ক্যান্টনমেন্টের উত্তাপ ঢাকা শহরে প্রবেশ করল না। শহর তার নিজের নিয়মে চলতে লাগল। শান্ত নিস্তরঙ্গ ঢাকা শহর।
মাঠাওয়ালারা মাঠা মাঠা বলে মাঠা বিক্রি করতে লাগল। ধুনুরিরা কাঁধে ধুন নিয়ে লেপ-তোষক সারাইয়ে নেমে গেল। ছুরি-কাঁচি ধার করানোর লোকও নামল। মিষ্টি গলায় বলতে লাগল, ছুরি-কাঁচি ধার করাইবেন? সে বছর প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ল। আমি আমার জীবনে এত সস্তা ইলিশ দেখি নি। ইলিশ মাছ সস্তা হওয়া মানে অন্যান্য মাছ ও শাকসবজির দাম কমে যাওয়া। তা-ই হলো। ঢাকা শহরবাসীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তাদের কাছে মনে হলো জিয়া সরকার দেশের জন্য মঙ্গল নিয়ে এসেছে।
আমি তখন খুবই কষ্টে জীবন কাটাচ্ছি। বাবার পেনশনের সামান্য টাকা এবং কেমেস্ট্রির লেকচারার হিসেবে আমার বেতনে ছয় ভাইবোন এবং মাকে নিয়ে বিশাল সংসার চলছে। চলছে বলা ঠিক হবে না, আটকে আটকে যাচ্ছে। গাড়ি চলে না চলে না’-টাইপ চলা। মাসের শেষদিকে আমাকে এবং মা’কে ধারের সন্ধানে বের হতে হচ্ছে। ধার দেওয়ার মতো মানুষের সংখ্যাও তখন সীমিত। যারা আছেন তারা আমাকে এবং মা’কে ধার দিতে দিতে ক্লান্ত বিরক্ত।
এই প্রবল দুঃসময়ে বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত ভাই একদিন আমাকে বললেন, বিচিত্রা গ্রুপ থেকে বাচ্চাদের একটা পত্রিকা বের হবে। প্রথম সংখ্যায় একটা লেখা দিতে পারবেন?
আমি এত জোরে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম যে মাথা ছিঁড়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। রাত জেগে লিখলাম নীলহাতি। শিশু-কিশোরদের জন্যে জীবনের প্রথম লেখা। এই লেখার চালিকাশক্তি সাহিত্যসৃষ্টি ছিল না, কিঞ্চিত অর্থোপার্জন ছিল।
লেখা প্রকাশিত হলো এবং আমি সম্মানী হিসেবে কুড়ি টাকা পেলাম। পরিষ্কার মনে আছে—এই টাকায় এক সের খাসির মাংস, পোলাওয়ের চাল এবং ঘি কেনা হলো। অনেকদিন ভালো খাবার খাওয়া হয় না। একদিন ভালো খাবার।
গ্রামবাংলায় একটি কথা চালু আছে, যেদিন উত্তম খাবার রান্না হয় সেদিন যদি হঠাৎ কোনো অতিথি উপস্থিত হন তখন ধরে নিতে হবে উত্তম খাবারের উপলক্ষ
সে অতিথি। তখন অতিথিকে যথাযোগ্য সমাদর করতে হবে।
ঘরে পোলাও, খাসির রেজালা এবং ডিমের কোরমা রান্না হয়েছে। বাসায় অপরিচিত একজন অতিথিও এসেছেন। ছোটখাটো মানুষ, গাত্রবর্ণ কালো। সারাক্ষণ হাসছেন। তাঁর নাম আশরাফুন্নিসা। কর্নেল তাহেরের মা। তিনি নাকি কাছ থেকে কোনো লেখক দেখেন নি। লেখক দেখতে এসেছেন।
তিনি আমাকে দেখে হাসতে হাসতে বললেন, হুমায়ূন ব্যাটা! আমাকে সালাম করো। আমি তোমার আরেক মা।
আমি তৎক্ষণাত তাঁকে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথার ঘ্রাণ কে বললেন, ঠিক আছে।
কী ঠিক আছে তা কখনো তাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি।
আমি তাকে না চিনলেও তার ছোট ছেলে আনোয়ারকে খুব ভালো করে চিনি। আনোয়ার তখন আমার মতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। মাঝে মধ্যে ক্লাসের শেষে আমরা দু’জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে বসে চা খাই।
আনোয়ারের মাথায় বিপ্লবী সিরাজ সিকদার এবং তার ভাই কর্নেল তাহের নানান আইডিয়া ঢুকিয়ে দিয়েছেন। সেইসব আইডিয়ার কারণে আনোয়ারের সব গল্পই দেশ বদলে দেওয়ার গল্প। তবে আনোয়ার যে সিরাজ শিকদার গ্রুপের এক সক্রিয় সদস্য তা আমাকে সে জানায় নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের লাউঞ্জে আনোয়ারের সব গল্প শেষ হয় চা শেষ করে একটা কথায় হুমায়ূন, চলো তো আমার সঙ্গে।
কোথায়?
তাহের ভাইয়ের কাছে। উনি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
উনি আমাকে চেনেন কীভাবে?
আমি তোমার কথা ভাইজানকে বলেছি, উনি তোমার বইও পড়েছেন। আমরা সব ভাইবোন বইয়ের পোকা।
আজ না। আরেক দিন যাব।
কবে যাবে?
কোনো-এক শুভদিনে যাব।
আনোয়ারের তখন পুরনো একটা মোটর সাইকেল ছিল। তাকে অকারণে মোটর সাইকেলে ঘুরতে দেখতাম।
আনোয়ার এবং কর্নেল তাহেরের মা বেগম আশরাফুন্নিসাকে আমি আমার মায়ের মতোই দেখেছি। তিনি আমাকে ডাকতেন হুমায়ূন ব্যাটা’। তাঁর ডাকের সঙ্গে আমার বাবার ডাকেরও মিল ছিল। বাবা আমাকে ডাকতেন—বড় ব্যাটা হুমায়ূন’।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা আমার নিজের খুব পছন্দের বই আগুনের পরশমণি আমি বেগম আশরাফুন্নিসাকে উৎসর্গ করি।
উৎসর্গপত্রে লেখা–
বীর প্রসবিনী
বেগম আশরাফুন্নিসা
কর্নেল তাহেরসহ
আটজন মুক্তিযোদ্ধার জননী।
উৎসর্গপত্রে সামান্য ভুল আছে। বেগম আশরাফুন্নিসা আটজন মুক্তিযোদ্ধার জননী না, তিনি নয়জন মুক্তিযোদ্ধার জননী। তাঁর সাত পুত্র এবং দুই কন্যা মুক্তিযোদ্ধা। এই নয়জনের মধ্যে চারজন মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্যে বীরত্বসূচক পদকের অধিকারী। কর্নেল তাহের বীর উত্তম, এক ভাই ইউসুফ বীর বিক্রম, দুই ভাই বীর প্রতীক। এই বীর প্রতীক এঁরা পেয়েছেন দু’বার করে।
এই প্রসঙ্গে আমি আবার ফিরে আসব। এখন চলে যাই নীলহাতি’তে।
খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানির মালিক খান সাহেব ‘নীলহাতি’ বই হিসেবে ছাপাতে রাজি হলেন। তবে বিরক্ত মুখ করে বললেন, আপনি যে সব লিখছেন বাচ্চারা এইগুলা পড়বে না। ছোট ছোট ডিটেকটিভ বই লেখেন। স্বপন কুমার টাইপ দুই টাকা সিরিজের—মাসে দু’ মাসে একটা করে বের হবে। পারবেন?
আমি বললাম, জি পারব।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্যাশ থেকে এক শ টাকা দিলেন ডিটেকটিভ বইয়ের জন্যে অগ্রিম সম্মানী। তিনি বললেন, একটা ডিটেকটিভ বই আগে লিখে দেন, তারপর আমি আপনার ‘নীলহাতি’ ছাপব। নীলহাতি বইয়ের সুন্দর কভার লাগবে। কাইয়ুম চৌধুরীকে দিয়ে হবে না, উনি দশ বছর লাগাবেন। দেখেন অন্য কাউকে পান কি না।
নীলহাতির প্রচ্ছদশিল্পী খুঁজতে গিয়ে আমার আদর্শলিপি প্রেসের শফিকের সঙ্গে পরিচয়।
শফিক ছোটখাটো মানুষ। শ্যামলা রঙ। চোখের পাপড়ি মেয়েদের মতো দীর্ঘ বলেই হয়তো চেহারায় মেয়েলি ব্যাপার আছে। তাকে ঘিরে আশ্চর্য এক স্নিগ্ধতা আছে। আমি অল্প কিছু মানুষের ভেতর এই বিষয়টি দেখেছি।
শফিক আমাকে বসিয়ে রেখেই নীলহাতি’র গল্প পড়ে ফেলল। ছয়-সাত পাতার গল্প, বেশি সময় লাগার কথা না। গল্প শেষ করে গম্ভীর গলায় অতি প্রশংসাসূচক একটি বাক্য বলল। প্রিয় পাঠক, এই বাক্যটি উপন্যাসে ব্যবহার করতে আমার লজ্জা লাগছে। তারপরেও ব্যবহার করছি। শফিক বলল, আপনি যে অনেক বড় একজন গল্পকার, গ্রীম ব্রাদার্সদের মতো, তা কি আপনি জানেন?
আমি হেসে ফেলে বললাম, জানি। দেশের মানুষ তো জানে না।
আমি বললাম, একদিন হয়তো জানবে। আবার হয়তো জানবে না। আমাদের নিয়ন্ত্রণ তো আমাদের হাতে নেই। অন্য কারও হাতে। আমরা পুতুলের মতো নাচছি। সবই ‘পুতুল নাচের ইতিকথা।
আপনি অদৃষ্টবাদী?
হ্যাঁ।
মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরেছেন?
হ্যাঁ।
কতবার?
একবার।
আরও দু’বার মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরবেন। তাই নিয়ম।
আমি শফিকের কথায় যথেষ্টই আনন্দ পেলাম।
শফিক বলল, আমি নিজেও অদৃষ্টবাদী। তবে আপনাকে অদৃষ্টবাদী হলে চলবে না। বড় লেখকেরা জীবনবাদী হন। অদৃষ্টবাদী হন না।
দুপুরে শফিক আমাকে ছাড়ল না। তার সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে হলো। রান্না করেছেন শফিকের মা। শফিক তাকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে। দ্রমহিলা নির্বাক-প্রকৃতির। ছেলের সঙ্গেও কথা বলেন না। ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখেন।
শফিক বলল, মার ধারণা তিনি কুকুরের কথা বুঝতে পারেন। তাঁর একটা কুকুর ছিল, নাম ‘কপালপোড়া’। মা ওই কুকুরের সঙ্গে কথা বলতেন। এখন আমার কুকুরের সঙ্গে কথা বলেন।
আপনার কুকুর আছে নাকি?
হ্যাঁ আছে। নাম দিয়েছি কালাপাহাড়।
শফিকের আদর্শলিপি প্রেসে ওইদিন দুপুরের খাবারের কথা আমার বাকি জীবন মনে থাকবে। কারণ ওইদিন শফিকের মায়ের রান্না করা অদ্ভুত এক খাবার খেয়েছিলাম—আমের মুকুল দিয়ে মৌরলা (মলা) মাছ। অনেককেই এই খাবার তৈরি করে দিতে বলেছি। কেউ রেসিপি জানে না বলে তৈরি করে দেয় নি। শফিকের মাও দ্বিতীয়বার এই খাবার রান্না করেন নি। তিনি আসলে সিজিওফ্রেনিয়ার রোগী ছিলেন। মাঝে মাঝে তার রোগের প্রকোপ বেড়ে যেত। তখন তিনি দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতেন। সারাক্ষণ অদৃশ্য এক কুকুরের সঙ্গে কথা বলতেন। শফিক তাকে ডাকলে কুকুরের মতোই শব্দ করতেন। এই মহিলার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের এক চিকিৎসক। আমি তার নাম ভুলে গেছি। এই চিকিৎসক শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ক্যানসারের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে তার মৃত্যু তরান্বিত করেছিলেন।
শফিকের কারণে আরও দুজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। একজন তার পোষা কুকুর কালাপাহাড়। তার গা-ভর্তি ভেড়ার লোমের মতো বড় বড় ঘন কালো লোম। প্রকাণ্ড শরীর। পুতি পুতি লাল চোখ।
কালাপাহাড় আমাকে দেখেই চাপা ক্রুদ্ধ গর্জন শুরু করল। শফিক বলল, চুপ! কালাপাহাড় চুপ। উনি আমার বন্ধু মানুষ। তাকে দেখে এ রকম শব্দ করা যাবে না। উনি ভয় পেতে পারেন। তুমি যাও তাঁর পায়ের কাছে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে থাকো।
আমাকে অবাক করে দিয়ে এই কুকুর আমার দুই পায়ের কাছে এসে মাথা নিচু করে বসল। আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনার এই কুকুর কি মানুষের ভাষা বুঝতে পারে?
শফিক বলল, সবার কথা বুঝতে পারে না। তবে আমারটা মনে হয় পারে।
আমি বললাম, অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
শফিক বলল, আমাদের ঘিরে আছে অবিশ্বাস্য সব ব্যাপার। আমরা তা বুঝতে পারি না। এই প্রসঙ্গে এডগার এলেন পো’র একটি উক্তি আছে। উক্তিটি শুনেছেন?
আমি বললাম, না। বলুন শুনি।
শফিক বলল, বলব না। আপনি এলেন পো’র রচনা পাঠ করে জেনে নেবেন। আপনি লেখক মানুষ। আপনার প্রচুর পড়াশোনা করা প্রয়োজন।
শফিকের কারণে দ্বিতীয় যার সঙ্গে পরিচয় হলো সে এক _____ অবন্তি। আমি এমন রূপবতী মেয়ে আগে কখনো দেখি নি। ভবিষ্যতে দেখব এমন মনে হয় না। দুধে আলতা গায়ের রঙ বইপত্রেই শুধুই পড়েছি, এই প্রথম চোখে দেখলাম। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর চোখ নিয়ে দুজন এসেছিলেন, একজন হলেন ইংরেজ কবি শেলী। দ্বিতীয়জন হলেন বুদ্ধদেবপুত্র কুনাল। আমি নিশ্চিত, অবন্তির চোখ ওই দুজনের চোখের চেয়েও শতগুণ সুন্দর।
মেয়েটার একটাই দোষ লক্ষ করলাম, সে কিছুক্ষণ পর পর ঠোঁট গোল করে ভুরু কুঁচকে বসে থাকে। তখন তাকে যথেষ্টই কুৎসত দেখায়। মনে হয় বিদেশি এক কুকুর বসে আছে। তার এই বাজে অভ্যাস কেউ শোধরানোর চেষ্টা কেন করে নি কে জানে।
শফিক বলল, আমার এই লেখকবন্ধুকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছি।
অবন্তি বলল, আমি কোনো লেখককে এত কাছ থেকে কখনো দেখি নি। আচ্ছা আপনি কি হাত দেখতে পারেন?
আমি বললাম, না।
অবন্তি বলল, আপনি চমৎকার একটা সুযোগ মিস করলেন। আপনি যদি হ্যাঁ বলতেন তাহলে অনেকক্ষণ আমার হাত কচলাবার সুযোগ পেতেন।
আমি হেসে ফেললাম। অবন্তি বলল, আপনার সঙ্গে আজ গল্প করতে পারব। আমার প্রচণ্ড শরীর খারাপ।
শফিক বলল, তোমার কী হয়েছে?
অবন্তি অবলীলায় বলল, মাসের কয়েকটা দিন মেয়েদের শরীর খারাপ থাকে। আমার সেই শরীর খারাপ। এখন বুঝেছেন?
আমি ছোটখাটো ধাক্কার মতো খেলাম। কোনো মেয়ের কাছ থেকে নিজের শরীর খারাপ বিষয়ে এই ধরনের কথা শুনব তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।
অবন্তির সঙ্গে দেখা হওয়ার একুশ বছর পর আমি একটি উপন্যাস লিখি। উপন্যাসের নাম লীলাবতী। লীলাবতীর রূপ বর্ণনায় আমি অবন্তিকে চোখের সামনে রেখেছিলাম।
তারিখ নভেম্বর ২৪ (১৯৭৫)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে বসে আছি। আনোয়ারের জন্যে অপেক্ষা করছি। আজ আনোয়ার আমাকে কর্নেল তাহেরের কাছে নিয়ে যাবে। কর্নেল তাহের যে তখন পলাতক, এস এম হলে পদার্থবিদ্যার একজন লেকচারারের ঘরে লুকিয়ে আছেন, সেই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।
দিনটা ছিল মেঘলা। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। আনোয়ার আসতে দেরি করছে। আমি তৃতীয় কাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছি। তখন ক্লাবের বেয়ারা এসে বলল, অধ্যাপক রাজ্জাক সাহেব আমাকে ডাকছেন। হ্যারল্ড লাসকির ছাত্র অধ্যাপক রাজ্জাক (পরে জাতীয় অধ্যাপক) তখন কিংবদন্তি মানুষ। তিনি আমাকে চেনেন এবং আমাকে ডাকছেন শুনে খুবই অবাক হলাম।
রাজ্জাক স্যারের সামনে দাঁড়াতেই বললেন, আসেন দাবা খেলি।
রাজ্জাক স্যার বিখ্যাত দাবা খেলোয়াড়। তার সঙ্গে কী খেলব। তারপরেও খেলতে বসলাম। খেলা কিছুদূর অগ্রসর হতেই আনোয়ার এসে উপস্থিত। আমি বললাম, আজ তো আর যেতে পারব না। স্যারের সঙ্গে খেলতে বসেছি।
আনোয়ার হতাশ মুখে বলল, বুঝতে পারছি।
দাবা খেলা সেদিন আমাকে মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করল। আমি কর্নেল তাহেরের সঙ্গে পুলিশের হাতে ধরা পড়লাম না। জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ওই দিনই দশ হাজার জাসদ কর্মীর সঙ্গে কর্নেল তাহের গ্রেফতার হলেন।
দশ হাজার জাসদকর্মীর সঙ্গে আদর্শলিপি প্রেসের শফিকও গ্রেফতার হয়। তার অপরাধ আদর্শলিপি প্রেস থেকে জাসদের প্রপাগান্ডা ছাপা হয়।
কর্নেল তাহেরকে মুক্ত করার জন্য দুদিন পর (২৬ নভেম্বর) জাসদ এক সাহসী পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনার মূল বিষয় বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে অপহরণ এবং পরে তার মুক্তির বিনিময়ে কর্নেল তাহেরের মুক্তি।
পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। অভিযানের ছয় নায়কের মধ্যে চারজনই সমর সেনের নিরাপত্তাকর্মীর হাতে নিহত হন। চারজনের একজন হলেন কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই। নাম সাখাওয়াত হোসেন। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহসিকতার জন্যে তাকে ‘বীর প্রতীক’ সম্মানে দু’বার সম্মানিত করা হয়েছিল।
মিথ্যা এক অভিযোগ আনা হলো কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে। তিনি নাকি ১৯৭৫ সনের ৭ নভেম্বর এক বৈধ সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালান। হায়রে রাজনীতি!
মহাবীর কর্নেল তাহেরের পরিচয় নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। তারপরেও সামান্য দিচ্ছি।
১৪ নভেম্বর ১৯৩৮ সনে জন্ম। বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ, মা আশরাফুন্নিসা।
সিলেটের এমসি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের দুর্গাপুর উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবনের শুরু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে এম. এ. প্রথম পর্ব সমাপ্ত। সেনাবাহিনীতে যোগদান। পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্টে কমিশন লাভ।
১৯৬৫ সনে কাশ্মীর রণাঙ্গণে যুদ্ধে কৃতিত্বের পুরস্কার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার ফোর্ট ব্রানে পড়ার সুযোগ পান। সেখানকার স্পেশাল অফিসার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর সনদে লেখা ছিল—এই যোদ্ধা পৃথিবীর যে-কোনো সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যেকোনো অবস্থায় কাজ করতে সক্ষম।
তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান ‘বীর উত্তম’ পান।
১৪ নভেম্বর ঠিক তার জন্মদিনেই কামালপুর অভিযানে গোলার আঘাতে বাম পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সবাই ধরে নেয় তিনি মারা যাচ্ছেন।