১৮. সাকারার সেরাপিয়াম

১৮ সাকারার সেরাপিয়াম

আগের শুক্রবারের কথা, বাবা মা পুরী বেড়াতে গিয়েছিল বলে বর্ধমানের বাড়ি ফাঁকা। তাই আমিও হোস্টেলেই রয়ে গিয়েছিলাম। বিকেল বেলা ক্লাস শেষ হওয়ার পরেই পিজি চান-টান করে সেন্ট মেখে বাবু সেজে বেরিয়ে গেল। বেটা নতুন প্রেম করা শুরু করেছে। তাই প্রায়দিনই সন্ধেবেলায় তিনি ছোটেন রাধানাথ বোস লেনে কলকাতা ইউনিভার্সিটির লেডিজ হোস্টেলের দিকে। তার প্রেমিকাটি ওখানেই থাকেন কিনা। আমার এদিকে একটাও ভালোবাসার পাত্রী জোটেনি এখনও অবধি। সন্ধে সাড়ে ছ-টা নাগাদ তাই একাই বেরিয়ে পড়েছিলাম। বড়োবাজারে আমার এক পিসি থাকেন। প্ল্যান ছিল তাঁরর সঙ্গেই দেখা করে আসব।

আমাদের হোস্টেল থেকে বেরিয়ে কলেজ স্ট্রিটে এসে পড়লেই উলটোদিকের প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের মোড়ে একটা বেশ বড়োসড়ো শিবমন্দির আছে। হোস্টেল থেকে বেরোলেই মন্দিরটাতে ঢুকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করা যেন অভ্যেসের মতো হয়ে গেছে। সেদিনও তাই ঢুকেছিলাম। বেরোতে যাব এমন সময় ভবেশদার গলা,

‘কী হে স্পন্দন ভাই, খবর কী?’

‘আপনি এদিকে! দোকান বন্ধ করে দিলেন নাকি?’

‘হ্যাঁ, আজকের মতো বন্ধ, তা তুমি একা কেন? শাগরেদ কোথায়?’

‘সে এখন অ্যাপোতে গেছে। আমি এই একটু পিসির বাড়িতে…’

‘ফিশ ফ্রাই খাবে?’

‘অ্যাঁ?’

‘অ্যাঁ আবার কী? আজ সকাল থেকে কেন জানি না ফিশ ফ্রাই খেতে ইচ্ছা করছিল, এসব জিনিস আবার একা একা খেলে ভালো টেস্ট পাই না। চলো কালিকায়। ফিশ ফ্রাই হয়ে যাক। আমি খাওয়াচ্ছি।’

‘কিন্তু পিসির বাড়ি?’

‘আরে, পিসি তো আর পালাচ্ছেন না?’

সত্যি কথা, পিসি পালাবে না। কিন্তু ফিশ ফ্রাইয়ের হাতছানিতে সাড়া না দেওয়াটা পাপ। তাই দু-জনে মিলে চললাম কালিকার দিকে।

image145.jpg

দোকানের সামনেটায় খুব ভিড় থাকে সবসময়েই। ফ্রাইয়ের অর্ডার দিয়ে দু-জনে একটু দূরে এসে দাঁড়ালাম। এমন সময় ভবেশদা বললেন,

‘এই যে শিবমন্দিরে প্রণাম করে এলে, মন্দিরের চৌকাঠের কাছে একটা ষাঁড়ের মূর্তি আছে খেয়াল করেছ? ওইটা কে বলো তো?’

‘নন্দি তো।’

‘হ্যাঁ, এই নন্দিই আবার মিশরে গিয়ে হয়ে গেল এপিস।’

‘ইজিপশিয়ানরা গোরুর পুজো করতেন বলেছিলেন। হাথোর। ষাঁড়ও দেবতা ছিল?’

‘ছিল ভাই, ছোটোখাটো দেবতা নয়। মেমফিসে তার নামে ছিল এক বিশাল মন্দির। সেরাপিয়াম অফ এপিস বুলস। সেখানে ষাঁড়ের মমি বানিয়ে রাখত মিশরীয়রা।’

‘একটা গোটা ষাঁড়ের মমি!!’

গরম ফিশ ফ্রাইয়ের একটা কোনা কাসুন্দিতে ডুবিয়ে হালকা কামড় দিয়ে শুরু করলেন ভবেশদা।

image26.jpg

‘দ্বিতীয় রামেসিসকে মনে আছে তো?’

‘হ্যাঁ, যাঁর সেই বিশাল বড়ো পাথরের মূর্তি আর আবু সিম্বেলের টেম্পলের কথা বলেছিলেন।’

‘হ্যাঁ, এই দ্বিতীয় রামেসিসের সময়ে আরেকজন দেবতার পুজো হত, বুঝলে। তার নাম ছিল তাহ। এই তাহ ছিল আর্ট আর ক্রাফটের দেবতা। আবার ওর ইচ্ছাতেই নাকি নীল নদে বন্যা আসত, জমিতে শস্য ফলত। তাই তাহ-এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

‘এই তাহ-এর পার্থিব রূপ ছিল একটা ষাঁড়। এরই নাম এপিস। ষাঁড় অনেক শক্তিশালী, সাহসী, এর প্রজনন ক্ষমতাও অনেক বেশি। তাই মিশরের ফারাওদের ইতিহাসের প্রথম থেকেই এপিসের পুজো হয়ে আসছিল। রামেসিসের সময় এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছোয়। জ্যান্ত ষাঁড়কেই তাহ-এর অবতার ধরে নিয়ে পুজো করা হত। তবে আবার যে-সে ষাঁড় হলে চলত না। কিছু স্পেসিফিক ক্রাইটেরিয়া ম্যাচ করতে হত।’

‘যেমন?’

‘যেমন, যে গোরু সেই ষাঁড়ের জন্ম দিয়েছে তার আগে কোনো সন্তান থাকলে চলবে না। আবার ষাঁড়ের শরীরেও কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ থাকতেই হবে। হেরোডটাস বর্ণনা দিয়ে গেছেন এর।

‘সেই বুল হবে একদম সাদা, শুধু পিঠের দিকে থাকবে কালো দাগ, সেটাও আবার উড়ন্ত চিলের আকারের হতে হবে, আর কপালে থাকবে ডায়মন্ড আকৃতির কালো ছোপ। লেজের চুল হতে হবে বিজোড় সংখ্যার, জিভের তলায় থাকতে হবে স্কারাব গুবরে পোকার মতো আরেকটা দাগ।’

‘হা হা, লেজের চুল গুনত ওরা বসে বসে?! তা ছাড়া চাপের কী আছে? ইভন নাম্বারের চুল পেলে একটাকে উৎপাটিত করলেই তো ঝামেলা মিটে যেত।’

image146.jpg

এপিস বুল

‘তুমিও দেখছি পিজির মতো ফচকেমি করছ আজকাল, আমি যা পড়েছি সেটাই বললাম, সত্যি ওরা গুনে দেখত কি না থোড়াই জানি নাকি!’

‘সরি সরি, আপনি চটবেন না, আর কিছু বলছি না। আপনি এগোন।’

‘হুঁ, তো, এই ষাঁড় বেশ রাজকীয়ভাবে থাকত বুঝলে মন্দিরের মধ্যে। শুধু এর দেখভাল করার জন্য আলাদা করে প্রিস্ট রাখা হত, যিনি সারাদিন ধরে ওর প্রতিটা মুভমেন্ট ফলো করতেন, লিখে রাখতেন। সেইগুলো থেকেই নাকি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হত। এপিস ষাঁড়ের শ্বাস নাকি ছিল খুব পবিত্র। সপ্তাহে একটা দিন তিনি আবার নাকি মন্দিরের জানলা দিয়ে ভক্তদের দর্শন দিতেন। বেশ কিছু গোরু নিয়ে তৈরি একটা হারেম থাকত ওঁর জন্য। অন্যদিকে যে গোরু সেই ষাঁড়ের জন্ম দিয়েছে তাকেও পুজো করা হত আলাদাভাবে। দেবতা তাহ বিদ্যুতের রূপে এসে নাকি তাকে গর্ভবতী করেছে।’

image147.jpg

পবিত্র ষাঁড় এপিসের পুজো করছেন ফারাও

‘এ তো একদম এলাহি আয়োজন দেখছি!’

‘তা আর বলতে ! স্বয়ং ফারাও এই ষাঁড়ের আশীর্বাদ ছাড়া কোনো শুভ কাজ শুরু করতেন না। তবে এপিস বুল যেদিন মারা যেত সেদিন দেশ জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসত। অনেক যত্ন নিয়ে ওর শরীরটাকে মমি বানানো হত। শরীরে সোনার অলংকার, মুখে সোনার মুখোশ পরিয়ে কবর দেওয়া হত ওকে। মারা যাওয়ার পরে নাকি এপিস একাত্ম হয়ে যাবে মৃত্যুর পরের দেবতা ওসাইরিসের সঙ্গে। তখন ওর নাম হবে ওসাইরাপিস। যখন একটা এপিস ষাঁড়কে মমি বানানো হচ্ছে তখনই দেশ জুড়ে তল্লাশি শুরু হত আরেকটা এমন ষাঁড়ের। 

‘দ্বিতীয় রামেসিসের রাজত্বকালে এমন দুটো ষাঁড় মারা যায়, বুঝলে। তাদেরকে মমি বানিয়ে সাকারার মরুভূমিতে কবর দেওয়া হয়। তবে ওর সন্তান খায়েমওয়াসেত যখন ফারাও হয়ে আসেন তখন একটা খুব বড়ো সিদ্ধান্ত নেন।

image148.jpg

এপিস বুলের মমি

‘যত এপিস বুল মারা যাবে তাদের সবার জন্য তৈরি করা হবে একটা বিশাল সমাধি। তার গোটাটাই হবে মাটির তলায়। একটা লম্বা গ্যালারি বানিয়ে তার দুই পাশে তৈরি করা হবে অনেকগুলো ঘর। প্রতিটা ঘরে থাকবে একজন এপিস বুলের সমাধি। আর মাটির ওপরে তৈরি করা হবে একটা বিশাল বড়ো মন্দির।

‘ফারাও যেমন ভেবেছিলেন ঠিক তেমনটাই করা হল। তারপর থেকে ইজিপ্টের ফারাওদের রাজত্বের শেষ দিন পর্যন্ত এই মন্দিরের জৌলুস অটুট ছিল। যিশুর জন্মের এক-শো বছর আগে স্ট্রাবো নামের এক গ্রিক ঐতিহাসিক এই তাক লাগানো মন্দিরের কথা লিখে গিয়েছিলেন। সাকারার এই সেরাপিয়াম থেকে মেমফিসের তাহ-এর মন্দির অবধি ছিল পাঁচ কিলোমিটার লম্বা একটা রাস্তা। সেই রাস্তার দু-পাশে রাখা ছিল অজস্র স্ফিংস।’

‘তাহলে এই মন্দির এখনও আছে?’

‘না ভাই, সেটা তো আর নেই। ৩৮৪ সালে রোমানদের হাত ধরে মিশরে খ্রিস্টান ধর্ম আসে। সঙ্গে সঙ্গেই সব পেগান ধর্মের চিহ্ন মিটিয়ে ফেলতে শুরু করে তারা। তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এই সাকারার সেরাপিয়াম।’

‘আচ্ছা, আপনি এই মন্দিরটাকে বার বার সেরাপিয়াম বলছেন কেন বলুন তো?’

‘সেরাপিয়াম তো গ্রিক শব্দ। এর মানে সেরাপিসের মন্দির। ফারাওদের ইতিহাসের শেষের তিনশো বছরের সব রাজা ছিলেন গ্রিক। ওঁদেরকে বলা হত টলেমি। মনে করে দেখো, রোসেটার পাথরের কথা বলার সময় এঁদের কথা বলেছিলাম। টলেমিরা এপিস আর ওসাইরিসকে মিলিয়ে নিজেদের এক দেবতা বানান, তাঁররই নাম সেরাপিস। সেরাপিসকে কিন্তু দেখতে ছিল মানুষেরই মতো। তাঁরর সঙ্গে থাকত তিন মাথাওয়ালা একটা কুকুর। নাম কারবেরাস। যাই হোক, টলেমিরা কিন্তু সাকারার এপিসের মন্দিরের আকারের কোনো অদলবদল করেননি। শুধু দেবতার নামটুকুই বদলে যায়।’

‘ওহ, এবারে বুঝলাম ব্যাপারটা। এবারে বলুন খ্রিস্টানরা এই মন্দিরের কী করেছিল।’

image149.jpg

সেরাপিস

‘ওরা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল সেরাপিয়ামকে। শুধু মাটির নীচের এপিস ষাঁড়ের কবরখানা আর সেই স্ফিংসের পথ রয়ে গিয়েছিল। পরের দেড় হাজার বছরে সেটাও চলে গিয়েছিল মরুভূমির বালির নীচে।’

‘তাহলে ফের খুঁজে পাওয়া গেল কী করে !!’

‘সেটা সম্ভব হয়েছিল এক ডাক্তারের জন্য, বুঝলে। ফিলিবার্তো মনক্যালেরি ছিলেন ইতালিয়ান। কায়রোতেই ডাক্তারি করছিলেন। কিন্তু ছিল টুকটাক আর্কিয়োলজির শখ। তা, এই ডাক্তারবাবু একসময় দেখলেন খোঁড়াখুঁড়ি করে যা আর্টিফ্যাক্ট পাওয়া যাচ্ছে, তা বিক্রি করে ডাক্তারির থেকে বেশি উপার্জন করা যায়। ব্যস, অমনি তিনি ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে ফুলটাইম আর্কিয়োলজিস্ট হয়ে গেলেন।

‘১৮৩২ সালে সাকারার সেই বিখ্যাত স্টেপ পিরামিডের উত্তরে ঢিল ছোড়া দূরত্বে কাজ করছিলেন ফিলিবার্তো। তখনই একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ে ওঁর। বালির মাঝখান থেকে জেগে আছে একটা পাথরের মাথা। আশেপাশের বালি সরাতেই বেরিয়ে পড়ল স্ফিংসের গোটা শরীর। চারপাশের আরও বালি সরাতে সরাতে সামনে আসতে থাকল একের পর এক আরও স্ফিংসের মূর্তি, যেন একটা রাস্তার দু-পাশে সারি দিয়ে রাখা আছে ওদের।’

‘এটাই কি সেই রাস্তা যেটা সাকারার সেরাপিয়ামের সঙ্গে জুড়ত মেমফিসের তাহ-এর মন্দিরকে !’

‘একদম ঠিক ধরেছ। ফিলিবার্তো আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন অ্যাভিনিউ অফ স্ফিংস। কিন্তু শখের এই আর্কিয়োলজিস্টের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা বিশেষ ছিল না। তাই বুঝতে পারেননি যে এটাই সেরাপিয়ামে যাওয়ার রাস্তা। তিরিশটা মতো স্ফিংসের মূর্তি ওখান থেকে তুলে নিয়েই ফিলিবার্তো খুশি হয়ে গিয়েছিলেন। সেই তিরিশটা স্ফিংসের বােরাখানা কিনে নিয়েছিলেন ইজিপ্টের বেলজিয়ান কনসাল জেনারেল সেসিনা পাশা। ছ-টা মূর্তি কিনেছিলেন দেশেরই কিছু ধনকুবের। ১৮৪৪-এ আর বাকি বারোটা মূর্তি কিনেছিল ব্রিটিশ সরকার।’

‘তাহলে এপিস বুলের সমাধির কী হল?’

‘আসছি সেই কথাতেই। ১৮৫০ সালে ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে একজন তরুণ আর্কিয়োলজিস্টকে পাঠানো হয় মিশরে। লক্ষ্য ছিল কোপটিক ভাষায় লেখা কিছু প্যাপিরাস মিউজিয়ামের জন্য নিয়ে আসা। লম্বা-চওড়া চেহারার মুখে হালকা দাড়িওয়ালা এই আর্কিয়োলজিস্টের নাম ছিল অগাস্ট মারিয়েতে। 

‘মারিয়েতে ইজিপ্টে এসে মাসকয়েক কাটানোর পরেই বুঝলেন কোপ্টিক প্যাপিরাসের সন্ধান কেউ দিতে পারছে না। এদিকে দেশে খালি হাতে ফেরাটাও বোকামির কাজ হবে। তখন একদিন ভাগ্য গেল খুলে।

image150.jpg

মারিয়েতে

‘সেসিনা পাশার প্যালেসে একদিন ডিনারের নেমন্তন্ন ছিল মারিয়েতের। সেদিন সন্ধেবেলায় পাশার বাগানে ঘোরার সময়ে ওঁর নজর পড়ে বাগানে রাখা বারোটা স্ফিংসের ওপরে। একটু ভালো করে পরীক্ষা করেই মারিয়েতে বুঝতে পেরে যান এই স্ফিংস সাকারার হারিয়ে যাওয়া সেরাপিয়ামের রাস্তারই। পাশার থেকে ফিলিবার্তোর ঠিকানা নিয়ে দেখা করেন ওর সঙ্গে। তারপরে ১৮৫০ সালের পয়লা নভেম্বর খোঁড়া শুরু করলেন ঠিক সেই জায়গা থেকে যেখানে ফিলিবার্তো খুঁজে পেয়েছিলেন প্রথম স্ফিংসের মূর্তি।

image151.jpg

‘এক মাসের মধ্যে মারিয়েতে খুঁজে পেয়ে গেলেন সেরাপিয়ামের ভিত! আর তার নীচেই ছিল এপিস বুলের সমাধি!

‘মারিয়েতে এখানে একটা ভুল করেন, বুঝলে। তাড়াহুড়ো করে সমাধির ভেতরে ঢোকার জন্য এক্সপ্লোসিভ দিয়ে সমাধির বাইরের দরজা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এতে সমাধির ভেতরের সিলিংয়ের একটা অংশ ভেঙে পড়ে। দেওয়ালের অনেক কারুকার্য খসে পড়ে। মারিয়েতে সমাধিতে ঢোকার পরে লম্বা সেই গ্যালারির দুই পাশে মোট চব্বিশটা ঘর খুঁজে পান। প্রতিটা ঘরে রাখা ছিল একটা করে বিশাল পাথরের তৈরি কফিন, যার এক একটার ওজনই প্রায় ১০০ টন! কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার ছিল এই যে, প্রতিটা কফিনই ছিল ফাঁকা।’

‘অ্যাঁ! ফাঁকা!! ষাঁড়ের মমি গায়েব!’

image152.jpg

প্রতিটা ঘরে রাখা পাথরের তৈরি বিশাল কফিন

‘হ্যাঁ, ভাই। মিশরের অন্যান্য সমাধির মতো এতেও তো বহুবার ডাকাতি হয়। ডাকাতরা কফিনগুলো থেকে চেঁছেপুঁছে সব নিয়ে গিয়েছিল। সেইসময়েই খুব সম্ভবত মমিগুলোকেও বের করে নিয়ে নষ্ট করে ফেলে। তোমাকে আগে বলেছিলাম মনে আছে নিশ্চয়, যে, অনেক সময়েই মমিগুলো ডাকাতদের মশালের জ্বালানির কাজ করত। এপিস বুলের মমিরও সেই হাল হয়েছিল খুব সম্ভবত। তুমি এখন যেমন হতাশ হলে শুনে, ঠিক তেমনই হতাশ হয়েছিলেন অগাস্ট মারিয়েতে। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। আর তার পুরষ্কারও পেয়েছিলেন।

‘সমাধির একদম শেষপ্রান্তে এসে একটা লুকোনো করিডোরের মধ্যে একজোড়া অক্ষত ষাঁড়ের মমি খুঁজে পান মারিয়েতে। সেখানে ডাকাতদের হাত পড়েনি। সেই জায়গায় ঢুকেই চমকে ওঠেন তিনি। কবরের মেঝেতে বালির ওপরে পায়ের ছাপ। তিন হাজার বছর পুরোনো। খুব সম্ভবত যারা মমি দুটোকে সমাধিস্থ করার জন্য এনেছিল তাদেরই। সেই এপিস বুলদের মমির গায়ে ছিল সোনার অলংকার, পরজন্মে এদের সুবিধার জন্য বড়ো বড়ো জারে রাখা ছিল শস্য। কবরের দেওয়ালে খোদাই করা ছিল ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস আর খায়েমওয়াসেতের নাম। এই মমিগুলো এখন রাখা আছে কায়রোর এগ্রিকালচার মিউজিয়ামে। মারিয়েতে এপিস বুলের একটা বিশাল বড়ো পাথরের মূর্তি নিয়ে যান দেশে। সেটা এখনও ল্যুভর মিউজিয়ামে রাখা আছে।’

‘ফ্যাসিনেটিং স্টোরি, সত্যি!’

‘তা আর বলতে, মিশরের ইতিহাসে এমন আরও কত কত গল্প যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই। তবে আরও ফ্যাসিনেটিং একটা কথা বলি তোমায়। ডাক্তার ফিলিবার্তো বােরাটা স্ফিংস ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে বিক্রি করেছিলেন মনে আছে?’

‘হ্যাঁ, বললেন তো।’

‘তার একটাও কিন্তু ইংল্যান্ডে পৌঁছোয়নি।’

‘তাহলে কোথায় গেল?’

ভবেশদা এবারে সেই ট্রেডমার্ক হাসিটা হেসে বললেন,

‘ভারতে, স্যার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওগুলোকে এদেশে পাঠায়। আরও ভালো করে বলতে গেলে পাঠায় দেশের রাজধানীতে।’

‘রাজধানীতে? তখন তো রাজধানী… কলকাতা!!’

‘ঠিক, ভাই। তার একটা স্ফিংসই দেখতে পাবে ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে গেলে।’

‘তাহলে বাকি এগারোটার কী হল?’

‘সেটাই রহস্য, ভায়া। বাকি এগারোটার কী হল সেটা কেউ জানে না!’

image153.jpg

ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের স্ফিংস

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *