1 of 2

১৮. কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ওদিকে

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ওদিকে পৃথু। ভুচু উপহার দিল, কিন্তু ভুচু ও ঠুঠাকে জোর করে নামিয়ে জন্মদিন উপলক্ষে যে কিছু খাইয়ে দেবে ওদের, এক টুকরো কেক; একটু দই বড়া, তার উপায় বা সাহসও নেই ওর। ওর কোনও অধিকার, ওর কোনও ইচ্ছা-অনিচ্ছাই নেই আর অবশিষ্ট। এখানে একরকম পেয়িং-গেস্ট হিসেবেই ওর থাকা।

কী ভাবল ভুচু কে জানে? ঠুঠা তো ওকে জানেই। ঠুঠা সবই বোঝে। ভুচু হয়তো ভাবল, ছোটলোক! ভাবল, পৃথুকেই! খাওয়াতে ভয় পায় ঘোষ্ণপরিবারের পৃথু ঘোষ! ভাবল? ঈসস…।

রুষার গাড়িটা পের্টিকোতে নেই। হয়তো কাউকে ছাড়তে গেছে। বাগান পেরিয়ে ঘরে ঢুকল পৃথু। নানারঙা বেলুন সাজানো হয়েছে। কেক কাটা হয়েছে। অনেকে এসেছিল, তার চিহ্নও বর্তমান। অধভুক্ত খাবার-দাবার, কাগজের প্লেট, গ্লাস, এদিকে ওদিকে। সব কটি আলো জ্বলছে। বাড়ির। ঝলমল করছে।

রুষ দেখতে পেয়েই বলল, এলেন এতক্ষণে মেয়ের বাবা! বার্থডে-চাইল্ডের বাবা। গ্রেট ফাদার। ইনডিড।

পৃথু ভয়ে কুঁকড়ে গেল। খুবই ক্লান্ত আর টেন্স এখন রুষা। “টাইগ্রেস ইন হিট”-এরই মতো হাইলি ডেঞ্জারাস।

এই একশ টাকা দিয়েছে ভুচু। মিলিকে।

দাও দাও। আমার খরচ, বাজেট অনেক বেশি একসীড করে গেছে। বা বা! ক্রীম আর পীচ-এর যা দাম আজকাল! কত লাগল জানো?

হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল রুষা।

পৃথু জানে না। জানতে চায়ও না। পৃথু শুধু একটু শান্তি চায়, একটু কম আলো, একটু নম্রতা; একটু ভালবাসা একটু দরদ, আরও একটু কম শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, ব্যসস। আর কিছুই ও চায় না।

তাঁরাও এসেছিলেন। তোমার পীরিতের লোকেরা।

শ্লেষের গলায় বলল, রুষা—

কারা?

কুর্চি আর ভাঁটু।

ওদেরও বলেছিলে বুঝি!

আহা! ন্যাকা! যেন জানো না?

তারপরই সুন্দর মুখটা বিকৃত করে বলল, অফিসের দীর্ঘ ছুটিটা বুঝি এই জন্যেই নেওয়া হল? টু রিনিউ দ্যা ডিসজয়েন্টেড রিলেশান। তাইই বলল। আমি ভাবি, হঠাৎ এরকম ছুটি। জীবনে কোনওদিনও…আমার জন্যে, ছেলেমেয়েদের জন্যে…

পৃথু চুপ করেই থাকল।

তাদের পাঠাতেও হল গাড়ি দিয়ে। শীতের রাতে, অতদূর যাবে কী করে? আশ্চর্য! সকলে যেন ধরেই নেয় যে, যাদেরই বাড়ি-গাড়ি আছে, তাদের বাড়ি নেমন্তন্ন করলে প্রত্যেককেই বাড়িতে পৌঁছে দেবার দায়িত্বটাও হোস্ট-এরই! কী ইনকনসিডারেট হতে পারে মানুষ! আরে, এই করে করেই তো আমার বাবা পথে বসলেন। লোকগুলোর একটু চক্ষুলজ্জা অবধি কি নেই? আশ্চর্য! যখন অবস্থা থাকে, চারধারে তখন ফসলি বটেরের ভিড় আর যখন থাকে না, তখন খাঁ-খাঁ। কেউ ডাকেও মা আসেও না। চেনেই না যেন কেউ।

পৃথু ভাবল, একথাটা সত্যি। সত্যি যে, তা ও নিজে যতটা জানে, তা খুব কম লোকই জানে, কিন্তু কুর্চি, পৃথুর কাছে; “ওই লোকগুলোর মধ্যে পড়ে না। কুর্চিকে যদি নেমন্তন্ন করে থাকে রুষা, পৃথুকে না-জানিয়েই, তাহলে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার দায়িত্বও নিশ্চয়ই রুষারই নেওয়া উচিত ছিল। ঘন জঙ্গলের পথে; রাতের বেলা, মোটর সাইকেলে। ঈসস। ভাগ্যিস হাতি নেই এদিকের জঙ্গলে। হাতিরা মোটর সাইকেলের শব্দ একেবারেই সহ্য করতে পারে না। অনেকসময় তেড়ে যায়।

পৃথুর যদি টাকা থাকত, উপায় থাকত, তবে কুর্চিকে একটি সাদা এয়ারকণ্ডিশানড মার্সিডিস গাড়ি কিনে দিত। লটারীর টিকিট তো প্রতিমাসেই কেনে। কিন্তু ও কি পাবে? পৃথু পাবে না। বিনা-মেহনতে কিছুই পাওয়ার কপাল করে আসেনি এ জন্মে। শুধু দেবারই জন্যে এসেছিল। শনিবারে যাদের জন্ম, তাদের কপাল নাকি এরকমই হয়। মা বলতেন। স্যাটারডেজ চাইল্ড হ্যাজ টু ওয়ার্ক হার্ড ফর আ লিভিং। সেটা যেমনই হোক না কেন। কিন্তু পড়ে-পাওয়ার কপাল তাদের নয়।

অনেক খাবার আছে। দয়া করে খাওয়া হোক। মেরী! মেরী!

মিলি কোথায়?

ওর ভিনোদ-আংকল আসতে পারেনি। কী নাকি জরুরি মীটিং ছিল। সেইই ডেকে পাঠিয়েছে মিলিকে। দারুণ একটা পার্টি-ফ্রক পাঠিয়েছে ইদুরকার সকালে। উইথ রেড-রোজেজ। ফুলের যে একটা দোকান হয়েছে, নতুন, দেখেছ বাজারে?

পৃথু চুপ করেই রইল।

ফুল? কাকে ফুল দেবে? ফুলের গন্ধ, ধূপের গন্ধে অ্যালার্জি রুষার। পৃথু নিজে মরে গেলে কোথা থেকে সাদা ফুল জোগাড় হবে, সেটা ওর নিজের না জানলেও চলবে! অতদূর অবধি ভাবে না ও।

আগের কথার খেই ধরেই রুষা বলল, তাই অজাইব সিংকে বললাম যে, কুর্চিদের ছাড়তে যাবার আগে মিলিকে ভিনোদ-এর বাড়ি নামিয়ে দিয়ে যাবে। আবার ফেরার সময় তুলে নিয়ে আসবে। কুর্চিদের ওখানে যেতে-আসতে তো অনেকক্ষণ। গেছেও অনেকক্ষণ। মিলির জন্যে একটা ছোট্ট পার্টি অ্যারেঞ্জ করেছে ভিনোদ। আমাকেও যেতে বলেছে। খুবই ক্লোজ-সার্কল। ড্রিঙ্কস এন্ড ডিনার। তোমাকেও। যাব আর আসব। তুমি যাবে না?

কখন বলেছে? মুখ না-তুলেই বলল পৃথু।

বলেছে তো আগেই। কিন্তু তোমাকে বলব কখন? তোমার সঙ্গে দেখা কি হয়? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই তো বটে! তুমি তো এখনও তোমার কলেজের হস্টেলের ঘরেই থাকো। ঘন্টা দিলেই, ঘড়ি-ঘড়ি খাওয়ার এসে যাচ্ছে; কোনওই দায়-দায়িত্ব নেই। মনের সুখে নভেল পড়া, কাব্য করা! জীবনটা কাটিয়ে দিলে বেশ!

মেরী এসে বলল, ডাকছিলেন?

হ্যাঁ। মেরী, মিলির ভিনোদ আংকল-এর জন্যে একটু কেক, আইসক্রীম সব ভাল করে টিফিন ক্যারিয়ার আর থামোস-এ প্যাক করে দাও। আমি এবার চান করতে যাব। শুনলাম, যাঁদের, বলেছে ভিনোদ, তাঁরা সব হাইলি রেসপেকটেবল লোক। টাইগার প্রজেক্টের একজন অফিসার আসবেন।

পৃথু চমকে উঠে বলল, কে? মিঃ পারিহার না কি? মিঃ লাওলেকার নয়তো?

রুষা বলল, মুন্সীয়ানার সঙ্গে। যেন ও নিজেও একজন ভারী অফিসর, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের।

টুসু কোথায়? পৃথু শুধোল।

ও-ও তো গেছে মিলির সঙ্গে। এত খাবার বেশি হল না এবারে! তোমার সব ঘড়ি-সারাইওয়ালা, জুতোওয়ালা, গাড়ির মিস্ত্রিদের ঠুঠা-ােবা কালাদের বলে দিলেই হত। এত্ত জিনিস ওয়েস্ট হল।

পৃথু আবার তাকাল রুষার দিকে। ভাবল বলে, কেন? ওরা কি ভিখিরি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *