপচাপ ঘটনাটা দেখেছিল জয়িতা। হঠাৎ তার মনে হয়েছিল এই মা যেন অন্যরকম। কিন্তু রামানন্দ রায়ের জন্যে কষ্ট হচ্ছিল তার।
বন্ধ দরজার সামনে চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পাশ ফিরতে মেয়েকে দেখলেন তিনি। তারপর ওই ধরা পড়ে যাওয়া ভাবটা কাটাবার জন্যে নার্ভাস-হাসি হেসে স্মার্ট হবার চেষ্টা করলেন, এভরিথিং অলরাইট?
ঠিক সেই মুহূর্তে মন পাল্টাল জয়িতা। এই মানুষটিকে দ্বিতীয় দুশ্চিন্তায় আজ ফেলার দরকার নেই। সে ঠিক করেছিল রামানন্দ রায়ের অনুরোধমত সব কথা খুলে বলে যাবে। এবং আজই সেই বলার দিন। কিন্তু এখন সে মাথা নেড়ে বলল, সব ঠিক আছে। আমি হয়তো আজ রাত্রে ফিরব না।
ফিরবে না?
হ্যাঁ। একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে বন্ধুদের সঙ্গে। যদি আটকে যাই, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
রামানন্দ রায় এক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ঝুঁকি নিয়ে ফেরার কোন দরকার নেই। তবে যদি সুবিধে হয় তাহলে লেট-নাইট হলেও ফিরে এস। আমি অপেক্ষা করব।
এখন এই গভীর রাত্রে সেন্ট্রাল অ্যাভিতে বসে জয়িতার চেপে রাখা অস্বস্তিটা মাথা তুলছিল। হঠাৎ ওই ঘটনার পর থেকে বাবা একদম পালটে গেছেন। আজকাল আর সীতা রায় রোজ সন্ধ্যেবেলায় ক্লাবে যান না, প্রায় মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরেন না। দুজন আলাদা বৃত্তে বাস করছেন। সীতা রায় যদিও একটা ব্যবধান রেখেছেন এখনও, কিন্তু রামানন্দ সেটাকে সরিয়ে দিয়েছেন। জয়িতার মনে পড়ল একটা লাইন, একমাত্র পাতি মধ্যবিত্তরাই পারে বারংবার নিজেদের খোলস পালটাতে।
এই সময় সুদীপ ফিরে এল সিগারেট খেতে খেতে। গাড়িতে উঠে বলল, বুঝলি জয়, এমন কিছু নয়। এর চেয়ে ভাল কাবাব অনেক খেয়েছি। দিল্লির আজমল খাঁ মার্কেটের পাশে একটা দোকানে যা করে না! এর শুধু ফালতু নামডাক।
কেউ কোন কথা বলল না। সুদীপ স্টার্ট দিয়ে আবার বলল, গাড়িটা কিন্তু খুব যত্নে ছিল। খুব স্মথ যাচ্ছে। তারপর ইন্ডিকেটারের দিকে তাকিয়ে বলল, পেট্রল নিতে হবে।
নিয়ে নে। আনন্দ এতক্ষণে জানাল।
মেডিকেল কলেজের উল্টোদিকের একটা পাম্প তখন বন্ধ হতে চলেছে। সুদীপ ম্যানেজ করে পুরো ট্যাঙ্ক ভরে নিল। ওরা কেউ কোন কথা বলছিল না। হ্যারিসন রোডে ঢুকে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। সত্যনারায়ণ পার্কের পাশে এখনও কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ফুটপাত পরিষ্কার। কিছু শ্রমিক পরিশ্রান্ত হয়ে ভিখিরীদের পাশে ঘুমিয়ে আছে ফুটপাতে। দোকানপাট বন্ধ। কল্যাণ দেখল সেই মিষ্টির দোকানটারও ঝাঁপ পড়েছে।
আনন্দ সুদীপকে ইশারা করতেই ওরা গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। পাশাপাশি অন্য গাড়িগুলোকে চাবি দিয়ে মালিকরা রাতের মত রেখে গেছে। সেখানেই গাড়িটা ঢুকিয়ে দেওয়ায় নজরে পড়বে না কারও। আনন্দকে দাঁড়াতে বলে সুদীপ ময়লা ডাস্টার বের করে গাড়ির পেছনদিকে বেঁধে দিল, তাড়াহুড়োয় গাড়িটাকেই বোধহয় খুঁজে পাব না। অন্যের গাড়ি চেনা খুব মুশকিল। সত্যি, জায়গাটায় তেমন আলো নেই বলে নাম্বার প্লেটটাকে অস্পষ্ট দেখাচ্ছিল।
খালি হাতে ওরা সেই গলিটার মধ্যে ঢুকল। কল্যাণ আর জয়িতা বসে থাকল গাড়িতে। সেই পানের দোকানটা এখনও খোলা। আনন্দ দেখল সেই একই লোক বসে আছে দোকানে। তার সামনে দাঁড়িয়ে একটা স্বাস্থ্যবান তোক দেশের গল্প করছে। সুদীপ চাপা গলায় বলল, কে বলবে এটা ইউ পি কিংবা রাজস্থান নয়! ওরা আর একটু এগিয়ে কারখানার সামনে এসে দাঁড়াল। সেই দারোয়ানটা নেই, তার জায়গায় আর একজন বসে আছে। গেটটা আধা ভেজানো। উলটোদিকের একটা বাড়ির রকে ওরা বসল।
আনন্দ নিচু গলায় বলল, আমার সন্দেহ ছিল মোহনলাল সাবধান হয়ে যাবে। আজ সকালে ও নিশ্চয়ই গন্ধ পেয়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ও ব্যাপারটাকে আমল দেয়নি।
সুদীপ বলল, যে লোকটা তোদের ফলো করে গিয়েছিল সে নিশ্চয়ই রিপোর্ট করেছে, আর যাই হোক তোরা পুলিশের লোক নস। পুলিশ হলে মিষ্টি খেতে গিয়ে দাম বেশি বলে বেরিয়ে আসে না। ট্যাকসিওয়ালা রিফুজ করলে কনস্টেবলকে সাহায্য করতে বলে না।
আনন্দ বলল, ঠিক বলেছিস। ভেতরে আলো জ্বলছে। কারখানায় কাজ হচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে। পেছনের দিকের দরজাটা ওই গলি দিয়ে গেলে পাওয়া যাবে, যাবি ওদিকে?
সুদীপ মাথা নাড়ল। বলল, আর একটু অপেক্ষা কর।
মিনিট পাঁচেক বাদে আর একটা গাড়িকে গলির মধ্যে ঢুকতে দেখা গেল। হেডলাইটের আলো এসে সরাসরি ওদের গায়ে পড়ছে দেখে আনন্দরা সরে বসল। একটা ঝকঝকে নতুন মারুতি ভ্যান। কারখানার গেটে সেটা পৌঁছনোমাত্র দারোয়ানটা উঠে সেলাম করল। মোহনলালকে নামতে দেখে ইশারা করল আনন্দ সুদীপকে। মোহনলাল দায়োয়ানকে কিছু বলতেই সে দরজা খুলে ভেতরে ছুটল। মোহনলাল ঘড়ি দেখলেন। একটু অসহিষ্ণু দেখাচ্ছিল তাকে। ড্রাইভারকে বললেন, গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে এসো। তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
কয়েক সেকেন্ড বাদেই একটি মধ্যবয়সী লোক হন্তদন্ত হয়ে দারোয়ানের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল, নমস্কার।
মোহনলাল বললেন, বনবিহারীবাবু, লাস্ট গাড়ি চলে গেছে?
হ্যাঁ স্যার। সাত নম্বর একটু আগেই বেরিয়ে গেছে। লোকটি যুক্তকর মুক্ত করছিল না।
কেমিস্ট সব কিছু চেক করেছেন? মোহনলালকে একটু নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছিল।
হা স্যার। এভরিথিং নর্মাল। শুধু আমাদের প্রোডাকশনগুলো চালু আছে।
সেগুলো থাকবে। এ মাসে আপনার একশ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দেব। শুনুন, কাল ভোরে এই কারখানায় রেইড হবে। সার্চ করা হবে। আপনারা অফিসারদের বলে আমাকে ফোন করবেন। কাউকে কোন বাধা দেবেন না। বুঝতে পারছেন? মোহনলাল হাসলেন।
মধ্যবয়স্ক লোকটি খুব ঘাবড়ে গেল, এ কি বলছেন স্যার?
যা বলছি তা জেনেই বলছি। আমি ব্যবস্থা করেছি। নিউজপেপারে বের হবে শত্রুপক্ষ মিথ্যে করে আমার নামে বদনাম রটিয়েছে। কিছুদিন থেকেই ভাবছিলাম এই রকম কিছু একটা করা দরকার। আজ চণ্ডীগড়ের ছোকরাটা আসায় বুদ্ধিটা খুলে গেল।
চণ্ডীগড়ের ছোকরা? সেটা কি ব্যাপার স্যার? লোকটির হতভম্ব ভাব কাটছিল না।
সব কথা তোমার না জানলেও চলবে। বি নর্মাল, গার্ডদের বলে দাও কোন এক্সট্রা এফর্ট নিতে হবে। আর হ্যাঁ, হোলসেলারদের দুটো কুলির আজ অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। বাঁচবে বলে মনে হয় না। এই রকম আকসিডেন্ট যাতে তোমার না হয় তাই যতটা সম্ভব মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করো। যাও, যা কাজ করছ তাই করো।
মোহনলাল কথা শেষ করে আবার গাড়িতে উঠে বসলেন। উনি চোখের আড়ালে চলে না যাওয়া পর্যন্ত লোকটি দাঁড়িয়ে রইল। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছল। দারোয়ানটা দাঁড়িয়েছিল সামনে, লোকটা এবার তার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল, আজ কজন ডিউটিতে আছে? চার্জে কে আজ?
দারোয়ান বলল, সুন্দরলাল সাব। ওকে ডেকে দেব?
না। ঠিক আছে, আমিই যাচ্ছি। আমি বেশি কথা বলি, মাঝে মাঝে মাথা খারাপ হয়ে যায়। শেষ কথাগুলো যেন নিজের সঙ্গেই বলা। দ্রুতপায়ে লোকটা নিজের কাজে ফিরে যেতেই দারোয়ানটা আরাম করে বসল।
আর একটু অপেক্ষা করে আনন্দ সুদীপকে নিয়ে ফিরে এল সত্যনারায়ণ পার্কের কাছে। সুদীপ বলল, কি কেস বল্ তো?
খুব বুদ্ধিমান মানুষ। নিজেই সার্চের ব্যবস্থা করেছেন সমস্ত মাল সরিয়ে। কাল যখন জানা যাবে হঠাৎ সার্চ করেও ওঁর কারখানায় কোন জাল মাল পাওয়া যায়নি তখন আরও সম্মান বাড়বে। এক বছরের মধ্যে কোন সরকারী হামলার সম্ভাবনা থাকবে না। আনন্দ কথাগুলো বলে দূরে দাঁড়ানো গাড়িটার দিকে তাকাল।
সুদীপ একটু অবিশ্বাসী গলায় বলল, যদি বুদ্ধিমান হয় তাহলে কর্মচারীদের ওপর কারখানা পরিষ্কারের দায়িত্ব দিত না। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব যাচাই করে ওই সিদ্ধান্তে যেত।
আনন্দ বলল, সেটা আগেই করে যায়নি তাই বা কে জানে! হয়তো অতিরিক্ত বলল লোকটাকে যাতে সে ভয় পায়, কখনও মুখ না খোল। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। দুপুরে যারা ডিউটিতে ছিল তারা এখনও আছে নাকি?
সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তুই কি এখনও অ্যাকশনের কথা ভাবছিস নাকি? জাল ওষুধ যখন ওখানে নেই তখন–।
তবুও অ্যাকশন করব। মোহনলালকে সাধু সাজতে দেব না আমি। যদি এখনই ফ্যাক্টরি অ্যাটাক করে সব শেষ করে দেওয়া যায় তাহলে প্রমাণ হবে না যে মোহনলাল কি ধরনের ব্যবসা করত। ভোরে সরকারী সার্চ পার্টি এসে ফিরে যাবে। এবং মোহনলাল হয়তো কয়েক মাসের মধ্যে আবার দুনম্বর ব্যবসাটা শুরু করতে সাহস পাবে না। তার চেয়ে বড় কথা পাবলিককে ব্যাপারটা জানানো দরকার। আয়।
ওরা গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই কল্যাণ বেরিয়ে এল। আনন্দ জয়িতাকে ডাকল, তুই আমার সঙ্গে চ। সুদীপ আর কল্যাণ থাকবে সেকেন্ড স্টেজে। আমাদের কপাল খুব ভাল। চণ্ডীগড়ের ছেলেটার অস্তিত্ব বনবিহারীবাবু জেনেছে কিন্তু কোন ডিটেলস জানে না। আমরা ভেতরে ঢুকে যাওয়ার মিনিট দুয়েক বাদে তোরা চার্জ করবি। শুধু গ্রেনেড আর পেট্রল বোমা। এই গরীব কর্মচারীদের মারার কোন ইচ্ছে নেই। কল্যাণ, তুই দেখেছিলি ফ্যাক্টরিটা কোন্দিকে? ওকে! যে যার মাল নিয়ে নে।
চামড়ার ব্যাগের স্ট্র্যাপটা কোমরে আটকে নিল আনন্দ। জয়িতার কাধে ঝোলানো ব্যাগের মধ্যে মালপত্র আছে। ব্যাগের স্ট্রাপটা কাঁধের সঙ্গে আটকে নিয়েছে সে যাতে দৌড়বার সময় না পড়ে যায়। দুজনে খুব শান্ত পায়ে হাঁটছিল। ওদের ঠিক পেছনেই সুদীপ আর কল্যাণ। সিগারেটের দোকানের সামনে এসে আনন্দ দেখল লোকটা এখন একা। সে কল্যাণকে বলল, এখান থেকে কিনে নে তোর সিগারেট। আমরা মোহনলালের সঙ্গে দেখা করে আসি।
ওরা দাঁড়িয়ে পড়তেই জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, আর একটা রিস্ক নিলি। ওই পানওয়ালাটাই হয়তো পরে কল্যাণদের আইডেন্টিফাই করবে।
আনন্দ মাথা নাড়ল, তার আগে মোহনলাল পুলিশকে আমার বর্ণনা দেবে।
ওরা গেটের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। দারোয়ানটা ওদের দিকে তাকাতে আনন্দ বলল, এই যে ভাই, চিনতে পারছেন?
লোকটা খানিকটা অবাক হয়ে মাথা নেড়ে না বলল। ভুল হয়ে গেছে এমন ভঙ্গি করে আনন্দ চটপট বলল, ওহে, তুমি না, সকালে যে ডিউটিতে ছিল সে আমাদের চেনে। মোহনলালজীর একবার ফেরার কথা ছিল, তিনি কি ফিরেছেন?
সোকাট এবার মাথা নেড়ে বলল, সাহেব একটু আগেই চলে গেছেন। আপনারা কে?
আমরা চণ্ডীগড় থেকে এসেছি। সাহেব চলে গেছেন, খুব মুশকিল হয়ে গেল। বনবিহারীবাবু আছে?
হ্যাঁ, উনি ভেতরে আছেন। কিছু দরকার আছে?
দরকার না থাকলে এত রাত্রে কেউ আসে? তুমি ওকে খবর দেবে?
আনন্দ যতটা সম্ভব জয়িতাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ, এবার সরে দাঁড়াতেই লোকটা ওকে দেখতে পেল। সে যেন ঠিক ঠাওর করতে পারছিল না যাকে দেখছে সে ছেলে না মেয়ে। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরে একটু হাসি ফুটল ঠোঁটে। তারপর দরাজ গলায় বলল, আপনারা যান না, বনবিহারীবাবু ভেতরে আছেন। ঢুকেই বা হাতে।
আনন্দ আর অপেক্ষা করল না। জয়িতাকে ইশারা করে ভেতরে ঢুকতে বলল। ভেতরে তীব্র আলো জ্বলছে। সকালের দেখা বারান্দাটা দিয়ে একটু এগোতেই ফ্যাক্টরির একটা অংশ চোখে পড়ল। এখন একটা তীব্র গন্ধ বের হচ্ছে কোন ওষুধের। বারান্দায় একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, বনবিহারীবাবু কোথায়? লোকটা ইঙ্গিতে যে ঘরটা দেখিয়ে দিল তার দরজায় দাঁড়িয়ে আনন্দ দেখল সাত-আটজন দারোয়ান গোহের লোককে কিছু বোঝাচ্ছেন বনবিহারীবাবু। তাদের দেখতে পেয়ে খানিকটা অবাক হয়ে কথা বন্ধ করতেই সে জিজ্ঞাসা করল, বনবিহারীবাবু কে?
আমি। কি চাই? এত রাত্রে ভেতরে কেন? গেটে কে আছে? অনন্ত? এদের ঢুকতে দিল কেন?
আমাদের মোহনলালজী পাঠিয়েছেন। অম্লানবদনে লোকটির মুখের ওপর কথাগুলো বলল সে।
মোহনলালজী! কই, উনি তো কিছু বলে যাননি আমাকে? কোত্থেকে আসছেন আপনারা? এবার যেন জয়িতাকে দেখতে পেল, সামান্য বিস্ময় ফুটে উঠল বনবিহারীর মুখে।
চণ্ডীগড় থেকে। উনি আপনাকে কিছু বলেননি?
এবার বনবিহারীর মুখের ভঙ্গি সহজ হল। সে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনাদের কথা হচ্ছিল বটে!
আমি এসে ওকে ওই বুদ্ধিটা দিলাম। সব তো ক্লিয়ার এখন? আনন্দ সহজ গলায় প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ। উনি সেটা জেনে গেছেন। বনবিহারীবাবু আবার জয়িতার দিকে তাকাল, ইনি?
পাঞ্জাবের যে ভদ্রলোক মোহনলালজীর সঙ্গে ব্যবসা করতে চান তার মেয়ে। সাত নম্বর মালটা পাঞ্জাবে পাঠাবেন ভেবেছিলেন মোহনলাল। ফার্স্ট স্যাপেল। তাড়াহুড়োয় এযাত্রায় হল না।
সাত নম্বরটা তো ব্রাবোর্ন রোডে স্টোর করতে পাঠানো হল।
ব্রাবোর্ন রোডে? প্রশ্নটা করেই আনন্দর মনে হল আর সময় বেশি নেই।
হ্যাঁ। ও, আপনারা জানেন না? এস পি অ্যান্ড কোম্পানির গুদামঘরটা সাহেবের।
আচ্ছা। বনবিহারীবাবু, আপনার গার্ডদের ঘরেই থাকতে বলুন। আর আপনি একটু বাইরে আসুন। খুব গোপনীয় কথা বলব। আনন্দ কথা বলতে বলতে চোখের ইশারা করল। বনবিহারীবাবু রহস্যের গন্ধ পেয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসামাত্র জয়িতা দরজা টেনে শেকল তুলে দিল। বনবিহারীবাবু প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই আনন্দ রিভলভারটা বের করল, আপনাকে আমি খুন করতে চাই না। প্রাণের মায়া থাকলে যা বলছি শুনবেন। আপনার ফ্যাক্টরিতে কতজন কাজ করছে এখন?
বেশি না। মাত্র আটজন নাইট ডিউটিতে আছে। থর থর করে কাঁপছিল মানুষটা। ওর কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল।
আনন্দ কড়া গলায় বলল, ওদের সবাইকে ওই লম্বা বারান্দাটায় এসে দাঁড়াতে বলুন।চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবেন না—আমি আপনার পেছনে আছি, অন্য কিছুর চেষ্টা করলে লাশ পড়ে যাবে।
বনবিহারীবাবু পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় বলল, আমি বুঝতে পারছি না এসব কি হচ্ছে?
কিছুই নয়। জাল ওষুধের কারখানা ধ্বংস করা হচ্ছে। এখানে জাল ওষুধ হয় না?
হয়। ওরা কারা? বনবিহারীবাবুর চোখের দৃষ্টিতে ততক্ষণে সুদীপ এবং কল্যাণ এসে গিয়েছে। ওরা দারোয়ানটার শরীর টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে ছেড়ে দিতেই সে মাটিতে শুয়ে পড়ল।
আনন্দ হুকুম দিল দরজায় দাঁড়িয়ে, এবার ওদের বাইরে আসতে বলুন জলদি!
রিভলভারটার খোঁচা খেয়ে বনবিহারীবাবু বিকট গলায় চিৎকার করে উঠল, আপনারা সবাই বেরিয়ে আসুন। জলদি জলদি। এখন সব কাজ বন্ধ রাখুন।
বিস্মিত মানুষগুলো একে একে বেরিয়ে আসতেই আনন্দ এক লাফে পেছনের বারান্দায় উঠে এসে চিৎকার করল, আপনাদের কোন ক্ষতি করতে চাই না আমরা, যদিও জাল ওষুধের কারখানায় আপনারা টাকার জন্যে কাজ করছেন। নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে যদি চান তাহলে ওপাশের ওই বারান্দায় উঠে যান। কেউ বীরত্ব দেখাতে চাইলে বা পালাবার চেষ্টা করলে মারা পড়বেন।
কথা শেষ হওয়ামাত্র হুড়োহুড়ি পড়ে গেল বারান্দায় যাওয়ার জন্যে। বনবিহারীও তাদের সঙ্গী হল। সঙ্গে সঙ্গে সুদীপ আর কল্যাণ ছুটে গেল ভেতরে। বিশাল হলঘরে আধুনিক যন্ত্রপাতিতে ওষুধ তৈরির ব্যবস্থা। সেই ঘর পেরিয়ে প্যাকিং-এর ব্যবস্থা। সবকিছুই নিখুঁত।
চারটে শক্তিশালী গ্রেনেড চার্জ করা মাত্র মনে হল সমস্ত বড়বাজার কাঁপছে। আর্টটা পেট্রল বোমায় সমস্ত কারখানাটা দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। ওরা যখন দৌড়ে রাস্তায় নামল তখন চারদিকে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। দলে দলে মানুষ ছুটে আসছে। তীব্রগতিতে ওরা যখন গাড়ির কাছে ছুটে এসেছে তখনই আনন্দ আবিষ্কার করল কল্যাণ নেই। সুদীপ ততক্ষণে গাড়ির মধ্যে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট করে সেটাকে বের করে এনেছে রাস্তায়। এক পলকেই সিদ্ধান্ত নিল জয়িতা, চিৎকার করে দাঁড়াতে বলে সে ছুটে গেল আবার গলিটার দিকে। জোরে ছুটতে গিয়ে পায়ের তলায় কিছু পড়ায় হোঁচট খেয়ে পড়েছিল কল্যাণ। সেই মুহূর্তেও তার খেয়াল ছিল ব্যাগটার কথা। এবং সেটাকে বাঁচাতে গিয়ে তার ডান হাতে প্রচণ্ড চোট লাগে। যারা ওদের দেখতে পেয়ে ধাওয়া করে আসছিল তারা কল্যাণকে দেখতে পেয়ে হই হই করে ধরে ফেলেছে। কল্যাণ উঠে দাঁড়িয়ে ছাড়াতে চাইছে নিজেকে কিন্তু তিনজন শক্ত হাতের মানুষের কাছে তাকে হার মানতেই হচ্ছে। জয়িতা দেখল কল্যাণকে বাঁচাবার কোন উপায় নেই। সে আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। গ্রেনেডটা প্রচণ্ড জোরে ফাটল সত্যনারায়ণ পার্কের ফুটপাতে। অনেকটা জায়গা গর্ত হয়ে উড়ে গেল। এবং সেই শব্দে কল্যাণের আক্রমণকারীদের এমন ভীত করল যে তারা ঊধ্বশ্বাসে ছুটে পাশের বাড়ির দিকে চলে গেল। জয়িতা চিৎকার করল, কল্যাণ চলে আয়!
কল্যাণ নিজে এতটা হতভম্ব হয়ে পড়েছিল যে জয়িতার চিৎকার না শোনা পর্যন্ত পাথরের মত দাঁড়িয়েছিল। এবার খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটে প্রায় চলন্ত গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। ঝড়ের মত গাড়িটাকে হ্যারিসন রোডে বের করে আনতেই একটা পুলিশ ভ্যান দেখতে পেল সুদীপ। ভ্যানটা ধীরগতিতে সেন্ট্রাল অ্যাভির দিক দিয়ে আসছিল। চেষ্টা করেও গতি কমাতে পারল না, শেষ মুহূর্তে মনে হল যত তাড়াতাড়ি ওটাকে পেরিয়ে যাওয়া যায় তত মঙ্গল। ভ্যানের সামনে বসা সার্জেন্ট খানিকটা অবাক হয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া গাড়িটাকে দেখতে দেখতে মন্তব্য করল, কি ব্যাপার? হসপিটাল কেস নাকি? আর তখনই হইচই করা লোকগুলো ছুটতে ছুটতে হ্যারিসন রোডে এসে দাঁড়াল। ভ্যানটা সেখানে পৌঁছানোমাত্র সার্জেন্টের কানে যেসব অভিযোগ বর্ষিত হল তাতে ভদ্রলোকের কিছু সময় লাগল আসল কথাটা উদ্ধার করতে। তিনি অয়্যার্লেসে লালবাজারে খবর পাঠালেন, সিরিয়াস ডাকাতি হয়ে গেছে বড়বাজারে। গাড়ির নাম্বার তিনটে পাওয়া গেছে। তিনটে নম্বর এবং কোন্ দিকে গিয়েছে জানাতে-না–জানাতেই দমকলের ঘণ্টা শোনা গেল।
সুদীপরা সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুতে পড়ামাত্র দমকলের ঘণ্টা শুনতে পেয়েছিল। আনন্দ বলল, আস্তে চালা। যতটা সম্ভব নর্মাল। সোজা কলেজ স্ট্রীট ধরবি। কল্যাণ কেমন আছিস?
পেছনের সিটে হেলান দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কল্যাণ বসেছিল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তার হাত ছিঁড়ে পড়ছিল। সেই অবস্থায় সে কোনরকমে উচ্চারণ করল, ঠিক আছে।
সুদীপ এখন অনেকটা স্বাভাবিক, পড়লি কি করে?
কলার খোসা ছিল। দেখতে পাইনি। তারপর এমন জোরে চেপে ধরল।
এইজন্যে বলে যেখানে সেখানে কলার খোসা ফেলতে নেই। মোস্ট অনাগরিক ব্যাপার।
কল্যাণ শুধু দাঁতে দাঁত চেপে বলতে পারল, শালা!
জয়িতার শরীর এতক্ষণ ঝিনঝিন করছিল। কল্যাণকে লোকগুলো জাপটে ধরেছে এই দৃশ্যটা ও দেখার পর থেকে ও ঠিক কি কি করেছে তা এখন মনে করে বলতে পারবে না। সুদীপ ঠাট্টা শুরু করতে ও স্বাভাবিক হয়ে এল, যন্ত্রণায় কাতর কল্যাণকে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় কষ্ট হচ্ছে?
হাতে। কল্যাণ চোখ বন্ধ করতেই নিজের শরীর থেকে জল বেরিয়ে গালে পড়ছে টের পেল, মনে হচ্ছে পড়ার পর হাতটা ভেঙেছে। ব্যাগ সামলাতে গিয়ে হাত ভাঙল বোধ হয়।
ওপাশ থেকে সুদীপ মন্তব্য করল, নইলে শরীরটাই উড়ে যেত এতক্ষণে।
জয়িতা এবার চেঁচিয়ে উঠল, ওঃ সুদীপ! ইউ মাস্ট নট টক লাইক দিস-রসিকতার সময় নয় এটা।
ওকে খুকী। আমি সিক্ হয়ে যাচ্ছি এখন থেকে। সুদীপ চটপট মুখ বন্ধ করল।
আনন্দ লক্ষ্য করছিল কেউ তাদের পেছনে আসছে কিনা। ভ্যানটা যখন দেখেছে তখন এতক্ষণে কলকাতার রাস্তায় যে সমস্ত টহলদারী ভ্যান রয়েছে তারা এই গাড়ির নাম্বার পেয়ে গেছে। অবশ্য অন্য ধান্দা ফেলে যদি সক্রিয় হয় তাহলে তারা ওদের খুঁজে বের করবেই। কিন্তু কল্যাণটাকে নিয়েই চিন্তা হচ্ছে। সুদীপের গাড়ি ততক্ষণে ওয়েলিংটন স্কোয়ার ছাড়িয়ে পার্ক স্ট্রিটের দিকে এগোচ্ছে। এখন ঘড়িতে একটা। সুদীপ বলল, সিরিয়াস কথা বলছি, আমাদের গন্তব্য কোথায়?
আনন্দ বলল, আমি ভেবেছিলাম ঠাকুরপুকুরে যাব। কিন্তু এই গাড়ি নিয়ে অত দূর যাওয়া ঠিক নয়।
সুদীপ জানতে চাইল, তাহলে এই মুহূর্তে তোর মাথায় কিছু ঢুকছে না, তাই তো?
আনন্দ উত্তর দেবার আগে সুদীপ গাড়িটা থামাল। ইলিয়ট রোড আর ওয়েলসলি স্ট্রিটের মোড়ে একটি মেয়ে এই রাত্রে দাঁড়িয়েছিল সাজুগুজু করে। সুদীপ লক্ষ্য করেছিল বেশকিছু আগে চলতে চলতে একটা অ্যাম্বাসাডার আচমকা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ড্রাইভার মুখ বের করে মেয়েটিকে দেখছে। মেয়েটি সেটা লক্ষ্য করে এমন ভাবভঙ্গি করছে যা শুধু হিন্দী সিনেমায় দেখা যায়। উৎসাহ পেয়ে মেয়েটির কাছে নেমে এল। এবার ঘটনাটা ওরা দেখতে পাচ্ছিল। জয়িতা চাপা গলায় বলল, কি হচ্ছে সুদীপ! আমাদের হাতে একদম সময় নেই, এইসব নোংরা ব্যাপার দেখার রুচিটা বন্ধ কর।
সুদীপ বলল, তোরা তৈরি থাক, আমি ডাকামাত্র বেরিয়ে আসবি। আনন্দ, গাড়ির স্টিয়ারিং থেকে আমার হাতের ছাপ মুছে ফেল। গ্লাভস পরে আসতে ভুলে গেছি। কথা শেষ করে সে শিস দিতে দিতে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেল।
মেয়েটা এবার সুদীপকে দেখতে পেয়ে আরও পুলকিত হল। লোকটি তখন দ্রুত মেয়েটিকে গাড়িতে ওঠার জন্যে অনুরোধ করছে। সুদীপ শুনতে পেল মেয়েটি উদাস গলায় বলল, আই নিড ওয়ান হান্ড্রেড। দ্যাটস অল।
লোকটি বিভ্রান্ত হল, একি কথা, একটু আগে বললে সত্তর আর ওকে দেখামাত্র তিরিশ বেড়ে গেল!
সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তিরিশ বাড়িয়ে দিলে কেন? উনি ঠিকই বলেছেন। যাও ভাগো এখান থেকে, নইলে–। সুদীপের মুখের ভঙ্গি দেখে মেয়েটি এমন ঘাবড়ে গেল যে সে কোনদিকে না তাকিয়ে পেছনের গলিতে ছুটে গেল। হেসে ফেলল সুদীপ, খুব বাঁচা বেঁচে গেছেন! আজকে আপনি মারা পড়তেন, ওই রকম মেয়ের সঙ্গে এত রাত্রে কথা বলে! কোথায় যাবেন?
গল্ফ গ্রীন। জবাব দিয়েই লোকটি গাড়ির দিকে এগোতে লাগল। চটপট পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সুদীপ বলল, আরে চললেন কোথায়! উপকার করলাম, একটা ধন্যবাদ জানাবেন না?
পেছনে বা পাশে মুখ না ফিরিয়ে লোকটি বলল, ধন্যবাদ!
সুদীপ চটপট গাড়ির সামনে পৌঁছে রিভলবারটা বের করল, গাড়ির চাবিটা কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাকাশে হয়ে গেল লোকটার মুখ, মানে—মানে আমার কাছে মাত্র একশ টাকা আছে তাই দিয়ে দিচ্ছি ভাই। আমাকে প্রাণে মারবেন না।
গাড়ির চাবিটা! হাত বাড়াল সুদীপ। চাবিটা পেতে দেরি হল না। দরজা সন্তর্পণে খুলে সে বলল, এবার উঠুন। আমি জোর করা পছন্দ করি না।
শান্ত ছেলের মত ড্রাইভারের পাশের সিটে লোকটিকে তুলে সে পাশে বসে বলল, একদম সামনে তাকাবেন। মুখ ঘোরালেই গুলি খাবেন।
লোকটি মাথা নাড়ল, ঠিক আছে, ঠিক আছে।
পেছনের দরজায় শব্দ হল। ওরা তিনজন একে একে উঠে বসলে সুদীপ বলল, শার্টটা খুলুন!
অ্যাঁ? লোকটি মুখ ফেরাতে গিয়েও সোজা হল।
বাংলা বুঝতে পারছেন না? সুদীপ গাড়ি চালু করল। লোকটি কোনমতে শার্ট খুলে সুদীপকে দিতেই সে সেটাকে পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, চোখ বেঁধে ফেল। আনন্দ চটপট পেছন থেকে লোকটির চোখ শক্ত করে বাঁধল।
সুদীপ বলল, বুঝতেই পারছেন, পেছনে আর একজন রয়েছে। এইবার চুপটি করে বসে থাকুন। আপনি এইভাবে রোজ মেয়ে ধরেন, তাই না?
না না। অন্ধ লোকটি মুখ ফেরাল, বিশ্বাস করুন এই প্রথম। কি যে হল, মেয়েটাকে দেখেই–আপনি তো বিবাহিত, ছেলেমেয়ে আছে, তাই না?
লোকটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সুদীপ বলল, এই মেয়েটিকে আমি চিনি। কাল সকালে ও যদি আপনার বাড়িতে গিয়ে গল্পটা করে তাহলে কেমন লাগবে? তার চেয়ে আসুন একটা রফায় আসি। আপনাকে আমি অনোয়ার শা রোডে নামিয়ে দিচ্ছি। কাল খুব ভোরে বেরিয়ে প্রিয়া সিনেমার পাশে এসে গাড়িটাকে নিয়ে যাবেন। পুলিশের ঝামেলা করলে কিন্তু মেয়েটা এসে যাবে। তখন আর একশতে হবে না, বুঝতে পারছেন?
গাড়িটা গাড়িটা নিয়ে কি হবে? লোকটার গলায় আর স্বর ফুটছিল না।
আমার এক বন্ধু বিয়ে করতে যাবে তার গাড়ি দরকার। আপনার কোন ভয় নেই। আর কথা বলল সে। গড়িয়াহাট-গোলপার্ক হয়ে সোজা চলে এল আনোয়ার শা রোডে। এখানেও একটা পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে দেখে সে আনোয়ার শা রোডে ঢুকল। তারপর বেশ কিছুটা এগিয়ে গাড়িটা থামিয়ে বলল, নেমে যান। চটপট।
লোকটি এবার ইতস্তত করছে দেখে চেঁচিয়ে উঠল সে। আর অমনি লোকটি নেমে দাঁড়াতেই সে স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে লেক গার্ডেন্সে ঢুকে পড়ল।
জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, এই নাটকটার কি দরকার ছিল? লোকটাকে স্বচ্ছন্দে ওখানেই রেখে আসা যেত, সময় বাঁচত।
সুদীপ সিগারেট ধরাল, এইজন্যে তোর নাম সুদীপ হয়নি। ওখানে লোকটাকে নামালে ফেলে রাখা গাড়িটাকে দেখতে পেত। পুলিশ বুঝতেই পারত আমরা গাড়ি বদল করেছি। আর এতক্ষণে সারা কলকাতায় খবর পৌঁছে যেত এই গাড়ি ধরবার জন্যে। মাথায় ঢুকেছে?
আনন্দ বলল, আমি ভাবছি লোকটা কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, না আজই পুলিশকে জানাবে! দেখে তো মনে হল ভীতু সম্প্রদায়ের সদস্য!
সুদীপ বলল, জানাবে না। শালা এরা হল মধ্যবিত্ত বঙ্গসন্তান, আত্মীয়স্বজনের কাছে প্রেস্টিজ চলে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। কিল খেয়ে হজম করাই রক্তের অভ্যেস। এখন বল কোথায় যাব, ট্যাঙ্কে দশ লিটার তেল আছে—আশি থেকে নব্বই কিলোমিটার।
জয়িতা বলল, আমাকে একবার বাড়িতে যেতেই হবে। সমস্ত মালপত্র ওখানে পড়ে আছে। তাছাড়া কল্যাণকে ইমিডিয়েটলি একজন ডাক্তার দেখানো দরকার।
যন্ত্রণায় বোধ হয় এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছে কল্যাণ। একই ভঙ্গিতে বসে থাকায় সহ্যের মধ্যে এসে গিয়েছিল। সে একটুও না নড়ে বলল, আমি ঠিক আছি।
সুদীপ বলল, জয়, তুই কল্যাণকে নিয়ে যেতে পারবি? আমরা ঠাকুরপুকুরে চলে যাচ্ছি, ওখানে কল্যাণ গেলে ডাক্তার ডাকার অসুবিধে হবে। পারবি?
জয়িতা মাথা নাড়ল, ঠিক আছে। আজ বাবার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে। আর ওর কাছে লুকিয়ে রাখব না। তোরা আমাদের ওখানে একটু নামবি। গাড়ি আছে যখন তখন মালগুলো নিয়ে যা। একটা পুলিশ ভ্যান আসছে সুদীপ।
সুদীপ দেখল উলটোদিক থেকে একটা ভ্যান আসতে আসতে হঠাৎ থমকে গেল।
একজন সার্জেন্ট মুখ বের করে তাদের গাড়ির নাম্বারটা পড়ার চেষ্টা করছে।