১৮. বৈশাখ মাস

বৈশাখ মাস।

আকাশে মেঘা জমতে শুরু করেছে। ধরন দেখে মনে হয় কালবৈশাখী হবে। পাখিরা অস্থির হয়ে ওড়াউড়ি করছে। ওরা টের পায়। কবির মাস্টার দ্রুত পা চালাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে আছে শওকত। শওকতের মাথায় বিছানার চাদর দিয়ে বাঁধা গাদাখানেক বই। বইগুলি যোগাড় হয়েছে নীলগঞ্জ পারলিক লাইব্রেরির জন্যে। পারলিক লাইব্রেরি আপাতত তাঁর শোবার ঘরে। খুব শিগগিরই ঘর তোলা হবে। জমি খানিকটা পেলেই হয়। জমি পাওয়া যাচ্ছে না!

কবির মাস্টার আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত স্বরে বললেন, তাড়াতাড়ি পা চালা শওকত। তুই দেখি বইগুলি ভেজানোর মতলব করছিস!

আর কত তাড়াতাড়ি যাইতাম কিন? আমি তো আর ঘোড়া না। মাথার উপরে আছে তিনিমুণি বোঝা।

লম্বা লম্বা পা ফেল রে বাবা। বই ভিজিলে সৰ্ব্বনাশ!

লম্বা লম্বা পা ফেলেও রক্ষা হল না। কালী মন্দিরের কাছাকাছি আসতেই চেপে বৃষ্টি এল। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস। তারা ছুটতে ছুটতে কালী মন্দিরে উঠল। মন্দিরটি জরাজীর্ণ। পূজা-টুজা হয় না। দীর্ঘ দিন। কালীমূর্তির মাথা নেই। মন্দিরের চাতাল গোবরে ভর্তি। কবির মাস্টারের এক পা গোবরে ড়ুবে গেল।

এহ, কী কাণ্ড রে শওকত!

পাকা দালানের বাড়ি। ছাদ ফেটে গেছে। পানি আসছে ভাঙা ছাদ থেকে। শওকত বলল, হাত তালি দেন স্যার।

কেন?

জায়গাটা সাপে ভর্তি।

বলিস কী!

দুইটা ছাগল মরাল সাপের কামড়ে।

আরো ব্যাটা, আগে বলবি তো!

কবির মাস্টার এই একটি প্রাণীকে ভয় করেন। এই প্ৰাণীটির সঙ্গে কেন যেন তাঁর বারবার দেখা হয়।

শওকত!

জ্বি স্যার।

চল, রওনা দিই।

এই তুফানের মইধ্যে কই যাইবেন? জবর তুফান হইতাছে।

বাতাসের বেগক্রমেই বাড়ছে। মন্দিরের দরজা-জানালা কিছু নেই। বৃষ্টির ঝাপটায় দু জনেই কাকতেজা হয়ে গেল। কবির মাস্টার একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। এক কালে কত জাঁকজমক ছিল মন্দিরের। প্রতি অমাবস্যায় ঢাক-ঢোল বাজিয়ে পূজা হত। এখন কিছুই হয় না। গরু-ছাগল চরে বেড়ায়। বিত্তশালী হিন্দুদের কেউই নেই। সবার ধারণা হয়েছে, সীমান্ত পার হতে পারলেই মহা সুখ।

পালবাবুরা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর একটি ছেলে মারা গেল। পালিয়ে যাবার সময় তাঁর বড়ো ছেলের বৌ বরুণা রহস্যময়ভাবে মিলিটারিদের হাতে পড়ল। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। মেয়েটি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে!

পালবাবু প্ৰায় জলের দরে বিষয়সম্পত্তি বিক্রি করলেন। সবাই বলল, এখন আর ভয় কী? এখন কেন যাবেন? পালবাবু থাকলেন না। দেশ ছাড়ার আগে কবির মাস্টারকে বলে গেলেন, মাস্টার, বসতবাড়ি আর দশ বিঘা ধানী জমি বিক্রি করি নাই, এইগুলি আমি তোমারে দিয়া যাইতাছি।

কবির মাস্টার অবাক হয়ে বললেন, কেন?

আমার বৌমা যদি কোনো দিন আসে এগুলি তুমি তারে দিবা। আমার কেন জানি মনে হয় বৌমা বাঁইচা আছে। সে একদিন-না-একদিন আসব নীলগঞ্জে।

সে বেঁচে আছে, এটা মনে করার কারণ কী?

আমি স্বপ্নে দেখছি মাস্টার।

সে যদি আসে, আমি নিজে পৌঁছে দেব আপনার কাছে।

না মাস্টার, তার দরকার নাই।

কেন? দরকার নেই কেন?

পালবাবু জবাব না দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

বরুণা ফিরে আসে নি। দশ বিঘা জমি এবং বসতবাড়ি আছে আগের মতোই। এক বার ফজল মিয়া দলিল বের করল একটা, বসতবাড়ি এবং জমি তাকে দলিল করে দিয়ে গেছে। পালরা। সেই দলিল আদালতে টিকল না। কিছু দিন হল ফজল আলির ভাগ্নে মিম্বর মিয়া একটি হ্যাণ্ডনেট বের করেছে, যার মর্মার্থ হচ্ছে, উনিশ শ সত্ত্বর সনে পালবাবু তার কাছে এগার হাজার বত্ৰিশ টাকা কার্জ নিয়েছে। সে টাকা শোধ হয় নি। টাকা শোধ কিংবা অনাদায়ে বাড়িঘর নিলামে তোলার জন্যে সে চেষ্টা-তদবির করছে।

কবির মাস্টার মিম্বর মিয়ার সঙ্গে দেখা করে ঠাণ্ডা, গলায় বলে এসেছেন, দেখ মিম্বর, উনিশ শ সত্ত্বর সনে তুমি হাফপ্যান্ট পরতে। দাড়িগোঁফও জ্বালায় নি। তোমার কাছ থেকে এগার হাজার টাকা কার্জ নিল পালরা! জালিয়াতি করতে হলে বুদ্ধি লাগে, তোমার মতো বেকুবের কাজ না।

মিম্বর মিয়া কোনো উত্তর দেয় নি, কিন্তু এমনভাবে তাকিয়েছে-যার মানে সে সহজে ছাড়বে না।

কিছু দিন হল, কবির মাস্টার ভাবছেন, গার্লস স্কুলটা পালদের বসতবাড়িতে শুরু করলে কেমন হয়? নাম দেবেন-বরুণাবালিকাবিদ্যালয়। বরুণা যদি সত্যি সত্যি ফিরে আসে, সে খুশিই হবে। আর, এক বার স্কুল চালু হয়ে গেলে সহজে কেউ হাত ব্লাড়াবে না।

ঝড় ভালোই হয়েছে। গাছপালা পড়ে চারদিক লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। অধিকাংশ কাঁচা বাড়ি ঝড়ে উড়ে গেছে। মানুষজন মারা যায় নি। তবে বদিউজ্জামানের মার পা ভেঙেছে দু জায়গায়। সে চিৎকার করছে গরুর মতো। বদিউজ্জামানের সেদিকে লক্ষ নেই। সে তার ঝড়ে উড়িয়ে নেওয়া ঘরের শোকে কাতর। সে উঠোনে বসে আছে মাথা নিচু করে। মায়ের চি ৎকারে বিরক্ত হয়ে এক বার ধমকে উঠেছে, আরে, খালি চিল্লায়। চুপ করেন।

ডাক্তারের কাছে আমারে লইয়া যা রে বদিউজামান।

সকাল হউক।

সকালতক বাঁচতাম না।

না বাঁচলে নাই।

বদিউজ্জামানের স্ত্রী হাঁস-মুরগির খবর নিতে ছোটাছুটি করছে।

আকাশের অবস্থা ভালো নয়। সাধারণত কালবৈশাখীর পরেপরেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। এবার সে-রকম হচ্ছে না। টিপটপ করে বৃষ্টি পড়ছে। বাড়িঘর-ভাঙা মানুষগুলির জন্যে রাতের একটা আশ্রয় দরকার। এতগুলি

আশ্রয় দেবার মতো ব্যবস্থা হঠাৎ করা মুশকিল।

কবির মাস্টার ছাতা মাথায় দিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ালেন। এত বড়ো একটা ঝড় হয়ে গেল, কিন্তু এক জন মানুষও মারা গেল না-এই ব্যাপারটি তাঁকে অভিভূত করল। ঝড়ের মধ্যে বেঁচে এদের অভ্যাস আছে।

বদিউজ্জামানের মাকে সদরে পাঠানো দরকার। বদিউজ্জামানের সেদিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ঘরের শোকেই সে কাতর।

কবির মাস্টার বিরক্ত হয়ে বললেন, মাথায় হাত দিয়ে বসে আছিস কেন? মাকে হাসপাতালে নিয়ে যা।

সকাল হউক, সকালে নিমু।

সকালে নিবি কিরে ব্যাটা? অবস্থা তো খুবই খারাপ।

এখন রওনা দিলে শেষ রাইতে পৌঁছমুসদরে। কেউ পুছত না আমারে।

রুয়াইল বাজারে নিয়ে যা। ডাক্তার দেখা।

পয়সা নাই মাস্টার সাব। হাঁস মারা গেছে দুইটা। তুফানে ফতুর হইছি।

বদিউজ্জামান থুক করে এক দল থুথু ফেলল। তার মা প্ৰাণপণে চিৎকার শুরু করল। কবির সাহেব বললেন, ডাক্তারের খরচ আমার কাছ থেকে নে!

তিনি তাঁকে পঞ্চাশটা টাকা দিলেন। এদের এত খারাপ অবস্থা! দুঃসময়ের জন্যে কোনো সঞ্চয় নেই। একটা নীলগঞ্জ তহবিল করা দরকার। যেখান থেকে দুঃসময়ে টাকা পয়সা নেওয়া যাবে। তবে যথাসময়ে সে টাকা ফেরত দিতে হবে। তাতে সবার মনে একটা সাহস হবে।

বদিউজ্জামান।

জ্বি।

টাকাটা ফেরত দিবি মনে করে। আমার নিজের টাকা না। সুখী নীলগঞ্জের টাকা।

কবির সাহেব রাতে আর ঘুমুতে গেলেন না। সমস্ত গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। না। তিনি তাঁর চিঠিপত্র নিয়ে বসলেন। চিঠিপত্র আসতে শুরু করেছে। ছাত্রদের কাছ থেকে যে-রকম সাড়া পাওয়া যাবে বলে মনে করা হয়েছিল, সে-রকম সাড়া পাওয়া যায় নি। চিঠির উত্তর সবাই দিচ্ছে, কিন্তু আসল জায়গায় পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। যেসব চিঠি পাচ্ছেন তার একটির নমুনা এরকম

শ্রদ্ধেয় স্যার,

আমার সালাম জানবেন। এই বৃদ্ধ বয়সেও যে আপনি একটা কিছু করতে যাচ্ছেন, তা জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। আশা করি আপনার স্বপ্ন সফল হবে। সুখী নীলগঞ্জ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। আমি কতটুকু সাহায্য করতে পারব তা জানি না। কারণ বৰ্তমানে কিছু আর্থিক সমস্যা যাচ্ছে। সমস্যাটা ঘটলেই আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

ইতি
আপনার স্নেহধন্য
আমীরুল ইসলাম

এই জাতীয় চিঠিগুলির উপর তিনি লাল কালি দিয়ে লেখেন-সাক্ষাৎ যার মানে হচ্ছে, চিঠিতে এর কাছে কোনো কাজ হবে না, দেখা করতে হবে। অবশ্যি মাঝে মাঝে দু-একটা এমন চিঠি পান যে আনন্দে চোখ ভিজে ওঠে। রংপুর থেকে ওহীদুল আলম বলে একটি ছেলে লিখল—স্যার, আমি ভাবতেও পারি নি আমার কথা আপনার মনে আছে। কী যে খুশি হয়েছি চিঠি পড়ে! অতি নিকৃষ্ট ছাত্র হয়েও আপনার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হই নি, এই আনন্দ আমার রাখার জায়গা নেই। স্যার, আমি জীবনে তেমন কোনো সাফল্য লাভ করতে পারি নি। মোটামুটি একটি টানাটানির সংসার বলতে পারেন। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আমি আপনাকে সাহায্য করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব। পাঁচ শ টাকা মনিঅৰ্ডার করে পাঠালাম। আমি আমার বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে আপনাকে পাঠাব। এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমার মহা সৌভাগ্য যে আপনার জন্যে কিছু করতে পারছি। স্কুলে ছাত্র থাকাকালীন সময়ে এক দিন একটা বড়ো অপরাধ করেছিলাম। আপনি আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে এক লাইনের যে উপদেশ দিয়েছিলেন, আমার তা এখনো মনে আছে। যত দিন বেঁচে থাকব। তত দিন তা মনে থাকবে।…

এই জাতীয় চিঠিগুলি তিনি আলাদা করে রাখেন। কোনো কারণে মন খারাপ হলে পড়েন। মুহূর্তের মধ্যেই মন ভালো হয়ে যায়। মনে হয় সুখী নীলগঞ্জ প্রকল্প নিশ্চয়ই এক দিন শুরু হবে।

তিনি ফজরের আজান পড়ার আগ পর্যন্ত চিঠিপত্র নিয়ে ব্যস্ত রইলেন। তারপর রুটিনমতো বেড়াতে বেরুলেন। দক্ষিণপাড়া থেকে কান্নার শব্দ আসছে। ব্যাপার কী? তিনি দ্রুত দক্ষিণ দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

কাঁদছে বদিউজ্জামান এবং তার স্ত্রী। বদিউজ্জামান তার মাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় নি। তার মা কিছুক্ষণ আগেই মারা গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *