১৮. পশু মানব
বেশ কয়েক বছর আগে আমি সিলেট থেকে ঢাকা আসার জন্যে রেল স্টেশনে গিয়েছি। সময়টা শীতকাল এবং সম্ভবত তখন কোনো একটা শৈত্যপ্রবাহ চলছে। কুয়াশা ঢাকা ঘোলাটে সূর্যে কোনো উত্তাপ নেই, সারাদেশ শীতের দাপটে জবুথবু হয়ে আছে। আমি সোয়েটার, জ্যাকেট এবং গলায় মাফলার জড়িয়েও শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি। তখন আমি একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখতে পেলাম, তিন-চার বছরের একটি বাচ্চা সম্পূর্ণ উদোম গায়ে রেললাইনের উপর খেলছে, তার শরীরে একটা সুতোও নেই। এই প্রচণ্ড শীতে যখন প্রতিটি মানুষ জাব্বাজোব্বা জড়িয়েও শীত থেকে রেহাই পাচ্ছে না তখন এই শিশুটি প্রচণ্ড শীতের বাতাসে কেমন করে নির্বিকারভাবে উদোম শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটি একটি অবিশ্বাস্য দৃশ্য।
একটা শিশুকে কতদিন না খাইয়ে রাখা যায়, কিংবা কত কম তাপমাত্রায় একটা শিশু বেঁচে থাকতে পারে বা কত কম বাতাসে একটা শিশু নিশ্বাস নিতে পারে এই। ধরনের প্রশ্ন মানুষের মাথায় ঘুরপাক খেলেও কোনো মানুষ কখনোই কোনো পরীক্ষা করে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করার চেষ্টা করে নি। (নাৎসি ডাক্তার ম্যাঙ্গেলাকে আমি মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি না।) কিন্তু মাঝে মাঝেই লোকচক্ষুর আড়ালে বড় হওয়া কোনো অপ্রকৃতস্থ পিতামাতার সন্তান, বড় দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত কোনো শিশু কিংবা ভূমিকম্পে আটকে পড়া কোনো নবজাতকদের দেখে বিজ্ঞানীরা মানব শিশু সম্পর্কে কিছু বিচিত্র তথ্য পেয়ে যান। সিলেট রেল স্টেশনের উদোম গায়ের শিশুটি ছিল একজন অপ্রকৃতস্থ মায়ের সন্তান, অবহেলায় বড় হওয়া সেই শিশুটিকে দেখে আমি অনুমান করেছিলাম একটা শিশুকে জন্মের পর থেকেই অভ্যাস করানো হলে সে নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর শীতেও উদোম গায়ে থাকতে পারে।
তবে মানুষ সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে বনের পশুর কাছে বড় হওয়া কিছু শিশুদের কাছ থেকে। ইতিহাসে এ রকম অনেক ঘটনার বর্ণনা আছে, সবচেয়ে বিখ্যাতটি সম্ভবত গ্রিক উপাখ্যানের রমুলাস এবং রিমাসের কাহিনী। এই দুইজন যমজ ভাইকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কিন্তু নিষ্পাপ শিশু দুটিকে হত্যা না করে তাদেরকে একটা ঝুড়িতে করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত একটি নেকড়ে মা তাদের দুধ খাইয়ে বড় করে। রমুলাস শেষ পর্যন্ত রোমে রাজত্ব করেছিল এবং তার নামানুসারেই রোমের নামকরণ করা হয়েছিল।
গ্রিক উপাখ্যানের এই কাহিনীটি চমকপ্রদ কিন্তু এখন আমরা জানি এটি পুরোপুরি সত্যি হতে পারে না। মানুষ কীভাবে মানুষ হয়ে ওঠে সেটি নিয়ে বিজ্ঞানীদের অনেক কৌতূহল। তারা এখন জানেন যে মানুষের বয়স প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার হলেও কথা বলার জন্যে পরিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতে পারে এ রকম আধুনিক মানুষ তুলনামূলকভাবে অনেক নতুন, মাত্র চল্লিশ হাজার বছর। ভাষা ব্যবহার করা বা একজনের সাথে আরেকজনের ভাব বিনিময়ের এই প্রক্রিয়াটা মানুষ কেমন করে শিখেছে সেটা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। যে কোনো পরিবেশেই মানুষ কী ভাষা ব্যবহার করতে পারে নাকি এটা মানুষকে সামাজিক পরিবেশে রাখলেই সে ভাষা শিখতে পারে সেটি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে এক ধরনের কৌতূহল ছিল। পশুদের কাছে বড় হওয়া শিশুদের থেকে বিজ্ঞানীরা জানেন, ভাষা বা ভাব বিনিময়ের প্রক্রিয়াটা শেখার জন্যে সামাজিক পরিবেশ বা মানুষের সাহচর্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সত্যি কথা বলতে কী ভাষা শেখার জন্যে শিশুদের যে ছোট একটা সময় রয়েছে কোনোভাবে সেই সময়টুকু যদি ব্যবহার করতে না পারে তাহলে পরে যত চেষ্টাই করা যাক না কেন তারা আর ভাষাটুকু শিখতে পারে না।
পশুর কাছে বড় হওয়া মানব শিশুর অনেকগুলো ঘটনা লিপিবদ্ধ থাকলেও সেগুলো যে সবই বিশ্বাসযোগ্য তা নয়। এই বিষয়গুলো নিয়ে মানুষের এত কৌতূহল যে সেটা ব্যবহার করে অনেকেই গাঁজাখুরি গল্প ফেঁদে রেখেছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে লিপিবদ্ধ এ রকম সবচেয়ে পুরনো এবং বিশ্বাসযোগ্য ঘটনাটি ঘটেছে জার্মানির হেমেলিন শহরে 1724 সালে। সেই শহরের মানুষেরা অবাক হয়ে একদিন দেখে কালো চুল বাদামি রঙের একটি বিচিত্র উলঙ্গ কিশোর মাঠেঘাটে ছোটাছুটি করছে। তাকে যখন ধরে আনা হলো শহরের মানুষ আবিষ্কার করল, কিশোরটি পুরোপুরি বুনো স্বভাবের, জ্যান্ত পাখি কাঁচা খেয়ে ফেলে। এ রকম বিচিত্র একটি প্রাণী–কাজেই প্রাচীনকালে যা ঘটার কথা তাই ঘটল, ইংল্যান্ডের রাজা জর্জ ওয়ান তাকে তার প্রাসাদে একটা সংগ্রহ হিসেবে রেখে দিলেন। পিটার নাম দেয়া সেই কিশোরটি রাকি জীবনটা সেখানেই কাটাতে হলো। দীর্ঘ ষাট বৎসরে সে কোনো কথা বলতে শিখে নি, কখনো যে হাসে নি!
পরের ঘটনাটি ঘটেছে ফ্রান্সের দক্ষিণে 1799 সালে। খুব শীত পড়েছে, খাবারের খুব অভাব, পেটের খিদেয় বন থেকে লোকালয়ে একটা বন্য ছেলে এসে হাজির। তাকে ধরে আবিষ্কার করা হলো ছেলেটির আচার-ব্যবহার পুরোপুরি জন্তুর মতো। বরফের মাঝে সে গড়াগড়ি খেতে পারে, তার ঠাণ্ডা লাগে না। অবলীলায় কাঁচা কিংবা পচা খাবার খেয়ে ফেলতে পারে। একজন মানুষ আর পশুর মাঝে পার্থক্য কী সেটা নিয়ে তখন অনেক বিতর্ক চলছে ঠিক তখন এই কিশোরটি মানুষের হাতে ধরা পড়েছে। বিশ্বাস করা হতো সহমর্মিতা আর ভাষা শেখার ক্ষমতা হচ্ছে মানুষ হওয়ার প্রথম শর্ত, কাজেই বৃনে পশুদের মাঝে বড় হওয়া এই কিশোরটি তখন সরার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিশোরটির নাম দেয়া হলো ভিক্টর আর অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীরা তার ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। জা মার্ক গাসপার্ড ইটার্ড নামে। একজন ডাক্তার ভিক্টরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে তাকে বড় করেছিলেন, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাকে কোনো ভাষা শেখানো যায় নি, “দুধ” শব্দটা ছাড়া আর কোনো শব্দ সে উচ্চারণ করতে শিখে নি। ভিক্টরের ভেতর সত্যিকার অর্থে আবেগ বা সহমর্মিতার সে রকম বিকাশ না ঘটলেও স্বামীহারা একজনকে কাঁদতে দেখে তাকে একবার বিচলিত হতে দেখা গিয়েছিল। ভিক্টর 40 বছর বয়সে প্যারিসে মারা যায়।
পশুর কাছে বড় হওয়া সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটেছিল ভারতবর্ষের মেদেনীপুর এলাকাতে। 1920 সালে একটা নেকড়ে মাতার কাছে দুটি বাচ্চা মেয়েকে পাওয়া যায়। নেকড়েটিকে মেরে ফেলে বাচ্চা দুটিকে নিয়ে আসা হলো জোসেফ অমৃত লাল সিং নামে একজন ধর্ম যাজকের কাছে। বাচ্চা দুটির বয়স আট বছর এবং দেড় বছর, বড়জনের নাম রাখা হলো কমলা ছোটজনের অমলা। তাদেরকে যখন ধরে আনা হয় তখন তারা হাত এবং পা ব্যবহার করে চতুস্পদ প্রাণীর মতো ছুটে বেড়ায়, সারাদিন অন্ধকার কোনায় ঘুমিয়ে থেকে রাতের বেলা জেগে ওঠে। গভীর রাতে তারা নেকড়ে বাঘের মতো চিৎকার করত। রান্না করা খাবার খেতে চাইত না, পছন্দ করত কাঁচা মাংস। তাদের ঠাণ্ডা বা গরমের অনুভূতি ছিল না এবং কখনোই বিন্দুমাত্র অনুভূতি প্রকাশ করত না। তাদের একমাত্র যে অনুভূতিটি বোঝা যেত সেটি হচ্ছে ভয়। তাদের ঘ্রাণশক্তি ছিল প্রবল এবং রাতের বেলায় তারা খুব ভালো দেখতে পেত।
অমলা নামের ছোট শিশুটি বছর খানেকের মাঝে কিডনির জটিলতায় মারা যায়। বড়জন আরো নয় বছর বেঁচেছিল।
এই ধরনের অন্যান্য শিশুর মতোই এই বাচ্চাগুলোও সত্যিকার অর্থে কোনো ভাষা শিখতে পারে নি। অনেক চেষ্টায় শেষে কমলাকে কাপড় পরানো শেখানো হয়েছিল। পশুর মতো চার হাত-পায়ে ছোটাছুটি করাই তার জন্যে স্বাভাবিক ছিল। অনেক কষ্ট করে তাকে দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে শেখানো হয়েছিল, যদিও কোথাও দ্রুত যেতে হলে সে চারপায়ে ছুটে যেত।
সবচেয়ে সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য (এবং বিশ্বাসযোগ্য) ঘটনাটি ঘটেছে উগান্ডায় 1991 সালে। মিলি নামে একটা মেয়ে বনের ভেতর হঠাৎ করে একটা মানবশিশুকে বানরদের সাথে দেখতে পেল। গ্রামে এসে সে অন্যদের খবরটা দেয়ার পর গ্রামবাসী সদলবলে গেল বাচ্চাটাকে উদ্ধার করতে। বাচ্চাটি এবং অন্যান্য বানরেরা প্রচণ্ডভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও মানুষেরা তাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসে। তাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে খোঁজ নিয়ে জানা গেল শিশুটির নাম জন সেবুনিয়া। তার যখন বয়স চার বৎসর তখন এক রাতে তার বাবা তার মাকে গুলি করে মেরে ফেলে, সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে সে বনের ভেতর পালিয়ে যায়। এরপর বনের ভেতর সে বানরদের সাথে সাত বছর কাটিয়ে দিয়েছিল।
অন্যদের মতো জন সেবুনিয়া প্রথম প্রথম কথা বলতে পারত না, কিন্তু চেষ্টা করার পর সে বেশ খানিকটা কথা বলতে শিখেছিল। অনুমান করা হয় জীবনের প্রথম চার বৎসর মানুষের সাথে থাকার কারণে সে কথা বলতে শিখেছিল।
পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন-তারা সবসময়েই চট করে এই ঘটনাগুলো বিশ্বাস করতে চান না। অনেকেরই ধারণা এই ঘটনাগুলো অতিরঞ্জিত, বাচ্চাগুলো আসলে কোনো পশু লালনপালন করে বড় করে নি। বাচ্চাগুলো সম্ভবত মানসিক প্রতিবন্ধী কিংবা অটিস্টিক। কাজেই তাদের আচার-আচরণ আসলে পশু দিয়ে লালিত হবার আচরণ নয় মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের বা অটিস্টিক শিশুদের আচরণ।
অনেকেই সন্দেহ করেন আসলেই পশুরা সত্যি সত্যি কোনো মানবশিশুকে লালন করতে আগ্রহী কিংবা সক্ষম কি না। পশুরা মানুষের মতো সহমর্মিতা বা স্নেহ-মমতা দেখাতে পারে কি না এটা নিয়ে অনেকের ভেতরেই একধরনের সন্দেহ ছিল।
তবে ১৯৯৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একটি চিড়িয়াখানায় বিচিত্র ঘটনা সবাইকে নূতন করে ভাবতে শিখিয়েছিল। সাড়ে তিন বছরের একটা বাচ্চা সেই চিড়িয়াখানার গরিলাদের জন্যে সংরক্ষিত জায়গায় উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।
চিড়িয়াখানার কর্মীরা যখন শিশুটিকে উদ্ধার করার জন্যে ছোটাছুটি করছে তখন তারা সবিস্ময়ে দেখল সেখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহিলা গরিলাটি এসে বাচ্চাটিকে খুব সাবধানে কোলে তুলে নিয়ে এক কোনায় গিয়ে বসে থাকে। উদ্ধারকারীরা এসে শিশুটিকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত গরিলা মাতাটি এই শিশুটিকে নিজের সন্তানের মতো পরম মমতায় কোলে নিয়ে বসেছিল।
আমরা মানুষ এবং পশুকে খুব স্পষ্টভাবে বিভাজন করে রাখি–কিন্তু ভালোবাসা এবং মমতার জগতে অনেক জায়গাতেই সেই বিভাজনের দাগটি অস্পষ্ট, পার্থক্যটুকু অনেক সময়ই মিলিয়ে যায়।