১৮. সাইফুল ইসলাম ভোরবেলা গলা সাধে

সাইফুল ইসলাম ভোরবেলা গলা সাধে। তার গলা ভালো। গানের মাষ্টারদের মতো কর্কশ এবং শ্লেষ্ম-জড়ান নয়। চৌধুরী সাহেব সাইফুল ইসলামকে সহ্য করতে না পারলেও ভোরবেলায় তার ঘরের সামনে দিয়ে হাঁটার সময় তাঁর কান উত্তর্ণ হয়ে থাকে। এবং নিজের মনেই বলেন–মন্দ না। আজও শুনলেন–

যা যারে কাগণ্ডয়া পিয়াকে পাস
কহিও খবরিয়া নৈ নহি ঘড়ি পল উন বিন…

চৌধুরী সাহেবের হাঁটার গতি কমে গেল। মনে-মনে বললেন-বাহু, ব্যাটা তো ভালো গাইছে। গান থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। খুট করে দরজা খুলে সাইফুল ইসলাম বের হয়ে এল। তার চোখ লাল। মুখ শুকিয়ে লম্বাটে হয়ে গেছে। সে দ্রুত এগিয়ে এল চৌধুরী সাহেবের দিকে। চৌধুরী সাহেব লক্ষ করলেন সে আসছে খালি-পায়ে।

মালিকুম চৌধুরী সাব।

ওলায়কুম সালাম।

আমি জানালা দিয়ে দেখলাম আপনি আসছেন। একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে।

তোমার শরীর খারাপ নাকি?

জ্বি। রাতে আমার ঘুম হয় না।

যা গরম, ঘুম না হওয়াই স্বাভাবিক।

চৌধুরী সাব, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।

বল।

একটু ভেতরে এসে যদি বসেন।

বল, এইখানেই বল।

সাইফুল ইসলাম বিড়বিড় করতে লাগল। চৌধুরী সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, বিষয়টা কী?

চৌধুরী সাব, গতকাল রাত্রে আমি জুমাঘরের পাশ দিয়ে আসছিলাম। মনসুরের যে কবর আছে তার ধার দিয়ে আসবার সময় একটা জিনিস দেখলাম।

কি জিনিস?

দেখলাম মনসুর বসে আছে কবরের পাশে। আমাকে দেখে সে হাসল।

কে বসে আছে বললে?

মনসুর।

কি ছাগলের মতত কথাবার্তা

সাইফুল ইসলাম বিড়বিড় করতে লাগল। চৌধুরী সাহেব ভারি গলায় বললেন, তুমি ডাক্তার-ফাক্তার দেখিয়ে ঘুমের ওষুধ-টষুধ খাও।

চৌধুরী সাহেব আর দাঁড়ালেন না। তাঁর অবশ্যি ব্যাপারটি ভালো করে শোনার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সময় নেই। ময়মনসিংহ থেকে এসপি সাহেব এসেছেন গত রাতে। তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ডাকবাংলায়। তাঁর খাবার-দাবার চৌধুরী সাহেবের বাড়ি থেকে যাচ্ছে। গত রাতে কথা হয়েছে চৌধুরী সাহেব সকালবেলা ডাকবাংলায় এসে চা খাবেন। দেরি করা যায় না। এসপি সাহেব লোকটিকে একটু কড়া ধাঁচের বলে মনে হয়েছে। সিএসপি অফিসারদের মতো। কিন্তু লোকটি দারোগা থেকে এসপি হয়েছে। এরা ভোঁতা ধরনের হয়ে থাকে, কিন্তু এ সেরকম নয়।

এসপি সাহেব একটা লুঙ্গি এবং হাতকাটা পাঞ্জাবি পরে বারান্দায় চেয়ারে, বসেছিলেন। টুর করতে আসা এসপি জাতীয় অফিসাররা লুঙ্গি পরে বসে থাকলে মানায় না। চৌধুরী সাহেব হাসিমুখে বললেন, কখন উঠলেন স্যার?

সকালেই উঠেছি।

রাতে ঘুম ভালো হয়েছিল?

হ্যাঁ।

খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা হয় নাই তো স্যার?

খানিকটা হয়েছে। পোলাওটোলাও এখন খেতে পারি না। ইনডাইজেশন হয়।

স্যার, এখন থেকে সাদা ভাত পাঠাব।

ভাত পাঠানর তো আর দরকার নেই। আমি এগারটার ট্রেনে চলে যাচ্ছি।

চৌধুরী সাহেব অবাক হয়ে বললেন, রাত্রে আপনার জন্যে একটু গান-বাজনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

না, রাত্রে থাকব না।

তদন্ত শেষ হয়ে গেছে নাকি স্যার?

কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করব। পোস্ট মার্টেম রিপোর্টটা দেখলাম। নরম্যাল ডেথ।

এসপি সাহেব চায়ে চুমুক দিতেদিতে বললেন, দেশে চোর-ডাকাতের সংখ্যা কচুগাছের মততা বাড়ছে। এরা কিভাবে মরল, সেই সব নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। আমি তো ভেবেছিলাম মিছিলটিছিল হবে, থানা ঘেরাওটোও হবে।

নীলগঞ্জ খুব ঠাণ্ডা জায়গা স্যার।

তাই দেখলাম। ঠাণ্ডা জায়গা এক বার গরম হয়ে গেলে কিন্তু মুশিবত হয়।

এসপি সাহেব সঙ্গের পিয়নটিকে সিগারেট দিতে বললেন। চৌধুরী সাহেব লক্ষ করলেন সাধারণ দেশী সিগারেটের একটি প্যাকেট দেওয়া হয়েছে। এর মানে কী? তিনি নাস্তার সঙ্গে দু প্যাকেট ফাইভ ফিফটি ফাইভ দিয়ে দিয়েছেন। সিগারেট মেরে দিচ্ছে নাকি? কী সর্বনাশ! ব্যাপারটা খোলাসা হওয়া প্রয়োজন। সরাসরি জিজ্ঞেস কাটা ঠিক হবে কিনা চৌধুরী সাহেব বুঝতে পারলেন না। এসপি সাহেব হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, আমি একটা বেনামী চিঠি পেয়েছি।

চৌধুরী সাহেব নড়েচড়ে বসলেন।

চিঠিতে বলা হয়েছে মনসুর নামের লোকটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। বেনামী চিঠির কোনো গুরুত্ব আমি দিই না।

চিঠিটা একটু দেখব স্যার?

না। আপনি দেখবেন কেন?

দেখলে বুঝতে পারতাম কে লিখেছে?

তার কোন দরকার নেই।

চৌধুরী সাহেব দেখলেন দবির মিয়া হনহন করে আসছে। তিনি বললেন, দবির মিয়াকে আসতে বলেছেন নাকি স্যার?

দবির মিয়া কে?

মনসুর থাকত যার বাড়িতে।

হ্যাঁ, বলেছি। আপনি এখন তাহলে উফ চৌধুরী সাহেব। আর শোনেন, দুপুরে ভাত পাঠাবেন না।

চৌধুরী সাহেব অস্বস্তি নিয়ে উঠে পড়লেন। সিগারেটের কথাটা তাঁর আর জিজ্ঞেস করা হল না। সাইফুল ইসলাম গলা সাধছে।

যা যারে কাগওয়া, পিয়াকে পাস।
কহিও খবরিয়া চৈন নহি ঘড়ি পল উন বিন…।

ব্যাটা গায় মন্দ না। দাঁড়িয়ে শুনতে ইচ্ছে করে। তিনি দাঁড়ালেন না, বাড়ি চলে এলেন। বসার ঘরে দু-তিন জন লোক বসে আছে। নিশ্চয়ই কোনো দরবাররবার। চৌধুরী সাহেব বলে দিলেন তাঁর শরীর ভালো নয়। এক জনকে পাঠালেন দবির মিয়ার দোকানে, অবশ্যি যেন দবির তাঁর সঙ্গে দেখা করে।

 

মনসুর আলি আপনার দোকানে কাজ করত।

জ্বি স্যার।

সে যে চোর, সেটা জানতেন?

জ্বি না। পরে জানলাম।

মনসুর ধরা পড়ার পরে চুরি ডাকাতি শুনলাম বন্ধ।

জি স্যার, এখনো হয় নাই।

দারোগা সাহেবের কাছে শুনলাম আপনার ছোট ভাই এক জন এসেছে।

ভাই না স্যার, আমার শ্যালক।

সে এখন করছে কী?

দবির মিয়া কপালের ঘাম মুছে শুকনো গলায় বলল, সে একটা নির্দোষী লোক। লোকজনের ষড়ুযন্ত্র এই অবস্থা স্যার।

এসপি সাহেব কিছু বললেন না। দবির মিয়া বলল, ছেলেটার জীবনটা নষ্ট হয়েছে স্যার। শুধু তার একার না, আমারও নানান ঝামেলা হচ্ছে। বড় মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না।

মেয়ের বিয়ের সাথে এর কী সম্পর্ক।

যে বাড়িতে এমন খুন-খারাবি করার লোক আছে সে বাড়িতে বিয়ে-শাদি কেউ করতে চায় না।

এসপি সাহেব আচমকা প্রসারে চলে গেলেন।

এই চিঠিটা কি আপনার শালার লেখা?

দবির মিয়া অবাক হয়ে চিঠিটা পড়ল।

মাননীয় এসপি সাহেব সমীপেবু,

জনাব,

বিনীত নিবেদন এই যে, গত বুধবার দিবাগত রাত্রে নীলগঞ্জ থানায় মনসুর আলি নামক এক নিরপরাধ ব্যক্তিকে খুন করা হইয়াছে। এই বিষয়ে আপনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। নচেৎ ফল খারাপ হইবে। আমরা ঘাস খাইয়া জীবন ধারণ করি না। থানা পুলিশকে নীলগঞ্জের লোকেরা ভয় পায় না। পূর্বেও এই অঞ্চলে এই জাতীয় অন্যায় হইয়াছে। থানার যোগসাজসে নিরাপরাধ ব্যক্তিকে খুনের দায়ে জেল খাটিতে হইয়াছে।

 

দীর্ঘ চিঠি। দবির মিয়া চিঠিটা দু বার পড়ল। এসপি সাহেব আবার বললেন, চিঠিটা কি আপনার শালার লেখা?

স্যার বলতে পারলাম না। তার হাতের লেখা আমি চিনি না। তবে…?

তবে কি?

সে এরকম চিঠি-ফিঠি লিখবে না স্যার। সে গোঁয়ার ধরনের।

দবির মিয়া অত্যন্ত চিন্তিত মুখে দোকানে গেল। বরকত আলি কাশবাক্স সামনে নিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি যেন দোকানটা তারই। সে টেনেটেনে বলল, আজকেও আসতে দেরি করছেন। সকাল সকাল দোকান খোলা দরকার।

দবির মিয়া জবাব দিল না।

চাইর জন কাস্টমার ফিরত গেছে। আমি বলছি ঘন্টাখানিক পরে আসতে।

ভালো করছেন।

কাস্টমার হইল আপনের হাতের লক্ষ্মী। কাস্টমার ফিরত যাওয়া খুব অলক্ষণ।

দবির মিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, আপনার কাজ শেষ হয়েছে?

কোন কাজের কথা কন?

দাবোগা সাহেবের সাথে দেখা করার কথা ছিল যে।

ও, সেইটা। ওসি সাহেব চার-পাঁচ দিন পরে যাইতে কইছেন। এখন থানায় খুব ঝামেলা যাইতেছে।

আরো চার-পাঁচ দিন থাকবেন তাহলে?

জ্বি।

আমার এখানে না, অন্যখানে থাকেন গিয়ে।

বরকত আলি স্তম্ভিত হয়ে গেল।

যামু কই আমি ভাইসাব?

যেখানে ইচ্ছা সেখানে যান।

বিস্মিত বরকত আলি চা খেতে গেল নাড়ুর দোকানে। চা খেয়ে মাথাটা ঠাণ্ডা করা দরকার।

বেলা প্রায় দশটা হয়েছে। সিক্সটিন ডাউনের আসবার সময়। নান্টুর দোকানে কামারদের ভিড় এই সময় সবচেয়ে বেশি। কাজেই সাইফুল ইসলাম যখন এসে বলল, নান্টু, একটা জরুরী কথা আছে আমার। একটু বাইরে আসা তখন সেসঙ্গত। কারণেই বিরক্ত হল।

পরে আসেন।

পরে না, এখন।

কি, টাকাপয়সা দরকার?

সাইফুল ইসলামকে নান্টুর কাছ থেকে প্রায়ই টাকাপয়সা ধার করতে হয়।

না, টাকাপয়সা না।

নান্টু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে দোকানের বাইরে এসে দাঁড়াল।

বলেন, কি বিষয়?

সাইফুল ইসলাম থেমেথেমে বলল, আমি জুমাঘরের পাশ দিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ দেখি মনসুর তার কবরের পাশে বসে আছে।

কারে দেখছেন?

মনসুর। মনসুর আলিকে।

নান্টু অবাক হয়ে ঢাকাল, এই সব কী কন!

সত্যি। আত্মার কসম।

সাইফুল ইসলাম নান্টুর হাত চেপে ধরল। গাড়ি আসবার সময় হয়ে গেছে। এ সময় কীসব বাড়তি ঝামেলা।

আসেন ভিতরে, চা খান।

সাইফুল ইসলাম চা খাবার জন্য ভেতরে গেল না। এসপি সাহেবের সম্মানে গান-বাজনার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তার। এখনন তার কিছুই করা হয় নি। গানবাজার আয়োজন কোথায় হয়েছে তা জানা দরকার। ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন, কিন্তু থানায় যেতে তার সাহসে কুলাচ্ছে না।

 

চৌধুরী সাহেব খবর পেলেন এসপি সাহেব এগারটার গাড়িতে যাচ্ছেন না। রাতে গান-বাজনার আয়োজন করা হয়েছে। চৌধুরী সাহেবের বাড়িতেই গান-বাজনা হবে। সময় অল্প। স্থানীয় বিশিষ্ট সব লোকজনদের খবর দিতে হয়। চৌধুরী সাহেব অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *