পিরোজপুর মহকুমার পুলিশপ্রধান ফয়জুর রহমান সাহেবের মন আজ অত্যন্ত ভালো। মন ভালো থাকার অস্বাভাবিক ঘটনার জন্যে তিনি খানিকটা লজ্জিত বোধ করছেন। দেশ ড়ুবে গেছে ভয়াবহ অনিশ্চয়তায়। এখন চরম দুঃসময়। এই অবস্থায় কোনো সুস্থ মানুষের মন ভালো থাকতে পারে না। তাহলে তিনি কি মানসিকভাবে খানিকটা অসুস্থ?
তিনি মানসিকভাবে খানিকটা অসুস্থ–এই ধারণা তাঁকে কিছুক্ষণ পীড়িত করল। সেই কিছুক্ষণ তিনি একমনে সূরা আর-রাহমান পড়লেন। একটু পরপর ফাবিয়ায়্যি আ-লা ই রাব্বিকমা তুকাজজিবান । তোমরা আমার কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে? আহারে, কী সুন্দর আয়াত!
তিনি বসে আছেন নামাজের পাটিতে। ফজরের নামাজ পড়া হয়েছে। নামাজের পাটি ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। ফজরের নামাজ নিয়মিত পড়া তাঁর কখনো হয় না। অনেক রাতে ঘুমুতে যান বলে সকালে ঘুম ভঙে না। আজ অসম্ভব সুন্দর স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙেছে। স্বপ্নে তিনি বিরাট এক বরযাত্রী দল নিয়ে যাচ্ছেন। দলের সঙ্গে নানান ধরনের বাদ্যবাজনার লোক আছে। তারা বাদ্যবাজনা করছে। বিয়েটা কার তা স্বপ্নে বুঝতে পারছেন না, তবে তার অতি ঘনিষ্ঠ কোনো একজনের, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। স্বপ্নের মধ্যে তাঁর মনে হলো, বিয়ে সম্ভবত তাঁর বড় মেয়ে শেফুর। কিন্তু মেয়ের বিয়েতে তো বরযাত্রী যায় না। তাহলে ঘটনাটা কী? ঘটনাটা জানার জন্যে তিনি মনের ভেতর অস্থিরতা বোধ করলেন। এই অস্থিরতাতেই ঘুম ভাঙল। তিনি টেবিলে রাখা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন, ভোর চারটা পঁচিশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আযান হবে। তিনি নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামলেন। অজু করে আযানের অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ অনুভব করলেন–তিনি সুখী একজন মানুষ। স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যা নিয়ে সুখী পরিতৃপ্ত একজন। আল্লাহপাক তাঁর প্রতি অসীম দয়া করেছেন।
তিনি দুরাকাত শোকরানা নামাজ পড়লেন। অতি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, পরম করুণাময়, আমাকে তুমি অনেক করুণা করেছ। আমি তার শোকরানা আদায় করি। দেশের আজ চরম দুঃসময়। আমার ছেলেমেয়েরা কেউ আমার পাশে ছিল না। তিনজন ছিল ঢাকায়, একজন কুমিল্লায়। তাদের তুমি নিরাপদে আমার কাছে এনে দিয়েছ। আল্লাহ, আমি তোমার শোকারগুজার করি।
তাঁর আরো কিছুক্ষণ নামাজের পাটিতে বসে থাকার ইচ্ছা ছিল। সেটা সম্ভব। হলো না, তার অতি আদরের পোষা হরিণ ইরা লাফ দিয়ে বারান্দায় উঠে নানানভাবে তাকে যন্ত্রণা করতে লাগল। শিং-এর গুতা, সার্ট কামড়ে ধরে পেছন দিকে টানার মতো কর্মকাণ্ড চলতে লাগল। বাধ্য হয়ে তিনি হরিণের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। যখন আশেপাশে কেউ থাকে না, তখন তিনি গলা নিচু করে হরিণের সঙ্গে গল্প করেন। আড়াল থেকে হরিণের সঙ্গে তার কথোপকথন শুনলে যে কেউ ভাববে, তিনি তার ছয় ছেলেমেয়ের যে-কোনো একজনের সঙ্গে গল্প করছেন।
কিরে তুই চাস কী? সার্ট ছেড়ার মতলব করেছিস? ফোস ফোঁস করছিস কেন? তুই কি সাপ যে ফোস ফোস করবি? শান্ত হয়ে বোস আমার পাশে। গলা লম্বা কর। গলা চুলকে দেব। খবরদার চাটোচাটি করবি না। অজু ভেঙে शाद।
হরিণের সঙ্গে গল্পগুজব শেষ করে তিনি খুরপি হাতে বাগানে কাজ করতে গেলেন। হরিণ ইরা গেল তার সঙ্গে। বাগানে নানান ধরনের শীতের সবজি তিনি লাগিয়েছেন। তাদের পেছনে যত্নও কম করা হয় না। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। অল্প কিছু টমেটো এবং কিছু টেরস হয়েছে। তিনি কয়েকটা টমেটো ছিঁড়ে হরিণকে খেতে দিলেন। হরিণ খাচ্ছে না। তাকে মনে হয় খেলার নেশায় পেয়েছে। সে নানান ভঙ্গিমায় লাফ বাপ করছে।
ভোর হয়েছে। ঘুম ভেঙে সবাই একে একে উঠতে শুরু করেছে। তিনি লক্ষ করলেন–তাঁর বড় ছেলে বাচু টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। ছেলেটার এই অদ্ভুত স্বভাব–সবসময় হাঁটাহাঁটি। সে কি কোনো চিন্তার মধ্যে থাকে? তার এই পুত্রের জন্ম এবং ইংল্যান্ডের যুবরাজ প্ৰিন্স চার্লসের জন্ম একই সময়ে একই দিনে। নিশ্চয়ই শুভক্ষণ। প্রিন্স চার্লসের জীবন এবং তার পুত্রের জীবন মিলিয়ে দেখতে হবে।
ছেলেকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। সে বাবাকে দেখে আড়ালে চলে গেছে। তিনি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। কোনো এক অজানা কারণে তার সব পুত্রকন্যাই তাকে অসম্ভব ভয় পায়। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর সহজস্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হয় নি। ষোড়শ বর্ষেন্তু পুত্ৰ মিত্র বদাচারেৎ। তাঁর পুত্ৰ মিত্র হয় নি। হলে ভালো হতো। দেশের অবস্থা নিয়ে পিতা-পুত্রের মিটিং হতো। ছেলের কাছে শুনতেন সে ঢাকায় কী দেখে এসেছে। তিনি বলতেন, পিরোজপুরে কী হচ্ছে। এই ছোট্ট মফস্বল শহরে অনেক কিছুই হচ্ছে। ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর সব ঘটনা। এখানেও ঘটতে পারে। ট্রেজারিতে এক কোটি টাকার মতো আছে। পনেরোজন আর্মড পুলিশের একটা দল ট্রেজারি পাহারা দেয়। পুলিশের এই দল আসে বরিশাল থেকে। এক মাস থাকে। অন্য এক দল আসে, পুরনো দল ফিরে যায়। দীর্ঘদিনের ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। আইনশৃঙ্খলা যেদিন ভাঙবে সেদিন সবকিছু ভাঙবে। ট্রেজারি লুট হয়ে যাবে।
পিরোজপুর মহকুমার প্রধান ব্যক্তি সিএসপি মুহিবুল্লাহ। সাব ডিভিশনাল অফিসার। সিন্ধু প্রদেশের মানুষ। তার স্থান হবে কোথায়? যদি শত শত মানুষ এসে এসডিওর বাংলো ঘেরাও করে বলে, এই পশ্চিম পাকিস্তানিটাকে আমাদের হাতে তুলে দাও, তখন তিনি কী করবেন? তাঁর পুলিশ বাহিনী দিয়ে এসডিও মুহিবুল্লাহ সাহেবকে রক্ষা করবেন? না-কি একপাশে দাঁড়িয়ে দেখবেন কী করে অসহায় একজন মানুষকে ধরে নিয়ে যায়? তাঁর ভূমিকা কী হবে? পুলিশ বাহিনী কি তখন তাঁর কথা শুনবে? রাষ্ট্ৰীয় শৃঙ্খলা যখন ভেঙে পড়ে, তখন তার প্রথম ধাক্কা এসে লাগে পুলিশ বাহিনীতে। কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ে। তখন আর হুকুম চলে না। হুকুমবিহীন পুলিশ বাহিনী কোনো বাহিনী না।
এই অঞ্চলে অন্য এক ধরনের উপদ্রবও আছে। এই উপদ্রবের নাম নকশাল উপদ্রব। একদল ছেলে নকশাল নাম নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ডাকাতি করে বেড়ায়। এই দলের প্রধান ছেলেটির নাম বজলু। সে তার দলবল নিয়ে গা ঢাকা দিয়েই ছিল। সুযোগ বুঝে সে দর্শন দিয়েছে। বিশেষ ভঙ্গিমায় প্রকাশ্যে হাঁটাহাঁটি করছে। তিনি গোপন খবর পেয়েছেন তার লক্ষ্য ট্রেজারির দিকে।
ফয়জুর রহমান সাহেব ক্ষেতের কাজ বন্ধ করলেন। হঠাৎ তার খানিকটা অস্থির লাগছে। দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্থিরতা বাড়তে শুরু করেছে। গত কয়েকদিন হলো এই সমস্যা তার হয়েছে–বেলা বাড়তে থাকে, তার অস্থিরতা বাড়তে থাকে। অস্থিরতা তীব্ৰ হয় সন্ধ্যাবেলা! সন্ধ্যার পর থেকে অস্থিরতা আবার কমতে থাকে। এটা কি কোনো শারীরিক অসুখ? না-কি মনের সমস্যা? সরকারি হাসপাতালের সিভিল সার্জন সিরাজ সাহেবের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করলে হয়। তিনি প্রতিদিনই আসেন। যখন আসেন তখন আর অস্থিরতার বিষয়টা নিয়ে আলাপ করার কথা মনে থাকে না।
সিরাজ সাহেব অতি ভদ্রলোক, অতি সরল। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করলেই এই ধরনের ভরসা পাওয়া যায়। মনে হয় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার মতো কিছু ঘটে নি। ভদ্রলোকের শরীর যেমন ভারী গলার স্বরও ভারী। তিনি কথা বলেন গলা নামিয়ে। প্রতিটি শব্দ এমনভাবে উচ্চারণ করেন যে মনে গেথে যায়।
এসডিপিও সাহেব শোনেন, আপনি আমি অর্থাৎ আমরা যারা পিরোজপুরে মোটামুটি আন্দামানটাইপ জায়গায় পড়ে আছি তাদের অবস্থাটা বুঝতে পারছেন? তারা আছে আল্লাহর খাস রহমতের তালিকায়। বুঝিয়ে বলি, পাকিস্তানি মিলিটারি মারামারি কাটাকাটি করতে থাকবে বড় বড় শহরে। তারা বিগ সিটি সামলাতেই এখন ব্যস্ত। তারপর যাবে ডিসট্রিক্ট লেভেলে, তারপর সাবডিভিশন। তার আগেই খেল খতম।
কীভাবে খেল খতম?
যা ঘটার ঘটে যাবে। হয় পাকিস্তান, না হয়। বাংলাদেশ। মাঝামাঝি ধরনের কিছু হবার সম্ভাবনাও আছে। লুজ ফেডারেশন টাইপ। কিংবা ধরেন আমেরিকার মতো United States of Pakistan. সেখানে বাংলাদেশ একটা রাষ্ট্র, পাঞ্জাব একটা, সিন্ধু, বেলুচিস্তান… বুঝেছেন?
বোঝার চেষ্টা করছি।
পাকিস্তানিরা খুব মারামারি কাটাকাটি যে করতে পারবে তাও না। জাতিসংঘ আছে না? বড় বড় রাষ্ট্র আছে। রাশিয়ার পদগোনি যদি এক ধমক দেয়। ইয়াহিয়ার পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে যাবে। সেই পায়খানা বন্ধ করা ডাক্তারের সাধ্য না। বোতলের ছিপি ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নাই। আচ্ছা, মনে করেন। কেউ কোনো ধমক ধামক দিল না, তারপরেও এক হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে এসে যুদ্ধ কলা? যুদ্ধ এত সোজা? যুদ্ধ কি মামার বাড়ির উঠানে ডাংগুলি খেলা?
যত সহজ সমাধানের কথা। আপনি বলছেন, তত সহজ আমার কাছে মনে হচ্ছে না।
আপনার কাছে জটিল মনে হচ্ছে?
জি।
আপনি তো ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ। কোরআন শরীফ বিশ্বাস করেন?
কী বলেন, কোরআন শরীফ বিশ্বাস করব না মানে?
পাক কোরআনে সূরা বনি ইসরাইলে আল্লাহপাক বলেছেন, আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। কাজেই আমাদের কী হবে না হবে সব আগে থেকেই ঠিক করা। যা আগে থেকে ঠিক করা তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ আছে?
না, লাভ নেই। যা হবার তা হবে। তারপরেও আমরা নিশ্চয়ই হাত-পা কোলে নিয়ে বসে থাকব না।
কী করবেন?
বিপদের জন্যে তৈরি হবো।
কীভাবে? মিলিটারি আসবে মেশিনগান, রকেট লাঞ্চার নিয়ে, আর আপনারা যুদ্ধ করবেন। একশ বছরের পুরনো থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে? ওদের আছে যুদ্ধের ট্রেনিং, আর আপনাদের ট্রেনিং হলো চোৱের পিছনে দৌড় দেয়া। মাথা থেকে সব চিন্তা-ভাবনা ঝেড়ে ফেলুন। ভাবিকে ভালো করে চা বানাতে বলুন। চা খেতে খেতে গল্প করব। খামাখা দুশ্চিন্তা করে ব্লাড প্রেসার বাড়াবেন না। Do ফুর্তি।
ফয়জুর রহমান সাহেব বাগানে রাখা বালতিতে হাত ধুলেন। ইরা পেছনে পেছনে আসছে। পানি খেতে চায় হয়তো। তিনি বালতি নিচু করে ধরলেন। বালতিতে মুখ ঢুকিয়ে চুমুক দিয়ে পানি খাচ্ছে ইরা। গরু ভেড়া ছাগল সবাই চুমুক দিয়ে পানি খায়। অথচ কুকুর শ্রেণী পানি খায় জিভ ড়ুবিয়ে। এর মানে কী? বড় ছেলেকে কি ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করবেন? সে দিনরাত বই পড়ে। এই প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই সে জানে। তাছাড়া এ ধরনের টুকটাক কথাবার্তা দিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবার পথ হয়তো তৈরি হবে। তিনি লক্ষ করলেন, বড় ছেলের হাতে চায়ের কাপ। সে চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। এই অবস্থাতেই চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। এর মানে কী? তিনি ছেলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে গলাখ্যাকড়ি দিলেন। ছেলে চমকে তার দিকে তাকাল। ছেলের চোখ দেখেই মনে হচ্ছে সে ভয় পাচ্ছে। জড়সড় হয়ে গেছে। ভয় পাবার কী আছে? তিনি বললেন, কী করছিস?
কিছু না।
চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?
ছেলে জবাব দিল না। বিব্ৰত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। বাবার সামনে থেকে চলে যেতে পারলে সে বাঁচে। অথচ তার কিছুক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। তিনি বললেন, স্বরূপকাঠির একটা লোক আছে, তার না-কি জীন সাধনা। সে ঘরের ভেতর জীন নামাতে পারে। সেই জীন কথা বলে। মাথায় হাত দিয়ে দােয়া করে। ভাবছি লোকটাকে আনাই। দেখি ঘটনা কী। আনাব?
ছেলে আগ্রহের সঙ্গে বলল, জি আনান। কবে আনাবেন?
ইচ্ছা করলে আজকেই আনা যায়। দেখি।
তিনি লক্ষ করলেন, উৎসাহ এবং উত্তেজনায় ছেলের চোখ চকচক করছে। ছেলে খুবই মজা পাচ্ছে। তিনি পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন। তিনি বললেন, চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিলি কেন?
তাঁর ধারণা এইবার ছেলে প্রশ্নের জবাব দেবে। তাকে কিছুটা হলেও সহজ করা হয়েছে। তার ধারণা ঠিক হলো, ছেলে কথা বলতে শুরু করল। তিনি আগ্ৰহ নিয়ে শুনছেন। ছেলের কথা বলার মধ্যে মাস্টার মাস্টার ভাব আছে। যেন সে ক্লাসে বক্তৃতা দিচ্ছে। তাঁর এই ছেলে কি ভবিষ্যতে মাস্টার হবে?
সূর্যরশ্মি মানুষের শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি করে। চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে মুখ করে থাকলে চোখে ভিটামিন ডি তৈরি হয়। চোখ খোলা রাখা যাবে না, কারণ সূর্যরশ্মিতে আলট্রাভায়োলেট আছে। সেটা চোখের ক্ষতি করে।
আলট্রাভায়োলেট কী?
ছোট তরঙ্গ দৈঘ্যের আলো। হাই এনার্জি।
আমি গ্রামে দেখেছি, হিন্দু ব্ৰাহ্মণরা পুকুরে গোসলের সময় সূর্যের দিকে তাকিয়ে মন্ত্র পড়ে।
তারা সূর্যমন্ত্র পাঠ করে। সূর্যের উপাসনা। আমি মন্ত্রটা জানি।
তিনি বিস্মিত হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই সূর্যমন্ত্র জানিস?
জানি। অং জবাকুসুম শংকাসং কাস্যপেয়ং মহা দুৰ্গতিং। ধ্বন্তারিং সর্ব পাপগনিং প্ৰণত হোসমি দিবাকরম ।
তিনি অবাক হয়ে বললেন, সূর্যমন্ত্র মুখস্থ করে বসে আছিস কেন? তুই মুসলমানের ছেলে?
ছেলে লজা পাচ্ছে। এই লজা দেখতে ভালো লাগছে। আজ একদিনে অনেক কথা হয়ে গেছে। আরেকদিন ওজজ্ঞেস করতে হবে, ছেলে এই মন্ত্র কেন শিখেছে?
ফয়জুর রহমান সাহেব সকালের নাশতা শেষ করে পুলিশের পোশাক পরতে বসলেন। গত দুদিন তিনি পোশাক পরেন নি। আজ পোশাক পরার বিশেষ কারণ আছে। কারণটা গোপন। কাউকেই এই বিষয়ে কিছু বলেন নি।
তাঁর অফিস নিজের বাসাতেই। এসডিপিওর বাংলোর একটা কামরায় অফিস। খুবই পুরনো ব্যবস্থা। সিলিং-এ বিশাল এক টানা পাখা। সরকারি খরচে একজন পাংখাপুলার আছে। তার নাম রশীদ। ফয়জুর রহমান সাহেব চেয়ারে বসা মাত্ৰ পাংখাপুলার রশীদ দড়ি ধরে টানতে শুরু করে। তিনি অবশ্যি বলে দিয়েছেন। পাখা টানতে হবে না। টেবিলফ্যান আছে। তারপরেও রশীদ নিয়মমতো কিছুক্ষণ পাংখা টানে। এই পাংখার বিষয়ে তাঁর ছেলেমেয়েদের খুব আগ্রহ আছে। একদিন দেখেছেন, তার মেজ মেয়ে শিখু পাংখার দড়ি ধরে বুলছে। হাতে টানা পাংখার ব্রিটিশ আমলের নিয়ম এখনো কেন এই জায়গায় চালু আছে ভেবে তিনি বিস্ময় বোধ করেন।
রশীদ!
জি স্যার।
দেশের অবস্থা কেমন?
অবস্থা ভালো স্যার। চারদিকে জয় বাংলা।
জয় বাংলার বাইরে কিছু আছে?
রশীদ। চুপ করে আছে। জয় বাংলার বাইরে কিছু নিশ্চয়ই আছে। সেই কিছুটা সে এখন বলবে না। সময়মতো বলবে। রশীদ মাঝে-মাঝে তাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু খবর দেয়।
ঘাটে নৌকা আছে রশীদ?
জি স্যার।
নৌকায় সুন্দর করে বিছানা করে রাখবে। কলসিতে পানি ভরে রাখবে। আমার ছেলেমেয়েরা যদি নৌকায় করে কোথাও যেতে চায়, তাদের নিয়ে যাবে।
জি স্যার।
মহকুমার পুলিশ প্রধান একটা সরকারি নৌকা পান। বড় নৌকা। নৌকার মাঝিরাও সরকারি কর্মচারী। ফয়জুর রহমান সাহেবের ছেলেমেয়েদের এই নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর খুব শখ। এই কাজটা তিনি কখনোই করতে দেন। না। আজ নিয়মের ব্যতিক্রম করলেন।
ফয়জুর রহমান সাহেব ঘড়ির দিকে তাকালেন। সকাল দশটা পঁচিশ। তিনি সাড়ে এগারোটা বাজার অপেক্ষা করছেন। সময় কাটছে না। টেবিলে অনেক ফাইল আছে; ফাইল দেখতে ইচ্ছা করছে না। টিএ বিল করা যায়। গত মাসের টিএ বিল করা হয় নি। তবে এখন টিএ বিল করা অর্থহীন। কে দেবে বিল? তিনি ড্রয়ার খুলে দুশ পৃষ্ঠার বাঁধানো খাতা বের করলেন। তিনি বেশ কিছুদিন হলো একটা রেডিও নাটক লেখার চেষ্টার করছেন। নাটকের নাম কত তারা আকাশে। এই নামকরণের একটা ইতিহাস আছে। তাঁর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান শাহীন এক রাতে উঠানে বসেছিল। হঠাৎ সে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বলল, কত তারা আকাশে! তিনি ছেলের মুখে শুদ্ধ বাংলায় এই বাক্য শুনে মোহিত হলেন এবং ততক্ষণাৎ ঠিক করলেন, এই নামে একটা গল্প লিখবেন।
গল্প না লিখে রেডিও নাটক লেখারও ইতিহাস আছে। রেডিও পাকিস্তান ঢাকার সহকারী প্রোগ্রাম প্রডিউসার বাহারুল হক সাহেবের বাড়ি পিরোজপুর। তাঁর সঙ্গে ফয়জুর রহমান সাহেবের পরিচয় হয়েছে। বাহারুল হক সাহেব। আশা দিয়েছেন, নাটক ভালো হলে রেডিওতে প্রচারের চেষ্টা করবেন।
ফয়জুর রহমান সাহেব গভীর মনোযোগে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত নাটক লিখলেন। কয়েকটা দৃশ্য বাদ দিলেন। নতুন যে দৃশ্যটি লিখলেন সেটি এতই আবেগময় যে লিখে শেষ করে তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালেন। রশীদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নতুন এসডিপিও সাহেবের অনেক ব্যাপারই তার কাছে অদ্ভুত মনে হয়। এই এসডিপিও সাহেব প্রায়ই কী যেন লেখেন, তখন তার চোখ দিয়ে পানি পড়ে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা আছে। এই ঘটনা তার জানতে ইচ্ছা করে। জানতে চাইলেই তো আর জানা যায় না। সে সামান্য পাংখাপুলার। পুলিশের কতাঁর মনের রহস্য জানার তার সুযোগ কোথায়?
এসডিও মুহিবুল্লাহ তার বাংলোর বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসেছিলেন। ফয়জুর রহমানকে আসতে দেখে তিনি ভুরু কুঁচকে তাকালেন। মহকুমা পুলিশ প্রধানের তাঁর কাছে আসার একটাই অৰ্থ–আইন-শৃঙ্খলাঘটিত কোনো সমস্যা হয়েছে। সমস্যা হবেই। সমস্যার সমাধান দেয়ার ক্ষমতা এখন তার নেই। এসডিপিওকে ফুল পুলিশ ইউনিফর্মে দেখেও তিনি খানিকটা বিস্মিত।
ফয়জুর রহমান সাহেব স্যালুট করলেন। মহিবুল্লাহ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত গলায় বললেন, Is anything wrong?
ফয়জুর রহমান বললেন, স্যার, আপনাকে পিরোজপুর ছেড়ে চলে যেঙ্গে হবে।
মহিবুল্লাহ চুপ করে রইলেন।
স্যার, আমি হুলারহাটে লঞ্চ রেডি করে রেখেছি। লঞ্চ আপনাকে বরিশালে নিয়ে যাবে। বরিশালে আপনি নিরাপদে থাকবেন। চেষ্টা করবেন বরিশাল থেকে ঢাকা চলে যেতে। সেখান থেকে নিজের দেশে।
বরিশাল যাবার পথেও তো আমাকে মেরে ফেলতে পারে।
ট্রেজারির পনেরোজন আর্মড পুলিশ সেই লঞ্চে যাচ্ছে। তাদের আমি আপনার নিরাপত্তার বিষয়টি বলে দিয়েছি।
তারা আপনার কথা শুনবে?
জি স্যার, শুনবে।
কখন যাব?
এখন।
আপনি এই চেয়ারটায় বসুন। আমি তৈরি হয়ে আসছি। আপনাকে ছোট্ট একটা প্রশ্ন করব, জবাব ভেবে চিন্তে দেবেন।
স্যার, প্রশ্ন করুন।
আপনার লয়েলটি কোন দিকে? পাকিস্তানের দিকে, না-কি বিদ্রোহীদের দিকে?
অবশ্যই বিদ্রোহীদের দিকে!
তাহলে আমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করছেন কেন? আচ্ছা থাক, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না।
হুলারহাট লঞ্চ টার্মিনালে ফয়জুর রহমান সাহেব মহকুমা প্রধানকে বিদায় দিলেন। মুহিবুল্লাহ লঞ্চে উঠার আগে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, You are a brother that I never had.
রাত নটা। কিছুক্ষণ আগে ফয়জুর রহমান সাহেব খবর পেয়েছেন মুহিবুল্লাহ ঠিকমতো বরিশাল পৌঁছেছেন। আজ রাতেই রকেট স্টিমারে তার বরিশাল থেকে ঢাকায় রওনা দেবার কথা।
পিরোজপুরের রাস্তায় রাস্তায় জঙ্গি মিছিল। মিছিলের স্লোগান–ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে আমরাও প্রস্তুত। বিরুদ্ধে শব্দটা বরিশালের বিশেষ উচ্চারণে হয়েছে ক্ৰদ্ধে। শুনতে অদ্ভুত লাগছে। মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির অল্পবয়েসী নেতা আলি হায়দার খান! ফয়জুর রহমান সাহেবের সঙ্গে এই মানুষটির বিশেষ সখ্য আছে। প্রায় রাতেই মিছিল শুরুর আগে আগে তিনি এসডিপিওর বাংলোয় চা খেতে আসেন। সেখান থেকে যখন মিছিলে যান, তখন তাঁর সঙ্গে এসডিপিও সাহেবের দুই ছেলেও থাকে। তারাও মহাউৎসাহে ইয়াহিয়ার ব্রুদ্ধে আমরাও প্রস্তুত। স্লোগান দেয়। তাদের হাতে থাকে বাবার ব্যক্তিগত পয়েন্ট টু টু বোরের একটা রাইফেল। একটাই রাইফেল দুজন হাত বদল করে। রাইফেল হাতে ছেলেদের দেখে তাঁর মনে একই সঙ্গে আনন্দ হয় এবং শঙ্কাও হয়।
আজ এসডিপিও সাহেবের দুই ছেলে মিছিলে যাচ্ছে না। কারণ আজ তাদের বাসায় জীন নামানো হবে। তাদের উৎসাহের কোনো সীমা নেই।
যে ব্যক্তি জীন আনবেন তার নাম কফিলুদ্দি। মধ্যবয়স্ক বলশালী একজন লোক। মুখভর্তি দাড়িগোফের জঙ্গল। ঘোলাটে চোখ। তার পরনে লুঙ্গি, গায়ে গাঢ় সবুজ রঙের পাঞ্জাবি।
কফিলুদ্দি একটা ঘরে সবাইকে নিয়ে বসাল। সেখানে জায়নামাজ পাতা। সে জায়নামাজে বসে বিভিন্ন সূরা বিশেষ করে সূরায়ে জীন পাঠ করে সশরীরে উপস্থিত করবে। যখন জীন আসবে তখন জীনের সঙ্গে বেয়াদবিমূলক কোনো কথাবার্তা বলা যাবে না। জীনকে প্রশ্ন করলেও করতে হবে অত্যন্ত আদবের সঙ্গে। জীনের উপস্থিতি অনুভব করা যাবে, তবে তাকে দেখা যাবে না। কারণ ঘর থাকবে অন্ধকার। ঘরে কোনো আলো জ্বালা যাবে না।
সবাই অজু করে অপেক্ষা করছে। ঘর অন্ধকার। কেউ তার নিজের হাতই দেখতে পাচ্ছে না। এমন অবস্থা। কফিলুদ্দি একমনে সূরা পড়ে যাচ্ছে। তার গলার স্বর ভারী। সে কেরাত পড়ছে বিশেষ ভঙ্গিমায়। হঠাৎ কী যেন হলো, ঘরের মাঝখানে থপ করে শব্দ। যেন ছাদ থেকে কেউ লাফিয়ে মেঝেতে নামল। মেঝেতে সে ব্যাঙের মতো থপথপ শব্দ করে হাঁটছে। কফিলুদ্দি তখনো কেরাত পড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় জীন বলল, আসসালামু আলায়কুম। আমি আসছি।
ভয়াবহ অবস্থা। বসার ঘরে বাইরের লোক বলতে কফিলুদ্দি একা। জীন সেজে দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রবেশের প্রশ্নই ওঠে না। অথচ কফিলুদ্দিনের কোরআন পাঠ এবং জীনের কথাবার্তা একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে। সে যে থপথপ করে ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাচ্ছে তাও বোঝা যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে সাপের শিসের মতো তীব্র শিসের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে।
এসডিপিও সাহেবের মেজ ছেলে জাফর ইকবাল ভয়ে ভয়ে বলল, আপনি কোথায় থাকেন?
জীন বলল, আমি থাকি কোহকাফ নগরে।
বাংলাদেশ কি স্বাধীন হবে?
কোনোদিন হবে না।
স্বাধীন কেন হবে না?
আমরা সব জীন একত্র হয়ে পাকিণ্ডানের জন্যে দোয়া করি। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
জীন আরো কিছু প্রশ্নের জবাব দিল। সবার মাথায় হাত রেখে দোয়া করল এবং বলল, সে আর বেশিক্ষণ এখানে থাকতে পারবে না। কারণ তার চলে যাবার সময় এসেছে। পাকিস্তানের তাঁরক্কির জন্যে জীন সমাজে আজ বিশেষ দোয়া হবে। তাকে সেই দোয়ায় সামিল হতে হবে।
ফয়জুর রহমান সাহেব এবং তার স্ত্রী দুজনই জীন যে সত্যি এসেছিলএই বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন। কফিলুদ্দিকে ভালো বখশিশ দিয়ে বিদায় করা হলো। জীন নামানোর এই অদ্ভুত কর্মকাণ্ড তাঁরা কেউই আগে দেখেন নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে না–এই ভয়ঙ্কর কথা যদি জীন না বলত, তাহলে জীন অনুভবের আনন্দ ষোল আনা হতো। জাফর ইকবাল বলল, দেশ স্বাধীন অবশ্যই হবে। কারণ জীন আসে নাই। জীনের সব কথাবার্তা আমি টেপ রেকর্ডারে টেপ করেছি। জীন যদি সত্যি আসত, সে দেখত যে আমি এই কাণ্ড করছি। তখনই সে রেগে যেত। সমস্তই কফিলুদ্দির কারসাজি।
ফয়জুর রহমান সাহেব তাঁর মেজ ছেলের সাহস দেখে চমৎকৃত হলেন। সে এক ফাঁকে জীনের কথাবার্তা রেকর্ড করে ফেলেছে। এই চিন্তা তো তার নিজের মাথায় আসে নি। তার জন্যে আরো বড় চমক অপেক্ষা করছিল। তাঁর বড় ছেলে জীনের কথাবাতাঁর রেকর্ড বাজিয়ে পুরোটা শুনে জীন যে আসে নাই সে বিষয়ে কঠিন প্রমাণ উপস্থিত করল। জীন কথাবাতাঁর এক পর্যায়ে পুরোপুরি বরিশালের ভাষায় বলেছে পরথম। তার যুক্তি হচ্ছে, যে জীন থাকে কোহকাফ নগরে সে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় প্রথমকে পরথম বলবে না।
দেশ স্বাধীন হবে না। জীনের এই কথায় মন খারাপ করার কোনোই কারণ নেই। কারণ জীন আর কেউ না, কফিলুদ্দি নিজে।
ফয়জুর রহমান সাহেব তাঁর ছেলেদের সাহস এবং বুদ্ধিতে অত্যন্ত প্ৰীত হয়ে সেই রাতে ঘুমুতে গেলেন। তাঁর মনে হলো এরকম ছেলেমেয়ে যার আছে তার চিন্তিত হবার কিছু নেই। যে-কোনো বিপদ এরা সামাল দিতে পারবে। তিনি ঘুমুবার জন্যে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলেন। কী মনে করে বিছানা থেকে উঠলেন। অজু করে তাহাৰ্জ্জুতের নামাজ পড়তে গেলেন।
নামাজে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই দরজার কড়া নড়ল। অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে কেউ একজন কড়া নাড়ছে। কড়া নাড়ার ভঙ্গি থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে। ভয়ঙ্কর কিছু না ঘটলে রজনীর দ্বিতীয় প্রহরে এসডিপিওর বাংলোর কড়া কেউ এইভাবে নাড়বে না।
তিনি এখন কী করবেন? নামাজ শেষ করবেন? না-কি কে কড়া নাড়ছে সেই খোঁজ করবেন? তার উচিত আগে নামাজ শেষ করা। যে কড়া নাড়ছে তার তর সইছে না। সে কড়া নেড়েই যাচ্ছে। কড়া নাড়ার শব্দে ফয়জুর রহমান সাহেবের স্ত্রী আয়েশার ঘুম ভেঙেছে। তাঁর বড় মেয়ে সুফিয়ার ঘুম ভেঙেছে। দুজনই ভীত মুখে বিছানা থেকে নেমেছে।
তিনি নামাজের পাটি থেকে নেমে পড়লেন। অসম্ভব খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে সবাই যাচ্ছে। কখন কী ঘটে যায় কিছুই বলা যায় না। আগে খোেজ নেয়া দরকার।
কড়া নাড়ছেন পিরোজপুর সদর থানার ওসি। তার সঙ্গে আছেন সেকেন্ড অফিসার। ফয়জুর রহমান সাহেব দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওসি নিচু গলায় বলল, স্যার, থানায় যেতে হবে।
কী হয়েছে?
ওয়ারলেসে জরুরি ম্যাসেজ দেবে। আপনার সঙ্গে কথা বলবে।
কে দিচ্ছে জরুরি ম্যাসেজ?
সেটা কিছু বলে নাই, তবে মনে হয় মিলিটারি হাইকমান্ড। তবে পুলিশ হেড কোয়াটারও হতে পারে।
ফয়জুর রহমান সাহেব অতি দ্রুত লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরলেন। শার্ট গায়ে দিলেন। তাঁর স্ত্রী ভীত মুখে বললেন, কোথায় যাচ্ছ?
থানায় যাচ্ছি।
কেন?
পরে বলব। পরে।
ছেলেদের কাউকে সাথে নিয়ে যাও। ওদের ডেকে তুলি?
কাউকে ডাকতে হবে না। খামাখা ভয় পেও না। ভয় পাবার মতো কিছু হয় নাই।
ওয়ারলেস ম্যাসেজ এসেছে ঢাকার পুলিশ সদরদপ্তর থেকে। আইজির বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে। ঢাকার অবাঙালি ওয়ারলেস অপারেটর জানাল–দেশের সব জেলা মিলিটারির দখলে আছে। সাবডিভিশন এবং থানা লেভেলেও মিলিটারি অতি দ্রুত অভিযান শুরু করবে। পুলিশ বাহিনীকে জানানো যাচ্ছে, তারা যেন সামরিক বাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতা করে। তারা দেশের আইনশৃঙ্খলা দেখবে এবং দেশের মঙ্গলের জন্যে সামরিক বাহিনীর নির্দেশ পালন করবে।
ফয়জুর রহমান ম্যাসেজ নিলেন। ওসি সাহেব বললেন, স্যার আমরা কী করব? ওসি সাহেবের মুখ দুশ্চিন্তায় ছোট হয়ে গেছে। তিনি রীতিমতো ঘামছেন।
ফয়জুর রহমান বললেন, পুলিশ সবসময় থেকেছে। সাধারণ মানুষদেব সঙ্গে। এখানো আমরা তাই করব। দেশের মানুষের সঙ্গে থাকব।
যারা থাকতে চায় না, তারা কী করবে?
তাদেরটা তারা জানে।
আপনি কোনো নির্দেশ দেবেন না?
না। পুলিশের কমান্ড ভেঙে পড়েছে। এই অবস্থায় নির্দেশ চলে না।
পুলিশ বাহিনীর কেউ যদি দেশে চলে যেতে চায়, তাহলে কি চলে যাবে?
হ্যাঁ যাবে।
ফয়জুর রহমান সাহেব হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছেন। এই শহরে কোনো স্ট্রীট লাইট নেই। কোনো বাড়িতেও আলো জুলছে না। তবে আকাশে চাঁদ আছে। চাঁদের আলোয় পথ চলতে অসুবিধা হচ্ছে না। হঠাৎ তার কাছে মনে হলো, জোছনার গ্রামের চেয়ে জোছনার শহর অনেক সুন্দর।
তিনি থমকে দাঁড়ালেন। বেশ কিছু সময় জোছনা অনুভব করলেন। আবার যখন হাঁটতে শুরু করলেন, তখন লক্ষ করলেন দূর থেকে কেউ একজন তাকে অনুসরণ করছে। তিনি যখন দাঁড়িয়ে যান, সেও দাঁড়ায়। তিনি হাঁটতে শুরু করলে সেও হাঁটে। ব্যাপারটা কী?
কে ওখানে, কে?
যে অনুসরণ করছিল সে থেমে গেল। ফয়জুর রহমান সাহেব পুলিশি গলায় ডাকলেন, কাছে আসো।
ভীত পায়ে মাথা নিচু করে কেউ একজন আসছে; কাছাকাছি এসে দাড়াবার পর তাকে চেনা গেল। পাংখাপুলার রশিদ।
ফয়জুর রহমান সাহেব হাঁটতে শুরু করলেন। রশিদ পেছনে পেছনে মাথা নিচু করে আসছে। রশিদের এই এক অভ্যাস–তিনি যেখানে যান রশিদ তাকে অনুসরণ করে, যত রােতই হোক। এর কোনো ব্যতিক্রম হয় না।
অদ্ভুত স্বপ্নটার কথা ফয়জুর রহমান সাহেবের হঠাৎ মনে পড়ল। স্বপ্নে তিনি বরযাত্রী যাচ্ছিলেন। সেখানেও তাঁর পেছনে ছিল রশিদ। বাস্তবের অনুসরণকাবী স্বপ্নেও ছিল।
রশিদ!
জি স্যার।
বিয়ে করেছ?
জি-না স্যার।
পরিপূর্ণ জোছনায় দুজন হাঁটছে। ফয়জুর রহমান সাহেবের হঠাৎ মনে হলো— স্বপ্নদৃশ্যেও আকাশে জোছনা ছিল; বরযাত্রী চাঁদের আলো গায়ে মাখতে মাখতে এগুচ্ছিল।