১৮. বান্ধবপুর বাজার

বান্ধবপুর বাজারে এককড়ি সাহার চালের আড়ত। তিনি সামান্য পুঁজি দিয়ে শুরু করেছিলেন। যুদ্ধের কারণে এখন রমরমা অবস্থা। ধান-চালের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। আরো বাড়বে— এরকম গুজব বাতাসে ভাসছে। সব চাল না-কি মিলিটারিরা কিনে নিবে। পাউরুটি খেয়ে যুদ্ধ করা যায় না। ভাত খেয়েও যুদ্ধ হয় না। ভাতে ঘুম পায়। তারপরেও মিলিটারিদের জন্যে রাতে ভাতের ব্যবস্থা। রাতে ভাত খেয়ে তারা আরামে ঘুমায়। দিনে যুদ্ধ শুরু হয়। দেশের চাল সব সরকার কিনছে। এদিকে আবার বাৰ্মা মুলুক থেকে চাল আসা বন্ধ। জাপানিরা বাৰ্মা দিয়ে ভারতবর্ষে ঢুকবে। নাক-চ্যাপটা মগগুলিকে শায়েস্তা করবে। এটা একটা আশার কথা।

এককড়ি সারাদিন ক্যাশবাক্স নিয়ে আড়তে বসে থাকেন। তাঁর মন প্ৰফুল্ল থাকলেও চোখেমুখে গভীর বিষণ্ণতা ফুটিয়ে রাখেন। ব্যবসা ভয়ঙ্কর খারাপ যাচ্ছে। যুদ্ধের কারণে তিনি ধনে-প্ৰাণে মারা পড়বেন— এই ধরনের কথা বলতে পছন্দ করেন। কথা বলার জন্যে সবসময় লোক পাওয়া যায় না। সন্ধ্যার দিকে অনেকেই আসে। যুদ্ধের খবর শুনতে আসে। এককড়ির নামে প্রতিদিন কলিকাতা সমাচার পত্রিকা আসে। দিনেরটা দিনে আসে না, দু’দিন পরে আসে। তাতে সমস্যা কী? খাবার দুদিনে বাসি হয়, খবর কখনো বাসি হয় না। সবাইকে সেই পত্রিকা পড়ে শোনানো হয়। পড়ানোর দায়িত্ব পালন করেন। গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী। তাঁর গলা উঁচু এবং সুরেলা। বিভিন্ন পূজা পার্বণে তিনি সুরেলা গলায় মাথা দুলিয়ে যখন ব্ৰতকথা পাঠ করেন, তখন ভক্তিমতি হিন্দু নারীদের চোখে আবেগে পানি আসে।

‘বিদেশে গেল পতি,
সে হতে সাবিত্রী সতী
দিবা রাতি করিছে রোদন
পতির বিরহে তার
দেহ হলো চৰ্ম্মসার,
ছয় জায়ে করিছে গঞ্জন।’

কলিকাতা সমাচার এককড়ি প্রথম পড়েন। যে কাগজটা খরচপাতি করে আনায় সে-ই প্ৰথম পড়বে এটাই নিয়ম। এককড়ি সময় নিয়ে পড়েন। খবরের কাগজ পাঠ যারা শুনতে এসেছে তাদের আগ্রহ এবং কৌতূহল বাড়ানোর জন্যে দু’একটা মন্তব্য করেন। দু’একটা শিরোনাম গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেই পড়েন।

ইংল্যান্ডে বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ
ব্রিটিশ সিংহ কম্পমান

ফ্রান্সের গভীরে অপ্রতিরোধ হিটলার

অপেক্ষমাণ জনতার একজন বলে বসিল, হিটলার বাবাজি দেহি ফান্সের গুয়া মাইরা দিছে।

এককড়ি চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বললেন, অশ্লীল কথা বলব না। দীননাথ।

দীননাথ বিস্মিত হয়ে বলল, ‘অশ্লীষ’ কথা কোনটা বলছি! সত্য কথা বলছি। হিটলার সবেরেই গুয়া মারতাছে— এটা সত্য কথা, অশ্লীষ’ না।

গৌরাঙ্গ চক্রবতীর কাছে মূল কাগজ চলে এসেছে। তিনি কয়েকবার কেশে, পানি খেয়ে আয়োজন করে পাঠ শুরু করেছেন। শ্রোতাদের চোখ অগ্রহ এবং উত্তেজনায় চকচক করছে। দূরদেশের যুদ্ধ তাদের স্পর্শ করছে না। হিটলার নামে দুর্ধর্ষ একজন সবাইকে নাস্তানাবুদ করছে, ভাবতেই আনন্দ।

গৌরাঙ্গ পড়ছেন– ‘একদিনে ৭০ বার বোমা হামলা। চাৰ্চিলের মাথায় হাত।’ পড়তে পড়তে গৌরাঙ্গ নিজেও মাথায় হাত দেন। হতাশ ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকান, যেন তিনি নিজে চাৰ্চিল। মাথায় বোমা বর্ষণ চোখের সামনে দেখছেন। শ্রোতারা বড়ই আমোদ পায়।

বান্ধবপুরের লোকজন আগে কখনো হিটলারের নাম শোনে নি। এখন এই নাম চলে আসছে নিত্যদিনের আলোচনায়। যাদের ছেলেসন্তান হচ্ছে, তারা সন্তানের নাম রাখছে- হিটলু কিংবা হিটু। হিটলারের সঙ্গে মিল রেখে নাম।

খবরের কাগজ পড়া শেষ হয়েছে। শ্রোতারা যে যার বাড়িতে চলে গেছে। এককড়ি হারিকেন নিভিয়ে দিয়েছেন। কেপ্লোসিনের সাশ্রয় করতে হবে। দাম যেভাবে বাড়ছে, কিছুদিন পর এই বস্তু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বাইরে চাঁদের আলো আছে। হারিকেন না জ্বালালেও চলে। আধো অন্ধকারে এককড়ি দোকানের কর্মচারীদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন। গলা নামিয়ে বললেন, চাল কিনা শুরু করা। দাম কিছু বেশি হলেও কিনবা। বড় নৌকা নিয়ে ভাটি অঞ্চলের দিকে যাও। সেখানে ধান চাল দুইই সস্তা।

কর্মচারীদের একজন বলল, কর্তা, কিনা শুরু করব কবে? পঞ্জিকাতে শুভ দিন দেখে শুরু করা উচিত না?

এককড়ির জন্যে তামাক সাজানো হয়েছে। তিনি তামাক টানতে টানতে বললেন, শ্ৰীগণেশের জন্যে সব দিনই শুভ। তারপরেও চৈত্র সংক্রান্তিতে পূজার পরে শুরু করা। এককড়ি তোমাক টানতে লাগলেন।

বাংলার পঞ্চাশের মন্বন্তরের সূচনা শুরু হলো। ভয়াবহ এই মন্বন্তরে বঙ্গদেশে ত্ৰিশ লক্ষ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। বিশ্বযুদ্ধের পাওনা এভাবেই তাদের শোধ করতে হয়। মহান ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ লেখেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘অশনি সংকেত’।

বঙ্গদেশের মানুষ এই ধরনের বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে এর আগেও একবার গিয়েছিল। ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল তখন লর্ড ক্লাইভ। তার সময়ের মন্বন্তরে (ছিয়াতুরের মনন্তর) বাংলার এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী মৃত্যুবরণ করে। তাদের মৃত্যু কখনোই শ্যাম সমান ছিল না।

 

জুমা মসজিদের বর্তমান ইমাম মাওলানা করিম এশার নামাজ শেষ করে ঘরে ফিরছেন। পাকা পুলের কাছে এসে মাওলানা থমকে দাঁড়ালেন। পাকা পুলের রেলিংয়ের ওপর লম্বা কে একজন দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে সাদা চাদর। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষ হলে মূর্তির হাত-পা নড়ত। বাতাসে গায়ের চাদর নড়ত। সেরকম কিছুই হচ্ছে না, মূর্তি পাথরের মতো স্থির।

করিম আয়াতুল কুরশি পড়ে বুকে ফুঁ দিলেন। পাকা পুল জায়গাটা খারাপ। পুলের কাছেই বিরাট যে তেঁতুলগাছ সেখানে ছায়ামূৰ্তিরা থাকে। অনেকেই দেখেছে। তিনি আজ প্রথম দেখলেন। তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করেন, তুমি কে? শেষ পর্যন্ত করলেন না। জিন-ভূতদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করা বিপদজনক। তখন তারা পিছু নেয়।

মাওলানা করিম দ্বিতীয়বার আয়াতুল কুরশি পড়ে হাততালি দিলেন। হাততালির শব্দ যতদূর যাবে জিন-ভূতদের তারচে’ও দূরে যাবার কথা। ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল না। হাততালির শব্দে ফিরে তাকাল। করিম নিজের অজান্তেই ভীত গলায় বলে ফেললেন, তুই কে?

আমি লাবুস।

এখানে কী করিস?

কিছু করি না।

পুলের উপরে দাঁড়ায়ে আছস কী জন্যে? মানুষরে ভয় দেখানোর জন্যে? আমি যদি আজ খাবড়ায়া তোর দাঁত না ফেলছি। বদমাইশা! পুলের উপর থেকে নাম বললাম।

লাবুস জবাব দিল না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে শীতল গলায় বলল, আপনি মাওলানা ইদরিসকে গত জুম্মাবারে কাফের ফতোয়া দিয়েছেন। কেন দিলেন?

করিম বললেন, তোর কাছে জবাবদিহি করব না-কি হারামজাদা? সে কাফেরের কাজ করেছে বলে কাফের ফতোয়া দিয়েছি। হিন্দুর মুখাগ্নি করেছে। খবর রাখস না?

লাবুস বলল, লাশের মুখে আগুন দিয়েছে। লাশের আবার হিন্দু-মুসলমান কী? লাশ নামাজ কালাম পড়ে না। মন্দিরে ঘণ্টাও বাজায় না।

বাপরে বাপ! জ্ঞান ফলায়। দেওবন্দের প্রিন্সিপাল স্যার আসছেন। হারামজাদা, তুই জানস না ইদরিস এক বেশ্যামাগির সাথে সংসার করতেছে? মাগির পেটও বাধায়ে ফেলেছে।

জুলেখা লাবুসের মা। করিমের কঠিন কথাতে লাবুসের কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে আগের মতোই শান্ত গলায় বলল, মাওলানা ইদরিসকে কাফের বলার কারণে আজ আমি আপনাকে শাস্তি দিব। এমন শাস্তি যে জনমে ভুলবেন না। যতদিন বাঁচবেন ইয়াদ থাকবে।

করিম থমকে গেলেন। বদমাইশটার কথা বলার ধরন ভালো না। ছুরি চাকু চালাবে কি-না কে জানে! লাবুসের হাতে অবশ্যি ছুরি চাকু কিছু দেখা যাচ্ছে না। বদমাইশটা চাদরের নিচে লুকিয়ে রাখতে পারে। মনে হয় তাই করেছে। চৈত্র মাসের গরমে গায়ে চাদর থাকার কথা না।

করিম বললেন, কী শাস্তি দিবি?

লাবুস বলল, আমি আপনেরে ন্যাংটা করে ছেড়ে দিব। ন্যাংটা অবস্থায় দৌড়াতে দৌড়াতে আপনি ঘরে যাবেন। আপনার স্ত্রী দরজা খুলে দেখবে ন্যাংটা ইমাম।

এই হারামজাদা! তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?

লাবুস রেলিং থেকে নামতে নামতে বলল, মাথা খারাপ হয় নাই। করিম উল্টাদিকে দৌড় দেবেন কি-না বুঝতে পারছেন না। এই হারামজাদা তাকে ভয় দেখাচ্ছে। এর বেশি কিছু না। এইসব ক্ষেত্রে ভয় পেতে নাই। ভয় পেলেই হারামজাদা বুঝতে পারবে, আরো লাই পাবে।

লাবুস করিমের দিকে এগুচ্ছে। ছোট ছোট পা ফেলে এগুচ্ছে। তার চোখের দৃষ্টি তীব্র এবং তীক্ষ্ণ। করিম দ্রুত ভাবছেন, এখনো দৌড় দেয়ার সময় আছে। তবে দৌড় দেয়াটা হবে বিরাট বোকামি।

লাবুস বলল, পাঞ্জাবিটা খুলে আমার হাতে দেন।

করিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। পাঞ্জাবির ওপর দিয়ে যাচ্ছে। উদম গায়ে বাজারের ভেতর দিয়ে যাওয়াও লজ্জার ব্যাপার। তারপরেও কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবেন— অতিরিক্ত গরমের কারণে পাঞ্জাবি খুলে রেখেছেন। কথা মিথ্যাও হবে না। আজ অতিরিক্ত গরম পড়েছে। পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে যাচ্ছে।

করিম পাঞ্জাবি খুলে লাবুসের হাতে দিতে দিতে বললেন, পাঞ্জাবি নিয়ে বাড়িত যা। অপরাধ যা করেছিস তার ক্ষমা নাই। তবে আজ আর কিছু বলব না। কোনো একদিন ফয়সালা হবে।

লাবুস বলল, এখন লুঙ্গি খুলে আমার হাতে দেন।

কী বললি?

একবার তো বলেছি। আবার বলি, লুঙ্গি খুলে আমার হাতে দেন। নিজে না দিলে আমি টান দিয়া খুলব।

করিমের হাত-পা জমে গেল। তার কান দিয়ে মনে হচ্ছে ধোয়া বের হচ্ছে। চোখ বাপসা।

মেঘের ভেতর থেকে চাদ বের হয়েছে। ফকফকা চাঁদের আলো। করিম দুই হাতে লজ্জা ঢেকে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লাবুসের হাতে মাওলানার লুঙ্গিপাঞ্জাবি। লাবুস সহজ গলায় বলল, বাজারের ভিতর দিয়ে যেতে পারবেন না। বাজারে হরিনাম জপ হচ্ছে। নদীর পাড় দিয়ে চলে যান। কেউ দেখবে না।

বাজারের দিক থেকে বিড়ি টানতে টানতে কে যেন আসছে। দূর থেকে বিড়ির আগুনের ওঠা-নামা দেখা যাচ্ছে। করিম রাস্তা ফেলে নদীর পাড়ের দিকে দৌড় দিলেন। রাত তেমন বেশি হয় নি। ঘাটের নৌকার মাঝিরা নিশ্চয়ই জেগে। আছে। তাদের কেউ-না-কেউ অবশ্যই দেখবে। জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা ভালো। রাত গভীর হলে বাড়ি ফিরবেন। জঙ্গলে বসে থাকারও হাজার সমস্যা আছে। সাপখোপের সমস্যা। অতিরিক্ত গরমে তারা সবাই গর্ত থেকে বের হয়েছে। পালপাড়ার এক বৌ গত বুধবার দুপুরে সাপের কামড়ে মারা গেছে। কচুর লতির সন্ধানে সে জঙ্গলে ঢুকেছিল। কচুগাছের নিচে হাত দেয়া মাত্ৰ সাপ ঠোকর দিল। আল্লাহ মারুদ জানে— তাঁর কপালে সাপের হাতে মৃত্যু আছে কি-না।

 

করিমের বাড়ি বাজারের শেষপ্রান্তে। তিনি বছরখানেক আগে ভাটি অঞ্চলের এক মেয়ে বিয়ে করেছেন। মেয়ের বয়স অল্প। কিশোরীর মায়া তার চোখ-মুখ থেকে যায় নি। তার নাম শরিফা। সে উঠানে হারিকেন জ্বলিয়ে স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করছে। বাজারে সত্যনারায়ণের ব্ৰতকথা হচ্ছে। উঠান থেকে মোটামুটি শোনা যায়। শরিফার শুনতে ভালো লাগছে। যদিও পরের ধর্মকথা শোনা ঠিক না। পাপ হয়। শরিফার প্রায়ই মনে হয় মুসলমানদের মধ্যে গানবাজনা করে ধৰ্মকথা বলার ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো।

গৌরাঙ্গের মিষ্টি গলার সঙ্গে মৃদঙ্গর বাড়ি, শরিফা আগ্রহ নিয়ে শুনছে।

কহিব তোমাকে আমি পূজার বিষয়।
সওয়া সেরা আটা কিংবা আতাপের গুড়ি।
কাঁচা দুগ্ধ সওয়া সের, কলা সওয়া কুড়ি।
সওয়া সেরা ইক্ষুগুড় সেবার প্রমাণ।
সওয়া সের গুয়া লাগে, সওয়া কুড়ি পান।
সওয়া সেরা সওয়া মন যে যে রূপে পারে।
মুদ্রা যদি থাকে। তবে নানা উপাচারে—

বেড়ার বাইরে কে যেন গলা খাঁকারি দিয়ে ডাকল, ইমাম সাহেব বাড়ি আছেন?

শরিফা চমকে উঠল। পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ। কথা না বললে মানুষটা উঠানে ঢুকে পড়তে পারে, সেটা আরো বিপদের।

ইমাম সাহেব বাড়ি ফিরেন নাই?

শরিফা ক্ষীণ গলায় বলল, না।

পুরুষকণ্ঠ বলল, মা! আমার নাম লাবুস। ইমাম সাহেবের কিছু জিনিস আমার কাছে। যদি অনুমতি দেন উঠানে রেখে যাই।

যে পুরুষ মা’ সম্বোধন করেছে তাকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেয়া যায়। শরিফা ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। দরজার আড়াল থেকে বলল, রেখে যান।

লাবুস উঠানে ঢুকল। যুবা পুরুষের গায়ে চাঁদের আলো পড়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ভিনদেশের কোনো রাজপুত্ৰ পথ ভুলে চলে এসেছে। শরিফার মনে হলো, এমন রূপবান পুরুষ সে তার জীবনে দেখে নি। আর এই যুবা পুরুষটার কী অদ্ভুত নাম— লাবুস।

শরিফা আর কথা বলবে না ঠিক করে রাখার পর বলল, আপনি হিন্দু না মুসলমান?

আমি মুসলমান। মা, আসসালামু আলায়কুম।

শরিফা বিব্রত গলায় বলল, ওয়ালাইকুম সালাম।

লাবুস বলল, মা, আমি সারাদিন খাই নাই। খুবই ক্ষুধার্তা। ঘরে কিছু কি আছে? চিড়া, মুড়ি, একটা কিছু হলেই হবে।

আপনি দাওয়ায় জলচৌকিতে বসেন। খাওয়া আনতেছি। কলসিতে পানি আছে। হাত-মুখ ধোন।

লাবুস বলল, আপনাকে মা ডেকেছি- আমাকে তুমি করে বলবেন।

শরিফা অতি দ্রুত খাওয়ার ব্যবস্থা করল। গরম ভাত। খলিসা মাছের ঝোল, পাট শাক, ডাল।

বারান্দায় পাটি পেতে খাওয়ার নিখুঁত আয়োজন। পাতে লবণ দেয়া, কাগজি লেবুর টুকরা, কাঁচামরিচ, একটা বাটিতে পাতে খাওয়ার ঘি।

শরিফা দরজার আড়াল থেকে ক্ষীণ গলায় বলল, আয়োজন কিছুই নাই, আমি শরমিন্দা। তোমারে দাওয়াত দিলাম। একদিন আসবা। পোলাও করব, মুরগির কোরমা করব।

লাবুস মাথা কাত করে বলল, জি আচ্ছা।

খাওয়া শেষ করে লাবুস উঠানে দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহপাক, আমাকে আমার নতুন মা যে যত্নের সঙ্গে খানা দিয়েছেন, তাকে সারাজীবন যেন কেউ না কেউ এরকম যত্ন করে খাওয়ায়।

অদ্ভুত এই দোয়ার কথা শুনে শরিফার চোখে পানি এসে গেল।

আহারে বেচারা, ঘরে কিছুই ছিল না, তারপরেও কত তৃপ্তি করে খেয়েছে। কী সুন্দর করে দোয়াটা করেছে! প্রিয়জন কেউ কি এর নাই? সে কি পথে পথে না খেয়ে ঘুরে?

তোমার পরিচয় কী?

আমার কোনো পরিচয় নাই।

পরিচয় থাকবে না। এটা কেমন কথা! আমারে মা ডেকেছ, খুশি হয়েছি। তোমার আসল মা কে?

আমার কোনো মা নাই। এখন আমারে বিদায় দেন, আমি যাই।

 

কলাপাতায় শরীর ঢেকে ইমাম করিম কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে গভীর রাতে ফিরলেন। তার চোখ রক্তবর্ণ। শরীর কাঁপছে। হতভম্ব শরিফা বলল, আপনার কী হয়েছে?

করিম বিড়বিড় করে বললেন, আগে গোসলের পানি দেও। গামছা দেও। জিনের হাতে পড়েছিলাম। জীবনসংশয় হয়েছিল। অনেক কষ্টে জানে বাঁচছি।

কন কী আপনি?

করিম বলল, তুমি কি ভাবিছ মিথ্যা বলতেছি? যা বলতেছি সবই সত্য। জিনের নাম খোররম। সে থাকে কোহাকাফ নগরে। এশার নামাজের পর বাড়ি ফিরতেছি, সে আমার পিছু নিছে। কখনো থাকে পিছে, কখনো চইলা আসে সামনে। তার হাত থেকে বীচার জন্যে সূরায়ে জিন পাঠ শুরু করলাম— এইখানে হইল সমস্যা।

কী সমস্যা?

ভয়ের কারণে মাঝখানে আমার দোয়া বিস্মরণ হলো। ‘ওয়া আন্না জানান না আললান তাকুলাল ইনসু পর্যন্ত পড়েছি, তারপর আর কিছু মনে আসে না। মাথা গেল আউলায়া, তখন জিন আইসা আমারে চাইপা ধরল। টান দিয়া নিয়া গোল জঙ্গলায়। পাছড়াপাছড়ি কামড়াকামড়ি।

কী সৰ্ব্বনাশ!

একসময় জ্ঞান হারাইলাম। যখন জ্ঞান ফিরাল দেখি ন্যাংটা হইয়া কাদার মধ্যে শোয়া। জানে যে বাঁচিছি। এইজন্য আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া।

ভয়ঙ্কর এই কথা শোনার পর শরিফা লাবুসের কথা চেপে গেল। সে যে ইমাম সাহেবের পাঞ্জাবি-লুঙ্গি দিয়ে গেছে, এটাও তো একটা রহস্য। আচ্ছা! এমন কি হতে পারে— লাবুস নামে যে এসেছে, সে-ই জিন খোররম? মানুষের বেশ ধরে এসেছে। তাকে মা বলে ডেকেছে। খাওয়া-দাওয়া করেছে। অনেক রাত পর্যন্ত শরিফা জেগে রইল। একসময় সে পুরোপুরি নিশ্চিত হলো, জিন খোররমের সঙ্গেই তার দেখা হয়েছে। মানুষ এত সুন্দর হয় না। মানুষ এত গরমে চাদর গায়ে রাখে না। শরিফার গা কাটা দিয়ে উঠল। পাশেই তার স্বামী অঘোরে ঘুমাচ্ছে। শরিফার ইচ্ছা করছে স্বামীকে ডেকে তুলে জিন খোররমের সাথে তার দেখা হওয়ার গল্পটা করে।

 

লাবুস ভালো ঝামেলায় আছে। অনাহারের ঝামেলা। এত বেলা হয়েছে, এখনো খাবারের কোনো ব্যবস্থা হয় নি। দুপুরে মাওলানা ইদরিসের বাড়ির কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এলো। ওই বাড়িতে তার মা জুলেখা থাকে। মায়ের সঙ্গে দেখা করার তার কোনো ইচ্ছা নেই।

সে রওনা হলো জংলার কালীবাড়ির দিকে। দেবীকে ভোগ হিসেবে কেউ কেউ হঠাৎ একটা দুটা পয়সা ছুঁড়ে দেয়। একবার এখান থেকেই একটা এক আনি পেয়েছিল।

কালীবাড়িতে কোনো পয়সা-কড়ি পাওয়া গেল না। কেউ একজন কলাপাতায় ক্ষীর দিয়ে গেছে। দুনিয়ার পিপড়া ক্ষীরের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পিপড়ার খাওয়া দেখে সে জঙ্গলে ঢুকল। জঙ্গলে বুবি গাছে (লটকন) পাকা বুবি আছে। যত ইচ্ছা খাওয়া যায়। সমস্যা একটাই, বুবি খেলে ক্ষুধা যায় না, বরং আরো বাড়ে। সে জঙ্গলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। জংলি কিছু কলাগাছ আছে। আঙুলের মতো ছোট ছোট কলা ধরেছে। এই কলা সে আগেও খেয়ে দেখেছে— তিতা এবং ভয়ঙ্কর কষটা। জোর করে খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে প্রবল বমিভাব হয়।

জঙ্গলের মাঝখানে জলা জায়গায় হুটপুট শব্দ হচ্ছে। লাবুস সেদিকে এগিয়ে গেল। কেউ বরিশি পুঁতে রেখেছে, সেখানে মাছ ধরা পড়েছে। প্রায় দুই হাত লম্বা এক বোয়াল। বর্শি ছেড়ার প্রাণান্ত চেষ্টায় সে ক্লান্ত। লাবুস বোয়ালটা ডাঙ্গায় তুলল। আগুনে পুড়িয়ে খেলে ভালো হবার কথা। আগুন জ্বালাবার কোনো সরঞ্জাম তার কাছে নেই। মাছটা কাঁচা খাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। যদিও তার মনে হচ্ছে, সে চোখ বন্ধ করে কীচা খেতেও পারবে। জংলি, মানুষরা তো একসময় কাঁচা মাছ খেত। তাদের সমস্যা না হলে তার হবে কেন?

আগুনের উদ্দেশ্যে লাবুস জংলা থেকে বের হলো। তার চাদরের নিচে বোয়াল মাছ লুকানো। আগুন পাওয়া কঠিন হবে। যুদ্ধের বাজারে দেয়াশলাইয়ের দাম তিনগুণ হয়েছে। লাবুস বাজারের দিকে হাঁটা ধরল। দেয়াশলাই জোগাড় হবে কি-না বুঝতে পারছে না। কেউ তাকে মাগনা দেয়াশলাই দেবে না। হিন্দু পাইস হোটেলের সামনে থমকে দাঁড়াল। রান্নার কী সুন্দর গন্ধ আসছে! পাইস হোটেলের মালিক নিবারণ বলল, দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া থাকবি না।

লাবুস বলল, কর্তা, ভাত খাব।

নিবারণ বলল, ভাত যে খাবি পয়সা আছে?

লাবুস বলল, পয়সা নাই। একবেলা খাওয়ার বিনিময়ে এই মাছটা আপনারে দিব।

লাবুস চাদরের নিচ থেকে মাছ বের করল। বোয়াল মাছের প্রাণশক্তি ভালো। সে এখনো জীবিত। কানকো নড়ছে।

নিবারণ বলল, খেতে বাস। বাইরে বসে খাবি। মুসলমানের ভিতরে ঢোকা নিষেধ। অন্যের খাওয়া নষ্ট হয়। যা কলাপাতা কেটে নিয়ে আয়।

সবুজ কলাপাতায় ধবধবে সাদা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত। ঝিঙা দিয়ে রাধা লাবড়া, সঙ্গে মলা মাছের ঝোল। খেতে খেতে লাবুসের মনে হলো, জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ ভারপেট খাওয়ায়। এইজন্যেই হয়তো বেহেশতে খাওয়া-খাদ্যের বর্ণনায় এত জোর দেয়া হয়েছে।

লাবুসের কলাপাতার ভাত শেষ হয়েছে। সে হাত গুটিয়ে বসে আছে, তার দৃষ্টি পাঁচক বামুনের দিকে।

নিবারণ বলল, অ্যাই এরে আরো ভাত দে, ডাল দে। পেটে ক্ষুধা নিয়ে কেউ আমার দোকান থেকে উঠবে, এটা ঠিক না। এতে অন্নপূর্ণা অসন্তষ্ট হন।

 

লাবুস যখন খাচ্ছিল, তখনি বেঙ্গল নেভিগেশনের লঞ্চে করে ধনু শেখ বান্ধবপুরের ঘাটে এসে নামেন। পা কাটা যাবার পর এই প্রথম তিনি নিজ গ্রামে এসেছেন। যে লঞ্চের সিঁড়ি দিয়ে আগে তিনি চোখ বন্ধ করে নামতেন, আজ সেই সিঁড়ি দিয়ে তাকে কোলে করে নামানো হচ্ছে। কী লজ্জার কথা! দুনিয়ার মানুষও জড়ো হয়েছে লঞ্চঘাটে। যেন তারা জীবনে কখনো এক ঠ্যাং-এর মানুষ দেখে নাই। সব বিদের দল। ধনু শেখের ইচ্ছা করছে দু’নলা বন্দুক দিয়ে একটা ফাঁকা আওয়াজ করেন, যাতে ভয়ে লোকজন ছুটে পালায়। তিনি নিরিবিলিতে নামতে পারেন।

ধনু শেখকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্যে চেয়ারের হাতলে বাঁশ বেঁধে বিশেষ আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অতি বিরক্তি নিয়ে তিনি চেয়ারে বসে আছেন। চারজন মিলে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা হয়েছে পান্ধির মতো। পান্ধির ভেতরে বসে থাকা মানুষ দেখা যায় না। এই ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে।

চেয়ারের পেছনে পেছনে বালক-বালিকার বিশাল এক বাহিনী। ধনু শেখের লোকজন ধমক ধামক দিয়েও এদের দূর করতে পারল না। এমন মজার দৃশ্য তারা অনেক দিন দেখে নি। যতক্ষণ দেখা সম্ভব ততক্ষণ তারা দেখবেই।

ধনু শেখ বিরক্ত গলায় বললেন, খামাকা পিছে পিছে না এসে স্লোগান দে। বল, খান বাহাদুর ধনু শেখ জিন্দাবাদ।

শিশুরা মহাআনন্দে জিন্দাবাদ দিতে লাগল। এত আমোদ তারা অনেক দিন পায় নি।

 

রাত আটটার মতো বাজে। বান্ধবপুরের বেশির ভাগ মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে। ধনু শেখ জেগে আছেন। তিনি এখনো রাতের খাওয়া খান নি। রান্নাবান্নার আয়োজন হচ্ছে। রাতে তিনি মাছ খান না। তার জন্যে খাসি জবেহ হয়েছে। কোলকাতায় খাসির মাংস বলে যা পাওয়া যায়, সবই পাঠা। হাজার মসলা দিলেও মাংস থেকে গন্ধ যায় না।

ধনু শেখের মদ্যপানের অভ্যাস ছিল না। পা কাটা যাবার পর সামান্য মদ্যপান শুরু করেছেন। জাহাজে করে কোম্পানির লোকজনের জন্যে বিলাতি বোতল আসে। নানা যন্ত্রণা করে তিনি সেখান থেকে বোতল সংগ্রহ করেন। মাঝে মাঝে বিস্মিত হয়ে ভাবেন, ইংরেজ জাতি কত উন্নত। এরা যখন মদ বানায়, সেই মদও উন্নত। আমরা এখনো পড়ে আছি ধেনু, মদে। এতই দুৰ্গন্ধ যে নাক চাপা দিয়ে খেতে হয়।

ধনু শেখ লাবুসকে খবর দিয়ে এনেছেন। সে অনেকক্ষণ থেকে ধনু শেখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ধনু শেখ কয়েকবার তার দিকে তাকিয়েছেন, কিছু বলেন। নি। নিজের মনে ডাবের পানি মেশানো জিনের বোতলে চুমুক দিয়েছেন। এইবার তিনি কথা শুরু করলেন—

তোমার নাম লাবুস?

হ্যাঁ।

ইহ্যাঁ করছি কেন? আদব লেহাজ ভুলেছ? কার সঙ্গে কথা বলতেছ। বিস্মরণ হয়েছ? আমি খান বাহাদুর। আদবের সঙ্গে কথা বলবা। বলো জি।

জি।

সুলেমানের পুত্ৰ?

জি।

সুলেমান কোথায়?

উনি ঘোড়ায় চড়ে ভিক্ষা করতে গেছিলেন, আর ফিরেন নাই।

ধনু শেখ আনন্দিত গলায় বললেন, ঘোড়ায় যেতে যেতে ইউরোপে চলে গেছে কি-না খোঁজ নাও। দেখা গেল যুদ্ধের মধ্যে পড়েছে। হা হা হা।

লাবুস বলল, আপনি কী জন্যে আমাকে ডেকেছেন?

ধনু শেখ ভুরু কুঁচকে বললেন, এত তাড়া কী জন্যে? তুমিও কি ঘোড়ায় চড়ে ভিক্ষায় বের হবে? গায়ে চাদর কেন? গরমের মধ্যে চাদর, ঘটনা কী?

লাবুস চুপ করে রইল।

ধনু শেখ বিরক্ত গলায় বললেন, প্রশ্ন করলে জবাব দিবা। আল্লাহপাক বোবা বানালে তুমি বোবা। নিজ থাইকা বোবা সাজবা না। গায়ে চাদর কেন?

লাবুস বলল, আমার কাপড় নাই, চাদর দিয়া নিজেরে ঢাইকা রাখি।

ধনু শেখ চারমিনার সিগারেট ধরিয়েছিলেন। সিগারেট ফেলে দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, বাপের মতো ভিক্ষায় বাইর হও নাই কেন? পিতা ভিক্ষুক পুত্রও ভিক্ষুক। ভিক্ষুক বংশ।

লাবুসের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। সে কিছু বলল না। এই মানুষটা শশাংক পালের মতো কথা বলছে। খুবই আশ্চর্যের কথা, কিছু কিছু মানুষ একইভাবে চিন্তা করে। তাদের পরিণতিও হয় একই।

ধনু শেখ বললেন, তোমাকে বিশেষ কারণে ডেকেছি। রসালাপ করার জন্যে ডাকি নাই। রসালাপ করতে হয় অল্পবয়সি মেয়েছেলের সাথে। বুঝেছ?

বুঝেছি।

হরিচরণের বিশাল বিষয়সম্পত্তি, সব তিনি যে তোমারে দানপত্র করে দিয়েছেন সেটা জানো?

না।

দানপত্রের মূল কপি আমার কাছে আছে। দানপত্র নিয়া যাও— মুফতে যে জিনিস পেয়েছ। ভোগ কর। তার আগে সাবান ডলে ভালোমতো গোসল কর। টাকা দিতেছি- জামাকাপড় কিনো।

ধনু শেখ একশ’ রুপির একটা নোট বের করলেন। লাবুস সহজ ভঙ্গিতে নোট হাতে নিল। ধনু শেখ উদার গলায় বললেন, রাতে আমার সঙ্গে খানা খাবে। পোলাও খাসির মাংস।

এত বড় একটা ঘটনা জানার পরেও একটা ছেলে এত নির্বিকার কেন ধনু শেখ ভেবে পেলেন না। পাগল না তো! সুস্থ মাথার মানুষ হলে আনন্দে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেত।

লেখাপড়া কিছু জানো?

অল্প জানি।

যুদ্ধ যে চলতেছে এইটা জানো?

শুনেছি।

কার সাথে কার যুদ্ধ?

জার্মানি আর জাপানের সাথে সারা দুনিয়ার যুদ্ধ।

আমরা ভারতবাসী কার সাথে আছি?

নেতাজি সুভাষ চন্দ্ৰ বসুর সাথে।

উনি কোথায়?

উনি ইংরেজের হাতে বন্দি।

যুদ্ধে কে জিতবে?

কেউ জিতবে না, তবে হিটলার হারবে। জাপানে দুইটা বড় বোমা পড়বে। জাপান হারবে।

ধনু শেখ বললেন, জাপানে দুইটা বড় বোমা পড়বে তোমাকে কে বলেছে? চার্চিল সাব তোমার সঙ্গে পরামর্শ করেছেন?

লাবুস বলল, আমি অনেক কিছু চোখের সামনে দেখি।

ধনু শেখ বললেন, তুমি তো বিরাট পীর হয়েছ। শরীরে নাই কাপড়, পেটে নাই ভাত। কিন্তু পীর কেবলা।

লাবুস শান্ত গলায় বলল, এখন তো ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা হয়েছে।

ধনু শেখ রাগী গলায় বললেন, ব্যবস্থা কে করেছে? আমি, না-কি হরিচরণ?

লাবুস জবাব দিল না। ধনু শেখ হঠাৎ লক্ষ করলেন, নোংরা চাদর গায়ে যে যুবক তার সামনে দাঁড়িয়ে সে অসম্ভব রূপবান একজন। মদের ঝোঁকে এরকম দেখছেন? বেশি তো খাওয়া হয় নি। মাত্র তিন গ্লাস।

তুমি নিশ্চয়ই বিবাহ কর নাই?

জি না।

আমার কন্যাকে বিবাহ করবা? তার নাম আতর। আমার মতো তার ঠ্যাং কাটা না। সে ভালো মেয়ে।

লাবুস পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো। তার ঠোঁটে হালকা হাসির আভাস। ধনু শেখ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এই ছেলে সত্যি সত্যি হেসে ফেললে তাকে রাম ধোলাই দিতে হবে। বেয়াদবির শাস্তি।

ধনু শেখের নিজের ওপরই রাগ লাগছে। হুট করে এই ফকিরের পুলাকে মেয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেললেন? দেশে কি সুপাত্রের অভাব হয়েছে? তিনি বুঝতে পারছেন যা করেছেন সবই মদের ঝোঁকে করেছেন। এই বস্তু খাওয়া বন্ধ করতে হবে। ধনু শেখ বললেন, খাম্বার মতো সামনে দাঁড়ায়া থাকবা না। বিদায়।

লাবুস বলল, রাতে আপনার সঙ্গে খানা খেতে বলেছিলেন।

ধনু শেখ বললেন, যা বলেছিলাম ফিরায়ে নিলাম। খান বাহাদুর ধনু শেখ ভিক্ষুকের সাথে খানা খায় না। সামনে থেকে যাও।

লাবুস ঘর থেকে বের হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ধনু শেখ তার সন্ধানে লোক পাঠালেন। তাঁর কাছে মনে হলো, একবার যখন খানা খাওয়াবেন বলে কথা দিয়েছেন তখন কথা রাখা উচিত।

 

রাত দুটা বাজে। মাওলানা ইদরিস উঠানে বসে আছেন। উঠানে আলো নেই। আকাশে মেঘ থাকায় চাঁদ বা নক্ষত্রের কোনো আলোও নেই। তার চারদিকে ঘন অন্ধকার। ঘরের দরজা খোলা। ঘরের ভেতর থেকে হারিকেনের সামান্য আলো আসছে। ইদরিস তাকিয়ে আছেন আলোর দিকে। তাঁর মন সামান্য বিষণ্ণ। শশাংক পালের বিষয়ে একটা কথা শোনা যাচ্ছে। সে না-কি মরে ভূত হয়েছে। অনেকেই শ্মশানঘাটে তাকে দেখেছে। নগ্ন অবস্থায় নদীর পানিতে পা ড়ুবিয়ে বসে থাকে। কাউকে দেখতে পেলে দুঃখিত গলায় বলে, এইটা কী করলা? একজন মুসলমানরে দিয়া আমার মুখাগ্নি করাইলা? এই কারণে প্রেতিযোনি প্রাপ্ত হয়েছি। গয়ায় পিণ্ডিদানের ব্যবস্থা কর। আমারে উদ্ধার করা।

গয়ায় পিণ্ডিদানের বিষয়টা কী ইদরিস জানেন না। যারা জানে তারাও এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিবে বলে মনে হয় না। পিণ্ডি দেওয়ার কাজটা কি কোনো মুসলমান করতে পারে? পারলে তিনি করতে রাজি আছেন। সমস্যা একটাই, গয়াকাশি যাবার মতো অর্থসংস্থান তাঁর নেই। তবে তাঁর ধারণা, মুখাগ্নির মতো পিণ্ডিদানের ব্যবস্থাটাও হিন্দুদের করতে হবে। তাঁকে দিয়ে হবে না।

গয়াকাশি না গেলেও মাওলানাকে একবার বগুড়ার মহাস্থানগড়ে যেতে হবে। শশাংক পাল মৃত্যুর আগে তাকে এই নির্দেশ দিয়ে গেছেন। সেখানে ললিতা নামে এক মেয়েকে খুঁজে বের করে বলতে হবে- বান্ধবপুরের এক সময়ের জমিদার বাবু শশাংক পাল তোমার পিতা। জীবিত অবস্থায় এই খবর তিনি তোমাকে দিতে পারেন নাই বলে তিনি বিশেষ লজ্জিত। তিনি তোমার জন্যে কিছু উপহার রেখে গেছেন। দশটা সোনার মোহর। বিশেষ একটা জায়গায় মাটিতে গর্ত করে পোতা।

জুলেখা দরজায় এসে দাঁড়াল। হাই তুলতে তুলতে বলল, একটু ভিতরে আসবেন? খাটের নিচে সাপ। সাপটা বিদায় করেন।

খাটের নিচে অন্যসব দিনের মতো হারিকেন জুলছে। আলোয় সাপ আসে না— এই কথা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে হারিকেনের কাছেই সাপটা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। মাওলানা হাততালি দিয়ে বললেন, অ্যাই যা। যা!

সাপটা মাথা তুলে তাকাল। কিছুক্ষণ মাওলানাকে দেখে আবার মাথা নামিয়ে শুয়ে পড়ল। জুলেখা বলল, সাপ খেদানির কোনো দোয়া জানেন না? দোয়া পড়েন।

মাওলানা বললেন, খোদার কালাম নিয়া ঠাট্টা-তামাশা করব না।

জুলেখা বলল, অন্য ব্যবস্থা নেন। লাঠি দিয়া মারেন।

মাওলানা বললেন, না। সে আমার কোনো ক্ষতি করে নাই। আমি তারে মারব কী জন্যে?

যখন ক্ষতি করব তখন কিন্তু আর উপায় থাকব না। এইটা শঙ্খচূড় সাপ। এর বিষ নামানি কোনো ওঝার পক্ষেও সম্ভব না।

মাওলানা সাপ খেদানোর চেষ্টা আরেকবার করলেন। শলার ঝাড়ু দিয়ে কয়েকবার সাপের খুব কাছাকাছি বাড়ি দিলেন। সাপের কোনো ভাবান্তর হলো না। মাথা উঁচু করে সে একবার মাওলানাকে দেখল, আরেকবার জুলেখাকে দেখে আগের মতো মাথা নামিয়ে ফেলল। মাওলানা বা জুলেখা দু’জনের কেউ তখন জানে না। এই শঙ্খচূড় সাপটা ডিম পাড়ার জন্যে খাটের নিচটা বেছে নিয়েছে। তাকে এখান থেকে সরানো এখন অসম্ভব।

 

ধনু শেখ খেতে বসেছেন। খাটে দস্তরখানা বিছিয়ে খাবার সাজানো হয়েছে। লাবুস তাঁর সঙ্গেই বসেছে। কালিজিরা চালের পোলাও, খাসির মাংস। বাটিভর্তি পেয়াজ দেয়া হয়েছে। খাদিমদার আছে দু’জন। একজন লাবুসের প্লেটে খাবার দিচ্ছে, আরেকজন ধনু শেখকে দেখছে।

লাবুস মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। তার গায়ে নকশাতোলা পাঞ্জাবি! পায়জামা পাঞ্জাবিতে লাবুসকে সত্যিকার অর্থেই রাজপুত্রের মতো লাগছে। ধনু শেখ খানিকটা বিচলিত বোধ করছেন। কেন করছেন তাও বুঝতে পারছেন না। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, তোমার নাম কী বলেছিলা বিস্মরণ হয়েছি। আরেকবার বলে।

লাবুস।

পিঁয়াজ নিয়া খাও। মুসলমানদের জন্যে পিঁয়াজ খাওয়া দুস্তর। কারণ পিঁয়াজ মুসলমান। রসুন হিন্দু। বুঝেছ?

হুঁ।

একবার তো বলেছি। ই হাঁ করবা না। এখন তোমাকে আদবাকায়দা শিখতে হবে। কারণ তুমি এখন রাইস আদমি।

লাবুস বলল, রাইস আদমির দোষ-ত্রুটি লাগে না। দোষ-ত্রুটি গরিবের জন্য।

তোমাকে এইসব কে শিখায়েছে? তোমার ভিক্ষুক পিতা?

আমার যা শিখার আমি নিজে শিখেছি। আমার কোনো শিক্ষক নাই।

ধনু শেখ বললেন, আমারে শিক্ষক মানতে পার। আমি অনেক কিছু জানি যা তুমি জানো না। সোহরাবদীর নাম শুনেছ?

জি না।

তিনি এখন আমাদের নেতা। আমি তার নাম দিয়েছি কাটাকুটি নেতা।

কেন?

কারণ তিনি গোপনে দাঙ্গা-হাঙ্গামার কথা বলেন। তাঁর মন্ত্র হিন্দু কমাও।

মুসলমান কমাও, এই মন্ত্র কি কেউ বলে?

সব হিন্দু নেতাই মনে মনে এই মন্ত্র জপ করে। কেউ কেউ প্রকাশ্যে বলে।

গান্ধিজি কি বলেন?

গান্ধিজি চুপ করে থাকেন। মাঝে মাঝে গান্ধিপোকার মতো ‘পাদ’ দেন। তখন সব জ্বলেপুড়ে যায়। হা হা হা।

লাবুস খাওয়া বন্ধ করে ধনু শেখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার হাসি অবিকল শশাংক পালের হাসি। মানুষটা চলে গেছে, কিন্তু তার হাসি রেখে গেছে।

ধনু শেখ বললেন, হিন্দু মারতে হবে এটা মাথার মধ্যে রাখবা। হিন্দু না মারলে পাকিস্তান কায়েম হবে না। হিন্দু মারলে ইংরেজ সরকার তোমাকে কিছুই বলবে না। কী জন্যে কিছু বলবে না জানো?

জানি না।

ইংরেজ চায় আমরা নিজেরা মারামারি করি। আমরা মারামারি করলে তারা থাকবে নিরাপদ। তখন ক্ষুদিরামরা তাদের মারবে না। এখন বুঝেছি যে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা আমার আছে? কী হলো, খাওয়া শেষ?

জি জনাব খাওয়া শেষ।

লাবুস হাত না ধুয়েই উঠানে নেমে গেল। ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টিতেই হাত ধোয়া হয়ে যাবে। লাবুস ভিজতে ভিজতে হরিচরণের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। পাকা পুলের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। খালে পানি বেড়েছে, শো শো শব্দ হচ্ছে। শুনতে ভালো লাগছে। শব্দের মধ্যেও ভালো মন্দ আছে। কিছু শব্দ শুনতে ভালো লাগে, কিছু শব্দ শুনতে খারাপ লাগে। এর কারণ কী? আল্লাহপাক মানুষকে যেমন ভালো এবং মন্দতে ভাগ করছেন— জগতের সবকিছুকেই তাই করেছেন? এ তাঁর কেমন লীলা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *