1 of 2

১৮. নবীনকুমারের ব্যাধির সংবাদ

রোগীকে দেখতে আসা এবং প্রবল অসুস্থ কিংবা আচ্ছন্ন অবস্থার রোগীর সঙ্গে কথা বলে আত্মপরিচয়দানের চেষ্টা, বঙ্গবাসীরা একটি বিশেষ কর্তব্য বলে মনে করে। নবীনকুমারের ব্যাধির সংবাদ ছড়িয়ে পড়ায় দলে দলে লোক আসার.বিরাম নেই। ইতিমধ্যে এ কথাও ছড়িয়ে গেছে যে নবীনকুমার কানে প্রায় শুনতেই পায় না। সুতরাং দর্শনপ্রার্থীরা তার একেবারে নিকটস্থ হয়ে সগৰ্জনে কথা বলে। নবীনকুমার কারুর কোনো উত্তর দেয় না, বিরক্তিতে মুখ কুঞ্চিত হয়ে থাকে তার। তবু দর্শনার্থীরা নিবৃত্ত হয় না, তারা পরস্পর আলোচনা করে, কোথায় কখন আর কার কার এই প্রকার অসুখ দেখেছে। কবে কোন বাড়িতে এই অসুখে মৃত্যু হয়েছে। কার। নবীনকুমার বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। তবে এই কাল ব্যাধির নিয়মই এই একটা কোনো অঙ্গ নিয়ে যায়। তবে হৃৎপিণ্ডের বদলে যে শুধু কান নিয়ে ছেড়েছে, এই তো নবীনকুমারের বড় ভাগ্য।

গণ্যমান্য ব্যক্তি বা বিশিষ্ট আত্মীয়স্বজনদের নিষেধও করা যায় না। নবীনকুমারের অপছন্দ হলেও তারা আসবেই। অপরাহ্নেই তাদের আসবার সময়। সেইজন্য এখন সেই সময়টা নবীনকুমার ঘুমের ভান করে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকে। দুলালচন্দ্ৰ থাকে পাহারায়। তাকে শিখিয়ে রাখা হয়েছে, ঘরে কেউ এলেই সে ওষ্ঠে তর্জনী ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, চুপ, কতা কইবেন না। ছোটবাবু ঘুমুচ্চেন। কোবরেজমশাই বলেচেন, হঠাৎ ঘুম ভাঙলে খুব ক্ষতি হবে।

এর ফলে ক্ৰমে ক্ৰমে দর্শনার্থীর সংখ্যা কমতে লাগলো। রোগী দেখা নয়, রোগীর কাছে নিজেকে দেখা দেওয়াটাই বড় কথা, সেই রোগীই, যদি দেখতে না পেল তা হলে আর শুধু শুধু এসে লাভ কী! এখন আর অপরাহ্নে নবীনকুমারকে মটকা মেরে শুয়ে থাকতে হয় না। অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে এখন সে কিছুটা হাঁটতে পারে। এক একদিন ছাদেও যায়।

একদিন শেষবেলায় দিবাকর এসে নবীনকুমারের কানের কাছে মুখ এনে চিৎকার করে বললো, ছোটবাবু, নিচে সভার বাবুরা সব এয়েচেন। একবার আপনার সঙ্গে দ্যাকা কত্তে চাচ্চেন, নিয়ে আসবো ওপরে?

নবীনকুমার বিস্মিতভাবে জিজ্ঞেস করলো, সভার বাবুরা? কোন সভার বাবুরা?

দিবাকর বললো, আজ্ঞে আপনার সভা?

নবীনকুমার ভুরু কুঁচকে বললো, আমার সভা? কিসের সভা?

এবার দিবাকরের বিস্মিত হবার পালা। সে বললো, আজ্ঞে, আপনি যে সভা খুলেছেলেন! ফি হাপ্তায় শনিবার শনিবার বাবুরা আসেন। অনেক ভাবের কত হয়।

নবীনকুমার দুলালচন্দ্ৰকে জিজ্ঞেস করলো, কিসের সভা বলচে রে দুলাল?

দুলালচন্দ্র বললো, আজ্ঞে ঐ আপনার বিদ্যোৎসাহিনী সভা।

দিবাকর বললো, আপনি একদিন জ্বর বিকারের ঘোরে বলেছেলেন যে আপনি না যেতে পাল্লেও সভার কাজ যেন বন্ধ না থাকে। আপনি মলেও সভার কাজ চলবে। তাই আমি সব বাবুদের খপর দিয়ে আনিয়েচি। আজ শনিবার তো। এয়েচেন আজ দশ-বারো জনা।

দেখা গেল, বিদ্যোৎসাহিনী সভা সম্পর্কে যেন নবীনকুমারের আর কোনো আগ্রহই নেই। অথচ তার অসুখের আগের দিন পর্যন্তও এই সভাই ছিল তার ধ্যান জ্ঞান। সভার বিবরণী লেখা, আগামী সভার জন্য কাৰ্যসূচী নিরূপণ করা, সভার পক্ষ থেকে ইদানীং যে পত্রিকা বেরুচ্চে তার জন্য রচনা এবং গ্রাহকদের পত্রের উত্তর দেওয়া। এই নিয়েই সময় অতিবাহিত করতো। সে।

নবীনকুমার নীরস কণ্ঠে বললো, অত চেঁচিয়ে কতা বলে না, দিবাকর। তোমরা কি আমার কানের পদটিাও ফাটিয়ে দিতে চাও?

দিবাকর জিজ্ঞেস করলো, বাবুদের ওপরে আনবো না?

–না!

দিবাকর আর দুলালচন্দ্র পরস্পর বিহ্বল দৃষ্টি বদল করলো। বিদ্যোৎসাহিনী সভা সম্পর্কে তাদের ছোটবাবুর হঠাৎ এই নিরাসক্তি যেন তারা বিশ্বাসই করতে পারছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিবাকর নিষ্ক্রান্ত হলো ঘর থেকে।

পরদিন দ্বিপ্রহরে আর একটি ঘটনা ঘটলো।

আহারাদি সমাপ্ত করে নবীনকুমার নিজের পালঙ্কে শুয়ে আছে। দিবানিদ্ৰা দূর করার জন্য এই সময় সে গ্ৰন্থ পাঠ করে। সংস্কৃত কাব্য মুখে মুখে অনুবাদ করে সে সরোজিনীকে শোনায়। সরোজিনী এখনো অন্দরমহল থেকে আসেনি। নবীনকুমার ঘন ঘন দ্বারের দিকে তাকাচ্ছে।

এক সময় সরোজিনী এসে পাঠমগ্ন নবীনকুমারের কানে কানে বললো, দেকুন, দেকুন, কে এয়েচে!

নবনীকুমার মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কে?

সে দেখতে পেল, দ্বারের কাছে মাথায় ঘোমটা দেওয়া এক কিশোরী দণ্ডয়ামান। এক গলা ঘোমটা, মুখ দেখা যায় না।

নবীনকুমার আবার জিজ্ঞেস করলো, কে?

সরোজিনী বললো, অ কুসোমদিদি, কাচে এসো না। আহা হা, তোমার আবার এত লজ্জা কিসের? চেনো না য্যানো!

কিশোরীটি সে রকম ব্ৰীড়াবিনতামুখী হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো।

সরোজিনী নবীনকুমারকে ছেড়ে সেখানে গিয়ে নিজেই কিশোরীটির মুখ থেকে অবগুণ্ঠন সরিয়ে দিয়ে বললো, এই দেকুন, আমার দিদির মিতেনী, আমাদের কুসোমদিদি। মনে নেই, সেই যে আপনাকে একদিন শাড়ী পরা নিয়ে ক্ষেপিয়েছেল?

কুসুমকুমারী তার নীল চক্ষুমণি দুটি নবীনকুমারের মুখের দিকে স্থির রেখে ঝরনা-লহরীর মতন সুমিষ্ট স্বরে বললো, কেমন আচেন মিতেনীর বর? আপনার অসুখ শুনে আপনাকে দেকতে এলুম।

সরোজিনী তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, আ কুসোমদিদি, উনি কানে ভালো শুনতে পাচ্চেন না, কাচে গিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলতে হবে। ডাক্তার-কোবরেজরা বলেচেন অবশ্য আর কাঁটা দিন পেরুলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে, আবার আগেকার চেয়ে বেশী কানে শুনতে পাবেন–তোমার কতগুলোন আমি বরং ওঁর কানে কানে বলে দিচ্চি!

হাত ধরে ধরে সে কুসুমকুমারীকে নিয়ে এলো পালঙ্কের কাছে।

নবীনকুমার ধীর স্বরে বললো, এ মেয়েটি কে, চিনতে পারলুম না তো!

সরোজিনী বললো, আহা-হা, মস্করা হচ্চে, কুসোমাদিদিকে চিনতে পারচেন না? সেই যে, আপনাদের থ্যাটারের আগের দিন এয়েছেল। আপনি ওর কাচ ঠেঙে শাড়ী পরে হাঁটার ধরন শিকতে চাইলেন…

নবীনকুমার কুসুমকুমারীর নীল চক্ষু দুটি দেখতে লাগলো। তারপর আপনমনেই বললো, কই, এ মুখ আগে দেকেচি বলে মনে তো পড়ে না।

কুসুমকুমারীও নবীনকুমারকে দেখছে একদৃষ্টে। নবীনকুমারকে চিনতে তারও যেন কষ্ট হচ্ছে খুব। তার সখী কৃষ্ণভামিনীর স্বামী নবীনকুমারকে সে প্রায় দেখেছিল অতিশয় প্রাণবন্ত, অতিশয় চঞ্চল এক কিশোর, চক্ষু দুটি অত্যুজ্জ্বল। পরে সরোজিনীর স্বামী হিসেবেও তাকে প্রায় একই রকম দেখেছিল। কিন্তু এ কোন নবীনকুমারকে এখন দেখছে সে! শরীরই শুধু কৃশ নয়, চক্ষু দুটি নিষ্প্রভ। মুখে পাণ্ডুর ছায়া, কণ্ঠস্বর নিষ্প্রাণ।

কুসুমকুমারী বললো, আমার নাম বনজ্যোৎসা, মনে পড়ে না?

সরোজিনী স্বামীর কানে সেই বার্তা প্রেরণ করবার জন্য ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে বললো, কুসোমদিদি বলচে, ওর আর একটা নাম বনজোছছনা! এবার চিনতে পেরেচেন?

নবীনকুমার দুদিকে মস্তক আন্দোলিত করলো।

জলে ভরে গেল কুসুমকুমারীর চক্ষু, নীল মণিদুটি আর দেখা গেল না। একবার বুঝি তার ওষ্ঠাধর সামান্য একটু কাঁপলো, তারপরই সে পিছন ফিরে দৌড় লাগালো, মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তার শাড়ীর আঁচল।

সরোজিনীও চলে গেল কুসুমকুমারীর পিছু পিছু। নবীনকুমার আবার পুস্তক পাঠে মনোনিবেশ করলো।

সরোজিনী ফিরে এলো বেশ খানিকক্ষণ পর। আফসোসের সুরে বললো, এহ, ছি, ছি, আপনি এমনধারা ব্যাভার করলেন কুসোমদিদির সঙ্গে? কত কাঁদলো! নিজে থেকে এয়েছেল আপনাকে দেকতে।

নবীনকুমার কথাগুলি ভালো শুনতেও পেল না, ভ্রূক্ষেপও করলো না।

সরোজিনী স্বামীর কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে কর্ণকুহরে বললো, আপনি সত্যি করে বলুন তো, কুসোমদিদিকে সত্যি চিনতে পারেননি?

নবীনকুমার বললো, না। মেয়েটি কে? কাদের বাড়ির যেন বউ মনে হলো। মেয়েটি একলা এয়েচে? ওর স্বামী আসেনি?

—ওর স্বামী যে ঘোর পাগল! আপনি একবার গেসলেন ওদের বাড়িতে।

—আমি গোসলাম কবে?

—আপনার সত্যি মনে নেই!

নবীনকুমারের মুখমণ্ডলে এবার একটু ব্যথার ছাপ পড়লো। সে অস্থিরভাবে বললো, আমার মনে পড়াচে না তো আমি কী করবো বলতে পারো? আমি কী মিচে কতা বলচি?

সরোজিনী ভয় পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ।

আরও কয়েকটি ঘটনার পর সকলেই বুঝতে পারলো যে এই কঠিন ব্যাধিতে নবীনকুমারের শ্রবণশক্তিই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, তার স্মৃতিশক্তিও অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গেছে। অনেক কিছুই তার মনে পড়ে না, অনেক মানুষকেই সে আর চিনতে পারে না। বিদ্যোৎসাহিনী সভার কথা তার মনে নেই। যে বিধবা বিবাহের ব্যাপার নিয়ে সে এত মত্ত হয়েছিল, এখন সে ঐ প্রসঙ্গ একবারও উচ্চারণ করে না। ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের নামও বোধহয় তার স্মরণে নেই।

আবার অনেক চিকিৎসক বদ্যি ডেকে আনা হলো। যথারীতি, সকলেরই ভিন্নমত। তবে, সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য মতামত মনে হলো এই যে, কোনো ঔষধ প্রয়োগে স্মৃতিশক্তি বা শ্রবণশক্তি ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিছু সময় দিলে স্বাভাবিকভাবেই ওগুলি আবার ফিরে আসতে পারে। নবীনকুমারের বয়েস কম, তার জীবনীশক্তিতেই সে পুনরায় পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠবে। এখন সবাগ্রে প্রয়োজন স্বাস্থ্যোদ্ধার। এবং স্বাস্থ্যোদ্ধারের শ্রেষ্ঠ উপায় বায়ু পরিবর্তন।

বিম্ববতী তাঁর পুত্রকে কিছুতেই চোখের আড়াল করতে চান না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিধুশেখরও উপদেশ দিলেন, কিছুদিনের জন্য নবীনকুমারকে বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হোক।

কোথায় পাঠানো হবে, তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করা হলো কয়েকদিন। কেউ বললো, বর্ধমান, ওদিককার জল হাওয়া ভালো, ওদিকে সচরাচর ওলাওঠা হয় না। কেউ বললো, কৃষ্ণনগর, অনেকেই সেখানে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য যায়। বারানসীর নামও উঠলো। মহাদেবের ত্রিশূলাগ্রে অবস্থিত ঐ বারানসী ধাম, সেখানকার তো তুলনাই হয় না। কিন্তু বারানসী বড় দূরের পথ, অতখানি ঝুঁকি নেওয়া যায় না।

শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, কোনো বিশেষ স্থলে নয়, নবীনকুমারকে ভ্ৰমণ করানো হবে নদীপথে। শীতকাল সমাসন্ন, এসময় নদীর বাতাস অতিশয় তেজ-বর্ধক। নদীর সজীব মৎস্য আর দু তীরের গ্রামাঞ্চলের টাট্‌কা তরিতরকারি পরিপাকের পক্ষে অতি উত্তম।

এলাহী বন্দোবস্ত হলো নবীনকুমারের নদী ভ্ৰমণের। তিনখানি বজরা ও চারখানি পানসী নিয়ে একটি বহর। দাস-দাসী-পাঁচক লাঠিয়াল এবং বন্দুকধারী সেপাই-এর দলবল ছাড়াও সঙ্গে নেওয়া হলো একজন কবিরাজ ও একজন অ্যালোপাথ। দিবাকর দুলালচন্দ্রের মতন বিশ্বস্ত কর্মচারীরাও রইলো। আর নেওয়া হলো সরোজিনীকে। এখন সরোজিনী শুধু নবীনকুমারের স্ত্রী এবং সঙ্গিনীই নয়, বার্তাবাহকও বটে।

নদীপথে পথেই পরিভ্রমণ করা হবে, তবে যদি কখনো জলযাত্রায় ক্লান্তি বোধ হয় তাহলে একটি বিশ্রামের স্থলও নির্দিষ্ট রইলো। কুষ্টিয়ার দিকে সিংহ পরিবারের একটি জমিদারি আছে, সেখানে আছে একটি অতি মনোহর কুঠিবাড়ি। আগে থেকেই স্থলপথে লোক পাঠিয়ে দেওয়া হলো সেখানে, কুঠিবাড়িটি সাজিয়ে গুছিয়ে প্রস্তুত করে রাখবে।

শুভদিন দেখে শান্তি স্বস্ত্যয়ন করে নিমতলার ঘাট থেকে গঙ্গাবক্ষে শুরু হলো যাত্রা। তখন কেল্লা থেকে মধ্যাহ্নের তোপ দাগ হচ্ছে। যেন নবীনকুমারের সম্মানেই শোনানো হলো সেই তোপধ্বনি।

দু-তিনদিন নবীনকুমার বেশ উৎফুল্ল হয়ে রইলো। শহর ছেড়ে এই প্রথম তার অন্য কোথাও যাত্ৰা। কাব্য-সাহিত্যের মধ্য থেকে সে বহু স্থানের বর্ণনা পাঠ করেছে। তার দেখতে ইচ্ছে করে সেই সব দেশ। সে সমুদ্র দর্শন করেনি, পাহাড় দেখেনি, অথচ মনশ্চক্ষে সে সমুদ্র ও পাহাড় দেখতে পায়। এবার সে স্বচক্ষে সব দেখবে।

কিন্তু দু-তিনদিন পরই আবার তার সব উৎসাহ চলে গেল। সে মলিন, বিষণ্ণ মুখে বোটের জানলা দিয়ে নদীর সৈকতের দিকে চেয়ে থাকে। সরোজিনী এসে ডাকলেও সে সাড়া দেয় না। সরোজিনী জোর করে কথা বলবার জন্য তার হাত ধরে টানাটানি করে, তবু সে নির্বাক।

গৃহের বাইরে এসে, বিশাল প্রকৃতির মধ্যে আশ্রয় নিয়ে নবীনকুমারের আরও মন খারাপ হয়ে গেছে। প্রকৃতির সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে না। সে জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু শুনতে পায় না জল-কল্লোল। আকাশ দিয়ে কত রকম পাখি উড়ে যায়, বজরার কাছে অনেক পাখি এসে বসে। কিন্তু সে কোনো পাখির ডাক শুনতে পায় না। সে দেখতে পায় মাঝি-মাল্লারা দাঁড়-বৈঠা চালাবার সময় মুখ ঠোঁট নাড়ছে, নিশ্চয়ই ওরা গাইছে কোনো গান কিংবা সমবেত স্বরে দিচ্ছে জোকার। কিন্তু নবীনকুমার শুধু দেখে, শুনতে পায় না কিছু। কোনো গঞ্জের সামনে এসে যখন বজরা থামে, তখন ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ফেরিওয়ালারা আসে, তারা নবীনকুমারের গবাক্ষের কাছে ডিঙ্গি ভিড়িয়ে হাতমুখ নেড়ে অনেক কিছু বলে, নবীনকুমারের কিছুই বোধগম্য হয় না। সে বিরক্ত হয়ে শয্যায় শুয়ে পড়ে চিৎপাত হয়ে।

স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে বলে নবীনকুমারের কৌতূহলও কমে গেছে। বরং সরোজিনীই মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, ওটা কোন গাছ, এটা কী পাখি, এখানে জলের রঙ দুরকম কেন? নবীনকুমার সংক্ষেপে উত্তর দেয়, জানি না।

স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য সরোজিনী প্রায়ই তার কানে ওষ্ঠ ঠেকিয়ে গান শোনায়। তার গলাটি বেশ সুরেলা। উড়িষ্যাবাসী গোপালের যাত্রাগান তার বাপের বাড়িতে প্রায়ই হতো। তাই শুনে শুনে সে কয়েকটি গান তুলেছে। কিন্তু নবীনকুমারের এখন আর গানও ভালো লাগে না। এমনকি সরোজিনীর স্পর্শেও রোমাঞ্চ বোধ করে না সে। সে শব্দবঞ্চিত বলে যেন সব কিছু থেকেই বঞ্চিত।

 

এইভাবে মাসাধিককাল কেটে যাবার পর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলো। এই পৃথিবী যেন আবার শব্দময় হয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠলো তার সামনে। খুবই আস্তে আস্তে অবশ্য। নবীনকুমার অনুভব করলো, সমস্ত রকম শব্দ মিলিয়ে এই বিশ্ব-ভুবনে একটি ব্যঞ্জনা আছে। আগে যখন তার স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি ছিল তখন এ সব চিন্তা তার মস্তিষ্কেই আসেনি। এখন সে টের পেল সব রকম ধ্বনির সমন্বয়ে একটি বিশেষ ধ্বনির সৃষ্টি হয়, তার মধ্যেই যেন ফুটে ওঠে পরিপূর্ণ জীবনের স্পন্দন।

কোনো অলৌকিক উপায়ে নবীনকুমার একদিনেই শ্রবণ-ক্ষমতা ফিরে পায়নি। একদিন সে চকিতে বুঝলো, মাঝি-মাল্লাদের মুখ নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক প্রকার শব্দও বেরুচ্ছে, সে শব্দের মর্ম সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু শব্দগুলি যেন দুলতে দুলতে ভেসে আসছে তার কানে। আর একদিন রাত্রে ঘুম ভেঙে সে যেন শুনতে পেল এক অনৈসৰ্গিক সঙ্গীত। এ সঙ্গীত নদীর নিজস্ব। ছলাৎ ছিল কল কল তার তান। এতদিন সে এ সঙ্গীত শোনেনি। সে এতই মুগ্ধ হয়ে গেল যে সে তৎক্ষণাৎ উঠে বসলো। সারারাত না ঘুমিয়ে সে শুনলো সেই জলস্বর।

নানান নদীপথ ঘুরে এখন তাদের বজরার বহর চলেছে পদ্মার ওপর দিয়ে। নবীনকুমারের কাছাকাছি এসে কেউ একটু উচ্চ কণ্ঠে কথা বললেই সে সব বুঝতে পারে। সে তৃষ্ণার্তের মতন বোটের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে সব রকম শব্দ শুনবে বলে।

সন্ধ্যা অনেকক্ষণ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। মাথায় পৌষ মাসের হিম পড়ছে বলে নবীনকুমার এক সময় বোটের ছাদ থেকে নেমে এলো নিজের কামরায়। সে দেখলো, একটি গবাক্ষের কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে সরোজিনী গুনগুনিয়ে গাইছে, আমি যে লাজে মরি, মনের কতা কইতে পারি নে, কত লোকে কত কতা বলে, আমি যে সইতে পারি। নে।

নবীনকুমারের সর্বাঙ্গ অকস্মাৎ শিহরিত হলো। সাদা রেশমী শাড়ি পড়েছে সরোজিনী। পিঠের ওপর চুল ছড়ানো। সে অন্য দিকে চেয়ে আছে, তবু তার গানের মর্ম বুঝতে পারছে নবীনকুমার। সে যেন এই প্রথম সরোজিনীর গান শুনলো। কানে কানে গান একদিন দুদিনই ভালো লাগে, তারপর বিরক্তি বোধ হয়। এই তো প্রকৃত গান, যা আনমনা, এ যেন সরোজিনীরই মনের ভাবোচ্ছাস সুর হয়ে বেরিয়ে আসছে।

নবীনকুমার এগিয়ে গিয়ে সরোজিনীর পিঠে হাত দিয়ে বললো, সরোজ, তুমি বড় সুন্দর, মনে হলো যেন তোমায় আমি আগে কখনো দেকিনি।

সরোজিনী মুখ ফিরিয়ে তাকালো। তার দুই চক্ষু জলে ভরে উঠলো।

নবীনকুমার বললো, এ কি সরোজ, তুমি কাঁদছো?

সরোজিনী বললো, আমার ভয় করে।

—তোমার কিসের ভয়?

—এই যে আপনি মাঝে মাঝে অমন কতা বলেন। আমার ভয় করবে না? আপনি অনেক কতা ভুলে যান। আপনি অনেককে চিনতে পারেন না। আমার মনে হয়, আপনি একদিন আমাকেও চিনতে পারবেন না।

-দূর পাগল! তা হয় নাকি? তোমায় চিনতে পারবো না? যাঃ!

—তবে যে আপনি ঐ কতটা বললেন?

–কী বললাম?

—আমায় আগে কখুনো দ্যাকেননি?

–আরে ও তো অন্যভাবে বলিচি, আগে দেকিনি মানে এমনভাবে দেকিনি। আজ যেন তোমায় নতুন করে এত সুন্দর দেকচি!

সরোজিনী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বললো, সত্যি সত্যি সত্যি তিন সত্যি করুন যে আমায় কখুনো ভুলে যাবেন না?

নবীনকুমার হাসতে হাসতে সরোজিনীকে বক্ষে টেনে নিল।

সেই রাত্রে ষোড়শ-উত্তীর্ণ সম্প্রতি সপ্তদশবর্ষীয় নবীনকুমার তার দ্বাদশবর্ষীয় সদ্য ঋতুমতী পত্নীকে সর্বাংশে গ্ৰহণ করলো।

পরদিন প্ৰভাতে নবীনকুমার বললো, সরোজ, শেষ রাতে আমি একটা ভারি আশ্চর্য মিঠে স্বপ্ন দেকিচি। সেই স্বপ্নের রেশ এখুনো মনে লেগে আচে। সরোজ, জীবন কত সুন্দর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *