আঠার
সাত দিন বিছানায় পড়ে ছিল অর্ক। পার্ক হোটেল থেকে ফিরে আসার রাত্রেই তেড়ে জ্বর এল সেই সঙ্গে মাথায় যন্ত্রণা। অনিমেষের তক্তাপোশে বিছানা করে দেওয়া হয়েছিল ওকে। জ্বরটা বেড়ে গিয়েছিল মাঝ রাত্রে, তখন কিছুই করার ছিল না। অনিমেষ আর মাধবীলতা অসহায় চোখে দেখেছিল গায়ে গতরে বেড়ে ওঠা বেপরোয়া ছেলেটা শিশুর মত কষ্ট পাচ্ছে। সারারাত জলপট্টি আর মাথায় বাতাস করে করেও যখন জ্বর কমানো গেল না তখন মাধবীলতা ভয় পেল। যে ছেলেটা বিকেলেও হাসিখুশি সুস্থ হয়ে ওদের নিয়ে কলকাতা দর্শন করে এল সেই ছেলের মাঝ রাত থেকে এই অবস্থা হয় কি করে! পাড়ার ডাক্তারবাবু এসেছিলেন সকালে। অনেকক্ষণ দেখেশুনে কয়েকটা ট্যাবলেটের নাম লিখে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ভয়ের কিছুই নেই। মনে হয় এতেই জ্বর কমে যাবে। কিন্তু জ্বর কমল পাঁচ দিনের মাথায়। আর এই পাঁচ দিন অনবরত কথা বলে গেছে অর্ক। সেসব কথার সূত্র এবং অর্থ বোঝেনি মাধবীলতা শুধু একটি বাক্য ছাড়া, ‘দু লাখ টাকা ছেড়ে দিলে?’ মাধবীলতা এবং অনিমেষ খুবই অবাক হয়েছিল প্রথম বাক্যটি কানে আসে। জ্বরের ঘোরেও অর্ক এই কথা বলায় বোঝা যাচ্ছে যে ওর মনে বিস্ময় চেপে বসেছে। ছেলের মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে মাধবীলতা বলেছিল, তোমার ছেলে বেশ বিষয়ী দেখছি!’
অনিমেষ ছেলের অসুখের সময় নতুন করে আবিষ্কার করল তার কিছুই করার নেই। ছেলেটা যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে, জ্বরে মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সে উপশম করতে পারছে না। এমনকি পাঁচ মিনিটের বেশী পাখা দোলাতে গেলে হাত কনকন করে। তাছাড়া মাধবীলতা ক্রমাগত বলে গেছে, তুমি সরো তো, কিছু করতে হবে না তোমাকে, একজন পড়েছে আর একজন পড়লেই সোনায় সোহাগা হবে আমার। অনিমেষ জানে মাধবীলতা তার অক্ষমতাকে ঢেকে রাখতে চাইছে। সত্যি বলতে কি, এই ছুতোটাকে সে নিজেও গ্রহণ করেছে। অনিমেষ তাই শুধু নজর রাখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। আর এই সময় নিজের ছেলেবেলার কথা বড্ড মনে পড়ে যায়। শৈশবে বাবার সঙ্গে তার দূরত্ব ছিল অনেক। শুধু তার কেন, পরিচিত বন্ধুদেরও দেখেছে বাবার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। মা পিসী দাদু তখন তার জগৎ জুড়ে ছিল। বাবা সেই সংসারের একজন সদস্য মাত্র কিন্তু সন্তানের সঙ্গে নিজস্ব কোন যোগ নেই। যেন ছেলের সঙ্গে আলাদা করে ঘনিষ্ঠতা করা সে সময়ে বাবার কাছে অস্বস্তির ছিল । দাদুর সামনে বাবা তাকে কোলে নিয়ে বা গলা জড়িয়ে ধরে গল্প করছে এমন দৃশ্য কল্পনা করাও যায় না, হয়তো সে-সময় বাবার সেটা ইচ্ছে থাকলেও করতে লজ্জা পেত। একান্নবর্তী পরিবারে স্ত্রী এবং সন্তানের প্রতি ভালবাসার প্রকাশ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চোখে যদি অন্যরকম মনে হয় এই সঙ্কোচে বাবা থাকতো নিজের জগতে। সন্তান একটু বড় হয়ে তাই বাবাকে দূরের মানুষ বলেই ভেবে নিত। ছেলেবেলায় অনেক বন্ধুকে অনিমেষ বাবাকে আপনি বলতে শুনেছে। কিন্তু এখন তো বাবা বন্ধুর মত, কিংবা এত কাছাকাছি যে সন্তানের সঙ্গে তার কোন আড়াল নেই। অর্কর সঙ্গে তার সেইরকম সম্পর্ক গড়ে উঠতে উঠতে কেন যেন উঠল না। শুধু তার শারীরিক অপটুতা? না। অনিমেষ এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। হয়তো ছেলের জীবনের প্রথম কয়েকটা বছর তার কাছে অজানা থাকায়, ওর তিলে তিলে বড় হওয়া দেখতে না পাওয়ায় একটা ফাঁক তৈরি হয়েই রয়েছে মনের গভীরে। যেটা তাকে স্বচ্ছন্দ করে না। মাধবীলতা বলল অনিমেষের ছেলে বেশ বিষয়ী। দু লাখ টাকার জন্যেই শোকগ্রস্ত হল নাকি অর্ক। তোমার ছেলে কথাটায় যে একটু ঠাট্টা মেশানো তা বোঝে অনিমেষ। কিন্তু জ্বরের ঘোরে যে দুলাখ দুলাখ করে যাবে ছেলে তা ভাবতে পারেনি সে। পাঁচ দিন বাদে যখন অর্কর জ্বর নামল তখন অনিমেষ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ কোন কথা শুনবো না, তোমাকে সারাদিন ঘুমুতেই হবে।
‘ওমা, ঘুমুতে যাব কেন? পাঁচ দিন প্রায় জেগে থাকা মাধবীলতার মুখ আজকের শান্তিতে স্নিগ্ধ। অনিমেষ আর কথা বলেনি। যে মেয়ে পাঁচ দিনের প্রতিটি ঘন্টা ছেলের সেবা করে গেছে সে যদি একথা বলে তাহলে আর কি করার আছে!
কিছুক্ষণ বাদে অনিমেষ উঠে এল খাটে। এই ক’দিন মাটিতে ওর বিছানা হয়েছিল। অর্ক চোখ খুলে নির্জীব ভঙ্গীতে শুয়ে আছে। বাবাকে খাটে উঠতে দেখে হাসবার চেষ্টা করল। অনিমেষ ওর পাশে নিজের শরীরটাকে কোনমতে তুলে গুছিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিরে, খিদে পাচ্ছে?’
অর্ক মাথা নাড়ল। না। অনিমেষ বলল, কি করে জ্বর বাধালি বল তো! এই কদিন কোন হুঁশই ছিল না তোর! এর মধ্যে পরমহংস দুদিন খোঁজ নিয়ে গেছে।’
পরমহংসের নাম শুনে আবার হাসি ফুটল অর্কর মুখে। ওকে যে ছেলের পছন্দ হয়েছে তা প্রথম দিনেই টের পেয়েছিল এরা। দুদিনই বেশ কিছু ফল দিয়ে গেছে পরমহংস। আপেলগুলো এখন শুকোচ্ছে। অনিমেষ বলল, ‘অত টো টো করে সারাদিন ঘুরতিস সহ্য হবে কেন? এখন আর বাইরে বের হওয়া চলবে না। এই সময় তার চোখে পড়ল মাধবীলতা কাপড় পাল্টে নিয়েছে ঘরের কোণে। আলনার ওপাশে ছোট্ট একটা আড়াল এই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করে মাধবীলতা। আঁচল ঠিক করতে করতে আয়নার সামনে আসতেই অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি বের হচ্ছ নাকি?’
‘হ্যাঁ। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই ঘুরে আসব। তুমি এই ট্যাবলেটটা ওকে আধঘন্টা বাদে মনে করে খাইয়ে দিও। টেবিলের ওপর রাখা ট্যাবলেটটাকে দেখাল মাধবীলতা।
‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ অনিমেষ ভ্রূ কুঁচকে তাকাল।
‘স্কুলে।’ দ্রুত হাতে চুল ঠিক করছিল মাধবীলতা।
‘সে কি! তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? পাঁচ দিন ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করে তুমি স্কুলে যাচ্ছ? আমি বলেছি তুমি আজ রেস্ট নেবে। তাছাড়া এই বেলায় তুমি স্কুলে গিয়ে কি করবে? অনিমেষ বেশ জোরেই কথাগুলো বলল।
মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ‘স্কুলে আমাকে যেতেই হবে। বলছি তো যাব আর আসব।’
‘কি এমন রাজকর্ম আছে যে যেতেই হবে। আমি বলছি তুমি যাবে না।’
‘অবুঝ হয়ো না। এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে উত্তেজিত হচ্ছ কেন?’
অনিমেষের মুখে চোখে ক্রোধ স্পষ্ট এবং শেষে সেটা হতাশায় রূপান্তরিত হল। সে হাত নেড়ে বলল, ‘তুমি যদি আমার কথা না শুনতে চাও তাহলে ছেলে অবাধ্য হবেই।’
মাধবীলতার হাত মাথার ওপর থেকে ধীরে ধীরে নেমে এল। তার চোখ অনিমেষের ওপর স্থির। ঠোঁট শক্ত। কথাটা বলে অনিমেষ ভেজানো দরজার দিকে মুখ ফিরিয়েছে। সে যে কিছুই দেখছে না তা বোঝা যায়। অর্ক বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কথাটা কানে যাওয়া মাত্র। এই ঘরে হঠাৎ কোন শব্দ নেই।
মাধবীলতার হাত আবার সচল হল । চুল আঁচড়ে, মুখ মুছে ব্যাগটা তুলে নিল হাতে। তারপর তক্তোপোশের পাশে এসে ছেলের মাথায় হাত রাখল। জ্বর নেই নিশ্চিত হয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল, ‘আমি কি করব বল তো?’
মুখ না ফিরিয়ে অনিমেষ ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘যা করছ তাই করো। সেজেগুজে স্কুলে যাও। সংসারের জন্যে খেটেখুটে উনি নিজেকে শেষ করে ফেলেছেন! আমি বুঝি না তোমার উদ্দেশ্য?’
‘কি বোঝ?’ মাধবীলতার গলায় হাসির মিশেল। সেটা টের পেয়ে অনিমেষের জ্বালা স্পষ্ট হল, ‘এই কষ্ট করে তুমি মনে মনে খুব আনন্দ পাও। একটা ভাঙ্গা সংসারকে একা টেনে বেড়াচ্ছ, এই ভাবনা তোমাকে আরও কষ্ট করতে অনুপ্রেরণা দেয়। স্যাডিস্ট অ্যাপ্রোচ। ইনডাইরেক্টলি তুমি বুঝিয়ে দাও আমরা অপদার্থ, তুমি না থাকলে আমরা ভেসে যেতাম। আর এই বুঝিয়ে দিতে পারাটাই তোমার আনন্দ। নিজেকে চাবুক মেরে যেমন অনেকের আনন্দ হয়।’
‘তাই?’ মাধবীলতার কণ্ঠ এবার স্থির।
‘অবশ্যই। নইলে যে মানুষ পাঁচদিন এক ফোঁটাও ঘুমোয়নি সে এখন ঘটা করে স্কুলে যায় হাজার নিষেধ সত্ত্বেও। কেন, আজ না গেলে কি তোমার চাকরি চলে যেত? যে দেখবে সেই বুঝতে পারবে তোমার শরীর ঠিক নেই। তারা আহা উহু বললে তোমার শুনতে ভাল লাগবে!’ অনিমেষ স্ত্রীর দিকে তাকাল ।
এতক্ষণে সত্যি ক্লান্ত দেখাল মাধবীলতাকে। ধীরে ধীরে সে বসে পড়ল তক্তাপোশের ওপর। কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করে যেন শক্তি সঞ্চয় করল। তারপর নিচু গলায় বলল, ‘আমার কাছে আর মাত্র পাঁচটা টাকা পড়ে আছে।’
‘পাঁচ টাকা, পাঁচ টাকা মানে?’ হতভম্ব হয়ে গেল অনিমেষ।
‘কদিনে যে খরচ হল সেটা তো হিসেবে ছিল না। এখনও মাইনে পেতে দেরি আছে। সংসারের খরচ ছাড়াও ওর ওষুধ কিনতে হবে না? স্কুলে না গেলে টাকার ব্যবস্থা কোত্থেকে হবে। তুমি তো অনেক কিছু বুঝে গেছ! হয়তো ঠিকই বুঝেছ কিন্তু এই মুহূর্তে হাতে কিছু টাকার দরকার। মাধবীলতা কেটে কেটে শব্দগুলো উচ্চারণ করল। অনিমেষের মনে হল এবার তার নিজের গালে চড় মারা উচিত। ক’দিনে যে প্রচুর খরচ হয়েছে এ কথাটা একবারও মনে পড়েনি। আর টাকার ব্যবস্থা করতে হলেও মাধবীলতাকেই যেতে হবে এটাই এখন সত্যি। সে নিজে চেষ্টা করলেও এক পয়সা ধার পাবে না। অবিনাশের কাছে আগে হলে হাত পাতা যেত কিন্তু সেই পেন্সিলারের কাজ প্রত্যাখ্যান করার পর আর ওর ওখানে যায় নি সে। নিজেকে আর একবার অসহায় কীটের মত মনে হচ্ছিল তার। এইসময় দরজায় কেউ শব্দ করল। মাধবীলতা দ্রুত নিজেকে সংযত করে বলল, কে?
‘আমি।’ মেয়েলি গলা। মাধবীলতা একটু বিরক্ত হয়ে উঠে দরজা খুলে বলল, ‘কি ব্যাপার?’
অনু বলল, ‘আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।’ মাধবীলতা একবার পেছনের দিকে তাকিয়ে দরজা ভেজিয়ে বাইরে গেল। আর তখনই অর্ক বলে উঠল, ‘বাবা!’ অনিমেষ মুখ তুলে তাকাল। ওর বুকে এক ধরনের যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছিল। তবু ছেলের ডাকে উত্তর দিল, ‘কি?’
‘আমি একটা কথা বলব তুমি সেটা মাকে বলবে না, বল!’
অনিমেষের কপালে ভাঁজ পড়ল। অর্কর বলার ভঙ্গী একদম অচেনা। এত আন্তরিক গলায় ওকে কথা বলতে ইদানীং শোনেনি সে। ওর মনে হল অর্ক এই মুহূর্তে মাধবীলতার চেয়ে তাকেই কাছের মানুষ বলে মনে করছে। নইলে মায়ের কাছে গোপন করে তাকেই কিছু বলতে চাইবে কেন। সে বলল, ‘কি?’
‘আগে বল বলবে না!’
‘ঠিক আছে।’ অনিমেষ নিজেকে গুরুত্ব দিতে চাইল।
‘আমার কাছে টাকা আছে। ওই যে টেবিলের ওপর আমার যে পড়ার বই তার নিচেরটা খুলে দ্যাখো পাবে। তুমি টাকাটা নিয়ে মাকে দাও। আর কক্ষনো বলবে না আমি দিয়েছি। অর্কর দুর্বল গলায় উত্তেজনা।
‘তুই কোত্থেকে টাকা পেলি?’ অনিমেষ চমকে উঠল।
‘পেয়েছি। তুমি তাড়াতাড়ি কর। মা ঘরে আসার আগেই টাকাটা বের করে নাও। নইলে—’ অর্ক হাঁপাতে লাগল। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্রুত হাত চালাল অনিমেষ। একটু ঝুঁকলেই টেবিলটার নাগাল পাওয়া যায়। তাড়াহুড়োতে বইগুলো এলোমেলো হল কিন্তু নিচেরটা খুলতেই টাকাগুলো হাতে এসে গেল। অনেকগুলো নোট, অঙ্কটা কত হবে বুঝতে না পেরে সে হতভম্ব-গলায় বলল, ‘কোত্থেকে পেয়েছিস।’
‘পরে বলব। তুমি যা হোক কিছু বলে দাও।’ অর্ক চোখ বন্ধ করল। আর তখনই মাধবীলতা ঘরে ঢুকল, ঢুকে বলল, ‘বেচারা!’
‘কি হয়েছে?’ অনিমেষের কণ্ঠস্বর কাঁপছিল। মাধবীলতা ছেলের দিকে তাকিয়ে কথা ঘোরাল, ‘এমন কিছু নয়। যাক, আমি ঘুরে আসছি।’
অনিমেষ বলল, ‘শুধু ধার করার জন্যে স্কুলে না গেলেই হবে।’
‘মানে? আমি আর কি জন্যে যাচ্ছি।’
‘তাহলে যেও না।’
‘বাঃ, ধার না করলে চলবে কেন? বিকেলেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।’
‘এই টাকাগুলো রাখো।’ অনিমেষ বিছানা থেকে তুলে টাকাগুলো মাধবীলতার দিকে বাড়িয়ে দিল। প্রচণ্ড বিস্ময় ফুটে উঠল মাধবীলতার মুখে। সে একবার টাকা আর একবার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে গলায় বলল, ‘কে দিল?’
‘দিয়েছে কেউ। কত আছে গুনে দ্যাখো।’
‘যে দিয়েছে সে তোমাকে গুনে দেয়নি?’ মাধবীলতার চোখে সন্দেহ।
‘দিয়েছে তবে টাকা নেবার সময় গুনে নেওয়া উচিত।’
মাধবীলতার মাথায় বোধহয় কিছু ঢুকছিল না। সে এবার ছেলের দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে অর্ক। এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই অর্কর কোন ভূমিকা নেই। তাছাড়া অত টাকা ছেলে পাবেই বা কোথায়! নোটগুলো দেখে মনে হচ্ছে পরিমাণ কম নয়। সে অনিমেষকে বলল, ‘ম্যাজিক শিখেছ নাকি?’
‘কেন?’
‘ঘরে বসে টাকা বানাচ্ছ!’
‘বানাচ্ছি কে বলল! ধরো এগুলো!’
‘কিন্তু তুমি কার কাছ থেকে পেয়েছ না বললে টাকা নেব না আমি। ও বুঝেছি, অবিনাশের কাছ থেকে ধার করেছ, না?’
‘অবিনাশ? না, না। আমি তো এখন আর ওখানে যাই না।’ সত্যি কথাটা বলে ফেলল অনিমেষ। একটা বিশ্বাসযোগ্য বানানো গল্প মনে মনে হাতড়াচ্ছিল সে। কিন্তু মাধবীলতার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনটাকেই যুতসই বলে মনে হচ্ছিল না। সে অর্কর নাম বলবে না অথচ একটা যুক্তি খাড়া করা খুব দরকার। ভেতরে ভেতরে অসহায় হয়ে পড়েছিল অনিমেষ। মাধবীলতার গলায় এবার সমাধানের সুর, ‘আচ্ছা! এতক্ষণে বুঝলাম। তুমি পরমহংসের কাছে পেয়েছো। না, না, এটা ঠিক কাজ করোনি। এতকাল বাদে দেখা হতেই টাকা ধার করলে, ও মনে মনে কি ভাবল কে জানে। তাছাড়া শোধ দিতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, সেটাও একটা সমস্যা হয়ে থাকল। নেবার আগে আমাকে বলতে পারতে। হাতের ব্যাগ টেবিলে রেখে মাধবীলতা টাকাগুলো নিয়ে গুনতে শুরু করল।
অনিমেষ যেন মুক্তি পেল । মাধবীলতাই যখন পরমহংসের নামটা বলে দিল তখন এর চেয়ে নিরাপদ অজুহাত আর কি আছে। সে উদাস গলায় বলল, ‘পরমহংস আমার কলেজ জীবনের বন্ধু।’
গোনা শেষ হলে মাধবীলতা বলল, এত টাকা? এত টাকা নেওয়ার কি দরকার ছিল! কবে শোধ দিতে হবে বলেছে?’
‘না। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আর তুমি যেন গায়ে পড়ে ওকে এসব বলতে যেও না। বেচারা লজ্জা পাবে। ওর নাম তুমি জানো এটা ও কিছুতেই চাইবে না। ফেরত দেওয়ার ব্যাপারটা আমি বুঝে নেব।’ অম্লান বদনে মিথ্যে কথা বলতে বলতে অনিমেষের খেয়াল হল অর্ক নিশ্চয়ই কান খাড়া করে এসব শুনছে। বাবা যে চমৎকার মিথ্যে বলতে পারে এমন ধারণা করার সুযোগ সে নিজেই দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ওর কাছে কথা রাখতে হলে এছাড়া যে উপায় নেই সেটুকু বুঝবে না?
টাকাগুলো তুলে রাখতে রাখতে মাধবীলতা বলল, ‘তোমার ছেলে দু লাখ দু লাখ বলে চেঁচাচ্ছিল আর তোমাকে সামান্য কটা টাকার জন্যে হাত পাততে হচ্ছে। একেই বোধহয় কপালের ফের বলে।’
অনিমেষ যেন এবার একটু স্বাভাবিক হতে পেরে বেঁচে গেল, ‘কেন, দু লাখ নিতে পারলে না বলে আফসোস হচ্ছে নাকি?’
‘আমি যদি হ্যাঁ বলতাম তাহলে এই সংসারের চেহারাটা বদলে যেত। কারো কাছে সামান্য প্রয়োজনে ধার করতে হত না। তোমাদের কাউকেই আর কষ্ট করতে হোতো না। অথচ তখন আমি কিছুতেই হ্যাঁ বলতে পারলাম না। কেউ যদি শোনে কাল দু লাখ টাকায় না বলে আজ দুশো টাকা ধার করতে ছুটি তাহলে পাগল বলবে। এই কদিন ধরে খোকা যখন জ্বরের ঘোরে টাকার কথা বলত তখন মনে হতো আমি কি ভুল করেছি? পাঁচজনে শুনলে বলবে বাড়াবাড়ি, গল্প উপন্যাসে হয়, কিন্তু আমি যে কিছুতেই তখন হ্যাঁ বলতে পারলাম না। তোমাকে যখন নিচে নেমে এসে বললাম তখন খুব ভয় করছিল। তুমি যদি না বলেছি বলে রেগে যাও তাহলে আমি কি করব? তোমার কথায় জোর পেলাম। কিন্তু সত্যি বল তো, আমি না বলেছিলাম কেন?’ মাধবীলতা চোখ তুলল।
‘অন্যের টাকা কেন হাত পেতে নেবে, তাই।’
‘না গো। তোমাকে বিকলাঙ্গ না বললে হয়তো আমি না বলতে পারতাম না।’
ভাত খাওয়ার পর অর্ককে আর আটকে রাখা গেল না। তবে এই কদিনে একটা বিশ্বাস মাধবীলতার এসেছে, অর্ক বুঝতে শিখেছে। ও অন্তত খুরকি কিলাদের সঙ্গে নিজেকে বিশ্রীভাবে জড়াবে না। বিশ্বাসটা দৃঢ় হয়েছিল যখন অনুর মায়ের শ্রাদ্ধের পর বিলু ওকে ডাকতে এল। অর্ক তখনও ভাত খায়নি কিন্তু একটু একটু হাঁটাচলা করছে। কদিনের অসুখে ওকে বেশ রোগা দেখাচ্ছে এবং কিছুটা লম্বা। স্কুল থেকে ফেরার পথে মুসুম্বি এনেছিল। বড্ড দাম কিন্তু অর্কর এখন এসব খাওয়া উচিত। পরমহংসের টাকা ফুরোবার আগেই মাইনে হাতে এসে যাবে, এই ভরসা। অনুদের ঘরের পাশ দিয়ে কয়েক পা এগোতেই বিলুকে দেখতে পেল মাধবীলতা। বিলু আর অর্ক।
সঙ্গে সঙ্গে যে বিরক্তিটা এল সেটা চেপে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি মাধবীলতা। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ওরা কথা বলছিল। তাকে দেখে দুজনেই চুপ করে গেল। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, ‘বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
অর্ক জবাব দিল, ‘বিলুর সঙ্গে কথা বলছি।’
‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু তোর এখন গায়ে রোদ লাগানো উচিত নয়। তারপর বিলুকে বলেছিল, ‘না রে, আমি এর মধ্যে নেই। তাছাড়া আমার শরীর খারাপ, ওসব ঝামেলায় যেতে পারব না।’
বিলু বলেছিল, ‘কি যে বলিস, অসুখ যেন আর কারো হয় না। এত বড় শ্রাদ্ধ হয়ে গেল, কিলা একাই সব নাফা হাপিস করল। তুমি সঙ্গে থাকলে আমি ওর বারোটা বাজিয়ে দিতাম। একটু ফিট হয়ে নাও তারপর সতীশদার সঙ্গে মোকাবিলা করব।’
অর্ক বলেছিল, ‘না, আমি পার্টি ফার্টির মধ্যে নেই।’
বিলু হেসেছিল, ‘আমরা কেউই নেই। কিন্তু পার্টি পেছনে থাকলে অনেক কাজে সুবিধে হয়। ঠিক আছে, বিকেলে রকে আয়।’
অর্ক বলেছিল, ‘না। তুই যা, আমি এখন বের হব না।’
ঘরে ফিরে এলে অর্ককে জিজ্ঞাসা করেছিল মাধবীলতা, ‘ও কি বলতে এসেছিল রে? এর মধ্যে, তোর অসুখের সময়েও একদিন এসেছিল।’
‘কিলার সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে তাই বলতে এসেছিল।’
‘কিসের ঝামেলা?’
‘শ্রাদ্ধের টাকাপয়সা নিয়ে। ছেড়ে দাও এসব কথা। ওঃ, তুমি আবার আজ মুসুম্বি এনেছ? তোমাকে সেদিন মানা করলাম না?’
‘এখন শরীর সারাতে হলে এসব খেতেই হবে। আর শোন, ওইসব ফালতু ঝামেলায় তুমি যেও না।’ মাধবীলতা প্রসঙ্গ টানল।
‘কে যাচ্ছে!’
ছেলের বলার ভঙ্গীতে মাধবীলতার বিশ্বাস বাড়ল। অনিমেষ বলেছিল, ‘ও তোমার মেয়ে নয় যে জোর করে ঘরে আটকে রাখবে।’
অতএব অর্ক আবার ঘর ছেড়ে বের হল। বের হয়েই শুনল খুরকিকে নাকি আর দেখা যাচ্ছে না। কিলার সঙ্গে সতীশদার সম্পর্ক এখন ভাল নেই। কদিন আগে পুলিশ নাকি আচমকা সিনেমা হলগুলোতে রেইড করে ব্ল্যাকারদের ধরে নিয়ে যায়। ওই দলে কিলাও ছিল। খবরটা জানার পরও নাকি সতীশদা থানা থেকে ওকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেনি। পুলিশ কিলার ডানহাত ভেঙ্গে দিয়েছে। প্লাস্টার করা হাত নিয়ে সতীশদার কাছে গিয়েছিল কিলা। এই নিয়ে একটু হামলা করার চেষ্টায় ছিল সে। পাড়ায় সি পি এমের জন্যে সে জান লড়িয়ে দিয়েছে অথচ কেউ তাকে ছাড়াতে যায়নি বলে চেঁচামেচি করেছিল। কিন্তু সতীশদা তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সে যদি সমাজবিরোধী কাজকর্ম থেকে বিরত না থাকে তাহলে পার্টি তাকে আশ্রয় দেবে না। এমনিতেই তার জন্যে নাকি পার্টির ইমেজ পাবলিকের কাছে খারাপ হয়ে গিয়েছে। সি পি এম পার্টি গুণ্ডা পুষতে রাজি নয়। কিলা শাসিয়েছে যে সে সতীশদাকে দেখে নেবে। ও যদি নুকু ঘোষকে একবার হ্যাঁ বলে তাহলে ঈশ্বরপুকুরে সি পি এমের বারোটা বাজিয়ে দিতে বেশীক্ষণ সময় লাগবে না।
অর্ক দেখল, ঈশ্বরপুকুরের সামনে একটা মঞ্চ তৈরি হয়েছে। কোয়া বলল, ‘আজ মাইরি ফাটাফাটি কাণ্ড হবে।’
অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ব্যাপার? ওরা শিবমন্দিরের রকে বসেছিল। খুরকি তো নেই কিলাও আজ আসেনি। বিলু বলল, ‘খুব জোর হাওয়া পাল্টে যাচ্ছে গুরু, এখন শুধু তাকে তাকে থাকতে হবে। গত পাঁচদিন ধরে শ্যামবাজারের কোন হলে ব্ল্যাক হয়নি, ভাবতে পারা যায় না।’
একটু বাদেই শ্লোগান দিতে দিতে কয়েকটা ছোট মিছিল হাজির হল মঞ্চের সামনে। মাইকে অবিরাম হ্যালো হ্যালো চলছিল। কে একজন পেছনে ফেস্টুন টাঙিয়ে দিল, ‘সমাজবিরোধীদের হামলার প্রতিবাদে জনসভা।’ বক্তৃতা শুরু হল। প্রথমে সি পি আই-এর একজন স্থানীয় নেতা বললেন, ‘বন্ধুগণ, আমরা এমন একটা সময়ে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি যখন জনপ্রিয় বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ক্রমশ সীমা ছাড়াচ্ছে, বামফ্রন্ট সরকারের প্রগতিমূলক কাজকর্ম যাতে জনসমর্থন না পায় তার জন্যে একটি বিশেষ সংবাদপত্র সচেষ্ট। তাদের রাজনৈতিক সংবাদদাতা সুযোগ পেলেই আমাদের উদ্দেশ্যে গালাগাল দিয়ে থাকেন। এদের আপনারা চেনেন। তাই সুযোগ-সন্ধানীদের সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নেই। যেহেতু আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করি তাই এদের মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের অন্য কোন উপায় নেই। আমরা সরকার গঠন করেছি কোন সংবাদপত্রের দয়ায় নয়। জনসাধারণ আমাদের হাতে এই মহান দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন। সম্প্রতি আমরা আর একটি জিনিস লক্ষ্য করছি। পাড়ায় পাড়ায় কিছু বেপরোয়া গুণ্ডা বদমাস ক্রমশ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। তাদের অসামাজিক ক্রিয়াকলাপের পেছনে কার মদত আছে তা আজ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই জনসাধারণ এই লুম্পেনদের ভয় পান। পুলিসকে কিছু বললে কাজ হয় না। কেন হয় না তাঁরাই জানেন। এইসব সমাজবিরোধীরা এখন বামফ্রন্টের সুনাম নষ্ট করার জন্যে তৎপর হয়েছে। এদের স্পর্ধা এত বেড়ে গেছে যে এরা আমাদের একজন স্থানীয় নেতাকে শাসাতে ভয় পায় না। আমরা জানি ওরা কোত্থেকে এই সাহস পাচ্ছে। ওদের হাতে গোপন অস্ত্র আছে। কিন্তু আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে আমরা দুর্বল নই। আপনাদের কাছে আমাদের আবেদন আপনারা এইসব সমাজবিরোধীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় সমাজবিরোধীদের চিহ্নিত করুন। তাদের বর্জন করুন।’
প্রচণ্ড হাততালির মধ্যে দ্বিতীয় বক্তা বলতে উঠলেন। অর্করা চুপচাপ শুনছিল। বিলু বলল, ‘কিলার কেস গিলে হয়ে গেল।’
অর্ক শিবমন্দির ছেড়ে চুপচাপ উঠে এল। এসব তার ভাল লাগছে না। আজ বাড়ি থেকে বের হবার সময় সে লুকনো জায়গা থেকে চিঠিটা বের করে এনেছে। বিলাস সোমের মুখ কয়েকদিন থেকেই অহরহ মনে পড়ছে তার। যদি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যান তাহলে নিশ্চয়ই এখনও বাইরে বের হবার মত শক্তি পাননি। ওকে যেদিন যেতে বলেছিলেন তারপর অনেকদিন চলে গিয়েছে। নিশ্চয়ই মনে মনে উতলা হচ্ছেন বিলাস সোম। ব্যাপারটা ওঁকে জানিয়ে দেওয়া উচিত। হারখানা হারিয়ে সে নিশ্চয়ই অন্যায় করেছে কিন্তু সেটা খুঁজে পাওয়ার জন্যে চেষ্টার ত্রুটি করেনি সে। এবং এই চিঠি পেয়ে বিলাস সোমের অবশ্যই কিছু বলার থাকবে না। মনের ভেতর যে ভারটা জমেছে সেটা হালকা হয়ে যাওয়াই ভাল।
মোড় অবধি আসতেই মনে হল শরীরটা ঝিমঝিম করছে। শরীর যে এত দুর্বল হয়ে পড়েছে তা টের পায়নি সে। একটা পানের দোকানের পাশের রকে একটু বসল অর্ক। কপালে এর মধ্যেই ঘাম জমেছে। আশ্চর্যজনকভাবে সে অসুখে পড়ল। এরকম জ্বর তার কখনও আসেনি। জ্বরের মধ্যে নাকি অনর্গল প্রলাপ বকে গেছে। এখন তাই রকে এসেও সেটা অদ্ভুত ঠেকছে। দু’ লাখ টাকার কথা নাকি বারংবার বলেছে সে। বাবাকে বিকলাঙ্গ বলায় মা এককথায় ওই দু’ লাখ টাকা ছেড়ে দিয়ে এল। এই যুক্তি মায়ের মুখে শুনলেও এখনও মানতে পারছে না অর্ক। মা অনেক আগে থেকেই টাকাটা নেবে না ঠিক করেছিল। কেন? মা অন্যের কৃপা কেন নিতে চায় না? সবাই যখন ম্যানেজ করার চেষ্টা করে, হাতিয়ে নিতে চায় তখন মা নির্বিকার হয়ে ছেড়ে দিয়ে এল। এই জিনিসটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না অর্ক। তাদের সংসারে সবচেয়ে খাটতে হচ্ছে তো মাকেই। পাঁচদিন তার জন্যে কষ্ট করে সেই মাকেই তো ধার করতে ছুটতে হচ্ছিল। চেনাশোনা কারো সঙ্গে মায়ের এই আচরণের মিল খুঁজে পাচ্ছে না অর্ক।
কিন্তু তবু মা যখন বাবার হাত থেকে টাকাটা নিয়ে খানিকটা প্রতিবাদ করেও নিশ্চিন্ত হয়ে বসল তখন তার খুব ভাল লেগেছিল। মনে হয়েছিল মাকে যদি সে প্রতি মাসে অনেক অনেক টাকা এনে দিত তাহলে মা বোধহয় আর চিন্তা করত না। কিন্তু তারপর বাবাকে বোঝাতে তার প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। মায়ের সামনে মেনে নিলেও একা পেলেই বাবা জিজ্ঞাসা করছিল, সে কোথায় টাকা পেয়েছে। সমস্ত ঘটনা মরে গেলেও সে বলতে পারতো না। শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবেচিন্তে মিথ্যে কথাটা বলেছিল। লেকটাউনের সেই ভদ্রলোকের স্ত্রী তার চিকিৎসার জন্যে এই টাকাটা দিয়েছিল, কারণ আইন আদালত হলে ওরা অপদস্থ হতো। এই মিথ্যে কথাটা বিশ্বাস করেছিল বাবা। কারণ তারপরেই বলেছিল, ‘ছি ছি, এভাবে টাকা নেওয়া তোর উচিত হয়নি। তোর তো কিছুই লাগেনি আর ভদ্রলোক গাড়িতে তুলে উপকারই করতে চেয়েছিলেন। তোর মা জানলে খুব কষ্ট পাবে। আর অ্যাদ্দিন টাকাটা নিজের কাছে রেখেছিলি কেন? মাথা নিচু করেছিল সে, জবাব দেয়নি। বাবা সেটাকে হয়তো লজ্জা বলে ভেবেছিল। বলেছিল, ‘মা টাকাটা ফেরত দিলেই তুই ভদ্রলোককে দিয়ে আসবি। এভাবে টাকা নেওয়া অন্যায়। আমাকে আবার পরমহংসকে বুঝিয়ে দিতে হবে যাতে আবার তোর মায়ের কাছে বেফাঁস না বলে বসে। কি যে করিস তুই, এভাবে ওর কাছে মিথ্যে বলতে ইচ্ছে হয় না।’
রকে বসে এসব কথা ভাবছিল অর্ক। এইসময় একটা সাতচল্লিশ নম্বর সামনে এসে দাঁড়াল! সে ধীরে ধীরে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। মাঝারি ভিড় এখনও, যেটা টালাপার্কে গেলেহালকা হয়ে যাবে। মাঝামাঝি জায়গায় রড ধরে দাঁড়াতেই সে খুরকিকে দেখতে পেল। জানলার ধারের একটা সিটে বসে ঢুলছে। খুব খারাপ চেহারা হয়ে গেছে এখন। চুল উস্কোখুস্কো, মনে হয় কদিন ঘুমোয়নি। ডাকতে গিয়েও ডাকল না অর্ক। কারণ ততক্ষণে পাকপাড়ায় বাস থেমেছে। আর স্টপেজে দাঁড়ানো লোকগুলোর মধ্যে থেকে একজন বাসের জানলার দিকে তাকিয়ে একছুটে দরজার হ্যাণ্ডেল ধরল। অর্ক বুঝল একটা কিছু হবে। সে একটু আড়াল খুঁজতে চাইল। কিলা ততক্ষণে খুরকির সামনে।