১৮. প্লাতনের চিন্তায় জ্ঞান ও অনুভূতি
পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান অনুভূতিনির্ভর কিংবা অনুভূতি থেকে আহরিত-অধিকাংশ আধুনিক মানুষই বিনা বিচারে মেনে নেন এই ধারণা। কিন্তু প্লাতনের দর্শনে এবং অন্য কিছু দার্শনিক সম্প্রদায়ের দর্শনে রয়েছে একেবারে পৃথক মতবাদ, মতবাদ এতদূর পর্যন্ত বলছে যে, ইন্দ্রিয়আহরিত জ্ঞান- জ্ঞান নামের যোগ্য নয় এবং সেই একমাত্র সত্য জ্ঞান যা কল্পনের সঙ্গে জড়িত। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ২+২=৪ অকৃত্রিম জ্ঞান কিন্তু তুষার শুভ্র- এই ধরনের বক্তব্য দ্ব্যর্থতা এবং অনিশ্চয়তায় এতদূর পরিপূর্ণ যে, দার্শনিকের সত্যের ভাণ্ডারে এর কোনো স্থান খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এই দৃষ্টিভঙ্গির উৎস বোধহয় পার্মেনিদেস কিন্তু এর স্পষ্ট রূপের জন্য দার্শনিক জগৎ প্লাতনের কাছে ঋণী। আমার প্রস্তাব, এই অধ্যায়ে জ্ঞান এবং অনুভূতি অভিন্ন এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে প্লাতনের করা সমালোচনা নিয়ে আলোচনা করব। থিয়েতেতস (Theatetus)-এর রচনার প্রথম অর্ধাংশ এই সমালোচনা রয়েছে।
এই কথোপকথনের বিষয়বস্তু হলো জ্ঞান-এর একটি সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করা কিন্তু শেষ হয়েছে কোনো সংজ্ঞায় উপনীত না হয়ে একটি নঞর্থক সিদ্ধান্তে এসে। অনেকগুলো সংজ্ঞা প্রস্তাব করা হয়েছে এবং পরিত্যাগ করা হয়েছে কিন্তু সন্তোষজনক মনে করা যেতে পারে এমন কোনো সংজ্ঞা প্রস্তাবিত হয়নি।
প্রস্তাবিত সংজ্ঞাগুলোর প্রথমটি এবং একমাত্র যে সংজ্ঞাটি নিয়ে আমি আলোচনা করব তাকে থিয়েতেতস এই ভাষায় উপস্থিত করেছেন
আমার মনে হয়, যিনি কিছু জানেন, তিনি তাঁর জ্ঞাত বিষয় অনুভব করছেন এবং বর্তমানে আমি যা বুঝি, জ্ঞান অনুভূতি ছাড়া কিছুই নয়।
সক্রাতেস এই মতবাদকে প্রতাগরস-এর মতবাদের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করছেন, যে মানুষই সমস্ত বস্তুর মাপন অর্থাৎ যে কোনো বস্তু, আমার কাছে যা প্রতিভাত আমার কাছে সেটা তাই এবং তোমার কাছে যা প্রতিভাত হচ্ছে তোমার কাছে সেটা তাই। সাতেস যোগ করেন, অনুভূতি তাহলে সবসময়ই যা অস্তিত্বশীল তাই এবং জ্ঞান হিসেবে এটি নির্ভুল।
এর পরবর্তী যুক্তিগুলোর বৃহৎ অংশ বিচার করেছে অনুভূতির চরিত্রায়ণ নিয়ে; এটা সম্পূর্ণ হলে অনুভূতির মতো জিনিস যে জ্ঞান হতেই পারে না-এ তথ্য প্রমাণ করতে আর দেরি হয় না।
প্রতাগরসের এই মতবাদের সঙ্গে সাতেস যুক্ত করলেন হেরাক্লিসের মতবাদ অর্থাৎ সমস্ত পদার্থই সর্বদা পরিবর্তনশীল। এর অর্থ হলো-যে সমস্ত পদার্থকে আমরা বলি আছে, সেই সমস্ত পদার্থই আসলে ঘটমান অবস্থায় রয়েছে। প্লাতনের বিশ্বাস এই তথ্য সত্য শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়নুভূত বস্তুগুলো সম্পর্কে কিন্তু সত্যকারের জ্ঞানের বস্তুগুলো সম্পর্কে নয়। যাই হোক, সম্পূর্ণ কথোপকথনে তাঁর সদর্থক মতবাদ আড়ালেই রয়ে গেছে।
হেরাক্লিতসের মতবাদ, এমনকি যদি শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়ানুভূত বস্তুগুলো সম্পর্কে প্রযোজ্য হয়, আর তার সঙ্গে যদি অনুভূতিকে যুক্ত করা হয়, জ্ঞানের সংজ্ঞা রূপে, তাহলে দাঁড়ায় যা ঘটমান তাই জ্ঞান, যা বর্তমান সেটা জ্ঞান নয়।
এখানে খুব প্রাথমিক চরিত্রের কয়েকটি ধাঁধা রয়েছে। বলা হয়েছে যে, ৬ যেহেতু ৪-এর চাইতে বড় কিন্তু ১২-র চাইতে ছোট যেহেতু ৬ বৃহৎও বটে, ক্ষুদ্রও বটে-এটা একটা দ্বন্দ্ব। আবার, সক্রাতেস এখন থিয়েতেতসের চাইতে লম্বা, থিয়েতেতস তরুণ এবং তার বৃদ্ধি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি কিন্তু কয়েক বছরে সক্রাতেস থিয়েতেতস-এর চাইতে ছোট হয়ে যাবেন। সুতরাং সাতেস লম্বাও বটেন, বেঁটেও বটেন। মনে হয় এই আপেক্ষিক প্রস্তাব প্লাতনকে দ্বন্দ্বে ফেলেছিল এবং হেগেল (Hegel) (তাকে অন্তর্ভুক্ত করে) পর্যন্ত সমস্ত বড় বড় দার্শনিককেও। যাই হোক, এই সমস্ত ধাঁধার সঙ্গে মূল। তর্কের সম্পর্ক কম এবং অগ্রাহ্য করা যায়।
এবার অনুভূতি বিষয়ক আলোচনায় ফিরে আসা যাক। মনে করা হয় যে, বস্তু এবং ইন্দ্রিয়বাহী দেহাংশের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার ফল অনুভূতি। হেরাক্লিসের মতবাদ অনুসারে এই দুটি সর্বদা পরিবর্তনশীল এবং পরিবর্তিত হতে গিয়ে অনুভবেরও পরিবর্তন করে। সাতেসের মন্তব্যঃ তিনি সুস্থ থাকলে মদ তাঁর কাছে মিষ্টি মনে হয় কিন্তু অসুস্থ হলে মনে হয় টক। এক্ষেত্রে অনুভবকারীর পবির্তনের ফলে অনুভবেরও পরিবর্তন হচ্ছে।
প্রতাগরসের মতবাদে কিছু আপত্তি উপস্থিত করা হয়েছে, আবার পরবর্তীকালে এই আপত্তিগুলোর কিছু কিছু বাতিলও করা হয়েছে। যুক্তি উপস্থিত করা হয়েছে যে, প্রতাগরসের শূকর এবং বেবুনগুলোকেও একইভাবে বস্তুর মাপন হিসেবে গ্রহণ করা উচিত ছিল, কারণ, তারাও অনুভবকারী। উন্মাদ অবস্থায় এবং স্বপ্নের অবস্থায় যে অনুভূতি হয় তার বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রস্তাব করা হয়েছে যে, প্রতাগরস (Protagoras) যদি সঠিক হন তাহলে কোনো একজন মানুষ অন্যের চাইতে বেশি জানেন না- প্রতাগরস শুধু দেবতাদের মতো জ্ঞানী নন, আরও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হলো তিনি কোনো মূর্খের চাইতে অধিক জ্ঞানী নন। তাছাড়া, যদি একজনের বিচার আর একজনের মতো নির্ভুল হয় তাহলে যারা বিচার করছেন যে, প্রতাগরসের ভুল হয়েছে তাহলে প্রতাগরসের যেমন নিজেকে নির্ভুল ভাবার অধিকার রয়েছে তেমনি বিচারকদেরও অধিকার রয়েছে নিজেদের নির্ভুল ভাবার।
সক্রাতেস সাময়িকভাবে নিজেকে প্রতাগরসের স্থানে স্থাপন করে এই সমস্ত আপত্তির অনেকগুলোর উত্তর খুঁজে বার করার দায়িত্ব নিয়েছেন। স্বপ্নের ব্যাপারে অনুভুতিগুলো সত্য অনুভূতি। শূকর এবং বেবুন সম্পর্কীয় যুক্তি তিনি প্রাকৃতজনোচিত নিন্দাবাদ বলে নাকচ করেছেন। প্রতিটি মানুষই যদি সর্ব বিষয়ের মাপন হয় তাহলে প্রত্যেকে অন্যের মতো জ্ঞানী-এই যুক্তি সম্পর্কে সক্রাতেস প্রতাগরসের সপক্ষে একটি খুব আকর্ষণীয় উত্তর উত্থাপন করেছেন- যদিও একটি বিচার অন্যটির তুলনায় সত্যতর হতে পারে না, তবুও অপরটির চাইতে শ্রেয়তর হতে পারে। এর অর্থ হলো তার ফলাফল হতে পারে তুলনায় ভালো। এখানে আমরা প্রয়োগবাদের (pragmatism) আভাস পাই।
এই উত্তর সাতেসের আবিষ্কার হলেও কিন্তু তিনি নিজে এই উত্তরে সন্তুষ্ট হননি। উদাহরণ, তিনি জোর দিয়ে বলছেন, এক চিকিৎসক যখন আমার অসুস্থতার গতিপ্রকৃতি নিয়ে কথা বলেন তখন তিনি সত্যই আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমার চাইতে বেশি জানেন। আর, রাষ্ট্রের কী আদেশ করা উচিত সে সম্পর্কেও যখন মানুষে মানুষে মতভেদ হয় তখন বোঝা যায় কিছু কিছু লোকের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অন্যদের চাইতে বেশি জ্ঞান আছে। সুতরাং জ্ঞানী মানুষ যে মূখের চাইতে ভালো মাপন-এ সিদ্ধান্ত এড়ানো যায় না।
প্রতিটি মানুষই সর্ব বিষয়ের মাপন- এগুলো সবই এই মতবাদের বিরুদ্ধে আপত্তি এবং জ্ঞান-এর অর্থ অনুভূতি-এই মতবাদের বিরুদ্ধে পরোক্ষ আপত্তি, অবশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত এই মতবাদ অন্য মতবাদের বিরুদ্ধে পরোক্ষ আপত্তি, অবশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত এই মতবাদ অন্য মতবাদটির পথিকৃৎ। যাই হোক, একটি প্রত্যক্ষ যুক্তি রয়েছে, তা হলো অনুভূতির সঙ্গে স্মৃতিকেও মেনে নিতে হবে। এটা স্বীকার করে সেই অনুসারে সংজ্ঞা সংশোধন করা হয়েছে।
তারপর আমরা আসি হেরাক্লিসের মতবাদের সমালোচনায়। এই সমালোচনা প্রথমে চরমে ওঠানো হয়, আমরা শুনেছি এফেসস (Ephesus)-এর বুদ্ধিদীপ্ত তরুণদের মধ্যে তাঁর শিষ্যদের অভ্যাস অনুসারেই এই কাজ করা হয়েছে। একটি বস্তুর পরিবর্তন হতে পারে দুভাবে, গতির ফলে এবং গুণগত পবির্তনের ফলে, তাছাড়া সদা পরিবর্তনশীলতার মতবাদে বলা হয়েছে সমস্ত বস্তুই সর্বদা দুভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। শুধুমাত্র সব বস্তুরই সবসময় কিছু গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে তাই নয়, সব বস্তুরই প্রতিটি গুণের কোনো না কোনো পরিবর্তন হচ্ছে- এফেসসের বুদ্ধিমান লোকেরা এইরকমই চিন্তা করতেন বলে আমরা শুনেছি। এই মতের ফলাফল অদ্ভুত। এটা সাদা-এ কথা আমরা বলতে পারি না, কারণ, আমরা যখন বলতে শুরু করেছি তখন যদি ওটা সাদা থাকত তাহলে আমাদের বাক্য শেষ হওয়ার আগেই ওটা আর সাদা থাকত না। আমরা কোনো জিনিস দেখছি একথা বলা ঠিক নয়, কারণ, দেখাটা অবিচ্ছিন্নভাবে সবসময়ই না দেখায় রূপান্তরিত হয়। সব জিনিসই যদি সবরকমভাবে পরিবর্তনশীল হয় তাহলে দেখাকে দেখা না বলে না-দেখা বলার অধিকার তার নেই, অনুভূতিকে অনুভূতি না বলে অননুভূতি বলারও অধিকার নেই। এবং যখন আমরা বলি অনুভূতি হলো জ্ঞান তখন আমরা স্বচ্ছন্দেই বলতে পারি অনুভূতি জ্ঞান নয়।
উপরোক্ত যুক্তিতর্কের ফল হলো, অন্য যা কিছু সদা পরিবর্তনশীল হোক না কেন, শব্দের অর্থকে অবশ্যই স্থায়ী হতে হবে, অন্তত কিছু সময়ের জন্য। কারণ, তা না হলে কোনো সিদ্ধান্তই নির্দিষ্ট হবে না এবং কোনো সিদ্ধান্ত মিথ্যার চেয়ে সত্য নয়। যদি জ্ঞান এবং শিক্ষাকে সম্ভব করতে হয় কোনো কিছুকে অবশ্যই কমবেশি স্থির হতে হবে। আমি মনে করি, এটা স্বীকার করা উচিত। কিন্তু এই স্বীকারোক্তির সঙ্গে অনেকটা পরিবর্তনশীলতাই সুসঙ্গত।
এই সময় দেখা যায় পার্মেনিদেসকে নিয়ে আলোচনা করতে অস্বীকার করা হচ্ছে এই ভিত্তিতে যে, তিনি অতি বৃহৎ ও মহৎ। তিনি একজন অতি সম্মানিত এবং ভয়ংকর চরিত্র। তাঁর মধ্যে এমন একটা গভীরতা ছিল যেটা সব মিলিয়ে সম্ভ্রান্ত। তিনি এমন একজন ব্যক্তি যাকে আমি সবচাইতে বেশি শ্রদ্ধা করি। এই সমস্ত মন্তব্যে প্লাতন স্থিতিশীল মহাবিশ্বের প্রতি তার ভালোবাসা প্রদর্শন করেছেন এবং দেখিয়েছেন হেরাক্লিতীয় পরিবর্তনশীলতা তাঁর কতটা অপছন্দ, এই পরিবর্তনশীলতা তিনি যুক্তির খাতিরে মেনে নিচ্ছিলেন। কিন্তু এই সম্মান প্রকাশের পরে তিনি হেরাক্লিসের বিকল্পে পার্মেনিদসীয় মতবাদকে বিকশিত করা থেকে বিরত থাকেন।
এবার আমরা পৌঁছাই অনুভূতিকে জ্ঞানরূপে শনাক্ত করার বিরুদ্ধে প্লাতনের অন্তিম যুক্তিতে। তিনি শুরু করেন এই যুক্তি দিয়ে যে, আমরা অনুভব করি চক্ষু ও কর্ণের মাধ্যমে কিন্তু সেগুলোর দ্বারা অনুভব করি না এবং তিনি দেখান আমাদের কিছু জ্ঞান কোনো জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সঙ্গে যুক্ত নয়। উদাহরণ, আমরা জানতে পারি শব্দ এবং রং সদৃশ নয়, যদিও দুটিকেই অনুভব করতে পারে এমন কোনো জ্ঞানেন্দ্রিয় নেই। অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্ব, সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য, ঐক্য এবং পার্থক্য, একত্ব এবং বহুত্ব বোঝার জন্য বিশেষ কোনো ইন্দ্রিয় নেই। একই তথ্য প্রযোজ্য সম্মানীয় এবং অসম্মানীয়, ভালো এবং মন্দ সম্পর্কে। কিছু কিছু বস্তু সম্পর্কে মন চিন্তা করে নিজস্ব কারণতন্ত্রের (instrumentality) সাহায্যে আর অন্য কিছু কিছু সম্পর্কে চিন্তা করে দৈহিক ক্ষমতার সাহায্যে। কঠিন এবং কোমল আমরা অনুভব করি স্পর্শের সাহায্যে কিন্তু তাদের অস্তিত্ব এবং তাদের পারস্পরিক বৈপরীত্য বিচার করে মন। একমাত্র মনই অস্তিত্ব পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে এবং অস্তিত্ব পর্যন্ত না পৌঁছালে আমরা সত্যে উপনীত হতে পারি না। এ থেকে বোঝা যায় শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা কোনো বস্তুকে জানতে পারি না, কারণ, শুধুমাত্র জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাহায্যে বস্তু অস্তিমান একথা বুঝতে পারি না। সুতরাং জ্ঞান নির্ভর করে চিন্তার উপরে, দেহের উপরে যে ছাপ পড়ে তার উপরে নয়। অনুভূতি জ্ঞান নয়, কারণ, সত্য বোঝার ব্যাপারে এর কোনো ভূমিকা নেই, যেহেতু অস্তিত্ব বোঝার ব্যাপারে এর কোনো ভূমিকা নেই।
অনুভূতি এবং জ্ঞানকে অভিন্ন মনে করার বিরুদ্ধে এই যুক্তিগুলোর কতটা গ্রহণযোগ্য এবং কতটা অবশ্যবর্জনীয়-সেই জট ছাড়ানো কোনো ক্রমেই সহজ নয়। প্লাতনের আলোচনায় আছে তিনটি আন্তঃসম্পর্কযুক্ত প্রসঙ্গ, যথা
(১) অনুভূতিই জ্ঞান,
(২) মানুষই সমস্ত বিষয়ের মাপন,
(৩) সমস্ত বস্তুই রয়েছে সদা পরিবর্তনশীল অবস্থায়।
(১) এদেরে মধ্যে প্রথমটি, শুধুমাত্র যার সঙ্গে যুক্তিগুলো প্রধানত জড়িত- সেটা তার নিজের কারণে সামান্যই আলোচিত হয়েছে, অবশ্য আমরা যা নিয়ে এখনই আলোচনা করেছি তার অন্তিম অংশ বাদ দিয়ে। এখানে যুক্তি দেখানো হলো, তুলনা, অস্তিত্বের জ্ঞান এবং সংখ্যার বোধ জ্ঞানের জন্য অবশ্যপ্রয়োজন কিন্তু এগুলোকে অনুভূতির অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। তার কারণ, তারা কোনো জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাহায্যে আহরিত নয়। এগুলো সম্পর্কে বক্তব্যটি পৃথক। সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য নিয়ে আলোচনা করা যাক।
রঙের যে দুটি আভা আমি দেখছি, সমরূপ বা অসমরূপ যা হোক না কেন, আমি যখন দেখছি, সেটা এমন একটি জিনিস যাকে আমি অনুভূতি বলে গ্রহণ করতে পারি, তাকে গ্রহণ করতে পারি অনুভূতি সম্পৰ্কীয় মতামত বলে। আমার বলা উচিত অনুভব জ্ঞান নয়, এটা শুধুমাত্র যা ঘটে এমন এবং এটা সমানভাবে পদার্থবিদ্যার জগৎ ও মনস্তত্ত্ববিদ্যার জগতের একটা অংশ। প্রত্যক্ষ অনুভূতি সম্পর্কে প্লাতনের মতোই আমাদের স্বাভাবিক চিন্তনে এটা হলো বস্তু এবং অনুভবকারীর একটা সম্পর্ক আমরা বলি আমি একটি টেবিল দেখছি। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি এবং টেবিল হলো যৌক্তিক গঠন। স্থূল ঘটনার মর্মবস্তু হলো শুধুমাত্র কয়েকটি রঙের প্রলেপ। এগুলো স্পর্শের কল্পনার সঙ্গে জড়িত, তারা শব্দের কারণ হতে পারে এবং হতে পারে স্মৃতির উৎস।
স্পর্শের কল্পনার সঙ্গে মিশ্রিত অনুভূতিটি বস্তুতে পরিণত হয় এবং তাকে শারীরিক বলে মনে করা হয়। শব্দ এবং স্মৃতি দিয়ে পূর্ণ প্রত্যক্ষ পরিণত হয় অনুভূতি-তে-সেটা বিষয়-এর অংশ এবং তাকে মানসিক বলে বিচার করা হয়। অনুভূতি একটি ঘটনা মাত্র এবং সেটি সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়। শব্দ দিয়ে পূর্ণ অনুভব একটি মতামত, তার সত্য কিংবা মিথ্যা হওয়ার শক্তি আছে। এই মতকে আমি বলি অনুভূতির মত। অনুভূতির জ্ঞান-এই প্রস্তাবটির ব্যাখ্যা হওয়া উচিত অনুভূতির বিচারই জ্ঞান। একমাত্র এইরূপেই এ প্রস্তাব ব্যাকরণসম্মতভাবে সঠিক হওয়ার ক্ষমতা রাখে।
সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যখন দুটি রঙের অনুভূতি যুগপৎ হয়, তাদের সাদৃশ্য কিংবা বৈসাদৃশ্য উপাত্তের একটি অংশ হয়ে ওঠা এবং অনুভূতির বিচারে তাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা খুবই সম্ভবপর। প্লাতনের যুক্তি- সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বোধ করার মতো কোনো জ্ঞানেন্দ্রিয় আমাদের নেই এবং এই যুক্তিতে কর্টেক্স (cortex-মস্তিষ্কের উচ্চতম অংশ)-কে অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং ধরে নেওয়া হয়েছে সমস্ত জ্ঞানেন্দ্রিয়ই বহির্গাত্রে রয়েছে।
সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্যকে অনুভূতির সম্ভাব্য উপাত্তের ভিতরে অন্তর্ভুক্ত করার যুক্তি হলো- অনুমান করা যাক যে, আমরা রঙের দুটি আভা A এবং B–দেখছি এবং আমাদের বিচারে A হলো B-এর মতো। প্লাতনের মতো আরও অনুমান করা যাক, এ বিচার সাধারণত সঠিক এবং বিশেষভাবে আমাদের বিচার্যক্ষেত্রে সঠিক। তাহলে A এবং B এর মধ্যে একটি সাদৃশ্যের সম্পর্ক রয়েছে এবং সেটি শুধুমাত্র আমাদের বিচারের ভিত্তিতে দৃঢ় ঘোষণা নয়। যদি এটি শুধুমাত্র আমাদের বিচার হতো তাহলে যাদৃচ্ছিক, সে বিচার সত্য অথবা মিথ্যা যাচাই করতে অপারগ। যেহেতু ব্যাপারটা স্পষ্টতই সত্য কিংবা মিথ্যা হতে পারে সেজন্য সাদৃশ্য A এবং B-এর মধ্যে থাকতে পারে এবং শুধুমাত্র মানসিক কিছু ব্যাপার হতে পারে না। A হলো B-এর মতো এই বিচার ঘটনার গুণে সত্য (এটা যদি সত্য হয়), ঠিক যেন A লাল কিংবা B গোল এ তথ্যের মতো। রঙের অনুভূতির চাইতে সাদৃশ্যের অনুভূতিতে মন অধিকতর জড়িত নয়।
এখন আসি অস্তিত্ব-তে, প্লাতন যার উপর খুব জোর দিয়েছেন। তিনি বলছেন, শব্দ এবং রং সম্পর্কে আমাদের একটি চিন্তন রয়েছে, যা এই দুটিকে যুগপৎ অন্তর্ভুক্ত করে, সেটা হলো তাদের অস্তিত্ব রয়েছে। অস্তিত্ব সবেরই রয়েছে এবং যেসব বস্তু মন নিজেই বোধ করতে পারে তার মধ্যে এটা একটা। অস্তিত্ব বুঝতে না পারলে সত্য বোঝা অসম্ভব।
এক্ষেত্রে প্লাতনের বিরুদ্ধে যে যুক্তি তার সঙ্গে সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্যের ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে যে যুক্তি তার যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তিটা হলো প্রাতন অস্তিত্ব সম্পর্কে যা বলেছেন তার সবটাই হয় দোষদুষ্ট ব্যাকরণ নয়তো কিছুটা দোষদুষ্ট অন্বয়। এই যুক্তি গুরুত্বপূর্ণ, শুধুমাত্র প্লাতন সম্পর্কে নয়, অন্য ব্যাপারেও এর গুরুত্ব রয়েছে যথা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কেও তত্ত্ববিদ্যাভিত্তিক যুক্তি।
ধরুন, আপনি একটি শিশুকে বলছেন সিংহের অস্তিত্ব রয়েছে কিন্তু একশৃঙ্গীর নেই, আপনি অন্তত সিংহ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য প্রমাণ করতে পারেন শিশুটিকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়ে এবং দেখো, ঐটা সিংহ-এই বলে। আপনি যদি দার্শনিক না হন তাহলে এর সঙ্গে কখনোই যোগ করবেন না যে- দেখতে পাচ্ছ, ওর অস্তিত্ব রয়েছে। দার্শনিক হওয়ার ফলে যদি আপনি এই কথাগুলো যোগ করেন তাহলে আপনার কথাগুলো হবে অর্থহীন। সিংহরা অস্তিমান বলার অর্থ সিংহরা আছে অর্থাৎ x একটি সিংহ কথাটি উপযুক্ত x সম্পর্কে সত্য। কিন্তু একটি উপযুক্ত x সম্পর্কে একথা আমরা বলতে পারি না যে, তার অস্তিত্ব রয়েছে, আমরা এই ক্রিয়াপদ শুধু একটা বিবরণে প্রয়োগ করতে পারি- সে বিবরণ সম্পূর্ণ কিংবা অসম্পূর্ণ হতে পারে। সিংহ কথাটি একটি অসম্পূর্ণ বিবরণ, কারণ, এ কথাটি বহু বস্তু সম্পর্কে প্রযোজ্য, চিড়িয়াখানার বৃহত্তম সিংহটি একটি সম্পূর্ণ কথা কারণ, এ কথার শুধু একটি বস্তু সম্পর্কে প্রযোজ্য।
এখন ধরা যাক, আমি একটা উজ্জ্বল লাল ছাপের দিকে তাকিয়ে আছি। বলতে পারি এটা আমার বর্তমান প্রত্যক্ষ। আমি এও বলতে পারি আমার বর্তমান প্রত্যক্ষ অস্তিমান কিন্তু অবশ্যই বলতে পারি না, এটা অস্তিমান কারণ, অস্তিমান শব্দটি একটি নাম সম্পর্কে প্রয়োগ করলে শুধুমাত্র অর্থপূর্ণ হয় না। এই তথ্য বরং তাৎপর্যপূর্ণ হয় একটি বিবরণ সম্পর্কে। মন বস্তুত্বের যে সমস্ত জিনিস সম্পর্কে তার মধ্যে একটি অস্তিত্ব-এটি তাকে খারিজ করে।
আমি এখন সংখ্যার বোধ নিয়ে আলোচনা করব। এক্ষেত্রে দুটি অত্যন্ত ভিন্ন বস্তু বিবেচনাযোগ্য একদিকে, গণিতশাস্ত্রের প্রতিজ্ঞা এবং অন্যদিকে, গণনার পরীক্ষাভিত্তিক প্রতিজ্ঞা ২+২=৪ হলো প্রথম ধরনের, আমার দশটি আঙুল আছে হলো দ্বিতীয় ধরনের।
পাটিগণিত এবং বিশুদ্ধ গণিত সাধারণভাবে অনুভূতি থেকে আহরিত নয়-এ বিষয়ে আমি প্লাতনের সঙ্গে সহমত। বিশুদ্ধ গণিত অনুলাপ (tautology) নিয়ে গঠিত, যুক্তিটা মানুষ হলো মানুষ এই যুক্তির সমগোত্রীয় তবে সাধারণত অনেক বেশি জটিল। একটি গাণিতিক প্রস্তাব সঠিক কিনা জানতে হলে বিশ্ব নিয়ে গবেষণা করার দরকার নেই, দরকার শুধুমাত্র সঙ্কেতগুলোর অর্থ বোঝ। দেখা যায় সংজ্ঞা বাদ দিলে সঙ্কেতগুলো (এগুলোর উদ্দেশ্য শুধুমাত্র সংক্ষিপ্তকরণ) অথবা, না, সব এবং কিছু কিছু-এই জাতীয় শব্দের সঙ্কেত। এই শব্দগুলো সক্রাতেস শব্দের মতো বাস্তব জগতের কিছু বোঝায় না। একটি গাণিতিক সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করে দুটি গোষ্ঠীর সঙ্কেতের একই অর্থ এবং যতক্ষণ আমরা শুদ্ধ গণিতে নিজেদের আবদ্ধ রাখি যতক্ষণ পর্যন্ত এর অর্থ অবশ্যই এমন হতে হবে যা কোনোরকম অনুভূতি নিরপেক্ষ। সেইজন্য প্লাতন যেমন বলছেন গাণিতিক সত্য অনুভব নিরপেক্ষ কিন্তু এটা একটা অদ্ভুত ধরনের সত্য এবং এই সত্য শুধুমাত্র সঙ্কেত নিয়ে কাজ করে।
আমার দশটি আঙুল আছে এই ধরনের গণনামূলক প্রস্তাব একটা ভিন্ন জাতের এবং স্পষ্টতই, অন্তত আংশিকভাবে অনুভূতিনির্ভর। স্পষ্টতই আঙুল সম্পর্কিত ধারণা অনুভূতি থেকে নিষ্কাশিত কিন্তু দশ সম্পর্কিত ধারণার ব্যাপারটা? এখানে মনে হতে পারে আমরা একটি সত্যিকারের সামান্য অথবা প্লাতনীয় কল্পনে পৌঁছেছি। দশ অনুভূতি থেকে নিষ্কাশিত-এ কথা আমরা বলতে পারি না, কারণ, কোনো প্রত্যক্ষকে যদি কোনো বস্তুর দশ সংখ্যকও বলে ধারণা করা যায় তাহলে অবশ্যই তাকে অন্য বস্তুর দশ সংখ্যক বলা যাবে। ধরা যাক, একটি হাতের সবকটি আঙুলের একসঙ্গে নাম দিলাম আঙুলিক তাহলে আমি বলতে পারি আমার দুটি আঙুলিক আছে এবং এর আগে অনুভূতি বিষয়ক যে তথ্যকে দশ সংখ্যার সাহায্যে বুঝিয়েছিলাম সেই একই তথ্য আমরা আঙুলিক দিয়ে বুঝিয়েছি। সুতরাং এটা লাল এই বাণীর তুলনায় আমার দশটি আঙুল আছে এই বাণীতে অনুভূতির ভূমিকা ক্ষুদ্রতর এবং ধারণার ভূমিকা বৃহত্তর। যাই হোক, ব্যাপারটা আসলে শুধুমাত্র পরিমাণগত।
যে সমস্ত প্রস্তাব দশ শব্দটি উপস্থিত, সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ উত্তর হলো- সেই প্রস্তাবগুলো নির্ভুলভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাদের ভিতরে দশ শব্দের অনুরূপ কোনো উপাদান নেই। দশের মতো একটি বৃহৎ সংখ্যার ক্ষেত্রে এর ব্যাখ্যা বেশ জটিল হবে। সুতরাং তার বদলে আমার দুটি হাত আছে কথাটি প্রতিস্থাপন করা যাক। এর অর্থ :।
একটা a রয়েছে এমন যে একটি b রয়েছে এমন যে, a এবং b সমরূপ নয় এবং x যাই হোক না কেন x আমার একটি হাত এ কথা শুধুমাত্র তখনই সত্য যখন x হয় a কিংবা x হয় b।
এক্ষেত্রে দুই কথাটির উপস্থিতি নেই। এ কথা সত্য যে, a এবং b– এই দুটি অক্ষরের উপস্থিতি রয়েছে কিন্তু তারা দুই অথবা সাদা, কালো বা অন্য কোনো রঙের কিনা সেটা জানা নিষ্প্রয়োজন।
সুতরাং একটা বিশেষ নির্ভুল অর্থে সংখ্যাগুলো আকারগত (formal) যে সমস্ত তথ্য দুটি সদস্যবিশিষ্ট নানা সংগ্রহের সাহায্যে নানা প্রস্তাবের সত্যতা সুদৃঢ়ভাবে নিরূপণ করে, তাদের ভিতরে সাধারণ কোনো উপাদান নেই, আছে শুধু আকার। এ বিষয়ে, স্বাধীনতার মূর্তি (Statue of Liberty) কিংবা চাঁদ অথবা জর্জ ওয়াশিংটন সাপেক্ষ প্রস্তাবের সঙ্গে এদের পার্থক্য আছে। এই জাতীয় প্রস্তাব স্থান-কাল-এর একটি বিশেষ অংশ উল্লেখ করে, স্বাধীনতার মূর্তি সম্পর্কে সমস্ত রকম সম্ভবপর বিবৃতির মধ্যে এটাই সাধারণ উপাদান। কিন্তু অমুক অমুক দুটি আছে-এইরকম প্রস্তাবগুলোর ভিতর একমাত্র একইরকম আকার ছাড়া সাধারণ কিছু নেই। লাল সঙ্কেতসম্পন্ন একটি প্রস্তাবনার অর্থের সঙ্গে লাল সঙ্কেতটির যে সম্পর্ক দুই সঙ্কেতসম্পন্ন একটি প্রস্তাবনার অর্থের সঙ্গে দুই সঙ্কেতটির সম্পর্ক তার তুলনায় অনেক জটিল। একটি বিশেষ অর্থে আমরা বলতে পারি সঙ্কেত দুই অর্থহীন, যখন.এ সঙ্কেত কোনো সত্য বিবৃতিতে উল্লিখিত হয় তখন এই উদ্ধৃতির অর্থের ভিতর অনুরূপ কোনো উপাদান থাকে না। পছন্দ হলে বলতে পারি সংখ্যাগুলো শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় ইত্যাদি কিন্ত তার সঙ্গে আমাদের অবশ্যই যোগ করতে হবে সংখ্যাগুলো যৌক্তিক কল্পকাহিনী।
আরও একটা যুক্তি আছে। শব্দ এবং রং সম্পর্কে প্লাতন বলেন সংযুক্তভাবে তারা দুই এবং প্রতিটি এককভাবে এক। আমরা দুই সম্পর্কে বিবেচনা করেছি, এবার এক সম্পর্কে বিবেচনা করতে হবে। এখানে একটি ভ্রম রয়েছে, সেটা অস্তিত্ব সম্পর্কে ভ্রমের তুল্য। বিধেয় এক বস্তু সম্পর্কে প্রযোজ্য নয় কিন্তু শুধুমাত্র একক শ্রেণিগুলো সম্পর্কে প্রযোজ্য। আমরা বলতে পারি পৃথিবীর একটি উপগ্রহ আছে কিন্ত চন্দ্র একটি একথা বললে পদান্বয়ে ভুল হয়। কারণ, এরকম একটি নিশ্চিত উক্তির অর্থ কী হতে পারে? আপনি এও বলতে পারেন চন্দ্র বহু, কারণ, এর বহু অংশ আছে। পৃথিবীর একটি উপগ্রহ আছে একথা বললে পৃথিবীর উপগ্রহ সম্পৰ্কীয় কল্পনের উপর একটি ধর্ম আরোপ করা হয়, সে ধর্মটি হলো।
একটি c রয়েছে এমন যে, x পৃথিবীর একটি উপগ্রহ সত্য, যখন এবং শুধুমাত্র যখন x এবং c অভিন্ন।
এটা একটা জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক সত্য কিন্তু যদি আপনি পৃথিবীর একটি উপগ্রহ-এর স্থলে চন্দ্র কিংবা ঐ জাতীয় কোনো নামবাচক বিশেষ্য স্থাপন করেন তাহলে তার ফল হবে অর্থহীন কিংবা অনুলাপ। সুতরাং এক কতকগুলো কল্পনের ধর্ম, ঠিক যেন আমার আঙুল এই কল্পনের ধর্ম হলো দশ। কিন্তু পৃথিবীর একটি উপগ্রহ আছে, তার নাম চন্দ্র, সুতরাং চন্দ্র একটি-এটা যুক্তি হিসেবে এর পরের যুক্তির শিষ্য ছিলেন, সুতরাং পিটার ছিলেন বারো-বারো-র জায়গায় সাদা প্রতিস্থাপন করলেও এই যুক্তি সঠিক হতো।
উপরোক্ত বিচারে দেখা যায় যদিও যুক্তিবিদ্যা এবং গণিতশাস্ত্রের মতো আকারগত জ্ঞান রয়েছে, যেগুলো অনুভূতি থেকে আহরিত নয়, অন্য সমস্ত জ্ঞান সম্পর্কে প্লাতনের যুক্তি হেত্বাভাস দোষে দুষ্টু (fallacious)। এ থেকে অবশ্য প্রমাণ হয় না যে, তাঁর সিদ্ধান্তগুলো মিথ্যা, এ থেকে শুধু প্রমাণিত হয় যে, এগুলো সত্যি ভাববার মতো কোনো সঠিক যুক্তি তিনি দেননি।
(২) এবার আসি প্রতাগরসের অবস্থান- সবেরই মাপকাঠি মানুষ কিংবা এর ব্যাখ্যা অর্থাৎ প্রতিটি মানুষই সকল বস্তুর মাপকাঠি। এখানে কোন স্তরে আলোচনাটি অগ্রসর হবে সেটা নির্ধারণ করা অপরিহার্য। এটা সহজবোধ্য যে, শুরুতে আমাদের প্রত্যক্ষ এবং অনুমিতির পার্থক্য নির্ণয় করতে হবে। প্রত্যক্ষের ব্যাপারে প্রতিটি মানুষ অবশ্যম্ভাবীরূপে নিজস্ব প্রত্যক্ষে সীমাবদ্ধ, অন্যের প্রত্যক্ষ সম্বন্ধে তার জ্ঞান আহরিত হয় অনুমিতির সাহায্যে অর্থাৎ শ্রুতি এবং পঠনের দ্বারা। উন্মাদ ও স্বপ্নদর্শীদের প্রত্যক্ষ, প্রত্যক্ষ হিসেবে অপরাপর মানুষের প্রত্যক্ষেরই মতো। একমাত্র আপত্তি হলো যে, তাদের প্রসঙ্গটা অস্বাভাবিক, তার ফলে তাদের অনুমিতি হেত্বাভাস দোষে দুষ্ট হতে পারে।
কিন্তু অনুমিতি সম্পর্কে কী বলা যাবে? তারা কি একইরকম ব্যক্তিগত এবং নিজস্ব? এক অর্থে আমাদের মেনে নিতেই হবে তারা তাই-ই। যা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে সেটা আমি অবশ্যই বিশ্বাস করব এমন কতকগুলো কারণে আমার কাছে যেগুলোর মূল্য আছে। এ কথা সত্যি যে, আমার কারণ হয়তো অন্য একজনের দৃঢ় উক্তি সেটা সম্পূর্ণরূপে পর্যাপ্ত কারণ হওয়া সম্ভব। উদাহরণ, যদি আমি সাক্ষ্য শুনছি এমন বিচারক হই। এবং আমি যতই প্রতাগোরীয় হই না কেন, এক কেতা সংখ্যা বিচারে আমার নিজের চাইতে একজন দক্ষ হিসাবনবিশের মত মেনে নেওয়া ভালো, কারণ, আমি হয়তো বার বার দেখেছি, প্রথমে তাঁর সঙ্গে আমার মতানৈক্য হলেও একটু যত্ন করে দেখলে বোঝা যাবে তিনিই সঠিক ছিলেন। এই অর্থে আমি মেনেও নিতে পারি আমার চেয়ে আর একজন অধিকতর জ্ঞানী। প্রতাগোরীয় অবস্থানের সঠিক ব্যাখ্যা এই দৃষ্টিভঙ্গির অবতারণা করে না যে, আমি সবসময় নির্ভুল, শুধুমাত্র এই যে, আমার ভুলের প্রামাণ্যতা আমার কাছে পরিস্ফুট হতে হবে। অপর এক ব্যক্তিকে যেভাবে বিচার করা যায় আমার অতীতের ব্যক্তিত্বকে সেভাবেই বিচার করা সম্ভব। কিন্তু এসবের ভিতরেই পূর্ব অনুমান হলো- প্রত্যক্ষের বৈপরীত্যে অনুমিতির ব্যাপারে একটি ব্যক্তিনিরপেক্ষ সঠিকতার মান রয়েছে। আমার একটি অনুমিতি যদি অন্য যে কোনো অনুমিতির মতোই উত্তম হয়, তাহলে যে বৌদ্ধিক নৈরাজ্য প্রতাগরস থেকে প্লাতন অনুমান করছেন, সেটা সত্যিই ঘটে। সুতরাং বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় এবং এ বিষয়ে প্লাতনই সঠিক। কিন্তু পরীক্ষামূলক সত্যে বিশ্বাসীরা বলবেন-পরীক্ষামূলক তথ্যের ব্যাপারে অনুমিতির সঠিকতা অনুভূতিনির্ভর।
(৩) নিরন্তর পরিবর্তনবাদকে প্লাতন ব্যঙ্গ করেছেন এবং তিনি এই মতবাদের যে চরম রূপ দিয়েছেন সেই রূপে এই মতবাদ কারও ছিল বলে অনুমান করা শক্ত। উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক যে রঙগুলো আমরা দেখি অবিচ্ছিন্নভাবে সেগুলোর পরিবর্তন হচ্ছে। লাল শব্দটি অনেক রঙের আভা সম্পর্কে প্রযোজ্য এবং আমরা যদি বলি আমি লাল দেখি-তাহলে পুরো বাক্যটা উচ্চারণে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণ কথাটা সত্য না থাকার কোনো কারণ নেই। প্লাতন তার ফলাফল লাভ করেছেন অবিরাম পরিবর্তনের প্রক্রিয়াগুলোকে করা, না-করা, জানা, না-জানার মতো যৌক্তিক বৈপরীত্যে আরোপ করে। এই বৈপরীত্যগুলো কিন্তু ঐ জাতীয় প্রক্রিয়ার বিবরণ দেওয়ার উপযুক্ত নয়। অনুমান করা যাক, কোনো এক কুয়াশাঘন দিনে আপনি দেখছেন রাস্তায় একটি লোক হাঁটতে হাঁটতে আপনার কাছ থেকে দূরে অপসৃত হচ্ছে? তার চেহারাটা ক্রমশ ঝাপসা হতে হতে এমন একটা সময় আসে যখন আপনি নিশ্চিত যে, তাকে আর দেখতে পাচ্ছেন না কিন্তু একটা মধ্যবর্তী সময় রয়েছে যখন আপনার সন্দেহ থাকে। যৌক্তিক বৈপরীত্য আবিষ্কৃত হয়েছে আমাদের সুবিধার জন্য কিন্তু অবিচ্ছিন্ন পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন পরিমাণ মাপক যন্ত্র, প্লাতন এই সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করেছেন। সুতরাং এ বিষয়ে তাঁর মন্তব্যের অধিকাংশই লক্ষ্যভ্রষ্ট।
একই সঙ্গে অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে, শব্দগুলোর যদি স্থির অর্থ না থাকে তাহলে আলোচনা হয়ে দাঁড়াবে অসম্ভব। যাই হোক, এক্ষেত্রে আবার অতিরিক্ত চরম হওয়া সহজ। শব্দের অর্থের পরিবর্তন হয়, উদাহরণ, ধারণা শব্দটি। শুধুমাত্র যথেষ্ট শিক্ষার সাহায্যেই প্লাতনকৃত শব্দার্থটির কাছাকাছি অর্থে আমরা পৌঁছাই। শব্দগুলো যে পরিবর্তনের বিবরণ দান করে তার তুলনায় শব্দের অর্থের পরিবর্তন শ্লথ হওয়া উচিত। কিন্তু শব্দের অর্থের কোনো পরিবর্তনই হবে না এমন কোনো কথা নেই। হয়তো যুক্তিবিদ্যা কিংবা গণিতশাস্ত্রের বিমূর্ত শব্দের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য নয় কিন্তু আমরা দেখেছি এই শব্দগুলো প্রস্তাবনার আকার সম্পর্কিত, বস্তু সম্পর্কিত নয়। এখানেও আমরা আবার দেখতে পাই যুক্তিবিদ্যা এবং গণিতশাস্ত্রের বিশেষত্ব আছে। পুথাগোরীয়দের প্রভাবে প্লাতন গণিতশাস্ত্রের চেয়ে অন্যান্য জ্ঞান একটু বেশিই হজম করে ফেলেছিলেন। মহত্তম দার্শনিকদের অনেকের সঙ্গে তিনি এই ভুলের অংশীদার কিন্তু তাহলেও এটা একটা ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়।