১৮
বীণাপাণির বিপদের কথা কেউ জানে না। কেউ না। কত বড় বিপদ নিয়ে যে সে বাস করছে আজকাল। সবসময়ে বুক এত ঢিবঢিব করে যে, বুকের ব্যামো না দাঁড়িয়ে যায়। সে ভাল করে ঘুমোতে পারে না, খেতে পারে না। মনটায় সবসময় অশান্তি। আজকাল রিহার্সালে তার পার্টও ভুল হয়।
সেদিন এক চুলের জন্য বেঁচে গেছে বীণাপাণি। শেষ রাত্তিরে যখন কাকা তার স্মাগলার কয়েকজন সাকরেদ নিয়ে এসে হাজির হল সেদিনই হয়ে গিয়েছিল বীণার। ভয়ে সে দরজা খুলবে কি, নিমাইয়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে ফেলেছিল, আমার বড্ড ভয় করছে!
নিমাই অবাক হয়ে বলল, ভয়ের কী? ও তো কাকার গলা।
তবু করছে। তুমি দরজা খুলো না।
নিমাই ডবল অবাক হয়ে বলে, খুলবো না! বলো কী? কাকা আমাদের অন্নদাতা, কোন বিপদে পড়ে এসেছে, দরজা না খুললে কি হয়? বলে নিমাই সাড়া দিয়ে বলল, কাকা নাকি? এই খুলছি।
দরজার শব্দ বন্ধ হল।
নিমাই যখন মশারি তুলে বেরোচ্ছে, তখন বীণাও চৌকির অন্য পাশ দিয়ে নামল। তারপর নিচু হয়ে চৌকির তলা থেকে কাপড়ে বাঁধা একটা পুঁটলি টেনে নিয়ে পট করে পিছনের জানালা গলিয়ে কচুবনে ফেলে দিল।
কাজটা ভেবেচিন্তে করেনি বীণা। তবে খুব বিবেচনার কাজই হয়েছিল।
নিমাই দরজা খুলতেই কাকা বলল, কিছু মনে কোরো না ভাই, আমরা বড় জরুরি কাজে এসেছি। বীণাকে ডাকো। বীণার বুকের ঢিবঢিবি সেই থেকে শুরু। সে ঘুমকাতুরে মুখ নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল, কী কাকা? এত সকালে কী ব্যাপার গো? কোনও বিপদ নাকি?
কাকা গম্ভীর মুখে বলল, কিছু লুকিও না। পগা কি তোমার কাছে মাঝে মাঝে বিদেশী টাকা রেখে যেত?
বীণা একটু হাঁ করে চেয়ে বলল, বিদেশী টাকা? তা কি করে বলব? মাঝে মাঝে একটা প্যাকেটমতো কি যেন রাখতে দিত। খুলে তো দেখিনি। হেরোইন-টেরোইন ভেবে ভয়ে আধখানা হয়ে থেকেছি।
পগা যে রাতে মারা যায় সে রাতের কথা মনে করে দেখ তো!
মনে করার কি আছে?
সেই রাতে কিছু রেখে গিয়েছিল তোমার কাছে?
না তো! তার এক মাস আগে থেকেই তার সঙ্গে দেখা নেই।
ভাল করে ভেবে দেখ। ব্যাপারটা কিন্তু খুব সিরিয়াস।
বীণা মাথা নেড়ে বলে, ভাববার কিছু নেই। আমার স্মরণশক্তি খুব ভাল। তবে সে কিন্তু আরও দু-একজনের কাছেও প্যাকেট রাখত।
সব জানি। লক্ষ্মী আর সনাতন। তাদের কাছেও খোঁজ নিতে হবে। একটা কথা বলি, রাগ করতে পারবে না।
আবার কি কথা?
তোমার কথা আমি বিশ্বাস করছি। তবু তোমার ঘরখানা আমরা সার্চ করব। আমরা সিওর হতে চাই।
বীণার ঘর ছোটো, আসবাবপত্রও নেই। সার্চ করতে দশ মিনিটও লাগল না। কচুবন বা বাড়ির আঁদাড়-পাঁদাড় খোঁজার মতো ধৈর্য এদের নেই।
কিছু না পেয়ে কাকা যেন খুশিই হল। বীণাকে বলল, বাঁচালে! তোমার ঘরে চোরাই ডলার পাওয়া গেলে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যেত।
বীণা খুব অবাক হওয়ার ভান করে বলে, ওম্মা গো! পাওয়া গেলেই বা মাথা কেন কাটা যেত তোমার? আমি কি ছাই জানতুম যে, কী আছে ওই প্যাকেটে?
তা ঠিক। আমার বড় বিপদ যাচ্ছে বীণা, মাথাটা ঠিক নেই। নন্দী আর রহমান পালিয়ে গেছে। তাদেরও ধরতে পারছি না। খুনের দায়ে ওদের নামে বোধহয় হুলিয়া বেরোবে। আচ্ছা, ঘুমোও। যাই।
নিমাই ব্যাপারটা জানতে ওদের সঙ্গে একটু এগোলো। বীণা সেই ফাঁকে পুঁটুলিটা কুড়িয়ে এনে বাক্সবন্দী করল। সুযোগমত ঘটিতে পুরে সরা চাপা দিয়ে মাটির মধ্যে পুঁতে রাখতে হবে। থাক কিছুদিন। লোকে যখন সব ভুলে যাবে তখন বের করে অল্পে অল্পে বেচে দিলেই হবে।
কিন্তু ভয়ও একটা ছিল। বাজারে লটারির টিকিট বিক্রির স্টল আছে পল্টু নামে একটা ছেলের। বিশ্ববিজয় অপেরার লাইটমিস্ত্রির ভাই। তার কাছে দু’দফায় মোট পঞ্চাশ ডলার ভাঙিয়ে বেশ কিছু টাকা পেয়েছিল বীণা। সুতরাং তার কাছে যে ডলার আছে তা পল্টু জানে। বীণা অবশ্য বুদ্ধি করে বলেছিল তার বড়দা কৃষ্ণজীবন বছরে দু-তিনবার বিদেশে যায়, মস্ত মানুষ, সেই দাদাই তাকে ডলার দিয়েছে। কথাটা অবিশ্বাসের নয় হয়তো, কিন্তু তবু মানুষকে বিশ্বাস কি? পল্টু যদি বলে দেয় তা হলে কী হবে তা ভাবতেই পারে না বীণাপাণি। কাকা এমনিতে ভাল কিন্তু বেইমানি দেখলে কি করে কে জানে। পল্টুকে বলতে বারণ করতে গেলেও বিপদ আছে, তাতে সন্দেহ বাড়বে।
বীণাপাণি ভয় পেয়ে গেল। খুব ভয়।
কাকাকে এগিয়ে দিয়ে এসে নিমাই গম্ভীর মুখে বলল, হল তো! ওইসব আজেবাজে লোককে প্রশ্রয় দিয়ে কিরকম ঝঞ্ঝাট হচ্ছে!
বীণাপাণি তার পুরুষটার দিকে চেয়ে রইল। কপাল এমনি যে, জুটল এক ল্যাংটো সাধু। চালচুলো নেই, কিন্তু পাপ-তাপের নামে একেবারে মূর্ছা যায়। এ যদি ডলারের খবর জানতে পারে তা হলে এখনই পাপের ভয়ে বীণাকে ছেড়ে লম্বা দেবে। এর কাছে বুদ্ধি, পরামর্শ চেয়ে লাভ নেই। বরং নিজের পাপ নিজেই বইবে বীণা। সেই ভাল।
বীণা মৃদুস্বরে বলে, কিসের ঝঞ্ঝাট? আমরা তো কিছু করিনি।
করিনি, কিন্তু সকালের বাসটা তো ফেল হয়ে গেল। বিষ্টুপুরের বাস ফের সেই দুপুরে।
থাকগে, আর গিয়ে কাজ নেই। তুমি বরং বাজার-টাজার করে আনো, আমি ঘরের কাজ সারি।
যাবে না!
আজ নয়। একটা বাধা যখন পড়েইছে তখন দু’দিন পরেই যাবোখন।
নিমাই একটু ভেবে বলল, সেটা ভাল হবে। হঠাৎ করে চলে গেলে সন্দেহ বাড়ত হয়তো।
বীণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিমাইকে বাজারে রওনা করে দিয়ে সে চারদিকটা ভাল করে দেখে নিল। তার বাড়ির আশেপাশে বসতি নেই বললেই হয়। জংলা জায়গা, উঠোন ঘেঁষে চাষের জমি, ঝোপজঙ্গল। বীণা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। ঘরের ভিটের এক জায়গায় একটা ইঁদুরের গর্ত আছে। সেটাই খুঁড়ে ফেলল। একটা মা-ইঁদুর কিচমিচ করতে করতে পালাল। কয়েকটা বাচ্চা লালচে রঙের কুষি ইঁদুর জড়ামড়ি করে পড়েছিল। বীণা মায়া করল না। তুলে বাইরে ফেলে দিল। কাক নিয়ে যাবে।
পাপ হল? তা হোক। ওই ইঁদুরগুলো বড় হয়ে কি মানুষের কম সর্বনাশ করত? পাপের বিচার করে বীণার কাজ নেই। এ সংসারে দুটো মানুষের মধ্যে একটা পাপী, আর একটা সাধু। কিন্তু পাপীটাই সংসার চালায়, আর সাধুটার এক পয়সারও মুরোদ নেই।
গর্তটা বুজিয়ে দিয়ে ওপরটা দুরস্ত করে পুরো ঘরটাই গোবরমাটি দিয়ে লেপে ফেলল বীণাপাণি। গর্তের গহীনে রইল মাটির ঘটের ভিতরে ডলার আর পাউন্ডের প্যাকেট। ওপরে কাঠের তক্তা বসিয়ে তার ওপর চাল রাখার মাটির জালাটা বসিয়ে দিল সে। যতদূর সম্ভব নিখুঁত হল বটে কাজটা, কিন্তু ভয়টা রয়েই গেল।
সেই থেকে বীণাপাণির মনে শান্তি নেই। সবচেয়ে বড় অশান্তির কারণ হয়ে রইল পল্টু। যদি বলে দেয়? কিংবা যদি ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করে?
কয়েকদিন অপেক্ষা করল বীণাপাণি। তারপর একদিন নিজেই সন্ধের রিহার্সালের পর বাজারের দিকে গেল। দু-চারটে জিনিস কিনল। তারপর যেন এমনিতেই এসে পড়েছে এমন ভাব দেখিয়ে পল্টুর স্টলটার সামনে দাঁড়াল।
এই পল্টু, ভুটান লটারিতে নাকি অনেক প্রাইজ দিচ্ছে?
হ্যাজাকের আলোয় পল্টু বসে একটা বইগোছের কিছু পড়ছিল। লোকজন নেই। মুখ তুলে হাসল, হ্যাঁ। এবার ফার্স্ট প্রাইজ এক কোটি। নেবে নাকি টিকিট?
দূর! আমার লটারির কপাল নেই। শুধু পয়সা নষ্ট।
বহু লোকের পয়সা দিয়েই তো দু-চারজন লাখোপতি কোটিপতি হয়।
পল্টু বেশ ছেলে। বাইশ-তেইশ বছর বয়স, পাতলা ছিপছিপে চেহারা, রংটা ফর্সা, ওর মিস্ত্রী দাদার মতো নয়। চোখে-মুখে লেখাপড়ার ছাপ আছে।
বীণার বুক দুরদুর করছে তবু। কথা খুঁজে পাচ্ছে না। পল্টু কিন্তু সন্দেহ করছে কি না তাও বুঝতে পারছে না। বুকের এই ঢিবঢিবিনি নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়?
বীণা একটু উদাস গলায় বলে, কোটি টাকা প্রাইজ হলে টিকিটেরও তো দাম অনেক।
হ্যাঁ। একশো টাকা করে।
না ভাই, আমাকে বরং একটা লাখ টাকার প্রাইজের টিকিট দে। কেটে দেখি।
আগে তো খুব লটারির টিকিট কিনতে, আজকাল কেনো না তো!
কেটে কেটে হদ্দ হয়ে ছেড়েছি।
পল্টু তার পেতে রাখা টিকিটের সারি থেকে বেছে একখানা দিয়ে বলল, এটা পাঁচ টাকার টিকিট। কাল খেলা। ফার্স্ট প্রাইজ পাঁচ লাখ টাকা।
পাঁচটা টাকা জলে গেল। তবু নিল বীণা। পল্টু বোধহয় ডলারের কথা ভুলে গেছে। জয় মা কালী! ওর যেন ব্যাপারটা একদম মুছে যায় মাথা থেকে। কী বোকামির কাজই যে হয়েছিল বনগাঁয়ে ডলার ভাঙানো।
পল্টু বীণার পাঁচটা টাকা নিয়ে আবার বইটা খুলতে যাচ্ছে, বীণাও চলে আসার জন্য পা বাড়িয়েছে, হঠাৎ পল্টু একটু চাপা গলায় বলল, ডলার আর কত আছে?
বীণা এমন চমকে উঠল যে হৃৎপিণ্ড আর একটু হলেই থেমে যেত। সে ফ্যাকাসে মুখে বলল, কিসের ডলার?
পল্টু তেমনি চাপা গলায় বলে, থাকলে দিও। ন্যায্য দাম পাবে। কেউ জানতে পারবে না।
অভিনয় ছাড়া বীণা আর কি পারে? কিন্তু মাঝে মাঝে অভিনয় করার কথা ভুল হয়ে যায়। বিশেষ করে বিপদে পড়লে। কয়েক লহমার ভুল শুধরে নিল বীণা। একটু মিষ্টি করে হেসে বলল, দুর পাগলা! ডলার কোথায় পাবো? বড়দার সঙ্গে কি আর দেখা হয় নাকি আমার? সেই একবার দেখা, বিয়ে বাবদ আশীর্বাদ দেওয়া হয়নি, পঞ্চাশ ডলার দিয়ে বলেছিল, ভাঙিয়ে কিনে নিস কিছু। মানিব্যাগে টাকা তখন ছিল না, ডলার ছিল। সদ্য বিলেত থেকে ফিরেছে তখন।
ডায়ালগ যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল বীণা।
পল্টু বিশ্বাস করল কি না মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। বলল, তোমার বড়দার কথা খুব শুনি। খুব নামকরা লোক নাকি?
কার কাছে শুনিস? বড়দা তো আর নেতা নয়।
শুনি নিমাইদার কাছে। মাঝে মাঝে নিমাইদা এসে আড্ডা দিয়ে যায়। তার মুখেই শুনেছি, তোমার বড়দা সাংঘাতিক লোক।
বীণা মলিন মুখে বলে, হ্যাঁ।
তা হলে তোমার এইখানে পচে মরার দরকার কি? বড়দাকে বললে নিমাইদার একটা কাজও তো হয়ে যায় বোধহয়।
কে বলবে বাবা! আর তোর নিমাইদারই বা কোন বিদ্যে আছে?
আর কিছু না হোক, নিমাইদা তো বিশ্বাসী লোক।
ওইটুকুই।
ওটা কি কিছু কম হল? আজকাল বিশ্বাসী মানুষ কোথায় পাবে?
এটা যে কলিকাল তা জানিস? এখন যত পাজি লোক তত তার কদর।
পল্টু একটু হাসল। তারপর বলল, ঠিক আছে, বড়দার কাছ থেকে ফের যদি ডলার পাও তো দিও।
তুই ডলার নিয়ে কী করিস?
পল্টু মৃদু মৃদু হাসছিল। বলল, যা সবাই করে। খদ্দের আছে গো। ডলার এখন দুনিয়াটাকে চালাচ্ছে।
বীণা এবার হঠাৎ খুব দুঃসাহসী একটা কাজ করে বসল। ভাবল, সন্দেহভঞ্জন করার এর চেয়ে বড় সুযোগ আর আসবে না। যা হওয়ার হবে। সে বুক ঠুকে বলল, ডলার নিয়ে যা কাণ্ড হয়ে গেল! ও বাবা, ওই নাম শুনলেই ভয় করে।
কী কাণ্ড?
কেন, পগা খুন হল না?
পল্টু মাথা নেড়ে বলে, সেটা মোটেই ডলারের জন্য নয়। ওদের জুয়ার আড্ডার পুরনো কাজিয়া। খুনটা আমার সামনেই হয়, ওই বটতলায়। দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার আগে আমরা তিন বন্ধু বনমালীর দোকানে চা খাচ্ছিলাম।
দেখেছিস?
স্পষ্ট। তবে খুনিয়াদের নাম-টাম জানতে চেও না। ওসব বলতে পারব না।
না বাবা, জানতে চাইও না। তবে মাঝে মাঝে পগা আমার কাছে একটা প্যাকেট রেখে আসত তাতে কী থাকত কে জানে বাবা! ভয়ে তো কখনও খুলে দেখিনি। এখন শুনছি তাতে নাকি ডলার থাকত। তাই নিয়ে কত হাঙ্গামা, ঘর সার্চ হয়ে গেল।
তাই নাকি?
যা ভয় পেয়েছিলাম!
পল্টু হঠাৎ কেমন একটা গলায় বলল, তোমার কাছে ছিল না বুঝি?
আবার চমৎকার ভালমানুষের পার্ট করে গেল বীণা, কোথা থেকে থাকবে? তার এক মাস আগে থেকেই যে পগার সঙ্গে দেখা নেই।
পগা আমার খুব দোস্ত ছিল, জানো বীণাদি! যেদিন খুন হল সেদিনও সন্ধের পর কিছুক্ষণ আড্ডা মেরেছিল আমার দোকানে এসে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল বলে বেশিক্ষণ কথা হয়নি। তারপর খুব ঝমঝম করে নামল। আমি দোকান গুটিয়ে ফেলেছিলাম। চায়ের দোকানে গিয়ে আড্ডা দিতে লাগলাম, আর পগা গেল জুয়ার আড্ডায়।
বীণার বুকে তোলপাড় হচ্ছে। পগা কি ওকে কিছু বলেছিল? বলেছিল কি যে, বীণার বাড়ি গিয়েছিল? বীণার গলা যেন আটকে আসতে চাইছে। তবু অভিনয়ের জোরে পেরিয়ে যেতে চাইল বিপদটা, ইস্! যদি তোর সঙ্গে থাকত তা হলে হয়তো বেঁচে যেত!
পল্টু মাথা নেড়ে বলে, বাঁচত না। হয়তো সেদিন বেঁচে যেত, পরদিন মরত। ওকে দেগে রেখেছিল যে। তোমার সঙ্গে ওর কেমন ভাব ছিল?
ভাব! ভাব আবার কি? কী যে বলিস! মাঝে মাঝে যেত, চেনাজানা ছিল। সে তো কত লোকের সঙ্গে আছে।
পল্টু একটু বিরস মুখে বলল, সে দিন অনেক ডলার ছিল ওর কাছে।
কাঁপা বুকে বীণা বলে, কি করে জানলি?
কি করে আবার! ওই বলছিল।
বীণার চোখের সামনে একটা পর্দা নেমে এল যেন। আর অভিনয় করে কী হবে? পল্টু বোধহয় সব জানে।
কিন্তু সম্পূর্ণ বেহাল মাথা নিয়েও বীণা অভিনয় করে যেতে ছাড়ল না, আর বলিস না। এখন ডলার শুনলেই আমার ভয় করে।
পল্টু হাসল। কেমন যেন হাসিটা।
বীণার বুকের কাঁপন রয়ে গেল। ঘুম হতে চায় না। খেতে বসলে ভিতরটা কেমন যেন ঘুলিয়ে ওঠে। অম্বলের অসুখ তো ছিলই। সেটা যেন বাড়ল।
পরদিন রাতে পাশাপাশি শুয়ে একটু সোহাগের ভাব করল নিমাইয়ের সঙ্গে। তারপর বলল, জানো, আমি একটা লটারির টিকিট কিনেছি!
তাই নাকি? ও কিনে কী হয়?
যদি ফার্স্ট প্রাইজটা পেয়ে যাই তা হলে?
নিমাই বলে, ওই লোভানিই তো মানুষকে দিয়ে কত অকাজ করিয়ে নিচ্ছে।
আহা, আমি বুঝি লোভী?
আমরা সবাই কম-বেশি লোভী। সে কথা বলছি না। কেটেছো বেশ করেছো। তবে প্রাইজের আশায় বসে থেকো না।
পল্টু বলল তাই কিনলাম। আচ্ছা, পল্টু ছেলেটা কেমন বলো তো!
কেন, ভালই।
কতটা ভাল?
নিমাই হাই তুলে বলে, ওই যেরকম হয় আর কি! ভাল থাকতে চায়, পারে না। চারদিকে নানা লোভানি তো।
তোমার সঙ্গে খুব ভাব বুঝি?
আছে একটু।
কিছু বলে-টলে তোমাকে?
অবাক হয়ে নিমাই বলে, কী বলবে? কিসের কথা বলছো?
এই আমাদের কথা-টথা!
তা কত কথা হয়। সব আগড়ম-বাগড়ম কথা। এক-এক দিন এক-একটা বিষয় উঠে পড়ে। তাই নিয়ে খানিক কথা হয়।
লটারির টিকিট ছাড়া ওর আর কিসের ব্যবসা?
নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, চোরাই কারবার আছে। যখন যেটা পারে করে। লটারির টিকিটে আর ক’পয়সা হয়?
হয় না?
হয়ও। মাঝে মাঝে এক-আধটা প্রাইজও লেগে যায়। সে কদাচিৎ। আজকাল লটারিওয়ালাও তো বড় কম নেই।
আচ্ছা আমরা যদি একটা কাজ করি তা হলে কেমন হয়?
কি কাজ?
ধরো যদি বনগাঁ ছেড়ে চলে যাই অন্য কোথাও?
কোথায় যাবে? পালপাড়া নাকি? না বিষ্টুপুর?
যদি ধরো তাই যাই? একেবারে?
সে কী! এখানকার বাস তুলে দিতে চাও?
কেন, এখানে আমাদের কে আছে?
তোমার যাত্রার দল, তোমার নিজের বাড়ি, এসব কষ্ট করে করলে সে কি ছেড়ে যাওয়ার জন্য?
আমার যে ভাল লাগছে না।
দূর পাগল! বলে নিমাই হাসে, আমাদের কি এত খামখেয়ালি করলে চলে?
বীণা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, তা হলে চলো, কোথা থেকে ঘুরে আসি।
কোথায় যাবে?
কাশী বৃন্দাবন নয় গো, কলকাতা যাবো।
কলকাতা! তা যেতে পারো। উঠবে কোথায়?
উঠব না। সকালে যাবো, বিকেলে চলে আসবো।
তা যেতে পারা যায়।
একটু বড়দার সঙ্গে দেখা করে আসব।
নিমাই একটু চুপ করে থেকে বলে, সে তো মস্ত কথা। শুনেছি কৃষ্ণজীবনবাবু এখন মস্ত লোক, সাততলায় ফ্ল্যাট।
ঠিকানা আছে।
সে তো আছে। চিনতে চাইবে কি?
মায়ের পেটের বোনকে চিনবে না?
হয়তো চিনবে। সে চেনার কথা বলছি না। বলছি পাত্তা দেবে কি না। একে তো অবস্থার তফাত, তার ওপর তোমরা সব ঝগড়া করে তাড়িয়েছিলে লোকটাকে।
সংসারে ওরকম কত হয়। আবার জোড়াও লাগে সম্পর্ক।
এটা লাগবে কি না কে জানে!
আমার দাদা কিন্তু মানুষটা বড় ভাল। অপমান আমিও করেছি বটে, সে বউদির জন্য। বউদি আমাদের এমন ছোটো নজরে দেখত।
এখনও কি তাই দেখবে না?
দাদা দেখবে না। দাদাকে আমি চিনি।
তা হলে যাই চলো একদিন, মানুষটাকে একবার দেখেছিলাম অনেক আগে। কাছ থেকে দেখে একটু পেন্নাম করে আসব। তুমি যে অত বড় একটা মানুষের বোন তা ভাবলে আমার গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যায়।
বীণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, অত বড় মানুষ, তায় আপনজন, তবু আমাদের কপালে তাকে আর রাখতে পারলুম কই নিজের জন হিসেবে! ওই রাক্ষুসীই তো গাপ করে নিল!
আহা ওরকম বলতে নেই। সব দিক বিবেচনা করতে হয়। তোমার বউদিও তো আবার লেখাপড়া জানা মেয়ে।
ছাই!
দিন চারেক বাদে তারা সত্যিই গিয়েছিল কলকাতায়। মাটি খুঁড়ে ডলারের বান্ডিল বের করে হাতব্যাগে লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বীণাপাণি। তার ইচ্ছে ছিল, বড়দাকে ডলারগুলো দেবে। বলবে, তুই বিদেশে যাস, তোর কাজে লাগবে। এর বদলে আমাকে টাকা দে।
দাদা নিরাপদ মানুষ।
ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে তারা যখন পৌঁছলো তখন বিকেল। লিফটে উঠতে ভরসাই হল না তাদের। এ যন্ত্র তারা চালাতে জানে না। দু’জনে সাততলায় উঠল হেঁটে, ঘেমে, হাপসে। ডোরবেলটা অবশ্য বাজাল, তবে ভয়ে ভয়ে।
বীণা যথাসাধ্য সেজে এসেছে, যথেষ্ট ফিটফাট করে এনেছে নিমাইকেও। তবু দরজা খুলে যে সুন্দরপানা মেয়েটা উঁকি দিলে সে যেন খুব অবাক হয়ে দেখল তাদের।
কাকে চাই?
কৃষ্ণজীবনবাবু কি আছেন? বীণা বলল। এই কি তার সেই ভাইঝি? চেনেও না তো বীণা।
বাবা! বাবা তো ইংল্যান্ডে।
বীণার প্রায় বসে পড়ার মতো অবস্থা। দাদা না থাকলে তো এ বাড়িতে তার কোনও অভ্যর্থনাই নেই।
বীণা মলিন হেসে বলল, তুমি বুঝি মোহিনী?
হ্যাঁ। আপনারা কোথা থেকে আসছেন?
বনগাঁ। আমি তোমার পিসি হই। ছোটো পিসি।
পিসি? মাই গড! তা হলে আসুন ভিতরে, মাকে ডাকছি।
ব্যস্ত হয়ো না। আমরা বেশিক্ষণ থাকব না। বিকেলের গাড়ি ধরে ফিরে যাবো।
আসুন তো ভিতরে। মা আছে।
রিয়া ছিল। ওদের সাজানো গোছানো মস্ত লিভিং কাম ড্রয়িং রুমে উজবুকের মতো কিছুক্ষণ বসে থাকার পর রিয়া এল।
কে, তুমি বীণাপাণি না?
হ্যাঁ বউদি। বলে দু’জনে উঠে প্রণাম করল।
রিয়া যে খুব অপ্রসন্ন হল তা নয়। তবে একটু আলগোছ ভাব। বলল, ও তো নেই।
শুনলাম। আমরা এমনি দেখা করতে এসেছিলাম। তোমরা ভাল তো!
ভালই।
দু-চারটে কথাবার্তা, চা আর সন্দেশ খাওয়ার পর বাইরের লোকের মতোই চলে এল তারা। আর ফেরত এল সব দুশ্চিন্তার আকর সেই ডলারের বাণ্ডিলও।
বীণাপানির বিপদের কথা পড়লাম । মন ভরে গেল ।