‘And now…. I will rehearse a tale of love
which I heard from Diotima of Mantineia,
a woman wise in this…. She was my
instructress in the art of love….’
(Socrates to Agathon: Symposium-Plato)
সেই সন্ধ্যায় পূর্বকথানুসারে যখন কেশবপল্লীতে হাজারিলালের কুটিরে যাই, বুঝি নাই যে আবার আমার একটি মেটামবফসিস আসন্ন। জীবন কী রহস্যময় বিষয়! প্রতিটি পরবর্তী পদক্ষেপে কী ঘটিবে তুমি জান না, জানিবার কোনো উপায় নাই। কর্মফল-তত্বে বিশ্বাস নাই, কারণ উহা যুক্তিবিরহিত। একই কর্মে এক প্রকার ফল ফলিতে দেখ না কি? সর্বত্র যেন আকস্মিকতা ওত পাতিয়া আছে। দুইয়ে দুইয়ে চারি হইবার গ্যারান্টি নাই।
হরিবাবু আমার অপেক্ষা করিতেছিলেন। হাতে একটি লাঠি ও একটি লণ্ঠন লইয়া বাহির হইলেন। মাথায় হিন্দুস্থানীদের মতন পাগড়ি, গায়ে কম্বল এবং পায়ে কাঁচা চামড়ার নাগরা। অগ্রহায়ণ মাসের সন্ধ্যা। হিমের গাঢ়তা জীবজগতকে নৈঃশব্দ্যে ডুবাইয়া রাখিয়াছে। বলিলেন, এ কী! তুমি আলোয়ান আন নাই কেন?
হাসিয়া বলিলাম, আমার রক্তে কিছু আছে। শীত কাবু করিতে পারে না। কিন্তু আপনি কি অন্যত্র যাইবেন?
হ্যাঁ। হরিবাবু চাপা স্বরে বলিলেন। আমারই ভুল হইয়াছে! তোমাকে আভাসে বলা উচিত ছিল আমরা একটি দুর্গম স্থানে যাইব!
আপনার সহিত নরকে যাইতেও আপত্তি নাই। তবে আমি নিরস্ত্র।
হরিবাবু হাসিলেন!… না, না। নরহত্যা করিতে যাইতেছি না। একটু অপেক্ষা করো। বলিয়া তিনি তাঁহার কুটিরের তালা খুলিয়া ঢুকিলেন। তাহার পর একখানি। তুলার কম্বল আনিয়া বলিলেন, গায়ে জড়াইয়া লও। মাথা পর্যন্ত ঢাকো।
বাঁধের শিশিরসিক্ত ঘাসে দুইজনে হাঁটিতেছিলাম। কোথায় যাইতেছি, কেন যাইতেছি, এইপ্রকার প্রশ্ন করার অভ্যাস আমার নই। শৈশব হইতেই এই নির্লিপ্ততা আমার মধ্যে থাকিয়া গিয়াছে। আমার পিতার যাযাবর স্বভাবই ইহার মূলে। সর্বক্ষণ সকল মুহূর্তের জন্য আশৈশব প্রস্তুত থাকিয়াছি, কোথাও যাইতে হইবে। দেবনারায়ণদা সেদিন ঐতয়ের ব্রাহ্মণের ‘চরৈবেতি’ শ্লোকটির ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। ভাবিলাম, যাযাবর নরগোষ্ঠী ছাড়া এমন উক্তি কাহাদের মুখ দিয়া বাহিব হইবে? ওইসকল শাস্ত্রপ্রণেতা নাকি আর্য ছিলেন। হরিদা সেদিন উদাত্তস্বরে আমার রক্তেরও আর্য সাব্যস্ত করিয়াছেন। হ্যাঁ, এই একটি ক্ষেত্রে ২+২ = ৪ হইল বটে। মনে মনে হাসিতে থাকিলাম।
শফি! শস্যচোরদের হাত হইতে শস্য বাঁচাইতে কৃষকেরা আমাকে যেভাবে তুমি দেখিতেছ, সেইভাবে রাত্রিকালে শস্যক্ষেত্র দেখিতে যায়। হরিবাবু চাপাস্বরে বলিলেন। কিন্তু কাহাবও সম্মুখে পড়িলে তুমি কী কৈফিয়ত দিবে ভাবিতেছি।
বলিলাম, আপনি জানেন না, ইতিমধ্যে সর্বত্র ছিটগ্রস্ত, অধোন্মাদ, এমন কি বদ্ধপাগল বলিয়া আমার সুখ্যাতি রটিয়াছে?
হরিবাবু হাসিতে লাগিলেন। বলিলেন, উহা অংশত সত্যও বটে। তবে জিনিয়াস ব্যক্তিরা এইরূপ হইয়া থাকেন। শফি, তোমার মধ্যে প্রতিভাধর পুরুষের তাবৎ লক্ষণ পরিস্ফুট।
হরিবাবু কি বিদ্রূপ করিতেছেন? গম্ভীর হইয়া চুপচাপ হাঁটিতে থাকিলাম। তিনি বুদ্ধিমান। একটা কিছু আঁচ করিয়া বলিলেন, তুমি কি রাগ করিলে আমার কথায়? শফি, তুমি জান না তুমি কী। স্ট্যানলিকে হত্যা কালে তোমার এক শক্তি দেখিয়াছি। আবার তুমি যখন গভীর দার্শনিক তত্বমুলক গ্রন্থ নিষ্ঠাবান ছাত্রের মতন অভিনিবেশ সহকারে পাঠ কর, তখনও তোমার মধ্যে আর-এক শক্তি দেখিয়াছি। দেবী দুর্গা এবং দেবী সরস্বতী উভয়ের অনুগ্রহ লাভ না করিলে ইহা সম্ভব হয় না!
ইচ্ছা হইল বলি, যমুনাপুলিনের বংশীধারী গোপীবল্লভেরও বুঝি বা অনুগহীত আমি –নতুবা কেন এই হৃদয়তন্ত্রী কোনো এক চিরন্তনী শ্রীবাধার জন্য নিরন্তর ব্যাকুলসুরে বাজিতেছে আর বাজিতেছে? কিন্তু হরিবাবু শাক্ত। গোঁড়া শাক্ত তো অবশ্যই। বৈষ্ণবদের কথা শুনিলেই চটি আগুন হন দেখিয়াছি। তাই চুপ করিয়া থাকিলাম। ধর্ম ব্যাপারটার মধ্যে আসলে একটা বিশ্বজনীন সামান্যতামূলক আদল রহিয়াছে। ফরাজি এবং সুফিদের সঙ্গে যথাক্রমে যেন শাক্ত এবং বৈষ্ণবের কেমন একটা মিল! ইহুদিদের তোরাপন্থী এবং কাব্বালাপহী, খ্রীস্টানদের ক্যাথলিক এবং প্রেসবাইটেরীয় গোষ্ঠী…
হরিবাবু হঠাৎ থামিয়া গেলে চিন্তাসূত্র ছিন্ন হইল। বলিলাম, কী হইল?
তিনি লণ্ঠনটি নাড়িতে থাকিলেন। এবার কিছু দূরে একটি আলো কিয়ৎক্ষণ আন্দোলিত হইয়া যেন নিভিয়া গেল। এখান হইতে অনাবাদি এলাকার শুরু। কাশবন, উঁচু গাছপালার জঙ্গল, জলাভূমি। বাঁধ বাঁকা হইয়া পশ্চিমে উঁচু এলাকায় গিয়া শেষ হইয়াছে। হরিবাবু উত্তেজিতভাবে বলিলেন, উহারা আসিয়া গিয়াছে। জুতো খুলিয়া হাতে লও। অল্প একটু জলকাদা হইতে পারে।
উহারা কাহারা এই প্রশ্ন করা আমার স্বভাব বহির্ভূত। বামদিকে নামিয়াঁ গিয়া অল্প নহে, যথেষ্ট জলকাদায় পড়িলাম। হিমে দুই পা নিঃসাড়! কাশবনের শিশিরে ভিজিয়া জবুথবু অবস্থা হইল। কিছুদূর চলার পর সম্মুখে ঘনকালো পাহাড়সদৃশ অথবা অন্ধকারেরও অন্ধকারতম একটি অংশের নিকটবর্তী হইয়া হরিবাবু অনুচ্চস্বরে বলিলেন, বন্দেমাতরম্।
ওই উর্দু কালো বিশালতার অভ্যন্তর হইতে প্রতিধ্বনিত হইল, বন্দেমাতরম্।
এতক্ষণে বুঝিলাম উহারা কাহারা। বিশালতাটি উঁচু গাছপালার জঙ্গল। একটি বটগাছের তলায় প্রকাণ্ড শিকড়গুলি লণ্ঠনের আলোয় স্পষ্ট হইল। শিকড়গুলিতে তিনজন লোক বসিয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন। হরিবাবু পরিচয় করাইয়া দিলেন। সত্যচরণ বসু, কালীমোহন বাঁড়ুজ্জে, তৃতীয় জন অমলকান্তি দাশ। প্রথম দুইজনের বয়স পঁচিশ কিংবা দুই-এক বৎসর কমবেশি হইবে। তৃতীয়জন আমার বয়সী। তাহার মুখে দিকে তাকাইয়া ছিলাম। কোথায় যেন দেখিয়াছি। হঠাৎ সে উঠিয়া আসিয়া আমাকে আলিঙ্গন করিল। বলিল, কী আশ্চর্য! তুমি সেইশফি না? ছোটদেওয়ানসায়েবের ভাইপো!
অমনি আমিও তাহাকে চিনিলাম। বলিলাম, কেমন আছ অমল?
অমলকান্তি উচ্ছ্বসিতভাবে বলিল, তোমাকে যে চিনিতে পারিলাম, তাহার কারণ তোমার ওই শীতল চাহনি। নতুবা তুমি গোফ রাখিয়া ধুতিশার্ট পরিয়া এমনই বাবু হইয়াছে যে কাহার বাপের সাধ্য চিনিতে পারে? উপরন্তু তোমার বপুখানিও পান্না পেশোয়ারির মতন প্রকাণ্ড হইয়াছে।
দ্রুত বলিলাম, পান্না পেশোয়ারির সম্বাদ কী?
তুমি জান না? অমলকান্তি অবাক হইয়া বলিল। …সে কতকাল হইল, তোমাদের জাহান্নাম গুলজার করিতেছে। কেহ হঁট মারিয়া তাহার ঘিলু বাহির করিয়াছিল। পুলিশ চুল্লুকে সন্দেহ করিয়া প্রচণ্ড পীড়ন করিয়াছিল। শেষে প্রমাণাভাবে বেকসুর খালাস পায়। কিন্তু তুমি হঠাৎ স্কুল ছাড়িয়া কোথায়—
বাধা দিয়া কালীমোহন বলিলেন, অমল! পরে বন্ধুর সঙ্গে কথাবার্তা বলিও। অগ্রে কাজের কথা হউক।
মৃদুস্বরে তাঁহারা কাজের কথা শুরু করিলেন। আমার বুকের ভিতর তখন ঝড় বহিতেছে। আনন্দ, নাকি অন্যকিছু, জানি না। শুধু জানি আমি রূপান্তরিত হইতেছি। খালি সিতারার মুখ ভাসিয়া আসিতেছে। দূরে সরিয়া যাইতেছে। আবার কাছে আসিতেছে। সিতারা আমার সহিত যেন জলক্রীড়া করিতেছে, যে-জলক্রীড়ায় একদা দিনশেষে সে আমার সঙ্গে মাতিয়া উঠিতে চাহিতেছিল। ডাক দিয়াছিল, আও শফিসাব! খেলুঙ্গি!
‘কাজের কথা’ চলিতেছিল। মহিমাপুর এবং পার্শ্ববর্তী আরও কয়েকটি মহালে এবার শুখায় অনাবাদ। কিন্তু জমিদারদের বেতনভোগী পরগণাম্যানেজারগণ এখনই প্রজাদের হুমকি দিতেছে। ওইসময় পরগণায় গত বৎসরও ভাল ফসল হয় নাই। কৃষক প্রজাদের অবস্থা সর্বস্বান্ত। বিহারমুলুকের মুণ্ডার্সদার বীরসা মহারাজের দৃষ্টান্তে বহু স্থানে কৃষকেরা জোট বাঁধিতেছে! ইংরাজ অফিসার এবং পুলিশবাহিনীর কাছে রাজধানী কলিকাতা হইতে লাটবাহাদুরের হুঁশিয়ারি আসিয়াছে, এমত সম্বাদ আছে। এমন কী, লোহাগড়া পরগণার দিকে সংপ্রতি বহরমপুর সেনানিবাস হইতে একটি গোরাপল্টনও রওনা হইয়া গিয়াছে। গোরাদের ভয়ে পথিপার্শ্বের তাবৎ গ্রামের মানুষজন গ্রাম ছাড়িয়া মাঠে-জঙ্গলে লুকাইয়া পড়িতেছে। ওদিকে বিহারের রাঁচীমুলুকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ফলে হাজার হাজার সাঁওতাল-মুণ্ডা-কোড়া-মূসহর প্রমুখ আদিবাসী বাঙ্গালাদেশে চলিয়া আসিতেছে। এই মহাসুযোগের সদ্ব্যবহার করা প্রয়োজন। কলিকাতা হইতে বিপ্লবী বন্দেমাতরম্ গুপ্তসমিতির নেতৃবৃন্দের নির্দেশ সম্বলিত একটি লাল হরফে ছাপা ইস্তাহার কালীমোহন পাঠ করিয়া শুনাইলেন।
নিজের রূপান্তশীল অংশের প্রান্ত হইতে অসহায় বিদ্রোহের বার্তা শুনিতেছি। এ আবার এক সন্ধিকাল জীবনে। কবেই বুঝিতে পারিয়াছি, আমি বিদ্রোহের ধাতুনিৰ্ম্মীত একটি সত্তা। অথচ মাঝে-মাঝে আমার মধ্যে একপ্রকার ‘টাগ অফ ওয়ার’ চলিতে থাকে। উষ্ণতা এবং শীতলতা, জাড্য এবং গতির বড়ই জটিল টানাপোড়েন।
কালীমোহন আমার দিকে চাহিয়া মৃদুহাস্যে বলিলেন, লোহাগড়া থানায় আপনার স্বজাতিভুক্ত এক দারোগা আছে। তাহার নাম মৌলুবি কাজেম আলি, সে এক জহলাদ। তাহার সুব্যবস্থার দায়িত্ব আপনিই লউন।
‘স্বজাতি’ শব্দটি আমাকে আঘাত হানিল। কিছুক্ষণ আগে অমলকান্তি ‘তোমাদের জাহান্নাম’ বলিয়াছিল, উহা কানে লই নাই। অমল লালবাগে আমার সহপাঠী ছিল। তাহার পিতা নবাববাহাদুরের কর্মচারী ছিলেন। কেল্লাবাড়ি এলাকায় বাস করিতেন দেখিয়াছি। অমলের দিকে চাহিয়া আস্তে বলিলাম, আমার অসুবিধা। আছে। অন্তত মাঘ মাস পর্যন্ত আমার পক্ষে এই আবাদ এবং আশ্রম ছাড়িয়া বাহিরে যাওয়া কঠিন। দেবনারায়ণদার আশ্রিত আমি। তিনি–
বাধা দিয়া হরিবাবু বলিলেন, না কালীদা! লোহাগড়া শফির অজানা জায়গা। উহার একটা কিছু ঘটিয়া গেলে এই আবাদ ও আশ্রমের ওপর প্রত্যাঘাত আসিবে। ফলে আমার বিপদ ঘটিবে। এমন দুর্ভেদ্য ব্যহ বলুন বা আশ্রয় বলুন, আর আমি পাইব না। সত্যচরণ এবং অমলকান্তি উভয়েই হরিবাবুর কথায় সায় দিলেন।
সত্যচরণ বলিলেন, ওই দারোগার ব্যবস্থা এখনই করিলে উল্টা ফল হইতেও পারে। শফিবাবুই বলুন, ইহা ঠিক কি না যে, মুসলমানের গায়ে হাত পড়িলে মুসলমানসমাজ ক্ষেপিয়া উঠিবে? আমরা মুসলমানদেরও পাশে লইতে চাই কি না? কলিকাতা এবং ঢাকায় আমাদের কিছু সংখ্যক মুসলমান সদস্য আছেন। ইংরেজকে তাড়াইতে হইলে হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন কি না?
সত্যচরণবাবুকে আমার অত্যন্ত পছন্দ হইল। কালীমোহনবাবুকে গম্ভীর দেখাইতেছিল। কিয়ৎক্ষণ নীরবতার পর বলিলেন, হরিনারায়ণ! শীত করিতেছে। অগ্নিকুণ্ড জ্বালাইলে বিপদের আশঙ্কা আছে কি?
হরিবাবুর সহাস্যে বলিলেন, না। ইহা বসতি অঞ্চল হইতে দূরে, উপরন্তু দুর্গম। কেহ দেখিলে ভাবিবে ভূতপ্রেত।
তিনি এবং অমল উৎসাহে শুষ্ক পত্র ও কাঠকুটা কুড়াইতে থাকিলেন। শিশিরে সিক্ত হওয়ার ফলে আগুনের বদলে ধোঁয়াই বেশি হইল। বৃত্তকারে বসিয়া তাঁহারা মৃদুস্বরে আবার কাজের কথায় মগ্ন হইলেন। আমি শুধু সিতারার কথা ভাবিতেছিলাম। সে পূর্ববৎ ঝড়ে অথবা প্লাবনতরঙ্গে একবার কাছে একবার দূরে সরিতেছিল।
আর ঠিক এইসময় আমার বুজুর্গ পিতার ন্যায় আমি একটি মোজেজা অথবা ‘Vision’ দেখিলাম। কিম্বা খ্রীস্টীয় তত্ত্বে ইহাকেই Revelation কহে কি না জানি না।
একদা প্রকৃতিজগতে একটি নদীর তীরে এক আদিম নারী আমাকে দেহের সোপানে টানিয়া তুলিয়াছিল। ভাবিয়াছিলাম, এইরূপে দেহের সোপানসমূহ অতিক্রম করিয়াই হয়তো প্রেমের মন্দিরে পৌঁছাইতে হয়। তখন আমি এক অপরিণতবুদ্ধি অপিচ এঁচোড়েপাকা কিশোর মাত্র। কিন্তু তাহার পর এক প্রাচীন জরাজীর্ণ পরিত্যক্ত রাজধানীর প্রান্তে অপর এক নারী– যে আমি নহে, অভিজাতবংশীয় কন্যা–অপর এক নদীর তীরে ‘আও শফিসাব, খেলুঙ্গি’ বলিয়া ডাক দিয়া মনের সোপানে। স্থাপন করিয়াছিল। ওই সোপানের শীর্ষেই প্রকৃত প্রেমের মন্দির। স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি দীপ জ্বলিতেছে নিষ্কম্প, অনির্বাণ। ধূপের সুগন্ধ ছড়াইতেছে। উহাতে সিতারার সিক্ত কেশের ঘ্রাণ। তরঙ্গের ভাষায় সে কহিতেছে, আও শফিসাব, খেলুঙ্গি! আও শফিসাব, খেলুঙ্গি! আও শফিসাব, খেলুঙ্গি!
সিদ্ধান্ত করিলাম, অন্তত একবেলার জন্যও লালবাগে যাইব।…
… ‘Daphne’s soft breast was enclosed in
thin bark, her hair grew into leaves, her
arms into branches, and her feet… were
held fast by sluggish roots, while her face
became the treetop. Nothing of her was left.
except her shining loveliness…’
Metamorphoses– Ovid.
বাঁকিপুরের মুসলিম জমাত ছিল হানাফি সম্প্রদায়ের। হজরত বঊিজ্জামান নুরপুরে থাকার সময় বাঁকিপুরের মাতব্বর লোকেরা ফরাজিমতে দীক্ষা নেয়। বিত্তশালী এই লোকগুলির প্রভাবেও বটে, আবার ‘বদুপিরের কেরামতি বা অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে জনরবের ফলে বাঁকিপুরের সমস্ত মুসলমান ফরাজি হয়ে উঠেছিল। গিয়াসুদ্দিনের ওপর তাই প্রবল চাপ পড়তে থাকে। কারণ তিনি হিন্দু হয়েছেন । ব্রহ্মপুরের আশ্রমে যাতায়াত করেন। অন্যদিকে তার গ্রামের হিন্দু বাবুজনেরাও ব্রাহ্মদের প্রতি প্রচণ্ড বিরূপ ছিলেন তাঁরাও মুসলমানদের তলে-তলে প্ররোচিত করতে থাকেন। তাঁকে একঘরে করা হয়। তিনি ছিলেন বাঁকিপুর পাঠশালার শিক্ষক। তাঁকে তাই পণ্ডিত গিয়াস বলা হত। নিরক্ষররা বলত ‘পুণ্ডিত’। তাঁর ভিটেটুকু বাদে আর মাটি ছিল না! বহুকাল আগে স্ত্রী মৃত। একটিমাত্র কন্যা ছিল। তার নাম রেহানা। প্রাইমারি পরীক্ষায় সে কৃতিত্বের দরুন মাসিক দুটাকা হারে বৃত্তি পেত। তাকে আর পড়ানোর মতো স্কুল গ্রামাঞ্চলে ছিল না। তখন যে সব ‘উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়’ ছিল, সেগুলিতে শুধু ছেলেদেরই পড়ানোর ব্যবস্থা। ফলে দুটাকা বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়। গিয়াস পণ্ডিত অগত্যা তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হন। তখন মুসলিম সম্প্রদায়ে কন্যাপণ প্রচলিত। রেহানাকে যে-কোনো বিত্তশালী পরিবারে পাত্রস্থ করা যেত। রেহানার গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ, ঈষৎ রোগাটে গড়ন, সাধারণ বাঙালি মেয়েদের। গড় লাবণ্য তার ছিল। তাছাড়া সে বুদ্ধিমতী এবং বিদ্যা-অভিলাষিণী কিশোরী। কিন্তু গ্রাম্য বিত্তশালী পরিবারের তৎকালীন প্রায় নিরক্ষর গাড়ল সদৃশ বয়স্ক পাত্রদের নোলায় যতই জল ঝরুক, গিয়াস পণ্ডিত– বিরোধী তৎপরতা– যা ক্রমশ বর্বর আন্দোলনের রূপ নিচ্ছিল, তাদেরকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করে এবং প্রতিক্রিয়াবশে তারাও মারমুখী হতে থাকে। গিয়াসুদ্দিনের আত্মীয়স্বজনও তাঁকে ত্যাগ করেন। অত্যাচারে অতিষ্ঠ গিয়াসুদ্দিন, অথচ ব্রহ্মপুরে আশ্রমে এলে তাকে দেখে বোঝাও। যেত না কিছু। হাস্য-পরিহাস এবং গম্ভীর তাত্ত্বিক আলোচনায় মগ্ন হতেন। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে বাতাসে খবর ছড়ায়। দেবনারায়ণ সেই খবরে প্রথম-প্রথম ততটা গুরুত্ব দিতেন না। অবশেষে একদিন আসন্ন মাঘোৎসবের প্রস্তুতি উপলক্ষে আলোচনাসভার । পর গিয়াসুদ্দিন গোপনে মুখ ফুটে সব কথা বলেন এবং তখনই খেয়ালি দেবনারায়ণ । দুখানি গোরুর গাড়ি, একটি পালকি এবং একদল পাইক পাঠিয়ে বাঁকিপুর থেকে গিয়াসুদ্দিন, রেহানা এবং গেরস্থালিটি উপড়ে আনার ব্যবস্থা করেন। গিয়াসুদ্দিন ও তাঁর কন্যা রেহানা ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হবেন আগামী মাঘোৎসবে। পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁদের দীক্ষা দেবেন। কলিকাতার ব্রাহ্ম সংবাদপত্রে এই উত্তেজনাপ্রদ সংবাদ ছাপা হয়। বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ডাকে ব্রাহ্মরা উচ্ছ্বসিত ভাষায় অভিনন্দন। জানিয়ে চিঠি পাঠান গিয়াসভাই এবং তাঁর কন্যাকে। ব্রহ্মপুবে তখন সে এক আবেগপূর্ণ কাল। প্রবল ব্যস্ততা।
আর সেই আবেগপূর্ণ কালে শফি ভিন্নতর এক নিজস্ব আবেগে উদ্বেলিত। সে লালবাগ যাবে। কিন্তু দেবনারায়ণ তাঁকে প্রায় বন্দী করে ফেলেছেন। বালিকাবিদ্যালয়, কুটিরশিল্পকেন্দ্র, কতকিছু পরিকল্পনা দেবনারায়ণের। টাকার। দরকারে অনাবাদি জঙ্গুলে মাটি যৎকিঞ্চিৎ সেলামি ও খাজনায় বন্দোবস্ত করছেন। উঠবন্দি ভূমিব্যবস্থা, যার অপর নাম সন-গুজারি জমিবিলি (অর্থাৎ বাৎসরিক ফসল ফলানোর অধিকার দান)–প্রথা, আবাদে বহুক্ষেত্রে চালু ছিল। এই মত্তকায় চতুর লোকেরা রায়তি বন্দোবস্তে মাটির মালিকানা লাভে তৎপর হয়। বিহাব অঞ্চলে। দুর্ভিক্ষ এবং শাসকদের অত্যাচারে পালিয়ে আসা আদিবাসীদের এক পয়সা দিনমজুরিতে নতুন রায়তরা দ্রুত মাটি কাটিয়ে বাঁধ তৈরি শুরু করে। জঙ্গল অদৃশ্য হতে থাকে। শখিনী নদীর ধারে বাঁধের কাজ শুরু হয়েছিল অঘ্রানের শেষাশেষি। সেই সময় শফি লালবাগ যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল।
নদীর ওপারে নবাববাহাদুরের মহাল। সেই মহালের গ্রামগুলি থেকে আপত্তি উঠেছিল, ওপারে বাঁধ দিলে সেইসব গ্রামের জমি বন্যায় ডুবে যাবে। এমন-কি। বসতিও বিপন্ন হবে। দরখাস্ত পেয়ে নবাববাহাদুর কালেকটর সাহেবকে জানান। লালবাগের এস ডি ও বাহাদুর গিলবার্ট ছিলেন রাগীও প্রকৃতির এক অসট্রেলিয়ান। ইংরেজ। তিনি সে সার্কেল অফিসারটিকে তদন্তে পাঠান, তাঁর নাম মৌলবি জব্বার খান (তৎকালে শিক্ষিত মুসলিমদের মৌলবি বলা হত)। জব্বার খান অবাঙালি মুসলমান এবং প্রভুর চেয়ে এককাঠি সরেস। তদন্ত করে বাঁধ তৈরি বন্ধের হুকুম দিয়ে গেলেন। নতুন রায়তরা দেবনারায়ণকে এসে ধরল। দেবনারায়ণ প্রতিকারের আশ্বাস দিলেন। তারপর নিভৃতে শফিকে ডেকে বললেন, নবাববাহাদুরের এক দেওয়ান সাহেব তোমার আত্মীয় –তুমিই বলেছিলে। ভাই শফি, এই বিপর্যয়ে তুমিই এখন ভরসা। তুমি গিয়ে তাঁকে বলো। তিনি যেন নবাববাহাদুরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটা ফয়সালা করেন। ফয়সালা যাই হোক না, আমি মেনে নেব। তোমাকে একা যেতে হবে না। গিয়াসভাইও যাবেন। কারণ তিনি বিজ্ঞ ব্যক্তি। শফি তখনই রাজি হয়ে গেল। শঙ্খিনী নদী ভাগীরথীতে মিশেছে। এখনও এই নদীপথের গম্যতা আছে। তবে মাঘের শেষাশেষি এই গম্যতা থাকবে না। জল কমে যাবে। পৌঁছতে ভাটি, ফিরতে উজোন। তাই দুজন দাড়ি, একজন মাঝি এবং রতন রাজবংশী পাইক নিয়ে ছোট্ট একখানি বজরায় গিয়াসুদ্দিন আর শফি ভোরবেলা নৌকায় রওনা দিল। গিয়াসুদ্দিন সারাপথ তত্ত্ব আলোচনায় শফির কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিলেন। ‘তৌহিদ’ আর ‘সোহহম’ এই দুই তত্ত্ব যে এক, তিনি তার ব্যাখ্যা করছিলেন। ’ফানা’ এবং’মোক্ষ’, ‘ফুকরওয়া-ফানা’ এবং ‘অম্মিতালোপ’, ‘ফানা’ এবং বৌদ্ধ (মিলিন্দপণহ বর্ণিত) ‘পুদগল-শূন্যতার’ একত্ব সাব্যস্ত করতে গিয়াসপণ্ডিত এতই ব্যাকুল যে শফির মনে হচ্ছিল, ইনি এতদিনে এমন একজন স্বধর্মাবলম্বীকে পেয়েছেন, যাকে বোঝাতে চাইছেন, তাঁর হিন্দুধর্মের বেদবেদান্ত-অনুরাগ এবং ব্রাহ্মধর্মে প্রবল আসক্তির পিছনে কোনো বিষয়স্বার্থ নেই! গিয়াসপভিতকে বড়ো করুণ দেখাচ্ছিল শফির। শেষে বললেন, ডিইটদের কথা পড়েছি। রাজা রামমোহন রায় তাঁদের অনুরাগী ছিলেন। তুমি তো ইংরেজি বিদ্যায় পারদর্শী, এবার তুমি ডিইট এবং খ্রীস্টধর্মের সম্বন্ধে কিছু বলো । খ্রীস্টতত্বে অনুরূপ কিছু আছে কি? তবে তার পূর্বে বলল, তুমি ইংরাজিতে পারদর্শী হলে কীভাবে? শফি অগত্যা বলল, আমি লালবাগে নবাববাহাদুর ইনসটিটিউশনে ছাত্র ছিলেম। ওখানে ইংরাজিই এজুকেশন-মিডিয়াম ছিল। এবার গিয়াসুদ্দিন তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বিরক্তিকর প্রশ্ন করতে থাকলেন। শফি দায়সারা জবাব দিল মাত্র। বুদ্ধিমান গিয়াসুদ্দিন বুঝতে পারলেন, যুবকটি চঞ্চলচিত্ত, ঈষৎ ছিটগ্রস্ত এবং স্বল্পভাষী। অথচ এর মধ্যে কী একটা আছে, চোখের চাহনির সাপের শীতলতা এবং সৌন্দর্যময় বলিষ্ঠ গড়নে সিংহের শৌর্য প্রাচীন যোদ্ধাদের কথা স্মরণ করায়। গিয়াসুদ্দিন গুনগুন করে অস্পষ্ট কী গান গাইতে থাকলেন। হয়তো ব্রহ্মসংগীত। দুপুর নাগাদ নৌকা ভাগীরথীতে পৌঁছলে মাঝিরা নৌকা বাঁধল। তীরবর্তী গঞ্জ থেকে চালডাল মাছ কিনে আনল। গিয়াসুদ্দিন স্নানকাতুরে। শফি গঙ্গার কাজলজলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার হঠাৎ মনে হল, সিতারা এত হিম কেন? এই জলে সিতারার স্বাদ পেতে চেয়েছিল সে।
শঙ্খিনীতে স্রোত ছিল। ভাগীরথী প্রায় নিশ্চল। মাঝে-মাঝে বালির চড়ায় নৌকা ঠেকে যাচ্ছিল। যখন দূরে ইমামবাড়া আর হাজারদুয়ারি প্রাসাদের শীর্ষদেশ দেখা গেল, তখন সূর্য ঢলে পড়েছে। হিমের স্পর্শ তীব্রতর। মাঝি চাঁদঘড়ি বলল, তাও পেছনে উত্তরে হাওয়া, নৈলে মুখআঁধারি বেলা হয়ে যেত। মিয়াঁসায়েব, কেল্লার ঘাটে তো নৌকো বাঁধতে দেবে না। কোথা বাঁধব হুকুম দিন। শফি আস্তে বলল, সাহানগর ঘাটে বাঁধরে চলো!
শফি ব্যগ্রদৃষ্টে তাকিয়ে জাফরগঞ্জের সেই ঘাটটি পেরিয়ে এল। ওই ঘাটে সিতারা। তাকে ঠিক এমনি দিনান্তকালে ডাক দিয়েছিল, আও শফিসাব! খেলুঙ্গি। ঘাটটি ফাঁকা। এই শীতে এখন কি কেউ স্নান করতে আসে? শফি আপনমনে একটু হাসল। কেল্লাবাড়ির সামনে দিয়ে নৌকো চলার সময় তার চাঞ্চল্য জাগল। সে শীতের বিকেলের বিবর্ণ ও ধূসরতামাখা আলোয় প্রতিটি চবুতরা, ছত্ৰতল, তীরবর্তী রাস্তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে রইল। নিচু নদীগর্ভ থেকে ওইগুলি দিগন্ত বলে মনে হচ্ছিল। তখন সে উঠে ছইয়ে হেলান দিল। এই সময় গিয়াসুদ্দিন বললেন, বহু বছর পরে লালবাগ এলাম। আহা, কী দৈন্যদশ্য ঘটেছে! মাঝিভাই, ‘সাহানগর ঘাট’ তো দূরে পড়বে। বরং ‘লম্পটের ঘাট তো আগেই। শফি, কী বলল? শফি আনমনে বলল, হুঁ।
এই লম্পটের ঘাটেই এক গোরা উপদ্রব করত। কাছেই সিপাহিব্যারাক। দেশি সিপাহিরাও মেয়েদের জ্বালাতন করত। সেটাই হয়তো এই নামের কারণ। অথচ কিংবদন্তি অন্যরূপ। ইংরেজ ইতিহাসওয়ালারা কখনও স্বয়ং নবাব সিরাজুদ্দৌলা কখনও তাঁর সেনাধ্যক্ষ মির মদনের লাম্পট্যকে এই ঘাটের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। শফি এতক্ষণে শুনতে পেল, গিয়াসপণ্ডিত হাট-বৃত্তান্ত নিয়ে বকবক করছেন। বললেন, তুমি জান? ইতিহাসহিতে শয়তানর, লিখেছে, মদন নামে এক হিন্দু নবাব সিরাজুদ্দৌলার জন্য স্নানাথিনী সুন্দরীদের নৌকায় তুলে নিয়ে যেতেন! অরে মূর্খ উজবুকের দল! এ মদন সংস্কৃত ভাষার মদন নয়। উচ্চারণবিকৃতিতে ‘মাদান’ মদন হয়েছে! মাদান খাঁটি আরবি ওয়র্ড। তোমার আব্বার ন্যায় এক বুজুর্গ পির ছিলেন পারস্যদেশে। তাঁর নাম হজরত মাদান শাহ। আর বাঙলাদেশের গ্রামে তুমি মুসলমানদিগের মধ্যে প্রচুর মদন শেখ দেখবে। তুমি দেওবন্দি আলেম মওলানা মাদানির নাম শুনেছ? শফি আনমনে মাথা নাড়ল। চবুতরা, ছত্ৰতল, রাস্তা– কেল্লা এলাকার কোথাও সিতারা নেই। পরে ভাবল, কেন সে থাকবে? সে কান্নু সাতমারের স্ত্রী হলেও খান্দানি নবাববংশজাত কন্যা। সে নির্জন ঘাটে যেতে পারে। এমন জায়গায় তাকে এখন দেখা যাবে কেন? গিয়াসুদ্দিন বললেন, ইংরাজিতে একটি প্রবাদবাক্য আছে না? যে কুকুরকে বধ করতে চাও, তাহার বদনাম রটনা করো! তুমি ইংরাজিনবিশ। বলো তো বাক্যটি ইংরাজিতে কী? শফি আস্তে বলল, মনে পড়ছে না। সে কেল্লার পূর্বফটকের পাশে বারি চৌধুরীর ঘরখানি লক্ষ করছিল। ঘরখানি বন্ধ। সে তার সামনে কোন মুখে দাঁড়াবে, ভাবছিল। গিয়াসুদ্দিন বললেন, সিরাজুদ্দৌলার নামে যথেচ্ছ কুৎসা না রটালে ইংরাজ রাজত্ব কায়েম হত না। তুমি তো এই শহরে ছিল। লক্ষ্য করেছ, ওই এক কবর বাদে তাঁর আমলের একটুকু স্মৃতিও কোথাও রাখা হয়নি। অথচ মোতিঝিলে তার খালা (মাসি) এবং খালুর (মেসো) স্মৃতির সবগুলিন বিদ্যমান! কোথায় গেল সুরম্য প্রাসাদ হীরাঝিল? দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, ‘সিইয়ার-উল-মুতাখশারিন’ কিংবা ‘মোজফফরনামাহ’ বহিদুইখানির প্রণেতাদ্বয় মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও ইংরাজ কর্মচারী। চাটুকার আর স্বার্থপর না হলে হতভাগ্য সিরাজুদ্দৌলাব এরূপ কুৎসা কেউ বটাতে পারে না। আমার বক্তব্য নয় যে মুসলমান শাসকমাত্রেই মহৎ, নিষ্কলঙ্ক, কিংবা হিন্দু শাসকরাও তদ্রূপ ছিলেন। শাসকচবিত্রে সাধারণ মনুষ্যের দোষগুণ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রস্তাব হল যে, সেই শাসকের ঐতিহাসিক ভূমিকা কী ছিল? ইংরাজ শাসনে নাকি শৃঙ্খলা স্থাপিত হয়েছে! অশ্বডিম্ব হয়েছে। গিয়াসুদ্দিন কুদ্ধভাবে বললেন, উহারা ভারতবাসীদিগের হস্তে বেলগাড়ি, বাপীয় পোত প্রভৃতি বিবিধ রঙিন খেলনা তুলিয়া দিয়া মোহাবিষ্ট করিয়াছে! আমরা অতিশয় মূর্খ!
গিয়াসুদ্দিন প্রাক্তন রাজধানী দেখতে-দেখতে উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, শফির মনে হল একথা। তার বলতে ইচ্ছা হল, মানুষ পা তুলে সরে গেলেই সেখানে ঘাস গজায়, এটাই যখন প্রাকৃতিক নিয়ম, তখন উত্তেজিত হওয়া বৃথা। মনুষ্যনির্মিত বস্তৃপিণ্ডের ধ্বংস অনিবার্য এবং সেই অভিমানী, ভূলুণ্ঠিত, মনুষ্য-ইজ্জতকে প্রকৃতি তাঁহার স্নেহকরতলে আবৃত করিয়া আরক্ষার ভান করে। অতএব পরিতাপ অর্থহীন।…
কিছুক্ষণ পরে দুজনে কেল্লাবাড়ির উত্তরফটকে পৌঁছুলেন। সেই সময় শফি বলল, আপনি ফটকে গিয়ে চুল্লু নামে একজনের খোঁজ করুন। আমার কথা বলার দরকার নেই। সে আপনাকে দেওয়ান আব্দুল বারি চৌধুরীর কাছে নিয়ে যাবে। যদি চুল্লুকে না পান, ওই পাহারাদের বললেই ওরা আপনাকে চাচাজির বাড়ি দেখিয়ে দেবে। সেখানে রহিম বখশ নামে একজন আছে। চাচাজির সঙ্গে সে দেখা করিয়ে দেবে।
গিয়াসুদ্দিন খুব অবাক হয়ে বললেন, সে কী! তুমি কোথায় যাচ্ছ?
এখনই আসছি। আপনি চাচাজিকে দেবনারায়ণদার চিঠিটি দিয়ে কথাবার্তা বলুন। উনি লালবাগে না থাকলে অগত্যা নৌকোয় গিয়ে অপেক্ষা করবেন। তখন আলোচনা করে পরবর্তী কার্যক্রম স্থির হবে।
গিয়াসুদ্দিন স্তম্ভিত মুখে বললেন, কী আশ্চর্য। মনে-মনে বিরক্ত হয়ে বললেন, সত্যিই যুবকটি ছিটগ্রস্ত। পা বাড়িয়ে ফের মনে-মনে উচ্চারণ করলেন, বদ্ধ উন্মাদ!
শফি অন্ধ ঘোড়ার মতো পা ফেলছিল। নহবতখানা পেরিয়ে বাঁদিকের মহল্লায় ঢুকে সে চলার গতি কমাল। পিলখানার ঘরগুলির দশা আরও শোচনীয দেখাচ্ছিল। তখনও আলো আছে, ধূসর রঙের আলো। তার বুক কাঁপছিল, আবেগে আর উৎকণ্ঠায়। এতক্ষণে একটি ইংরেজি প্রবাদ তার স্মরণ হল, ‘আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড!’ আর-কোন বইয়ে যেন পড়েছিল, যাহাকে ভালবাস, তাহাকে কদাচ চক্ষুর আড়াল করিও না। বাবু বঙ্কিমচন্দ্র চাটুজ্জের বইয়েই কি?
সেই ঘর, সেই বেড়া, সেই পেয়ারাগাছ। কিন্তু এরা কারা? শফি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বারান্দা থেকে কেউ বলল, কৌন হো?
শফি একটু কেশে বলল, কাল্লু আছে?
জীর্ণ কম্বল গায়ে এক বুড়ো এসে বেড়ার ওধারে দাঁড়িয়ে বলল, বাবু! কাকে টুড়ছেন?
কাল্লুকে। পিলখানার সাতমার কাল্লুর বাড়ি না এটা?
বুড়ো বলল, হাঁ। কাল্লু তো একবরষ আগে রোশনিমহল্লা চলে গেসে। থানায় সিপাহিব নোকরি করছে। আপ বোশনিমহলেমে যাকে পুছিয়ে, বোল দেগা। এখোন কাল্লু কৈ মামুলি আদমি নেহি।
শফি অবাক হয়ে বলল, কাল্লু পুলিশের চাকরি করছে?
জি হাঁ বাবুসাব! কাল্লু তো ছোটাদেওয়ানসাবকা পাশ নোকরি করত। ছোটদেওয়ানসাব দোবর আগে নোকরি ছোড় কর চলা গেয়া। কান্নুকো উনহি পুলিশকা নোকরি মিলা দিয়া! তো আপনি কোথা থেকে আসতেছেন বাবুসাব?
শফি জবাব না দিয়ে ফিরে চলল। শীতের সন্ধ্যা নিঝুম হয়ে এসেছে। বাজার এলাকায় নৈঃশব্দ। মিটিমিটি আলো, জড়োসড়ো মানুষজন, একটা একা গাড়ি তার প্রায় গা ঘেঁষে চলে গেল এবং কোচোয়ান নিশ্চয় তাকে গাল দিয়ে গেল। রোশনিমহল্লায় পৌঁছে পান্না পেশোয়ারির ঘবটা সে চিনতে পারল। ঘরের সামনে। উঁচু চবুতরা ফাঁকা। কিন্তু ঘরের ভেতর কারা লম্ফ জ্বেলে তাস খেলছে। চত্বরটার সামনে কয়েক মুহঁত দাঁড়িয়ে শফি একটি পুরনো বাস্তবতাকে নিবিড়ভাবে বুঝতে চেষ্টা করল। এইখানে একজন হত্যাকারীর জন্ম হয়েছিল! বাস্তবতাটি রক্তাক্ত এবং শক্তিশালী। শফি চমক উঠল। লক্ষ হাতে অন্য পাশের ঘরের দরজা থেকে কেউ তাকে প্রশ্ন করছে, কৌন হ্ৰয়া খাড়া হ্যায় জি?
এ এক বুড়ি। লোলচর্ম! শফি বলল, এখানে কাল্লু সিপাহির বাড়িটা কোথায়?
বুড়ি গলিতে নেমে বলল, উদেখিয়ে। উও পেড়–দেহড়ি, হাঁ– ওহি কাল্লু সিপাহিকা ঘর।
বাড়িটার সামনে গিয়ে শফি বুঝল, কাল্লুর অবস্থার উন্নতি হয়েছে। দেউড়িওয়ালা একটা বাড়িতে সে আছে। উঠোনে একটা কিসের গাছ। দরজা খোলা, কিন্তু চটের পরদা ঝুলছে। মিয়াঁসাহেব হয়ে গেছে নবারি হাতির সাতমার কাল্লু খাঁ পাঠান। শফি চাপাস্বরে ডাকল, কাল্লু! কাল্লু!
আবছা আঁধারে পায়ের শব্দ হল। তারপর চটের পরদার ফাঁকে একটি ছোট্ট মুখ বেরুল। সেই সময় ভেতর থেকে কেউ বলল, কৌন রি? বোল্ দে, সিপাহিসাব ডিবটিমে হ্যায়। থানেমে যানে বোল্ দে।
‘সিপাহিসাব।’ ওই কণ্ঠস্বর কার? শফি গলা একটু চড়িয়ে বলল, আমি শফিউজ্জামান। সে সিতারার নাম উচ্চারণ করতে পারল না। তার কণ্ঠস্বরে কাঁপন ছিল।
এবার লম্ফের আলো চটের পরদার ওধারে উঁচু থেকে নিচু হয়ে এগিয়ে আসতে-আসতে– কৌন?
শফি। শফিউজ্জামান।
পরদা সরে গেল। লক্ষের আলোয় একটি মুখ, উজ্জ্বল গ্রীবা, বুকে একটি শিশু– প্রশান্ত, কিন্তু নির্লিপ্ত স্ত্রীমুখ। তারপর নীরবতা। তুম– আপ, তারপর আপনি বলেই থেমে যাওয়া।
শফি বলল, চিনতে পারছ না, সিতারা? আমি শফি।
এবার সিপাহিবধূ একটু হাসল। তাজ্জব। তুমি এ কেমন হয়ে গেছ শফিসাব? একদম বাঙালিবাবু। ধুতি-উতি, শার্ট-উট পিন্ধকার– কী হয়েছে তোমার? হা খোদা! কার সাদ্য আছে তোমাকে চিহিবে? আও, আও! অন্দর আও।
শফি চটের পরদা তুলে ঢুকে লম্ফের আলো অনুসবণ করল। সেই সময় দ্রুতদৃষ্টিপাতে বাঁদিকে একটি চালাঘরে গোরু আর ছাগল, ডানদিকে মুরগির দরমা, একপাশে পাতকুয়ো, গোসলখানা আর পায়খানাঘর, লাউগাছের বলিষ্ঠ লতা, পুঁইমাচা, তাবপর সামনে চারটি ধাপের ওপর বারান্দায় দুখানি কুরসি দেখতে পেল। কুরসি জীর্ণ, কিন্তু অভিজাত। কারণ একদা তা মখমলে মোড়া ছিল। মখমলের লালিত্য ক্ষয়ে গেছে। টুটাফাটা অংশ সেলাইকরা। সিতারা, বয়ঠো– বোসো আরামসে বলে একটি কুরসির দিকে ইশারা করল। চোখের সেই দীপ্তি কই? সুরমার টান আছে। কিন্তু দৃষ্টিব্যাপী ধূসরতা। কণ্ঠার হাড় ঠেলে উঠেছে। শফি কুরসিতে বসল। মুহূর্তে অনুমান করল, কাল্লু এগুলি কেল্লাবাড়ি থেকে আত্মসাৎ করেছে। দুখানি ঘর। একখানি ভোলা। ভেতরে তাকিয়ে শফি আবার অবাক হল। নিচু কড়িকাঠ থেকে একটি কাঁচের ঝালরদেওয়া সুন্দর ঝাড়বাতি জ্বলছে। এও কেল্লাবাড়ি থেকে আত্মসাৎ! একটি প্রকাও পালঙ্ক, পুরু গদির ওপর নকশাদার চাদর আর তাকিয়া, ঝুলন্ত কয়েকটি রঙিন সিকের কাঁসা-পেতলের বিবিধ তৈজস। শফি দেখল, বছর তিনেক বয়সের সালোয়ার-কামিজপরা মেয়েটির মুখের আদলে সিতারার অতীত ঐশ্বর্য প্রতিফলিত, সে ঘরের মেঝেয় দু-পা ছড়িয়ে বসল এবং সিতারা তার ছোট্ট উরুর ওপর বুকের ঘুমন্ত শিশুটিকে স্থাপন করল। তারপর লস্ফটির সাহায্যে একটি চৌকোনো সুদৃশ্য ‘লানটিন’ জ্বালল। এও, শফির মনে হল, কেল্লাবাড়ি থেকে আত্মসাৎ। লম্ফটি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে লানটিনটি বারান্দায় এনে সিতারা স্থির ও শান্ত দাঁড়াল। তাকে দেখতে থাকল শফি। পরনে ফিকে নীল কামিজ, শাদা সালোয়ার। শাদা উডনিতে মাথা এবং বুক ঢাকা। তার দুহাতে অনেকগুলি রেশমি চুড়ি, কিন্তু কবজি থেকে দূরে আঁটোভাবে আটকান। তার নাকে প্রকাণ্ড নাকছাবি ঝিলমিল করছে। কানে রুপোর মোটা দুটি ঝুমকো। সেই সিতারা! কিন্তু সেই সিতারা নয়। শান্ত, উদাসীন, নির্লিপ্ত। হঠাৎ শ্বাস ছেড়ে বলল, চায় পিও। তারপোরে কোথা হচ্ছে।
একদিন এমনি সন্ধ্যারাতে সিতারা তাকে চা খাইয়েছিল। কিন্তু সেই সিতারা নয়। শফি বলল, চা খাব না। তুমি বসো।
সিতারা একটু হাসল। …তুমি মেহমান। চায় পিও। নাশতা-উশতা করো। তারপোরে কোথা।
না।
সিতারা তাকাল। আস্তে বলল, কেনো? আমাকে তুমি এখনো নাপসন্দ কর বুঝলাম। তো ঠিক হ্যায়!
শফি হাসবার চেষ্টা করে বলল, সিতারা! তোমার জন্য পান্না পেশোয়ারিকে
জানি। মালুম করেছিলাম। তুমি আমার ইজ্জতরাখনেওয়ালা! আমি কুছু ভুলি নাই। নেভি ভুলোঙ্গি।
শফি চুপ করে রইল। সিতারাও চুপ করে রইল। একটু পরে শফি মুখ তুলে একটু হাসল।… তুমি বলেছিলে, ‘পুরা জওয়ান’ হয়ে তোমার কাছে আসতে। মনে পড়ে? কেন বলেছিল সিতারা?
সিতারা হাসল না। নির্বিকার মুখে বলল, হাঁ। তুমি পুরা জওয়ান হয়েছ। পান্না পেশোয়ারির চেহরা হইয়েছে। লেকিন বাঙ্গালি বাবু হইয়েছ। কী বেপার? তুমি সৈয়দজাদা। পিরসাহাবের খান্দান। কেননা তুমি–
বাধা দিয়ে শফি বলল, তুমি এত রোগা হয়ে গেছ কেন?
সিতারা একথার জবাব দিল না। বলল, ছোটোদেওয়ানসাব তো নৌকরি ছেড়ে চলে গেসে। তুমি কার ঘরে এসেছ?
শফিও একথার জবাব দিল না। বলল, বিড্ডুর খবর কী?
বিড্ডু কলকাত্তা চলে গেসে। নৌকরি-উকরি করে।
শফি বলল, কাল্লুভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল না।
সিতারা এবার ব্যস্ত হয়ে উঠল। জেরাসে বয়ঠো! আমি খবর ভেজছি। থানেমে হ্যায় মালুম পড়ে। তোমার কথা মুন্নির আব্বা হরঘড়ি বলে।
মুন্নি কে?
সিতারা ঘরের ভেতর ছোট্ট মেয়েটিকে দেখাল। উও মুন্নি। উসকি বাদ একঠো লড়কা আয়া। বদ নসিব! এক মাহিনা জিন্দা থা। উসকা বাদ উও লড়কি। তিন মাহিনা উমর (বয়স)। সিতারা হাসল– আত্মস্থ, জননীর হাসি। তারপর বলল, সিপাহিজী বোলতা ‘তিন্নি’, আমি বলি ‘জানি’। কেনো কি আমার খান্দানে একজন ছিল, জানি বেগম। আংরেজ-লোকের সাথে জঙ্গ করেছিল। আমার দাদিজান তিনহি– জান? আব্বাহজরত জিন্দা থাকলে পুছ করতে।
শফি বলল, চলি সিতারা।
শফি উঠে দাঁড়ালে, সিতারা বলল, তুমি –তুম এক আজিব আদমি শফিসাব। জেরাসে ঠাহার যাও– সিপাহিজিকো বোলাতি! তোমার খবর পেলে জরুর আ যাবে! এক মিনট!
শফি বলল, পরে দেখা হবে।
সে দ্রুত ধাপ বেয়ে নেমে গেল উঠোনে। দরজার চটের পরদা তুলে বেরুনোর সময় একবার ঘুরে উঁচু বারান্দায় লানটিনের আলোয় একপলকের জন্য স্থির ও ঋজু নারীমূর্তিটিকে দেখল, যেন বা এক বৃক্ষ। শীর্ণ, ফলবতী, তবু লাবণ্যে ঝলোমলো। উহাকে তাই ভালবাসিতে সাধ যায়। ‘Even as a tree, Phoebus loved iier…’ জলদেবী দাফনিকে তাহার প্রেমিক দেবতা বৃক্ষরূপিণী দেখিয়াও প্রেম ত্যাগ করিতে পারেন নাই।…
‘দিনকা মোহিনী রাতকা বাঘিনী
পলক-পলক লোহূ চোষে…’
ব্রহ্মপুর আশ্রমে মাঘোৎসবে সেবার প্রচণ্ড ভিড় হয়েছিল। আশ্রম এবং এই নতুন গ্রামটি বিশাল নিম্নভূমির উত্তরে উঁচু এলাকায় অবস্থিত। আশ্রম, কাছারি, বিদ্যালয়, আশ্রমিকদের বাসগৃহ– এসবের পিছনে একটি বিস্তীর্ণ বাঁজা ডাঙায় শামিয়াঁনা খাঁটিয়ে সভা হয়। জেলার হিন্দু ভদ্রলোক শুধু নন, মুসলমান মিয়াঁরাও এসে জোটেন। চাষাভুষো সর্বশ্রেণীর মানুষ হুজুগের বশে ভিড় করেছিল। জমিদারও এসেছিলেন জনাকতক। তাঁদের সঙ্গে যে পাইকবাহিনী ছিল, তারা লাঠি উঁচিয়ে ভিড় সামলানোর কাজে যোগ দেয়। আগের দিন সদর থেকে একদল সশস্ত্র পুলিশ আসে এবং ক্যাম্প পেতে খবরদারি শুরু করে। বোধ করি গুপ্তপুলিশও ঢের ছিল। স্বেচ্ছাসেবকবাহিনীর নেতৃত্ব আমাকে দিতে চেয়েছিলেন দেবনারায়ণদা। আমার নেতৃত্বের যোগ্যতা নেই। একথা শুনে ক্ষুব্ধ দেবনারায়াণদা হৃদয়নাথ শাস্ত্রীর মধ্যম পুত্র অজয়কে দায়িত্বটি দেন। কিন্তু শিবনাথ শাস্ত্রী মহোদয়কে দেখে নিরাশ হয়েছিলাম। মাঝারি গড়নের মানুষটি, মুখে দাড়ি, বৈশিষ্ট্যহীন চেহারা। এই হাজার হাজার মানুষকে তিনি কী শোনাবেন? বিকেলে বেদমন্ত্র পাঠ এবং ব্রহ্মসংগীতের পর সভায় বক্তৃতা শুরু হল। বড়ো হট্টগোল। তার মধ্যে শিবনাথ শাস্ত্রী মঞ্চে সঁড়ালেন। একটি হাত বরাভয়মুদ্রায় উর্ধ্বে তুলে কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর মনে হল, মেঘ গর্জন করে উঠল। ‘ভ্রাতৃবৃন্দ। ভগিনীগণ!’ মুহূর্তে সমস্ত কোলাহল থেমে গেল। মাঝে-মাঝে, একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, চোখ বুজে ফেলছিলাম। অবিকল আমার পিতার কণ্ঠস্বর। সেই আগুনের হলকা, সেই বজ্রধ্বনি, সেই ঐশী বার্তা ঘোষণা! সুললিত আরবি শ্লোকগুলির মতোই হঠাৎ-হঠাৎ সংগীতময় বৈদিক স্তোত্র আবৃত্রি। তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। সূর্য দিগন্তে নেমেছে, তবু বিরামহীন অনর্গল বাক্যস্রোত, যেন ভাঙা বাঁধের পথে বন্যার কল্লোল– না, উপমাটি সঙ্গত হইল না, বন্যা ধ্বংসের স্রোত, আর ইহা যেন সৃজনপ্রবাহ; এবং মুসলমানদের উদ্দেশে উচ্চারিত হল, ‘মোসলেম ভ্রাতৃবৃন্দ! পবিত্র কোরাণগ্রন্থে আছে, পরমস্ৰষ্টা কু-উ ন এই ধ্বনি উচ্চারণ করলেন। এর অর্থ : হউক। অমনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃজিত হল। আর আমাদের আৰ্য্যশাস্ত্রে আছে, পরমস্রষ্টা বুহ্ম উচ্চারণ করলেন ঔং- এই নাদব্রহ্মই সমগ্র সৃষ্টির মূলাধার। কাঁধে কার হাত পড়লে ঘুরে দেখি, হাজারিলাল। সে কানে কানে বলল, এসো। সভা শেষ হতে রাত্তির হবে। ওই দেখো, বিলিতি বাতিগুলিন জ্বালানো হচ্ছে। তার পেছন-পেছন উঠে এলাম। আশ্রম এলাকায় ঢুকে হরিবাবু। বললেন, রত্নময়ী এসেছে। গোবিন্দদা কথা রেখেছেন। এসো, সে তোমার সঙ্গে পরিচয়ে উৎসুক। কারণ তোমার বাবার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল– তুমি তো সেসব কথা জান। বললাম, তাকে কোথায় রেখেছ? হরিবাবু জবাব দিলেন না। মন্দিরের পিছনে গিয়ে দেখি স্বাধীনবালা দাঁড়িয়ে আছে। বিরক্তমুখে বলল, এত দেরি কেন? সভা ভাঙলেই মা এসে পড়বে জান না? হরিবাবু শুধু হাসলেন। আমি বললাম সভা রাত্তির অব্দি চলবে। স্বাধীন বলল, আমি সভায় যাচ্ছি। সে চলে গেল।
সুনয়নীর কুটিরের দাওয়ার বাঁশের খুঁটি ধরে স্বাধীনের বয়সী একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শীর্ণ, ছিপছিপে গড়ন। কাঁধে খোঁপা ঝুলছে, পাতাচাপা ঘাসের রঙ তার মুখের। হরিবাবু বললেন, রত্ন! এই তোমার সেই পিরবাবার ছেলে শফি।
রত্নময়ী সুস্পষ্ট উচ্চারণে বলল, আস্সালামু আলাইকুম।
আমি স্তম্ভিত। হরিবাবু হাসতে হাসতে বললেন, রত্ন পূর্বজন্মে মুসলমান ছিল। যাই হোক, তোমরা বাক্যালাপ করো। সভা উপলক্ষে বিস্তর ‘টিকটিকির’ উপদ্রব হওয়ার সম্ভাবনা। আমি সভার ভিড়ে গা-ঢাকা দিতে গেলাম। রত্ন, তুমি গোবিন্দদাকে বলবে, যেন কেশবপল্লীতে আমার ঘরে গোপনে তোমাকে নিয়ে যান! কিছু কথা আছে।
হরিবাবু দুত চলে গেলেন। রত্নময়ী নেমে এসে জবাফুলের ঝোঁপের পাশে দাঁড়াল। তার গায়ে একখানি সবুজ কাশ্মীরি নকশাদার আলোয়ান জড়ানো। খোঁপা খসে গিয়েছিল। আলতো হাতে বেঁধে আমার দিকে তাকাল। কোটরগত উজ্জ্বল দুটি চোখ। ঈষৎ তীক্ষ্ণ নাক। হরিবাবুর চেহারার সঙ্গে কোনো মিল নেই। বলল, তাহলে আপনি সত্যিই হিন্দু হয়েছেন?
একটু হেসে বললাম, আমি ধর্ম মানি না। নাস্তিক।
সে আমাকে কেমন দুষ্টে দেখছিল। মনে হল, আমার গায়ে আঁচ লাগছে। যেন অপ্রকৃতিস্থ চাহনি। একটু পরে তেমনি অপ্রকৃতিস্থ ভঙ্গিতে বলল, আপনার আব্বা আমার জিনটিকে তাড়াতে পারেনি। মাঝে-মাঝে সে আমাকে বিব্রত করে। আমিও ছাড়ি না।
এবার বললাম, আপনার আরবি উচ্চারণ শুনে মনে হল আপনি আরবি জানেন। কোথায় শিখলেন?
রত্নময়ী হাসল। আমার প্রিয় জিনটির কাছে। তাকে যদি দেখতে চান, কৃষ্ণপুরে যাবেন। আপনার দাওয়াত নেমন্তন্ন) রইল। আপনি ইচ্ছা করলে আমাদের সঙ্গেও যেতে পারেন। আমার পিতাঠাকুর আপনার আব্বার খুব ভক্ত।
সে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলার পর একমুহূর্ত থেমে খাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, বাট হি হিজ এ টির্যাট। দা স্যাটান হিমসেলফ। আই হেট হিম।
ফের স্তম্ভিত হয়ে বললাম, কেন?
হি হ্যাজ কিলড্ মাই মাদার। হি লিভস উইথ এ কনকুইন– ইউ নো, এ বাইজি!
তার হাবভাবে অপ্রকৃতিস্থতা বাড়ছে লক্ষ করে বললাম, আপনি ইংরেজিও চমৎকার বলেন!
আই ওয়াজ টট ইংলিশ বাই অ্যান ইউরেশিয়ান গভরনেস! হার নেম ওয়াজ কেটি –কেটি উডবার্ন। রত্নময়ী প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। ডু ইউ নো হোয়াই শি হ্যাড লেফট দা জব? দা ব্রুট জমিনডার ওয়াস্ অ্যাটেমটেড টু রেপ দা লেডি। আই হেট হিম, হেট হিম! সশব্দে থুথু ফেলল রত্নময়ী।
প্লিজ–
রত্নময়ী তাকাল। পরমুহূর্তে হেসে উঠল।..আমি আরবি ভাষায় বাবাকে গাল দিতাম। এইসব কথাই বলতাম। আপনার আব্বাও এসব শুনেছিলেন। আরবি ভাষায় উপদেশ দিয়েছিলেন, জন্মদাতার কোনো খাতাহ (ত্রুটি) নজর করতে নেই। তাঁর সঙ্গে আমার বাহাস (তর্ক) হয়েছিল। বলেছিলাম, যিনি গর্ভে আমায় ধরেছেন তাঁর বুঝি কোনো মূল্য নেই? জানেন? সে কী বাহাস!
আমিও হাসতে-হাসতে বললাম, আর লোকেরা ভাবল বুঝি আপনার জিনটা—
বাধা দিয়ে রত্নময়ী বলল, জিনটা আছে। তাকে আমি দেখতে পাই। তার সঙ্গে কথা বলি। এই যে দেখছেন, আমি কেমন টিপ পরে সেজেগুজে আছি, কেন? তার সঙ্গে দেখা যে-কৈানো সময় হতে পারে বলে! সে চায়, আমি সুন্দরীটি সেজে থাকি। আমি সেই মেয়ে –দিনকা মোহিনী রাতকা বাঘিনী/ পলক-পলক লোহ চোষে। কিছু বুঝলেন?
হুঁ।
ফাহিম আইয়ু সা’ইন?
সরি। আমি আরবি জানি না।
রত্নময়ী রুষ্টস্বরে ভেংচি কেটে বলল, বলছি–কী বুঝলেন? মুসলমানের ছেলে, পিরের বাচ্চা! বলে –আরবি জানি না!
মুখ গম্ভীর রেখে বললাম, বুঝলাম যে আপনি রাত্তিরে বাঘিনী হয়ে জিনটার রক্ত চুষে খান। কিন্তু বেচারা জিন যে রক্তশূন্য হয়ে মারা পড়বেন!
ডোন্টা জোক উইথ মি।
বিব্রত হয়ে বললাম, সরি ম্যাডাম! তারপর এদিক-ওদিক দ্রুত তাকিয়ে নিলাম। হরিবাবু আর স্বাধীন এক পাগলি জমিদারকন্যার পাল্লায় আমাকে ফেলে দিয়ে কেটে পড়ল। একে কীভাবে সামলাই? সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। গায়ে আলোয়ান নেই। ভীষণ শীত করছে। উত্তরের সভা থেকে উত্তরের হাওয়ায় এখন সমবেত সংগীতধ্বনি ভেসে আসছে।
স্বাধীনবালা এসে বাঁচাল। বলল, মা একেবারে ব্রহ্মস্বাদে আপ্লুত। চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু ঝরছে। আমি ভাবলাম, আলো কোথায় আছে –দিদি খুঁজে পাবেন নাকি ।
সে সোজা ঘরে ঢুকে শলাইকাঠি জ্বেলে লণ্ঠন ধরাল। ডাকল, দিদি। হিম লাগবে। ঘরে আসুন। শফিদা, চলে এসো।
বললাম, চলুন! বড় হিম লাগছে।
কিন্তু রত্নময়ী দাঁড়িয়ে রইল। তখন স্বাধীন এসে তাকে টানতে-টানতে ঘরে নিয়ে গেল। আমি বললাম, চলি খুকু!
স্বাধীন বলল, এসো না বাবা! তোমার এত তাড়া কিসের?
চাদর নেই দেখছ না? শীত করছে।
স্বাধীন তার গা থেকে মোটা তাঁতের চাদরটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, নাও, গায়ে। জড়াও।
চাদরে নারীর ঘ্রাণ! আমার এ কী বোধশক্তি– পঞ্চেন্দ্রিয় কেন এত তীক্ষ্ণ! অস্বস্তি, অথচ মোহাবিষ্ট অবস্থা– আমি আক্রান্ত। এই আচ্ছাদন যেন বাঘিনীর মতো পলকে পলকে আমার রক্ত শুষে নিচ্ছে! ঘরে ঢুকলাম না। দোরগোড়ায়। মাটিতেই বসে পড়লাম, জুতো উঠোনে খুলে রেখে এসেছি। স্বাধীন বলল, ওখানে। কেন? এই মোড়ায় বসো।
বললাম, থাক। আমি প্রকৃতির মানুষ।
রত্নময়ী তাপোশে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আমাকে দেখছিল। স্বাধীন কী বলতে যাচ্ছিল আমাকে, রত্নময়ী বলে উঠল, ওঁকে আমি যা ভয় পাইয়ে দিয়েছি। সে খি খি করে হাসতে লাগল।
স্বাধীন সকৌতুকে বলল, শফিদাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন! ও কে আপনি জানেন? দুর্দান্ত বাঘ!
রত্নময়ী হঠাৎ মূৰ্ছিত হয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।…