আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মামুনের মন খারাপ হয়ে গেল।
শার্টের পকেটের কাছে এক পয়সার সাইজের একটা ফুটো তেলাপোকার কাণ্ড। এই শার্ট গায়ে দিয়ে বেরুনো যাবে না। সবাই তাকিয়ে থাকবে। কিন্তু বদলে অন্য কিছু পরতেও ইচ্ছা করছে। না। এটা মুনার পছন্দ করে কিনে দেয়া শার্ট। মামুন ভেবে রেখেছিল ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলেই এটাই পরবে। তাতে মুনার উপর এক ধরনে মানসিক চাপ তৈরি হবে। লাল স্ট্রাইপের এই শার্ট নিঃশব্দে সারাক্ষণ বলবে।–মুনা, তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে ভালবাসি। মেয়েদের মনস্তত্ত্বে ছেলেমানুষী একটা ব্যাপার আছে। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়েরাও এ ধরনের হালকা জিনিস পছন্দ করে।
কিন্তু এটা পরে কী খাওয়া যাবে? ফুটোটা বেশ বড়। সাদা গেঞ্জি দেখা যায়। মামুন আয়নার সামনে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে মন ঠিক করল। থাকুক ফুটো। এতে একটা সুবিধা পাওয়া যাবে। মুনা এক সময় নিশ্চিত বলবে ১ পকেটের ওখানে কি? সে তখন মুখ কালো করে বলবে হৃদয়ের কাছাকাছি ফুটো হয়ে আছে। খুবই হালকা ধরনের কথা। তবে হালকা ধরনের কথাবার্তাও মাঝে মাঝে শুনতে ভাল লাগে।
মামুন মুনার অফিসে ঢুকে আকাশ থেকে পড়ল। মুনা নেই। সে নাকি দুমাসের ছুটি নিয়েছে। আজ নিয়ে পাঁচ দিন হল। কিন্তু অদ্ভুত কথা! পাল বাবু চোখ কপালে তুলে বলবেন, সে কী আপনি জানেন না?
জি না, জানি না।
বলেন কি? কেন জানেন না?
মামুন বিরক্ত হয়ে বলল, আমাকে বলেনি। তাই জানি না।
কিন্তু আপনাকে বলবে না কেন? হোয়াই? ঝগড়া চলছে নাকি?
না কিছু চলছে না।
বিরক্তিতে মামুনের চোখ সরু হয়ে গেল। পাল বাবু তার বিরক্তিকে মোটেও আমল দিলেন না। জোর করে তাকে ক্যান্টিনে নিয়ে আলুর চাপ এবং চায়ের অর্ডার দিয়ে বসলেন। মামুন শুকনো গলায় বলল, খামোকা এসব আনছেন। আমি কিছুই খাব না।
না খেলে না খাবেন। আমার সঙ্গে দুমিনিট বসতে তো অসুবিধা নেই। আরাম করে বসুন এবং ধীরে-সুস্থে বলুন ব্যাপারটা কি? ঝগড়াটা কি নিয়ে করলেন?
ঝগড়া হয়েছে আপনাকে কে বলল?
এসব বলার দরকার হয় না। আপনার চোখে-মুখে পরিষ্কার লেখা আছে। মান-অভিমানপর্ব বোঝা যায়। হা হা হা।
মামুন কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। আগে এই লোকটিকে ভালই লাগত। আজ কেমন গ্ৰাম্য লাগছে। কথার ফাঁকে থুথুর কণা ছিটকে আসছে। কিছু কিছু নিশ্চয়ই পড়েছে চায়ের কাঁপে এবং আলুর চাপে। কুৎসিত দৃশ্য। সহ্য করা মুশকিল। মামুন সাহেব।
বলুন।
রাগ ভাঙবার বুদ্ধি আপনাকে শিখিয়ে দিচ্ছি। সোজা বুদ্ধি। জটিল সমস্যা গুলি সলভ করতে হয় সহজ বুদ্ধি দিয়ে। কঠিন বুদ্ধি খরচ করলে সমস্যটা আরো জট পাকিয়ে যাবে। চা খাচ্ছেন না। তো। ঠাণ্ডা হচ্ছে।
হোক ঠাণ্ডা। দুপুরে আমি চা খাই না।
তাহলে ঠাণ্ডা কিছু খান–লাচ্ছি আছে। এই ইনাকে ভাল করে লাচ্ছি দাও।
আপনি শুধু শুধু ব্যস্ত হচ্ছেন আমি কিছুই খাব না।
আরে ভাই খান। খেতে খেতে আমার বুদ্ধিটা শুনুন। কিছু না যাবেন, সোজাসুজি পায়ে ধরে ফেলবেন এবং কান্না কান্না গলায় বলবেন ক্ষমা চাই।
রাগে মামুনের গা জ্বলে গেল। কি রকম ইডিওটিক কথাবার্তা। এ ধরনের কথাবার্তা একজন শিক্ষিত মানুষ বলে কি করে?
বুঝলেন মামুন সাহেব, এপ্রোচটা নাটকীয় কিন্তু এর নাম হচ্ছে কোরামিন ইনজেকশান। এটাতেই রোগের আরাম হবে। আর যদি কাজ না হয় তাহলে আপনি অফিসে এসে আমার ডান গালে একটা চড় দিয়ে যাবেন। হা হা হা।
এখানে বসে সময় নষ্ট করার আর কোনো মানে হয় না। যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণই এর বকবকানি শুনতে হবে।
উঠলেন নাকি?
জি উঠলাম।
লাচ্ছি। তো মুখেই দিলেন না।
বলছি তো আপনাকে, কিছুই খাব না।
আপনি মিস মুনার বাসায় চলে যান। যা বললাম সেটা করেন। শ্ৰীকৃষ্ণের মত দেবতা যদি রাধার পা ধরতে পারে তাহলে আপনার ধরতে বাধা কী?
বকুল আজ স্কুলে যায়নি। স্কুল খোলা আছে, টেস্ট পরীক্ষার প্রিপারেশনের জন্যে ক্লাস হচ্ছে না। একা একা বাসায় তার ভয় ভয় লাগছিল। কাজের মেয়েটি তার এক খালার বাড়িতে গেছে এখনো আসেনি। বাবুর স্কুল ছুটি তিনটায়। এতক্ষণ একা একা থাকতে হবে। সে ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠে নিচু গলায় বলছিল কে? একা ঘরে থাকলেই যত ভূতের গল্পগুলি মনে পড়ে যায়। টিনা ভাবীর কাছে শোনা একটা গল্প তখন থেকেই মনে হচ্ছে কাটা হাতের গল্প। কবজি পর্যন্ত কাটা একটা হাত মানুষের ঘরে এসে ঢোকে। নানান কাণ্ডকারখানা করে। বকুলের দুপুর থেকে মনে হচ্ছে হাতটা তাদের ঘরে এসেছে। রান্নাঘরে খুটখাট করছে। সে একা একা বসে আছে রান্নাঘরে। তার দুপুরের খাওয়া হয়নি। বাবু না আসা পর্যন্ত হবেও না। একা একা রান্নাঘরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
দুটোর সময় দরজার কড়া নড়ল। বকুলের আনন্দের সীমা রইল না। যাক কেউ-একজন এসেছে। সে দরজা খুলে দেখল মামুন ভাই। হেঁটে হেঁটে এসেছেন বোধ হয়। ঘেমে লাল হয়ে আছেন।
কেমন আছ বকুল?
জি ভাল আছি।
মুনা বাসায় নেই?
জি না। আপা নেই।
কোথায় গেছে?
জানি না। কোথায় যেন ঘুরে বেড়ায়।
বল কি।
ভেতরে আসুন মামুন ভাই। আপনি আসায় যা ভাল লাগছে। একা একা খুব ভয় লাগছিল।
একা তুমি?
জি একা।
মামুন ভেতরে ঢুকল। কথাবার্তা কী বলবে ভেবে পেল না। কিছুক্ষণ অবশ্যি অপেক্ষা করা যায়। মামুন বলল, সে সাধারণত কখন ফিরে?
কোনো ঠিক নেই। অনেক সময় সন্ধ্যার পর ফিরে।
বল কি?
আপনাদের ঝগড়া হয়েছে তাই না মামুন ভাই?
মামুন ইতস্তত করে বলল, হ্যাঁ হয়েছে। তোমাকে সে কি কিছু বলেছে?
না, মুনা। আপা মরে গেলেও কাউকে কিছু বলবে না। আপনাকে একটু চা করে দেই?
উঁহু! ভাত খাইনি এখনো।
আমাদের এখানে খান। আমিও খাইনি।
না ভাত খাব না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে যাব। তুমি আমাকে ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও।
মামুন মুখ কালো করে বসে রইল। বকুল ঠাণ্ডা পানি বদলে ভাত বেড়ে বলল, খেতে আসুন মামুন ভাই। মামুন নিঃশব্দে খাবার টেবিলে গিয়ে বসল। বড় মায়া লাগল বকুলের। কেমন আগ্রহ করে খাচ্ছেন। নিশ্চয়ই খুব ক্ষিধে পেয়েছে।
বকুল!
জি।
আমার ব্যাপারে তোমার আপা তোমাকে সত্যি কিছু বলেনি?
জি না।
আমি একটা অন্যায় করেছিলাম বুঝলে বকুল। তার জন্যে আমার লজ্জার সীমা নেই। আমি তো মহাপুরুষ না। সাধারণ মানুষ। মহাপুরুষেরাও ভুল করে। অন্যায় করে। করে না?
বকুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মামুন ভাই ক্লাসে বক্তৃতা দেবার মতো ভঙ্গিতে কথা বলছেন। ওদের ভেতর কি সমস্যা হয়েছে কে জানে? বড় জানতে ইচ্ছা করছে।
মামুন খাওয়া শেষ হওয়া মাত্র চলে গেল। অদ্ভুত ভঙ্গিতে চলে যাওয়া। যেন সে হঠাৎ সবার উপরে বিরক্ত হয়ে উঠেছে। মনস্থির করছে কিছু-একটা করবে। কেমন থমথমে মুখ।
বাবু এল সাড়ে তিনটার দিকে। শীতের দিন। সাড়ে তিনটায় কেমন বিকেল বিকেল হয়ে যায়। বাবুকে ভাত বেড়ে দিয়ে বুকল বলল, তুই কিছুক্ষণ একা থাকতে পারবি বাবু? আমি ভাবীদের বাসায় পাঁচ মিনিটের জন্যে যাব। বাবু গম্ভীর গলায় বলল, একবার গেলে এক ঘণ্টার আগে আসবে না।
যাব আর আসব। উনার ছেলেদের জ্বর। দেখে আসা দরকার। যাই বাবু? লক্ষ্মী ময়না।
আচ্ছা যাও।
একা এক ভয় লাগবে না তো?
আমার এত ভয় নেই।
ইস কি আমার সাহসী। রাতে তো একা একা বাথরুমে যেতে পারিস না।
বাবু কিছু বলল না। কথাটা সত্যি। দিনের বেলা তার কোনো ভয় লাগে না। কিন্তু রাত হলেই দারুণ ভয় লাগে।
টিনা ভাবী ঠোঁট উল্টে বললেন, তারপর কি মনে করে? তার মনে ভাবী রেগে আছেন। রাগাই স্বাভাবিক। দু’দিন খবর পাঠাচ্ছেন্ন আসবার জন্যে। আসা হচ্ছে না।
বাচ্চারা কেমন আছে ভাবী?
তা জেনে তোর কী হবে? ওরা জ্বরে বেইশ হয়ে পড়ে থাকলেই বা কি আর ভাল থাকলেই বা কি?
বকুল বেশ লজ্জা পেল। দু’টি বাচ্চার প্রচণ্ড জ্বর। হাত-পা এলিয়ে ঘুমাচ্ছে। জ্বরের আঁচে গা কেমন লালাভ হয়ে আছে।
ডাক্তার দেখিয়েছ ভাবী?
হুঁ দেখিয়েছি। তোর ডাক্তারকেই আনিয়েছিলাম। ও ডাক্তারি কিছু জানে না বলে মনে হয়, কি ওষুধপত্র দিয়েছে তাতে জ্বর আরো বেড়ে গেছে।
অন্য ডাক্তার দেখাও। দেশে কি আর ডাক্তার নেই? কত বড় বড় ডাক্তার আছে।
অন্য ডাক্তার দেখাব। চক্ষুলজার জন্যে পারছি না। বেচারা রোজ দুতিনবার এসে খোঁজ নেয়। এখন যদি দেখে অন্য ডাক্তায় এনেছি…। মহা যন্ত্রণায় পড়লাম বুঝলি।
তুমি আজই অন্য ডাক্তার খবর দাও।
তাই দিতে হবে। তোর ভাই চোঁচামেচি করছে। আমি আজ দিনটা সময় নিয়েছি। আজ দিনের মধ্যে না কমলে অন্য ডাক্তারের কাছে যাব।
ভাবী দেখ, গা ঘামছে। জ্বর বোধ হয় নেমে যাচ্ছে। ঠোঁট চাটছে। ওদের একটু পানি খাওয়াই। খাওয়া। বোতলে গুকোজ সরবত আছে দেখ। আমি একটু গা ধুয়ে আসি।
পাঁচ মিনিটের জন্যে এসে এক ঘণ্টার ওপর কাটিয়ে দিল। তার উঠে আসতে ইচ্ছে করছে না। টিনা ভাবী দুই বাচ্চাকে দুই পাশে নিয়ে শুয়ে শুয়ে গল্প করছে। এত ভাল লাগছে দৃশ্যটি দেখতে। একই রকম দেখতে দু’টি বাচ্চাকে দুপাশে নিয়ে শোবার মতো আনন্দ বোধ হয়। আর কিছু নেই। বকুলের মনে হল–ইস। তার যদি এ রকম দু’টি বাচ্চা হত। এটা মনে হতেই সে লজ্জায় বেগুনী হয়ে গেল। তার মনে হল টিনা ভাবী তার মনের কথাটা টের পেয়ে ফেলেছে।
বকুল!
কী ভাবী?
তো বিয়ের কথাবার্তা পাকা করতে হয়। কার সঙ্গে কথা বলব? তোর আসল গার্জেন তো বোধ হয় তোর বোন।
বকুল মাথা নিচু করে বসে রইল। উত্তর দিল না। টিনা হালকা গলায় বলল, তুই কিছু মনে করিস না বকুল–তোর এই বোনটাকে আমার পছন্দ হয় না। কেমন পুরুষ পুরুষ ভাব।
মুনা আপা খুব ভাল মেয়ে।
ভাল মেয়ে তো বটেই। তোদের ঝামেলার যেভাবে ঝড় সামাল দিয়েছে। এ রকম কাঁটা পুরুষ পারবে? তবে ব্যাপার কি জানিস বকুল.. তোর আপা হচ্ছে কঠিন ধরনের মেয়ে। মেয়েরা কঠিন হলে ভাল লাগে না। মেয়েরা হবে নরম ধরনের। আহাদী। কথায় কথায় কেঁদে ফেলবে… যেমন তুই?
আমি বুঝি আহাদী?
না আহাদী না। তুই হচ্ছিস মায়াবতী।
মুনা আপা বুঝি মায়াবতী না?
না।
বকুলের মন খারাপ হয়ে গেল। মুনা আপা সম্পর্কে কেউ কিছু বললে তার ভাল লাগে না। রাগ লাগে।
বকুল, এমন মুখ কালো করে ফেলেছিস কেন?
ভাবী, আমি উঠি?
এখন উঠবি কি? আরেকটু বস। তোর ডাক্তার আসবে কিছুক্ষণ মধ্যে। তার সঙ্গে দুই-একটা কথাটথা বল।
কি যে তুমি বল ভাবী।
বিয়ের আগে কথাটথা বলা হাতের সঙ্গে হাত লেগে যাওয়া এইসব খুব ভাল লাগে। অন্য রকম একটা আনন্দ হয়। বিয়ের পর দেখবি এইসব খুব পানসে লাগছে। শরীরের সঙ্গে শরীরের পরিচয়ের আগের যে প্রেম সেটার মত ভাল আর কিছু নেই।
টিনা ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলল। মনে মনে বকুলও একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার কেমন ভয় ভয় করে। এত রহস্য পৃথিবীতে। এইসব রহস্যের মধ্যে বড় হওয়া বেশ কষ্টে।
বকুল। একটু চা করতে পারবি। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের পাতা মেলে রাখতে পারছি না।
ঘুমাও।
উঁহু। তোর ভাই আসবে। ঘুমিয়ে আছি দেখলে মুখ ভারী হয়ে যাবে। পুরুষ মানুষদের তুই তো চিনিস না। অদ্ভুত জিনিস।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই।
বাচ্চা দু’টি এমন ওদের যন্ত্রণাতেই রাতে ঘুমুতে পারছি না–শেষ রাতে একটু তন্দ্ৰামত এসেছে তখন তোর ভাই ডেকে তুলল। তার নাকি ভীষণ মাথাব্যথা চুল টেনে দিতে হবে। উঠে গেলাম চুল টেনে দিবার জন্যে–ও আল্লা দেখি মাথা ব্যথা কিছু না তার অন্য কিছু চাই।
বকুল মুখ লাল করে বসে রইল।
পুরুষের মত স্বার্থপর জাত আর তৈরি হয়নি। নিজের বাচ্চারা এমন অসুস্থ এর মধ্যে কেউ কি পারে…
বকুল কথার মাঝেই উঠে দাঁড়াল। মৃদু স্বরে বলল, ভাবী আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসি।
লজ্জায় তুই দেখি একেবারে লাল হয়ে গেছিস। এসব খুব সাধারণ ব্যাপার। বিয়ের দু’দিন পর দেখবি ডাল-ভাত হয়ে গেছে।
বকুল চা বানিয়ে এসে দেখে টিনা ভাবী ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে ঘুম থেকে জাগানোর কোনো মানে হয় না। সে নিজেই চাটা খেল। বাচ্চা দু’টির জ্বর আসলেই অনেকখানি কমেছে। এরা ঘুমের মধ্যে হাসছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার দু’জন একই সঙ্গে হাসছে। একটি স্বপ্নই বোধ হয় দেখছে দু’জন। বকুল নিচু হয়ে ওদের কপালে চুমু খেল। কেমন দুধ দুধ গন্ধ। একবার চুমু খেলে মুখ উঠিয়ে নিত ইচ্ছা করে না। বুকের মধ্যে কেমন অদ্ভুত ভাবে শিরশির করে। কেন করে? কোনোদিন বোধ হয় তা জানা যাবে না।
বকুল বেরুল চারটার একটু আগে। বেরুনো মাত্র দেখা হল ডাক্তার ছেলেটির সঙ্গে। বকুলের বুক ধ্বক করে উঠল। এক পলকের জন্যে দুলে উঠল সব কিছু।
বকুল ভাল আছ?
রুগী দেখতে গিয়েছিলো?
হুঁ।
আছে কেমন ওরা?
ভাল।
তোমার তো আর দেখাই পাওয়া যায় না। স্কুলে যাও না?
এখন আমাদের ক্লাস হচ্ছে না।
ক্লাস হচ্ছে না কেন?
টেস্টের প্রিপারেশনের জন্য।
কেমন হচ্ছে প্রিপারেশন?
ভাল। আমি এখন যাই?
এই সপ্তাহের মধ্যেই আমার মা যাবেন তোমাদের বাসায়।
বকুল কিছু বলল না। জহির হাসিমুখে বলল, মাকে তোমার ছবি দেখিয়েছি; মা কি বললেন জান? মা বললেন–মেয়েটার নাকটা এত মোটা কেন? জহির বেশ শব্দ করে হাসতে লাগল। এত লজ্জা লাগছে বকুলের। একই সঙ্গে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা শুনতেও ইচ্ছা করছে। সম্পূর্ণ দুরকম জিনিস একসঙ্গে মানুষের মনে আসে কিভাবে কে জানে।
বকুল!
জি।
তুমি দেখি ঘেমে-টেমে একটা কাণ্ড করছি। এত অস্বস্তি বোধ করছ কেন? এ কালের মেয়েরা কত স্মার্ট থাকে।
আমি যাই এখন।
বকুলের পা পাথরের মত ভারী। বড্ড কষ্ট হচ্ছে পা টেনে টেনে যেতে। কান্না পেয়ে যাচ্ছে। একটা সময় আসছে। যখন এই ছেলেটির সঙ্গে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করবে। উঠে চলে যাবার কোনো তাড়া থাকবে না। কে দেখে ফেলবে এই নিয়ে চাপা আতংক থাকবে না। কি প্রচণ্ড সুখের সময়ই না হবে সেটা। ঝুম বৃষ্টি নামলে তারা দুজনে বৃষ্টিতে ভিজবে। হাত ধরাধরি করে ভিজবে। ভাবতে বকুলের চোখ জলে ভর্তি হয়ে গেল। সুখের কথা ভাবতেও যে কষ্ট হয় কেন কে জানে। এত বিচিত্র কেন পৃথিবীটা। কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে। কাকে সে জিজ্ঞেস করবে?