জানালার পর্দা সরানো কিছুটা। একটুকরো আকাশ, কয়েকটা বাড়ির মাথা দেখা যায়। দূরে একটা ছাদে শাড়ি শুকোতে দিয়েছে কেউ। আর পাতাবহুল নিমের ঘন ডাল। এতক্ষণ রোদে চিকচিক করছিল নতুন পাতাগুলো। এখন পড়তি রোদের ম্লান কোমল আলোয় শুধু বেগুনি হয়ে রয়েছে। আবিদ সেদিকে মুখ ফেরালো। তারপর উঠে গেল জানালার ধারে। সরিয়ে দিল পর্দাটা একপাশে। তারপর অনেকক্ষণ ধরে সিগারেট ধরালো। প্রথম কাঠিটা নিভে গেল জ্বলে উঠেই। ধরলো দ্বিতীয়টা।
বাবু ঘুম থেকে উঠেছে অনেকক্ষণ। তাকে কোলে করে বারান্দায় এসেছিল তাহমিনা। তারপর শান্ত করবার জন্যে মাই দিয়েছিল খানিক মোড়ায় বসে। এতক্ষণ আবিদ বসে ছিলো ভেতরে। বার থেকে কোনো শব্দ পাওয়া যায় নি তার। চেয়ার টানবার কী গলার কোনো আওয়াজ শোনা যায় নি। চট করে বোঝা যাবে না যে ভেতরে কেউ আছে। তাহমিনারা ও কেমন মনে হয়েছিল, আবিদ যেন আদৌ আসে নি। শুধু একটি মুহূর্তের জন্য বারান্দায় বসে। মাই ওর মুখে তুলে দিতে গিয়ে অদ্ভুত একটা দুরু দুরু লজ্জার কাঁপন লেগেছিল তার সারা শরীরে। এমন কোনো দিন হয়নি। বাবু হবার পর একদিনও না। আজ হঠাৎ সে অনুভব করেছিল, সে মা। আজ সেই অনুভবটুকু শিথিল করে দিয়েছে তার সমস্ত শরীর। তাহমিনা যেন এক নিমেষে বদলে গেছে।
তারপর বাবুর অস্পষ্ট ভুরুতে দিয়েছে গভীর কাজলের রেখা। ঘরে এসে পাউডার দিয়ে বুলিয়েছে তার ছোট্ট কোমল শরীর। তারপর নিচেয় নেমে ঝির কোলে দিয়ে বলেছে ও বাসায় বেরিয়ে আসতে। পাশের বাড়ির বৌটির দিনে অন্তত একবার বাবুকে কোলে নেয়া চাইই। অন্য দিন হলে তাহমিনা নিজেই যেতো। হয়ত গল্প করত খানিক। কিংবা হয়ত বৌটি আসতো নিজেই। আজ বাবুকেই পাঠিয়ে দিল সে। আর কেন যেন সেই মুহূর্তে ভাবলো, ও বাসার বৌ যেন আজ ঈশ্বর করুন না আসে।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এসে কামরায় দাঁড়াতেই তাহমিনার মনে হলো, কেন সে সবাইকে বাইরে পাঠিয়ে দূরে সরিয়ে একেলা হতে চাইলো? আর এখন আবিদের মুখোমুখি এই একেলা হওয়াটা কী ভীষণ! সে অনুভব করল। সে ভাবলো। চুপ করে রইলো।
আবিদ তখনো সেই জানালার কাছে দাঁড়িয়ে। তাহমিনা সেদিকে স্থির তাকিয়ে চোখ তার আবিদকে ছাড়িয়েও তারো দূরের শূন্যতায়। হঠাৎ যেন কী একটা ক্ষরিত হয়ে যাওয়ার অদৃশ্য শিহরণ জাগলো তার আত্মায়। যেন একটা শক্তি অপসারিত হলো তার চেতনা থেকে। একটা একটা করে আশেপাশের একই চোখে দেখা বস্তুগুলো মিলিয়ে গেল দৃষ্টির অতীতে। তাহমিনার শরীর কেঁপে উঠল থরথর করে।
একি হলো তার? না–না–ওকথা নয়। এ সে কিছুতেই হতে দেবে না। কোন মূল্যে কোনদিনই নয়।
তাহমিনা জোর করে চোখ ফিরিয়ে নিতে চাইল আবিদের শরীর থেকে। কিন্তু পারল না। আগের চেয়ে, এই প্রথম তার চোখে যেন পড়ল, অনেক কৃশ হয়ে গেছে আবিদ। আর ওর ডান পায়ে কি সেই দুর্ঘটনার চিহ্ন এখনো আছে? ও কেন একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে? ক্ষোভ হলো ঈশ্বরের ওপর, কেন তিনি ওকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে দিলেন না?
হঠাৎ চমক ভাঙল তার, এ কি ভাবছে সে? এ কথা তো স্বপ্নেও সে কোনদিন ভাবতে চায় নি। চিরদিনের মত সে ভুলে যেতে চেয়েছিল সেই ব্যর্থ দিনগুলোর ইতিহাস। কান্নায় ভেঙে পড়তে চাইলো তার আত্মা। আত্মার গভীর থেকে কে যেন কেবলি অশান্ত পাশ ফিরছে তাকে আরো অশান্ত করে দিয়ে।
একটু কেঁপে ওঠা গলায় জোর করে সে উচ্চারণ করল, তুমি চলে যাও। চলে যাও।
ঘুরে দাঁড়াল আবিদ। যেন সে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে এই কথারই অপেক্ষা করছিল।
না–না তোমার পায়ে পড়ি আবিদ–
আর সে বলতে পারল না, কিম্বা বলবার হয়ত এরপর কিছুই নেই তার। তাহমিনা ছুটে গিয়ে বিছানায় বালিশে মুখ লুকোলো। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। কেন–কেন সে তাদের দুজনকেই ভালোবাসতে পারে না? ফারুক আর–আর আবিদ। তার সমস্ত হৃদয় যেন কথা হয়ে তার অবাধ্য এই কণ্ঠের আশ্রয় মিনতি করলো–আবিদ, তোমাকে আমি ভালোবাসি। আবিদ, আমি তোমারই। একটুপর এক আশ্চর্য নির্ভরতার মত তাহমিনা তার কান্নাশরীরে অনুভব করলো আবিদের কম্পিত করতল।
লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা
মার্চ ১৯৫৬