১৮. কী নাম

কী নাম?

আনিসুর রহমান।

আর কোনো নাম আছে?

জি না।

মালেক বলে কাউকে চেনো?

জি না।

মালেক নাম তো খুবই কমন, এই নামে কাউকে চেনো না?

জি না। কমিউনিষ্ট পাটির নেতা মোহাম্মাদ মালেক। উনাকে চেন না?

জি না।

শরিয়তুল্লাহ বলে কাউকে চেন? ঠিকানা তস্তুরীবাজার।

জি না।

সে তো তোমাকে তিনটা ডিকশনারি পাঠিয়েছিল, তাকে চেনো না?

জি না।

সফিকুর রহমান বলে কাউকে চেনো?

আমার বাবার নাম সফিকুর রহমান।

তাও ভালো, নিজের বাবাকে ইচনতে পারছ। আমি ভেবেছিলাম, তুমি কাউকেই চিনবে না। নিজের বাবাকেও না।

প্রশ্ন কর্তা হেসে ফেললেন। প্রশ্ন কর্তার সঙ্গে যে তিনজন আছেন তারাও হাসলেন। যে ঘরে কথাবার্তা হচ্ছে সেই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। ছোট্ট ঘুপচি মতো ঘর। হলুদ রঙের দালান। ছাদ অনেক উঁচু। উঁচু ছাদ থেকে ঝুলন্ত লম্বা তারের মাথায় ইলেকট্রিক বান্ধ। ঘরে কোনো হাওয়া আসছে না। কিন্তু বান্ধটা পেন্ডুলামের মতো দুলছে। আনিসের দৃষ্টি বান্ধে আটকে যাচ্ছে। বাম্বের আলো উজ্জ্বল। মনে হয় একশ পাওয়ারের বাহু। উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ায় সে তার সামনে বসা তিনজনকে ঠিকমতো দেখতে পারছে না। যিনি তাঁকে প্রশ্ন করছেন তিনি পুলিশের কোনো সিনিয়র অফিসার হবেন। কারণ তাঁর পাশের দুজন অত্যন্ত সমীহ করে তাঁর দিকে তাকাচ্ছেন। মূল প্রশ্নকর্তার গায়ে সার্ট-প্যান্ট। সাটের রঙ হালকা নীল। বাকি দুজনের গায়ে পুলিশের পোশাক। প্রশ্ন কর্তার সামনের টেবিলে ফুলতোলা একা রুমাল। রুমালে একটা পিস্তল।

তোমার নাম আনিসুর রহমান?

জি।

তোমার বাবা নাম সফিকুর রহমান?

জি।

এমএ পাশ করেছ?

জি।

তোমার বিষয়বস্তু হলো ইতিহাস।

জি।

টেবিলে রাখা পিস্তলটা তুমি চেনো? চেনো না? তোমাকে চিনতেই হবে, কারণ তোমাকে ধরা হয়েছে পিস্তলসহ। এখন বলো, পিস্তলটিা চেনো না?

জি চিনি।

এই পিস্তল কখনো ব্যবহার করেছ?

জি না।

ব্যবহার করো নাই কী জন্যে?

আমাকে পিস্তলটা লুকিয়ে রাখার জন্যে দেয়া হয়েছে। ব্যবহার করার জন্য দেয়া হয় নি।

কে তোমাকে দিয়েছে?

আমি তার নাম বলব না।

নাম তো অবশ্যই বলবে। আমরা এখনো জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি নাই। যখন জিজ্ঞাসাবাদ সত্যি সত্যি শুরু করব, তখন প্রশ্ন জিজ্ঞাস করার আগেই উত্তর দিয়ে দিবে। তোমাকে তোমার নাম জিজ্ঞসা করব, তুমি নিজের নাম তো বলবেই, তোমার বাবার নাম বলবে, তোমার শ্বশুরের নামও বলবে। শ্বশুরের নাম কী?

স্যার, আমি এখনো বিয়ে করি নি।

বিয়ে করো নি কেন? পার্টির নিষেধ আছে? তুমি কমিউনিস্ট পাটির মেম্বার না?

জি মেম্বার।

তোমাকে মেম্বার কে বানিয়েছেন? মোহাম্মদ মালেক?

জি।

ভাষা আন্দোলনে জড়িত আছ?

জি না।

জড়িত না কী জন্যে— বাংলা ভাষা পছন্দ করো না? না-কি আরো বড় ধরনের আন্দোলনের জন্যে অপেক্ষা?

স্যার, একটু পানি খাব।

অবশ্যই পানি খাবে। পানি কেন খাবে না! তোমাকে যদি এখন পানি না। দেই, তাহলে রোজহাশরে আমি নিজে পানি পাব না। পানি দিচ্ছি। পানি খাও। তারপর গরম এক কাপ চা দিচ্ছি। চা খাও। ধূমপানের অভ্যাস আছে?

জি আছে।

গুড। সিগারেট দিচ্ছি। সিগারেট খাও। মন শান্ত করো এবং সুবোধ বালকের মতো প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি যে কী ভয়াবহ অবস্থায় আছ তুমি জানো না। তুমি ধরা পড়েছ অস্ত্রসহ। অস্ত্র মামলায় তোমার যাবজীবন সাজা হয়ে যাবে। আর আমরা যদি আরেকটু কায়দা-কানুন করি, তাহলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে পারব। ঠিক আছে। এখন কিছু সময়ের জন্যে আমরা ব্ৰেক নেব। ভালো কথা, সারাদিনে তুমি কিছু খেয়েছ?

জি না।

তাহলে তো শুধু চা খাওয়া ঠিক হবে না। চায়ের সঙ্গে সামান্য কিছু হলেও খাওয়া। মাখন দেওয়া দুই পিস পাউরুটি দিতে বলি? বলব?

জি বলুন।

আমার নাম এবং তোমার বাবার নাম কিন্তু এক। আমার নামও সফিকুর রহমান। আইবি’র পুলিশ ইন্সপেক্টর সফিকুর রহমান। তোমার বাবা নিশ্চয়ই খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ছিলেন না?

জি।

আমি কিন্তু ভালো মানুষ না। আমি খুব খারাপ মানুষ। কতটা খারাপ কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পাবে।

স্যার, একটু পানি খাব।

অবশ্যই পানি খাবে। তোমাকে তো বলেছি পানি দেয়া হবে। পানি, চা, সিগারেট, মাখন লাগানো দুই স্নাইস পাউরুটি। আচ্ছা আনিস, গত দুই বছর তুমি কোথায় ছিলে?

ময়মনসিংহে, নয়াপাড়া। সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের বাড়িতে।

এই রিভলবার কি তখনো তোমার সঙ্গে ছিল?

জি।

আর কেউ সেখানে তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে গিয়েছিল?

জি না।

মনে করে দেখ, কেউ না?

জি না। স্যার পানি খাব।

ও হ্যাঁ পানি খাবে। পানি, চা-নাশতা দিতে বলছি। সিগারেট দিচ্ছি। সিগারেট টানতে থাকো এবং যে সব প্রশ্ন করব তার জবাবগুলি ঠিক করে রাখো। কাগজ দেয়া হবে। কাগজে গুছিয়ে লিখবো। তিনটা মাত্র প্রশ্ন। প্রশ্নগুলি মন দিয়ে শোনো— প্রশ্ন এক. এ জাতীয় অস্ত্ৰ তোমাদের কাছে কয়টি আছে? কার কার কাছে আছে? প্রশ্ন দুই. হিন্দুস্তানের সঙ্গে তোমাদের কি যোগাযোগ আছে? প্রশ্ন তিন. তোমাদের মূল আন্দোলনটি বৃহৎ বাংলা আন্দোলন, সর্বহারা আন্দোলন না-কি ভালো পাকিস্তান আন্দোলন। সহজ প্রশ্ন— সহজ উত্তর। ঠিক না আনিস?

জি স্যার।

পুলিশ ইন্সপেক্টর সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক না পেলে আমি কী করব সেটাও একটু বলে রাখি, এতে সুবিধা হবে। আমি তোমার তিনটা আঙুলের নখের নিচে আলপিন ঢুকিয়ে দেব। কোন তিনটা আঙুল সেটা তুমিই ঠিক করবে। খুবই কষ্টকর প্রক্রিয়া, কিন্তু কী আর করা!

স্যার পানি খাব।

পুলিশ ইন্সপেক্টর সফিকুর রহমান পানি দিতে বললেন। চা-সিগারেট দিতে বললেন। তার মুখে হাসি।

আনিস কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। তার নিচে দুটা কালো কম্বল। আরেকটা কম্বল তার গায়ে। যে সেলে তাকে রাখা হয়েছে সেটি ফাঁসির আসামিদের জন্যে আলাদা করা কনডেম সেল। সেলের ছাদের সঙ্গে আলো-বাতাস আসা-যাওয়ার জন্যে চারকোনা একটি ভেন্টিলেটার আছে। এই মুহুর্তে ভেন্টিলেটার দিয়ে রোদ এসেছে। সেই রোদ পড়েছে দেয়ালে। আনিস রোদের দিকে তাকিয়ে আছে। সেলের ভেতরে ভ্যাপসা গরম। আনিসের লাগছে ঠাণ্ডা। তার কাছে মনে হচ্ছে, মেঝের নিচ থেকে ঠাণ্ডা উঠে এসে তার গায়ে লাগছে। দুটা কম্বলে ঠাণ্ডা মানছে না। দিনের বেলাতেও তার মুখের কাছে এবং কানের কাছে মশা ভিনভন্ন করছে। হাত দিয়ে মশা তাড়ানোর উপায় নেই। দুটা হাতই ফুলে উঠেছে। নখের নিচে পিন ঢুকানোর ফল ফলেছে, হাত বিষিয়ে উঠেছে।

বেশির ভাগ সময় আনিস ঘোরের মধ্যে কাটাচ্ছে। ঘোরটা যখন আসে। তখন তার ভালো লাগে। আঙুলের যন্ত্রণা টের পাওয়া যায় না। ঘোরের সময় সে কাউকে না কাউকে সেলের ভেতর বসে থাকতে দেখে। বেশির ভাগ সময় দেখে মালেক ভাইকে। মালেক ভাই নিচু গলায় কথা বলেন। তাঁর কথাগুলি বেশির ভাগ সময়ই গানের মতো মনে হয়। মনে হয়। গানের সুরে কথা বলে এই মানুষটা তাকে ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করছে।

কেমন আছ আনিস?

ভালো আছি। মনে হয় জ্বর আসছে কিন্তু আমি ভালো আছি।

তোমার কথা শুনে ভালো লাগল। আনিস শোনো, যেখানে থাকবে, যে অবস্থায় থাকবে ভালো থাকার চেষ্টা করবে। ভালো থাকার চেষ্টা করাটা খুব জরুরি।

জি।

আনিস শোনো, দেশের ভালোর জন্যে দেশের সব মানুষ কাজ করে না। অল্প কিছু মানুষ কাজ করে। তুমি অল্প কিছু মানুষের একজন। এটা ভেবে তোমার ভালো লাগছে না?

জি লাগছে।

যে কষ্ট তুমি ভোগ করছ, সেই কষ্ট তোমার পরের প্রজন্ম ভোগ করবে না। তারা বাস করবে স্বাধীন বাংলাদেশে।

মালেক ভাই, এইসব কথা অনেকবার বলেছেন। নতুন কিছু বলুন।

নতুন কথা শুনতে চাও? এইগুলাও নতুন কথা।

আনিস মাঝে মাঝে সিদ্দিকুর রহমান সাহেবকে তার পাশে বসে থাকতে দেখে। তিনি সবসময়ই অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলেন।

মাস্টার।

জি।

ফুলের পাপড়ি সবসময় বেজোড় সংখ্যায় হয়। একটা ফুলের পাপড়ি হয় জোড় সংখ্যায়। ফুলের নামটা বলো।

বলতে পারছি না।

চিন্তা করো। চিন্তা করে বলো।

চিন্তা করতে ভালো লাগছে না।

কেন ভালো লাগছে না?

গাছপালা বনজঙ্গল আমার ভালো লাগে না। তাদের নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। চিন্তা করতে হবে মানুষ নিয়ে।

গাছপালা, বনজঙ্গল এরা কি মানুষের অংশ না?

এইসব আপনি কী বলেন, এরা মানুষের অংশ হবে কী জন্যে?

আমার তো মনে হয় মানুষই বরং গাছপালার অংশ। মানুষকে গাছের ফুল হিসেবে কল্পনা করো। ফুলের থাকে পাপড়ি, মানুষের আঙুল হলো পাপড়ি। ফুলের থাকে গন্ধ— মানুষের গুণ হচ্ছে গন্ধ। ফুল থেকে ফল হয়…

আপনি কি চুপ করবেন?

আচ্ছা যাও চুপ করলাম।

হঠাৎ হঠাৎ আনিস লীলাবতীকে দেখতে পায়। সে খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে, আপনি আমার সঙ্গে চলুন তো।

কোথায় যাব?

আমাদের বাড়িতে যাবেন। আমি আপনাকে জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে রাখব, কেউ আপনাকে পাবে না।

এরা আমাকে ছাড়বে না।

তাহলে একটা কাজ করুন, এরা আপনার কাছে যা যা জানতে চায় সব বলে দিন। হড়হড় করে বলে দিন।

সম্ভব না।

অবশ্যই সম্ভব। পুলিশ ইন্সপেক্টর সাহেবকে ডাকুন, ডেকে সব বলে দিন।

পুলিশ ইন্সপেক্টর সাহেবকে বেশির ভাগ সময়ই আনিস তার আশেপাশে দেখতে পায়। তিনি হাতে একটা আলপিন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং একটা প্রশ্নই বারবার করতে থাকেন। আনিসও ক্লান্তিহীনভাবে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে।

তোমার নাম কী?

আনিস।

তোমার নাম কী?

আনিস।

তোমার নাম কী?

আনিস।

তোমার নাম কী?

আনিস।

তোমার নাম কী?

আনিস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *