১৮. তারকার আত্মহত্যা
রবির বিয়ের পরপরই ঠাকুরবাড়িতে অনেক ওলটপালট ঘটে গেল।
স্বামীর মৃত্যুতে সৌদামিনী সংসারে উদাসীন হয়ে পড়লেন। সেই সংবাদ পেয়ে মহর্ষি কিছুদিনের জন্য পাহাড় থেকে নেমে এলেন জোড়াসাঁকোয়।
নবদম্পতিকে চারটি মোহর দিয়ে আশীর্বাদ করলেন তিনি আর জমিদারি দেখার ভার দিলেন রবিকে। প্রতি সপ্তাহে অবশ্য রবিকে রিপোের্ট পাঠাতে হবে বাবামশায়ের কাছে। দিনকয়েক ইতস্তত গঙ্গায় নৌকোভ্রমণ করে দেবেন ঠাকুর শেষে চুঁচুড়ার একটি বাগানবাড়িতে আশ্রয় নিলেন।
মহর্ষি রবিকে চিঠি লিখে নির্দেশ দিয়েছেন, ইংরাজি শিক্ষার জন্য ছোটবৌকে লারেটো হৌসে পাঠাইয়া দিবে। ক্লাসে অন্যান্য ছাত্রীদের সহিত একত্র না পড়িয়া তাহার স্বতন্ত্র শিক্ষা দিবার বন্দোবস্ত উত্তম হইয়াছে। তাহার স্কুলে যাইবার কাপড় ও স্কুলের মাসিক বেতন ১৫ টাকা সরকারী হইতে খরচ পড়িবে।
ইতিমধ্যেই অবশ্য মৃণালিনীকে জোড়াসাঁকো থেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে তার পড়াশোনার ব্যবস্থা চালু করে ফেলেছেন জ্ঞানদা। লরেটো হাউসে মৃণালিনীকে আলাদা করে ক্লাস করানোর জন্য বেতন লাগছে সাত টাকা। রবির উপযুক্ত করে তোলার তাগিদে তাকে গান শেখানোর ক্লাসেও ভরতি করা হল।
তবে রবি এ-সবে একটু উদাসীন। নিজস্ব জীবনছন্দের মধ্যে হঠাৎ এসে পড়া এই বালিকাবধূকে নিয়ে কী করবেন তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। এতদিন কখনও সদর স্ট্রিটে নতুনবউঠানের কাছে আবার কখনও মেজোবউঠানের কাছে বির্জিতলাওয়ে যে উদ্দীপক জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, তার বদলে জোড়াসাঁকোর নিস্তরঙ্গ দিনগুলো যেন কাটতে চায় না।
এখন জোড়াসাঁকোয় না আছে জ্যোতিদাদার প্রাণের আগুন, না আছে মেজোবউঠানের সুমার্জিত শিল্পসাহিত্যচর্চা, না নতুনবউঠানের মায়াবী উদ্ভাস। তেতলাঘরের নির্জনতায় তার প্রাণ হাঁফিয়ে ওঠে। মৃণালিনী কখনও এখানে থাকেন কখনও বা মেজোবউঠানের কাছে।
তার ওপর বন্ধুরাও যেন বর্জন করেছেন হানিমুনে ব্যাঘাত ঘটাবার ভয়ে। রবি বাধ্য হয়ে প্রিয়নাথকে চিঠিতে লিখলেন, Honeymoon কি কোনোকালে একেবারে শেষ হবার কোনো সম্ভাবনা আছে– তবে কি না, Moon-এর হ্রাসবৃদ্ধি পূর্ণিমা অমাবস্যা আছে বটে। অতএব আপনি Honeymoon-এর কোনো খাতির না রেখে হঠাৎ এসে উপস্থিত হবেন।
বউকে ছেড়ে সদর স্ট্রিট বা বির্জিতলাওয়ে আগের মতো পাড়ি জমাতেও পারছিলেন না রবি, এখন মেজোবউঠান মৃণালিনীকে নিয়ে গিয়ে যেন রবিকেও বাঁচিয়ে দিয়েছেন। রবি প্রায় সন্ধেবেলায় বির্জিতলাওর আসরে যোগ দিতে পারছেন। থেকেও যাচ্ছেন মাঝে মাঝেই। জ্ঞানদা মৃণালিনীর শিক্ষার জন্য এ-সব করছেন ঠিকই, কিন্তু তার হৃদয়ের গোপন একটি ইচ্ছেও এতে চরিতার্থ হচ্ছে, রবিকে কাদম্বরীর রাহুগ্রাস থেকে সরিয়ে আনতে পেরেছেন তিনি।
মৃণালিনীর পিঠছাপানো চুলে পরিপাটি করে খোঁপা বেঁধে দিতে দিতে জ্ঞানদা নিজের ফেলে আসা নববধূ-জীবনের গল্প বলেন, একবার আমাদের গুরুঠাকুর এসেছিলেন। তাকে বাবামশায় জিজ্ঞেস করেছিলেন কিরকম কন্যাদানে বেশি পুণ্য হয়। তিনি বললেন– সাতবছর বয়সে বিয়ে দিলে, অর্থাৎ গৌরীদানে। ঠিক সেই বয়সেই আমার বিয়ে হয়। কলকাতার ঠাকুরবাড়ি থেকে তখন যশোরে মেয়ে খুঁজতে পাঠাত, কারণ যশোরের মেয়েরা নাকি সুন্দরী হত। যেসব দাসীরা মনিবের পছন্দ ঠিক বুঝতে পারে, তাদের খেলনা দিয়ে তারা মেয়ে দেখতে পাঠাতেন। আমাদের ওখানেও এইরকম দাসী গিয়েছিল। দাসী পছন্দ করে গেলে যখন আমার বিয়ের দিন সব ঠিক হয়ে গেল, তখন বাবামশাই আমাকে আনার জন্য সরকার, দাসী, চাকর পালকি সব পাঠালেন।
বালিকা আস্তে করে বলে, আমাকেও তোদর বাড়ি থেইক্যা অনেক সুন্দর সুন্দর খেলনা আর শাড়ি গয়না পাঠিয়েছিল। গাঁয়ের লোকেরা কোনওদিন অমন দেখে নাই।
অ্যাই মেয়ে, এখানে ওরকম যশুরে বুলি বলবি না। শোন, আমার বিয়ে। তো তোদের মতো জোড়াসাঁকোর দালানে হয়নি, তখন শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন। জ্ঞানদা স্মৃতিচারণ করতে থাকেন, বিয়ের পর বাসীবিয়েতে আমাকে মেয়েপুরুষ মিলে ঘেরাটোপ দেওয়া পালকিতে নিতে এসেছিল। শ্বশুরবাড়ির অন্দরমহলে যখন পালকি নামাল তখন বোধহয় আমার শাশুড়ী আমাকে কোলে করে তুলে নিয়ে গেলেন। তার ভারী মোটা শরীর ছিল, কিন্তু আমি খুব রোগা ও ছোট ছিলুম বলে কোলে করতে পেরেছিলেন। আমাকে নিয়ে পুতুলের মতো এক কোণে বসিয়ে রাখলেন। মাথায় এক গলা ঘোমটা, আর পায়ে গুজরী-পঞ্চম ইত্যাদি কত কি গয়না বিধছে। আমার পাশে একজন গুরুসম্পর্কীয়া বসে যৌতুকের টাকা কুড়োতে লাগলেন। আমি তো সমস্তক্ষণ কাঁদছিলুম।
জ্ঞানদা বলতে বলতে যেন অতীতে ডুবে গেছেন, আমার শ্বশুর যখন যৌতুক করতে এলেন তখন একটু জোরে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলুম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন– কেন কাঁদছে? লোকে বললে– বাপের বাড়ি যাবার জন্যে। তাতে তিনি বললেন– বল পাঠিয়ে দেব। সকলে বলতে লাগলেন– দেখেছ কী সেয়ানা বউ! ঠিক তাকমাফিক চেঁচিয়ে কেঁদে উঠেছে, যখন শ্বশুর যৌতুক করতে এসেছে। কিছুদিন পর্যন্ত লোকে আমাকে রোজই দেখতে আসত ও নানারকম ফরমাশ করত– উপর বাগে চাও তো মা ইত্যাদি। মেয়েরা কাপড় পর্যন্ত খুলে দেখত। আমি খুব লাজুক ছিলাম। ঠিক তোমার মতো। সমবয়সিদের সঙ্গেও ভালভাবে কথা বলতে পারতাম না।
কে বলবে এহন তোমাকে দেইখ্যা! মৃণালিনী সাহস করে বলে ফেলেন, তোমারে দেইখ্যা মনে হয় যেন সাক্ষাৎ দশভুজা জগদ্ধাত্রী।
ও বাবা, মেয়ের মুখে দেখি বোল ফুটেছে! জ্ঞানদা আনন্দে হেসে ওঠেন। কিন্তু ওই যশুরে বুলি ছাড়তে হবে।
সন্ধেয় গানবাজনার আসর বসছে রোজই। জ্যোতির সঙ্গে অক্ষয় এসে হাজির হন প্রায়ই। পিয়ানোর রিডে দিশি-বিদেশি সুরের ওঠানামায় উত্তাল হয়ে ওঠে বির্জিতলাওর বাড়ি।
সে-সব উত্তেজনার অবসানের পর রাত হলে বালিকাবধুর পাশে শুয়ে রবির মনে পড়ে একাকিনী নতুনবউঠানের মুখ। কী করছেন তিনি? জ্যোতিদাদা কি বাড়ি ফিরেছেন? না ফেরার সম্ভাবনা খুব বেশি, তিনি এখন আবার বিনোদিনীর কাছে যাতায়াত করছেন। তা হলে একা সেই বিরহিণী কীভাবে রাত কাটাচ্ছেন। রবি উদ্বেগে বিছানা ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করেন। বালিকা মৃণালিনী জানতে চায়, আপনার কী হয়েছে? ঘুম আসছে না? মাথা টিপে দেব?
তার মুখের দিকে তাকিয়ে রবির বড় মায়া হয়। বারো বছরের সরল বালিকা বোঝে না, তার পক্ষে চব্বিশ বছরের রবির জটিল মনোজগতে ঢোকা কত কঠিন।!
.
কাদম্বরী সত্যিই একা হয়ে পড়েছেন। রবি আসার সময় পায় না। জ্যোতি প্রায় রাতেই বাড়ি ফেরেন না। কোথায় থাকেন জানতে চাইলে বড় অশান্তি করেন, মনে মনে কাদম্বরীর গভীর সন্দেহ জ্যোতি নিশ্চয় বিনোদিনীর কাছে রাত কাটাচ্ছেন।
শুয়ে বসে তার দিন কাটে না, রাত কাটে না। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে রাস্তা দেখেন। রাস্তার ফিরিওলা, ঠেলাওলা দেখেন। সেলাই নিয়ে বসলেও মন লাগে না, মনের রং হারিয়ে গেছে যে! রূপাকে আনিয়ে নিয়েছেন সদর স্ট্রিটে, তার সঙ্গে বসে কখনও তাস খেলেন, কখনও চলে কাব্যপাঠ। আর প্রতিটি ছোটখাটো শব্দে চমকে উঠে দরজার দিকে তাকান, যেন মনে মনে কারও আগমনের প্রতীক্ষায় আছেন।
ওদিকে অলস দুপুরে বিনোদিনীর কোলে মাথা রেখে জ্যোতি গল্প করেন। জানো বিনোদ, নিলাম থেকে সস্তায় একটা জাহাজের খোল পেয়ে কিনে ফেলেছি। এবার জাহাজ সাজিয়ে গুজিয়ে তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে পাড়ি দেব একদিন।
ওমা, বিনোদিনী জ্যোতির চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে থেমে যান অবাক হয়ে, বলেন, জাহাজের খোল আবার কেনা যায় নাকি, ও দিয়ে তোমার কী হবে?
আরে বুঝতে পারছ না, জ্যোতি উৎসাহে উঠে বসেন, আস্ত জাহাজ কেনার চেয়ে খোল কিনে তাতে ইঞ্জিন জুড়ে কামরা লাগিয়ে নিলে কম খরচে চমৎকার জাহাজ হয়ে যাবে। আমি এবার জাহাজের ব্যাবসা করব, ইংরেজদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। দেখো বিনোদ, আমার স্বদেশি জাহাজ লোকের নিশ্চয় পছন্দ হবে।
তুমি অতবড় জমিদারবাড়ির ছেলে, তুমি এ-সব জাহাজের ব্যাবসা ট্যাবসা করবে কেন? বিনোদিনীর বিস্ময় কাটে না।
জ্যোতি কিন্তু উৎসাহে টগবগ করছেন, জমিদার তো কী হয়েছে? আমার ঠাকুরদা দ্বারকানাথ তো টেগোর কোম্পানি খুলে ইন্ডিয়া জাহাজের মালিক হয়ে একসময় বিরাট ব্যাবসা করেছেন, তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি উদ্যোগপতি। বাঙালিরা কলম চালায় কিন্তু জাহাজ চালাতে পারবে না কেন? দেখে নিয়ো বিনোদ, আমার জাহাজ কোম্পানি অনেক বড় হবে, অনেক টাকা আসবে। আর সেই টাকা আমি থিয়েটারের জন্য খরচ করব।
বিনোদিনীকে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করে তিনি বললেন, আমি তোমার নামে থিয়েটার করে দেব বিনোদিনী সরোজিনী! তোমার কোনও সাধ অপূর্ণ রাখব না।
বিনোদিনীর ক্ষতে যেন প্রলেপ পড়ে, মনে খুব আনন্দ হয়। কৃতজ্ঞতায় ভালবাসায় জ্যোতির ইন্দ্রনিন্দিত শরীরে নিজেকে মিশিয়ে দেন বিনোদিনী। তৃষ্ণার্ত জ্যোতির দেহের প্রতিটি অঙ্গে বৃষ্টিফোঁটা হয়ে ঝরে পড়তে থাকেন। পরমসুখের সেই মুহূর্তে বিনোদিনীর স্বর্গীয় বিফলের মতো নিটোল স্তনে মুখ গুঁজে দেন জ্যোতি।
কিছুক্ষণ পরে স্তন থেকে নিজের অনিচ্ছুক মুখটিকে অল্প টেনে তুলে জ্যোতি বললেন, তুমি নিষিদ্ধ ফলের মতোই উত্তেজক।
কেন, তোমার ঘরে যে অনিন্দ্যসুন্দরী স্ত্রী আছেন শুনতে পাই ঠাকুর? তির্যক স্বরে বিনোদিনী জানতে চান, তার কাছে দেহসুখ পাওনি?
জ্যোতির মুখে ছায়া পড়ে। কাদম্বরীর কাছে তিনি অপরাধী। বিনোদিনীর তীব্র আকর্ষণে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, তাকে ঠকিয়ে চলেছেন। বিনোদিনী সেই নরম জায়গাটাতেই ঘা দিয়েছে।
কী গো সুপুরুষ, উত্তর দিলে না, বিনোদিনী নিজের বহুনন্দিত রতিক্ষমতার স্তুতি শোনার লোভে গলা জড়িয়ে ধরে আবার খোঁচান জ্যোতিকে।
জ্যোতি ধীরে ধীরে বিষাদমাখা গলায় বললেন, তিনি গৃহলক্ষ্মী। তার সঙ্গে রতিখেলায় তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানোর আনন্দ, কিন্তু তুমি আমার উত্তেজক মদিরা। আমার সৃষ্টির উন্মাদনা। এই দুইয়ে তুলনা চলে না।
তার মানে? বিনোদিনী ছদ্ম রোষে বলেন, বলতে চাও, তিনি পবিত্র আর আমি সাতঘাটে ঘোরা অপবিত্র? তা হলে আর আমার কাছে আসা কেন?
বিনোদিনী ছিটকে সরে বসেন। জ্যোতি তার কাছে গিয়ে দুহাতের ঘেরে বেঁধে বলেন, অয়ি মানিনী, মানময়ী, তুমি সরে গেলে আমার লেখা বন্ধ হয়ে যাবে, গান থেমে যাবে। তুমি কি তাই চাও?
পৃথিবীর আদিম মানব মানবীর মতো উদ্দাম রতিখেলায় ডুবে গেলেন নাট্যকার ও মঞ্চসম্রাজ্ঞী।
.
কাদম্বরী তখন এ ঘর-ও ঘর ছটফট করছেন নিঃসঙ্গ যৌবনের ভারে। তার এই অতুল রূপরাশি আর কোনও পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টির প্রশংসা কুড়োয় না। পোষা। হরিণশিশুর মতো পায়ে পায়ে ঘোরে না কোনও রবি, কাব্যপাঠ করতে করতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকেন না কোনও বিহারীলাল, কোনও অক্ষয় চৌধুরী তার চোখে চোখ রেখে গান গেয়ে ওঠেন না, তার আসঙ্গকামনায় থরথর করে ওঠেন না কোনও প্রেমাতুর স্বামী। কোনও শিশু তার স্তন্যসুধার জন্য মুখ বাড়ায় না। কী করবেন তিনি এই ভরাযৌবন নিয়ে?
দেউড়িতে ঢং ঢং করে বেলা তিনটের ঘণ্টা পড়ে। এই ঘণ্টা বাজানোর প্রথাটিও ঠাকুরবাড়ির। এখন জোড়াসাঁকোয় লম্বা বারান্দা জুড়ে মেয়ে-বউরা বসবেন দাসীদের কাছে খোঁপা বাঁধতে। কাদম্বরীর খোঁপাদাসী সদর স্ট্রিটে এসেই তাঁর খোঁপা বেঁধে দেয় যত্ন করে। কোনওদিন মোচা খোঁপা তো কোনওদিন পৈঁচে ফঁস। হাতির দাঁতের বেলকুঁড়ি বসিয়ে কাদম্বরীর কবরী বেঁধেছে সে।
সাজগোজ হলে কাদম্বরী রূপাকে বলেন, চল বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। কত কী দেখার আছে পৃথিবীতে!
রূপা তো একপায়ে খাড়া, বলে চলে যাই। কিন্তু কোথায় যাবে? আমরা তো রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না।
আচ্ছা, আমরা যদি মালিনীর সঙ্গে বইয়ের ঝোলা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরি? কাদম্বরী বলেন, বেশ মজা হবে না?
তোমাকে দেখে কেউ বইওলি বলবে না, না হয় আটপৌরে শাড়ি পরলে, কিন্তু তোমার রূপ আর বনেদিয়ানা লুকোবে কী করে?
তা হলে চল গিরিশ ঘোষমশাইয়ের কাছে যাই, কাদম্বরী আর-একটি ভাবনায় উদ্দীপিত, বলব, আমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে বিনোদিনীর চেয়ে ভাল অভিনেত্রী গড়ে নিন। আমি সেই মালিনীর গল্পের নায়িকার মতো মঞ্চে উঠে সবাইকে চমকে দেব।
আর নতুনদাদা প্রচণ্ড রেগে মঞ্চে উঠে তোমাকে মারতে যাবেন! রূপা হেসে কুটোপাটি হয়।
আর পুলিশ এসে ওঁকে বের করে দেবে– কাদম্বরীও হেসে গড়িয়ে যান। পরক্ষণেই সচকিত হয়ে বলেন, কিন্তু তারপর তিনি কোথায় যাবেন, সেই তো বিনোদিনী হতচ্ছাড়ির বুকে মুখ লুকোবেন! তা হলে এ প্ল্যান চলবে না। অন্য কিছু ভাবতে হবে, দাঁড়া।
রূপা উত্তেজিত হয়ে বলে, স্বদেশি দলে যোগ দেবে? যশোরের স্বদেশিদের কাছে চলে যাই চলো, দেশের কাজও হবে আর
আর হ্যারিসাহেবের সঙ্গে দেখাও হবে, কাদম্বরী ছদ্মরাগে রূপার চুলের ঝুটি নেড়ে দিয়ে বলেন, কী তাই তো? তোর যদি স্বদেশির নাম করে অভিসারে যাওয়ার এত শখ তো আমাকে টানছিস কেন?
আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না নতুনবউঠান, রূপা চোখ ছলছল করে বলে ওঠে হঠাৎ। কিন্তু বাড়ির কেউ কি মেনে নেবে এই সম্পর্ক? তুমি আমাকে বাঁচাও।
কাদম্বরী সচকিত হন, রূপা, সেই তুই একটা গন্ডগোল বাঁধালি! আমি কাকে কী বলব, সে একটা চাল নেই চুলো নেই বাউন্ডুলে সাহেব, তার ওপর এখন আবার স্বদেশি করছে, পুলিশের খাতায় নাম উঠে গেছে হয়তো! তাকে বিয়ে করতে হলে তোকে বাড়ি থেকে পালাতেই হবে, কিন্তু খাবি কী, থাকবি কোথায়?
রূপা খিলখিল করে হেসে বলে, সেই যে কথায় আছে না, ভোজনং যত্রযত্র শয়নং হট্টমন্দিরে।
সে যে কী অপরূপ দৃশ্য হবে রূপা, কাদম্বরীও হেসে লুটিয়ে পড়েন, তুই আর তোর হ্যারিসাহেব হট্টমন্দিরে শুয়ে আছিস আর চারদিকে ভিড় করে লোকে এনকোর এনকোর বলে চিৎকার করছে, আহা!
যাঃ তুমি যে কী কথা বলছ নতুনবউঠান, রূপা লজ্জা পেয়ে ছুটে পালায়।
দরজার কাছে কারও পায়ের শব্দে চমকে উঠে কাদম্বরী দেখলেন রবি এসেছে। তার চোখ অভিমানে ছলছল করে ওঠে। চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে কাদম্বরী বললেন, বেঁচে আছি কিনা দেখতে এসেছ রবি?
রবি কাছে এসে নতুনবউঠানের থুতনি ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেন, কাজলনয়ন থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুটুকু পরমযত্নে মুছে দেন আঙুল দিয়ে। তারপর বলেন, রাগ কোরো না, প্রতিদিন তোমার জন্য আমার দুশ্চিন্তা হয়, প্রতিরাত তোমার কথা ভেবে ভেবে আমার ঘুম আসে না। কিন্তু আসতে পারিনি কিছুতেই।
তা পারবে কী করে? রবির হাত ঠেলে দিয়ে সরে যান কাদম্বরী। এখন তোমার নতুন বউয়ের সঙ্গে পুতুলখেলার সময়, এখন কি আর বুড়িবউঠানের সঙ্গ ভাল লাগে!
রবির মনে তীব্র আবেগের ধাক্কা লাগে, প্রতি পল-অনুপল যাকে মনে পড়ে, যার ছায়া থেকে সরার জন্য নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় পল-অনুপল, সেই মন প্রতিমা এ-কথা বলছেন!
রবি আর্তনাদ করে ওঠেন, যদি বুক চিরে তোমাকে দেখাতে পারতাম, নতুনবউঠান আমার ক্ষতবিক্ষত মন।
মিথ্যে বোলো না রবি, কাদম্বরী তাও অভিমান করেন, তুমিও তোমার নতুনদাদার মতো আমাকে মিথ্যে স্তোক দিচ্ছ। আমাকে কেউ আর ভালবাসে না। তার গায়ের কচি কলাপাতা রঙের জর্জেট শাড়িটি অবহেলায় মাটিতে লুটোয়।
বিদ্যুৎলতার ঈষৎ উন্মোচনে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে রবির, রেশমি জ্যাকেটের উদ্ধত নির্লজ্জতায় চোখ পুড়ে যায়। তিনি কাদম্বরীর কোমর জড়িয়ে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে বলেন, আমি ভালবাসি, আমি ভালবাসি। এরকম করে আর কাউকে কোনওদিন ভালবাসিনি নতুনবউঠান। যদি সাধ্য থাকত, তা হলে তোমার এই যন্ত্রণা দূর করতাম।
কাদম্বরীও শকুন্তলার মতো জড়িয়ে ধরেন প্রিয়তম হরিণশিশুটিকে, দুজনে দুজনকে তীব্র আবেগে জাপটে ধরে অনুচ্চারিত এক বেদনায় কাঁদতে থাকেন, কাঁদতেই থাকেন।
.
জ্যোতি বাড়িতে সময় দিতে পারছেন না। কাদম্বরীকে নিয়ে আবার জোড়াসাঁকোয় ফিরে গেলেন। সেখানে অন্তত কিছু লোকজন আছে, তাদের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদে হাসি গল্পে দিন কেটে যাবে কাদম্বরীর, জ্যোতি কিছুটা নিশ্চিন্তমনে বিনোদিনীর কাছে কাটাতে পারবেন।
জাহাজ নিয়েও খুব ব্যস্ততা জ্যোতির। প্রচুর ঋণ নিয়ে জাহাজ সাজিয়েছেন। কামরা সৌন্দৰ্যায়নের ভার দিয়েছেন জ্ঞানদাকে। কাদম্বরীকেও এ-ভার দিতে পারতেন জ্যোতি কিন্তু আজকাল অপরাধবোধে তার সামনে দাঁড়াতেই ভয় পান। তা ছাড়া কাদম্বরীর রুচি চমৎকার হলেও জাহাজের কামরা সম্বন্ধে তাঁর কোনও ধারণাই নেই। জ্ঞানদা ফরাসি ইংরেজ অনেক জাহাজে চড়েছেন, তার অভিজ্ঞতার কারণেই জাহাজের সাজগোজ হয়েছে খুবই মনোহারী।
বিলিতি জাহাজ কোম্পানি ফ্লোটিলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খুলনা বরিশাল জলপথে ফেরি চালাবেন তিনি। দিশি লোকেরা দিশি জাহাজে চড়তেই নিশ্চয় পছন্দ করবে, জ্যোতির জাহাজ উদবোধনের দিন ঠিক হয়েছে ১৯ এপ্রিল। ১৮৮৪ সালের এই দিনটি বাঙালির জাহাজ ব্যাবসার ইতিহাসে সোনার জলে লেখা থাকবে। জ্যোতি বুঝতে পারেননি, ওটাই হয়ে উঠবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার দিন।
১৯ এপ্রিলের জন্য মহা তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে সেদিন উপস্থিত থাকার জন্য। হয়তো বড়লাট আসবেন, জ্যোতির বিশেষ ইংরেজ-প্রীতি না থাকলেও হোমরাচোমরা সাহেবরা না এলে জাহাজের তেমন প্রচার হবে না। বাঙালির জাহাজ ব্যাবসার টানে প্রেস আসবে, কিন্তু গোরাসাহেবদের রিঅ্যাকশন দেখতে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
উদবোধন উপলক্ষে জ্ঞানদা তার নিজের ও বিবি-সুরেনের জন্য বিশেষ পোশাক তৈরি করতে দিয়েছেন। বাড়িতে দরজি বসেছে। কিন্তু জ্যোতির পোশাক নিয়েই তার বেশি চিন্তাভাবনা। বিলিতি দোকানের স্যুট কিনবেন, না রাজকীয় চোগা-চাপকান-পাগড়িতে সাজাবেন তাকে। অবশ্য জ্যোতি যা পরেন তাকে চমৎকার মানায়। বড়বাজারের পাঞ্জাবি শালওয়ালা এসেছে নানারকম জরি-কিংখাবের ছিটকাপড় নিয়ে। তার থেকেই জ্যোতি আর রবির জন্য কাপড় বেছে চাপকান করতে দিলেন শেষে।
এ-সব হুলুস্থুল তোড়জোড় থেকে অনেক দূরে বর্ষার মেঘের মতো একঢাল খোলা চুল ছড়িয়ে একা একা বসে আছেন কাদম্বরী। জ্যোতির ওপর তার তীব্র অভিমান, জাহাজের উদবোধনের কোনও কর্মকাণ্ডে স্বামী তাঁকে জড়াননি, সব ছেড়ে দিয়েছেন মেজোবউঠানের হাতে, যে মেজোবউ এর কাদম্বরী চক্ষুশূল। বাড়ি আসেন না, কোথায় কোথায় রাত কাটান, সব সহ্য করছি, ভালবাসা কি এতটাই ক্ষয়ে গেল যে কাজের সঙ্গিনী হওয়ার মর্যাদাটুকুও কেড়ে নিতে হবে!
জ্যোতি তাকে বলেছেন, একেবারে উদবোধনের দিন জাহাজে নিয়ে গিয়ে চমকে দেবেন। সে চমক কে চায়, তিনি তো চেয়েছিলেন সেই কাজে সহযোগী হতে। কেন, কেন এই অবহেলা? সেদিনের মধুরজনী কি আর ফিরে আসবে না?
তবু কাদম্বরী প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিশু তাঁতিনিকে ডেকে নতুন একটি কমলারঙা স্বর্ণচরী শাড়ি বেছেছেন উদ্বোধনে পরার জন্য, গয়না বেছে বেছে আয়নার সামনে পরে দেখছেন। সেদিন শুধু জ্যোতিই তাকে চমক দেবেন তা হয় না, কাদম্বরীও চমকে দেবেন জ্যোতিকে।
জীবনের সেরা সাজ সাজবেন তিনি, জ্ঞানদাকে হারিয়ে দেবেন রূপের উজ্জ্বলতায়। যখন জাহাজের ডেকে গিয়ে দাঁড়াবেন, লোকের চোখ তাকেই ঘুরেফিরে দেখবে। জ্ঞানদা তার চেয়ে অনেক সৌভাগ্যবতী হতে পারেন, কিন্তু রূপে ও সংবেদনায় তার ধারেকাছে আসতে পারবেন না, জানেন কাদম্বরী। ঠাকুরবাড়ির অন্দরে সেকথা চালু আছে। সেই রাগেই হয়তো মেজোবউ জ্যোতিকে তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
জ্যোতির খুব ইচ্ছে ছিল বিনোদিনীকে নিয়ে আসবেন অনুষ্ঠানে, কিন্তু বিনোদিনী রাজি না। বিনোদিনীর উপস্থিতি ছাড়া জ্যোতি তার জাহাজের উদবোধন করতে চান না। কী উপায় করা যায় ভাবতে ভাবতেই তড়িঘড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন জ্যোতি।
কাদম্বরী ঘরে বসে থোপানিকে কাপড় দিচ্ছিলেন। অভ্যেসমতো জ্যোতির জোব্বার পকেটে হাত দিয়ে কাগজপত্র বার করতে গিয়ে তার হাতে উঠে এল সুগন্ধী একটি খাম, কোনায় মেয়েলি ছাঁদের অক্ষরে লেখা সরোজিনী আর মাঝখানে অতি যত্নে জ্যোতির নাম। কাদম্বরীর বুক ধড়ফড় করে। ধোপানিকে বিদায় করে দিয়ে চিঠিটা খোলেন তিনি,–
প্রিয়তমেষু,
তোমার কাছ থেকে যে আনন্দ ও মর্যাদা পাইয়াছি, তাহা আমার বহুস্বপ্নের ফসল। কিন্তু যে কথা মুখে বলতে পারি নাই তাহা জানাইবার জন্যেই এই পত্র। দুপুরের দুষ্টামির পরে তুমি যখন আমার বালিশে মাথা রাখিয়া পরম আরামে ঘুমাইতেছ, তখন তোমার পাশে বসিয়াই তোমাকে লিখিতেছি। গোপন কথাটি হইল, আমার শরীরের মধ্যে তোমার একটি ক্ষুদ্র বীজ বাড়িয়া উঠিতেছে, কয়েকদিন বমিবমি লাগিতেছিল, এমাসে ঋতুদর্শন হয় নাই। প্রথমবার পোয়াতি হইবার সময়ে যেমন হইত ঠিক সেইরকম। তুমি শুনিয়া খুশি হইবে কি না জানি না বলিয়াই মুখে বলিতে পারি নাই। সন্তানের পিতৃপরিচয় আমি কাহাকেও জানাইব না, শুধু আমি জানিলাম আর তুমি। সংসার জানিবে ও আমার সন্তান, আমার একার। কোনও মূল্যেই আমি তোমাকে হারাইতে চাহি না। আমার শতশত চুম্বন গ্রহণ করিয়ো।
ইতি
তোমার একান্ত সরোজিনী।
বজ্রাহতের মতো বসে পড়েন কাদম্বরী। শব্দগুলি তার মাথায় বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে– দুপুরের দুষ্টামি, ক্ষুদ্র বীজ, সন্তানের পিতৃপরিচয়, চিঠি হাতে নিয়ে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে যান তিনি। অনেক পরে রূপা এসে তার জ্ঞান ফেরায়।
থমথমে প্রতিমার মতো চিঠি হাতে নিয়ে দুদিন বসে রইলেন কাদম্বরী। জ্যোতি সত্যিই তাঁকে ঠকিয়ে বিনোদিনীর কাছে যান! জ্যোতির সন্তান এসেছে। বিনোদিনীর গর্ভে, তার মানে তার পৌরুষ নিষ্ফলা নয়! অর্থাৎ কাদম্বরীই বন্ধ্যা। সবাই যে তাঁকে বাঁজা বলে উপহাস করে সেটাই তবে সত্যি! হতাশায়, গ্লানিতে প্রতিমুহূর্তে তার মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু তার আগে জ্যোতির সঙ্গে একবার শেষ দেখা হবে না? উদবোধনের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন তিনি, তারপর ভাবা যাবে কী করণীয়।
শাড়ি-জামা নাড়াচাড়া করেন, চিঠি পড়েন আর অপেক্ষা করতে থাকেন ১৯-এর বিকেলের জন্য। রূপা বাড়ির মেয়েদের ডাকাডাকি করেন কাদম্বরীর সঙ্গে কথা বলতে, সৌদামিনী শরৎকুমারীরা এক-দুবার এসে ঘুরে যান, কিন্তু কাদম্বরীর মৌনতা কেউ ভাঙতে পারেন না।
জাহাজ উদবোধনের একদিন আগেই দেখাশোনার জন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে জাহাজে আস্তানা পেতেছেন জ্ঞানদা। জ্যোতি তত তিনদিন ধরে সেখানে আছেনই। এত অতিথির খানাপিনার ব্যবস্থা করা কী চাট্টিখানি কথা! জ্ঞানদা অতিথিদের জন্য বিলিতি মোগলাই সবরকম রান্নার আয়োজন করিয়েছেন। খাবার টেবিল সাজানো, কামরার অন্দরসজ্জা সবদিকেই তার তীক্ষ্ণ নজর। গানবাজনার আয়োজন অবশ্য রবি আর অক্ষয়ের দায়িত্ব। তারাও অনবরত। আসা-যাওয়া করছেন জাহাজে।
একদিকে প্রবল কর্মযজ্ঞ আর অন্যদিকে অনন্ত প্রতীক্ষা। কাদম্বরী ভাবছেন কীভাবে জ্যোতির মুখোমুখি হবেন! কিছু বলবেন, নাকি বলবেন না! ছলনার অভিযোগে জ্যোতিকে কাঠগড়ায় পঁড় করালে তিনিও যদি কাদম্বরীকে বাঁজা অসম্পূর্ণা বলেন! এ-সব চেপে রেখে হাসিমুখে তার সামনে কি দাঁড়াতে পারবেন কাদম্বরী?
জাহাজে তখন শেষমুহূর্তের চাপ। পিয়ানোয় বসে রিড নাড়াচাড়া করতে করতে রবি একবার জানতে চান, জ্যোতিদাদা, নতুনবউঠানকে আনতে যাবে না?
যাব যাব, বলে পিয়ানোয় বসে পড়েন জ্যোতি, একটু পরে যাব, ভাটার টান কমুক। তা তোর বউকে আনছিস না কেন রবি?
সে তো আমি জানি না, তার কথা মেজোবউঠান জানেন, রবি আনমনে উত্তর দিলেন। কাজের লোকেদের ডাকাডাকিতে আবার অন্যদিকে চলে যান জ্যোতি।
কাদম্বরী উদ্বেগে ঘরে-বাইরে করছেন। বিশু তাঁতিনির কাছ থেকে আফিম চেয়ে রেখেছেন, ইচ্ছে-মুক্তি এখন তার হাতের মুঠোয়। একটি সুন্দর হাতির দাঁতের কৌটোয় তুলে রেখেছেন আফিমটা। কিন্তু তার আগে শেষ দেখতে চান তিনি। ১৯ এপ্রিল বিকেলের আগেই কমলা রঙের স্বর্ণচরীতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন হেকেটি ঠাকরুন, এবার সবার মাথা ঘোরানোর পালা। শেষ বাজিটা তাকে জিততেই হবে, ডাকিনী যোগিনীদের হাত থেকে জ্যোতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে নিজের হৃদয়ে। বাঁজা তো কী হয়েছে, নারীত্বের আকর্ষণ তো শেষ হয়ে যায়নি।
কিন্তু জ্যোতি কিছুতেই সময় পাচ্ছেন না জাহাজ ছেড়ে বেরতে। চিরকালের মতোই শেষে রবিকে বললেন কাদম্বরীকে নিয়ে আসতে।
রবি জানেন কাদম্বরী অগ্নিগর্ভ হয়ে আছেন, তিনি সাহস পান না, বলেন, না জ্যোতিদাদা, আজ তোমাকেই যেতে হবে। আজ আমি তাকে সামলাতে পারব না।
কিন্তু জ্যোতি বেরতে গেলেই জ্ঞানদা পিছু ডাকেন, অথবা জাহাজের কাপ্তেন, অথবা কোনও অতিথি আগেভাগেই পৌঁছে গেছেন বলে থেমে যেতে হয়।
কাদম্বরী অপেক্ষা করেন। বিকেল পেরিয়ে সন্ধে হয়, সন্ধে পেরিয়ে রাত। ছাদ থেকে কে যেন বলে ওঠে, কই লো নতুনবউ, তোর বর নিতে এল না?
এক এক করে সব গয়না খুলে ফেললেন কাদম্বরী। শাড়ি খুলে মেঝেতে ফেলে দিলেন। সাটিনের পেটিকোট আর রেশমি জ্যাকেট পরে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। কারা যেন জানলা দিয়ে দেখে যাচ্ছে। কী সব বলছে। ঘোরের মধ্যে কাদম্বরী শুনতে পেলেন, জাহাজের নাম রেখেছে সরোজিনী। ওঃ কী অপমান!
অনেক রাতে উঠে হাতির দাঁতের কৌটো খুলে সবটা আফিম মুখের মধ্যে ঢেলে দিলেন কাদম্বরী। তারপর জল খেয়ে মাতালের মতো টলতে টলতে শুয়ে পড়লেন মেঝেতে।
সকালে তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় আবিষ্কার করার পরে শুরু হল যমে মানুষে টানাটানি। যন্ত্রণায় ছটফট করছেন কাদম্বরী, তাঁর পঁচিশ বছরের স্বর্গীয় সৌন্দর্যরাশি যেন ক্রমশ বিষাক্ত আইভিলতার চেহারা নিচ্ছে।
রবি টানা দুদিন তার শয্যার পাশে বসে রইলেন অপরাধী হৃদয়ে। জ্যোতির অবস্থা উদভ্রান্তের মতো। সত্যি সত্যি কাদম্বরী যে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে, এটা তার ভাবা উচিত ছিল! সেরেস্তার কাজ বন্ধ। দুই বিখ্যাত ডাক্তার নীলমাধব হালদার ও সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করেও কিছু করা গেল না।
২১ এপ্রিল ভোরে কাদম্বরী মারা গেলেন।
তার শেষযাত্রায় সঙ্গ নিলেন রবি, সোমেন্দ্র, দ্বিপেন্দ্র ও অরুণেন্দ্র। সারাটা পথ রবি একটিও কথা বললেন না। ফিরে এসেও না। চব্বিশ বছরের জীবনে মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আগে কখনও দেখেননি তিনি। তার সবচেয়ে আপন মানুষটিই অভিমান করে চলে গেলেন, কত কী সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল, কত কথা অকথিত রইল। আর-একটু মনোযোগ দিলে এই বিপত্তি ঘটত না, জ্যোতিদাদা দূরে সরে গিয়েছিলেন বলেও রবির উচিত ছিল আরও কাছে এগিয়ে আসা। এই আপশোস কখনও যাবে না।
মহর্ষির নির্দেশে পুড়িয়ে ফেলা হল কাদম্বরীর শেষ চিরকুট, বিনোদিনীর চিঠিপত্র, এমনকী মৃতার হাতের লেখাও। খবরের কাগজে মোটারকম ঘুষ দিয়ে খবর বন্ধ করা হল। এইভাবেই ঠাকুরবাড়ির সুন্দরীতমা, বিষণ্ণতমা নারীটির মৃত্যু ঢাকা পড়ে গেল অনন্ত রহস্যের মোেড়কে।
কিন্তু রবির হৃদয় থেকে তাকে উপড়ে ফেলতে পারলেন না কেউই। কাদম্বরীর প্রথমবারের আত্মহননের চেষ্টার পরে তারকার আত্মহত্যায় রবি লিখেছিলেন, যদি কেহ শুধাইত/আমি জানি কী যে সে কহিত। যতদিন বেঁচে ছিল। আমি জানি কী তারে দহিত। এখন আবার ঘোরের মধ্যে একটার পর একটা কবিতায় নতুনবউঠানের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করলেন তিনি।