১৮. শহর ছেড়ে চলে গেলাম

কয়দিন পর আমরা শহর ছেড়ে চলে গেলাম। প্রথমে গেল ফজলুরা। একেবারে হঠাৎ করে চলে গেল, যাবার আগে আমাদের সাথে দেখাও করে যেতে পারে নি। তারপর গেল আশরাফেরা। তার আব্বা সবাইকে নিয়ে ঢাকা চুলে গেলেন। ঢাকা শহর নাকি এখন সবচেয়ে নিরাপদ। তারপর আমাদের যাবার দিন এসে গেল। দুটি নৌকা ঠিক করা হয়েছে, নৌকা করে আমরা এবং অরু, আপারা গ্রামের ভিতরে চলে যাব। যাবার আগের দিন আমি খুব কষ্ট করে রাশেদের সাথে দেখা করতে গেলাম। শহরে খবর ছড়িয়ে গেছে ছোট ছোট ছেলেরা মুক্তিবাহিনীর হয়ে কাজ করছে, তাই আব্বা আর আমাকে বাসা থেকে বের হতে দেন না।

রাশেদ যখন শুনল আমিও চলে যাচ্ছি তার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। বলল, সত্যি b{ब्ल शाच्छ्ञिा?

হ্যাঁ। আব্বা আর থাকতে চাইছেন না। মিলিটারী ক্যাম্পের এত কাছে থাকা খুব নাকি ভয়ের ব্যাপার।

রাশেদ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে তাহলে সব একা একা করতে হবে।

কি করবি একা?

পারমিশান নাই— বলেই রাশেদ হেসে ফেলল। বলল, তোকে বলতে কোন দোষ নেই! তুই আর আমি তো একই। তারপর গলা নামিয়ে বলল, নদীর উপরে যে ব্রীজটা আছে সেটা উড়াবো। ফুগাম্যান এসেছে, সাথে লিমপেট মাইন।

ফ্রগম্যান?

হ্যাঁ পায়ে ব্যাঙের পায়ের মত ফ্লীপার লাগিয়ে নদীতে সাঁতরে সাঁতরে যায়।

সত্যি?

হ্যাঁ।

দিন-তারিখও ঠিক করা আছে কিন্তু সেটা এখনো কেউ জানে না। একটা যুদ্ধ হবে কমলগঞ্জে। অনেক বড় যুদ্ধ। তখন একটা পাকাপাকি ফুণ্ট খুলবে। এখানে। তার আগে আগে যেন কোন সাপ্লাই যেতে না পারে।

সত্যি?

হ্যাঁ।

আমি কি বলছি জানিস?

কি?

ব্রীজটা আগেই না উড়াতে। ঠিক যখন একটা মিলিটারী ট্রেন ব্রীজের উপরে থাকবে তখন ‘বুম’! রাশেদ দুই হাত দিয়ে আমার চোখের সামনে ব্রীজটা উড়িয়ে দিল।

আমি গলা নামিয়ে বললাম, কেমন করে জানবি কোনটা মিলিটারী ট্রেন? ভুল করে যদি প্যাসেঞ্জার ট্ৰেন উড়িয়ে দেয়—

না না সেটা তো করাই যাবে না। রাশেদ মাথা নেড়ে বলল, ধার কমলগঞ্জে যুদ্ধ শুরু হল। তখন একটা ট্রেন বোঝাই করে মিলিটারী গোলাবারুদ তো। ওদিকে যাবেই। তখন ধর আমরা কেউ যদি স্টেশনে থাকি যখন দেখব ট্রেনটা ছাড়ছে খবর পাঠিয়ে দিলাম, ঠিক যখন বীজের উপর আসবে। — ‘বুম’। রাশেদ আবার বীজটা উড়িয়ে দিল।

কেমন করে খবর পাঠাবি?

সেটা এখনো ঠিক করি নি। দিনের বেলা আয়না দিয়ে —

যদি মেঘলা দিন হয়?

রাশেদ একটু হেসে বলল, সেটা ভেবে একটা কিছু উপায় বের করে ফেলব! মনে নাই শফিক ভাইকে কেমন করে উদ্ধার করলাম।

ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ায় আমরা দুজনেই একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে হাসতে থাকি। আমি গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, শফিক ভাই কেমন আছেন এখন?

ভাল, এতদিনে বর্ডারের কাছে পৌছে গেছেন। হাসপাতালে থাকার সাহস পেলেন না। পরদিন ভোরেই একটা রিক্সা নিয়ে বের হয়ে গেলেন, সবার সামনে দিয়ে!

আমি আর রাশেদ আবার আনন্দে হাসতে থাকি। রাশেদ হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, তুই থাকলে খুব ভাল হত। সবাই চলে যাচ্ছে, আমি একা হয়ে গেলাম।

রাশেদ একটা নিঃশ্বাস ফেলে কেমন জানি একটা দুঃখী-দুঃখী মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, আমারও যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কি করুব বল? ছোট হলে বড় অসুবিধে, সবসময় বড়দের কথা শুনতে হয়।

তা ঠিক।

আমি আর রাশেদ আরো অনেকক্ষণ কথা বললাম, দুজনে হেঁটে হেঁটে গোলাম রাস্তা দিয়ে তারপর আবার ফিরে এলাম। রাশেদ তখন আমাকে চায়ের দোকানো নিয়ে মালাই দিয়ে চা খাওয়ালো। ফিরে আসার সময় রাশেদ হঠাৎ আমার হাত ধরে একটু ইতস্ততঃ করে বলল, তুই আমার বন্ধু হবি?

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, কেন? আমি কি তোর বন্ধু না?

একেবারে প্রাণের বন্ধু। সারা জীবনের বন্ধু। মরে গেলেও যে বন্ধু থেকে যায়। সেই বন্ধু। হবি?

আমি মাথা নাড়লাম, হব।

রাশেদ তখন খুশি হয়ে একটু হাসল। ফিসফিস করে বলল। আমার কোন প্রাণের বন্ধু নাই— মানে আগে ছিল না। একজন বন্ধু খুব দরকার যাকে সবকিছু বলা যায়।

সবকিছু কি?

কত কি বলা যায়! তুই কি আমার কিছু জানিস? আমি কে? আমার বাবা কি? কি করে? কিছু জানিস?

আমি মাথা নাডুলাম, না, জানি না।

মাঝে মাঝে আমার কৌতূহল হয়েছে সত্যি কিন্তু কখনো রাশেদকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। রাশেদ একটু হেসে বলল, তুই যখন আমার প্রাণের বন্ধু হলি তোকে কেউ একটুকু কিছু বলবে। আজকাল শুধু ভয় হয় যে কােনদিন কেউ আমরা আর যাব।

তা ঠিক।

রাশেদ হঠাৎ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, যদি আমি কোনদিন মরে যাই, তুই আমার কথা মনে রাখবি?

রাশেদ কেন এটা বলল আমি জানি না। কিন্তু আমার বুকটা হঠাৎ ধ্বক করে উঠল, আমি রাশেদের হাত ধরে বললাম, ধুব বেকুব কোথাকার! তুই মরবি কেন?

রাশেদ মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ মরার কথা বলা ঠিক না।

আমরা কত ছোট কিন্তু আমাদের কিনা এখনই মরে যাওয়া বেঁচে থাকা নিয়ে ভাবতে হয়।

 

আমরা রওনা দিয়েছি ভোরে। দুটি নৌকায় আমরা আর অরু আপারা ভাগাভাগি করে যাচ্ছি। নৌকাদুটি যাচ্ছে নদীর তীর ঘেঁষে। মাঝে মাঝে মিলিটারী গানবোট এসে পড়ে তখন লুকিয়ে যেতে হয়, কাছাকাছি কোন ছোট খাল থাকলে সেখানে ঢুকে পড়তে হয়। দুটি নৌকা একটা আরেকটার কাছাকাছি যাচ্ছে। দুপুর বেলা এক জায়গায় থেমে নৌকায় কিছু রান্না করা হল খাওয়ার জন্যে। ডালের মাঝে ডিম ভেঙে দিয়ে অদ্ভুত একটা রান্না কিন্তু খেতে খারাপ না। খিদে লাগলে অবশ্যি সবকিছু খেতে ভাল লাগে, নৌকায় সারাদিন শুধু বসেই আছি। তবু দুপুর বেলা ভীষণ খিদে পেয়েছিল।

দুপুরে ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করে আবার নৌকা ছেড়ে দিল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। আমি নৌকার ছাঁইয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চারিদিকে এক ধরনের সুমসাম নীরবতা। পানির ছলাৎ ছিল।াৎ শব্দ হচ্ছে কিন্তু খানিকক্ষণ বসে থাকলে সেই শব্দ আর কানে আসে না। মনে হয় কোথাও কোন শব্দ নেই। আকাশে তারা উঠেছে। কত লক্ষ লক্ষ তারা, আমি অ্যাবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। একেকটা পৃথিবী থেকে কত কোটি কোটি মাইল দূরে। কত বড় এই বিশাল বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড আর পৃথিবী কত ছোট! সেই ছোট পৃথিবীতে আমরা নিজের দেশের মানুষ নিজের দেশে নিজের ঘর বাড়িতে থাকতে পারি না। তাড়া খেয়ে বনের পশুর মত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আমাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়!

নৌকা দুটি বড় নদী থেকে বাঁক নিয়ে ছোট একটা নদীতে ঢুকে পড়ল। মাঝি হালকা গলায় বলল, আর ভয় নাই গো!

অরু আপা নৌকার ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কি ভয় নাই?

পাঞ্জাবী গো ভয় নাই। এটা নীল গাং।। নীল গাংয়ে গানবোট ঢুকে না।

কেন।

জয় বাংলা এখনো। হা হা হা— মাঝি খুশিতে হাসতে থাকে।

আর কতক্ষণ যেতে হবে আমাদের?

দেরি আছে মা। ভোর রাতের আগে না।

অরু আপা নৌকার ভিতর থেকে বের হয়ে এসে বললেন, ইশ! কি সুন্দর। আমাকে ছাঁইয়ের উপর দেখে বললেন, ওমা! তুই এখানে বকের মত বসে আছিস। সর, জায়গা দে। আমিও বসব।

আমি জায়গা করে দিলাম। অরু, আপা আমার পাশে বসে বললেন, দেখিস পড়ে श्r।&!

পড়ব কেন। তুমি কি পড়ে যাবে?

আমি বুড়োধারী মানুষ পড়বা কেন? তুই ছোট তাই বললাম।

তোমরা মনে কর আমরা ছোট বলে কিছু পারি না?

অরু আপা আমার গলায় উত্তাপটুকু বুঝতে পেরে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আচ্ছা যা আর বলব না। তোরা আর ছোট না, তোরা বড়। অরু আপা বক্তৃতা দেওয়ার মত করে বললেন, উনিশ শ একাত্তর সনের স্বাধীনতা সংগ্রাম এই দেশের শিশুদের কাছে থেকে তাদের শৈশবকে ছিনিয়ে নিয়েছে।

অরু আপা কথাটি বললেন ঠাট্টা করে কিন্তু আমার মনে হয় কথাটা সত্যি। আমার জন্যে সত্যি। আমার আর রাশেদের জন্যে সত্যি। ফজলু আর আশরাফের জন্যে সত্যি।

আমরা দুজন খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। এক সময় অরু আপা গলা নামিয়ে বললেন, তোদের শফিক ভাইয়ের কোন খোঁজ জানিস? কোথায় আছে এখন?

আমি চুপ করে রইলাম।

অরু, আপা আমার দিকে তাকালেন, জানিস, তাই না?

আমি তবু চুপ করে রইলাম। –

আরু আপা আবার বললেন, বল না কোথায় আছে। কেমন আছে। কারা উদ্ধার করল, কোথায় নিল। বল না।

টপ সিক্রেট। বলার পারমিশন নাই।

প্লীজ আমাকে বল। আমি কাউকে বলব না। এই তোর গা ছুঁয়ে বলছি।

গা খুঁয়ে বললে কি হয়?

মনে হয় বলে দিলে গায়ে চুলকানী হয়।

যাও। বল খোদার কসম।

খোদার কসম।

কাউকে বলবে না?

কাউকে বলবো না।

আমি মুখ টিপে হেসে বললাম, তার আগে বল দেখি শফিক ভাইকে হাসপাতাল থেকে কারা উদ্ধার করেছে?

মুক্তিবাহিনীরা একটা সুইসাইড স্কোয়াড। স্পেশাল ট্রেনিং পাওয়া একটা কমান্ডো ইউনিট।

কতজন ছিল?

ষোল সতর জন।

তার শফিক ভাইকে কেমন করে নিয়েছে।

প্রথমে মোটর সাইকেলে তারপর স্পীড বোটে।

হাসপাতালে কি যুদ্ধ হয়েছিল?

হ্যাঁ, একটা ছোট খাট যুদ্ধ হয়েছিল।

কেউ মারা গিয়েছিল?

চারজন রাজাকার আর দুইজন মিলিটারী।

আমি খুকখুক করে হেসে ফেললাম। অরু আপা বললেন, কি হল হাসছিস কেন?

তুমি কাউকে বলবে নাতো?

না, বলবো না।

আমি গলা নামিয়ে বললাম, শফিক ভাইকে উদ্ধার করেছি আমরা।

অরু আপা মনে হল আমার কথা ঠিক বুঝতে পারলেন না। বললেন, কি বললি?

শফিক ভাইকে উদ্ধার করেছি আমরা। আমি, রাশেদ ফজলু আর আশরাফ।

কি বললি? কি বললি? অরু আপা তখনো কিছু বুঝতে পারছেন না।

সুইসাইড স্কোয়াড, কমান্ডো, এই সব বানানো কথা। আমরা ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। আসলে ছিলাম মাত্র আমরা চারজন।

তোরা চারজন? তোরা?

হ্যাঁ।

শফিককে কোথায় নিলি? কেমন করে নিলি?

কোথাও নেই নি। আমরা শুধু ভান করেছি। তাকে নিয়ে গেছি। খালি স্ট্রেচার কাপড় দিয়ে ঢেকে ছুটে পালিয়ে গেছি। শফিক ভাই একটা ছোট ঘরে লুকিয়েছিলেন, দাড়ি টাড়ি কেটে কাপড় ফেলে ভীড়ের মাঝে, হৈ চৈয়ের মাঝে একটা খালি বেড়ে শুয়ে পড়েছেন। ডাক্তার সাহেবের সাথে আগে থেকে ঠিক করে রাখা ছিল একটা বিছানা খালি রেখেছিলেন। কেউ টের পায় নি।

তোরা? তোরা— অরু আপা কথা বলতে পারছিলেন না! আমি আবার খুকধুক করে হেসে ফেললাম, রাশেদের একটা স্টেনগান ছিল –

স্টেনগান! রাশেদের? এইটুকুন ছেলে—

মুক্তিবাহিনী রাখতে দিয়েছিল, তাই ব্যবহার করেছে! কোন ক্ষতি তো হয়নি। কয়েকবার গুলি করেছে ভয় দেখানোর জন্যে। আর এরকম অপারেশান তো খালি হাতে করা যায় না! রাজাকারটাকে যখন মাটিতে ফেলা হল—

রাজাকারের সাথে মারপিটও করেছিস?

হ্যাঁ, আমি আর ফজলু গিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলেছি–

অরু আপা পুরে ঘটনাটা আবার খুলে বলতে হল। অরু আপা সব কিছু শুনে মাথায় হাত দিয়ে বললেন, তোরা? তোরা? এইটুকুন ছেলে এতবড় একটা কাজ করলি? এইটুকুন ছেলে!

আমি বললাম, অরু, আপা, এরকম সময়তো আগে কখনো আসেনি। কেউ তো জানে না কি করতে হবে। বড়রাও জানে না, ছোেটরা জানে না। তাই আমাদের যেটা ঠিক মনে হয়েছে সেটা করেছি।

অরু আপা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা। বড়দের মত কথা বলা শিখে গেছিস দেখি।

আমি একটু লজ্জা পেয়ে বললাম, আসলে এটা রাশেদ বলেছিল। রাশেদ সব সময় বড় মানুষের মত কথা বলে। আমাদের এই অপারেশনটার বুদ্ধিটাও রাশেদের মাথা থেকে বের হয়েছে।

সত্যি?

হ্যাঁ। আমরা খুঁটিনাটি জিনিসগুলি ঠিক করেছি। কিন্তু আসল বুদ্ধিটা রাশেদের। আমরা ভান করব শফিক ভাইকে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আসলে নিব না। দারুণ বুদ্ধি।

হ্যাঁ, দারুণ বুদ্ধি।

শফিক ভাই পরের দিন সবার সামনে একটা রিক্সা নিয়ে চলে গেছেন। প্রথম রাত শহরেই ছিলেন। পরের দিন নৌকা করে বর্ডারের কাছে একটা হাসপাতালে চলে গেছেন।

আবু আপা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললেন, একটা দেশ মানে কি জানিস ইবু? দেশ মনে হচ্ছে সেই দেশের মানুষ। যে দেশে তোদের মত মানুষ আছে সেই দেশকে কে আটকে রাখবো? বল তুই, কে আটকে রাখবো? কে?

 

আরু আপা ঠিকই বলেছিলেন। দেশকে কেউ আটকে রাখতে পারেনি। যে যুদ্ধ বছরের পর বছর হবার কথা ছিল সেটা নয়। মাসে শেষ হয়ে গেল। দিলীপাদের মত এক কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে ইণ্ডিয়াতে চলে গেছে। পথে-ঘাটে, বনে-বাদাড়ে, ক্যাম্পে, একেবারে পশুর মত দিন কাটাচ্ছে। একজব দুজন নয়, এক কোটি মানুষ। পৃথিবীতে বেশির ভাগ দেশে এককোটি মানুষ পর্যন্ত নেই। ইণ্ডিয়া তাদের খাওয়াচ্ছে, পরাচ্ছে, কিন্তু কতদিন করবে? শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়া পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে এগিয়ে এল। মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি এল ইণ্ডিয়ার মিলিটারী। ভাবলাম এখন ভয়ংকর যুদ্ধ হবে। কিন্তু কিসের কি! যুদ্ধের কোন নিশানা নেই, এক লক্ষ পাকিস্তান মিলিটারী লেজ গুটিয়ে দুই সপ্তাহের মাঝে কাপুরুষের মৃত আত্মসমর্পণ করে ফেলল।

তখন বুঝতে পারি নি, পরে বুঝেছিলাম। নিরীহ মানুষকে গুলী করা খুব সোজা। পাকিস্তান মিলিটারী সেটা খুব ভাল পারে, চোখ বন্ধ করে তিরিশ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলল। নয় মাসে। কিন্তু সত্যি সত্যি যুদ্ধ করা এত সোজা নয়। যুদ্ধ করতে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন জিনিস লাগে। এক হচ্ছে সরকার, যে যুদ্ধের পরিকল্পনা করবে। দুই মিলিটারী, যারা গোলা-বারুদ বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করবে। আর তিন হচ্ছে দেশের মানুষ যারা এই যুদ্ধকে সমর্থন করবে। যে কোন যুদ্ধে এই তিনটা জিনিসই দরকার, এর একটাও যদি কম হয় যুদ্ধ করা যায় না। পাকিস্তান মিলিটারীর প্রথম দুইটা ছিল কিন্তু তিন নম্বরটা ছিল না। সারা দেশের মানুষ ছিল পাকিস্তান মিলিটারী বিপক্ষে, তাই যখন মুক্তিবাহিনীর সাথে ইণ্ডিয়ায় মিলিটারী এগিয়ে এল পাকিস্তানী মিলিটারীরা একেবারে খাটি কাপুরুষের মত আত্মসমপণ করল। সেটা সম্ভব হয়েছে এই দেশের মানষের জন্যে। যুদ্ধ করুক আর নাই করুক দেশের সব মানুষ ছিল এক সাথে, সব মানুষ ছিল মুক্তিযোদ্ধা!

ডিসেম্ববরের ষোল তারিখ দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে আমাদের বাসায় ফিরে এলাম। জানুয়ারির শেষে রাস্তাঘাট, বীজ কিছু নেই। পাকিস্তান মিলিটারী যখন দেখেছে তাদের কোন উপায় নেই রাস্তা-ঘাট, কল-কারখানা, বীজ সব কিছ ধ্বংস করে গেছে। কাপুরুষের কাজে তাদের সমান আর কেউ নেই।

লঞ্চে করে আমরা যেদিন শহরে পৌঁছলাম, সেদিন জানুয়ারি মাসের উনত্রিশ তারিখ, দুপুর বেলা। আমাদের বাসায় গিয়ে আমরা একেবারে অবাক হয়ে গেলাম, দরজা জানালা আছে কিন্তু ভেতরে কিছু নেই সব কিছু তছনছ করে ফেলেছে। ভিতরে যা আছে সব কিছু ভেঙ্গে ছুঁড়ে লুটপাট করে নিয়ে গেছে। আম্মা যখন কোমরে আঁচল পেচিয়ে জিনিসপত্র টানাটানি করতে শুরু করছেন আমি তখন এক ছুটে বের হলাম খোঁজ-খবর নিতে। প্রথমে ফজলুর বাসায়, দেখি সেখানে আশরাফও আছে। আমাকে দেখে দুজনে চিৎকার করতে করতে ছুটে এল, ইবু এসেছে! ইবু এসেছে!

জাপটা জাপটি করা শেষ হলে আমি বললাম, তোরা ভাল ছিলি?

হ্যাঁ। বেঁচে থাকা মানেই ভাল থাকা।

রাশেদ, রাশেদ কই?

আশরাফ আর ফজলু কেমন জানি চমকে উঠল।

একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল, দেখলাম ওদের মুখটা কেমন যেন ছাইয়ের মত সাদা হয়ে যাচ্ছে। আশরাফ দুই হাতে আমাকে শক্ত করে ধরে বলল, হায় খেদা! তুই এখনও জানিস না?

কি জানি না?

দুজনের কেউ কোন কথা বলল না, কেমন যেন ভয় পেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

কি হল কথা বলছিস না কেন?

তখনো কেউ কথা বলল না।

কি হয়েছে রাশেদের? আশরাফ ঢোক গিলে বলল, ডিসেম্বর মাসের দুই তারিখে ধরা পড়ল বাজারের কাছে। ব্যাগের মাঝে ছয়টা গ্রেনেড ছিল। আজরফ আলী আর রাজাকাররা তখন নদীর ঘাটে নিয়ে দাড় কবিয়ে- দাঁড় করিয়ে—

আমার হঠাৎ মনে হল আমার হাত পায়ে কোন জোর নেই। আমি পিছিয়ে একটা দেয়াল ধরে বললাম, মেরে ফেলেছে রাশেদকে? মেরে ফেলেছে?

আশরাফ হঠাৎ ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল।

আমার ইচ্ছে হল ভয়ংকর একটা চিৎকার করে সারা পৃথিবীকে ভেঙে ধ্বংস করে দিই। হায় খোদা! তুমি এটা কি করলে? কি করলে? তুমি এটা কি করলে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *