১৮. বন্দী হলো রবিন

১৮. বন্দী হলো রবিন

মে মাসের এক সুন্দর সকাল। ঝলমল করছে রোদ। শেরউডের গাছে গাছে নতুন নরম পাতাগুলো কাঁপছে মৃদু হাওয়ায়। চারদিকে বুনো ফুলের মিষ্টি সুবাস। দিনটা রোববার শুধু রোববার নয়, উইট সানডে (ঈস্টারের পরের সপ্তম রোববার)।

কি সুন্দর সকালটা, তাই না?’ বললো লিটল জন।

কোন জবাব দিল না রবিন হুড।

‘কি হয়েছে, ওস্তাদ?’ জানতে চাইলো লিটল জন। হাঁড়ি করে রেখেছো কেন মুখটা?’

‘কতদিন গির্জায় যাইনি বলো তো?’ হঠাৎ মুখ খুললো রবিন। মনে হচ্ছে, কলুষিত হয়ে রয়েছে দেহ-মন। আজকের এই দিনেও যদি গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা না করতে পারি…

‘নটিংহাম ছাড়া কাছে পিঠে আর গির্জা কোথায়?’ বললো মাচ।

‘ওই নটিংহামেই যাব আমি!’ হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো রবিন। ‘হ্যাঁ, সেইন্ট মেরির গির্জায় প্রার্থনা করবো আমি আজ।’

অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করলো ওকে লিটল জন আর মাচ, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না, ও যাবেই। বললো, ‘নিশ্চিন্ত থাকো তোমরা, কেউ সন্দেহ করবে না। চারপাশের গ্রাম থেকে কত লোক ঢুকছে আজ শহরে। ওদেরই মত ছাই-রঙা সুট পরে ঢুকে পড়বো আমিও।’

‘ঠিক আছে, যাবেই যখন, জনা বারো লোক নিয়ে যাও সাথে,’ বললো মাচ। ‘অস্ত্র থাকবে সবার সাথেই, কোন বিপদ হলে যেন আত্মরক্ষা করা সম্ভব হয়।

‘আরে না,’ সাফ মানা করে দিল রবিন। ‘তোমাদের মত দশ-বারোজন গুণ্ডা কিসিমের লোক সাথে নিয়ে শহরে ঢুকতে গেলেই বরং নজরে পড়ে যাব কারও। একমাত্র লিটল জনকে সাথে নিতে পারি আমার তল্পিবাহক হিসেবে।

তৈরি হয়ে নিয়ে রওনা হয়ে গেল ওরা দু’জন। গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করার আশা পূরণ হতে যাচ্ছে বলে খুশি হয়ে ওঠার কথা রবিনের, আসলে কিন্তু তা হলো না। মেজাজটা কেন জানি খিঁচড়ে রয়েছে ওর। ফলে যা হবার হলোঃ কিছুদূর যেতে না যেতেই সাধারণ এক কথায় দু’কথায় তর্ক বাধিয়ে বসলো সে লিটল জনের সাথে। তর্কাতর্কিটা ক্রমে ঝগড়ার আকার নিল, শেষ পর্যন্ত নটিংহামের কাছাকাছি এসে এমনই চরমে পৌঁছলো যে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে হঠাৎ চড়াৎ করে একটা চড় কষিয়ে দিল সে লিটল জনের গালে।

অপমানে কালো হয়ে গেল ঢ্যাঙা দৈত্যের মুখ। চট্ করে হাতটা চলে গিয়েছিল তলোয়ারের বাঁটে, কিন্তু সামলে নিল। তুমি না হয়ে আর কেউ যদি… থাক সে কথা। আমি চললাম। অনুচরের অভাব হবে না তোমার, রবিন হুড; কিন্তু আমাকে পাবে না আর!’

রবিন এগিয়ে চললো নটিংহামের দিকে, আর ধুপ-ধাপ পা ফেলে শেরউডের দিকে ফিরলো লিটল জন-আনুষ্ঠানিক ভাবে বিদায় নেবে বন্ধু-বান্ধব সবার কাছ থেকে। কিছুদূর হেঁটেই সব রাগ পানি হয়ে গেল রবিনের, অনুশোচনায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হেঁটে চললো সে, রাগের মাথায় এমন একটা কাজ করে বসা যে মোটেই উচিত হয়নি, বুঝতে পারছে এখন পরিষ্কার। এমন বিশ্বস্ত অনুচর সারা দুনিয়া খুঁজেও কি সে পাবে দ্বিতীয় আরেকজন? মনে মনে ঠিক করলো সেইন্ট মেরির বেদিমূলে প্রার্থনা করবে সে, যেন আবার ভাব হয়ে যায় ওর লিটল জনের সাথে।

গেট দিয়ে ঢুকতে কোন অসুবিধেই হলো না। সাধারণ কৃষকের পোশাক পরা রবিনের দিকে একবারের বেশি দু’বার চাইলো না তোরণ রক্ষীদের কেউ। সোজা হেঁটে গিয়ে গির্জায় ঢুকলো রবিন। পুরোহিত এসে দাঁড়িয়েছেন মঞ্চে, এখুনি শুরু হবে প্রার্থনা, হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লো সে একটা মোটা থামের পাশে।

পুরোহিতের বাণী পাঠ চলছে, মন দিয়ে শুনছে রবিন, আগ্রহের আতিশয্যে মাথার টুপিটা একটু পিছনে সরে গেছে। হঠাৎ কালো পোশাক পরা দীর্ঘকায় এক সাধুর নজর পড়লো ওর মুখের ওপর। ভিতর ভিতর চমকে উঠলো সাধু। আরে! এই লোক সেই দস্যু রবিন হুড না?

বার কয়েক চোখ বুলিয়ে নিশ্চিত হয়ে গেল সাধু। রাগ আর ঘৃণার চিহ্ন ফুটে উঠলো তার চোখের দৃষ্টিতে। কাউকে কিচ্ছু না বলে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল সে গির্জা থেকে।

এসব কিছুই টের পেল না রবিন, বুঝতে পারলো না কতবড় বিপদ ঘনিয়ে আসছে ওর মাথার ওপর। কালো পোশাক পরা সাধুটি আর কেউ নয়, এমেট মঠের সেই কোষাধ্যক্ষ- যার বিশ ক্রাউন কয়েকশো পাউণ্ডে রূপান্তরিত হয়েছিল ঈশ্বরের ইচ্ছেয়।

প্রথমেই ছুটে গিয়ে নগর-তোরণের রক্ষীদেরকে নির্দেশ দিল সে গেট আটকে দেয়ার। শাসালো, যদি পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত একজন লোকও এই গেট দিয়ে ঢোকে কিংবা বেরোয়, তাহলে সরাসরি জবাবদিহি করতে হবে তাদের শেরিফের কাছে। সাধুর ক্ষমতা সম্পর্কে জানা আছে রক্ষীদের, দ্বিরুক্তি না করে ঘটাং-ঘট বন্ধ করে দিল গেট।

এবার ছুটলো সাধু সোজা শেরিফের বাসার দিকে। খবর দেয়ার ধার না ধেরে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো সে হলঘরে। একটা চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছিলেন ওখানে শেরিফ।

‘উঠুন, স্যার শেরিফ। জলদি উঠে পড়ুন! সাংঘাতিক খবর নিয়ে এসেছি আমি! লোকজন ডাকুন, ওকে ধরতে হলে এক্ষুণি চলুন আমার সাথে গির্জায়।’

‘হয়েছেটা কি? অত হড়বড় করছেন কেন? একটু বিরক্তই হয়েছেন শেরিফ এভাবে আচমকা তন্দ্রাভঙ্গ হওয়ায়। আবার মুরগী চুরি গেছে মঠ থেকে?’

‘মুরগী না!’ উত্তেজনার বশে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো সাধু, রবিন! রবিন হুড!’

নামটা কানে যেতেই তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন শেরিফ। ‘অ্যাঁ! রবিন হুড! নটিংহামে?’

‘তবে আর কি বলছি!’ অস্থির হয়ে উঠলো সাধু। ‘এক্ষুণি দেখে এসেছি আমি ওকে গির্জায়। যদি লোকজন নিয়ে আমার সাথে…

‘রবিন হুড? গির্জায়? চিনতে ভুল হয়নি তো আপনার?’

‘অযথা সময় নষ্ট করছেন আপনি, স্যার শেরিফ’ রেগে উঠলো সাধু। আমি ভুল করবো ওকে চিনতে? আটশো পাউণ্ড কেড়ে রেখে দিয়ে কি বিপদেই না ফেলেছিল, কি নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছে আমাকে মোহান্তের কাছে সে আপনি বুঝবেন না। ওর চেহারা ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। হাজারটা লোকের মধ্যে থেকে একনজর দেখেই বের করে দেব চিনে।’

ছোট্ট একটা রূপোর বাঁশী মুখে তুলে ফুঁ দিলেন শেরিফ, ছুটে এলো একজন পরিচারক। এক্ষুণি ত্রিশজন জঙ্গল-রক্ষীকে তৈরি হয়ে নিতে বলো, আমিও বেরোচ্ছি, হানা দিতে হবে এক জায়গায়।’ শেরিফকে ত্রস্ত হাতে বর্ম আর শিরস্ত্রাণ পরতে দেখে ছুটে বেরিয়ে গেল পরিচারক। কোমরে তলোয়ার ঝুলিয়ে যখন শেরিফ বাইরে বেরোলেন, দেখলেন সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে রক্ষীরা। সাধুকে নিয়ে ছুটলেন তিনি গির্জার দিকে, পিছনে মার্চ করে চললো জঙ্গল-রক্ষীর দল।

গির্জার ভেতর এই সশস্ত্র অনুপ্রবেশে তুমুল হৈ-চৈ পড়ে গেল। উঁচু গলায় ঘোষণা করলেন শেরিফ, ‘আপনারা ভয় পাবেন না। ভাল মানুষের কোন ক্ষতি হবে না। আপনাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে এক ভয়ানক দস্যু, তাকেই ধরতে এসেছি আমরা।

‘ওই যে! ওই যে!’ চেঁচিয়ে উঠলো সাধু, হাঁটু মুড়ে বসে আছে ছাই-রঙা পোশাক পরা লোকটা। ওই যে রবিন হুড!’

নিজের নাম শুনে তাজ্জব হয়ে গেল রবিন, আকাশ থেকে পড়লো যেন। এদিকে হুলস্থুল শুরু হয়ে গেছে গোটা গির্জা জুড়ে। কেউ সামনে এগিয়ে এসে কাছ থেকে দেখতে চাইছে বিখ্যাত দস্যু রবিন হুডকে, কেউ আতঙ্কিত হয়ে পালাবার চেষ্টা করছে দূরে। দরজার দিকে চেয়ে দেখলো রবিন, বেরোবার পথ আগলে দাঁড়িয়ে গেছে রক্ষীরা।

পরিষ্কার বুঝতে পারলো রবিন, এই গোলমালের মধ্যে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পথ করে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই এখন। ‘ইশশ!’ ভাবলো সে, ‘এখন যদি লিটল জনটা থাকতো পাশে!’ সড়াৎ করে টান দিয়ে বের করে ফেললো সে বিশাল তলোয়ারটা, তারপর সিংহ-বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লো রক্ষীদের ওপর। বিশটা তলোয়ারের বিরুদ্ধে একটা তলোয়ার, কিন্তু রবিনের অসাধারণ নৈপুণ্য আর তড়িৎবেগ কোথায় পাবে ওরা? তাড়াহুড়োয় নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি লেগে যাচ্ছে ওদের, ঠিক যেখানে মারতে চাইছে সেখানে লাগছে না আঘাত; ওদিকে একের পর এক লোককে ঘায়েল করে চলেছে রবিনের ক্ষুরধার তরবারী। লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে; সামনে যাচ্ছে, পিছনে আসছে, আর সাঁই সাঁই চালাচ্ছে তলোয়ার-কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না রবিনকে। বার তিনেক পথ পরিষ্কার করে বেরিয়ে যেতে গিয়েও পারলো না, নতুন একদল এসে পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে।

‘মেরে ফেলো না!’ কাছেই শেরিফের কণ্ঠ শোনা গেল। জখম করতে পারো, কিন্তু একেবারে মেরে ফেলো না ওকে! রাজার আদেশ আছে, জ্যান্ত ধরতে হবে!

শেরিফের গলা চিনতে পেরে ঝট্ করে সেইদিকে ফিরলো রবিন হুড, প্রচণ্ড এক হুঙ্কার ছেড়ে লাফিয়ে গিয়ে হাজির হলো তাঁর সামনে হাতে উদ্যত তলোয়ার। ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন শেরিফ, ঢালটা মাথার ওপর তুললেন আত্মরক্ষার জন্যে। ঝনাৎ করে তলোয়ারের আঘাত এসে লাগলো ঢালের গায়ে, হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল ঢালটা। আঘাতের গতিবেগ থামলো না তাতে, প্রচণ্ড বেগে নেমে এলো শেরিফের মাথার ওপর। শিরস্ত্রাণটার কল্যাণে বেঁচে গেলেন শেরিফ এ যাত্রা, যদিও এই এক আঘাতেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন তিনি মেঝের ওপর। সাধারণ লোহা হলে কেটে ঢুকে যেত রবিনের তলোয়ার, কিন্তু পাকা কারিগরের তৈরি ইস্পাতের শিরস্ত্রাণ প্রচণ্ড আঘাতটা ঠেকিয়ে তো দিলই, দু’টুকরো করে দিল তলোয়ারটা।

ভাঙা তলোয়ারটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একজনের হাতের মোটা লাঠিটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করলো রবিন, কিন্তু পিছন থেকে আর একজন ল্যাঙ মারতেই হুড়মুড় করে পড়ে গেল সে মেঝেতে। সাথে সাথেই দশ-বারোজন রক্ষী ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর ওপর। হাত- পা ছুঁড়ে মুক্ত হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলো রবিন, কিন্তু এত লোকের চাপের নিচ থেকে বেরোতে পারলো না কিছুতেই। পিছমোড়া করে কষে বেঁধে ফেলা হলো ওকে।

উঠে দাঁড়িয়েছেন শেরিফ, টলছেন, মাথাটা ঘুরছে এখনও, কিন্তু হাত-পা বাঁধা রবিনকে দেখে খুশিতে প্রায় নাচতে শুরু করলেন তিনি। এতদিনে এতদিনে পেয়েছেন তিনি দস্যু রবিন হুডকে তাঁর হাতের মুঠোয়।

‘নিয়ে চলো!’ হুকুম দিলেন শেরিফ। দুর্গের সবচেয়ে নিচের দুর্ভেদ্য কুঠরীতে আটকে দাও। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা দ্বিগুণ পাহারার ব্যবস্থা করো।’

দুর্গের নিচে সাত ফুট চওড়া দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটা কারাগার প্রকোষ্ঠে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হলো রবিনকে, লোহার বল্টু এঁটে ঝোলানো হলো বড় বড় তিনটে তালা।

‘এখান থেকে বেরোক দেখি,’ বললেন শেরিফ। বুঝবো বাপের ব্যাটা! আজ পর্যন্ত কেউ এই ঘর থেকে পালাতে পারেনি।

‘কিন্তু…’ শেরিফের কার্যকলাপে সন্তুষ্ট হতে পারছে না কালো পোশাক পরা সাধু। ‘ঝামেলাটা বাধিয়ে রেখে কি লাভ আমি বুঝতে পারছি না কিছুতেই। এক্ষুণি ওকে ফাঁসী দিয়ে দিলেই তো চুকে যায় ল্যাঠা।’

যদি পারতাম, তাহলে আমি এক সেকেণ্ড দেরি করতাম মনে করেছেন? আমার হাতে সে-ক্ষমতা থাকলে ফাঁসীর ঝামেলাতেও যেতাম না, ওইখানে ওই গির্জার মধ্যেই খুন করে ফেলতাম ওকে।’

‘ক্ষমতা নেই?’ জানতে চাইলো কোষাধ্যক্ষ। ‘গোটা নটিংহাম শায়ারে আপনার চেয়ে ক্ষমতা বেশি কার?’

‘রাজার,’ নিচু গলায় বললেন শেরিফ। ‘রাজার আদেশ এসেছে ক’দিন আগে, যদি কখনও ধরা পড়ে রবিন হুড, যেন তাকে শাস্তি দেয়ার আগে তাঁর অনুমতি নেয়া হয়। এই দস্যু সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছেন রাজা রিচার্ড, তিনি নিজ চোখে একবার দেখতে চান একে।’

কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে কিছু ভাবলো কোষাধ্যক্ষ, তারপর বললো, ‘আমিই ওকে তুলে দিয়েছি আপনার হাতে।’

‘ঠিক, ঠিক,’ বললেন শেরিফ।

রাজার কানে ওর বন্দী হবার সংবাদটা পৌছানোর ব্যাপারে আমার দাবিই অগ্রগণ্য হওয়া উচিত।’

‘তা উচিত,’ বললেন শেরিফ। ‘মনে হয় ভাল পুরস্কার মিলবে সংবাদদাতার কপালে।’

‘রাজা যদি কোন পুরস্কার দেন, সেটা আমারই পাওয়া উচিত বলে মনে করেন না?’

‘মনে করি। আপনি পেলে আমার কোন আপত্তি নেই। বরং খুশি হব যদি রাজা আপনাকে কোন বড়সড় মঠের মোহান্ত-টোহান্ত করে দেন। আপনি আজ মস্ত উপকার করেছেন আমার। আপনার সহযোগিতার কথা উল্লেখ করবো আমি আমার চিঠিতে।’

‘ধন্যবাদ!’ খুশি হয়ে উঠলো সাধু। তাহলে কাল ভোরেই রওনা দেব আমি আপনার চিঠি নিয়ে। এখন চলি তাহলে? যাত্রার জন্যে প্রস্তুতি নিতে হবে আমার আবার।’

.

সেই রোববার সারাটা দিন ধরে চরম উত্তেজনা বিরাজ করলো গোটা নটিংহাম শহরে। সবার আলোচ্য বিষয়ঃ রবিন হুড। গ্রেফতারের সময় যারা গির্জায় ছিল তাদের প্রত্যেককে ঘিরে জটলা বাঁধলো শ্রোতার দল, ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ চায় সবাই। রবিনকে আটকে রাখা সম্ভব হবে কি হবে না তাই নিয়ে তুমুল তর্কের ঝড় উঠলো ঘরে ঘরে। কিন্তু এতসব আলোচনা-সমালোচনার একটি শব্দও বোরোতে পারলো না শহরের চার দেয়ালের বাইরে। প্রতিটি গেটের প্রহরা দ্বিগুণ করে দিয়েছেন শেরিফ, কড়া হুকুম দিয়েছেন-রাজার নির্দেশ এসে পৌঁছানোর আগে কেউ শহরের বাইরে যেতে কিংবা ভেতরে আসতে পারবে না। কেউ যদি বাইরে বেরোতে না পারে, রবিন হুডও পারছে না; আর কেউ যদি ভেতরে আসতে না পারে, তার দলবলও আসতে পারছে না উদ্ধারের চেষ্টায়।

এত করেও কিন্তু সংবাদ আটকে রাখতে পারলেন না শেরিফ। মুচি লবের মাধ্যমে ঠিকই খবর পেয়ে গেল শেরউডের সবাই। সন্ধে হতেই রবিন হুডের দু’জন বিশ্বস্ত লোককে সাথে নিয়ে মই বেয়ে বাড়ির ছাতে উঠে সেখান থেকে নগর-প্রাচীরের মাথায় চড়েছে সে। একটা দড়ির সাহায্যে লবকে দেয়ালের বাইরে নামিয়ে দিয়েছে ওরা, নিচে নেমে বাঁধন খুলে দিতেই আবার টেনে তুলে নিয়েছে দড়িটা। সোজা রবিনের আস্তানার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে লব।

লব গিয়ে দেখলো দলের সবার মধ্যে চাপা একটা অস্বস্তির ভাব বিরাজ করছে। কেউ মুখ ফুটে কিছু বলেনি, কিন্তু অমঙ্গল আশঙ্কায় ভেতর ভেতর অস্থির হয়ে রয়েছে প্রত্যেকে। সবাই বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হয়েছে রবিনের। কারণ, কিছু না বলে এভাবে বাইরে কোথাও এতক্ষণ থাকে না রবিন হুড। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে লিটল জনের, অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে সে রবিনকে একা নটিংহামে যেতে দিয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে আসায়।

লবের মুখে সব শুনে একেবারে ভেঙে পড়লো দলের সবাই, ক্ষোভে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়ছে কেউ কেউ, রবিনের যে নির্ঘাৎ ফাঁসী হতে যাচ্ছে সে ব্যাপারে কারও মনে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই-একমাত্র লিটল জন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইলো না যে রবিনের কোন ক্ষতি হতে পারে।

‘শোনো,’ সবাইকে ডেকে বললো সে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে গিয়েছিল রবিন সেইন্ট মেরির গির্জায়। সেই গির্জা থেকে ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে কেউ ফাঁসী দিতে পারবে, এ আমি বিশ্বাস করি না। ঈশ্বর ওকে সাহায্য করবেন। বহুবার মরতে মরতেও বেঁচে ফিরে আসেনি ও আমাদের মধ্যে? দেখে নিয়ো, এবারও আসবে। কাজেই হা- হুতাশ বাদ দিয়ে, এসো, আমাদের কর্তব্য ঠিক করে নেয়া যাক। আমার মনে হয় শহরটার ওপর নজর রাখা এখন বিশেষ ভাবে দরকার, একটা কিছু উপায় খুঁজে বের করতে হবে আমাদের যাতে ভেতরে ঢুকে ওকে মুক্ত করে আনতে পারি।

পরদিন খুব ভোরে নটিংহামের দক্ষিণ-তোরণের কাছেই একটা ঝোপের আড়ালে বসে আছে লিটল জন, সাথে মাচ। লিংকন গ্রীন ছেড়ে দু’জনেই পরেছে পশুপালকের চামড়ার পোশাক। এ পোশাকে কারও কোন সন্দেহের উদ্রেক না করে এই অঞ্চলের যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারবে তারা। সূর্য ওঠেনি এখনও, কিন্তু উঠি উঠি করছে। আরেকটা সুন্দর সূর্যকরোজ্জ্বল দিন আসছে, ঘুম থেকে উঠে মিষ্টি গান জুড়েছে পাখিগুলো, অপূর্ব লাগছে মৃদু বাতাসে পাতার মর্মর-এই মুহূর্তে মাটির নিচের এক অন্ধকার কুঠরিতে বন্দী হয়ে রয়েছে রবিন, ভাবতে গিয়ে খচ্ করে কাঁটা বিধলো লিটল জনের বুকের ভেতর। হঠাৎ লক্ষ্য করলো ওরা, ধীরে ধীরে গেটের পাশের একটা গুপ্ত দরজা খুলে যাচ্ছে। পরমুহূর্তে দেখা গেল তেজি একটা ঘোড়ায় চেপে কালো পোশাক পরা এক সাধু বেরিয়ে এলো বাইরে। তার পিছনেই একটা সাদা ঘোড়ায় রয়েছে অল্পবয়েসী এক পরিচারক। ওরা বেরিয়ে যেতেই বন্ধ হয়ে গেল গুপ্ত দরজাটা। সোজা এগিয়ে আসছে ঘোড়া দু’টো ওরা যে ঝোপটার আড়ালে লুকিয়ে বসে আছে সেদিকেই।

‘ওই কালো সাধুটাকে চিনতে পারছো, মাচ?’ ফিসফিস করে বললো লিটল জন, ‘এ হচ্ছে সেই কোষাধ্যক্ষ, যাকে তুমি, আমি আর উইল স্কারলেট ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম রবিনের কাছে, বিশ ক্রাউনের বেশি আর কিছু নেই বলেছিল, কিন্তু বেরিয়েছিল আটশো পাউণ্ডেরও বেশি। মনে আছে?’

মাথা ঝাঁকালো মাচ, তারপর উঠে পড়লো লিটল জনের ইঙ্গিত পেয়ে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কোনাকুনি হেঁটে রাস্তায় গিয়ে উঠলো দু’জন, তারপর ধীর পায়ে এগোলো নটিংহামের দিকে।

চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর বুলাতে বুলাতে ধীর গতিতে এগোচ্ছে সাধু আর পরিচারক, কোন দিকে বিপদের কোন আভাস দেখলেই তীরবেগে ছুটিয়ে দেবে ঘোড়া। একটা মোড় ঘুরতেই দেখা গেল দু’জন নিরীহ পশুপালক চলেছে শহরের দিকে। এদেরকে ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করলো না সাধু, যেমন চলছিল তেমনি হাঁটার গতিতে এগিয়ে চললো সামনে।

সুপ্রভাত, হোলি ফাদার, মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করলো লিটল জন কালো সাধুকে। ‘নটিংহাম শহর থেকে আসছেন বুঝি?’

‘ঠিকই ধরেছো,’ বললো সাধু গম্ভীর কণ্ঠে।

‘ওখানকার খবর কি, ফাদার? কানাঘুষোয় শুনলাম, সেই জঘন্য চরিত্রের দস্যুটা নাকি ধরা পড়েছে কাল?’

‘কার কথা বলছো তুমি?’

‘দস্যু রবিন হুড।’

‘সর্বনাশ!’ এক হাতে কপাল চাপড়ালো সাধু। খবরের কি পাখা আছে নাকি! কি করে যে গুজব ছড়ায়, আশ্চর্য! যাই হোক, মিথ্যা শোনোনি, সত্যিই কাল সেইন্ট মেরির গির্জা থেকে ধরা পড়েছে ভয়ঙ্কর লোকটা।

‘যাক!’ হাঁফ ছাড়লো লিটল জন। শুনে আনন্দ হচ্ছে। আমাদের দু’জনের কাছ থেকে একবার টাকা কেড়ে নিয়েছিল শয়তানটা। ঠিক হয়েছে এখন, ভাল হয়েছে।’

‘তোমাদের আর কয়টা টাকা, আমার কাছ থেকে আটশো পাউণ্ড কেড়ে নিয়েছিল স্যুটা। তবে উপযুক্ত প্রতিশোধ নিয়েছি আমি কাল। আমিই আবিষ্কার করি ওকে গির্জার মধ্যে, আমিই দৌড়ে গিয়ে খবর দিই শেরিফকে। ওর গ্রেফতারের ব্যাপারে কাউকে যদি ধন্যবাদ দিতে হয়, আমাকে দিতে পারো।’

আপনার প্রাপ্য থেকে যেন ঈশ্বর আপনাকে বঞ্চিত না করেন,’ বললো লিটল জন। কখনও যদি সুযোগ হয়, আমরাও পুরস্কৃত করবো আপনাকে। চলুন, আপনাকে পাহারা দিয়ে কিছুদূর অন্ততঃ এগিয়ে দিয়ে আসি। আশে-পাশের জঙ্গলে লোকজন আছে রবিন হুডের, ধরতে পারলে খুন করে ফেলবে ওরা আপনাকে।’

‘জানি আমি,’ বললো কালো সাধু। ‘সেজন্যে প্রস্তুতও আছি আমরা। বিপদের সামান্য আভাস পেলেই তীর বেগে ছুটে পালাবো।’

‘বিপদের আভাস সব সময় টের পাওয়া যায় না, ফাদার,’ বললো লিটল জন। এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লো গম্ভীর মুখে। ‘বিপদ জিনিসটা চেনা মুশকিল। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই।’

রওনা হয়ে গেল ওরা। নিজের কৃতিত্বে এতই আত্মহারা হয়ে পড়েছে সাধু যে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে চললো নিজের বাহাদুরির কথা। রাজার কাছে যে শেরিফের চঠি বয়ে নিয়ে চলেছে, বললো সেকথাও।

বেশ কিছুদূর এগিয়ে জঙ্গলের একটা অন্ধকার মত জায়গায় এসেই হঠাৎ সাধুর ঘোড়ার রাশটা টেনে ধরলো লিটল জন। মুহূর্তে বুঝে নিল সাধু বিপদ কোথায়, চট্ করে কালো আলখেল্লার ভেতর থেকে একটা ছোরা বের করে বিধিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো লটল জনের বুকে। লাফিয়ে সরে গেল লিটল জন, পোশাকের নিচে লুকিয়ে রাখা তলোয়ারটা বের করলো একটানে, সাঁই করে চালালো সেটা কালো সাধুর গলা লক্ষ্য করে। এক আঘাতেই ঘোড়ার ওপর থেকে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সাধু, বার কয়েক হাত-পা ছুঁড়েই ত্যাগ করলো শেষ নিঃশ্বাস

‘এই হারামজাদাই সমস্ত নষ্টের গোড়া,’ বললো লিটল জন। ‘রাজার কাছে গিয়ে কৃতিত্ব জাহির করার সাধ মিটিয়ে দিয়েছি জন্মের তরে।’

পরিচারক ছোকরাটার ঘোড়ার রাশ ধরে রেখেছিল মাচ, এক হাতে শিঙাটা মুখে ভুলে তাতে ফুঁ দিল তিনটে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চারপাশ থেকে হুড়মুড় করে এসে াজির হলো জনা বিশেক যুবক। কালো সাধুকে কবর দেয়ার নির্দেশ দিল লিটল জন, বললো, মাচ আর ও ফিরে না আসা পর্যন্ত যেন আস্তানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা হয় ছোকরাকে। তারপর সাধুর পকেট থেকে চিঠি বের করে নিয়ে চেপে বসলো সে তার ঘোড়ায়। মার্চ চড়লো পরিচারকের ঘোড়াটায়। ছুটলো ওরা লণ্ডনের উদ্দেশে।

লণ্ডনে পৌঁছে সোজা রাজ প্রাসাদে গিয়ে হাজির হলো ওরা। দ্বার-রক্ষীকে বললো, নটিংহামের শেরিফের জরুরী চিঠি এনেছি মহামান্য রাজা রিচার্ডের কাছে। রাজা ছাড়া মার কারো হাতে দেয়া যাবে না এ চিঠি।

মস্ত এক হলঘরে কারুকার্য খচিত বিশাল এক চেয়ারে বসে আছেন সিংহ হৃদয় রাজা রিচার্ড। আশেপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কয়েকজন লর্ত। লিটল জন আর মাচকে নিয়ে আসা হলো সেখানে। হাঁটু ভাঁজ করে বসে কুর্নিশ করলো লিটল জন রাজাকে, তারপর বাড়িয়ে ধরলো চিঠি।

‘ঈশ্বর মঙ্গল করুন,’ বললো সে। ‘মহামান্য রাজার হৃদয়ে বর্ষিত হোক স্বর্গের শান্তি।’

মৃদু হাসলেন রাজা। চিঠিটা নিয়ে খুলে মন দিলেন পড়ায়। প্রশংসার দৃষ্টিতে চেয়ে য়েছে লিটল জন রাজার মুখের দিকে। দু’চোখ ভরে দেখছে না, যেন গোগ্রাসে গিলছে সে রাজাকে। মুখটা সুদর্শন, উজ্জ্বল নীল চোখ দু’টোতে রাজ্যের দুঃসাহস, এক নজরেই বোঝা যায় মস্ত একটা উদার হৃদয় রয়েছে তাঁর বুকের ভিতর। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখে নিচ্ছে লিটল জন, যাতে নিখুঁত ভাবে বর্ণনা করা যায় শেরউডে ফিরে।

হঠাৎ একটা হাত তুললেন রাজা, জোরে একটা চাপড় দিলেন চেয়ারের হাতলে। বোঝা গেল কোন কারণে খুবই খুশি হয়ে উঠেছেন তিনি। একটু বাদেই চিঠি থেকে মুখ তুলে উপস্থিত সবার দিকে চাইলেন রাজা।

‘সুখবর আছে একটা,’ বললেন তিনি। ‘নটিংহামের শেরিফ খবর দিচ্ছেন, ধরা পড়েছে শেরউডের সেই দুঃসাহসী দস্যু রবিন হুড। তার সম্পর্কে আমার কি ইচ্ছা জানতে চেয়েছেন তিনি।

‘দারুণ খবর, হুজুর! দারুণ খুশির খবর!’ চেঁচিয়ে উঠলেন কাছে দাঁড়ানো হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপ। ‘বহুদিন থেকে সবাইকে জ্বালিয়ে মারছে বদমাশটা। আপনাকে তো বলেছি ওর কুকীর্তির কথা, কি রকম নাজেহাল করেছিল আমাকে। অবশেষে ধরা তাকে পড়তেই হলো। কী যে খুশি লাগছে, হুজুর! এক্ষুণি আদেশ দিয়ে দিন ওকে ফাঁসীতে লটকে দেবার।’

মৃদু হাসলেন রাজা। আবার মনোনিবেশ করলেন চিঠিতে। বিশপের উল্লসিত পরামর্শ যেন শুনতেই পাননি তিনি। আর একবার চিঠিটা পড়ে নিয়ে বললেন, ‘অনেকদিন থেকেই শখ ছিল আমার একে দেখার। আমি দেখতে চাই কেমন মানুষ সে। আমি শাসন করছি গোটা দেশ, কিন্তু ওর এলাকায় ও-ই সর্বেসর্বা। ওর শাসন মেনে নিচ্ছে মানুষ খুশি মনে। আমি জানতে চাই, কেন? কি আছে রবিন হুডের মধ্যে যে রাজার সম্মান দেয়া হচ্ছে ওকে শেরউডের জঙ্গলে?’

কেউ কোন কথা বললো না। কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে হঠাৎ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাইলেন রাজা লিটল জনের চোখের দিকে। ‘চিঠিতে দেখছি এমেট মঠের কোষাধ্যক্ষ বয়ে নিয়ে আসছে এটা। কোথায় গেল সে? তার বদলে তোমরা কেন?’

উত্তরটা আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিল লিটল জন। বললো, ‘ইয়োর ম্যাজেস্টি, সেই সাধু মারা গেছেন পথে; চিঠি পৌঁছানোর দায়িত্ব পড়েছে আমার কাঁধে।

মাথা ঝাঁকালেন রাজা। এ নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামালেন না। যেভাবেই পৌঁছে থাক, পৌঁছেছে চিঠি। বললেন, ‘রবিন হুডকে দেখতে চাই আমি। তোমরা দু’জন যখন সংবাদ নিয়ে আসতে পেরেছো, আমার বিশ্বাস, ওকেও এনে হাজির করতে পারবে। তোমাদের ওপরই দায়িত্ব দিচ্ছি আমি; আমার নির্দেশ গিয়ে জানাবে নটিংহামের শেরিফকে; বলবে, ওকে পাহারা দেবার জন্যে যেন চল্লিশজন তীরন্দাজ দেয় তোমাদের সাথে। আমার এই সীলটা রাখো, দেখাবে শেরিফকে।

রাজার সীল হাতে নিয়ে উপযুক্ত সম্মানের সাথে চুমো খেল তাতে লিটল জন, ঢুকিয়ে রাখলো বুক পকেটে। ওদের প্রত্যেককে বিশ পাউণ্ড করে বখশিশ দিলেন রাজা। বিদায় নিয়ে রওনা হয়ে গেল ওরা নটিংহামের উদ্দেশে।

কোথাও বেশিক্ষণ বিশ্রাম না নিয়ে প্রায় একটানা ঘোড়া চালিয়ে এসে পৌঁছলো ওরা নটিংহাম শহরের গেটের সামনে। যেমন ছিল তেমনি বন্ধ রয়েছে গেট, তালা মারা। দমাদম দরজা পিটালো লিটল জন, হাঁক-ডাক ছাড়লো তোরণ-রক্ষী-প্রধানের উদ্দেশে। দেয়ালের ওপর থেকে মাথা বের করে নিচের দিকে চাইলো রক্ষী-প্রধান, জানতে চাইলো কি চায় ওরা।

‘ব্যাপারটা কি!’ তাজ্জব হয়ে যাওয়ার ভান করলো জন। ‘দিন দুপুরে গেটে তালা দিয়ে ঘুমাচ্ছো নাকি তোমরা?’

‘না,’ জবাব দিল তোরণ-রক্ষীদের প্রধান। ‘রবিন হুডকে আটকে রাখা হয়েছে দুর্গ- কারাগারে। দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টার জন্যে আটকে দিয়েছি আমরা গেট, যাতে ওর লোকজন ঢুকে পড়ে কোন গোলমাল না করতে পারে। চারদিক থেকে শহরটাকে ঘিরে রেখেছে ওরা, দেয়ালের ওপর আমাদের কাউকে দেখলেই তীর মারছে।’ একটু থেমে জানতে চাইলো সে, ‘তোমরা কারা?’

‘আমরা লণ্ডন থেকে এসেছি। রাজার তরফ থেকে বাণী নিয়ে এসেছি নটিংহামের শেরিফের কাছে।’

এই কথা শুনে গেটটা সামান্য ফাঁক করে ওদের দু’জনকে ভেতরে ঢোকার পথ করে দেয়া হলো, ওরা ঢুকে পড়তেই আবার তালা মেরে দেয়া হলো দরজায়। গেটে কড়া পাহারার নমুনা দেখে ছোট্ট করে শিস দিল লিটল জন। বললো, ‘এক্ষুণি শেরিফের সাথে দেখা করতে চাই আমি। কোনদিকে তার বাড়িটা…একজন লোক দিতে পারবে আমাদের সাথে?’

লোক দিল রক্ষী-প্রধান। সোজা গিয়ে দেখা করলো ওরা শেরিফের সাথে। রাজার সীলটা দেখাতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন শেরিফ, মাথা থেকে হুড সরিয়ে কুর্ণিশ করলেন সীলটাকে-যেন রাজা স্বয়ং এসে দাঁড়িয়েছেন সামনে।

‘মহামান্য রাজা রিচার্ডের কাছ থেকে কি নির্দেশ বয়ে এনেছেন আপনারা?’ জানতে চাইলেন শেরিফ।

গড় গড় করে বলে গেল লিটল জন। মাথা ঝুঁকিয়ে জানালেন শেরিফ, তাঁর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে। তারপর একটু ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘লণ্ডনে নিয়ে যাওয়ার পর কি ঘটবে দস্যুটার কপালে, কিছু শুনেছেন কারও মুখে?’

‘শুনেছি, কিছু বাছা বাছা কথা শোনাবেন রাজা বদমাশটাকে, তারপর ওকে ঝুলিয়ে দেয়া হবে ফাঁসী কাঠে।

‘বেশ, বেশ!’ খুশি হয়ে উঠলেন শেরিফ। ‘আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম, রাজা আবার ওকে ক্ষমা-টমা করে দেন না কি! কিন্তু এমেটের সেই সাধু কোথায় গেলেন, রাজার অনুগ্রহ পাবার আশায় নিজেই যেচে পড়ে সংবাদ বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি… পুরস্কার কিছু মিলেছে?’

‘হ্যাঁ, মিলেছে,’ বললো লিটল জন। ‘এতই ভাল পুরস্কার যে এমেট মঠে আর ফিরতে হবে না তাঁকে কোন দিনই। যথাযোগ্য পুরস্কারই মিলেছে তাঁর।’

‘টাকা, না জমি?’

‘জমি। যতটা দরকার, ঠিক ততটাই,’ বললো লিটল জন। ‘কিন্তু, মাননীয় শেরিফ, অনেক পথ চলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমরা; একটা সরাইখানা খুঁজে নিয়ে বিশ্রাম করবো আমরা এখন। কাল আবার সকাল-সকাল রওনা হতে হবে তো, একটু জিরিয়ে না নিলে….’

‘আরে না, না!’ চেঁচিয়ে উঠলেন শেরিফ, ‘কি যে বলেন! সরাইখানায় যাবেন কেন? আপনারা আমার সম্মানিত অতিথি। বিরাট এক ভোজের আয়োজন করছি আমি আপনাদের সম্মানে, যেন রাজা জানতে পারেন, উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছি আমরা তাঁর দূতদের।’

সত্যিই, খুবই জাঁকজমকের সাথে মস্ত এক ভোজের আয়োজন করে সম্মান দেখালেন শেরিফ রাজার দূতদেরকে। খানাপিনা চললো অনেক রাত পর্যন্ত। আকণ্ঠ মদ খেয়ে প্রায় বেহুঁশ হবার দশা হলো সবার, গ্লাসের পর গ্লাস রাজার ‘স্বাস্থ্য পান’ করতে করতে নিজের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল থাকলো না আর কারো। টলতে টলতে অতিথিদের বিশ্রামের ঘর দেখিয়ে দিলেন শেরিফ।

ঘণ্টাখানেক চুপচাপ অপেক্ষা করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো লিটল জন আর মাচ। টু শব্দ নেই কোথাও, বোঝা যাচ্ছে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। খোলা তলোয়ার হাতে পা টিপে বেরিয়ে এলো ওরা ঘর থেকে। হলঘরের সতরঞ্চির ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে অনেকে, মদের প্রভাবে ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। ওদের কাউকে ডিঙিয়ে, কাউকে পাশ কাটিয়ে শেরিফের ঘরে গিয়ে হাজির হলো ওরা। গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছেন শেরিফও, অতিরিক্ত মদ খাওয়ার ফলে প্রায় অজ্ঞান অবস্থা। তাই তাঁর হাতের আঙুল থেকে আংটিটা খুলে নিতে মোটেই অসুবিধে হলো না লিটল জনের। ব্যাস, এখানকার কাজ শেষ, পা টিপে বেরিয়ে এলো ওরা বাড়ির বাইরে।

নির্জন রাস্তা দিয়ে দ্রুত পায়ে ছায়ার মত হেঁটে সোজা এসে হাজির হলো ও। কারাগারের সামনে। বাইরে কাউকে দেখতে না পেয়ে লোহার গেটের গায়ে তলোয়ারের বাঁট দিয়ে খটাখট আওয়াজ শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতি হাতে গেটের ওপাশে এসে দাঁড়ালো জেলার। জানতে চাইলো কারা ওরা, কি চায় এত রাতে।

‘জেল ভেঙে পালিয়েছে রবিন হুড!’ দোষারোপের ভঙ্গিতে বললো লিটল জন। ‘কেমন জেলার তুমি?’

‘খুবই ভাল জেলার,’ জবাব দিল লোকটা। ‘জ্যান্ত একটা মিছে কথা কোথায় কুড়িয়ে পেলে, হে? এইমাত্র দেখে এলাম আমি, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দিব্যি বসে বসে ঝিমাচ্ছে রবিন হুড।’

‘যাই হোক, নিজের চোখে সেটা দেখে নিশ্চিন্ত হতে চাই আমরা,’ বললে লিটল জন। ‘সত্যিই ও কুঠরিতে আছে কিনা নিজের চোখে দেখবো আমরা।’

‘কে তোমরা?’

‘লণ্ডন থেকে এসেছি আজ আমরা, রাজার দূত,’ উত্তর দিল লিটল জন। শেরিফের আংটিটা বের করে দেখালো। ‘শেরিফের অনুমতি নিয়ে এসেছি আমরা, এই দেখো তার প্ৰমাণ।’

আংটিটা দেখা মাত্র ব্যস্ত সমস্ত ভঙ্গিতে গেট খুলে দিল জেলার। মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে একলাফে ভেতরে ঢুকে গলা টিপে ধরলো লিটল জন জেলারের, যাতে টু শব্দ না বেরোতে পারে গলা দিয়ে। চটপট জেলারের হাত-পা বেঁধে ফেললো মাচ, মুখ বেঁধে ফেললো ভেতরে কাপড় ঠেসে দিয়ে। ওর কোমর থেকে চাবির গোছাটা চলে গেল লিটল জনের হাতে।

‘এখন আমিই জেলার!’ বললো লিটল জন। জেলার হিসেবে তার প্রথম কাজ হলো প্রাক্তন জেলারকে একটা কুঠরিতে পুরে বাইরে থেকে তালা মেরে দেয়া। মাচকে সিঁড়ির মাথায় পাহারায় রেখে বাতি হাতে তর তর করে নেমে গেল সে সিঁড়ি বেয়ে। সবচেয়ে নিচের কুঠরির লোহার দরজায় বিরাট আকারের তিনটে তালা দেখে বুঝলো সে, এরই মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে রবিন হুডকে।

একের পর এক চাবি লাগিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করছে লিটল জন। সপ্তম, অষ্টম ও নবম চাবিতে খুলে গেল পর পর তিনটে তালা। ভারি বল্টুগুলো খুলে ফেললো সে ঘটাং ঘট, তারপর ঠেলা দিতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ তুলে খুলে গেল লোহার দরজা। একগাদা খড়ের ওপর আধশোয়া হয়ে বসে আছে একজন হাত-পা বাঁধা লোক। বাতির আলোয় পরিষ্কার চিনতে পারলো লিটল জন রবিনকে।

‘ওস্তাদ! আমি এখানে! উঠে পড়ো, পালাতে হবে এক্ষুণি।’

‘লিটল জন!’ চাপা, বিস্মিত কণ্ঠে ডাকলো রবিন। গলাটা চিনতে পেরেছে সে লিটল জনের, কিন্তু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে যেন ভরসা পাচ্ছে না।

‘হ্যাঁ, ওস্তাদ, আমি!’ একটা ছোরা বের করে ত্রস্তহাতে সমস্ত বাঁধন কেটে দিল লিটল জন। তারপর কাপড়ের নিচে লুকিয়ে আনা আরেকটা তলোয়ার বের করে গুঁজে দিল রবিনের হাতে। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো রবিন হুড, হাতে তলোয়ার পেয়ে শারীরিক-মানসিক সমস্ত শক্তি ফিরে পেল সে এক মুহূর্তে।

ঠিক এমনি সময়ে ওপর থেকে মাচের চিৎকার ভেসে এলো। একলাফে কুঠরি থেকে বেরিয়েই এক-এক লাফে তিন ধাপ করে ডিঙিয়ে ছুটলো ওরা উপর দিকে। পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেই দেখতে পেল ওরা উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে পাঁচজন গার্ড কোণঠাসা করে ফেলেছে মাচকে। প্রচণ্ড এক হুঙ্কার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো লিটল জন ওদের উপর। রবিনও ছুটে গেল তলোয়ার হাতে। যে কামরা থেকে বেরিয়ে এসেছিল গার্ডরা, সেই কামরায় ওদের ফেরত পাঠাতে বেশিক্ষণ লাগলো না ওদের তিনজনের। মুখ বাঁধাবাঁধির সময় নেই এখন, কাজেই বাইরে থেকে দরজাটায় তালা লাগিয়ে দিয়েই হাঁক ছাড়লো লিটল জন, ‘জলদি! জলদি কেটে পড়তে হবে এখন! লোকজন জেগে উঠবে এখনই গার্ডদের চিৎকার শুনে। দৌড় লাগাও!’

দৌড়ে বেরিয়ে এলো ওরা কারাগারের খোলা গেট দিয়ে। ওদিকে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে গার্ডরা।

‘পশ্চিম তোরণের দিকে চলো!’ বললো রবিন। ওদিকে গার্ডের সংখ্যা কম হবে।’

‘চলো ওদিকেই,’ বললো লিটল জন। ‘কিন্তু গার্ড কোনও দিকেই কম নেই। প্রত্যেক গেটেই দ্বিগুণ পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রীতিমত যুদ্ধ করে বেরোতে হবে আমাদের।’ কিছুদূর দৌড়েই হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো তিনজন একসাথে। ঢং ঢং করে বেজে উঠেছে কারাগারের পাগলা ঘন্টি। বীভৎস আকার ধারণ করলো লিটল জনের মুখ। বললো, ‘ওই হারামজাদা গার্ডগুলোর কাজ! গোটা শহরের প্রত্যেককে কাজে লাগাবে ওরা এবার আমাদের বিরুদ্ধে। এক্ষুণি হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসবে ঘর থেকে সব লোক। জলদি! এসো আমার সাথে!’ বলেই একটা অন্ধকার গলি ধরে ছুট লাগালো সে। কিছুদূর গিয়ে অন্ধকার এত গাঢ় হয়ে উঠলো যে একে অন্যের হাত ধরে চলতে হলো ওদের। ডাইনে বাঁয়ে ঘুরে আরও সংকীর্ণ গলিতে চলে এলো লিটল জন। বড় রাস্তা থেকে যথেষ্ট নিরাপদ দূরত্বে সরে এসে একটা দেয়ালের পাশে চালার নিচে দাঁড়ালো ওরা।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা, ঢং ঢং পাগলা ঘণ্টি বেজে চলেছে এখনও, গোটা শহর জেগে উঠেছে, শোরগোল বাড়ছে ক্রমে, ব্যাপার কি জানার জন্যে আলো হাতে বেরিয়ে পড়ছে মানুষ রাস্তায়।

রাস্তার লোকজন আর একটু বাড়ুক,’ বললো লিটল জন। ‘তারপর আমরাও মিশে যাবো ভিড়ের মধ্যে।’

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না ওদের। পাগলের মত ছুটোছুটি করছে লোকজন খবরের জন্যে। আধঘন্টা অপেক্ষা করে আলগোছে লোকজনের মিছিলে জুটে গেল ওরা তিনজন। লিটল জনের পিছন পিছন হাঁটছে মাচ আর রবিন হুড। কিছুক্ষণ হাঁটার পরই টের পেল ওরা কোথায় নিয়ে চলেছে ওদের লিটল জন। এ-রাস্তা ও রাস্তা ঘুরে কারও সন্দেহের উদ্রেক না করে ক্রমে মুচি লবের দোকানের দিকে নিয়ে চলেছে সে ওদের। গলির মুখে দাঁড়িয়ে শুনলো ওরা একজন উঁচু গলায় হাঁক ছেড়ে আরেকজনের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, ‘পালিয়েছে রবিন হুড। জেল ভেঙে পালিয়েছে ঠিকই, কিন্তু গেট ডিঙাতে পারবে না; রাতটা এই শহরেই কাটাতে হবে ওকে। কাল ভোরে বাড়ি বাড়ি সার্চ করে খুঁজে বের করা হবে ওকে।

‘তাহলে তো সকালের আগেই নটিংহাম ছেড়ে বেরোতে হয়, বললো লিটল জন। লম্বা পা ফেলে আবার এগোলো সে। লবের দোকানের পিছনে ছোট্ট কুঠরিটার জানালায় কয়েকটা মৃদু টোকা দিতেই ভিতর থেকে লবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিল লিটল জন। ‘লব, বাসায় তুমি একা?’

‘আরে! লিটল জন নাকি?’ ফিস ফিস করে জানতে চাইলো লব। ‘এত রাতে তুমি কোত্থেকে? এসো, এসো, একাই আছি।’

দরজা খুলে দিতেই অন্ধকার ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো তিনজন। বাতি জ্বেলে রবিন হুডকে তার ঘরে দেখে তাজ্জব হয়ে গেল লব; কিন্তু যতটা না অবাক হলো তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হলো সে ওকে মুক্ত দেখে।

কিভাবে কি ঘটেছে শুনে নিয়ো তুমি কাল লোকের মুখে,’ বললো লিটল জন। এক্ষুণি আমাদের পার করার ব্যবস্থা করো, লব। তুমি যেভাবে আমাদের খবর দিতে গিয়েছিলে, সেই একই কৌশলে পালাতে চাই আমরা শহর ছেড়ে। জলদি!

‘বেশ তো,’ বললো লব। মইয়ের মাথায় তৈরি আছে দড়ি। চলো, হাতে চলো।’

মই বেয়ে লবের বাড়ির ছাতে, তারপর সেখান থেকে প্রাচীরের ওপর উঠে পড়লো ওরা। কোমরে দড়ি বেঁধে প্রথমে নামানো হলো রবিনকে, তারপর নামলো মাচ; লবের পক্ষে ওর ওজন সামলানো সম্ভব নয় বলে দড়ির ধার ধারলো না লিটল জন, দুই হাতে প্রাচীরের প্রান্ত ধরে ঝুলে পড়লো প্রথমে, তারপর লাফ দিয়ে নেমে পড়লো নিচে। দ্রুত হাতে রশি গুটিয়ে নিল লব, দ্রুত পায়ে রওনা হয়ে গেল ওরা তিনজন শেরউডের উদ্দেশে। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই তখন।

এদিকে সকালের অপেক্ষায় অস্থির পদে পায়চারি করছেন শেরিফ। পাগলা ঘন্টি শুনে নেশা ছুটে গেছে তাঁর। জেল ভেঙে রবিন হুডের পালাবার খবর শুনে প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়লেন তিনি, তারপর সব দিকের গেটে পাহারার ব্যবস্থা আরো দ্বিগুণ জোরদার করে দিলেন। এতে রাগ কিছুটা প্রশমিত হলো বটে, কিন্তু সেই জায়গা দখল করলো আশঙ্কা বাড়ি বাড়ি সার্চ করেও যদি ওকে পাওয়া না যায়! কিভাবে মুখ দেখাবেন তিনি রাজার কাছে? রাজা যে রকম রাগী মানুষ, তাঁকেই না আবার লটকে দেয় ফাঁসীতে! পুবাকাশ কিছুটা ফর্সা হয়ে আসতেই শুরু হলো ঘরে ঘরে তল্লাশির কাজ, নিজে ছুটোছুটি করে তদারক করলেন শেরিফ প্রত্যেকটি দলের কাজ। কিন্তু হায়! কোথায় রবিন হুড! গোটা শহর তোলপাড় করে প্রত্যেকটি বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট-গুদাম তন্ন তন্ন করে খানাতল্লাশি করেও পাওয়া গেল না রবিন হুডকে।

কি করে পাওয়া যাবে, সে তখন পৌঁছে গেছে শেরউডে। নেতাকে এতবড় বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে ফিরে আসতে দেখে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে তাকে প্রিয় অনুচরেরা, মুহুর্মুহু হর্ষধ্বনি দিচ্ছে ধনুক উঁচিয়ে। দু’হাতে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল রবিন লিটল জন আর মার্চের গালে।

‘ওস্তাদ,’ বললো লিটল জন, ‘আমার কর্তব্য আমি করেছি। কারাগারে বন্দী থেকে তুমি কষ্ট পাবে, সেটা কিছুতেই সহ্য হচ্ছিল না, তাই ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি তোমাকে এই গ্রীনউডের নিচে। এখন তুমি নিরাপদ। আমারও কাজ শেষ। এবার তাহলে বিদায় দাও। তোমরা সুখে শান্তিতে থাকো, ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন… আমি চললাম।’

লিটল জন সত্যিই চলে যাচ্ছে দেখে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো রবিন হুড। ছুটে এসে ওর হাত ধরলো। আমাকে ছেড়ে চলে যেয়ো না, জন! সেদিন ভারি অন্যায় করেছিলাম আমি, তার জন্যে মনে মনে কষ্টও পেয়েছি অনেক। তোমাকে দুঃখ দিয়েছি, আমাকে মাফ করে দাও, জন। আসলে নেতা হওয়ার যোগ্যতা আমার একটুও নেই। আজ থেকে তুমিই আমাদের নেতা, আমরা সবাই কাজ করবো তোমার নির্দেশ মত।’

রবিনকে কাঁদতে দেখে পানি এসে গেল লিটল জনের চোখেও, দূর হয়ে গেল সমস্ত অভিমান। প্রবল বেগে মাথা নাড়লো সে, তা হয় না, ওস্তাদ। তুমিই আমাদের নেতা। তোমার আদেশ তো আর অমান্য করতে পারি না, ঠিক আছে, থাকবো আমি, যাব না। তাছাড়া, ওস্তাদের হাতে দুয়েকটা চড় খেলে কি হয়! এটা তো অনেকটা আশীর্বাদের মত! কেঁদো না, তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না আমি।’

দুই বন্ধু জড়িয়ে ধরলো পরস্পরকে।

ভুঁড়ি দুলিয়ে এগিয়ে এলেন সন্ন্যাসী টাক। ‘বাহ্, এই পুনর্মিলন উৎসব উপলক্ষে বড়সড় একটা ভোজের আয়োজন করে ফেললে কিন্তু মন্দ হয় না। কি বলো তোমরা?’

ঠিক আছে,’ বললো রবিন। আপনি আয়োজন করুন, দুটো হরিণ মেরে নিয়ে আসছি আমি আর লিটল জন।

মহা ধুমধামের সাথে ভূরিভোজ হলো সেদিন শেরউডে।

খবর চাপা থাকে না, শেরিফের কানে গিয়ে পৌঁছলো সংবাদঃ মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে রবিন হুড শেরউড জঙ্গলে। উদ্বিগ্ন হৃদয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে সমস্ত ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে চিঠি লিখলেন তিনি রাজার কাছে। বার বার ক্ষমা প্রার্থনা তো করলেনই, শেষের দিকে উল্লেখ করতে ভুললেন না যে লিটল জনের হাতে রাজার ব্যক্তিগত সীল দেখেই আস্থা স্থাপন করেছিলেন তিনি ওদের ওপর।

চিঠি পড়ে ভয়ানক রেগে গেলেন রাজা রিচার্ড। জ্বলে উঠলো তাঁর নীল চোখ দুটো, লাল হয়ে উঠলো সুদর্শন মুখটা। কল্পনাও করতে পারেননি তিনি এভাবে তাঁকে ঠকাবার স্পর্ধা থাকতে পারে কারো। গুম হয়ে থাকলেন তিনি বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু রাগ বেশিক্ষণ থাকে না সিংহহৃদয় রিচার্ডের। অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা দেখতে পেলেন তিনি, এবং দেখে মুগ্ধ হলেন।

‘একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন?’ পারিষদবর্গের উদ্দেশ্যে বললেন তিনি, ‘ভেবে দেখেছেন, লোকটা তার প্রভুর প্রতি কী আশ্চর্য রকম একনিষ্ঠ? টের পাচ্ছেন, কী রকম ভালবাসে ওরা রবিন হুডকে? আহা, অমন বিশ্বাসী অনুচর যদি আমি পেতাম! রাজাকে কলা দেখাতেও দ্বিধা করলো না লোকটা প্রিয় নেতাকে উদ্ধার করতে গিয়ে। নাহ, সত্যিই, এই রবিন হুড লোকটার সাথে যেমন করে হোক দেখা করতেই হবে আমার। আমি জানতে চাই, কী আছে ওর মধ্যে, যে-জন্যে এমন ভালবাসা, ভক্তি আর আনুগত্য পায় সে মানুষের কাছ থেকে।’ মুচকি হাসলেন রাজা যখন মনে পড়লো তাঁর উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দিয়ে নিজেদের নেতাকে কারাগার থেকে মুক্ত করাই যাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তাদেরই খুশি হয়ে বিশ পাউণ্ড করে পুরস্কার দিয়েছিলেন তিনি।

কালো সাধুর সঙ্গের সেই পরিচারকটির কাছে জঙ্গল-জীবন এতই ভাল লেগে গেল যে নটিংহামে আর ফিরতে চাইলো না কিছুতেই, রয়ে গেল সে দস্যুদলের সাথে, ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো স্বাধীনচেতা, সত্যিকার মানুষ হিসেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *