আঠারো
সকাল আটটায় বৃদ্ধ ডাক্তারকে এই ঘরে নিয়ে আসা হল। ভদ্রলোককে দেখেই মনে হল তিনি গত রাত্রে এক ফোঁটা ঘুমোতে পারেননি। আকাশলাল বলল, ‘সুপ্রভাত ডাক্তার।’
‘সুপ্রভাত।’ ভদ্রলোক এক দৃষ্টিতে আকাশলালকে দেখছিলেন।
‘আপনি কি সুস্থ নন ডাক্তার?’
‘অসুস্থ? আমি? হা ভগবান। কে কাকে বলছে। আপনি কেমন আছেন?’
‘আজ আমি খুব ভাল আছি। একদম তাজা।’
‘শুয়ে পড়ুন।’
অতএব আকাশলালকে শুতে হল। বৃদ্ধ যখন তাকে পরীক্ষা করছিলেন তখন তার মনে হল মানুষটি কবে যে একটু একটু করে বদলে গেলেন সে নিজেই বুঝতে পারেনি। যখন ওঁকে প্রায় জোর করে নিয়ে আসা হয়েছিল তখন যে চেহারা তার সঙ্গে এখন কোনও মিল নেই। ওঁর মতো এক পণ্ডিত ব্যক্তি এই যে প্রায় বন্দি জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন তা কি কোনও ইতিহাসে লেখা থাকবে? আর এখানে নিয়ে আসা তো চট করে হয়নি। দিনের পর দিন লোক পাঠিয়ে ওঁকে একটা ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে হয়েছিল আকাশলালকে।
‘প্রেসার নর্মাল নেই। থাকার কথাও নয়। বুকের চাপটা কী রকম আছে?’
‘নেই।’
‘মিথ্যে কথা বলবেন না।’
‘জোরে নিঃশ্বাস নিলে সামান্য লাগে।’
বৃদ্ধ ডাক্তার সামান্য সরে একটা চেয়ারে বসে পাকা চুলে আঙুল বোলালেন, ‘যে জন্যে এত সব তা আজকের দিনটার জন্যে, না?’
‘হ্যাঁ, ডাক্তার। আপনি আর্ধেক কাজ করেছেন বাকিটার জন্যে আমি আপনার ওপর নির্ভরশীল। সব কিছু ঠিকঠাক চললেও আপনার হাতেই আমার ফিরে আসা নির্ভর করছে।’ আকাশলাল খুব হালকা গলায় কথাগুলো বলল।
ডাক্তার মাথা নাড়লেন, ‘আমি যা করেছি এবং করব তার ওপর আমার কোনও হাত নেই। আমি আপনাকে অনেকবার বলেছি এটা এমন একটা এক্সপেরিমেন্ট যার মূল্য হল জীবন। আজ থেকে দশ বছর আগে হলেও আমি এই প্রস্তাবে রাজি হতাম না। কিন্তু আমি কি এখনও রাজি? আপনি আমাকে বাধ্য করছেন কাজটা করতে।’
আকাশলাল হাসল, ‘ডাক্তার। আপনি সেইসব ধনীদের গল্প শুনেছেন?’
‘কাদের গল্প?’
‘যাদের প্রচুর টাকা অথচ মৃত্যু নিশ্চিত। যে অসুখে তারা ভুগছে তার কোনও ওষুধ এখনকার বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারেনি। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনে নিজের শরীরকে বাঁচিয়ে রেখেছে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে টাইম ক্যাপসুলে। মৃতপ্রায় শুয়ে আছে মাটির নীচের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে। যদি কখনও বিজ্ঞান সেই রোগের ওষুধ বের করতে পারে তা হলে— ।’
ডাক্তার হাত তুলে আকাশলালকে থামালেন, ‘আপনি গল্প বললেন, এখনও আমি এটাকে গল্প বললে খুশি হতাম। বিজ্ঞান সব করতে পারে। এখন যা পারছে না আগামী কাল পারবে। কিন্তু ধরা যাক, আশি বছর পরে ওই শরীরকে বের করে এনে রিভার্স প্রক্রিয়ায় তার প্রাণস্পন্দন জাগ্রত করে ওই নতুন ওষুধ প্রয়োগ করে যদি রোগমুক্ত করা সম্ভব হয় তা হলে লাভ কী? ওই মানুষটি তখন কার জন্যে কী জন্যে বাঁচবে? আর কতদিন সেই বাঁচা সে উপভোগ করবে। পাগল। তবু আপনার ক্ষেত্রে আমি রাজি হয়ে গেলাম অন্য কারণে।’
‘কী কারণে ডাক্তার?’
‘এতদিন আমি রুগির চিকিৎসা করতাম প্রথাগত উপায়ে। যা শিখেছি, অভিজ্ঞতা আমাকে যা দিয়েছে তাই প্রয়োগ করতাম। মানুষের কষ্ট যাতে দূর হয় তার জন্যে ওষুধ দিতাম অথবা অস্ত্র ধরতাম। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মেডিসিন ইজ দি মাদার অফ দি সায়েন্সেস। কেন জানেন, চিকিৎসকদের ইন্টারেস্ট হল মানুষের শরীরে এবং পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যাবে এই প্রফেসনের লোকগুলো হল সেই সংঘব্দ্ধ মানুষ, যারা ধর্ম এবং রাজনীতি বাদ দিয়ে বিজ্ঞানসম্মত পথে চিকিৎসা করে। আমিও তাদের একজন ছিলাম এই মাত্র। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিস্ময় হল মানুষের শরীর। কী নেই এখানে? আমরা তার কতটা তৈরি করতে সক্ষম? ধরুন রক্ত। এখনও বিজ্ঞান রক্ত তৈরি করতে পারল না। পঁচিশ থেকে তিরিশ হাজার মিলিয়ন রেড সেলস আর পঞ্চাশ হাজার মিলিয়ন হোয়াইট সেলস। আর এই সব সেলগুলো যে তরল পদার্থে থাকে তার নাম প্লাজমা। সব জানা সত্ত্বেও তো তৈরি করা গেল না। এসব নিয়ে মাঝে মধ্যে ভাবতাম। মানুষের শরীরের যেসব ধমনী দিয়ে রক্ত চলাচল হয় তা যোগ করলে পৃথিবীর যে-কোনও রেলপথ অনেক ছোট হয়ে যাবে। আমি যেটা করলাম সেটা সামান্য একটা এক্সপেরিমেন্ট। ফ্যান ঠিক ঠিক চালাতে একটা রেগুলেটার লাগে। সেটাকে এড়িয়েও তো ফ্যান চালানো যায়। কিন্তু একই স্পিড় থাকে আর ঝুঁকিও। আপনার ক্ষেত্রে সেই ঝুঁকিটা নিয়েছি।’ ডাক্তারকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল।
‘অনেক ধন্যবাদ ডাক্তার।’
‘কিন্তু আপনি কেন আমোক এই কাজটা আমাকে দিয়ে করালেন তা এখনও বললেন না। আপনার যদি মরার ইচ্ছে থাকে তা হলে পুলিশের কাছে গেলেই সেটা সহজ হত।’
‘যেহেতু আমি মরতে চাই না তাই আপনার সাহায্য নিয়েছি।’
‘কিন্তু এভাবে কেন?’
‘ঠিক সময়ে আপনাকে আমি বলব ডাক্তার।’ আকাশলাল ঘড়ি দেখল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, ‘আপনি ওষুধটা এনেছেন নিশ্চয়ই?’
‘হ্যাঁ। আমাকে আনতে হয়েছে। কিন্তু আমি আবার আপনাকে সতর্ক করছি।’
‘করুন।’
‘এই ক্যাপসুল খাওয়ার তিন ঘণ্টা পরে আপনার হার্ট বন্ধ হয়ে যাবে।’
‘ঠিক তিন ঘণ্টা বা আগে পরেও হতে পারে।’
‘গুড।’
‘কিন্তু মনে রাখবেন, হার্ট কাজ বন্ধ করা মাত্রই মৃত্যু-দরজায় পৌঁছে যাওয়া।’
‘সাধারণ অবস্থায় সেই দরজাটায় ঢুকে পড়তে কত সময় লাগে?’
‘সেটা শরীরের ওপর নির্ভর করে। হার্ট বন্ধ হবার পর মস্তিষ্ককোষ তিন ঘণ্টার বেশি সাধারণত সক্রিয় থাকতে পারে না।’
‘আমার ক্ষেত্রে সেটা চব্বিশ ঘণ্টা থাকবে!’
‘আমি তাই আশা করছি।’
‘ডাক্তার, আমি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই আপনার কাছে উপস্থিত হব।’
‘আপনি যা করছেন ভেবে চিন্তে করছেন?’
‘হ্যাঁ। এ ছাড়া কোনও উপায় নেই।’
‘তা হলে একটা অনুরোধ করব। আপনার যদি ফিরে আসা সম্ভব না হয় তা হলে এদের বলে যান আমাকে মুক্তি দিতে। আমি সমস্ত পৃথিবীর লোককে জানাব যে আমিই আপনার হাতে আত্মহত্যার অস্ত্র তুলে দিয়েছি।’
আকাশলাল এগিয়ে গিয়ে ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরল। দুজনে আলিঙ্গনাবদ্ধ থাকল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর আকাশলাল ফিসফিস করে বলল, ‘ডাক্তার, আমার বাবাকে আমি শেষ বার যখন আলিঙ্গন করেছিলাম কুড়ি বছর আগে, তখন জানতাম না সেই একই অনুভূতি কখনও আমার হবে। আজ হল।’
হায়দাররা চুপচাপ বসেছিল। আকাশলাল সরে এলে ত্রিভুবন জিজ্ঞাসা করল, ‘এই ক্যাপসুলটা আপনি কীভাবে নিয়ে যাবেন?’
ক্যাপসুলটাকে দেখল আকাশলাল। ছোট্ট নিরীহ দেখতে। রক্তে মিশে যাওয়ামাত্র মৃত্যুবাণ ছুঁড়তে শুরু করবে যা তিন ঘণ্টায় কার্যকর হবে। সে ডাক্তারকে বলল, ‘আমি এটা মুখে রাখতে চাই।’
‘স্বচ্ছন্দে। মুখের ভেতরের তাপ অথবা লালায় এটি গলবে না। আপনাকে দাঁত দিয়ে বেশ জোরে চাপতে হবে ভাঙার জন্যে। আপনার ডান দিকের কষের দাঁতের একটা নেই। ওটা ওখানে রেখে দেবার চেষ্টা করুন।’ ডাক্তার বললেন।
ক্যাপসুলটাকে দুই ঠোঁটে নিল আকাশলাল। তার সঙ্গীরা অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশলালের মনে হল যদি এই মুহূর্তে ডাক্তারের কথা মিথ্যে হয়ে যায় তাহলে ভার্গিসের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না সে সকাল ন’টায়। ধীরে ধীরে সে মুখের ভেতরে নিয়ে গেল ক্যাপসুলটাকে। না, গলছে না একটুও। অন্তত জিভে অন্য কোনও স্বাদ আসছে না। সে কষ দাঁতের পাশে জিভ দিয়ে ক্যাপসুলটাকে ঢোকাতে সেটা চমৎকার আটকে গেল। তবে ইচ্ছে করলেই সেটাকে বের করে নিয়ে আসা যায় দুই দাঁতের দেওয়াল থেকে। আকাশলাল বলল, ‘ধন্যবাদ ডাক্তার।’
দরজায় শব্দ হতেই ত্রিভুবন বেরিয়ে গেল। হায়দার বলল, ‘ডাক্তার, আপনি কি এখন বিশ্রাম করতে যাবেন?’
‘অসম্ভব। এই অবস্থায় কেউ বিশ্রাম করতে যেতে পারে না। তবে, আমি এই ঘরে থাকলে যদি আপনাদের কথা বলতে অসুবিধে হয়— ।’
আকাশলাল মাথা নাড়ল, ‘নাঃ। আপনি থাকতে পারেন।’
ত্রিভুবন ফিরে এল, ‘একটু আগে ভার্গিসকে হেডকোয়ার্টার্সে ফিরে আসতে দেখা গিয়েছে। সে আর তার ড্রাইভার ছিল জিপে।’
‘কোথায় গিয়েছিল? কার সঙ্গে দেখা করেছিল?’ আকাশলাল জিজ্ঞাসা করল।
‘এখনও জানা যায়নি।’
‘সেই সার্জেন্টটার খবর পেলে?’
‘না।’
‘উহুঁ। আমার মনে হচ্ছে ওই সার্জেন্টটার সঙ্গে ভার্গিসের কিছু একটা হয়েছে। হয়তো লোকটাকে সে মেরেই ফেলেছে। ত্রিভুবন, তুমি নিজে দ্যাখো কোন চেকপোস্টে ওদের দেখা গেছে।’
ত্রিভুবন মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল।
আকাশলাল ঘড়ি দেখল। ন’টা বাজতে আর পনের মিনিট বাকি। সে বলল, ‘ক্যাসেটটা নাও।’
হায়দার ক্যাসেট নিল। মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মিনিট পাঁচেক পরে আধ-কিলোমিটার দূরে একটা পাবলিক টেলিফোন বুথের সামনে হায়দার বাইক থেকে নামল। বুথের সামনে তাদের লোক পাহারায় ছিল। মাথা নেড়ে বুথের ভেতর ঢুকে টেপরেকর্ডার বের করল হায়দার। ইতিমধ্যেই ওর মধ্যে ক্যাসেট ঢোকানো হয়ে গেছে। সে ঠিক ন’টায় ভার্গিসের নম্বরগুলো ঘোরাতে লাগল।
কয়েক মুহূর্ত। রিং হতেই ভার্গিসের হুঙ্কার শোনা গেল, ‘হ্যালো।’
রেকর্ডারের বোতাম টিপল হায়দার। সঙ্গে সঙ্গে আকাশলালের গলা শোনা গেল, ‘ভার্গিস। আমি তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। আজ ঠিক বারোটার সময় মেলার মাঠের মাঝখানে আমার জন্যে তুমি অপেক্ষা করবে। আমি অস্ত্রহীন হয়ে যাব। তোমার লোক যদি আলোচনার আগে আমাকে গুলি করে তাহলে আমার লোকও তোমাকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলবে। আমি আত্মসমর্পণ করছি এবং সেটা বন্ধুভাবেই হোক। আকাশলাল।’