শেষকথা / উপসংহার
১৫শ ও ১৬শ শতকে এশিয়া মহাদেশে সাম্রাজ্য গঠনের এক মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছিল। এই সময়কালে তিনটি মহান রাজতন্ত্র–অটোমান সাম্রাজ্য, সাফাভিদ সাম্রাজ্য এবং মুঘল সাম্রাজ্য সমগ্র বিশ্বকে তাদের আভিজাত্যের উজ্জ্বলতায় এবং কলাকৃষ্টির অবদানে বিস্ময়ান্বিত করে। অথচ তিন গোষ্ঠীর শাসনতন্ত্রের ভিত্তিও ভিন্ন প্রকারের ছিল। যেমন অটোমান রাজত্বে ছিল সুন্নি তুর্কিদের আধিপত্য, এখানে যারা তুর্কি নন, তারাও কিন্তু রাজকীয় সৈন্যদলের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীর দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। সাফাভিদ শাসনে শিয়াদের প্রাধান্য ছিল, আবার কিজিলরাশরাও তাদের সাহায্য করত। ভারতের মুঘল সাম্রাজ্য কিন্তু কোনো বিশেষ জাতি বা ধর্মের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়নি। কোনো জাতি বা কোনো ধর্ম যে এককভাবে এর পর্যাপ্ত ভিত্তি রচনা করতে পারত না, এই তত্ত্বটি আকবর সবথেকে পরিস্কার ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। আকবর গোঁড়া উলেমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে ইবন আরবির সু-ই-কুল দর্শনের অনুরক্ত ছিলেন। এই দর্শনের মুখ্য উপজীব্য ছিল এই যে, বিভিন্ন ধর্মকে একই সত্যে পৌঁছাবার বিভিন্ন পথ বলে স্বীকার করা কর্তব্য এবং তাদের মধ্যেকার কোনো দ্বন্দ্বকে পরিহার করতে হবে।
আকবর হিন্দু রাজাদের কেবল বিশ্বস্ত সমর্থক বলেই কাছে টেনে নেননি, তিনি তাদের সাম্রাজ্যের অংশীদারের সম্মানও দিয়েছিলেন। এই নীতি কিন্তু তার পরেও অব্যাহত ছিল। এমনকি ঔরঙ্গজেবও তাঁর রাজত্বের প্রথম দুই দশক এই নীতিই অনুসরণ করেছিলেন। আকবর আবার প্রাচীন তুর্কি অভিজাতদেরও খানাজাদ (সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান) এবং মুবিদির (শিষ্য) সম্মান নিয়ে তাদের ব্যক্তিগত আনুগত্য নিশ্চিত করে কাছে টেনে নিয়েছিলেন।
এছাড়া প্রতিভাবানদের সামনে উন্নতির দরজাও খুলে দেওয়া হয়। যার ভিত্তিতে রাজবংশ বহির্ভূত সীমিত সংখ্যক গোষ্ঠীর মানুষদের যথা হিন্দুদের মধ্যে কায়স্থ, ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণ এবং শেখাজাদদেরও রাজকার্যে নিয়োগ করা যেতে পারত।
আকবর যে শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, তা ছিল একাধারে উদারনৈতিক। এবং উন্মুক্ত। তবে প্রথম থেকেই একে কয়েকটি গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রথমে গোঁড়া মুসলিমরা এর বিরোধিতা করেছিলেন। কারণ রাজকার্যে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান থেকে স্থানচ্যুত করার জন্য তারা অখুশি হন। ইসলাম বিপন্ন বলে ধ্বনি তুলতে থাকেন। এই বিরোধীরা আবার অভিজাতদের নিকট আবেদন নিয়ে বদায়ুনির মতো বক্তব্য জানাতে থাকেন যে তাদের হিন্দুদের দ্বারা স্থানচ্যুত করা হচ্ছে। এই সব হিন্দুদের নিজস্ব ভূসম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও তার উপরে এঁদের জায়গিরও তারা অধিকার করে নিতেন।
এ-কথা লক্ষণীয় যে এইসব বক্তব্য বা ধ্বনি কিন্তু জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের সময় বিশেষ কার্যকরী হয়নি। এইভাবে শেখ আহমেদ শিরহিন্দির অভিজাতদের গোঁড়ামির পথে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা ফলবতী হয়নি। ঔরঙ্গজেব তার সমগ্র সাম্রাজ্যকে মুসলিম সমর্থনের ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এবং তার নীতির সার্থক রূপায়ণের জন্য গোঁড়া ধর্মীয় মতাবলম্বীদের নিজ পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টাও করেছিলেন একথা সত্য। কিন্তু একথা ভাবলে ভুল হবে যে এই সব ক্রিয়াকর্ম বিগত পঞ্চাশ বৎসরে দেশে মৌলবাদী মুসলিম মনোভাব গড়ে ওঠার যুক্তিসংগত এবং অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
আথার আলির বক্তব্য অনুযায়ী ঔরঙ্গজেব এবং দারার সংঘাতের সময় অভিজাতরা কোনো আদর্শের ভিত্তিতে দু’ভাগে বিভক্ত হননি, কিন্তু এই বিভাজন ঘটেছিল ব্যক্তিগত সম্পর্কের নিরিখেই। এছাড়া ঔরঙ্গজেবের রক্ষণশীল মনোভাব তাঁর রাজত্বকালের প্রথম দুই দশকে কেবল ধীরে ধীরেই গড়ে উঠেছিল, এবং তার বাইশ বৎসরের শাসনকাল অতিবাহিত হওয়ার পরেই জিজিয়া কর পুনর্বার আরোপিত হয়। পরে আবার এই ব্যাপারে আপোশ করার জন্যই তিনি বহুসংখ্যক মারাঠাকে রাজকার্যে নিয়োগ করেন।
ঔরঙ্গজেবের মৌলবাদী নীতি কিন্তু আসলে নিষ্ফল হয়। প্রথমত মুসলিম সমাজ এত ভাগে বিভক্ত ছিল যে তাদের পক্ষে একটি সংঘবদ্ধ বা একত্রিত গোষ্ঠী হিসাবে নিজেদের প্রতিপন্ন করা সম্ভব ছিল না। এছাড়া অভিজাতরাও গোঁড়া ধর্মযাজকদের ঔদ্ধত্য এবং অর্থের বিনিময়ে আদর্শচ্যুত হওয়ার মতো বিষয়গুলি একেবারেই সমর্থন করতেন না। এছাড়া সামাজিক সম্পর্ক এবং কলাকৃষ্টি উভয়ক্ষেত্রেই উদারপন্থা এত গভীরে প্রোথিত ছিল যে তাকে সহজে বিনষ্ট করা সম্ভব ছিল না, যা অনেক শাহজাদা ও বিশেষ করে শাহজাদী রোশনারার ব্যবহারে প্রকাশ পেয়েছিল, যিনি দিল্লিতে উদার। মতাবলম্বীদের নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অভিজাতরাও একই পথ অবলম্বন করেন। যথা স্বয়ং ঔরঙ্গজেবের প্রিয় ওয়াজির ও মির বকশি, আসাদ খান ও জুলফিকর খান, তার মৃত্যুর বারো বৎসরের মধ্যেই ঔরঙ্গজেবের অনেক প্রাচীনপন্থী নীতিকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দেন। ইতিপূর্বে বাহাদুর শাহ নিজেকে একজন মুজতাহিদ (পবিত্র নিয়মবিধির পর্যালোচনার অধিকারী) বলে দাবি করে এবং ‘খুতবার আশীর্বচনে আলির নামের পরে ‘ওয়াসি’ শব্দটি বসিয়ে গোঁড়া উলেমাদের বিরাগভাজন হন।
অর্থাৎ মারাঠাদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিবাদ সত্ত্বেও, ঔরঙ্গজেবের পরবর্তীকালে একটি স্বল্পসময় ব্যতীত মুঘলদের নীতি কিন্তু যথেষ্ট উদার ছিল এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতেও এই উদারমনস্কতা অক্ষুণ্ণ ছিল। আবার পরবর্তীকালে মুসলিমদের ধর্মের নামে একজোট করার জন্য শাহ ওয়ালিউল্লাহর প্রচেষ্টাও সফল হতে পারেনি।
কিন্তু এই উদারনৈতিক চরিত্র ব্যতিরেকে ও প্রাক্-আধুনিক পর্যায়ের ভারত, পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ বা অন্যান্য সকল দেশের মতো মুঘল সাম্রাজ্য একটি ‘যুদ্ধবাদী দেশ’-ও ছিল। শাসক সম্প্রদায় যুদ্ধবিদ্যার প্রয়োগ করেই তাদের উচ্চাশা অর্জন করেছিলেন এবং সেই আভিজাত্যকে প্রতিপালন করেছিলেন। প্রতিবেশী দেশগুলির বিরুদ্ধে এবং অভ্যন্তরীণ সীমান্ত বিস্তারে অর্থাৎ অবাধ্য অধীনস্থ এবং স্বায়ত্ত শাসনভোগী রাজাদের শায়েস্তা করতে তাদের উদ্যম ও সময়ের এক সিংহভাগ ব্যয় হতে থাকত। তাদের ব্যবহারযোগ্য সম্পদের অধিকাংশই যুদ্ধের জন্য বা নিজেদের সামরিক আভিজাত্যকে অটুট রাখতে ব্যবহৃত হত। কিন্তু এই সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অর্থনীতির উন্নত হয়েছিল ও কৃষ্টি বিকশিত হয়েছিল। এর একটি কারণ সম্ভবত এই যে আধুনিক কালের মতো তখন যুদ্ধ এতটা ধ্বংসাত্মক ছিল না। তাই আমরা তখনকার আঁকা ছবির প্রেক্ষাপটে দেখি যে কৃষকেরা মাঠে চাষ করছে। অথচ সেই মাঠের অপর পার্শ্বে চলছে যুদ্ধ।
দেশে তখন নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধ চলছিল, ছিল এক মাথাভারী সামরিক অভিজাত-তন্ত্র। যারা তৎকালীন পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ বেতন ভোগ করত, ভূমি রাজস্ব ছিল অত্যধিক এবং সমাজে স্বৈরাচারী দৃষ্টিভঙ্গির প্রাবল্য। কিন্তু এখন একথা সর্বজনস্বীকৃত যে এতসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ১৬শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নততর অবস্থায় আরোহণ করেছিল এবং কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া অষ্টদশ শতাব্দীর প্রথমভাগেও এই উন্নতি ছিল অক্ষুণ্ণ। মুঘল আমলে এই প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়নি বরং মুঘল শাসন এই উন্নয়নের সহায়ক ভূমিকা নেয়। আবার মুঘল কেন্দ্রমুখীনতা ও রাজস্বনীতি দেশে অর্থভিত্তিক বা বাজার অর্থনীতির প্রবর্তনের পথিকৃৎ বলা যায়, কেন না মুঘলেরা অর্থমূল্যের বিনিময়ে ভূমি রাজস্ব প্রদান প্রথার উপর সমধিক গুরুত্ব দিয়েছিল। রাজস্ব কোনো কারণে অন্যকিছুর মাধ্যমে দেওয়া হলেও তাকে দ্রুত অর্থে পরিবর্তন করে নেওয়া হত। এই মুদ্রা-ভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশের প্রভাব থেকে কিন্তু গ্রামগুলিও মুক্ত ছিল না। অর্থবান গ্রামবাসীগণ মুঘলদের কৃষিনীতি অবলম্বন করে তাদের কৃষি ক্ষেত্র বিস্তার করার এবং কৃষিকার্যের উন্নতির দিকে নজর অবশ্য নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যই মনোযোগ দেয়। তারা বেশি করে বাণিজ্যিক শস্যের উৎপান শুরু করেন যাতে করে সেগুলি দেশের ক্রমবর্ধমান মাণ্ডিগুলিতে এবং রাজার শহর বা কসবাতে অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হতে পারে। এই শ্রেণির ভূস্বামীরা অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইজারাদার রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।
নগদ মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশ এবং উদ্বৃত্ত রাজস্বসমূহ মূলত এক নগরবাসী শাসকশ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে এক নূতন রীতিই প্রবর্তন হল। এই নাগরিক শাসক সম্প্রদায় এবং তাদের অজস্র পরিচারিকা ও অধীনস্থ ব্যক্তিদের পছন্দ অনুযায়ী নানান বিশিষ্ট ধরনের দ্রব্যসামগ্রীর এক চাহিদার সৃষ্টি হল। এইসব দ্রব্য দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে আসত। সুতরাং এক ক্রমবর্ধমান সংখ্যার যেসব বণিক এবং উৎপাদক সংস্থার সৃষ্টি হল, তারা কিন্তু এই সামন্ততান্ত্রিক অভিজাতদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করার বিষয়ে যেমন আত্মবিশ্বাসী ছিল, তেমনি তারা উদ্ধত এবং বেপরোয়া বিদেশি বণিকদের চাপ সহ্য করার বিষয়েও সুনিশ্চিত ছিল। এ কথার প্রমাণ আছে যে বাণিজ্যজাত মূলধন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং শক্তিমান ব্যবসায়ীরাই উৎপাদক শিল্পকে ক্রমশ আরও বেশি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনছিলেন। দেশে প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্যের আমদানি থেকে বোঝা যায় যে দেশে বৈদেশিক বাণিজ্য ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছিল। দেশে দেশে তখনও শ্রম শিল্প-ভিত্তিক ধনতন্ত্রবাদের সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি বটে, কিন্তু এক ধনী ও স্বয়ম্ভর ও কৌশলী বাণিজ্যিক শ্রেণি, নিপুণ হস্তশিল্পী বা কারিগর এবং উৎপাদনশীল গ্রামাঞ্চল মিলে সুবিধাজনক আবেষ্টনীতে শিল্প-ভিত্তিক ধনতন্ত্রের সৃষ্টি করতে পারত। ১৮শ শতাব্দিতে এই পদ্ধতির সাফল্যের জন্য রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর আঙ্গিকও এক চূড়ান্ত নির্ণায়ক ছিল।
এর থেকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মুঘল শাসকশ্রেণির নিরন্তর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি অবহেলা প্রদর্শন। ইউরোপীয় নৌবহর, জাহাজ পরিচালনার কৌশল এবং কামানগুলির শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিলেও স্থলজীবী মুঘল শাসকরা এই ইউরোপিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলিকে কোনো ভয়ের বা চিন্তার কারণ মনে করেননি, যেহেতু বিভিন্ন ইউরোপীয় সংস্থার মতপার্থক্যের উপর নির্ভর করে কোনোমতে ভারতীয় বণিকেরা নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে পারত। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সমাজবিজ্ঞানের প্রতি অবহেলা এক বিশাল ভ্রান্তির রূপ ধারণ করেছিল। একদিকে যেমন ধর্ম বা অতিন্দ্রীয়বাদ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতে শেখেনি, প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের নাম উল্লেখই এদের কাছে অসহ্য প্রতীয়মান হয়। কিন্তু অভিজাত ব্যক্তিবর্গ এবং শাসকদের ন্যূনতম বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য যে কেউ অগ্রণী হয়নি। সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর বলা যায় মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে এই সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই দেখতে হবে। এটি পরিষ্কারভাবে বোধগম্য যে ঔরঙ্গজেবের রাজত্ব কালের শেষভাগ থেকেই খানাজাদ বা অভিজাত সন্তানেরা অস্থির হয়ে উঠছিল, এরা আবার সংখ্যায় সমস্ত অভিজাতদের অর্ধেকের সমান। তারা এবং তাদের পরিবারবর্গ যে ধরনের প্রাপ্তির জন্য নিজেদের যোগ্য মনে করত, বাদশাহকে বিশ্বস্তভাবে সেবা করলে যে তা পাওয়া সম্ভব হয় সেকথা তারা বুঝতে পেরেছিলেন, জায়গিরদারির সংকট গভীরতর হওয়া এবং খানাজাদদের বিচ্ছিন্নতার ফলে তারা নিজেদের পৃথক রাজ্যখণ্ডের সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তাদের শক্তিমান এবং প্রভাবশালী আঞ্চলিকতা বোধ অবশ্য তাদের প্রত্যাশা পূরণের সহায়ক হয়। এটি একটি লক্ষণীয় বিষয় যে এই সব নূতন বাদশাহের অধীনস্থ স্বতন্ত্র রাষ্ট্রগুলিতে জায়গির প্রথা অব্যাহত ছিল, কিন্তু তা হস্তান্তরের আর উপায় রইল না। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জায়গিরের সুবাদে খানাজাদরা যে আর নূতন ভূস্বামীর। দ্বারা স্থানচ্যুত হবে না, তা এভাবে সুনিশ্চত হল।
মুঘলদের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের সম্পর্ক নিয়ে বহু চর্চা ও গবেষণা হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে মুঘলদের রাজস্ব যথেষ্ট গুরুভার হলেও এত বেশি ছিল না যার জন্য কৃষকদের কোনোমতে বেঁচে থাকতে হত বাঁচবার জন্য প্রতিবেশী রাজার নিকট পালিয়ে যেতে হত। গ্রামীণ ভদ্ৰশ্রেণি বা জমিদার ছাড়াও কৃষি সমাজের এক ক্ষুদ্র অংশ অপেক্ষাকৃত বিত্তবান ছিল এবং যারা কৃষিকার্য বিস্তার ও উন্নয়নের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করতে পারত। মুঘলদের সময়কালে যে কৃষির উন্নয়ন হয়েছিল এই শ্রেণির কৃষিজীবীরাই তার সর্বাধিক সুবিধাভোগী প্রতিপন্ন হয়, যাদের আধুনিক পরিভাষায় ‘মধ্যবর্তী শ্রেণি’ বলা হয়। তারা ছিল ভূমির অধিকারী কৃষিজীবী যাদের মধ্যযুগীয় পরিভাষায় ‘খুদকশত’ বলা হত যা আমরা আগেই দেখেছি। সুতরাং যখন মুঘলরা স্বয়ংশাসিত রাজাদের খারাজদাতা জমিদার শ্রেণিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছিল এবং জমিদারদের উপর রাজস্বের নির্ধারণ এবং আদায়ের দায়িত্ব সামরিক ভীতি প্রদর্শন করে চাপাতে চেয়েছিল–তারা কিন্তু এই বিষয়ে সহযোগিতা করেনি। তারা আবার ‘খুদকশত’ বা ‘মালিক-কৃষিজীবীদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কে স্থাপন করে। জমিদারির অতিরিক্ত দাবি আদায়ের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করতে চেয়েছিল। একেই আমি সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগে উত্তর ভারতে মুঘলদের শান্তি ও সুস্থিরতা সৃষ্টির ত্রিমুখী নীতি বলে বর্ণনা করেছি।
এই ভূস্বামী কৃষিজীবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম কঠিন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আদর্শগত বিতর্কের শুরু হয়। জমিদারদের নিজস্ব সশস্ত্র কর্মচারী ছিল শুধু তাই নয়, তারা জাতি, গোষ্ঠী, আঞ্চলিক এমনকি ধর্মগত ভিত্তিতেও সশস্ত্র কৃষকদের এক অংশকে তাদের বাহিনীর কাজে নিয়োগ করতে পারত। এই শক্তিশালী গোষ্ঠীকে নিরস্ত্র করা এক সুকঠিন কাজ ছিল যা শিবাজি নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছিলেন। এছাড়া গ্রামের ভূস্বামী কৃষিজীবীদের হাতে অধিকতর ক্ষমতা ন্যস্ত করা দূরে থাক, যদিও তারা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অংশ ছিলেন, মুঘলেরা তাদের কেন্দ্রমুখী নীতির বশবর্তী হয়ে জাতি বা গোষ্ঠী ভিত্তিক গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলিকে গোপনে ক্ষতি করার চেষ্টা করতেন। শেষ পর্যন্ত একটি উচ্চনীচ অবস্থান ভিত্তিক পরিকাঠামোর সৃষ্টি করা হয়নি, যার মধ্যে বহুসংখ্যক অনভিজাতদের স্থান দেওয়া যেতে পারত।
ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধি এবং পরম্পরাগত ও জনপ্রিয় ধর্মীয় আন্দোলন-সমূহ, যা সামাজিক ন্যায় ও সমতার উপরে প্রাধান্য দিয়ে এবং সমাজের উচ্চনীচ ভেদের বিরোধিতা করত সেগুলির প্রভাবে বর্ধিত আত্মবিশ্বাসের সীমা ক্রমশ মানুষের আন্দোলনের ভূমি প্রস্তুত করল এবং মুঘলদের সঙ্গে সংঘাতের মধ্য দিয়ে তাদের নিজস্ব নূতন রাজ্যের সৃষ্টি করল–যথা জাট ও শিখেরা যেমন করেছিল। আফগানরা আরও বেশি উপজাতীয় ছিল এবং গোঁড়া হলেও অনেক সমন্বয় ভিত্তিক ছিল। মারাঠাদের এদের ভিতর কোনো শ্রেণিতেই ফেলা যায় না। আঞ্চলিক ও লৌকিক উভয় সত্তার অধিকারী হয়ে তারা মূলত ছিল লুণ্ঠনকারী। কিন্তু মুঘল রাষ্ট্রশাসন। ব্যবস্থার ক্ষতি করার বিষয়ে তাদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
একটি নিয়ন্ত্রক শাসকশ্রেণি বা একটি বর্ধমান মুদ্রাভিত্তিক (অথবা বাজার) অর্থনীতি, এর কোনোটাই এই সব গ্রামীণ অভ্যুত্থানকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারত না। রাজকীয় আধিপত্যের দুর্বলতা বুঝে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জমিদারেরা স্থানীয় সশস্ত্র কৃষকদের সাহায্য নিয়ে রাজস্ব দেওয়া স্থগিত রাখত এবং তাদের নিজেদের অধীনস্থ এলাকার বিস্তার সাধনেও প্রবৃত্ত হত।
অর্থাৎ কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে অভিজাতদের গুরুত্বপূর্ণ অংশের ক্রমবর্ধমান দূরত্ব এবং গ্রামাঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণের ধারাবাহিক অবক্ষয় মুঘল সাম্রাজ্যের সংশক্তি হারানোর দুটি মূল কারণ হিসেবে এদের উল্লেখ করা যেতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল মারাঠাদের দ্রুত বিস্তারমান গেরিলা যুদ্ধপদ্ধতির নিকট মুঘল বাহিনীর পরাজয়। একথা প্রমাণিত হয়েছে যে গোলন্দাজ আক্রমণের পদ্ধতি বিষয়ে মুঘলদের ব্যর্থতা এবং দ্রুত গুলি ক্ষেপণের শক্তি-সম্পন্ন চকমকি জ্বালানো হালকা বন্দুক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার জন্যই উত্তর ভারতের উন্মুক্ত প্রান্তরে মারাঠাদের প্রতিরোধ করা মুঘলদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
গোলকুণ্ডা এবং বিজাপুরকে কর্ণাটকে তাদের অধিকার অব্যাহত রাখার অনুমতি দিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা যে জেদ ও গোঁড়ামির সঙ্গে ঔরঙ্গজেব প্রত্যাখ্যান করেন, তার ফলে মুঘলদের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্র অতি প্রসারিত হয়ে যায় এবং প্রশাসনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া দাক্ষিণাত্যে তার দীর্ঘ সময় ব্যাপী অবস্থানও। অবশ্যই মুঘল শক্তির পতন ত্বরান্বিত করে। ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের গুরুত্বকে এত দেরিতে স্বীকার করার বিষয়টিকে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। শিবাজি যখন আগ্রায় আসেন তখন তার সঙ্গে মীমাংসা করে নিলে কি অবস্থার লক্ষণীয় পরিবর্তন হত? এ কথা ভাবতে লোভ হয়। কিন্তু মারাঠাদের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে হলে তা দাক্ষিণাত্যের বিষয়ে ভবিষ্যৎ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন, যা জয় সিংহ দেখিয়েছিলেন। এই রকম একটি নীতি সত্য সত্যই যখন গৃহীত হয়, তার কুড়ি বৎসর পূর্বে গ্রহণ করলে পরে প্রকৃতই কোনো পার্থক্য হত কি না, তা অবশ্য একটি কাল্পনিক প্রশ্ন।
বাণিজ্যিক শ্রেণির সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গেলে বলতে হয় যে সকল ব্যবসায়ীই সাধারণত শান্তিপ্রিয়, কিন্তু যুদ্ধ চলাকালীন বণিক সম্প্রদায়ের সকলেই যে সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা কিন্তু ঠিক নয়। তাই পুনার বিখ্যাত অধিকোষগুলি (ব্যাংক) পেশোয়াদের সামাজিক অভিযানগুলির অর্থের ব্যবস্থা করেছিল। মধ্য ভারতের কোনো কোনো মারাঠা রাজ্যে অধিকোষপতি বা ব্যাংকের মালিকেরা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান অধিকার করেছিলেন। কোনো অধিকোষপতি আবার তাদের ঋণ পরিশোধ করার জন্য ইজারাদারও হয়ে উঠেছিলেন। মুঘল অভিজাতদের নিকট থেকে আসা বিনিয়োগ ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাবার ফলে ভারতীয়দের বৈদেশিক ও নৌ-বাণিজ্য বিশেষ ভাবে ব্যাহত হয় এবং ইউরোপীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি দ্রুত এই মন্দার সুযোগ। গ্রহণ করে। এই অবস্থা থেকে খুব সামান্য কয়েকজন ভারতীয়ই লাভবান হয়েছিলেন। তবে অন্তদেশীয় বাণিজ্যের উপর এর বিশেষ প্রভাব পড়েনি। এবং জগৎ শেঠের মতো কোনো কোনো ব্যবসায়ী কোনো আঞ্চলিক রাজ্যের যথা বঙ্গের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
তবে সব মিলিয়ে একথা বলা ঠিক হবে না যে গ্রামাঞ্চলের ধনী ব্যবসায়ী, অধিকোষপতি এবং ধনী ব্যক্তিরা ইংরেজ এবং ফরাসি বণিকদের দ্বারা ভারতীয় ব্যবসায়ীদের স্থানচ্যুত করার প্রচেষ্টার সঙ্গে নিজেদের স্বার্থরও মিলন ঘটিয়েছিলেন, এবং উপর উপর নিজেদেরও আধিপত্যের বৃত্তে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে ১৮শ শতকে, বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামো সমন্বিত বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজ্যের সমন্বয়ে একটি জালিকা গঠন করা কি সম্ভব ছিল, বল-সাম্যের ভিত্তিতে যা একত্রিত থাকবে? ১৭২০ সালের পরে এইরকম একটি সমন্বয় গঠন করার পথে প্রধান বাধা ছিল মারাঠারা এবং পরে উত্তর ভারতে আবদালিরা। কিন্তু মারাঠাদের পেশোয়াদের অধীনে এক সময় অধিকার বিস্তারের চেষ্টা কিন্তু ১৭৬১ সালের মধ্যে নিঃশেষিত হয়ে যায়, তাদের দুর্বল অর্থনৈতিক ভিত্তি, এবং অন্যের স্থায়ী কর্তৃত্বকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যবাহী গেরিলা নেতা থেকে সমর্থ প্রশাসক হয়ে ওঠার ব্যর্থতা এবং সীমান্তের বহিদেশ থেকে আগত সশস্ত্র আক্রমণকারীদের যথাযথ ভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব, এই সমস্ত মূল কারণের ফলেই সমগ্র উত্তর ভারতে মারাঠাদের সর্বময় নেতৃত্ব স্থাপন করা স্পষ্টতই তাদের ক্ষমতার অতীত ছিল।
সুতরাং ১৭৬১ সালের পরবর্তী ঘটনাগুলি কিন্তু মুখ্যত ১৭২০ থেকে ১৭৬১ সালের মধ্যবর্তী ইতিহাসের সম্প্রসারণের দ্বারাই নির্ধারিত হয়েছিল।