মিলি বসে আছে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে।
মিলির বর এতটা আশা করেনি। তার ধারণা ছিল ডাক্তারের কাছে যাবার কথা শুনে সে রোগে উঠবে। হৈচৈ করবে। ইদানীং সে খুব হৈচৈ করছে। কিন্তু আজ সে বেশ শান্ত। সহজ সুরে পাশে বসা মহিলার সঙ্গে কথা বলছে। মহিলা পান খাচ্ছেন। তিনি নিশ্চয়ই পেসেন্ট নন। কোন রোগী ডাক্তারের কাছে এসে এমন আরাম করে পান চিবোয় না। মিলি তার বরকে হাত ইশারা করে ডাকল। মতিয়ুর নড়ল না। কাছে গেলেই মিলি হয়ত চট করে রেগে যাবে। সহজ স্বাভাবিক ভাব মুহুর্তের মধ্যে মাটি হবে। মিলি নিজেই এগিয়ে এল। হাসি মুখে বলল, আমাকে একটা পান এনে দেবে? পান খেতে ইচ্ছা হচ্ছে।
ডাক্তারের কাছেও সে বেশ স্বাভাবিক রইল। মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বলল, পান খাচ্ছি বলে রাগ করছেন না তো? ডাক্তার সাহেব হাসলেন।
না, রাগ করব কেন?
আমার বড় ভাই খুলি রাগ করেন।
তাই বুঝি?
জি। কাউকে পান খেতে দেখলেই তার নাকি গরুর জাবর কাটার কথা মনে হয়। ভাইয়া এমনিতে খুব গম্ভীর। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সব মজার কথা বলে? আপনি আমার ভাইকে চেনন তো?
হ্যাঁ নামে চিনি। টিভিতে একবার দেখেছিলাম। কী একটা প্রোগ্রামে যেন এসেছিলেন। টিভিতে খুব লাজুক মনে হচ্ছিল।
উনার কোনো বই পড়েছেন?
গল্পের বই পড়ার অভ্যাস আমার খুব কম।
আমারো কম। ভাইয়া আমাকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছে, সেটি শেষ করতেও আমার এক মাস লেগেছে। আপনি বোধ হয়। আমার কথা বিশ্বাস করছেন না।
বিশ্বাস করব না কেন?
কেউ বিশ্বাস করে না।
মিলি হাই তুলল। সন্ধ্যাবেলার দিকে তার একবার প্রচণ্ড ঘুম পায়। তারপর বাকি রাতটা কাটে জেগে। কি কষ্ট! কি কষ্ট!
আপনার ভাইকে আপনি খুব পছন্দ করেন?
হুঁ।
আর কাকে পছন্দ করেন?
আর কাউকে না।
কাউকে না?
না। আমার এই কথাটিও আপনি বিশ্বাস করছেন না, তাই না?
বিশ্বাস করব না কেন?
আমার কেন জানি শুধু মনে হয় কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। আমি অবশ্যি খুব মিথ্যা কথা বলি।
সে তো আমরা সবাই বলি। আমিও বলি।
মিলি খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। ডাক্তার সাহেব অপেক্ষা করতে লাগলেন। মিলি বলল,
আপনি আমার সব কথাতেই সায় দিচ্ছেন কারণ আপনার ধারণা আমি পাগল তাই আমাকে না। রাগাবার চেষ্টা করছেন।
আপনার ধারণা ঠিক নয়। আপনি একজন সুস্থ মানুষ। আপনার কথায় সুন্দর লজিক আছে। একজন মানষিক রোগীর কথাবার্তায় কোনো লজিক থাকে না। প্রায়ই ওরা বুদ্ধিমানের মত কনভারসেশন চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু লজিকে এসে আটকে যায়।
আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই পাগল।
ডাক্তার সাহেব হেসে ফেললেন। মিলিও হাসল। এই ডাক্তারটিকে তার পছন্দ হয়েছে। ক্লিনিক থেকে বেরিয়েই মিলি বলল, আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে পারছি না। মতিয়ুর বলল, বাসায় যাচ্ছি। বাসায় গিয়েই ঘুমিয়ে পড়বে। সে তার স্ত্রীর হাত ধরল। অনেক দিন পর সে স্ত্রীর প্রতি অন্য এক ধরনের মমতা অনুভব করছে। অসহায় শিশুর জন্য যে ধরনের মমতা অনুভব করা হয় সে ধরনের মমতা।
মিলি বলল, আমার বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না।
বাসায় না গেলে কোথায় যাবে? রাস্তায় ঘুরবে খানিকক্ষণ? না। আমাকে ভাবীর বাসায় নিয়ে চল। অনেকদিন ভাবীকে দেখি না। তাঁকে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।
কাল সকালে গেলে হয় না?
সকালে উনাকে পাওয়া যাবে না। অফিসে চলে যান। তা ছাড়া এখন আমার যেতে ইচ্ছা! করভুসুকুম হয়ত যেতে ইচ্ছা করবে না। ভাবীর সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা আছে।
কী কথা?
মিলি জবাব দিল না। তার ঘুম পাচ্ছে। গাড়িতে উঠেই সে চোখ বন্ধ করে এলিয়ে পড়ল। কে জানে আজ রাতে হয়ত তার গাঢ় ঘুম হবে। জেগে জেগে রাত কাটাতে আর ভাল লাগছে না।
মতিয়ুর নরম গলায় বলল, ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে তোমার কী কথা হল?
তেমন কোনো কথা হয়নি। আমি পান খাচ্ছিলাম তো তাই দেখে উনি খুব রেগে গেলেন। রাগলেন কেন?
ভাইয়ার মত স্বভাব। ভাইয়াও তো রাগত।
বলেই মিলি হাসল। মতিয়ুর আর কিছু বলল না।
মিলিকে দেখে রানু খুবই অবাক হল।
একি অবস্থা তোমার মিলি। শরীরের এ রকম হাল কেন?
আমি পাগল হয়ে গেছি। ভাবী।
কী বলছ আবোল-তাবোল। আস, তুমি বিছানায় শুয়ে থাক। তোমার এতটা শরীর খারাপ হয়েছে আমি জানতামই না।
টগর চোখ বড় বড় করে দেখছে মিলিকে। অপলক তাকিয়ে আছে। মিলি বলল, ভাবী ওকে বল চলে যেতে, আজ রাতে আমি তোমার সঙ্গে ঘুমোব। বলেই সে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। এই কথাটি সে দীর্ঘদিন পরে বলল। তার বিয়ের পরও সে বেশ অনেকবার অসময়ে চলে এসেছে রানুর কাছে। লজ্জিত ভঙ্গিতে বলেছে, ভাবী আজ রাতে তোমার সঙ্গে ঘুমোব। রানু হেসে বলল, ঝগড়া কিছু করেছ?
না, ঝগড়া না। এমনি। ভাইয়াকে বল অন্য ঘরে ঘুমুতে। আজ সারা রাত গল্প করব আমরা দু’জন। কেমন ভাবী?
হ্যাঁ করব।
গল্প অবশ্যি করা হত না। শোয়া মাত্রই মিলি ঘুমিয়ে পড়ত। নিশ্চিন্ত ঘুম। আজ অনেক দিন পর মিলির আবার হয়ত পুরানো সখ জেগে উঠেছে। সারারাত গল্প করার কথা বলবে কিন্তু বিছানায় যাওয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়বে।
মতিয়ুর মিলিকে রেখে যেতে রাজি হল না। নিচু গলায় বলল, ওর শরীর খুবই খারাপ। ও যে কি পরিমাণ বিরক্ত করে ধারণাও করতে পারবেন না। রাতে একজন ডাক্তার এসে থাকেন। আজ সে অনেক ভাল। কতক্ষণ এরকম ভাল থাকবে বলা মুশকিল।
হঠাৎ করে এ রকম হল কেন?
হঠাৎ করে হয়নি। ধীরে ধীরে হয়েছে। আপনি অনেক দিন পর দেখছেন বলে আপনার কাছে এ রকম লাগছে।
ডাক্তার কী বলছেন?
তেমন কিছু বলছেন না। বলার মত হয়ত কিছু নেই। আমি গাড়ি রেখে যাচ্ছি, ঘণ্টাখানিক বা ঘণ্টা দু’এক পর পাঠিয়ে দেবেন।
মিলি বিছানায় শুয়ে ছিল। অপলা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। টগর অনেক দূরে বসে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। মিলি টগরের প্রতি কোনো রকম উৎসাহ দেখাল না। যেন সে টগরকে চিনতে পারছে না।
রানু বলল, তুমি কিছু খাবে মিলি?
আমি কিছুই খাব না। তুমি আমার পাশে বস।
তোমার শরীর এত খারাপ হয়েছে আমাকে কিছু বলনি কেন।
বললে তুমি কী কবতে?
মিলি ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। থেমে থেমে বলল, আমার জন্যে কেউ কখনো কিছু করে না। আমার মা করেনি, আমার বাবা করেনি, তুমি কেন করবে? তুমি তো বাইরের মেয়ে। রানু কিছু বলল না। চেযার টেনে মিলির পাশে এসে বসল।
আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি। তখন একদিন বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। কারণ খুব সামান্য। মার একটা শাড়ি পরে ছাদে হাঁটছিলাম। বাবার ধারণা হল পাশের বাসার একটা ছেলের সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করছি। তুমি আমার কথা বিশ্বাস কবছ তো ভাবী?
করছি।
আমি অবশ্যি প্রচুর মিথ্যা কথা বলি, তবে মাঝে মাঝে সত্যি কথাও বলি। আমারই হযত লেখক হওয়া উচিত ছিল কিন্তু লেখক হয়ে গেল ভাইয়া। যে তার সাবা জীবনে কোন মিথ্যা কথা বলেনি। মজার ব্যাপার, তাই না ভাবী?
মিলি তাকাল রানুর দিকে। সে হয়ত মনে মনে ভেবেছে এই জাগোযাতে বানু আপত্তি করবে। কিন্তু রানু কিছু বলল না। মিলি বলল, ভাইযা প্রসঙ্গে এই কথাটা কী আমি ঠিক বললাম ভাবী?
বোধ হয় ঠিক।
তবে আমার কী মনে হয় জান ভাবী, আমার মনে হয় সব মানুষের মিথ্যা বলাব অভ্যেস থাকা উচিত। এতে অনেক ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওযা যায়। ভাইযােব। যদি মিথ্যা বলাব অভ্যাস থাকত তাহলে আর তোমাদের এই ঝামেলা হত না।
রানু ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমার তো মিথ্যা বলার অভ্যাস আছে। তোমাদের খুব ঝামেলা হয় না?
হয়।
মিথ্যা কথা বলা না বলার ওপর কোনো সম্পর্ক নির্ভর করে না।
মিলি একটি নিঃশ্বাস ফেলল। অপলা বলল, আপনার বাবা আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে। দিলেন তারপর কী হল সেটা বলুন, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে। রানু বিবক্ত স্বাবে বলল, ঐ সব শুনে কী হবে?
আমার শুনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে আপা।
মিলি হাসি মুখে বলল, ব্যাপারটা খুব কষ্টের কিন্তু এখন কেন জানি আমার হাসি লাগছে। বাবা আমাকে ছাদ থেকে ডেকে আনলেন, তারপর খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, যে ছেলেটিকে ভুলাবার জন্যে তুমি এত সাজসজ্জা করে ছাদে হাঁটাহাঁটি করছ, তার সঙ্গে চলে যাও। এই বলেই দারোযানকে গোট বন্ধ করে দিতে বললেন। আমি গেটের বাইরে হতভম্ব হয়ে দাড়িযে রইলাম। আমার গায়ে ঝলমলে একটা শাড়ি। কিন্তু পায়ে কিছু নেই। খালি পাযে ছাদে হাঁটছিলাম তো।
তার পর?
তার পরটা শুনে কী হবে? বাদ দাও। বাবার স্বভাবই ছিল এ রকম। আমাদের দুই ভাইবোনকে কি পরিমাণ কষ্ট যে দিয়েছেন। ভাইয়ার প্রথম বই যখন বের হল খুব হৈচৈ হল। অল্প দিনের মধ্যেই ভাইয়া বিখ্যাত হয়ে গেল। তখন বাবা ইংরেজিতে একটা বিশাল প্রবন্ধ লিখলেন এবং সেই প্রবন্ধে প্রমাণ করলেন যে বইটা কোনো এক ফরাসি বিখ্যাত উপন্যাসের দুর্বল অনুকরণ। মিলি শব্দ করে হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। রানুর এই প্রথমবারের মত মনে হল মিলি বেশ অসুস্থ।
বুঝলে ভাবী, আমরা দু’জন খুব কষ্ট করেছি।
রানু কথা ঘুরাবার জন্যে বলল, তোমার মেয়ে কেমন আছে?
জানি না কেমন আছে। বোধ হয় ভালই আছে।
জান না মানে?
ও তো আমার সঙ্গে থাকে না। একেক সময় একেক জনের সঙ্গে থাকে। এখন আছে তার এক ফুপুর সঙ্গে। আমার তো মাথার ঠিক নেই। আমার সঙ্গে রাখতে ভরসা পায় না। কখন কি করে বসি। কয়েকদিন আগে আমার কাছে এনেছিল, আমি এমন ভান করলাম যেন চিনতে পারছি না। আমি মাঝে মাঝে পাগলের ভান করি এবং বেশ ভালই করি।
মিলি আবার উঁচু স্বরে হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতেই বলল, ভাবী আমি উঠব।
এখনই উঠবে?
হ্যাঁ, এসো তুমি আমাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দাও।
রানু বলল, টগারকে আদর করলে না? সব সময় তো আদর করতে।
এখন আমার আর ছোট বাচাকাঁচা ভাল লাগে না ভাবী। টগর যাই? অপলা যাচ্ছি কেমন?
আবার এসো।
না, আমি আর আসব না।
কেন?
মিলি হাসতে হাসতে বলল, আর আসতে ইচ্ছা করবে না। অপলা হেসে ফেলল। মিলি বলল আমার কথা তুমি বিশ্বাস করছ না, তাই না? মাঝে মাঝে আমি কিন্তু সত্যি কথা বলি।
রানু মিলিকে ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামল। মিলি বলল, আমি নিজে নিজেই নামতে পারব। আমাকে যতটা দুর্বল দেখাচ্ছে তত দুর্বল আমি না। আমি বেশ শক্ত। মাঝে মাঝে দুর্বল হবার ভান করি।
কেন কর?
যাতে ও আমাকে ভালবাসে।
মিলি আবার হেসে ফেলল। আদুরে গলায় বলল, আমার শুধু ভালবাসা পেতে ইচ্ছা করে।
রানু বলল, সে তো সবারই করে। মিলি শান্ত স্বরে বলল, না। সবার করে না। যেমন তুমি, তোমার কী করে?
রানু জবাব দিল না।
ভাবী, এখন বিদেয় হচ্ছি। বক বক করে সবার মাথা ধরিয়ে দিয়েছি। পাগল মানুষ, কী করব বল?