১৮. সালমা বানু চোখ মেলে

সালমা বানু চোখ মেলে একজন অপরিচিত মানুষকে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। আজকাল প্রায়ই অপরিচিত লোকজন তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কথা বললে এরা কথার জবাব দেয় না। কিছু কিছু মানুষের চেহারা থাকে বিকৃত। এদের দেখলে ভয় ভয় লাগে। এরা বোধহয় মানুষ না–পৃথিবীতে মানুষের বেশ ধরে অনেকেই ঘুরে বেড়ায়। তাদেরই একজন। আয়াতুল কুরসি পড়ে ফু দিলে এরা চলে যায়। কিংবা হাততালি দিলেও কাজ হয়–হাততালির শব্দ যতদূর যাবে এরা তত দূরে সরে যাবে। এক সময় তাঁর আয়াতুল কুরসি মুখস্থ ছিল। রাত-বিরাতে ভয় পেতেন–সূরা পড়তেন, ভয় কাটতো। এখন স্মৃতিশক্তিও দুর্বল হয়ে গেছে। কিছুই মনে থাকে না।

কেমন আছ মা?

অপরিচিত লোকটা তাকে মা ডাকছে কেন?

কি ব্যাপার মা, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না।

সালমা বানু খুব লজ্জা পেলেন। আতাহার দাঁড়িয়ে আছে। কি সুন্দর ইস্ত্রি করা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেছে। গায়ে সেন্ট দিয়েছে না-কি? মিষ্টি গন্ধ আসছে।

মা, আজকাল নাকি তুমি কাউকে চিনতে পারছ না?

পারছি তো।

উহুঁ, চিনতে পারছি না। বল তো আমি কে?

তুই বটু।

আচ্ছা যাক, পাস মার্ক দেয়া গেল। চিনতে পেরেও এমন অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছিলে কেন?

সালমা বানু বললেন, বোস।

আতাহার বসতে বসতে বলল, চোখে কাজল দিয়েছ নাক? চোখগুলো সুন্দর লাগছে।

ভাত খেয়েছিস বটু?

না।

হাসপাতালের ভাত খাবি?

খাব। হাসপাতালে। আজ কি রান্না মা?

জানি না। ঐ যে ট্রেতে খাবার ঢাকা দেয়া আছে। আমার সামনে বসে বসে খা। আমি দেখি।

আতাহার বাথরুম থেকে হাত ধুয়ে খেতে বসে গেল। তার ভাল খিদে পেয়েছে। খিদের কারণেই হয়ত হাসপাতালের খাবার খেতে তেমন খারাপ লাগছে না। একটা ভাজ্বি। চড়ুই পাখির রানের সাইজের একটা মুরগীর রান, ডাল।

তোমাদের রান্না তো মা খারাপ না।

সালমা বানু আনন্দিত ভঙ্গিতে হাসলেন। অনেকদিন পর পরিবারের একজনকে তিনি তার সামনে খেতে দেখলেন।

বাসার খবরাখবর কি বল তো বটু?

খবরাখবর ভাল।

ঐ দিন তোর বাবা এসে এমন হৈ-চৈ শুরু করেছে, আমি লজ্জায় বাঁচি না।

আতাহার তীক্ষু দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। বিস্মিত গলায় বলল, বাবার কথা কি বললে মা?

কি বললাম?

বাবা এসে খুব হৈ-চৈ করেছেন। বাবা মারা গেছেন সেটা তো মা তুমি জান! জান না?

হুঁ জানি।

তোমার কি মনে থাকে না?

মনে থাকবে না কেন?

মা শোন, তোমার ভাবভঙ্গি ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে–আমি পাগল-টাগল হবার চেষ্টা করছি। ছেলেরা পাগল হলে মানায়, মেয়েরা পাগল হলে মানায় না।

তোর যে কি অদ্ভুত কথাবার্তা! পাগলের আবার মানামানি কি?

তোমার লজিক তো মা ঠিকই আছে। ভেরী গুড। মতির মা কোথায়?

জানি না।

তোমাকে একা ফেলে গেল কোথায়?

একা ফেলে যায়নি তো–তুই তো আছিস।

আমি তো আর সারারাত থাকব না। চলে যাব।

আরেকটু থাক।

মতির মা না আসা পর্যন্ত থাকব। চিন্তা করার কিছু নেই।

সংসার কিভাবে চলছে?

সংসার কিভাবে চলছে তা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না মা। সংসার খুব ভালমত চলছে।

তোর বাবা যেভাবে মুখ-টুখ কালো করে আমার খাটের পাশে বসে থাকে তা থেকে তো মনে হয় সংসার চলছে না।

আবার বাবাকে কোথেকে নিয়ে এলে?

সালমা বানু খুবই লজ্জা পেলেন। তাই তো, বার বার তিনি একই ভুল করছেন। এই জাতীয় ভুল করা ঠিক না। মৃত মানুষ কখনো ফিরে আসে না। স্বপ্নে দেখা দিতে পারে–কিন্তু বাস্তবে কখনো না।

 

হাসপাতাল থেকে বেরুতে বেরুতে রাত বারোটা বেজে গেল। আগে এত রাতে বাসায় ফেরার সময় ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যেত। বাবা বারান্দায় বসে থাকতেন। তিনি দরজা খুলে দিতেন। তারপর বড় ধরনের ভূমিকম্প হত। রেকটার স্কেলে যে ভূমিকম্পের মাপ হল সাত পয়েন্ট পাঁচ।

এখন দরজা খুলে দেয় মিলি। সে কিছুই বলে না। রশীদ সাহেবের মৃত্যুর পর তার মধ্যে কিছুটা জবুথব্রু ভােব চলে এসেছে। সংসারের কাজকর্মেও এলোমেলো ভােব চলে এসেছে। কয়েকদিন আগে মাছ, ডাল, আর ভাজ্বি রান্না করে সবাইকে খেতে ডেকেছে। প্লেট নিয়ে বসার পর মিলি লজ্জিত গলায় বলেছে–ভাত তো রান্না হয়নি। এরকম ভুল কেউ করে!

মিলির বিয়ের কথা হচ্ছে। এই মাসেই বিয়ে হয়ে যাবে। মনিকা দূর থেকে সব ব্যবস্থা করেছে। ছেলে আমেরিকায় থাকে–গীন কার্ড পেয়েছে। যার সঙ্গে বিয়ে হবে সেও আমেরিকা যেতে পারবে।

মনিকা লিখেছে–

মিলি,
বাবার মৃত্যুতে সংসার যে ভেঙে পড়েছে তা আমি দূর থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আতাহার, ফরহাদ দুটা অপদার্থ। কোনদিন সংসার দেখবে না। তোকে সে দেখেশুনে বিয়ে দেবে সেই আশায় গুড়েবালি। তোকে তোর নিজের পথ নিজেকেই দেখতে হবে।

আমি তোর জন্যে বর ঠিক করেছি। আহামরি কিছু না। আমাদের ভাগ্যে আহামরি কিছু জুটবে এটা মনে করাও ভুল। ছেলের একমাত্র যোগ্যতা সে আমেরিকায় বাস করে।

আমাকে ভাবী ডাকে এবং খুব মানে। ক্যাব চালায়। টেক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে বিয়ে এটা ভেবে মুখ বাকিয়ে বসবি না। বাংলাদেশের ট্যাক্সি ড্রাইভার আর আমেরিকার টেক্সি ড্রাইভার এক না।

ছেলের স্বভাব-চরিত্র ভাল। তবে তার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। আমেরিকান এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল। কনট্রাক্ট ম্যারেজ। বিয়ের পর গ্রীন কার্ড পেয়েছে। এখন ডিভোর্স নিয়ে যে যার পথ দেখেছে। আমি তোকে সবকিছু খোলাখুলি লিখলাম। এখন তোর বিবেচনা।

আমার পরামর্শ নিলে এই বিয়েতে রাজি হওয়া তোর জন্যে মঙ্গলজনক হবে। তুই তোর মতামত অতি দ্রুত আমাকে জানাবি। যদি হ্যাঁ হয়, তবে ছেলে এসে বিয়ে করে তোকে নিয়ে চলে যাবে। চট করে তোকে ভিসা দেবে না। কামাল বলেছে, সে তোকে প্রথম সুইডেন নিয়ে যাবে। সেখান থেকে আমেরিকা আনবে। তোকে বলতে ভুলে গেছি। ছেলের নাম কামাল। ওর কয়েকটা ছবি পাঠালাম।

মার শরীর আরো খারাপ করেছে শুনে খুব ভয় পাচ্ছি। মারও ভালমন্দ কিছু হয়ে যাবে না তো! বিপদ আসতে শুরু করলে আসতেই থাকে। এদিকে তোর দুলাভাই আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছে যে, তুই কল্পনাও করতে পারবি না। ঐ দিন ব্রেকফাস্টের টেবিলে গরম কফির কোপ আমার দিকে ছুড়ে দিল। কপাল কেটে রক্তারক্তি। গোলও পুড়েছে। এইসব কথা লিখতেও লজ্জা লাগে।

বাবার মৃত্যুর খবর শুনে তার মাথায় প্রথম ঢুকেছে। সংসার চালানোর জন্যে

আশ্চর্য মানুষের মন–কত ছোট হয়! আমি তাকে বললাম, তোমার টাকা তারা খরচ করবে কিভাবে? টাকা তো তোমার একাউন্টে।

যাই হোক, বাসার যাবতীয় খবর জানাবি। মার চিকিৎসার খরচ কোথেকে আসছে, সংসার কিভাবে চলছে–এইসব আমার জানা দরকার। জেনেও কিছু করতে পারব না।

তুই ভাল থাকিস। বিয়ের ব্যাপারে মত থাকলে আমাকে জানাবি।

ইতি তোর মনিকা আপু

পুনশ্চ–১ : পঞ্চাশ ডলার পাঠালাম। এই টাকা দিয়ে এতিমখানায় বাবার নাম করে এক বেলা খাবার ব্যবস্থা করবি।

পুনশ্চ–২ : তোর চিঠিতে দেখলাম–বড় মামা সবাইকে তার বাড়িতে উঠার পরামর্শ দিয়েছেন। পরামর্শটা ভাল। তোর তো বিয়েই হয়ে যাবে। থাকছে শুধু ফরহাদ আর আতাহার। মার যা অবস্থা শুনছি। তাকে বাকির খাতায় লিখে রাখাই ভাল। ফরহাদ আর অত্যাহার মামার বাসায় থাকলে ওদের ইশ হবে। আতাহার নিশ্চয়ই চক্ষুলজ্জায় পড়ে চাকরি-বাকরির চেষ্টা করবে। তোরা রাজি হয়ে যা। বড় মামাকে আমি পৃথক পত্র দিয়েছি।

 

সামনের রাস্তায় গনি সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। আতাহার বিস্মিত হয়ে বলল, গনিভাই আপনি? কোথায় যাচ্ছিলেন?

গনি সাহেব বললেন, কোথাও যাচ্ছিলাম না–তোমার খোঁজেই এসেছি।

আতাহার বিস্মিত হয়ে বলল, আমার খোঁজে?

হ্যাঁ তোমার খোঁজে। তোমাকে তো আবার রাত বারোটার আগে এলে পাওয়া যায় না।

ব্যাপার কি?

তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে এসেছি। তোমার বাবা মারা গেছেন এই খবর তুমি আমাকে দাও নাই–আমার মনটা খারাপ হয়েছে। আমি সাজ্জাদের কাছে বাসার ঠিকান, চাইলাম–সে তোমার ঠিকানা জানে না–এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা? ঠিকানা অবশ্য আরো আগেই জোগাড় হয়েছে–আমি পড়ে গেলাম অসুখে। ফু জ্বর–একশ চারপাঁচ পর্যন্ত উঠে। আতাহার, আমার আসতে দেরি হয়ে গেল।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন–আসুন, ভিতরে আসুন।

মধ্যরাতে গৃহস্থের বাড়িতে যেত নেই। গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। আমি আধুনিক মানুষ হলেও এইসব আবার মানি। এটা ধর।

এটা কি?

তেমন কিছু না–তোমার একটা কবিতা ছেপেছি। ভাবলাম নিজের হাতে দিয়ে আসি। জোছনা নিয়ে তুমি যে কবিতাটা লিখেছ–সেটা হয়েছে। আর ধর, এই খামটা ্রাখ–একশ টাকা আছে। সম্মানী।

গণিভাই, ঠিক করে বলুন কবিতা ছাপা হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে। কবিতাটা পড়ার পরই হঠাৎ আমার জোছনা দেখার ইচ্ছা করল–তখন বুঝলাম তুমি পেরেছ।

আতাহার মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেছে। একটা খুব হাস্যকর ব্যাপার হয়েছে–তার চোখে পান এসে গেছে। তার বড়হ লজ্জা লাগছে।

আতাহার!

জ্বি।

কবিতা নিয়ে আমি অনেক বড় বড় কথা বলি, বক্তৃতা দেই–আমি নিজে কিন্তু লিখতে পারি না। আমি যে জিনিসটা পারি না–তোমরা পার–তখন একই সঙ্গে আনন্দ হয়–আবার ঈর্ষাও হয়।

আপনি কখনো লেখার চেষ্টা করেননি।

কে বলেছে করিনি? যাই আতাহার।

আসুন আপনাকে একটু এগিয়ে দেই।

আস। রাস্তা নিৰ্জন–তুমি বড় রাস্তা পর্যন্ত আমার সঙ্গে চল।

দুজন নিঃশব্দে হাঁটছে। এত দীর্ঘ সময় গণি সাহেব কখনো চুপচাপ থাকেননি। আতাহারের হঠাৎ করে এই মানুষটাকে খানিকটা তার বাবার মত লাগল। রশীদ সাহেবও নিঃশব্দে হাঁটতেন। হাঁটার সময় তাঁর মাথাটা নিচু হয়ে থাকতো–যেন তিনি ফুটপাতের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে আছেন। জগতের সব রূপ ফুটপাতে দেখে ফেলেছেন। এর বাইরে তার আর কিছু দেখার নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *