খুদাবক্স খাঁ বাহাদুর
খুদাবক্সের কীৰ্ত্তি
অনেকেই বোধ হয় জানেন না যে সমস্ত ভারতের মধ্যে একটি অতুলনীয় জিনিষ বাঁকিপুরে আছে। এটি খুদাবক্স-পুস্তকালয়। পুরাতন ফার্সী ও আরবী হস্তলিপি এবং মুসলমানকালের ছবির যেমন অপূর্ব্ব মূল্যবান সংগ্রহ এখানে আছে, এমন আর ইউরোপের বড় বড় রাজধানী ভিন্ন কোথায়ও নাই। এবং খুদাবক্সের কতকগুলি গ্রন্থরত্ন ইউরোপেও অপ্রাপ্য। এই সব হস্তলিপির সংখ্যা এখন পাঁচ হাজার; ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে যখন শুধু তিন হাজার বহি ছিল, তখন তাহাদের দাম আড়াই লাখ টাকা স্থির করা হয়। সুতরাং এখন দাম চারি লক্ষের কাছাকাছি হইবে। তা ছাড়া অনেকগুলি ছাপার ইংরাজী পুস্তক ও চিত্রসংগ্রহ আছে, তার দাম প্রায় এক লাখ টাকা। পুস্তকের ঘরটি রাজবাড়ীর মত সাজান এবং ৮০,০০০ টাকায় তৈরী। এ সমস্ত পুথি, মুদ্রিত পুস্তক, দালান এবং জমি খাঁ বাহাদুর খুদাবক্স, সিআইই সাধারণের নামে লিখিয়া দিয়া গিয়াছেন। জ্ঞানের এমন দাতা আর ভারতে হয় নাই। বড়লী সাহেবের নাম অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জগদ্বিখ্যাত বড়লিয়ান্ লাইব্রেরী চিরস্মরণীয় করিয়াছে। তেমনি খুদাবক্স ভারতীয় বড়লী বলিয়া গণ্য হইবেন। সার্থক তাঁহার নাম খুদাবক্স, অর্থাৎ ‘ঈশ্বরের দান” (যেমন সংস্কৃত দেবদত্ত), কারণ এরূপ সাধারণের উপকারী লোক ক্ষণজন্মা, ঈশ্বরপ্রেরিত।
জীবনী
ছাপরা জেলার একটি মুসলমান বংশে খুদাবক্স ২রা আগস্ট ১৮৪২ খ্রি: জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পূর্ব্বপুরুষেরা নির্ধন হইলেও জ্ঞানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁহাদের একজন, কাজী হায়বউল্লা, অন্যান্য মুসলমান পণ্ডিতগণের সহিত “ফতাওয়া-ই-আলমগিরী” সংকলনে সাহায্য করেন। খুদাবক্সের পিতা মুহম্মদ বক্স পাটনায় ওকালতি করিতেন। আরবী ও ফার্সী হস্তলিপি সংগ্রহ তাঁহার জীবনের ব্রত ছিল। আর্থিক অবস্থা ভাল না হইলেও তিনি পৈত্রিক ৩০০ খানা হস্তলিপিকে বাড়াইয়া ১৫০০ খানা করেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি খুদাবক্সকে আজ্ঞা করিলেন যে প্রত্যেক বিষয়েই গ্রন্থসংগ্রহ সম্পূর্ণ করিতে হইবে এবং এগুলির জন্য একটি দালান করিয়া সাধারণকে দান করিতে হইবে। খুদাবক্স অম্লান বদনে এই আদেশ গ্রহণ করিলেন, যদিও তাঁহাদের পরিবারে তখন বড়ই অর্থকষ্ট ছিল, এবং মুহম্মদ বক্স এক পয়সাও রাখিয়া যান নাই। খুদাবক্স-লাইব্রেরী এই আদেশ পালনের অমর দৃষ্টান্ত এবং এক মহাপুরুষের চিরস্মরণীয় কীর্তি।
বালক খুদাবক্স কিছুদিন পাটনায় ও তারপর কলিকাতায় ইংরাজী পড়েন। কিন্তু ইতিমধ্যে পিতার পক্ষঘাত রোগ হওয়ায় তাঁহাকে বাঁকিপুরে ফিরিয়া আসিতে হইল। সংসারের অবস্থা বড় খারাপ, এজন্য তিনি চাকুরীর খোঁজ করিতে লাগিলেন। এক মুনসেফের কাছারীতে নায়েব-গিরির প্রার্থনা করিয়া পাইলেন না; অথচ তিনিই আবার একদিন ভারতবর্ষের এক রাজধানীতে চিফ জাস্টিস হইয়াছিলেন! কিছুদিন পরে যদি বা জজের পেষকার হইলেন, কিন্তু জজ মিষ্টার লাটুরের সহিত না বনায় বিরক্ত হইয়া পদত্যাগ করিলেন। তারপর তিনি ১৫ মাস ডেপুটি ইনস্পেক্টর অব স্কুলস্ হইয়া কর্ম্ম করেন। শেষে ওকালতি পরীক্ষা (প্লিডারশিপ) পাশ করিয়া ১৮৬৮ সালে বাঁকিপুরের কাছারীতে ব্যবসায় আরম্ভ করিলেন। আদালতে যাইবার প্রথম দিনই ১০১ খানি ওকালতনামা সহি করিলেন। এমন সফলতা আর কোন উকীলেরই বিষয়ে শুনা যায় না। ওকালতিতে তাঁহার যথেষ্ট আয় হইতে লাগিল এবং তিনি প্রথম শ্রেণীর উকীলের মধ্যে গণ্য হইয়া শেষে সরকারী উকীল নিযুক্ত হইয়াছিলেন। খুদাবক্সের স্মরণশক্তি এমন তীক্ষ্ণ ছিল যে যদিও প্রত্যহ অসংখ্য মোকদ্দমা করিতে হইত অথচ শুধু একবার চোখ বুলাইয়া নথি অভ্যস্ত করিয়া লইতেন, বাড়ীতে খাঁটিতে হইত না। একবার হাইকোর্টের এক জজ (বোধ হয় সর্ লুই জ্যাক্সন্) বাঁকিপুরে বেড়াইতে গিয়া আদালতে খুদাবক্সের বক্তৃতা শুনিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলেন এবং যখন জানিতে পারিলেন যে উনি তাঁহার বাঁকিপুরে জজিয়তী করিবার সময়ে পরিচিত ও আদৃত উকীল মুহম্মদ বক্সের পুত্র তখন তিনি শয্যাগত মুহম্মদ বক্সের বাড়ী গিয়া দেখা করিলেন এবং খুদাবক্সকে একটি সবজজি দিতে চাহিলেন, এবং পরে স্টাট্যুটরি সিবিলিয়ান করিবারও আশা দিলেন। কিন্তু খুদাবক্সের তখন খুব পশার, তিনি চাকুরী স্বীকার করিলেন না।
এদিকে সাধারণ হিতের জন্য বিনা পয়সায় খাঁটিতে খুদাবক্স কখনও পরাঙ্মুখ ছিলেন না। স্কুল কমিটির সভ্য হইয়া জ্ঞান বিস্তারের সাহায্য করায় ১৮৭৭ সালের দিল্লী দরবারে তাঁহাকে সম্মানের সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। যখন লর্ড রিপনের আমলে স্বায়ত্বশাসন স্থাপিত হইল, খুদাবক্সই পাটনা মিউনিসিপ্যালিটি ও ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের প্রথম ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি পুরাতন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ছিলেন।
অবশেষে ১৮৯৪ সালে নিজাম তাঁহাকে হায়দ্রাবাদের উচ্চ বিচারালয়ের প্রধান জজ নিযুক্ত করিলেন; ভারতে ওকালতির এই চরম উন্নতি ও সম্মান ৷ ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে খুদাবক্স খাঁ বাহাদুর এবং ১৯০৩ সালে C.I.E উপাধিপ্রাপ্ত হন।
১৮৯৮ সালে হায়দ্রাবাদের কর্ম্মত্যাগ করিয়া বাঁকিপুরে ফিরিয়া আসিলেন এবং আবার ব্যবসায় আরম্ভ করিলেন। কিন্তু তাঁহার স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল; এবং শেষাশেষি মতিভ্রম ঘটে। গত ৩রা আগস্ট বৈকালে ১টার সময় তাঁহার জীবনলীলা শেষ হইল।
খুদাবক্সের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মি. আবুল হসন, ব্যারিষ্টার, কলিকাতা ছোট আদালতের প্রধান বিচারপতি। চারি পুত্রের মধ্যে মি. সালাহ্-উদ-দীন, এম.এ.বি.সি.এল. (অক্সফোর্ড) ব্যারিষ্টার, আরবীর পুরাতত্ত্ব সম্বন্ধে প্ৰবন্ধ লিখিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছেন। দ্বিতীয় মি: শিহাবুদ্দীন এখন ডেপুটি সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট অব্ পুলিস; আরবী ফার্সী হস্তলিপি সম্বন্ধে ইনি অনেক সংবাদ রাখেন। তৃতীয় মুহীউদ্দীন এফ এ অবধি পড়িয়াছেন, কনিষ্ঠ ওয়ালীউদ্দীন স্কুলের ছাত্র।
মুসলমান লেখকদের জীবনী ও গ্রন্থ সম্বন্ধে খুদাবক্সের অদ্বিতীয় অভিজ্ঞতা ছিল। এই বিষয়ে তিনি বিলাতের নাইটীথ সেঞ্চুরী কাগজে এক প্ৰবন্ধ লেখেন; এবং নিজের সংগৃহীত হস্তলিপির অনেকগুলির বিস্তৃত বর্ণনাসহ এক কেটেলগ ফার্সীতে ছাপা (নাম মাহবুব্-উল্-আল্বাব, হায়দ্রাবাদে ১৩১৪ হিজরীতে লিখো করা)। একদিন আমার সম্মুখে তিনি মুহম্মদের সময় হইতে ৮০০ হিজরী পর্যন্ত যত আরব জীবনচরিতকার ও সমালোচক হইয়াছে তাহাদের নাম ও গ্রন্থের ধারাবাহিক উল্লেখ করিলেন এবং প্রত্যেকের গুণ দোষ ও গ্রন্থ-সীমা বর্ণনা করিলেন। ইহার অনেকগুলিই তাঁহার পুস্তকালয়ের জন্য জোটাইয়াছেন। কিন্তু ভারতে মুসলমানদের মধ্যেই বা আরবীর গভীর চর্চ্চা কয়জন করেন?
পুস্তকের গৃহ
পিতৃ আজ্ঞায় খুদাবক্স যে লাইব্রেরী বাড়ী তৈয়ার করিয়াছেন তাহা দেখিয়া চক্ষু জুড়ায়। বাড়ীটি দোতলা, চারিদিকে প্রশস্ত বারান্দা। পশ্চিম বারান্দা, দুই সিঁড়ি এবং নীচের মেঝেগুলি মার্কেল পাথরে মোড়ান, এবং নানা কারুকার্য্যে খচিত, কোথায় বা দাবা খেলার ঘরের মত, কোথায় বা নানারঙের পাথর বসাইয়া ছক্ কাটা। আর আর বারান্দা ও মেঝে রঙীন ইঁটে আবৃত, যেমন কলিকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এর মেঝে।
লাইব্রেরী সম্বন্ধে স্বপ্ন
এই পুস্তকালয় খুদাবক্সের সমস্ত হৃদয় জুড়িয়াছিল; জাগরণে স্বপ্নে তিনি এর বিষয় ভাবিতেন ৷ এ সম্বন্ধে নিজের দুটি স্বপ্ন মধ্যে মধ্যে বলিতেন; তাহা এইরূপ:-
“প্রথমে আমি বড়ই কম পুঁথি পাই। কিন্তু একরাত্রে স্বপ্ন দেখিলাম যে কে যেন আমাকে বলিল “যদি হস্তলিপি চাও তবে আমার সঙ্গে এস।” আমি তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে গিয়া লক্ষ্ণৌয়ের ইমাম্বারার মত একটি প্রকাণ্ড অট্টালিকার দ্বারে উপস্থিত হইলাম। পথ প্রদর্শক একলা ভিতরে গিয়া কিছুক্ষণ পরে বাহির হইয়া আসিল এবং আমাকে সঙ্গে লইয়া আবার মধ্যে গেল। দেখিলাম যে ইমামবারার প্রশস্ত হলের মধ্যে এক মহাপুরুষ বসিয়া আছেন, তাঁহার মুখ আবৃত, চারিপার্শ্বে তাঁহার সঙ্গিগণ উপবিষ্ট। পথ-প্রদর্শক আমাকে দেখাইয়া বলিল ‘এই লোকটি হস্তলিপি চায়।’ মহাপুরুষ উত্তর করিলেন ‘উহাকে দেও।’ এর পর হইতেই আমার পুস্তকালয়ে নানাদিক হইতে হস্তলিপি আসিয়া জুটিতে লাগিল। (খুদাবক্সের স্বপ্নদৃষ্ট মহাপুরুষ মুহম্মদ এবং তাঁহার চারিপাশে মুহম্মদের সঙ্গিগণ, আস্হাব্।)
“এক রাত্রে আমি স্বপ্নে দেখিলাম যে পুস্তকালয়ের পাশের রাস্তা লোকে লোকারণ্য হইয়াছে। কারণ জানিবার জন্য বাড়ী হইতে বাহির হইয়া আসিলাম। সকলে বলিল ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ তোমার পুস্তকালয় দেখিতে আসিয়াছেন, আর তুমি এতক্ষণ অনুপস্থিত ছিলে!’ আমি তাড়াতাড়ি উপরে পুথির ঘরে গিয়া দেখি যে তিনি চলিয়া গিয়াছেন, কিন্তু দুইখান হদীসের হস্তলিপি টেবিলের উপর খোলা রহিয়াছে; লোকে বলিল যে প্রেরিত-পুরুষ, এই দুখানি পড়িতেছিলেন। (এই দুই পুথির উপর খুদাবক্স স্বহস্তে লিখিয়া রাখিয়াছেন “এ বহি কখনও পুস্তকালয় হইতে বাহিরে যাইতে দিবে না ৷ “ )
খুদাবক্সের সমস্ত হৃদয় সমস্ত মন এই পুস্তকালয়ে মগ্ন ছিল। শেষ বয়সে মতিভ্রমের সময় তিনি প্রায়ই পুস্তকালয় সম্বন্ধে নানারূপ কাল্পনিক বিপদ ভাবিয়া ব্যস্ত হইতেন। প্রতি পুস্তক যেন তাঁহার চোখের সম্মুখে থাকিত। মৃত্যুর দুই দিন আগেও একখান মসনদ নামক গ্রন্থের আলমারী শেল্ফ ও স্থান ঠিক বলিয়া দিলেন!
শেষ বয়সে পুস্তকালয়ের বারান্দায় অথবা বাগানে খুদাবক্স প্রত্যহ সকাল সন্ধ্যা কাটাইতেন। সেই ধবলকেশ ও শ্মশ্রুযুক্ত স্থির গম্ভীর মূর্ত্তি এখনও যেন মানসচক্ষুতে দেখিতে পাই। বৃদ্ধ খাঁ বাহাদুর সাধারণ মত সাদা পোষাক পরিয়া চেয়ারে বসিয়া আছেন, তাঁহার হুঁকাটি একটি নীচু তিন-পায়া টেবিলের উপর দাঁড়াইয়া; তিনি হয়ত দুই একজন আগন্তুকের সঙ্গে কথা কহিতেছেন অথবা কোন হস্তলিপির পাতা উল্টাইতেছেন,- এ দৃশ্য কতদিন রাস্তা হইতে দেখা গিয়াছে।
এই পুস্তকালয়ের জাতীয় আবশ্যকতা
লাইব্রেরী এবং পাঠাগারের মাঝে একটি ছোট আঙ্গিনায় খুদাবক্সের সমাধি হইয়াছে। গোরটি নীচু এবং সাধারণ রকমের। ইহাই তাঁহার শেষ বিশ্রামের স্থূল, যিনি ভারতবর্ষের জন্য রাজা রাজড়ার চেয়েও বেশী মূল্যবান দান করিয়া গিয়াছেন। প্রতি জেলাতেই খুদাবক্সের মত ৩/৪ জন প্রধান উকীল থাকেন; কিন্তু তাঁহার কীর্ত্তি ভারতে অদ্বিতীয়। যতই আমাদের জ্ঞানের চর্চ্চা বাড়িবে ততই আমরা খুদাবক্স-পুস্তকালয়ের প্রকৃত মূল্য বুঝিতে পারিব। এখন আমাদের দেশের পুরাতত্ত্ববিদগণের সংখ্যা বড় কম; তাঁহাদের অধিকাংশই সংস্কৃত ও পালির চর্চ্চা করেন, ফার্সীর দিকে দুই তিনজন মাত্র গিয়াছেন, আরবীর দিকে কেহই না। একজন বিলাতী পণ্ডিত খুদাবক্স-লাইব্রেরী পরিদর্শন করিয়া বলেন, “পুস্তকের জন্য কি সুন্দর গোর নির্ম্মাণ করিয়াছেন! ইউরোপ হইলে এই লাইব্রেরীতে প্রত্যহ শত শত লেখক তত্ত্বান্বেষণ করিত; কিন্তু এখানে একটিও পাঠক দেখিতেছি না।” কিন্তু ভারতবর্ষের কি চিরদিনই এই দশা থাকিবে? ইতিমধ্যেই আমাদের কয়েকজন দেশের প্রাচীন কাহিনীর আলোচনা আরম্ভ করিয়াছেন। দিন দিন তাঁহাদের সংখ্যা বাড়িবে। খুদাবক্স লাইব্রেরী স্থাপন হওয়ায় এই লাভ হইয়াছে যে দেশের অমূল্য অনেক গ্রন্থ চিরদিনের জন্য দেশে থাকিয়া যাইতেছে। অনেক মুসলমান ও হিন্দু ভদ্রলোক তাঁহাদের পৈত্রিক হস্তলিপিগুলি এই লাইব্রেরীতে দান করিয়া তাহাদিগকে সাধারণের ব্যবহারে লাগাইতেছেন এবং বিনাশ বা বিক্রয় হইতে রক্ষা করিয়াছেন।
ইংরাজদের একটি মহা গুণ এই যে তাঁহারা যেখানেই যান, হস্তলিপি, প্রাচীন কলাবস্তু, বৈজ্ঞানিক সামগ্রী প্রভৃতি সযত্নে সংগ্রহ করেন এবং তাহা নিজের দেশের মিউজিয়ম ও পুস্তকালয়ে দান করিয়া স্বজাতির জ্ঞানবৃদ্ধির সাহায্য করেন। বিলাতের বডলিয়ান, ব্রিটিশ মিউজিয়ম্ এবং ইন্ডিয়া আফিস লাইব্রেরীতে অনেক হস্তলিপি প্রাচীন য়্যাংগ্লোইণ্ডিয়ান্ কর্মচারীদের দান। সেই ব্রিটিশ রাজ্যের অভ্যুদয়ের সময়ে তাঁহারা একদিকে এদেশ বিজয় ও শাসন-শৃঙ্খলাস্থাপন করিতেন, আর অপর দিকে যত অমূল্য হস্তলিপি ও ছবি পারিতেন সংগ্রহ করিতেন। এইরূপে কত কত সংস্কৃত ও ফার্সী পুঁথি একেবারে ভারত হইতে লোপ পাইয়াছে। সেগুলি বিলাত না গেলে আর দেখিবার উপায় নাই। ভারত ইতিহাস লেখার মালমশলা বিলাতে যত সহজলভ্য ও প্রচুর, এদেশে তেমন নহে। প্রাচীন ইজিপ্ট জানিতে হইলে, লন্ডন, প্যারিস ও বার্লিনে যাইতে হয়, নব্য মিসরে নহে। ভারতের দশাও প্রায় তেমনি।
কিন্তু খুদাবক্স লাইব্রেরী স্থাপিত হওয়ায় এবং সাধারণের নামে লিখিত পড়িত করিয়া দেওয়ায় আমরা এই ক্ষতি হইতে রক্ষা পাইয়াছি। আর এসব গ্রন্থরত্ন হারাইবার সম্ভাবনা নাই। লাইব্রেরীটি দেশময় বিখ্যাত; সকল পুথির মালিককে যেন ডাকিতেছে– “যদি তোমাদের গ্রন্থ নিরাপদ রাখিতে এবং সাধারণের সেবায় লাগাইতে চাও তবে আমাকে দেও; তাহা না করিলে ওগুলি হয় ধ্বংস হইবে না হয় অন্য দেশে চলিয়া যাইবে।” এইরূপে খুদাবক্স ভিন্ন অন্য লোকের দানেও লাইব্রেরী পুষ্ট হইতেছে। তার দুটি দৃষ্টান্ত দিতেছি :-
বাদশাহ জাহাঙ্গীর ভবিষ্যৎ গণনা করিবার জন্য এক খণ্ড হাফিজের পদ্যাবলী হঠাৎ খুলিয়া যে ছত্রে প্রথম দৃষ্টি পড়িত তাহার অর্থ লইতেন, এবং কোন্ ঘটনা সম্বন্ধে কোন্, তারিখে ঐ বহি দেখিলেন ও ভবিষ্যৎ বাণীর কি ফল হইল তাহা স্বহস্তে ছত্রটির পাশে লিখিয়া রাখিতেন! যেমন ইউরোপের মধ্যযুগে ভার্জিলের পদ্যগ্রন্থ লোকে দেখিত এবং এখনও অনেক মুসলমান কোরান দেখিয়া ভবিষ্যৎ জানিতে চাহেন, ঠিক সেই মত। এই জন্যই হাফিজের নামান্তর লিসান্-উল্-ঘাএব্ (অদৃশ্য জিহ্বা অর্থাৎ ভবিষ্যৎ কথা)। এই অমূল্য পুথিখানি গোরক্ষপুরের মৌলবী সুভানউল্লা খাঁ বৎসর দুই হইল খুদাবক্স লাইব্রেরীতে উপহার দিয়াছেন। ইতিপূর্ব্বে তাঁহার দপ্তরী বইখানি বাঁধিবার সময় অনাবশ্যক বোধে মার্জিনে জাহাঙ্গীরের হস্তের লেখা এক ইঞ্চি পরিমাণে কাটিয়া ফেলিয়াছে! আর দেরী করিলে বোধ হয় পুথিখানি একেবারে লোপ পাইত।
আবার আওরংজীবের মুন্শী (Secretary) ইনায়াৎ-উল্লাখাঁর আহকাম্-ই-আলমগীরী এতদিন নামে মাত্র জানা ছিল; ভারতে বা ইউরোপের কোন সাধারণ পুস্তকালয়ে এখানি দেখা যাইত না, এবং কোন ঐতিহাসিক উহা পাঠও করেন নাই। ২৯০৭ খ্রি: পূজার ছুটিতে আমি রামপুর (রোহিলখন্দ) নবাবের পুস্তকালয়ে উহার এক বাদশাহী হস্তলিপি প্রথমে পাই এবং নকল লইবার বন্দোবস্ত করি। তারপর বাঁকিপুর ফিরিয়া দেখি কি না কিছুদিন পূর্ব্বে উহার আর এক হস্তলিপি (দিল্লীর কোন সম্ভ্রান্ত লোকের জন্য লিখিত) খুদাবক্স লাইব্রেরীতে পাটনার সফদর নবাব দান করিয়াছেন! এইরূপে কত কত বই এখানে আসিতেছে।
চিত্র ও লেখার কারুকার্য্য
প্রাচ্য চিত্রবিদ্যার আদর্শ এখানে এত সংগ্ৰহ হইয়াছে যে তা দেখিয়া মি: হ্যাঁভেল মুগ্ধ হইয়া গিয়াছেন। মুঘল বাদশাহদিগের অনেক ছবির বহি ও সচিত্র ইতিহাসের হস্তলিপি, রণজিৎ সিংহের কতকগুলি সচিত্র বহি, এবং দিল্লী ও লক্ষ্ণৌয়ের বড়লোকদের ছবির য়্যালবাম (“মুরাক্কা”) এখানে অনেক আছে। অনেক বৎসরের পরিশ্রমের পর একখানি একখানি করিয়া ছবি সংগ্রহ করিযা কোন কোন ভল্যুম সম্পূর্ণ করা হইয়াছে। প্রথমে মধ্য এসিয়ায় চীনে চিত্রকরদিগের প্রভাব এবং মুঘল বাদশাহদের সঙ্গে মধ্য এসিয়া হইতে সেই চীনে চিত্রপ্রথার ভারতে আগমন, পরে ভারতীয় (হিন্দু) চিত্রবিদ্যার বিকাশ, অবশেষে বিলাতী আর্টের আধিপত্য,- এ সমস্ত এই ছবিগুলি হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। এর অনেকগুলি ছবির ফটোগ্রাফ লইয়াছি, ক্রমে প্রবাসীতে বাহির হইবে। এবার সাধু কবীর দেওয়া গেল। এত যুগের এত দেশের এবং এত রকমের কাগজে এইসব পুঁথি লেখা যে এই লাইব্রেরীতে বসিয়া কাগজ তৈয়ারীর ইতিহাস রচনা করা যায়। কতকগুলি কাগজ পেকিনের (নাম “খাঁবালিঘ”), কতক বুখারা ও সমরকন্দের কতক, কাশ্মীরী, বাদশাহদিগের নিযুক্ত কারিগরের প্রস্তুত।
খুদাবক্সের পুস্তকালয়ের ইংরাজী বইগুলিও মূল্যবান এবং অনেক দাম প্রায় লক্ষ টাকা হইবে। বিশেষত: তিনি বিলাতে এক সম্পূর্ণ লাইব্রেরি নিলামে কিনিয়া লন, তাহার চামড়ার বাঁধাই দেখিয়া চক্ষু জুড়ায়।
গ্রন্থসংগ্রহের গল্প
এইসব ফার্সী ও আরবী হস্তলিপি সংগ্রহের বিবরণ উপন্যাসের মত কৌতূহলজনক। মুসলমান রাজত্বের সময় যত সব শ্রেষ্ঠ হস্তলিপি দিল্লীর বাদশাহের নিকট আসিয়া জুটিত। কতকগুলি শত শত এমন কি হাজার মোহর দিয়া কেনা হইত; কতকগুলি বাদশাহের বেতনভোগী লেখক ও চিত্রকরদের দ্বারা রচিত হইত; কতকগুলি বা যুদ্ধের পর বিজিত দেশ হইতে আনা হইত (যেমন বিজাপুর এবং গোলকুণ্ডা হইতে); আর অনেকগুলি প্রথমে ওমরাহদের ঘরে ছিল এবং তাঁহাদের মৃত্যুর পর অন্যান্য সম্পত্তির সহিত বাদশাহী সরকারে ভুক্ত হইত। আকবরের সভা-কবি ফৈজির মৃত্যুর পর তাঁহার ৪,৩০০ হস্তলিপি বাদশাহ জব্ৎ করিয়াছিলেন। এইরূপে ১৬ ও ১৭ শতাব্দীতে এসিয়ায় সব চেয়ে বড় ও মূল্যবান পুস্তকালয় দিল্লীর বাদশাহদের ছিল।
১৮ শতাব্দীতে এর কতকগুলি লক্ষ্ণৌয়ের নবাবেরা হস্তগত করেন। অবশেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর দিল্লী লক্ষ্ণৌয়ের রাজবাড়ী লুঠ হইল, পুরাতন পুঁথিগুলি চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। রোহিলখন্দের নবাব ইংরাজদের পক্ষে ছিলেন। দিল্লী জয়ের পর তিনি ঘোষণা করেন যে প্রতি পুথির জন্য এক টাকা দিবেন; এইরূপে সিপাহী ও গোরারা তাঁহাকে কত বাদশাহী ও ওমরাহদের হস্তলিপি বেচিল।
অনেক দিন ধরিয়া এই নবাবের সঙ্গে খুদাবক্সের পুথি কেনা লইয়া পাল্লাপাল্লি চলে। অবশেষে খুদাবক্স মুহম্মদ মকী নামক একজন অত্যন্ত চতুর আরবজাতীয় পুথির দালালকে নবাবের পক্ষ হইতে ভাঙ্গাইয়া আনেন, এবং আঠারো বৎসর পর্যন্ত তাহাকে মাসিক ৫০ টাকা বেতন দিয়া, সিরিয়া, আরব্য, মিশর, এবং পারস্যে পুথি খুঁজিতে ও কিনিতে নিযুক্ত করেন। এই লোকটি অনেক মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রহ করিয়া দেয়।
যে কোন হস্তলিপি-বিক্রেতা বাঁকিপুরে আসিত খুদাবক্স বহি কিনুন আর না কিনুন তাহাকে আসিবার যাইবার রেলভাড়া দিতেন। এইরূপে তাঁহার নাম ভারতময় বিখ্যাত হইল এবং কোথাও কোন হস্তলিপি বিক্রয় হইতে গেলে প্রথমে তাঁহাকে দেখান হইত ৷
মজার বিষয় এই যে, একবার একজন পূর্ব্বর্তন দপ্তরী রাত্রে এই পুস্তকালয়ে ঢুকিয়া প্রায় ২০ খান মহামূল্য হস্তলিপি চুরি করিয়া লাহোরে একজন দালালের নিকট বেচিতে পাঠায়। দালাল সৰ্ব্বপ্রথমে খুদাবক্সকে সেগুলি পাঠাইয়া জিজ্ঞাসা করে যে তিনি কিনিবেন কি! এইরূপে চোর ধরা পড়িল।
আর একবার ঠিক এই মত ধর্ম্মের কাঠি বাতাসে নড়িয়াছিল। মি. জে, বি, এলিয়াট্ নামে পাটনার প্রাদেশিক জজ মুহম্মদ বক্সের নিকট হইতে কমালুদ্দীন ইসমাইল ইস্ফাহানীর দুর্লভ পদ্যাবলী ধার লইয়া পরে ফিরিয়া দিতে অস্বীকার করেন, বলেন যত দাম চাও দিব। মুহম্মদ বক্স রাগিয়া এক পয়সা লইলেন না। পরে যখন এলিয়ট্ সাহেব পেন্সন লইয়া বিলাতে যান তাঁহার সব ভাল পুথিগুলি কয়েকটি বাক্সে প্যাক করিয়া বিলাতে পাঠান হইল। অকেজো কাগজ পত্র ও বহি নিলামে বিক্রয় করিবার জন্য অপর এক বাক্সে বন্ধ করিয়া পাটনায় রাখিয়া গেলেন। ধর্ম্মের এমনি কাজ ঐ কেড়ে লওয়া হস্তলিপি এবং আরও ৩/৪ খানি অমূল্য পুথি, (তার একখানিতে শাহজাহানের সই আছে!) ভ্রমক্রমে এই বাক্সে রাখা হয়, এবং নিলামে মুহম্মদ বক্স তাহা কিনিয়া লন! সাহেব বিলাত পৌঁছিয়া ভ্রম টের পাইলেন, কিন্তু তখন আর কি হইবে?
পুস্তক সংগ্রহ করা একটি নেশা। ইহাতে খুদাবক্সেরও ধর্মাধর্ম্ম জ্ঞান ছিল না। পাটনার একজন প্রাচীনবংশের মূর্খ মুসলমানের নিকট একখান দুর্লভ হস্তলিপি ছিল। সে তাহার এক অক্ষরও পড়িত না অথচ কিছুতেই তাহা খুদাবক্সকে বেচিতে বা দান করিতে সম্মত হইল না। অবশেষে খুদাবক্স ৩ দিনের জন্য পুথিখানি ধার করিলেন, এবং মলাট হইতে কাটিয়া বাহির করিয়া লইয়া সেই মলাটের মধ্যে নিজের একখান সেই আকারের কিন্তু অসার হস্তলিপি সেলাই করিয়া ফেরত দিলেন; মালিক তাহা পাইয়াই সন্তুষ্ট!
ব্লকম্যান সাহেবের মৃত্যুর পর কলিকাতায় তাঁহার হস্তলিপি সংগ্রহের নিলামের সময় খুদাবক্স গিয়া জজ আমীর আলীর সঙ্গে আড়াআড়ি করিয়া দাম হাঁকিতে লাগিলেন, এবং বলিলেন “আজ দেখিব জজ জেতে কি উকীল জেতে।” অবশেষে জজ মহাশয়ই পিছাইয়া গেলেন।
একবার হায়দরাবাদে কাছারী হইতে ফিরিবার সময় খুদাবক্সের তীক্ষ্ণ চক্ষু দেখিতে পাইল যে এক মুদীর অন্ধকার দোকানের মধ্যে ময়দার বস্তার উপর কয়েকখান পুথি আছে। অমনি গাড়ী থামাইয়া সেগুলি উল্টাইয়া দেখিয়া দাম জিজ্ঞাসা করিলেন। মুদী উত্তর করিল, “এইসব পুরাতন কাগজ অন্য কাহাকেও হইলে ৩ টাকায় বেচিতাম। কিন্তু হুজুর যখন লইতে চান তখন এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন দামী জিনিষ আছে। আমি ২০ টাকা চাই।” খুদাবক্স সেই দামই দিলেন। পুথিগুলির মধ্যে একখান আরবী জীবনচরিত ছিল যাহা অন্য কোথায়ও পাওয়া যায় না। স্বয়ং নিজাম তাহা ৪০০ টাকায় কিনিতে চাহিলেন, কিন্তু খুদাবক্স সে বহি ছাড়িলেন না।
শ্রেষ্ঠ পুঁথির বিবরণ
এখন এই লাইব্রেরীর গ্রন্থরত্নের কতকগুলি বর্ণনা করিব। জাহাঙ্গীরের ভাগ গণনার বহির কথা আগেই বলিয়াছি। তুর্কীর সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদের ক্যান্টিনোপ্ল ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ জয়ের বিবরণ এক মহাকাব্যের আকারে লিখিয়া সেই সচিত্র পুথি গ্রন্থকার ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান তৃতীয় মুহম্মদকে উপহার দেন। তুর্কী রাজবাড়ী হইতে বইখানি চুরি হইয়া শাহজাহানের রাজত্বকালে ভারতে আসে। পৃথিবীতে ইহার আর দ্বিতীয় নাই। এর একখানি যুদ্ধের ছবি প্রবাসীতে দিব।
ফার্সী লেখায় নূর আলী ভারতে সব চেয়ে বিখ্যাত ছিলেন। তাঁহার নকল করা জামির কাব্য ইউসুফ ও জ্বলেখা বাদশাহ জাহাঙ্গীর হাজার মোহর দামে কেনেন। এখানি এখন খুদাবক্স লাইব্রেরীতে স্থান পাইয়াছে। শাহজাহানের সহী করা দুইখানি বহি আছে, একখানির লেখা তাঁহার ১৪ বৎসর বয়সের। দারাশিকোর স্বহস্তে লিখিত সাধুচরিত (সফিনৎ-উল্-আওলিয়া),গোলকুণ্ডার সুলতানের দিউয়ান-ই-হাফিজ,- আমীর খরুর মসৃনবী যাহা বুখারার সুলতান মীর আলীকে তিন বৎসর জেলে পুরিয়া রাখিয়া লেখাইয়া লন!– রণজিৎ সিংহের সৈনিক বিভাগের হিসাবের বহি (ফার্সী ও গুরুমুখী অক্ষরে লেখা), আলী মৰ্দ্দান খাঁ শাহজাহানের সঙ্গে প্রথমে সাক্ষাতের সময় যে সচিত্র ফিদ্দৌসীর শাহনামা বাদশাহকে উপহার দেন, সেখানি,- আমীর খর গ্রন্থাবলী, আকবরের মাতা হামিদাবানুর মোহরযুক্ত– হাতিফির কাব্য শীরীন্ ও খ বিজাপুর রাজ্যের জন্য অতি সূক্ষ্ম অক্ষরে লেখা- জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী, যাহা তাঁহার আজ্ঞায় গোলকুণ্ডার রাজাকে উপহার দেওয়া হয় এবং পরে আওরাংজীব ঐ দেশ জয় করিয়া কাড়িয়া লইয়া আসেন, একখান অনেক চিত্র-পূর্ণ তাইমুর বংশের ইতিহাস, ভারতীয় সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ছবির আদর্শ সহিত শাহজাহানের ইতিহাস- এ সমস্ত খুদাবক্স সংগ্রহ করেন। শেষোক্ত দুইখানির অনেক ছবি প্রবাসীর জন্য ফটো লইয়াছি। আর কত বর্ণনা করিব? সবগুলির নাম করিতে গেলে প্রবন্ধ শেষ হইবে না।
আরবী বিভাগে তফসির্-ই-কবীর নামক কোরানের এক টীকা আছে, তিন প্রকাণ্ড ভলুমে, অতি ক্ষুদ্র অথচ পরিষ্কার ও আগাগোড়া এক রকমের অক্ষরে লিখিত। একজন লোক এত পরিশ্রম করিয়াছিল ভাবিলে আশ্চর্য্য হইতে হয়। মুসলমান জগতের অনেক পণ্ডিত আন্দলুস্ অর্থাৎ দক্ষিণ স্পেনে জন্মগ্রহণ করেন। যখন অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ অন্ধকারে আবৃত তখন এই মুর রাজত্বেই জ্ঞানের দীপ জ্বলিয়াছিল। আরব বৈজ্ঞানিক জোহরাবীর লেখা অস্ত্রচিকিৎসার এক পুথি আছে, তাহাতে সব অস্ত্রের ছবি দেওয়া! বিখ্যাত খলিফা হারুনের পুত্র মামুনের রাজত্বকালে ডিয়কোরাইডেস রচিত উদ্ভিদতত্ত্বের এক গ্রীক বহির আরবীতে অনুবাদ হয়, নাম কিতাব-উল-হাশায়েশ। ইহার এক অতি পুরাতন হস্তলিপি আছে, সমস্ত উদ্ভিদের রঞ্জিত ছবিযুক্ত, শিকড়টি পর্যন্ত আঁকা! একখণ্ড ভেড়ার চামের কাগজে (পার্চমেণ্টে) কতকগুলি কুফিক্ অক্ষর আছে, প্রবাদ যে সেগুলি মুহম্মদের জামাতা আলীর হস্তাক্ষর! যে সময়ে আরবীতে আকার ইকার উকারের চিহ্ন (জের্, জবর্, পেশ্) ব্যবহারে আসে নাই, সেই পুরাকালের লিখিত এক কোরান আছে; (মুর্শীদাবাদে নিজামৎ লাইব্রেরীতেও এরূপ আর একখান দেখিয়াছি।) রেশমের মত পাতলা একখান সরু অথচ অতি দীর্ঘ পার্চমেন্টে অতি ক্ষুদ্র অক্ষরে সমগ্র কোরান লেখা; অথচ সাধারণ চক্ষে পড়া যায়!
আর দুই খানি ঐতিহাসিক গ্রন্থ আকবর বাদশাহের আরবী প্রার্থনা-পুস্তক, এবং ফার্সীতে লিখিত যীশুর কাহিনী (দাস্তান-ই-মাসিহ্।) শেষ পুথিখানির ভূমিকায় লেখা আছে যে বাদশাহ খ্রিস্টধর্ম্মের সারমর্ম্ম জানিতে ইচ্ছা প্রকাশ করায় ক্যাথলিক পাদারী জেরো (অথবা জন্ধ্র) এবং হম্ শুটর খ্রিস্টান, এই দুই জন বাইবেল হইতে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করিয়া এই ফার্সী বহি রচিয়া বাদশাহকে উপহার দেন; গ্রন্থখানি আকবরের মৃত্যুর একবৎসর পূর্ব্বে, ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা।
গত দিল্লী দরবার হইতে ফিরিয়া লর্ড কার্জ্জন প্রথমেই বাঁকিপুরে আসেন। তখনও তাঁহার মনে মুঘল বাদশাহগণের গৌরবচিহ্ন জাগিয়া ছিল। খুদাবক্স লাইব্রেরীতে প্রবেশ করিয়া তিনি দিল্লীর দিউয়ান-ই-খাসের সোনায় লিখিত পদ্যটি আবৃত্তি করিলেন :-
আগর্ ফিদৌস্ বর্রু-এ-জমীনস্ত।
হমিনন্ত ও হমিনস্ত ও হমিনস্ত।
অর্থাৎ
ধরাতলে যদি কোথা স্বৰ্গলোক থাকে।
এই তাহা, এই তাহা, এই তাহা বটে ॥
ইহাই খুদাবক্স-পুস্তকালয়ের প্রকৃত বর্ণনা ৷
[প্রবাসী, ভাগ ৮, সংখ্যা ৬, আশ্বিন, ১৩১৫।]