১৮. দ্য ওয়েইং অব দ্য ওয়ান্ডস
রোববার সকালে হ্যারির ঘুম ভাঙলে, একটু সময় লাগে বুঝতে শরীরটা কেন যুৎসই নয়–ভারি বিষাদ লাগছে। তাছাড়া চিন্তিত। তারপর গতরাতের সব ঘটনা ওর সামনে ভেসে ওঠে। ও ছেঁড়া পর্দা আর নিজের চারটে পোস্টারের দিকে। তাকায়। ওর মন চাইছে রনের ঘুম ভাঙিয়ে তাকে বলতে যে ও নিজ থেকে করেনি। কিন্তু রন কোথায়? ভাল করে দেখেনি রন ওর খাটে শুয়ে আছে কি নেই। রনের বিছানা এলোমেলো শূন্য। ও নিশ্চয়ই একাই ব্রেকফাস্ট খেতে চলে গেছে।
হ্যারি রাতের পোশাক পাল্টে প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে কমনরুমের দিকে এগোয়। অনেকেরই তখন ব্রেকফাস্ট শেষ হয়ে গেছে। ওকে দেখে সকলেই হৈ চৈ করে নতুন করে অভিনন্দন জানাতে থাকে। হ্যারির গ্রেট হলে যাবার ইচ্ছা চলে গেল। সকলেই ওকে নায়ক হিসেবে ভেবে চলেছে। ও গ্রিফিন্ডরদের সঙ্গে না গিয়ে ক্রিভে ব্রাদারর্সদের সঙ্গে বসে কথা বলতে ইচ্ছা করল। ওরা অনেকক্ষণ ধরে ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইছে মনে হল।
মন থেকে সেসব চিন্তা বাদ দিয়ে হ্যারি সুরজের কাছে গেল। ঠেলে দরজাটা খুলে দুচার স্টেপ উঠতেই হারমিওনের মুখোমুখি হয়ে গেল।
হারমিওন ন্যাপকিনের জড়ান একগাদা টোস্ট হাতে নিয়ে যাচ্ছিল। হ্যারিকে দেখে বলল–হ্যালো… তোমার জন্য টোস্টগুলো নিয়ে যাচ্ছিলাম… একটু হাঁটতে যাবে?
হ্যারি হাসতে হাসতে বলল–উত্তম প্রস্তাব।
ওরা নিচে নেমে এনট্রেন্স হল পেরিয়ে, গ্রেট হলের দিকে না তাকিয়ে লেকের লনের দিকে চলল, ওখানে ডারমস্ট্রংগ স্কুলের জাহাজ নোঙর করা আছে। লেকের জলে জাহাজের প্রতিবিম্ব পড়ছে। একটু যেন কৃষ্ণবর্ণ। ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। টোস্ট কামড় দিতে দিতে নীরবে ওরা লেকের পাড় দিয়ে হাঁটতে লাগল। তারপর নীরবতা ভঙ্গ করে গত রাতের সব কথাবার্তা, ঘটনা হারমিওনকে বলল।
হারমিওন, হ্যারির কথা একমনে শুনল, কোনও প্রশ্ন বা প্রতিবাদ করল না। মনে হয় বিশ্বাস করল।
হারমিওন সব কথা শোনার পর বলল–আমি জানি, অবশ্যই তুমি দাগ পেরিয়ে গবলেটে পার্চমেন্ট দাওনি। ডাম্বলডোর তোমার নাম বলার পর আমি তোমার মুখ দেখেছি। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন কে তোমার নাম গবলেটে দিলো। মুডি ঠিক কথা বলেছেন তোমার নাম গবলেটে দেওয়া কোনও ছাত্রদের কাজ নয়। ওদের গবলেটকে বোকা বানানো বা ডাম্বলডোরের সতর্কবাণী উপেক্ষা করার সাহস হবে না।
হ্যারি ওকে বাধা দিয়ে বলল–তুমি রনকে দেখেছ?
হারমিওন জবাব না দিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে।
–ও … মনে হয় ব্রেকফাস্ট খাচ্ছিল তখন।
–ও কী তখনও বিশ্বাস করে আমি লাইন পেরিয়ে নিজ হাতে নাম দিয়ে এসেছি?
–না, বোধহয়… মানে আমার মনে তেমন সন্দেহ নেই। হারমিওন একটু বেখাপ্পা বলল।
–না, বোধ হয়, মানে কী?
–ওহ হ্যারি, তোমার আসল কথা বুঝতে এত সময় লাগে কেন? বুঝতে পারছ, তুমি সিলেক্ট হয়েছ বলে ও একটু জেলাস!
–জেলাস? হ্যারি–অবিশ্বাসের সুরে বলল–কিসের জন্য জেলাস? ও কি সকলের সামনে নিজেকে নিজে বোকা বানাতে চায়? তুমি বল?
হারমিওন গম্ভীর হয়ে বলল–শোনা, তুমি ভাল করেই জান-একমাত্র তোমাকেই সকলে মনোযোগ দিতে চায়। আমি জানি তার জন্য তুমি দায়ী নও। তারপরই সঙ্গে সঙ্গে বলল হ্যারির রাগরাগ মুখ দেখে আমি জানি সকলের মনোযোগ তুমি মোটেই পছন্দ করো না… কিন্তু… ওয়েল, তুমি জান…. রন কখনই ওর ভাইদের সঙ্গে বাড়িতে রেষারেষি করে না, তুমি ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তোমার নাম আছে। যখন তোমার কাছে লোকেরা আসে তখন ওর দিকে কেউ তাকায় না। কিন্তু তুমি ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু বলে ওটা মেনে নেয়। আমি জানি; কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনও ও আমাকে এসব কথা বলেনি। তাই মনে হয়…।
–দারুণ, দারুণ বলেছ, হ্যারি তিক্ত কণ্ঠে বলল–সত্যিই মহানুভবতা। ওকে বলবে। আমার স্থানটি আমি ওকে দেব এবং তার স্থানে আমি যাব, যখনই ও চাইবে। যেখানেই যাই তখন সকলেই আমার কপালের কাটাদাগ নিয়ে অনেক রিসার্চ করে আলোচনা করে। আমার এ ভার সে বহন করুক।
হারমিওন অতি সংক্ষেপে বলল–দুঃখিত হ্যারি, আমি এ নিয়ে ওর সঙ্গে কোনও আলোচনা করতে চাই না।… দরকার মনে করলে তুমি নিজেই বলবে। বিবাদ মিটে যাবার এটাই একমাত্র পথ।
–আমি ওকে বোঝানোর জন্য ওর পেছনে পেছনে ছুটতে চাই না। হ্যারি কথাগুলো এত সশব্দে বলল যে, গাছের ওপরে বসে থাকা প্যাঁচাগুলো ভয় পেয়ে গাছ থেকে আকাশে উড়ে গেল।… ও বোধহয় বিশ্বাস করবে আমার ঘাড় ভেঙে গেলে খুব আনন্দ পাবে এই কথা শুনে।
হারমিওন বলল–বাজে কথা বলবে না।… ঘাড় ভাঙা মোটেই মজার ব্যাপার নয় হ্যারি। আমি ভাবছি এখন কি করা যায়…. আমাদের কি করতে হবে, তুমি ভাবছ না? চল, সোজা ক্যাসেলে গিয়ে ওকে ধরি।
–ঠিক বলেছ, ওর পাছায় একটা লাথি মারতে হবে।
–যা যা ঘটেছে তুমি সিরিয়সকে লিখে জানাবে। তোমাকে তো বরাবরই হোগার্টে যা ঘটছে জানাতে বলেছেন।… তুমি জানলে অবশ্যই তিনি সমাধান জানাবেন।
–কেমন করে?
–হ্যারি মনে রেখ যা ঘটেছে সেটা চেপে রাখার ব্যাপার নয়। খুবই মারাত্মক হারমিওন খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বলল। টুর্নামেন্টটা নামকরা, তুমিও টম–ডিক নয়। আমি খুবই আশ্চর্য হব যদি ডেইলি প্রফেট এই ব্যাপারটা নিয়ে চুপ থাকে। তুমি সিলেকটেড ওরা কোনমতেই ছোট করে দেখবে না। তোমার প্রতি ইউ–নো–হুর নজর আছে তা তুমি ভাল করেই জান। সিরিয়স তাই ব্যাপারটা বিশেষ করে জানতে চাইবে।
–ঠিক আছে, আমি অবশ্যই লিখব, হ্যারি বলল।
কথাটা বলে অবশিষ্ট টোস্ট ছুঁড়ে লেকের জলে ফেলে দিল। তারপর ওরা ক্যাসেলে ফিরে এল।
–কার প্যাঁচা আমি পাঠাই? হ্যারি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল… আমাকে তো আবার হেড–উইগকে পাঠাতে নিষেধ করেছেন।
রনকে জিজ্ঞেস কর ওরটা পাওয়া যাবে কিনা–হ্যারি সোজাসুজি বলল–আমি ওরি কাছে চাইতে যাবো না।
–বেশ তাহলে স্কুল থেকে নাও।
ওরা দুজনে আউলারিতে গেল। হারমিওন হ্যারিকে লেখার জন্য কলম, কালি আর পার্চমেন্ট কাগজ দিল সিরিয়সকে লেখার জন্য। হ্যারি প্যাচাঁদের দেখতে দেখতে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে লিখল
প্রিয় সিরিয়স,
আপনি বলেছিলেন, হোগার্টে যা কিছু ঘটবে আপনাকে
জানাতে, তাহলে আপনাকে জানাচ্ছি। আমি ঠিক জানি না আপনি শুনেছেন
কিনা–ট্রাইউইজার্ড টুর্নামেন্ট
এ বছরে হচ্ছে, গত শনিবার
রাতে আমাকে চতুর্থ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। আমি বলতে পারি না কে আমার নাম গবলেট অব ফায়ারে
দিয়েছে, কারণ আমি দিইনি। হোগার্ট থেকে হাফপাফের সেডরিক ডিগরি চ্যাম্পিয়ন
নির্বাচিত হয়েছে।
এইটুকু লিখে হ্যারি থামল চিন্তা করতে লাগল। গতাত থেকে যে উদ্বেগের বিরাট বোঝা ওর বুকে চেপে বসে রয়েছে… সেই উদ্বেগের ব্যাপারে কিছু জানানোর প্রবল ইচ্ছা হল। কিন্তু কেমন করে সাজিয়ে–গুজিয়ে সেটা লিখবে বুঝে উঠতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত কলমটা কালির দোয়াতে চুবিয়ে শুধুমাত্র একটি ছত্র লিখল চিঠির শেষে।
আশাকরি আপনি ভাল আছেন,–হ্যারি।
–শেষ হয়েছে, হ্যারি হারমিওনকে বলল।… হ্যারি দাঁড়াল হাত ঘুরিয়ে প্যান্টের পেছন থেকে ঘাস–খড় ঝেড়ে নিল।… হেডউইগ সেই সময় উড়ে এসে ওর কাঁধে বসল। তারপর একটা পা বাড়িয়ে দিল।
–আমি তো তোমাকে দিয়ে চিঠি পাঠাতে পারবো না। কথাটা বলে স্কুলের প্যাঁচা খুঁজতে থাকে। আমাকে ওদের থেকে একটা বাছতে হবে।
হেডউইগ অসম্ভব শব্দ করে ডেকে উঠে আবার উড়ে গেল। ওড়ার সময় ওর একটা পায়ের নখ দিয়ে হ্যারির কাঁধে আঁচড় লেগে গেল।… হেডউইগ হ্যারির চারপাশে ঘুরতে লাগল। হ্যারি একটা বড় প্যাঁচার পায়ে চিঠিটা বেঁধে দিতেই ঝাঁ করে উড়ে গেল।
হেডউইগও নীল আকাশে ভেসে চলল। ও ভীষণ রেগে গেছে চিঠিটা ওকে দিয়ে স্কুলের অন্য প্যাঁচাকে দেয়াতে।
.
ক্লাস শেষ হবার পর হাফলপাফ, গ্রিফিন্ডরের ছাত্ররা হ্যাগ্রিডের কেবিন থেকে চলে গেলে, হ্যাগ্রিড যেতে দিলেন না। না যেতে দেয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ওর সঙ্গে নিরিবিলিতে আলোচনা করা। হাফলপাফ আর গ্রিফিন্ডরের ছাত্ররা ইদানীং হ্যারিকে এড়িয়ে চলেছে।
ওরা গেছে তাদের স্ক্রিউটদের নিয়ে মাঠে।
হ্যাগ্রিড হ্যারিকে বললেন–তো তুমি একজন প্রতিযোগী। টুর্নামেন্ট স্কুল চ্যাম্পিয়ন।
হ্যারি শুধরে দিয়ে বলল–কয়েকজনের মধ্যে একজন। হ্যাগ্রিডের কুচকুচে কাল চোখ দুটো খুব রাশভারি দেখলে ওর মোটাসোটা দুই রুর তলায়।
–তাহলে তুমি জানো না কে তোমার নাম দিয়েছে?
আপনি অন্তত বিশ্বাস করতে পারেন আমি দিইনি; হ্যারি বলল।
–নিশ্চয়ই করি; হ্যাগ্রিড ঘোৎ ঘোঁৎ করে বললেন।
–আমি শুধু নয়, ডাম্বলডোরের তাই মত।
–আমার খুব জানতে মন চায় কে করেছে, হ্যারি তিক্ত কণ্ঠে ঘরের ভেতর থেকে ওরা দুজনে বাইরের লনে তাকিয়ে রইল। ওরা দেখল ক্রিউটদের নিয়ে সকলেই নাজেহাল। ওরা বেশ মোটাসোটা আর বড় হয়ে গেছে। দেখতে হয়েছে বড় বড় কাঁকড়া বিছে আর দীর্ঘ কাঁকড়ার মিশ্রণে। কম করে তিনফুট লম্বা, প্রচুর শক্তিশালী। এখন আর বর্ণহীন–শক্ত বহিরাবরণহীন নয়। হালকা হালকা চকচকে মোটা ছাল গায়ে। এখনও তাদের মাথা অথবা চোখ আছে কি নেই বোঝা যায় না। এত শক্তিশালী যে ধরে রাখা সম্ভবপর নয়।
হ্যাগ্রিড খুব খুশি হয়ে বলল–ওদের নিয়ে খুব মজা করছে ছেলে মেয়েগুলো। ক্রিউট সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই।
হ্যারি চুপ করেছিল। হ্যাগ্রিড বললো–আহ আমিও জানি না হ্যারি। হ্যাগ্রিড বেশ লম্বা শ্বাস নিলেন। মুখে চিন্তার ছাপ।… স্কুল চ্যাম্পিয়ন… সবকিছুই ঘটে যাচ্ছে। তাই না?
হ্যারি কোনও জবাব দিল না। হ্যাঁ, একের পর এক কত কি ঘটে যাচ্ছে। হারমিওনের সঙ্গে লেকের ধারে হাঁটার সময় হারমিওন ওই একই কথা বলেছিল।
***
তারপরের কটা দিন হোগার্টে চরম দুঃখের দিন বলতে হয়। সব সময় মনে উদ্বেগ অশান্তি। সতীর্থরা বলে, ও যখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ত তখন নাকি অযথা ঝগড়া মারামরি করত। কিন্তু নানা গোলমালে–গণ্ডগোলে রন কখনও ওর পাশ থেকে সরে যায়নি–সবসময় সঙ্গ দিয়েছিল। হ্যারি ভাবে স্কুলের ছেলেদের বিশ্রি ব্যবহার, অশভ্য কথাবার্তা, সন্দেহ এর সবকিছুর মোকাবিলা করতে পারবে রন যদি অতীতের মত ওর পাশে থাকে। প্রকৃত বন্ধুর মত। কিন্তু রন নিজে থেকে এগিয়ে এলে হ্যারি ওর সঙ্গে তেমন অন্তরঙ্গ হবে না, নতুন করে ওকে বিষয়টা বোঝাবার চেষ্টা করবে না।… তবু যাই হোক, চতুর্দিক থেকে বিশ্রী পরিবেশ বোঝার মত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। খুব একাকী মনে হয়।
ও হাফপাফের ভাবনা–চিন্তা বুঝতে পারে–ওরা ওকে পছন্দ নাও করতে পারে–ওদের তো দলের একজন চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। স্লিদারিনদের নোংরা হিংসুটে অপমান–তার বেশিকিছু তাদের কাছ থেকে আশা করে না। ওদের গ্রুপের ছেলে মেয়েদের কাছে ও খুবই অপ্রিয় কারণ কিডিচ খেলায় গ্রিফিন্ডরের কাছে জিততে পারে না। শুধু তাই নয় ইন্টার হাউজ প্রতিযোগিতায়ও। কিন্তু র্যাভেন ক্ল? ওরা তো ওকে সাপোর্ট করতে পারে… কিছু বেশি না হোক সেডরিকের মত। ওর ধারণা ভ্রান্ত; বেশিরভাগ র্যাভেন ক্লরা মনে করে ও পাগলের মত নানা রকমভাবে কারচুপি করে গবলেট অব ফায়ারে নাম দেয়াতে ওর ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে। চালাকি… আগাগোড়া চালাকি করেছে হ্যারি।
তাছাড়া সেডরিককে দেখলেই বোঝা যায় ও চ্যাম্পিয়ন হবার যোগ্য নয়। সুন্দর দেখতে, সোজা নাক, মাথাভর্তি কাল চুল আর ধূসর দুই চোখ। বোঝা যাচ্ছে না হোগার্টের ছেলে–মেয়েরা কাকে বেশি পছন্দ করছে সেডরিক না ভিক্টর ক্রাম? হ্যারি চোখ এড়ায় না, সিক্সথ ইয়ারের মেয়েরা যারা এতদিন ভিক্টরের অটোগ্রাফের জন্য ছোটাছুটি করত তারা এখন ছুটছে ফেডরিকের পিছু পিছু। লাঞ্চের সময় ফেডারিককে ভিক্ষা চাওয়ার মত অটোগ্রাফ চাইছে।
ইতোমধ্যে হ্যারি সিরিয়সের জবাব পায়নি। হেডউইগ রেগে আছে… এখন আর ধারে কাছে আসে না। ট্রেলা আরও চমৎকার! অদূর ভবিষ্যতে হেডউইকের মৃত্যু হবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। সে তো আছেই; কিন্তু প্রফেসর ফ্লিটউইকের সামোনিং চার্মদের অনুশীলনে এত খারাপ করেছে বলা যায় না। তাই ওকে অতিরিক্ত হোমওয়ার্ক করতে হচ্ছে। নেভিল ছাড়া সকলেই ওর যেন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফ্লিটউইকের ক্লাস শেষ হবার পর হ্যারির শুকনো মুখ দেখে হারমিওন বলল প্রফেসর ফ্লিটউইক তো খুব সোজাসোজা পড়াচ্ছেন, ভাল করে বোঝাচ্ছেন, না বোঝার তো কোনও কারণ নেই। চুম্বকের মত সারা ক্লাস ঘোরেন। ডাস্টার, ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট আর লুনা স্কোপ নিয়ে তার কারবার খুবই সোজা। আসলে তুমি ক্লাসে ওর কথা ভাল করে শোন না। তাই ক্লাস বোঝ না।
আশ্চর্য কেন এমন হল? দেখল সেডরিক একদল ছাত্রীদের সঙ্গে যাচ্ছে। যাবার সময় সকলে ওর দিকে তাকাল। ও যেন হ্যারি নয়-একটা বিরাট ক্রিউট!
হ্যারি আর হারমিওন লাঞ্চ খাবার পর যখন স্নেইপের অন্ধকার কারাকক্ষের সামনে দাঁড়াল, দেখল স্লিদারিনরা প্রত্যেকে বুকে ব্যাজ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছাত্র–ছাত্রী সবাই। হঠাৎ একনজরে হ্যারির মনে হল ওরা যেন S.PE.W ব্যাজ বুকে লাগিয়েছে… কিন্তু না, একইরকম ব্যাজ, লেখা জ্বলজ্বলে লাল অক্ষরে… কম আলোর আন্ডারগ্রাউন্ড প্যাসেজে লাল অক্ষরগুলো আরও যেন জ্বলজ্বল করছে। ব্যাজে লেখা:
সাপোর্ট সেডরিক ডিগরি
আসল হোগার্ট
চ্যাম্পিয়ন।
ম্যালফয় ওকে দেখে উচ্চস্বরে বলল, কেমন হয়েছে পটার?… আরও দেখ…?
ম্যালফয় ওর বুকে আটা ব্যাজে আঙ্গুল দিয়ে টিপতেই লেখাটা বদলে গেল।
পটার টিংকস পটার পচা
লেখা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে স্লিদারিনরা চিৎকার করে উঠল শুধু নয় খিল খিল করে হেসে উঠল। সকলেই ম্যালফয়ের মত বুকের ব্যাজ আঙ্গুল দিয়ে টিপল… পরিষ্কার করে ফুটে উঠল পটার স্টিংকস। হ্যারির মুখ, গলা আগুনের মত গরম হয়ে উঠল।
হারমিওন স্লিদারিনের প্যানসি পার্কিনসন ও তার দলবলকে বলল, বাঃ বেশ মজার ব্যাপার তো। স্লিদারিনের ছেলেমেয়েরা ভীষণভাবে হাসছিল। সত্যি উদ্ভাবনী শক্তি আছে বলতে হবে।
রন, ডিন আর সিমাসের সঙ্গে একধারে দাঁড়িয়েছিল। ওদের সঙ্গে হাসাহাসি করছিল। হ্যারিকে দেখেও দেখল না।
ম্যালফয় একটা ব্যাজ হারমিওনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল–চাই?
–আমার অনেক আছে। আমার হাতে হাত লাগাবে না। এইমাত্র আমি হাত ধুয়ে এসেছি, আর নোংরা করতে চাই না, হারমিওন বলল।
হ্যারি রাগে ফুঁসছিল। ও জাদুদণ্ডটায় হাত দিল। অনেক দিনের বুকের মধ্যে জমাট বাধা রাগ ও শেষ করে দিতে চায়। সেখানে বেশ ভিড় জমে গেল।
–হ্যারি! হারমিওন বাধা দিল।
ম্যালফয় নিজের জাদুদণ্ডটা বার করে বলল–বেশ, বার কর পটার। মুডি এখানে নেই তোমাকে বাঁচানোর জন্য। সাহস থাকে তো বার কর তোমার জাদুদও।
দুজনে–দুজনের দিকে তাকাল। মাত্র এক সেকেন্ড।
ফার্নানকুলাস–হ্যারি জোরে জোরে বলল।
ডেনসাওজিও–ম্যালফয় আরও জোরে বলল।
দুজনের জাদুদণ্ডের মুখ থেকে আগুন বেরিয়ে এল। সেই আগুন একে অপরকে আঘাত করল। তারপর কোনাকুনি ছিটকে গেল। হ্যারির আগুন গোয়েলের গালে লাগল। ম্যালফয়ের হারমিওনের মুখে। গোয়েল মুখ নামিয়ে নাকে হাত চাপা দিল। সেখানটায় ফোঁড়ার মত ফুলে উঠে–হারমিওন দারুণ আতঙ্কে দুহাতে মুখ ঢাকল।
–হারমিওন! রন দৌড়ে ওর দিকে গেল। হ্যারি দেখল রন হারমিওনের হাতটা মুখ থেকে সরাতে চেষ্টা করছে। আগে থেকেই হারমিওনের সামনের দুটো দাঁত বড়। এখন সেই দুটো আরও বড় হয়ে গেছে। দাঁত দুটো বেড়েই চলেছে। দাঁত দুটো লম্বা হওয়াতে ওকে অনেকটা উভচর প্রাণী বিবরের মত দেখাচ্ছে।
হারমিওন ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল।–ওর দাঁত বেড়েই চলেছে।
-এই তোমরা এখানে কি সব করছ? স্নেইপ সেখানে এসে গম্ভীর তীব্র স্বরে বললেন
স্লিদারিনরা নিজেদের পক্ষ নিয়ে কিছু বলবার চেষ্টা করবার আগেই স্নেইপ তার একটা হলুদ বর্ণের আঙ্গুল ম্যালফয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন–তুমি বল কি হয়েছে?
হ্যারি বলল–আমরা একই সময় দুজনে দুজনকে আক্রমণ করেছি।
–পটার আগে করেছে স্যার–ওই দেখুন গোয়েলের অবস্থা।
স্নেইপ এগিয়ে এসে গোয়েলকে দেখলেন। সারা মুখটা যেন বিষাক্ত ফাংগাসে ফুলে উঠেছে।
স্নেইপ বললেন–ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাও।
রন তখন বলল–দেখুন স্যার, ম্যালফয় হারমিওনের কি অবস্থা করেছে। দেখুন, দেখুন স্যার।
ও জোর করে হারমিওনের মুখটা তুলে স্নেইপকে দেখাল। ও আপ্রাণ চেষ্টা করছে হাত দিয়ে মুখটা চাপা দেয়ার। কিন্তু খুবই অসুবিধে। দাঁত দুটো তখন কণ্ঠা পর্যন্ত চলে এসেছে। প্যানসি পারকিনসন, স্নিদারিনের অন্য মেয়েরা হারমিওনের মুখের অবস্থা দেখে হি হি করে হেসে ফেটে পড়ল। স্নেইপের দৃষ্টির আড়ালে বার বার হারমিওনকে হাত দিয়ে দেখাতে লাগল।
স্নেইপ হারমিওনের দিকে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন–দেখছি দুজনের একই অবস্থা।
হারমিওন রাগে, অপমানে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। তারপর দৌড় দিল। দেখতে দেখতে ও দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
সৌভাগ্য বলতে হবে হ্যারি আর রন দুজনেই একই সঙ্গে স্নেইপের দিকে তাকিয়ে চেঁচাতে লাগল। ওদের চিৎকার আর প্রতিধ্বনিতে স্নেইপ কিছুই ওদের কথার মানে বুঝতে পারলেন না। অদ্ভুত পরিস্থিতি! শেষ পর্যন্ত সামান্য বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা।
–দেখা যাক কি করতে পারি। রেশমের মত সুরেলা কণ্ঠে স্নেইপ বললেন। পঞ্চাশ পয়েন্ট কাটবে গ্রিফিন্ডরের আর পটার ও উইসলির ডিটেনসন। যাও ঘরে যাও, অমান্য করলে সপ্তাহ খানেক ডিটেনসন হতে পারে।
হ্যারির কান ঝন ঝন করছিল। অবিচারের জন্য স্নেইপকে অভিশাপ দিতে মন চাইল। ও রনের সঙ্গে অন্ধকার কক্ষের পেছনে চলে এল। তারপর টেবিলের ওপর স্কুল ব্যাগটা শব্দ করে রাখল। রন রাগে ঠক ঠক করে কাঁপছিল। মনে হল দুজনের সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু তাহলেও ও ডিন আর সিমাসের পাশে বসে পড়ল। হ্যারি টেবিলের ধারে একা দাঁড়িয়ে রইল। ম্যালফয় স্নেইপের দিক থেকে পেছন ফিরল। ওর বুকে আঁটা ব্যাজটা আঙ্গুল দিয়ে টিপে বোকার মত হাসল।
ব্যাজে আবার ফুটে উঠল : পটার স্টিংকস
ক্লাস শুরু হলে হ্যারি স্নেইপের দিকে তাকিয়ে রইল। বীভৎস ব্যাপারটা ভাবল।… যদি ওর জানা থাকত কুসিয়েটাস কার্স… তাহলে ও মাকড়সার মত স্নেইপের পিঠে পড়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিত।
আন্টি ডোর্টস স্নেইপ বললেন, তারপর ছাত্র–ছাত্রীদের দিকে তাকালেন। তার ঠাণ্ডা কাল চোখ জ্বল জ্বল করতে লাগল। আশাকরি তোমরা সকলে সব সরঞ্জাম নিয়ে এসেছ। এখন তোমরা সেগুলো যত্ন করে মেশাও তারপর তোমাদের মধ্যে একজনকে পরীক্ষা করতে বলব। স্নেইপ হ্যারির দিকে তাকালেন। হ্যারি জানে তারপর স্নেইপ কি বলবেন। স্নেইপ ওর সারা শরীর বিষাক্ত করে দেবেন। হ্যারির ইচ্ছা করল ওর কলড্রনটা তুলে ক্লাসের সকলের সামনে স্নেইপের তেল চকচকে মাথায় ছুঁড়ে মারে।
হ্যারির স্নেইপের মাথায় কলড্রন ছুঁড়ে মারার স্বপ্ন ভেঙে গেল। কে যেন স্নেইপের ঠাণ্ডা অন্ধকার ঘরের দরজায় নক করল।
ঘরে ঢুকলেন কলিন ক্রিভে। হ্যারির দিকে সোজা তাকিয়ে স্নেইপের ডেস্কের কাছে গেলেন।
–বলুন? স্নেইপ অসৌজন্যভাবে বলেন।
–স্যার আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে হ্যারিপটারকে উপরে নিয়ে যেতে পারি।
স্নেইপ কলিনের দিকে মুখ নামিয়ে তাকালেন। ওর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।
স্নেইপ ঠাণ্ডা গলায় বললেন–হ্যারি পটারের পোসানের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস শেষ হতে আরও একঘন্টা লাগবে। ক্লাস শেষ হলে ওপরে যাবে।
কলিনের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল।
–স্যার, স্যার মি. ব্যাগম্যান ওকে ডাকছেন। কলিন সামান্য নার্ভাস হয়ে বলল।
–সব চ্যাম্পিয়নরা ওখানে গেছে… ফটো তোলা হবে।
হ্যারির কলিনের কথা একটুও মনে ধরছে না… বিশেষ করে একসঙ্গে ফটো তোলার ব্যাপারে। একবার বনের দিকে তাকিয়ে দেখল ও মুখ তুলে ছাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
স্নেইপ বললেন–খুব ভাল, খুব ভাল। পটার তোমার জিনিসপত্র এখানে রেখে ফটো তোলা হলেই চলে এসো। তারপর তোমার তৈরি প্রতিষেধক টেস্ট করা যাবে।
–স্যার, সঙ্গে ওর বইপত্র নিয়ে যেতে বলেছেন। কলিন ককিয়ে ককিয়ে বলল। সব চ্যাম্পিয়নরা।
–খুব ভাল, অতি ভাল, স্নেইপ ঠাণ্ডা স্বরে বললেন। পটার তুমি তোমার জিনিসপত্র নিয়ে আমার সামনে থেকে যাও!
হ্যারি ওর স্কুলের ব্যাগটা পিঠে চাপিয়ে দাঁড়াল, দরজার দিকে পা বাড়াল।
স্লিদারিন ছাত্রদের ডেস্কের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তাদের চারদিক থেকে ব্যাজে ফুটে উঠল : পটার স্টিংকস
হ্যারি ক্লাসরুমের দরজাটা বন্ধ করে করিডোরে দাঁড়ালে কলিন বলল–তুমি চ্যাম্পিয়ন হয়েছ বলে সবাই এইসব বাদরামী করছে, তাই না? মজার ব্যাপার।
হ্যারি হেসে বলল–মজার ব্যাপার তো বটেই।… ওরা এনট্রেন্স হলের দিকে চলল। খানিকটা যাবার পর হ্যারি বলল–ফটো দিয়ে কী হবে কলিন?
–মনে হয় ডেইলি প্রফেট চাইছে।
হ্যারি বলল–দারুণ। পাবলিসিটি… পাবলিসিটি আমার দরকার। খুব বেশি প্রচার…।
হ্যারি ও কলিন ঠিক জায়গায় পৌঁছবার পর হ্যারি দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকার আগে কলিন বলল–গুড লাক! হ্যারি ঘরে ঢুকল।
ঘরটা ছোট একটা ক্লাসরুমের মত। ঘরের মাঝখানে অনেকটা খালি জায়গা করার জন্য সব চেয়ার টেবিল দেয়াল ঘেঁষে রাখা। ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে তিনটে টেবিল এক সঙ্গে রাখা। টেবিলের ওপরটা খুব লম্বা ভেলভেট দিয়ে ঢাকা। সেই টেবিলের (তিনটে ঠেকিয়ে রাখা) সামনে পাঁচটা চেয়ার রয়েছে। তার মধ্যে একটাতে লুডো ব্যাগম্যান বসে আছেন। একজনের সঙ্গে কথা বলছেন যাকে হ্যারি আগে কখনও দেখেনি। তার পরনে টকটকে লাল রোব।
ভিক্টর ক্রাম স্বাভাবিকভাবে সকলের কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখে তেমনি ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কারও সঙ্গে কথা বলছে না। সেডরিক আর ফ্লেউর নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আগে যেমন মেয়েটিকে গম্ভীর দেখেছিল তো নয়! খুব খুশি খুশি মন। মাঝে মাঝে স্বভাব মত মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে লম্বা চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। ওর রূপালী চুলে মাঝে মাঝে আলো পড়ে চকচক করে উঠছে। একজন পেটমোটা লোক একটা বড় ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্যামেরা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। এক চোখ দিয়ে ক্যামেরা ফেউরকে দেখছে। বেগম্যানের চোখ পড়ে গেল হ্যারির দিকে। চেয়ার ছেড়ে ওকে জড়িয়ে ধরার জন্য এগিয়ে গেলো না–আহা চ্যাম্পিয়ন নাম্বার ফোর এসে গেছে। এসো এসো এদিকে এসো। চিন্তার কোনও কারণ নেই… ম্যাজিক দণ্ড ওজন করার উৎসব। বাকি সব বিচারকরা এখনি এসে পড়বেন।
হ্যারি সামান্য হকচকিয়ে বলল–দণ্ড ওজন করার উৎসব?
প্রথাগতভাবে তোমারটা ওজন করতে হবে। নো প্রোবলেম। তোমার সামনে যেসব কাজ রয়েছে তার জন্য তোমার জাদুদণ্ড খুবই দরকারী যন্ত্র, বেগম্যান বললেন-এ বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তিরা ওপরে ডাম্বলডোরের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছেন। তারপর ওরা এলে ফটো তোলা হবে। এনাকে হয়ত তুমি চেনো না। রিটা স্কীটার যে জাদুকরী রক্তলাল আলখেল্লা পরে বসেছিলেন তাকে দেখালেন বেগম্যান। বললেন, ডেইলি ফেটের হয়ে টুর্নামেন্ট সম্বন্ধে একটা ছোট প্রতিবেদন লিখবেন।
–ঠিক বললেন না, খুব ছোট একটা কিছু হবে বলে মনে হয় না, রিটা বলল।
মহিলা মাথার চুল অদ্ভুতভাবে কার্ল করে বেঁধেছেন। বড় চোয়াল–খুব বে মানান। চোখে তার মণি–মুক্ত খচিত চশমা। হাতে কুমীরের চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ। আঙ্গুলের ইঞ্চি দুই লম্বা নখগুলো গোলাপী রঙ-এ রঞ্জিত।
–ছবি তোলা সেশনের আগে যদি হ্যারির সঙ্গে দুচারটে কথা বলতে পারতাম তবে ভাল হত, রিটা বেগম্যানকে বললেন। কিন্তু তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখনও হ্যারির ওপর নিবদ্ধ।–জানেনতো বয়সে সবচেয়ে ছোট চ্যাম্পিয়ন, ওর সম্বন্ধে একটু রং ফলাতে হবে তো!
–অবশ্যই, বেগম্যান বললেন–অবশ্য হ্যারির যদি কোনও আপত্তি না থাকে।
–না, নেই, হ্যারি বলল।
–চমৎকার! রিটা স্কীটার বললেন–কথাটা বলেই উল্কি দেওয়া আঙ্গুল দিয়ে খুব শক্ত করে হ্যারির হাতের উপরিভাগ ধরলেন। তারপর একটা দরজা খুলে হ্যারিকে বাইরে নিয়ে গেলেন।
–ভেতরে বড় গোলমাল, নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে না, রিটা বললেন আহা, বড় সুন্দর জায়গা। ছিমছাম নিরিবিলি! হ্যারি বলল-এখানের আলমারিতে আমাদের ম্যাজিক ঝাড়ু রাখা হয়। রিটা আবার বলল–সুন্দর, অতি সুন্দর নিরিবিলি জায়গা। সেখানে বসার কোন চেয়ার নেই। আছে একটা ফুটো বালতি আর কার্ডবোর্ডের বাক্স। রিটা হ্যারিকে বাক্সের ওপর বসিয়ে, নিজে বালতিটা উল্টো করে বসল। খোলা দরজাটা উঠে বন্ধ করে দিতেই জায়গাটা আরও অন্ধকার হয়ে গেল। শুরু করা যাক।
রিটা ওর কুমিরের চামড়ার হ্যান্ডব্যাগটা খুলে তার ভেতর থেকে কয়েকটা মোমবাতি বের করে দটা দুলিয়ে সেগুলো জ্বালালো। শূন্যে সেগুলো এমনভাবে রাখল যাতে ভাল করে দেখতে পাওয়া যায়।
–হ্যারি আশাকরি তুমি কিছু মনে করবে না, যদি আমি তাড়াতাড়ি লেখার জন্য দ্রুত লিখিয়ে পালক দিয়ে নোট করি?
তাহলে কথা বলতে বলতে নোট করতে সুবিধে হবে।
স্বাভাবিকভাবে কথা বলা যাবে, কি বল?
হ্যারি বলল–আলোচনার বিষয়?
রিটা স্কীটারস হাসল। হ্যারি দেখল ওর কয়েকটা দাঁত সোনার। রিটা হ্যান্ডব্যাগ থেকে লম্বামত অ্যাসিড সবুজ পালক আর কিছু পাকান পার্চমেন্ট বের করল। তারপর সেগুলো কোলের ওপর রাখল। পার্টমেন্টের পাশে সব মুছিয়ে জাদুর রাবার পালকটা রেখে বুজ পালকটা দাঁতে চেপে ধরল। সেটা কয়েক মুহূর্ত পরে মজাসে কিছু খাচ্ছে তেমনিভাবে টানলো। পালকটা সামান্য কেঁপে উঠল।
–টেস্টিং… আমার নাম রিটা স্কীটার, ডেইলি প্রফেট, রিপোর্টার।
হ্যারি ঝট করে অ্যাসিড–গ্রীন পালকের দিকে তাকাতেই দেখল পালকটা কিছু লিখতে শুরু করেছে পার্চমেন্টে লম্বালম্বি :
অতি আকর্ষণীয় সুন্দর দেহী স্বর্ণাভ কেশযুক্তা রিটা স্কীটার, তেতাল্লিশ বর্ষীয়া, যার দুর্দান্ত পালক অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিদের মিথ্যা খ্যাতি ফুটো করে দিয়েছে
–অতি সুন্দর, রিটা স্কীটার আবার বলল–পার্চমেন্টের ওপরের অংশটা ছিঁড়ল, মুড়ে সেটাকে হ্যান্ডব্যাগে রেখে দিল। তারপর হ্যারির দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল–কী বল শুরু করা যাক। ট্রাউইজার্ড টুর্নামেন্টে যোগ দেবার–কি কারণে তোমার ইচ্ছা হয়েছিল?
–ও হ্যাঁ, হ্যারি বলল, কিন্তু পালক ওকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করল। ও কিছু না বললেও, কুইল খসখস করে লিখে চলল
একটি কুৎসিত কাটাদাগ অতীতের দুঃখজনক এক ঘটনার চিহ, হ্যারি পটারের সুন্দর মুখটা বিকৃত করেছে, ওর চোখ
কুইলের দিকে তাকিও না হ্যারি, রিটা বলল। অনিচ্ছায় হ্যারি রিটার দিকে তাকাল-এখন আমার প্রশ্নের জবাব দাও–কেন তুমি প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে মনস্থ করেছিলে হ্যারি?
হ্যারি বলল–আমি মনস্থ করিনি। তাছাড়া গবলেট অব ফায়ারে কত নাম দেয়া হয়েছিল তাও আমি জানি না। অন্তত আমার নাম আমি দিইনি।
রিটা স্কীটার মোটা করে আঁকা ধনুকের মত একটি ভুরু তুলল। শোন হ্যারি ভয় পাবার কোনও কারণ নেই। আমরা সকলে জানি তুমি নাম দাওনি–ও নিয়ে অযথা চিন্তা করবে না। আমাদের পাঠকরা একজন বিদ্রোহীকে ভালবাসে।
–আমি নাম দিইনি, কে দিয়েছে তাও জানি না।
–তোমার প্রতিযোগিতা সম্বন্ধে মতামত কী?
–আমি এখনও কিছু ভাবিনি।
–অতীতে চ্যাম্পিয়নরা মারা গেছে–তুমি জান? রিটা চটপট করে প্রশ্ন করল সে সম্বন্ধে আদপেই তুমি কিছু ভেবেছ?
হ্যারি বলল–শুনেছি এবারে সে আশঙ্কা নেই।
পালকটা কাগজের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরতে থাকে। অনেকটা আইস স্কেটিং-এর মত।
–মনে হয় এর আগে তুমি চোখের সামনে মৃত্যু দেখেছ? কথাটা বলে রিটা হ্যারির জবাব শোনার জন্য আরও বুকে পড়ল।
–তোমাকে সেই মৃত্যু কতটা আলোড়িত করেছে?
হ্যারি আবার বলল–ও হ্যাঁ।
–তুমি কী মনে কর অতীতের সেই মানসিক আঘাত তোমাকে… সেই জন্যই তুমি… মানে তোমার জানার প্রবল আগ্রহ, কেন তাদের মৃত্যু হয়েছিল।
–আমি কোনও কারণেই নাম দিইনি হ্যারি বিরক্তির মুখে বলল।
–তোমার কি বাবা-মার কথা আদপেই মনে আছে?
–না।
–তুমি টুর্নামেন্টে প্রতিযোগিতায় নামছ একথা জানতে পারলে তারা কি মনে করতেন? দুশ্চিন্তা?
রাগ?
হ্যারি এবার সত্যি রেগে গেল। তারা তো বেঁচে নেই, অতএব কি মনে করতেন সে প্রশ্ন আসে কেমন করে? ও দেখল প্রশ্নটার জবাব না পেয়ে রিটা ওর দিকে তীব্র ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে। ভুরু কুঁচকেছে। হ্যারি ওর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কুইল কি লিখেছে দেখার জন্য তাকাল।
বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ আসতে ওর দুই অদ্ভুত গভীর সবুজ চোখ জলে ভরে গেছে। তাদের কথা ওর স্মৃতিতে নেই।
লেখাটা পড়া হলে হ্যারি উচ্চস্বরে বলল–কে বলেছে আমার চোখ জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে?
রিটা কিছু বলার আগেই যে দরজার পাশে ঝাড়ু থাকে সেটা খুলে গেল। হ্যারি দেখল দরজার গোড়ায় ডাম্বলডোর দাঁড়িয়ে রয়েছেন। চোখের দৃষ্টি দুজনের ওপর।
ডাম্বলডোর–চিৎকার করে রিটা স্কীটার বলল। মুখ চোখ দেখে মনে হয় খুশিতে ডগমগ।
–কেমন আছেন? রিটা বলল। কথাটা বলে ও ওর পুরুষেলী হাতটা ডাম্বলডোরের দিকে বাড়িয়ে দিল।
–আশাকরি এই গরমকালে আমার লেখা ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অব উইজার্ভস কনফারেন্স আপনি পড়েছেন।
অতি জঘন্য, ডাম্বলডোর বললেন। ও দুই চোখ কৌতুকে নাচতে শুরু করেছে।
–আমি আমার সম্বন্ধে তোমার লেখাটা পড়েছি
–কিছু মনে করবেন না ডাম্বলডোর মাঝে মাঝে আপনার মন্তব্য সকলে বলেছে সেকেলে। আমার কথা নয়, জনসাধারণ বলেছে।
ডাম্বলডোর বললেন–তোমার বিরক্তিকর কথাবার্তা, অহেতুক অদ্রতার কারণ জানতে পারলে খুবই খুশি হবো রিটা।…. ব্যাপারটা পরে আলোচনা করা যাবে। ঝাড়ু ওজন বিলম্ব করার কোনও কারণ নেই।
হ্যারি ছাড়া পেয়ে বাঁচল। এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে সেভরিকের পাশে বসে পড়ল। ভেলভেট কভার দেওয়া টেবিলের দিকে তাকাতেই দেখল শূন্য চেয়ারগুলো আর শূন্যে নেই। পাঁচজনের মধ্যে চারজন বিচারক বসে রয়েছে–প্রফেসর করকার, মাদাম ম্যাক্সিম, মি. ক্রাউচ আর লাডো বেগম্যান। একটু পর রিটা স্কীটার ঘরে ঢুকে এককোণে বসে পড়লো। তারপর লেখাগুলো কোলের ওপর রেখে দ্রুত লিখিয়ে পালক মুখ দিয়ে চুষে করে আবার পার্টমেন্টের ওপর রাখলেন।
ডাম্বলডোর নিজের আসনে বসে বললেন–মি. অলিভেন্ডারের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে পেরে আমি ধন্য। ডনি এখন চ্যাম্পিয়নদের জাদুদণ্ডের পরীক্ষা করবেন ও দেখবেন সেগুলো ঠিক আছে কিনা। টুর্নামেন্ট শুরু হবার আগেই চেকিং পর্ব শেষ হবে।
ডাম্বলডোরের কথা শুনে মি. অলিভেন্ডারকে দেখে চমকে উঠল হ্যারি। বৃদ্ধ জাদুকর! মানুষটি বড়ই চেনা। ভাবতে ভাবতে ওর মনে পড়ে গেল… তিন বছর আগে ডিয়াগন অ্যালেতে তো এরই কাছে জাদুদও কিনেছিল ও।
মি. অলিভেন্ডার ঘরের মধ্যস্থলে শূন্যস্থানে গিয়ে বললেন–ম্যাডাম ডেলাকৌর আপনারটা কি প্রথমে…?
ডেলাকৌর, অলিভেন্ডরের কাছে গিয়ে তার জাদুদণ্ডটা দিলেন।
–হুম, অলিভের বললেন
অলিভেন্ডর এক এক করে সেডরিক ও ক্রামের জাদুদণ্ড টেস্ট করলেন। কারও ওয়াভে কোনও খুঁত পেলেন না। সকলেই খুবই যত্নের সঙ্গে রেখেছে।
হ্যারির ডাক পড়ল ও ক্রামের পাশ দিয়ে মি. অলিভেন্ডরের হাতে ওর জাদুদণ্ড দিল।
–আহ, হ্যাঁ অলিভেন্ডর বললেন, ওর বিনীতদ্যুতি চোখ দুটো দীপ্ত হয়ে উঠল।… হা হা পটার তোমাকে আমার বেশ মনে আছে।
হ্যারির মনে পড়ে গেল। মনে হল গতকালই যেন অলিভেন্ডরের দোকান থেকে দণ্ডটা কিনেছে।
চার গ্রীষ্মের আগে ওর বয়স যখন এগার হ্যাগ্রিডের সঙ্গে মি. অলিভেন্ডরের দোকানে গিয়েছিল। হ্যারির মাপটা নিয়ে একে একের পর এক দণ্ড দেখিয়েছিল। শেষে হ্যারির উপযুক্ত একটা দণ্ড পেলেন। সেটা হ্যারিকে দেখিয়ে বলেছিলেন দণ্ডটা হোল্পি দিয়ে (জামের মতো রসাল ফলযুক্ত চিরশ্যামল গাছ) তৈরি। এগার ইঞ্চি লম্বা একটা পালক ফনিক্সের লেজ থেকে নেওয়া। মি. অলিভেন্ডর খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন হ্যারির ওই দণ্ডটি মানানোর জন্য। বলেছিলেন অবাক কাণ্ড। হ্যারি জিজ্ঞেস করেছিল অবাক কাণ্ড… তার মানে। মি. অলিভেন্ডর বলেছিলেন, হ্যারি জাদুদত্রে সঙ্গে যে পালকটা আছে সেটা ফনিক্স পাখির। লর্ড ভোল্টেমর্টের দণ্ডতে সেই একই পাখির পালক আছে।
হ্যারি সেই সংবাদ কাউকে বলেনি। ওর নিজের ওয়ান্ড খুব প্রিয়। ভোল্ডেমর্টের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। মি, অলিভেন্ডর আর বিশেষ কিছু বলেননি।
অন্যদের জাদুদণ্ড পরীক্ষা করতে অলিভেন্ডর যে সময় নিয়েছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি হ্যারি পটারের ফনিক্স পাখির পালক দেওয়া জাদুদণ্ড পরীক্ষা করতে সময় নিলেন।
ডাম্বলডোর বললেন–ধন্যবাদ, এবার তোমরা যেতে পার।… ডিনারও খেয়ে নিতে পার। হ্যারি যাবার আগে যে লোকটি কাল ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল লাফিয়ে উঠে বলল–ফটো ডাম্বলডোর ফটো।
বেগম্যান একই কথা বললেন।–চ্যাম্পিয়ন্স এবং বিচারকদের গ্রুপ ফটো। রিটা তুমি কি মনে কর?
রিটা বলল–যা, ফটো তোলা আগে। ওর দৃষ্টি তখনও হ্যারির ওপর নিবদ্ধ। কিছু ফটো আলাদা নিলে ভাল হবে। গ্রুপ নয়।
ফটো পর্ব শেষ হলে হ্যারি ডিনার খেতে নিচে গেল। হারমিওনকে সেখানে চোখে পড়ল না। ও তখনও দাঁতের ব্যাপারে হাসপাতালে। ও টেবিলের শেষ প্রান্তে একাই ডিনার খেল। তারপর গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে চলে গেল। অনেক বাড়তি কাজ শেষ করতে হবে। সামনিং চায়ের কাজও করতে হবে। ডরমেটরিতে রণের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
রন বলল–তোমার প্যাঁচা। ও হ্যারির বালিশের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল। লশী পাচা ওর জন্য বসেছিল।
হ্যারি বলল–ঠিক আছে।
রন বলল–আমাদের আগামীকাল রাতে আটক থাকতে হবে স্নেইপের অন্ধকার ঘরে।
কথাটা বলে গটগট করে বেরিয়ে গেল রন, যাবার সময় হ্যারির দিকে তাকাল। হ্যারি ভাবল রনের পিছু পিছু যাওয়া যায়, ওর সঙ্গে কথা বলতে। কেন কথা বলছে না সে জানা দরকার। কিন্তু ওর বিছানায় সিরিয়সের চিঠি নিয়ে প্যাঁচা বসে রয়েছে। চিঠিতে কি জবাব দিয়েছেন সেটাই জানা দরকার। হ্যারি প্যাঁচার পা থেকে চিঠিটা খুলে নিল।
হ্যারি,
আমি চিঠিতে তোমাকে কিছুই লিখতে পারছি না। মাঝপথে সেটা খোয়া যেতে
পারে। আমাদের মুখোমুখি কথা বললে ভাল হবে। বাইশ নভেম্বর রাত একটার সময় তুমি কি গ্রিফিন্ডর
টাওয়ারে থাকতে পারবে? আমি অন্যদের চেয়ে ভাল করে জানি তুমি নিজেকে নিজে সামলাতে পার।
ডালডোর ও মুডি যখন তোমার কাছেই রয়েছেন তখন তোমাকে কেউ ছুঁতে সাহস করবে না। তাহলেও মনে হচ্ছে একজন তোমাকে ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে। ওই টুর্নামেন্টে
তোমার যোগদান
খুবই ভাবনার বিষয়। ডাম্বলডোরের উপস্থিতিতে কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। হ্যারি, চতুর্দিকে চোখ
রেখে চলবে। আমি অস্বাভাবিক কিছু জানাতে চাই। বাইশ নভেম্বর সম্বন্ধে তোমার মত আমাকে শীঘ্র জানাবে।
সিরিয়স