ঘুম আসে না ইয়াসমিনের। কেবলি সে এপাশ ওপাশ করতে থাকে। লোকটির চেহারা নয়, কণ্ঠস্বর তার স্মৃতিতে বার বার ফিরে আসে। লোকটি যে পরিষ্কার বাংলা কথাগুলো বলেছিল, এখন তা ইয়াসমিনের কানে তীব্র ভাষায় রূপ নেয়। বাংলা কি ইংরেজি, সে আর সচেতন নয়।
ঘর অন্ধকার। মেঝের ওপর প্রত্যেকে জায়গা দখল করে শুয়ে পড়েছে মাথা পর্যন্ত কম্বল টেনে। ইয়াসমিনকে দরোজার কাছে জায়গা দেয়া হয়েছে। দরোজার ফাঁক দিয়ে হিস-হিস করে হিম বাতাসের স্রোত আসে। তার দরুণ শীতবোধ হয়।
হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে কুণ্ডলী পাকিয়ে সে শীতের সঙ্গে লড়াই করে। কম্বল আনে নি, গায়ের কোট খুলে ওপরে দিয়ে দিয়েছে সে।
নিজেকে রিক্ত এবং ব্যর্থ মনে হয় তার। ব্যর্থতাই বড় হয়ে তাকে রোমশ জন্তুর মতো চেপে ধরে। সেই সঙ্গে আবার তার মনে হয়, অন্য কারো শরীর সে ধারণ করে আছে, তার পুরনো দেহ বিদায় নিয়েছে, এই দেহের কোনো সংকেতই বোধগম্য বা নিয়ন্ত্রিত নয়।
পায়ের শব্দ পাওয়া যায়।
অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে মার্ক এসে ফিসফিস করে বলে, আমার কম্বল লও।
অনুভব করে মার্ক কোট সরিয়ে নিয়ে কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয় তাকে। ইয়াসমিন মার্কের হাত ধরে থাকে কিছুক্ষণ। যেন সে এতক্ষণ উঁচু দালানের কার্নিশে বিপজ্জনকভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ একটা অবলম্বন পেয়েছে।
তুমি কী গায়ে দিবে?
আমি বসিয়া থাকিব।
ইয়াসমিন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। শীত পরাজিত হয়। উষ্ণতা ফিরে আসে।
মার্ক, তুমি আছ?
হাঁ, আমি আছি।
আমি কাঁদিতে ইচ্ছা করি।
কাঁদিও না, কেন কাঁদিবে?
তুমি ইহাদের মতো নও। তুমি ইহাদের সঙ্গে আছ কেন?
মার্ক কোনো উত্তর দেয় না।
ইয়াসমিন এবার কম্বলের ঢাকা সরিয়ে মুখ বের করে ফিসফিস করে বলে, চল আমরা দুজনে কোথাও চলিয়া যাই। মার্ককে নীরব দেখে ইয়াসমিন আঘো উঠে বসে। সঙ্গে সঙ্গে নাভীর নিচে ক্ষীণ অথচ গভীর একটা ব্যথা অনুভব করে, লোকটিকে তখন প্রহার করবার স্মৃতি ফিরে আসে, এই ব্যথাবোধ মানসিক এবং তারই সহানুভূতিতে বলে ইয়াসমিন মনে মনে ব্যাখ্যা করে নিয়ে, মার্কের হাত ধরে ব্যগ্র কণ্ঠে বলে, যাইবে মার্ক?
না, যাইব না।
তুমিও কি আমার ত্বকের রঙ ঘৃণা কর।
মার্ক তার কপালে হাত রাখে। তোমার ত্বকের রঙ সম্পর্কে আমি সচেতন নহি।
সে তো উহারাও নহে। আমার উপস্থিতিতে লোকটিকে বাদামি শুকর বলিল।
উহাদের কথা আলাদা। আমি উহারা নহি।
তবে যাইতে চাহ না কেন?
আমি দুঃখ এবং পতন প্রত্যক্ষ করিতে চাই।
আর কত করিবে?
জীবকাল পর্যন্ত। তোমার সঙ্গে যাইতে পারিলে খুশি হইতাম, সুখ আমি চাহি না। সুখের ভিতরে সম্পদ নাই, ঐশ্বর্য নাই। আমার সঙ্গীত মরিয়া যাইবে। সঙ্গীত ভিন্ন আমার বন্ধু নাই। মানুষ কখনোই মানুষের বন্ধু হইতে পারে না। ইহা অলংঘনীয় দূরত্ব।
ইয়াসমিন ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে সে।
মার্ক বলে, তুমি নিদ্রা যাও।
উহারা লোকটিকে বাদামি শুকর বলিল কেন?
তুমি নিদ্রা যাও।
উহারা লোকটিকে প্রহার করিল কেন?
তুমি নিদ্রা যাও।
উহার লোকটিকে সর্বস্বান্ত করিল কেন?
তুমি নিদ্রা যাও।
আমি কেন প্রতিবাদ করিতে পারিলাম না। কেন বাধা দিলাম না। কেন তাহাকে ডাকিয়া আনিলাম?
তুমি তো স্ব ইচ্ছায় আসিয়াছিলে। তুমি তো পূর্বেও বাধা দাও নাই। তুমি তো পূর্বেও প্রতিবাদ কর নাই।
ইয়াসমিন আবার উঠে বসে। গা থেকে কম্বল সরিয়ে বলে, কী বলিতেছ? এ কী যুক্তি দিতেছ?
যুক্তি যথাযথ।
তুমিও উহাদের দলে। তুমিও বাদামি শুকর বলিতে পার। আমার উপস্থিতিতে কী করিয়া বলিতে পারিল? তবে কি আমাকে অন্তর হইতে গ্রহণ করে নাই?
না, করে নাই।
ইয়াসমিন স্তব্ধ হয়ে যায়।
মার্ক বলে, মোহভঙ্গ সম্পূর্ণ হইয়া যাউক। বাক্য সত্য হউক। তোমাকেও বাদামি কুকুরী বলিয়াছে, তোমার সাক্ষাতেই বলিয়াছে।
না, বলে নাই। কে বলিয়াছে?
অবশ্য তোমার তখন উপলব্ধি করিবার মতো অবস্থা ছিল না। ভিনসেন্ট বলিয়াছে।
অন্ধকার বিকট ও দুঃসহ মনে হয় ইয়াসমিনের। দুর্বল কণ্ঠে সে উচ্চারণ করে, সত্য?
হাঁ। সত্য। তোমাকে ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছি। মিথ্যা বলিব না। অপরাহ্নে ঘ্রাণ লইবার অধিবেশনে তুমি সম্পূর্ণরূপে উত্তোলিত হইয়া যাইবার পর, ভিনসেন্ট তোমার কুমারীত্ব হরণ করে।
না। আর্তনাদ করে ওঠে ইয়াসমিন। নাভির নিচে ক্ষীণ ব্যথাটা হঠাৎ তীব্র হয়ে যায়। মার্ক মন্ত্র পাঠের মতো উচ্চারণ করে চলে, বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের ন্যায় তোমার শরীর ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছিল। সম্ভবত তোমার যন্ত্রণা হইতেছিল।
ইয়াসমিনের স্মৃতিতে যন্ত্রণা নেই দেখে সে নিজেই বিস্মিত হয়ে যায়। তার স্মৃতিতে মহাশূন্যে চন্দ্রযানের সুখকর সম্মুখ-ধাবমান। তার চেতনা এখন ক্রমশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেতে থাকে।
মার্ক নিষ্করুণ কণ্ঠে বলে যায়, তখন ভিনসেন্ট তোমাকে চড় মারিতে মারিতে বাদামি কুকুরী শান্ত হও বলিতেছিল।
চন্দ্রয়ান থেকে ছিটকে পড়ে ইয়াসমিন। ভয়াবহ দ্রুত গতিতে পতিত হতে হতে সে আকুল কণ্ঠে বলে, মার্ক আমাকে তুমি রক্ষা করিলে না?
মার্ক উত্তর দেয়, আমি তখন আমা হইতে বিযুক্ত ছিলাম।
১৯.
এত ভোরে দরোজায় বেল বাজতে শুনে মিস্টার আলি আর নাহার, দুজনে একই সঙ্গে নেমে আসেন। নাহার সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে থাকে দুঃসংবাদের দুঃসহ প্রতীক্ষায়। নিশ্চয়ই থানা থেকে পুলিশ ইয়াসমিনের কোনো খবর নিয়ে এসেছে। সে আল্লাকে ডাকে।
দরোজা খুলেই আলি হতভম্ভ হয়ে যান।
ইয়াসমিন দাঁড়িয়ে আছে।
নাহারের মনে হয়, বাস্তব এত সহানুভূতিশীল নয়। এ স্বপ্ন।
ইয়াসমিন বাবার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে বলে, ভিতরে আসিতে পারি?
আলি সরে দাঁড়ান নীরবে। ইয়াসমিন ক্ষণকাল অপেক্ষা করে ভেতরে পা রাখে। নাহার এসে তার হাত ধরলে, সে অধোমুখে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে, সন্তর্পণে হাত ছাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যায়।
স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। যেন, বাস্তব এখনো সত্যি বলে বিশ্বাস হয় না তাদের। তারপর, স্বামীর বুকে হাত রেখে নাহার বলে, আল্লা মুখ তুলে চেয়েছেন, ওকে তুমি কিছু বলো না।
দুজনে ওপরে এসে দেখেন, ইয়াসমিন তার ঘরে ঘরের দরোজা সে বন্ধ করে দেয় নি। ভোরের ধূসর আলোয় ইয়াসমিনকে দেখা যায় বিছানার ওপর হাতের বড় ব্যাগটা রেখে স্থির দাঁড়িয়ে আছে।
দূর থেকেই আলি ইয়াসমিনকে লক্ষ্য করে বলেন, নিজের বাড়িতে প্রবেশ করিবার জন্য অনুমতির আবশ্যক হয় না, স্মরণ রাখিও।
আলি তার নিজের ঘরে চলে যান। দরোজা বন্ধ হয়ে যেতেই নাহার ছুটে যায় ইয়াসমিনের ঘরে। দুহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সে বলে, তোর দয়া মায়া নেই, তুই পাষাণ, কী করে পারলি তুই?
ধীরে ইয়াসমিন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, মাম, আমি ঢাকা যাব।
নাহার অবাক হয়ে যায়। ঢাকা?
দেশে যাব। ড্যাডিকে বল।
মেয়ের স্থির নিশ্চিত উচ্চারণ শুনে নাহার আর কিছু বলতে পারে না। ত্রস্ত পায়ে স্বামীর কাছে যায়।
নাহারের মুখে শুনে আত্মার ভেতরে চমকে ওঠেন মিস্টার আলি। শোবার ঘরের দেয়ালে টানানো পোস্টারের লেখা, ফ্লাই বিমান ফ্লাই হোম আজ এই প্রথম তার কাছে বিকট ও ভয়াবহ মনে হয়।
স্বদেশ কি এই গাঢ় সবুজ পোস্টারের মতো সুন্দর? কোন স্বদেশে ফিরে যেতে চায়। ইয়াসমিন।
ইউনিভার্সিটির সেই অধ্যাপকের কথা, বজলুল করিমের কথা, ডাঃ বারীর কথা, টুকরো টুকরো কথাগুলো আছড়ে পড়ে তার চেতনায়। আবার একই সঙ্গে সে কানে শুনতে পায়, তার আপিস ঘরে দুধের বোতলে জানালা ভাঙ্গার শব্দ, থানায় পুলিশের পরিহাস, সড়কে শ্বেতাঙ্গদের নিষ্ঠুর মন্তব্য।
মিস্টার আলি নিঃশব্দে সখেদে ক্রমাগত মাথা নাড়েন। তারপর হঠাৎ দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে অস্ফুট স্বরে বলেন, উহার কোনো স্বদেশ নাই, উহার কোনো স্বদেশ নাই।
তিনি নিজেও টের পান না, বিলাপের উচ্চারণ ইংরেজিতেই করছেন।
অন্তিম দুঃখজনক প্রতিত হইয়াছে