১৮. সংস্কৃতি

অষ্টাদশ অধ্যায় – সংস্কৃতি

ক. শিল্প

১. চিত্রকলা

সাহিত্যরচনার প্রায় সব বিভাগেই রবীন্দ্রনাথ যেমন স্বকীয় প্রতিভাবলে যুগান্তর আনয়ন করিয়াছেন, চিত্রকলা সম্বন্ধে তাঁহার ভ্রাতুস্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৭১-১৯৫১) সম্বন্ধেও অনেকটা সে-কথা বলা চলে। অবনীন্দ্রনাথের বাল্যজীবন ও সাধারণভাবে প্রথম যুগের শিল্পরীতির আদর্শ এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে আলোচিত হইয়াছে। ১৮৯৮ সনে অবনীন্দ্রনাথ কলিকাতা সরকারী শিল্প বিদ্যালয়ের (Government School of Art) সহকারী অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হন, কিন্তু অধ্যক্ষ হ্যাঁভেল (Havell) সাহেব পদত্যাগ করিবার অল্পকাল পরেই তিনিও পদত্যাগ করেন। ১৯৪২ সনে অবনীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর আচার্য পদে নিযুক্ত হন এবং কিছুকাল তথায় বাস করেন। যদিও অবনীন্দ্রনাথ চিত্রশিল্পী বলিয়াই প্রসিদ্ধ, তথাপি সাহিত্যরচনায়ও তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখাইয়াছেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগীশ্বরী অধ্যাপকরূপে তিনি যে বক্তৃতা করেন (১৯২১) তাহাও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হইয়াছে।

এই গ্রন্থের আলোচ্য যুগের প্রারম্ভেই অর্থাৎ ১৯০৫ সনে অবনীন্দ্রনাথ ভারতীয় শিল্পের নবজন্মদাতা’-রূপে স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিলেন। কারণ, আঠারো ও উনিশ শতকে বাংলায়, তথা ভারতে চিত্রকলা অবনতির চরম সীমায় পৌঁছিয়াছিল। এই নবজাগরণের প্রত্যক্ষ ফল অথবা নিদর্শনস্বরূপ নূতন দুইটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করা যায়। প্রথম-১৯০৭ সনে প্রতিষ্ঠিত বিচিত্র সভা, দ্বিতীয়–১৯১৩ সনে প্রতিষ্ঠিত ‘অরিয়েন্টাল আর্ট সোসাইটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতে। ১৯১২ সনে লণ্ডনে ও প্যারিসে এবং ১৯১৯ সনে জাপানের রাজধানী টোকিও শহরে অবনীন্দ্রনাথ এবং তাঁহার শিষ্য ও অনুবর্তীদের ছবির প্রদর্শনী হয়।

১৯২০ সনের পরে অবনীন্দ্রনাথের শিল্প নব নব রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এ সম্বন্ধে তাঁহার একজন জীবনচরিতকার লিখিয়াছেন, “১৯২০-১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে অবনীন্দ্রনাথের শিল্প যত বৈচিত্র্যময় হইয়া দেখা দিয়াছিল এমন- পূর্বে বা পরে, আমরা লক্ষ্য করি না। …১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দ হইতে অবনীন্দ্রনাথের শিল্প নূতনরূপে আত্মপ্রকাশ করে। রেখা, বর্ণ, রূপ–তিনের সমন্বয়ে অবনীন্দ্রনাথ সরল রূপসৃষ্টির প্রয়াস করিয়াছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের রচনা যে-পরিমাণে মূর্তিধর্মী তাহার সাদৃশ্য পূর্বের রচনাতে আমরা দৈবাৎ পাই”।[৩]

অবনীন্দ্রনাথের শিল্পপ্রতিভা দ্বারাই যে ভারতীয় শিল্পের নবজাগৃতি সম্ভব হইয়াছে ইহা সর্বদিসম্মত বলিয়া গ্রহণ করা যায়। কিন্তু, এই প্রতিভার প্রকৃতি ও স্বরূপসম্বন্ধে মতের অনৈক্য দেখা যায়। এক দলের মতে তিনি ভারতীয় প্রাচীন চিত্রকলার পারম্পর্য রক্ষা করিয়া ইহার পুনরুদ্ধারের পথ প্রশস্ত করিয়াছেন, অপরদিকে আর এক দল বলেন, “তাহার শিল্প একান্তভাবে বাংলার অথবা একান্তই ভারতীয় পরম্পরা-বিবর্তন, একথা বলা চলে না। আন্তর্জাতিক পটভূমিতে অবনীন্দ্রনাথই প্রথম ভারতীয় শিল্পী। শিল্পের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি উন্মোষিত হইয়াছে সর্বপ্রথম অবনীন্দ্রনাথের। ওমর খৈয়াম, সাহাজাদপুর-দৃশ্যাবলী, আরব্য আখ্যানচ্ছবি, অথবা কবিকঙ্কন চণ্ডীর ছবি–এইসব রচনাতে সাহিত্যগত ভাব প্রকাশের চেষ্টা অপেক্ষা বস্তুনিষ্ঠ রূপসৃষ্টির সাফল্যই বিশেষ দ্রষ্টব্য, আর তাহাই ছিল শিল্পের লক্ষ্য।[৪] এ-সম্বন্ধে এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে কিছু আলোচনা করিয়াছি। সাধারণ ঐতিহাসিক গ্রন্থে ইহার বিস্তৃত আলোচনা সম্ভবপর নহে।

অবনীন্দ্রনাথের শিষ্য ও অনুবর্তীদের মধ্যে নন্দলাল বসু (১৮৮২-১৯৬৬) সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি পাঁচ বৎসর কলিকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্রহিসাবে অবনীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন এবং এই সময়ের মধ্যে ‘শিব সতী’ ছবিখানি আঁকিয়া ভারতীয় প্রাচ্যকলামণ্ডলীর প্রথম প্রদর্শনীতে ৫০০ টাকা পুরস্কার পান (১৯০৮)। ছাত্রাবস্থায় অঙ্কিত কর্ণের সূর্যস্তব’, ‘সতী’, ‘সুজাতা’ প্রভৃতি বিখ্যাত ছবিগুলিতে তাঁহার শিল্পপ্রতিভার প্রকর্ষ ও বৈশিষ্ট্য প্রকটিত হয়। ১৯০৯-১১ সনে যখন লেডী হ্যাঁরিংহ্যাম অজন্তা গুহাচিত্রের অনুলিপি করেন, তখন নন্দলাল তাঁহার সহযোগী ছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ আর্ট স্কুল ছাড়িয়া আসিবার পর নন্দলালও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতে তাঁহার সহযোগীরূপে চিত্রাঙ্কন করেন। এখানে পূর্বোল্লিখিত বিচিত্রা’ ক্লাবে তিনি অসিত হালদার, মুকুল দে ও সুরেন্দ্রনাথ কর প্রভৃতির সঙ্গে শিল্পশিক্ষা দান করেন। এইখানে একজন জাপানী শিল্পী কিছুদিন অতিথিরূপে ছিলেন। নন্দলাল তাঁহার নিকট হইতে প্রাচ্যের কালি-তুলির নানা আঙ্গিক শিক্ষা করেন। তিনি প্রাচীন পটের আদর্শে পট আঁকেন এবং তিনবার ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে সভামঞ্চ ও তোরণ অলংকৃত করিয়া বিশেষ প্রশংসা লাভ করেন। হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনের (১৯৩৭) ৮৬ খানি এই শ্রেণীর চিত্রালংকার ‘হরিপুরা পট’ নামে খ্যাত। ১৯২১ সনে নন্দলাল প্রসিদ্ধ বাঘ’-গুহার দেওয়ালে অঙ্কিত নষ্টপ্রায় চিত্রগুলির অনুলিপি প্রস্তুত করেন।

কক্ষের দেয়ালে চিত্র অঙ্কন নন্দলালের একটি বৈশিষ্ট্য। তিনি শ্রীনিকেতনে (১৯৩০) এবং শান্তিনিকেতনের গ্রন্থাগারে (১৯৩২) ও ‘চীনা ভবনে’ ভিত্তিচিত্র অঙ্কিত করেন। তিনি ১৯৪৩ সনে বরোদার একটি মন্দিরের চারিদিকের দেয়ালে পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক চিত্র অঙ্কিত করিয়া যশোলাভ করেন। স্বাধীন ভারতের সংবিধান (constitution)-গ্রন্থের যে সচিত্র সংস্করণ প্রকাশিত হয় তাহা নন্দলালের চিত্রে অলঙ্কৃত।

এই সমুদয় চিত্রালঙ্কার এবং তাহার অঙ্কিত চিত্রাবলী, বিশেষতঃ ‘উমার ব্যথা ও ‘উমার তপস্যা’ (১৯২১), ‘পোয়ে নৃত্য’ (১৯২৪), নটীর পূজা’ (১৯২৭) প্রভৃতি চিত্র হইতে ইহা অনুমান করা অসঙ্গত হইবে না যে, “প্রকরণ-পদ্ধতি, ভাবভঙ্গী, রূপরসের বৈচিত্র্য অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় যত, নন্দলালের শিল্পসৃষ্টিতে তাহা হইতে বেশি বই কম হইবে না।”[৫]

শেষজীবনে নন্দলাল প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্থাৎ পরিচিত মনুষ্যজীবন ও প্রাকৃতিক দৃশ্যই তাঁহার চিত্রের বিষয়বস্তুরূপে গ্রহণ করেন। নন্দলালের একজন জীবনী-লেখকের নিম্নলিখিত মন্তব্যটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য : “অবনীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল পরস্পরের পরিপূরক। অতিশয় সংক্ষেপে বলা যায়, পাশ্চাত্ত্য চিত্ররীতির প্রতিষ্ঠাভূমি হইতে প্রাচ্য রূপকলার সন্ধানে যাত্রা করেন অবনীন্দ্রনাথ; নন্দলাল যাত্রা করেন ভারতীয় ধ্রুবচিত্র-রীতি তথা মূর্তিকলার সহজ অধিকারের ক্ষেত্র হইতে। কালে চীনা, জাপানী, পাশ্চাত্ত্য, মিশরীয়, প্রাগৈতিহাসিক, নানা জাতির, নানা যুগের রীতিপদ্ধতির মর্মে প্রবেশ করেন এবং উপযোগী গুণগুলি আত্মসাৎ করেন। গুরু-শিষ্য উভয়েরই প্রতিভাতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্তের মিলন ঘটিয়াছে ভিন্নভাবে। আপন আপন রূপকৃতিতে দেশ ও কালের খণ্ডতা ও ক্ষুদ্রতা উভয়েই পার হইয়া গিয়াছেন।[৬]

অবনীন্দ্রনাথের শিষ্যদের মধ্যে নন্দলাল বসুর পরই অসিতকুমার হালদারের (১৮৯০-১৯৬৪) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহার মাতা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্রী (অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয়ী) এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতেই তাহার জন্ম হয়। কিশোরবয়সেই তিনি অবনীন্দ্রনাথের নিকট চিত্রবিদ্যা শিক্ষা করেন। তাঁহার অঙ্কিত চিত্রের সৌকুমার্য ও কাব্যগুণের প্রাধান্যহেতু তাঁহাকে বলা হইত “রংয়ের কবি” (colour poet)। রাসলীলা’, যশোদা ও কৃষ্ণ’, ‘অগ্নিময়ী সরস্বতী’ প্রভৃতি চিত্রগুলির জন্য তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। নন্দলাল বসুর সঙ্গে তিনিও অজন্তা গুহার চিত্রগুলির অনুলিপি প্রস্তুত করেন ও লেডী হ্যাঁরিংহামকে সাহায্য করেন (১৯০৯-১১)। বাঘ’-গুহা ও ‘যোগীমারা’-গুহার চিত্রাবলীর অনুলিপি প্রণয়নেও তিনি অন্য শিল্পীদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। এই সমুদয়ের ফলে তিনি ‘অজন্তা এবং বাগগুহা ও রামগড় এই দুইখানি গ্রন্থ অতি সহজ ভাষায় রচনা করিয়া বাঙালীকে এই সমুদয় অমূল্য চিত্রের সহিত পরিচিত করেন।

অবনীন্দ্রনাথের আর-একজন শিষ্য সুরেন্দ্রনাথ কর (১৮৯৪-১৯৭০) বহুকাল শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ছিলেন এবং অবনীন্দ্রের অনুকরণে ‘ধোওয়া ছবি’ (wash painting) এবং মিনিয়েচার (miniature) ছবির জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। স্থাপত্যকর্মেও তাঁহার দক্ষতা ছিল। শান্তিনিকেতনে কয়েকটি ভবনের এবং কলিকাতায় দেশবন্ধু স্মৃতিমন্দির’ প্রভৃতি অনেক সৌধের সাজসজ্জা ও অলংকরণ তাঁহার শিল্পপ্রতিভার পরিচায়ক।

উল্লিখিত তিনজন শিল্পী ব্যতীত অবনীন্দ্রনাথের শিষ্য ও অনুবর্তী আরও কয়েকজন চিত্রশিল্পী তাহার দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া বঙ্গদেশে (এবং বাহিরে) চিত্রশিল্পের নবযুগকে সমৃদ্ধিশালী করিয়াছেন। ইহাদের মধ্যে সমরেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শৈলেন্দ্রনাথ দে, প্রমোদ চট্টোপাধ্যায়, মুকুল দে প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি পরলোকগত যামিনী রায়ও একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ছিলেন।

পূর্বোক্ত চিত্রশিল্পী-সম্প্রদায় হইতে সম্পূর্ণ ভিন্নপ্রকৃতির শিল্পী ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠভ্রাতা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৭-১৯৩৮)। কিছুদিন তিনি তকালে সুপরিচিত হরিনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট শিক্ষালাভ করেন এবং জাপানী শিল্পী ইওকোহামা টাইকানের দ্বারাও প্রভাবান্বিত হন। কিন্তু, তিনি স্বকীয় প্রতিভাদ্বারা যে নূতন পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন তাহা সম্পূর্ণ তাহার নিজস্ব এবং তাহার অনুগামী অনুবর্তীও নাই বলিলেই চলে। ইউরোপীয় জলরঙ (water colour) ও জাপানী কালি-তুলির কাজ–এই দুই পদ্ধতির সংযোগের দ্বারা গগনেন্দ্রনাথ এক নূতন রচনারীতি উদ্ভাবন করেন। ভারতে কালি-তুলি কাজের তিনি পথপ্রদর্শক। তিনি ভারতীয় আঙ্গিকের অনুসরণ করেন নাই।

গগনেন্দ্রনাথ ছিলেন বাস্তববাদী শিল্পী। তাঁহার ব্যঙ্গচিত্র রচনা এককালে খুবই জনপ্রিয় ছিল এবং বাংলা সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হইত। প্রধানতঃ সমসাময়িক রাজনীতি ও হিন্দুসমাজের উচ্চশ্রেণীর জীবনযাত্রা ও রীতিনীতিই তাঁহার ব্যঙ্গের প্রধান লক্ষ্যস্থল ছিল। তাঁহার ব্যঙ্গচিত্রগুলি বজ্র’ (১৯১৭), ‘অদ্ভুত লোক’ (১৯১৭) ও ‘নবহুল্লোড় (১৯২১)–এই তিনখানি গ্রন্থে মুদ্রিত হইয়াছে। ব্যঙ্গচিত্র ছাড়াও দৃশ্যচিত্র, বর্ণনামূলক চিত্র, প্রতিকৃতি, বিমূর্ত চিত্র ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়মূলক অঙ্কিত চিত্র তাঁহার বহুমুখী প্রতিভার পরিচায়ক।

২. স্থাপত্য

বিংশ শতকের পূর্বার্ধে কেবলমাত্র দুইটি সৌধকে উচ্চাঙ্গের শিল্পশ্রেণীভুক্ত করা যাইতে পারে। কালক্রমানুসারে প্রথম, কলিকাতার ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, দ্বিতীয়, কলিকাতা হইতে দশ মাইল উত্তরে গঙ্গাতীরে অবস্থিত বেলুড় মঠের শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির।

(ক) ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল

মহারানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর (১৯০১) পর বড়লাট লর্ড কার্জন একটি স্মৃতিসৌধ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন এবং প্রধানতঃ এদেশীয় রাজন্যবর্গের দানে ইহা নির্মিত হয়। Royal Institute of British Architect-এর প্রেসিডেন্ট Sir william Emerson ইহার না (plan) করেন। ইহা প্রধানতঃ Italian Renaissance-এর স্থাপত্যরীতির একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ইহা নির্মাণ করিতে প্রায় এক কোটি পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ হয়।

১৯০৪ সনে ইহার নির্মাণকার্য আরম্ভ হয় এবং ১৯২১ সনে ইহা প্রায় সম্পূর্ণ হয়, কেবল চারি কোণের গম্বুজ চারিটি ১৯৩৪ সনে বসানো হয়। আগ্রার বিখ্যাত তাজমহল যে মাক্রানা শ্বেতপাথরে নির্মিত, এই সৌধটিও প্রধানতঃ সেই পাথরেই নির্মিত হয়, কিন্তু ইহার গঠনপ্রণালী সম্পূর্ণ ভিন্নরকমের। কেহ কেহ ইহাকে Indo European (ইন্দো-ইউরোপীয়) স্থাপত্যরীতি বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। যদিও ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পের কিছু কিছু নিদর্শন ইহাতে দেখিতে পাওয়া যায় তথাপি ইহা ইউরোপীয় পদ্ধতিতেই নির্মিত; সুতরাং ইহাকে ভারতীয় স্থাপত্য-শিল্পের নিদর্শন বলিয়া গ্রহণ করা যায় না।

সৌধটি ৩৩৩ ফুট দীর্ঘ, ২৩৮ ফুট প্রশস্ত এবং উপরিস্থিত গম্বুজসহ ১৮৪ ফুট উচ্চ। এই গম্বুজটির উপরে ব্রোঞ্জধাতুনির্মিত ১৬ ফুট উচ্চ ঘূর্ণায়মান (বিজয়লক্ষ্মী) Victory-র মূর্তি আছে। ইহার ওজন ৮০ মণেরও বেশি। সমগ্র সৌধটির আকৃতি ইংরেজি বড় ‘H’ অক্ষরের ন্যায়-ইহার দুই প্রান্তদেশ বাঁকানো কলোনেড (Colonade) দিয়া সংযুক্ত করা হইয়াছে।

উত্তরদিকের প্রধান প্রবেশদ্বার দিয়া ঢুকিলে প্রথমে যে কক্ষটিতে পৌঁছান যায় তাহাতে ইংলণ্ডের অনেক রাজা-রানীর মূর্তি আছে। ইহার ডানদিকে একটি বিশাল কক্ষে অনেকগুলি প্রসিদ্ধ চিত্র আছে। প্রথম কক্ষের বামদিকের গ্যালারিতে (Portrait Gallery) অনেক খোদিত ও অঙ্কিত মূর্তি আছে। ইহার সংলগ্ন একটি কক্ষে ভারতীয় রাজন্যবর্গের অনেক পুরানো অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শিত হইয়াছে। ডৌমের ঠিক নীচের কক্ষে (Queen’s Hall) মহারানী ভিক্টোরিয়ার মূর্তি আছে। ইহার দক্ষিণের কক্ষে (Prince’s Hall) ব্রোঞ্জ ও প্রস্তরনির্মিত অনেক মূর্তি আছে। এইরূপ বিভিন্ন কক্ষে ঐতিহাসিক চিত্র ও মূর্তি এবং ঐতিহাসিক দলিলপত্র আছে।

(খ) বেলুড় মঠের শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির [৭]

স্বামী বিবেকানন্দ দেহরক্ষার পূর্বে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের পূজার জন্য একটি বিরাট মন্দির প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা করেন এবং গুরুভ্রাতা স্বামী বিজ্ঞানানন্দজীর নিকট তাঁহার মনোভাব ব্যক্ত করেন। স্বামী বিজ্ঞানানন্দ পূর্বাশ্রমে বড় একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি স্বামীজির অনুরোধে ইহার একটি নক্সা প্রস্তুত করেন। স্বামী বিবেকানন্দ এই নটি অনুমোদন করেন। প্রায় ত্রিশ বৎসর পরে স্বামীজির এই কল্পনা কার্যে পরিণত হয়। স্বামী বিজ্ঞানানন্দ কলিকাতার বিখ্যাত মার্টিন কোম্পানীকে এই মন্দির নির্মাণের কার্যে নিযুক্ত করেন। মার্টিন কোম্পানীর স্থপতি (architect) মেজর হেরল্ড ব্রাউনের সহিত পরামর্শ করিয়া মন্দিরের না পাকাপাকিভাবে স্থির হইল। স্বামী বিবেকানন্দের অনুমোদিত নক্সার নিম্নলিখিত তিনটি বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রাখিয়া উহা প্রস্তুত হইল।

প্রথমতঃ, গর্ভমন্দিরের ছাদ হইবে গম্বুজাকৃতি (domical)। দ্বিতীয়তঃ, খ্রীষ্টীয় গির্জার মত গর্ভমন্দির ও নাটমন্দির একসঙ্গে সংযুক্ত থাকিবে। প্রাচীন ভারতীয় মন্দিরের মত এই দুই অংশের মধ্যে কোন ব্যবধান অর্থাৎ খোলা জায়গা থাকিবে

। তৃতীয়তঃ, মন্দিরটির আবরণ (architectural mouldings) ভারতীয় রীতিতে হইবে।

এই নক্সা-অনুসারে ১৯৩৫ সনের ১০ই মার্চ মন্দিরের নির্মাণকার্য আরম্ভ হইল এবং প্রায় চারি বৎসর পরে আট লক্ষ (বা ইহারও কিছু বেশি) টাকা ব্যয়ে মন্দিরটির নির্মাণকার্য শেষ হয়।

মন্দিরটি উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত। প্রশস্ত উচ্চ সোপানাবলী দিয়া উঠিয়া ছয় ফুট উচ্চ ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত এই মন্দিরে প্রবেশ করিতে হয়। প্রবেশদ্বারটি ৭৮ ফুট উচ্চ। ইহা দক্ষিণভারতের মন্দিরের গোপুরমের বাংলা সংস্করণ। প্রথমে সুদীর্ঘ নাটমন্দির এবং ইহার শেষভাগে ইহার সহিত সংযুক্ত গর্ভগৃহ। নাটমন্দিরটির ভিতরের মাপ-১৫২ ফুট লম্বা, ৭২ ফুট চওড়া ও ৪৮ ফুট উচ্চ। ইহার পর ২৬ ফুট লম্বা ও ২৬ ফুট চওড়া গর্ভমন্দির।

ইহার চারিপাশে পরিক্রমের জন্য প্রায় দশ ফুট করিয়া জায়গা রাখা হইয়াছে। সমগ্র মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে ২৩৫ ফুট, প্রস্থে ১৪০ ফুট–প্রায় ৩২,১০০ বর্গফুট।

গর্ভমন্দিরের বাহিরের দেয়াল চুনারের বেলেপাথর (sand stone) দিয়া মোড়া আছে। অর্থের অনটন হওয়ায় নাটমন্দিরের দেয়ালে তাহা করা সম্ভবপর হয় নাই। “পাথর ও imitation plaster এবং চুনার রং-ঢালা concrete-এ দেয়াল আবৃত হইয়াছে। গর্ভগৃহের মেঝে শ্বেতপাথরে এবং নাটমন্দিরের মেঝে কালোপাথরে আবৃত।”

“গর্ভগৃহের উপর কেন্দ্রস্থলে একটি বিশাল গম্বুজ এবং চারিধারে ছোট ছোট আটটি গম্বুজ ও চারিটি কক্ষ (pavilion); কেন্দ্রীয় গম্বুজটির উপরে সোনার পাতেমোড়া ধাতুনির্মিত কলসী। গম্বুজগুলি রাজপুতানার স্থাপত্যরীতি অনুসারে নির্মিত।”

“গম্বুজ-গাত্রটি সাদাসিধা না করিয়া bead (গুটিকা) এবং রোল দেওয়া হইয়াছে। দক্ষিণভারতের মন্দিরগাত্রে এইরকমের শিল্প দেখা যায়। প্রাচীন মন্দিররীতি-অনুযায়ী আমলকী ইত্যাদি দিয়া চূড়া তৈরি করা হইয়াছে। বড় গম্বুজের নীচে shallow dome আছে।”

“ইহার উচ্চতা ৬০ ফুট এবং ভূমি হইতে মন্দিরশীর্ষ ১০৮ ফুট উচ্চ। Dome-এর নির্মাণকার্যে চুনার-পাথর, ইট এবং কংক্রীট ব্যবহার করা হইয়াছে। বড় ডোমের নীচে চারিধারে খালি জায়গা ছত্রী দিয়া পূরণ করা হইয়াছে–ইহাতে বাংলা দেশের ঘরের খড়ের চালের ভাব আনিবার চেষ্টা করা হইয়াছে। বড় ডৌম এর চারিপাশে যেসব ছোট ছোট ডৌম আছে সেগুলির নীচে কার্ণিশ ও তাহার নীচে ব্র্যাকেট বসানো হইয়াছে।”

গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে মর্মরপাথরের বেদীর উপর ভাস্কর গোপেশ্বর পাল নির্মিত শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণের ধ্যানস্থ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে। নন্দলাল বসু এই বেদীটির নক্সা প্রস্তুত করেন এবং তাহার নির্দেশমত বেদীর সম্মুখে ব্রাহ্মী হংস উত্তীর্ণ করা হইয়াছে। গর্ভগৃহের পশ্চাতে শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাণ্ডারগৃহ এবং ইহার উপর দ্বিতলে শয়নগৃহ।

ভাঙ্গনের ভয়ে গঙ্গা হইতে ৩০০ ফুট দূরে পশ্চিমতীরে মন্দিরটি নির্মিত হয় এবং ভাঙ্গন প্রতিরোধের জন্য পোস্তা (seawall) তৈরি হয়।

এই মন্দিরটির পরিকল্পনায় ভারতের প্রাচীন ও মধ্যযুগের এবং পাশ্চাত্ত্য স্থপতিরীতির সংমিশ্রণ বেশ স্পষ্টই বোঝা যায়। মন্দিরের প্রবেশদ্বারটিতে প্রাচীন বৌদ্ধ গিরি-গুহা মন্দিরের প্রবেশদ্বারের প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়। এই প্রবেশদ্বার একটি বৃহৎ সৌধের মধ্যস্থলে অবস্থিত। ইহার দুইধারে দুইটি করিয়া স্ত ম্ভবাহিত একটি খিলানের অভ্যন্তরে মঠ ও মিশনের প্রতীক-চিহ্ন (monogram) খোদিত হইয়াছে। স্বামী বিবেকানন্দ ইহার পরিকল্পনা করিয়াছিলেন–তরঙ্গায়িত জলরাশি, তন্মধ্যে প্রস্ফুটিত পদ্ম ও এবং তদুপরি উদীয়মান সূর্যরশ্মি যথাক্রমে কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান সূচিত করে। ইহার উপরে আলো ও বাতাস প্রবেশের জন্য আর একটি ঐরূপ বিশাল মুক্ত খিলান। ইহার উপরিভাগে চারিটি গম্বুজ ও দুইধারে দুইটি ছোট গৃহপরিবেষ্টিত একটি বৃহৎ কক্ষ। ইহাদের আচ্ছাদন বঙ্গদেশের খড়ের ঘরের চালার অনুকরণে নির্মিত। সমগ্রভাবে দেখিলে এই প্রবেশদ্বারটির গঠনরীতির সহিত কার্লে (ও অন্যান্য প্রাচীন বৌদ্ধ) গুহা-মন্দিরের প্রবেশদ্বারের বিশেষ সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হইবে।

নাটমন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করিলে এই সাদৃশ্য আরও স্পষ্ট হইয়া উঠে। ইহার দুইটি বিশেষত্বপ্রথমতঃ, দুই সারি প্রস্তরস্তম্ভ দ্বারা ইহার অভ্যন্তর তিনভাগে বিভক্ত; স্তম্ভের সারির মধ্যবর্তী অংশ খুব প্রশস্ত। ইহার অবশিষ্ট দুইধারের দুই অংশ অপেক্ষাকৃত খুবই কম চওড়া; অনেকেই ইহাকে গির্জার অভ্যন্তরস্থিত মধ্যভাগ (nave) ও দুইপাশের (aisle) সঙ্গে তুলনা করিয়াছেন। কিন্তু খ্রীষ্টজন্মের পূর্বে রচিত কার্লে (ও অন্যান্য) বৌদ্ধ গুহামন্দিরে ঠিক এই ব্যবস্থা দেখিতে পাওয়া যায়। সুতরাং খুব সম্ভবতঃ খ্রীষ্টান স্থপতিরা ভারতীয় রীতিরই অনুকরণ করিয়াছিলেন। বেলুড়ের শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরের পরিকল্পনায়ও স্বামী বিজ্ঞানানন্দ ভারতীয় গুহামন্দিরেরই অনুকরণ করিয়াছিলেন।

দ্বিতীয়তঃ, নাটমন্দিরের অর্ধবৃত্তাকার (vaulted) ছাদও কার্লে গুহামন্দিরের ছাদের অনুরূপ; বেলুড় মন্দিরের গম্বুজ, জালির কাজ ও অন্যান্য আভরণে মধ্যযুগের ভারতীয় স্থাপত্যরীতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

(গ) ধামতোড় মন্দির

আলোচ্য যুগে বঙ্গদেশে অনেক হিন্দু মন্দির ও মুসলমানদের মসজিদ নির্মিত হইয়াছে। কিন্তু এগুলি উনিশ শতকের মন্দির ও মসজিদের অনুকরণ মাত্র, কোন বৈশিষ্ট্যের পরিচয় নাই এবং কোনটিই উন্নতশ্রেণীর শিল্পের পর্যায়ভুক্ত করা যায় না। এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে যে কুটির দেউল ও সমতল ছাদের এক-কুঠুরির দালান মন্দিরের উল্লেখ আছে, এ-যুগে সেই শ্রেণীর মন্দিরই নির্মিত হইয়াছে। তবে পূর্বেকার মন্দিরগুলির ন্যায় আলোচ্য যুগের মন্দিরগাত্রে টেরাকোটা বা পোড়ামাটির অলঙ্করণ বড় একটা দেখা যায় না। সর্বসাধারণের বিশ্বাস এবং দুইজন মনস্বী স্পষ্টভাবে এই মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, বিংশ শতকের এই অলঙ্করণ প্রথাটি একেবারে লুপ্ত হইয়াছে। কিন্তু সম্প্রতি শ্ৰীযুক্ত অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩০ সনে নির্মিত একটি মন্দিরের গাত্রে এই অলঙ্করণ-পদ্ধতি আবিষ্কার করিয়া প্রমাণিত করিয়াছেন যে, ইহা একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই। সুতরাং এই মন্দিরটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেছি।

এই মন্দিরটি পঞ্চরত্ন শ্রেণীর। ইহা মেদিনীপুর জিলার অন্তর্গত পাঁশকুড়া হইতে ৮ মাইল পশ্চিমে এবং ডেবরা হইতে ২ মাইল পূর্বে বাগনান হইতে মেদিনীপুর যাইবার পাকা সড়কের উত্তরধারে ধামতোড় গ্রামে অবস্থিত। মন্দিরটির উৎসর্গলিপি অনুসারে ইহা ১৩৩৭ সালের ২০শে ফাল্গুন (১৯৩১ সনের মার্চ) মাসে নির্মিত হইয়াছিল। ইহার সম্মুখের দেওয়ালে “বিভিন্ন খোপে অন্তত ৭৪টি টেরাকোটা মূর্তি-ভাস্কর্য নিবদ্ধ।” মূর্তিগুলির বিষয়বস্তু সনাতন রীতির, যথা “দশাবতার, পৌরাণিক দেবদেবী, কৃষ্ণলীলার দৃশ্য ও বেশ কয়েকটি সামাজিক চিত্র।” মন্দিরের এই অলঙ্করণ খুব নৈপুণ্যের পরিচায়ক নহে। মন্দিরের কোন কোন স্থলে টেরাকোটার পরিবর্তে পঙ্কের অলঙ্করণ আছে। মন্দিরের ভিত্তি প্রায় ছয় হাত গভীর ও তাহার সবটাই ইট দিয়া ভরাট।

৩. ভাস্কর্য

চিত্রকলার ন্যায় ভাস্কর্যে বঙ্গদেশে আলোচ্য যুগে কোন নূতন রীতিপদ্ধতি বা সম্প্রদায় গড়িয়া ওঠে নাই। এখন কলিকাতা শহরে ২১টি মূর্তি আছে। তন্মধ্যে অধিকাংশই ব্রোঞ্জনির্মিত। ইহার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দশটি মূর্তির নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে দিলাম।[১০]

যাহার মূর্তিঅবস্থান স্থলউৎপাদনভাস্করের নাম
১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণব্রোঞ্জকার্তিক পাল
২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঅ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসকংক্রীটসেলিম মুন্সি
৩। মহাত্মা গান্ধীচৌরঙ্গী-পার্ক স্ট্রীট সংযোগস্থলব্রোঞ্জদেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী
৪। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুলাটভবনের পূর্বদক্ষিণ কোণেব্রোঞ্জপ্রদোষ দাসগুপ্ত
৫। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুশ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ব্রোঞ্জবোম্বাইর জনৈক শিল্পী
৬। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনআকাশবাণী ভবনের সম্মুখে  ব্রোঞ্জরমেশ পাল
৭। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীকার্জন পার্কব্রোঞ্জদেবী প্রসাদ রায়চৌধুরী
৮। ক্ষুদিরাম বসুবিধান সভা ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণেব্রোঞ্জতাপস দত্ত
৯। স্বামী বিবেকানন্দগোলপার্ক (দক্ষিণ কলিকাতা)শ্বেতপাথরমণি পাল
১০। আশুতোষ রায়চৌধুরীচিত্তরঞ্জন এভিনিউ ও চৌরঙ্গীর সংযোগস্থলব্রোঞ্জদেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

এইসব মূর্তির শিল্পকলা সম্বন্ধে ভূতপূর্ব আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ প্রখ্যাত ভাস্কর চিন্তামণি কর মন্তব্য করিয়াছেন :

“নগরের কেন্দ্রস্থলে কোন দেশনায়ক বা বিখ্যাত ব্যক্তির মূর্তি স্থাপনায় কেবলমাত্র ব্যক্তিগত চেহারার হুবহু অনুরূপ সৃষ্টিতে সীমিত হলে এইসব ভাস্কর্য প্রাণহীন ব্যক্তিত্বহীন ট্যাকসিডারমিষ্টদের কাজের মত দেখাতে পারে।

নিপুণ ভাস্কর প্রখ্যাত ব্যক্তির প্রতিমূর্তি রচনায় গঠনের বৈচিত্র্যে ও কৌশলে তাঁর মুখ্য আদর্শটুকু বজায় রেখে এক বিরাট পুরুষের ব্যঞ্জনাকে ব্যক্ত করে থাকেন।[১১]

অন্যান্য দুই-একজন শিল্পীও অনুরূপ মত ব্যক্ত করিয়াছেন। ভাস্কর্যশিল্পে যে বঙ্গদেশীয় (তথা ভারতীয়) শিল্পীরা খুব উৎকর্ষ লাভ করেন নাই, ইহাই সাধারণত অভিমত।

খ. নাট্যাভিনয় [১২]

আলোচ্য যুগের প্রারম্ভে যে তিনটি রঙ্গালয় কলিকাতায় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল–স্টার, ক্লাসিক ও মিনার্ভা থিয়েটার–তাহাদের উৎপত্তি ও প্রগতি, সে-যুগের বিখ্যাত অভিনেতা, অভিনেত্রী ও অভিনীত নাটকের নাম প্রভৃতি এই গ্রন্থমালার তৃতীয় খণ্ডে আলোচিত হইয়াছে।

বিংশ শতকের প্রথম দুই দশকে নাট্যশালার বা অভিনয়ের বিশেষ কোন পরিবর্তন হয় নাই, কেবল ক্লাসিক থিয়েটারের নূতন সত্বাধিকারী মনোমোহন পাড়ের নামানুসারে ইহার নাম হয় মনোমোহন থিয়েটার। গিরিশচন্দ্র ঘোষের মৃত্যুর (১৯১২) পর তাঁহার পুত্র দানীবাবু (সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ) অভিনেতা হিসাবে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ১৯১৯ সনে মিনার্ভা ও ষ্টার থিয়েটারের পরিচালকদের মধ্যে অভিনয়ের স্বত্ব লইয়া মামলা হওয়ায় বঙ্গ-রঙ্গমঞ্চে নাটকের অভিনয় সম্পর্কে নিয়মাবলী সর্বপ্রথম বিধিবদ্ধ হয়। ঐ বৎসরই মিনার্ভায় ‘মিশরকুমারী’ নাটক অভিনীত হয় এবং মঞ্চসজ্জা, পোশাক-পরিচ্ছদ, দৃশ্যসজ্জা, বাদ্য ও সঙ্গীতের উৎকর্ষে ইহা খুব জনপ্রিয় হয়।

এই সময় শিশিরকুমার ভাদুড়ী (১৮৮৯-১৯৫৮) বাংলার রঙ্গমঞ্চে এক নবযুগ আনয়ন করেন এবং যুগপ্রবর্তক’ অভিনেতা ও নাট্যাচার্যরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ইংরেজী সাহিত্যে এম.এ. পাশ করিয়া (১৯১৩) তিনি অধ্যাপনাকার্যে ব্রতী হন। ছাত্র ও অধ্যাপকজীবনে তিনি সৌখিনভাবে অভিনয় করিয়া বিশেষ খ্যাতিলাভ করেন। ১৯২১ সনে উত্তর-কলিকাতায় ম্যাডান থিয়েটার-কর্ণওয়ালিস রঙ্গমঞ্চ (পরবর্তীকালে শ্রী’ সিনেমাগৃহ) প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ঐ সনের ১০ই ডিসেম্বর ‘আলমগীর’ নাটকে শিশিরকুমার ভাদুড়ী নাম-ভূমিকায় সর্বপ্রথম পেশাদারী অভিনেতারূপে রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হইলেন। এই অভিনয়ের দ্বারা তিনি দর্শকগণকে মুগ্ধ করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের আদর্শ ও মতবাদের অনৈক্য হওয়ায় তিনি থিয়েটার ত্যাগ করিয়া চলচ্চিত্রে যোগদান করিলেন। তাঁহার পরিচালিত শরৎচন্দ্রের ‘আঁধারে আলো’ ও ‘চন্দ্রনাথ’ এই দুইখানি চলচ্চিত্রের অভিনয়ে তিনি নিজেও অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু, ১৯২৩ সনে শিশিরকুমার পুনরায় রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হইলেন। নিজেই একটি দল গড়িয়া তিনি প্রথমে কলিকাতায় ইডেন কাননের প্রদর্শনীতে, পরে হ্যারিসন রোডে অবস্থিত ‘আলফ্রেড রঙ্গমঞ্চ ভাড়া করিয়া সীতা’, ‘বসন্ত লীলা’ ও ‘আলমগীর’ নাটক অভিনয় করেন। এই সমুদয়ের সাফল্যে উৎসাহিত হইয়া তিনি স্থায়ীভাবে মনোমোহন রঙ্গমঞ্চে নাট্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৩০ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ হইতে ষ্টার থিয়েটারের পরিচালকবর্গের পরিবর্জনের ফলে ইহা ‘আর্ট থিয়েটার’ নামে পরিচিত হইল। অতঃপর বাংলার নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে নাট্য মন্দির’ ও ‘আর্ট থিয়েটার’ এই দুইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নবযুগের প্রবর্তন হইল।

আর্ট থিয়েটার কর্ণার্জুন’ অভিনয়ের দ্বারা ইহার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করিল। ১৯২৩ সনের ৩০শে জুন ইহার উদ্বোধন হয় এবং একাদিক্রমে তিনশত বার অভিনয়ের দ্বারা ইহা বাংলার নাট্যজগতে যে নূতন ‘রেকর্ড স্থাপন করিল, আজ পর্যন্তও তাহা অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে। ইহার তিন প্রধান অভিনেতা-তিনকড়ি চক্রবর্তী (কর্ণ), অহীন্দ্র চৌধুরী (অর্জুন ও কিছুদিন কর্ণ) এবং নরেশ মিত্র (শকুনি) এই চরিত্রের অভিনয়ে যে খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন তাহা কখনও ম্লান হয় নাই এবং অভিনেতা হিসাবে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর ন্যায় তাঁহাদের নামও নাট্যজগতে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। এই অভিনয়েই সর্বপ্রথম পূর্ব হইতেই দর্শকের আসন সংরক্ষিত (reserved) করিবার ব্যবস্থা প্রচলিত হয়।

নাট্যমন্দিরে ‘সীতা’ নাটকও দুইশতবার অভিনীত হইয়াছিল। শিশিরকুমার ‘রামে’র ভূমিকায়, তাঁহার দুই ভ্রাতা বিশ্বনাথ ও তারাকুমার লক্ষ্মণ’ ও ‘ভরতের ভূমিকায়, ‘বৈতালিকে’র ভূমিকায় অন্ধ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে এবং সীতা’র ভূমিকায় শ্রীমতী প্রভা সমগ্র নাট্যজগতে অবিস্মরণীয় খ্যাতি অর্জন করেন। সীতা’র প্রথম অভিনয়-রজনীতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন। সীতা’র পরে নাট্যমন্দিরে ‘জনা’, ‘পাষাণী, ‘আলমগীর’ প্রভৃতির অভিনেতা ও পরিচালক হিসাবে শিশিরকুমার অক্ষয় কীর্তি অর্জন করেন। ১৯২৫ সনে ‘নাট্যমন্দির একটি লিমিটেড কোম্পানীতে পরিণত হয় এবং শিশিরকুমার মনোমোহন রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করিয়া কর্ণওয়ালিস’ রঙ্গমঞ্চে অভিনয় আরম্ভ করেন। মঞ্চসজ্জায় দৃশ্যসজ্জায় ও প্রেক্ষাগারের নূতন ব্যবস্থাপনায় কর্ণওয়ালিস আদর্শ রঙ্গমঞ্চ বলিয়া খ্যাতিলাভ করে।[১৩] নাট্যমন্দিরের টিকিটের দাম বৃদ্ধি হয় ন্যূনতম এক টাকা হইতে পাঁচ টাকা ও দশ টাকা পর্যন্ত। নূতন রঙ্গমঞ্চে শিশিরকুমার ‘বিসর্জন’, ‘ষোড়শী’, ‘দিগ্বিজয়ী’, নরনারায়ণ প্রভৃতি নূতন নাটক এবং পুরাতন নাটক ‘প্রফুল্ল’তে অভিনয় করেন।

শিশিরকুমার ‘মনোমোহন রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করার পর ‘আর্ট থিয়েটার’ ঐখানে ও ‘ষ্টার থিয়েটার’ উভয় স্থানেই অভিনয় করে। কর্ণার্জুন ছাড়াও আর্ট থিয়েটার ‘চন্দ্রশেখর, শ্রীরামচন্দ্র, ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘অশোক’, গিরিশচন্দ্রের শঙ্করাচার্য প্রভৃতি অভিনয় করে। রবীন্দ্রনাথের প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে গীতিবহুল ‘ধনঞ্জয় বৈরাগী’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হন প্রসিদ্ধ গায়ক নট মুকুন্দ দাস। পূর্বোক্ত অভিনেতাগণ ছাড়া দুর্গাদাস, সুশীলাবালা প্রভৃতি এখানে অভিনয় করেন। নাট্যমন্দিরের সঙ্গে পাল্লা দিয়া আর্ট থিয়েটার স্টার রঙ্গমঞ্চে দানীবাবুকে লইয়া ‘প্রফুল্ল’ নাটকের অভিনয় করে। কিন্তু একজন বিশেষজ্ঞের মতে “নাট্যমন্দিরের কাছে তাঁহাদের প্রয়াস নিষ্ফল হইয়াছিল।”[১৪]

১৯২৫ সনে ষ্টার রঙ্গমঞ্চে রবীন্দ্রনাথের ‘চিরকুমার সভা’ অভিনীত হয়। ইহার অভিনয়ের সাফল্যই সম্ভবতঃ রবীন্দ্রনাথের ‘গৃহপ্রবেশ’, ‘শোধবোধ’, ‘শেষরক্ষা, ‘তপতী’ প্রভৃতি নাটককে অভিনয়োপযোগী রূপ দিতে অনুপ্রাণিত করে।[১৫] আর্ট থিয়েটার’ ও ‘নাট্যমন্দিরে’ রবীন্দ্রনাথের নাটক প্রায় সমান সংখ্যায় অভিনীত হয়।

১৯৩৫ সনে শিশিরকুমার ‘বিল্বমঙ্গল’ ও যোগেশ চৌধুরীর ‘দিগ্বিজয়ী’ নাটক মঞ্চস্থ করেন। এই সময়ে প্রতিভাশালিনী অভিনেত্রী কঙ্কাবতী সাহু বি.এ. নাট্যমন্দিরে যোগদান করেন এবং শেষোক্ত নাটকে ভারতনারীর, ভূমিকায় প্রথম রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন। শিশিরকুমার ‘নাদির শাহে’র ভূমিকা গ্রহণ করেন। “দিগ্বিজয়ী শিশির প্রতিভার এক অবিস্মরণীয় কীর্তি”।[১৬]

নটীর পূজার’ অভিনয়ে (১৩৩৩) রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরী দেবী নটীর ভূমিকায় অভিনব নৃত্যশিল্প কলিকাতার শিক্ষিত সমাজকে মুগ্ধ ও বিস্ময়চকিত করেন।[১৭] তখন ইহা লইয়া হিন্দু-সমাজের এক সম্প্রদায় নাসিকা কুঞ্চিত করিয়াছিলেন। কিন্তু উক্ত অভিনয়ে নৃত্যের সাফল্যে এবং রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক বোলপুরে নৃত্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে আজ কেবল রঙ্গমঞ্চে নহে, ভদ্রসমাজের সাধারণ আমোদ-উৎসবে নারীনৃত্য একটি সুপরিচিত অঙ্গ।

শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ প্রথমে ‘আর্ট থিয়েটারে’ মঞ্চস্থ হইলেও শিশিরকুমার ‘ষোড়শী’ ও ‘মা’-র অভিনয়ে অদ্ভুত সাফল্য লাভ করিয়াছিলেন এবং অভূতপূর্ব কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন। “মোড়শী ও রমা তাঁহার দুই কীর্তিস্তম্ভ। যে রমা’কে সার্থক নাট্যরূপ দিতে অসমর্থ হইয়া ‘আর্ট থিয়েটার’ শরৎচন্দ্রের হস্তে ফেরৎ দেন, তাহাকে লইয়া শিশিরকুমার যে কীর্তিস্তম্ভ রচনা করিয়াছেন তাহাই শিশিরবাবুর কৃতিত্বের স্মারক হইয়া রহিয়াছে।”[১৮]

বাংলা রঙ্গমঞ্চের অভিনেতা ও পরিচালকদের দলাদলির ফলে ১৯৩০ সনে নাট্যমন্দির এবং দুই-তিন বৎসর পরে আর্ট থিয়েটারের দরজা বন্ধ হইয়া যায়। মিনার্ভা থিয়েটার ভবন ১৮২২ সনে অগ্নিদাহে ভস্মীভূত হইলেও তিন বৎসর পরে পুনরায় নির্মিত হয়।

বঙ্গদেশের নাট্যজগতে যে উজ্জ্বল যুগের কথা এতক্ষণ আলোচনা করিয়াছি তাহার প্রধান দুই ধারক ও বাহক সম্বন্ধে নিম্নলিখিত মন্তব্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানের যোগ্য :

“শিশিরকুমারের নাট্য মন্দির এবং আর্ট থিয়েটার’-এর দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃষ্টিতে যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। আর্ট থিয়েটার-এর কর্ণার্জুন’, ও নাট্যমন্দির’-এর ‘সীতা’, ‘আর্ট থিয়েটারে’র শ্রীকৃষ্ণ’ ও ‘নাট্য মন্দিরের নর-নারায়ণ’-এ ইহাদের পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্টভাবে লক্ষিত হইত। প্রয়োজনীয় যে উন্নত শিল্পচেতনা এবং অভিনয়ের যে অন্তরস্পর্শী আবেদন নাট্য মন্দির’-এ প্রকাশ পাইত, ‘আর্ট থিয়েটার’ সে গৌরব কোনদিনই অর্জন করিতে পারে নাই। শিল্পীর আত্মপ্রকাশের ভিতর দিয়া সমস্ত নাটকখানিকে উপস্থাপনা এবং তাহার পরিণতির তীর্থে পৌঁছাইয়া দেওয়ার জন্য দৃশ্যপট, সঙ্গীত, নৃত্য, আঙ্গিক, অভিনয়, আলোকচিত্র সবই তাহার সঙ্গে সুসমঞ্জস করিয়া তুলিবার সার্থক প্রয়াস লক্ষিত হয় শিশিরকুমারের প্রয়োেগ-নৈপুণ্যে। ফলে রঙ্গমঞ্চে দেখা দিল স্বভাবানুগের আবেদন। এইভাবেই বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে নূতন এক যুগ দেখা দিল। এইজন্যই শিশিরকুমার যুগপ্রবর্তক”।[১৯]

১৯৩০ সনের শেষভাগে শিশিরকুমার সীতা’ নাট্যাভিনয় দেখাইবার জন্য সদলবলে আমেরিকার যুক্তরাজ্যে যাত্রা করেন। ২৮শে অক্টোবর ব্যাল্টিমোর (Baltimore) থিয়েটারে ‘সীতা’ নাটক অভিনীত হয়। নিউইয়র্কে ছয় রাত্রি ‘সীতার অভিনয় দেখান হয়। কিন্তু অর্থ বা প্রতিপত্তি–কোন দিক দিয়াই এই অভিযান সফল হয় নাই। ফিরিয়া আসিয়া পথে দিল্লীর রাজভবনে সীতার অভিনয় করিয়া শিশিরকুমার ১৯৩১ সনে কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন।

অতঃপর কলিকাতার নাট্যজগতে নানা রঙ্গমঞ্চের ও সম্প্রদায়ের দ্রুত উত্থান পতনের ধারাবাহিক বিবরণ দেওয়া এস্থলে সম্ভবপর নহে। সমবায় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ‘রঙমহলে’র শুভ উদ্বোধন হয় (১৯৩১, ৮ই অগষ্ট)। শিশিরকুমারই প্রধান অভিনেতা ও শিক্ষক হইলেন এবং সতু সেন প্রযোজনা ও সম্পাদনার ভার গ্রহণ করিলেন। কিছুদিন পরে শিশিরকুমার ‘নব নাট্যমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে শরৎচন্দ্রের ‘বিরাজ বৌ’ ও ‘বিজয়া এবং রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ ও ‘শ্যামা’ অভিনীত হয়। শিশিরকুমার নিজেই ‘বিরাজ বৌ’-এর নাট্যরূপ দেন এবং ইহা ২৮শে জুলাই (১৯৩৪) অভিনীত হয়। বিজয়া’ নাটকে শিশিরকুমার ও কঙ্কাবতী যথাক্রমে রাসবিহারী’ ও ‘বিজয়ার ভূমিকায় অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন, কিন্তু নব নাট্যমন্দির’ বেশিদিন স্থায়ী হয় নাই। ইহার বিলুপ্তির কয়েক বৎসর পরে ইহার প্রতিপক্ষ নাট্য নিকেতন’-এরও বিলোপ ঘটে। শিশিরকুমার প্রথমে কিছুদিন নাট্য নিকেতন’-এর সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ইহার বিলোপের পর “ইহার ভাঙ্গা আসরেই শিশিরকুমার তাহার নটজীবনের শেষ কীর্তিস্তম্ভ শ্রীরঙ্গম’ এর মঞ্চ আঁকাইয়া তুলিলেন।[২০] ‘শ্রীরঙ্গম্’-এর উদ্বোধন হয় ১৯৪২ সনের ১০ই জানুআরি। তাহার এই নিজস্ব সর্বশেষ মঞ্চে তাঁহার প্রতিভা অচলভাবে সর্বাপেক্ষা অধিককাল (প্রায় ১৪। ১৫ বৎসর) একাদিক্রমে সোনার ফসল ফলাইয়াছিল।[২১]

এখানকার নাট্যাভিনয়ের মধ্যে মাইকেল মধুসূদন’, ‘পরিচয়’, ‘প্রশ্ন’, ‘তখুতে তাউস’, ‘বিপ্রদাস’ ও ‘আলমগীর’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

‘আলমগীর’ পুনরভিনয়ের (১০ই ডিসেম্বর, ১৯৫১) সঙ্গে শিশিরকুমারের নটজীবনের ত্রিশ বৎসর পূর্ণ হয়। ইহার পূর্বেই তিনি অনুজ বিশ্বনাথের হস্তে ‘শ্রীরঙ্গ’-এর দায়িত্বভার অর্পণ করেন। ১৯৫৬ সনের ২৭শে জানুআরি শিশিরকুমারকে শ্রীরঙ্গম্ ছাড়িয়া আসিতে হয়। এইসঙ্গে বঙ্গীয় নাট্যশালার দ্বিতীয় যুগের অবসান হইল।

শ্রীরঙ্গ’-এর সমকালীন আর-একটি নূতন রঙ্গমঞ্চ ছিল নাট্যভারতী। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুই পুরুষ’-এর অভিনয় দ্বারা ইহার উদ্বোধন হয়। কয়েকজন প্রসিদ্ধ অভিনেতা-নরেশ মিত্র, যোগেশ চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলি বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ১৯৪৪ সনে ইহা বন্ধ হইয়া যায়। এই গ্রন্থের আলোচ্য যুগের শেষে কেবল চারিটি রঙ্গমঞ্চ ছিল–ষ্টার, মিনার্ভা, রঙ্গমহল ও শ্রীরঙ্গম। এই যুগে বাংলা নাট্যশালার দুইটি অভিনব সৃষ্টির উল্লেখ করা প্রয়োজন। সতু সেনের নাম পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। বাংলা রঙ্গমঞ্চে তাঁহার প্রধান কীর্তি ঘূর্ণায়মান ষ্টেজ (revolving stage) সৃষ্টি। রঙমহল মঞ্চে মহানিশা’ নাট্যাভিনয়ে ইহা প্রথম ব্যবহৃত হয়। নাট্য নিকেতনে ‘জননী’ নাটকে ‘ওয়াগান ষ্টেজ’ প্রথম ব্যবহৃত হয় (১৩৪০ সাল)। নাট্য নিকেতনের ‘চক্রব্যুহ’ নাটক অভিনয়ে (১৯৩৩) দৃশ্য-পরিকল্পনা, সঙ্গীত ও সুর-সংযোজনা এবং নৃত্যকলায় যথাক্রমে চারু রায়, নজরুল ইসলাম ও নীহারবালার যুক্তপ্রয়াসে ইহা অপূর্ব সাফল্যলাভ করে। এই সময়ে নির্মলেন্দু লাহিড়ী ও সরযুবালা নাট্য নিকেতনের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ (শচীন সেনগুপ্ত প্রণীত) অভিনয়ে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন।

উপসংহারে নাট্যাভিনয়ে শিশিরকুমার ভাদুড়ী যে নবযুগের সূচনা করিয়াছিলেন, অভিনয়ের সৌকর্য ও অভিনবত্ব ছাড়াও তাঁহার আর-একটি অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিশিরকুমারের সময়ে দ্রসমাজ হইতে অভিনেত্রী সগ্রহ করা সম্ভবপর ছিল না এবং সাধারণ রঙ্গালয়ের অভিনেত্রীদের সামাজিক মর্যাদা না থাকায় তাঁহাদের সহচর অভিনেতাগণও যথোচিত সামাজিক মর্যাদা পাইতেন না। ইংরেজীশিক্ষিত আধুনিক রুচি ও নীতিবোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা স্বভাবতঃই রঙ্গমঞ্চের প্রতি বিরূপ ছিলেন। শিশিরকুমারের ন্যায় সম্ভ্রান্তবংশীয় উচ্চশিক্ষিত একজন অধ্যাপক পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে যোগদান করিয়া বাংলার রঙ্গমঞ্চকে সামাজিক পাতিত্য হইতে উদ্ধার করিয়াছেন–ইহা বলিলে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হইবে না। শিশিরকুমার নিজেও এ-সম্বন্ধে খুব সচেতন ছিলেন। এই গ্রন্থের লেখক যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও একটি ছাত্রাবাসের অধ্যক্ষ ছিলেন তখন শিশিরকুমার সদলবলে ঢাকায় অভিনয় করিতে গিয়াছিলেন। সেখানে ছাত্রবৃন্দ সভা করিয়া তাহাকে বিপুল সম্বর্ধনা জানায়, অধ্যাপকেরাও উপস্থিত ছিলেন। শিশিরকুমার তাঁহার ভাষণে অন্যান্য অনেক কথার মধ্যে বলিয়াছিলেন যে, “ঢাকায় এসে আমার মনে হচ্ছে আমি যেন জাতে উঠেছি।” এই সরল সংক্ষিপ্ত বাক্যটির মধ্যদিয়া তাঁহার দীর্ঘজীবনের দুঃসাহসিক প্রয়াস ও তিক্ত অভিজ্ঞতা ফুটিয়া উঠিয়াছে। ঢাকায় যে-বাড়ীতে তিনি অন্যান্য অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের সহিত বাস করিতেন, বাল্যবন্ধু হিসাবে বর্তমান লেখক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি হইয়াও সেখানে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলে তিনি আনন্দের উচ্ছ্বাসে তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিয়াছিলেন।[২২]

বর্তমান যুগে যে স্ত্রী-পুরুষের প্রকাশ্যে অভিনয় ভদ্রসমাজে কেবল স্বীকৃত নহে, আদৃত হইয়াছে, তাহার জন্য শিশিরকুমার যথেষ্ট কৃতিত্ব দাবি করিতে পারেন।

তথ্যনির্দেশ

১. এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে ভ্রমবশতঃ এই নিয়োগের তারিখ ১৯০৫’ মুদ্রিত হইয়াছে।

২. অবনীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে তথ্য ও মতামতের জন্য লেখক তাঁহার জীবনী-লেখক

বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের নিকট ঋণী (ভারতকোষ, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৮১)।

৩. ভারতকোষ, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৮২

৪. তদেব

৫. ভারতকোষ, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ১৫৬

৬. ভারতকোষ, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ১৫৬

৭. এই মন্দিরের বিবরণের জন্য নিম্নলিখিত প্রবন্ধ এবং পুস্তিকা হইতে উপকরণ সংগ্রহ করিয়াছি : (ক) উদ্বোধন পত্রিকায় প্রকাশিত (১৩৭৮, চৈত্র, পৃ. ১৪২-৪৭) শ্রীগোপেন্দ্রকৃষ্ণ সরকার লিখিত ‘বেলুড় মঠের শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির’। লেখক নিজে এই মন্দিরের নির্মাণকার্যে নিযুক্ত ছিলেন। Swami Tejasananda, The Ramakrishna Movement : Its Ideal and Activites-Published by the Ramakrishna Mission Saradapitha, Belur Math, Howrah, Second Edition 1956 (P.p. 18-20).

৮.. The Tribes and Costes of West Bengal (P. 321) by Sudhansukumar Ray and edited by Asok Mitra (1953)–শ্রীবিনয় ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (১৯৫৭, পৃ. ৮৯)।

৯. বিস্তৃত বিবরণের জন্য শ্রীঅমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘দেখা হয় নাই (১৩৮০) ১০৫-০৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। আমাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণটি এই গ্রন্থের বিবরণেরই সারমর্ম।

১০. ইহা ছাড়াও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (কলেজ স্কোয়ার গোলদীঘি), গিরিশ ঘোষ (সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ), বাঘা যতীন, সূর্য সেন, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, যতীন দাস প্রভৃতির মূর্তি আছে।

১১. আনন্দবাজার পত্রিকার দুইটি সংখ্যায় কলিকাতার বিভিন্ন মূর্তিসম্বন্ধে শান্তি নিকেতনের প্রসিদ্ধ ভাস্কর শ্রীরামকিঙ্কর বেইজের বিভিন্ন মূর্তিসম্বন্ধে মন্তব্য এবং শ্ৰীচিন্তামণি করের এ-সম্বন্ধে পূর্বোদ্ধৃত সাধারণ মন্তব্য লিপিবদ্ধ হইয়াছে।

১২. এই পরিচ্ছেদের অনেক তথ্য ও মতামত শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য প্রণীত বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস’ দ্বিতীয় খণ্ড, নবম অধ্যায় হইতে সংগৃহীত। এজন্য কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁহার ঋণ স্বীকার করিতেছি।

১৩. শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, নবম অধ্যায়, পৃ. ৫৭১।

১৪. তদেব, পৃ.৫৭৩ ১৫. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, নবম অধ্যায়, পৃ. ৫৭৩-৭৪

১৬. তদেব, পৃ. ৫৭৩-৭৪ ১৭. তদেব, পৃ. ৫৭৫ ১৮. তদেব, পৃ. ৫৭৪

১৯. শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য-বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, নবম অধ্যায়, পৃ. ৫৭৫-৭৬।

২০. শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য-বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, নবম অধ্যায়, পৃ. ৫৭৮.

২১. তদেব, পৃ. ৫৭৮

২২. বর্তমান লেখকের গৃহে তাঁহার স্ত্রীকে শিশিরকুমার বলিয়াছিলেন, ‘ভদ্র ঘরের মেয়েরা যতদিন নাট্যাভিনয়ে অংশগ্রহণ না করিবে ততদিন বাংলার রঙ্গমঞ্চের উন্নতি হইবে না। পরবর্তীকালের বহুরূপী নাট্যসম্প্রদায়ের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি এই মন্তব্যের সমর্থন করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *