কতদিনই বা আগের কথা, মাত্র পাঁচ ছ’ বছর! এই পথ দিয়ে একদিন দলবেঁধে হৈ হৈ করে যাওয়া হয়েছিল, ট্রেনের অন্যান্য যাত্রীদের চুপ করিয়ে দিয়ে ওরা চিৎকার করে গেয়েছিল কোরাস গান। আজ ওরা মাত্র দু’জন! আসবার সময় পমপম একটা কথাও বললো না, জানলায় মাথাটা হেলান দিয়ে বসে রইলো চোখ বুজে। অলি মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যা। মন বসাতে পারেনি। লোকাল ট্রেনে ভিড় যথেষ্ট, বিভিন্ন স্টেশানে লোজন উঠছে নামছে, কিন্তু ওদের কোনাকুনি বিপরীত দিকে দু’জন। লোক বসে আছে গ্যাঁট হয়ে, তাদের নামার কোনো লক্ষণ নেই। অলি চোখ তুললেই চোখাচোখি হচ্ছে ওদের সঙ্গে।
দুটি যুবতী মেয়ের দিকে দু’জন পুরুষ মাঝে মাঝে তাকাবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু লোক দুটির গড়াপেটা চেহারা, তেমন অল্প বয়েসীও নয়। ওদের ঠিক রাস্তাঘাটের রোমিও বলে মনে হয় না। পুলিস? অন্য কোনো পাটির ভাড়া করা গুণ্ডা? ওদের চোখে চোখ পড়তেই গা-টা ছমছম করছে অলির। যদিও এখন বেলা এগারোটা, ট্রেনে এত মানুষ, তবু আজকাল প্রকাশ্য দিবালোকেই বহু লোকের চোখের সামনে খুন-জখম হয়, দুটো বোমা ফাটালেই কেউ আর বাধা দিতে আসে না।
মেমারি স্টেশানে অনেক লোক নামলো, অন্য যাত্রীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে পমপমের হাত ধরে নেমে পড়লো অলি। পমপম ফিসফিস করে বললো, আমায় ছেড়ে দে অলি, আমি হাঁটতে পারবো! অলি তবু ছাড়লো না, প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে চলে এলো গেটের বাইরে। আগে পমপমদের গ্রামের বাড়িতে গরুর গাড়িতে যেতে হতো, এখন সাইকেল রিকশা চলে। একটা রিকশায় উঠে পড়ে অলি পেছন দিকে না তাকিয়ে পারলো না, সেই লোকদুটিও এই স্টেশানে। নেমেছে, কিন্তু ওদের অনুসরণ করবার জন্য অন্য রিকশায় চাপেনি, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দু’জন সৈনিকের মতন, জামার পকেটে হাত। ওরা যে সাধারণ যাত্রী নয়, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এবার কি ওরা গুলি ছুঁড়বে? রিকশাটা চলতে শুরু করলে অলি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইলো পেছন দিকেই, ওরা যা খুশি করুক, বাধা দেবার উপায় তো নেই, শুধু ওদের দিকে ঘৃণা ছুঁড়ে দেওয়া যেতে পারে।
লোকদুটি কিছুই করলো না, দাঁড়িয়ে রইলো একইভাবে। রিকশাটা বাঁক ঘুরে যাবার পর অলি ভাবলো, তা হলে কি পমপমের বাবা অশোক সেনগুপ্ত ওদের পাহারা দেবার জন্য পাঠিয়েছেন লোক দুটোকে?
মানিকতলা কেন্দ্রে বাই-ইলেকশানে জিতে কয়েক মাস আগে এম এল এ হয়েছেন অশোক সেনগুপ্ত। তাঁর প্রভাবেই নিশ্চিত ছাড়া পেয়েছে পমপম, যদিও তিনি আগে বলেছিলেন মেয়ের ব্যাপারে তিনি হস্তক্ষেপ করবেন না, পমপমও কিছুতেই তার বাবার সাহায্য নিতে চায়নি। পমপমকে ছাড়া হয়েছে স্বাস্থ্যভঙ্গের কারণে, সে প্রায় শয্যা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। মুক্তি পাবার পরেও মানিকতলার বাড়িতে কয়েকদিন থেকেই আবার বিদ্রোহ করেছিল পমপম, সে বাড়িতে অনবরত তার বাবার পার্টির লোকজন আসছে, অনেকে পমপমকে খুব বাচ্চা বয়েস থেকে চেনেন, তাঁরা পমপমকে উপদেশ দিতে চান, পমপমেরই ভালোর জন্য তাকে অন্যদিকে ফেরাতে চান, অমনি পমপমের সঙ্গে তর্ক বেধে যায়, পমপম। উত্তেজিত হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে, পমপম গ্রামের বাড়িতে কিছুদিন থেকে শরীর সারাবে। তবে একটা শর্ত আছে, পমপম সেখানে আবার নকশালদের আড্ডা করতে পারবে না। কোনো পলাতককে আশ্রয় দিতে পারবে না। এই শর্তে পমপম রাজি না হলে তাকে ব্যাঙ্গালোরে এক মাসির বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে, এটাই অশোক সেনগুপ্তর শেষ নির্দেশ!
অলি ভাবলো, ঐ গুণ্ডা চেহারার লোকদুটোকে যদি পমপমের বাবা পাঠিয়ে থাকেন, তা হলে ওরা কি পাহারা দেবার জন্য এসেছিল, না ওদের সঙ্গে আর কেউ আসে কি না তাই লক্ষ রাখতে এসেছিল?
পমপম কিছু বুঝতে পারেনি, অলি তাকে কিছু বললোও না।
একমাত্র মনের জোরটাই টিকে আছে পমপমের, তার শরীরটা একেবারে ভেঙে দিয়েছে ওরা। খানিকটা হাঁটলেই তার পা থরথর করে কাঁপে, হাত দুটো যেন শরীরের সঙ্গে আলগা হয়ে ঝুলছে, একখানা বই পড়তে গেলেও যখন-তখন তার হাত থেকে খসে পড়ে যায়। মুখখানা একেবারে রক্তশূন্য। তবু লালবাজারে পমপমের ওপর কী ধরনের অত্যাচার করা হয়েছে, তা সে কিছুতেই বলবে না। এমনকি অলিকেও না। শুধু মাঝে মাঝে ফিসফিস করে, ওদের মুখগুলো তো চিনে রেখেছি, একদিন ঠিক শোধ নেবো! ওদের ছেলেমেয়েরাও ওদের নাম উচ্চারণ করতে লজ্জা পাবে।
গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় পমপমকে যখন কিছুদিনের জন্য পি জি হাসপাতালে রাখা হয়েছিল। পুলিস পাহারায়, তখন নার্সের পোশাক পরে অলি দেখা করতে গিয়েছিল তার সঙ্গে। পি জির সুপারিনটেনডেন্ট অলির শান্তিমামার বিশেষ বন্ধু, সেইজন্যই এটা সম্ভব হয়েছিল। অলিকে দেখে পমপম শুধু অবাক হয়নি, বিরক্তও হয়েছিল খুব। অলি তাদের দলের কেউ নয়, কয়েকদিন স্টাডি সার্কেলে এসেছিল মাত্র, তারপর নিজে থেকেই সে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, সে কেন এই ঝুঁকি নেবে? অলির ওপর পুলিসের নজর পড়ে যাবেই, অলিকে যদি পুলিস অ্যারেস্ট করে তা হলে পমপমের ওপর যে ধরনের অত্যাচার হয়েছে, অলি তা কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। অলি খুবই মেয়েলি ধরনের মেয়ে, তুলো-মোড়া বাক্সের পুতুলের মতন।
পমপমের নিষেধ শোনেনি অলি, তিনবার গিয়েছিল সে, বহরমপুর জেলে আটক কৌশিকদের খবরাখবর সে-ই জানিয়েছে পমপমকে। শুধু মানিকদার কথাটা গোপন করে গেছে।
পমপম ছাড়া পাবার পরেও কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে যায়নি। দলের অধিকাংশই এখন। জেলে, আর যারা পলাতক তাদের মধ্যে কতজন নিহত আর কে কে জীবিত তা জানার উপায় নেই। আর যারা সক্রিয় কর্মী না হলেও সিমপ্যাথাইজার ছিল, তারা কেউ আর সম্পর্ক রাখতে চায় না, ভয়ের চোটে দেখা হলেও না-চেনার ভান করে।
শুধু অলি গেছে পমপমের কাছে, প্রত্যেকদিন।
পিচ নেই, শুধু খোয়া ফেলা রাস্তা, রিকশাটা লাফাচ্ছে অনবরত, অলি পমপমকে চেপে ধরে আছে শক্ত করে। স্টেশন থেকে পমপমদের বাড়ি যে এতখানি দূর, তা আগেরবার মনেই হয়নি। অলির মনে পড়লো, আগেরবার তারা যখন এই রাস্তা দিয়ে ফিরছিল, তখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল বাবলুদা, তার ধারণা হয়েছিল, তার পায়ে সেপটিক হয়েছে!
একবার চোখ মেলে পমপম বললো, মানিকদাকে একটু খবর দিতে পারবি? কতদিন মানিকদাকে দেখিনি!
যে-অলি কোনোদিন মিথ্যে কথা বলতে পারে না, সে একটুও গলা না কাঁপিয়ে বললো, আমি এখান থেকেই কৃষ্ণনগর যাবো, যাবার পথে মানিকদার সঙ্গে দেখা করে যাবো।
পমপম অলির কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বললো, তুই একা একা কৃষ্ণনগর যাবি কী করে? এখানে দু’চারদিন থাক, আমি একটু শক্ত হলে আমিও তার সঙ্গে যাবো।
অলি বাচ্চা মেয়েকে সান্ত্বনা দেবার মতন করে বললো, না রে পমপম, তোর এখন যাওয়া চলবে না। তুই গেলে পুলিস ফলো করবে।
–আর তোকে কেন পুলিস ফলো করবে না?
–আমাকে তো কেউ চেনে না।
–হ্যাঁরে অলি, একটা সত্যি কথা বলবি? অতীন বেঁচে আছে? তোরা বলছিস, তাকে নাকি বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার বিশ্বাস হয় না। মানিকদাকে ছেড়ে অতীন বিদেশে পালিয়ে যাবে, আমার কিছুতেই বিশ্বাস হয় না।
–তার নামে যে মার্ডার চার্জ ছিল! সে যেতে চায়নি, তাকে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে থাকলে এতদিনে তাকে…
–কৌশিক আর অতীন কি এক জেলে ছিল?
–কৌশিক এখন আর জেলে নেই, জানিস না? ওরা জেল ভেঙে পালিয়েছে!
ধড়মড় করে পমপম নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞেস করলো, যাঁ, কী বললি? কে জেল ভেঙে পালিয়েছে, অতীন, না কৌশিক? কোন্ জেল? আগে বলিস নি কেন আমাকে?
কথাটা হঠাৎ বলে ফেলে অলি একটু বিব্রত হয়ে পড়লো। সে এরকম ভাবে ঠিক জানাতে চায় নি। পমপম বোধহয় খবরের কাগজও পড়ে না। খবরটা যে ঠিক কী ভাবে পমপমকে জানানো উচিত, তা অলি বুঝতে পারছে না।
সে বললো, আগে বাড়ি গিয়ে একটু বিশ্রাম নে, তারপর সব বলবো।
পমপম তীব্র গলায় ধমক দিয়ে বললো, না, এক্ষুনি বল! কৌশিক এখন কোথায়?
কৌশিক যে এখন কোথায়, তা অলি জানে না। দু’দিন আগে একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড ঘটে গেছে। দমদম জেলের মধ্যে কারারক্ষী ও নকশালপন্থী বন্দীদের মধ্যে মুখোমুখি একটা সংঘর্ষ, রীতিমত যুদ্ধের মতন। একতরফা ভাবে বিনা বিচারে নকশাল ছেলেদের মেরে ফেলার ঘটনা এটা নয়, সম্ভবত আগে থেকেই এরকম কিছু একটা আভাস পেয়ে নকশাল ছেলেরাও তৈরি হয়েছিল। গোলাগুলি চালিয়েছে দু’পক্ষই, সব শুদ্ধ নিহত হয়েছে পনেরো জন এবং সাতাশ। জন আহত, এর মধ্যে বেশ কয়েকজন কারারক্ষীও আছে। তবে কোন পক্ষে কতজন হতাহত, সে তথ্য জানায়নি সরকার। কিন্তু বত্রিশ জন বন্দী এই সুযোগে পালিয়েছে জেলের পাঁচিলের বাইরে।
দু সপ্তাহ আগে বহরমপুর জেল থেকে কৌশিকদের দলটাকে দমদম জেলে আনা হয়েছিল, সে খবর পেয়েছে অলি। কৌশিক নিশ্চয়ই পলাতকদের মধ্যে আছে। কৌশিক কিছুতেই মরতে পারে না, অলির দৃঢ় বিশ্বাস। যেন অলির প্রবল ইচ্ছাশক্তিতেই কৌশিক বেঁচে থাকবে।
দমদম জেলের ঐ ভয়াবহ খবর জানার পর অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছিল অলি। সেই কান্নার মধ্যেই সে বারবার বলেছিল না, না, কৌশিক কিছুতেই মরেনি, সে বেঁচে আছে, সে বেঁচে আছে!
কৌশিক, পমপম, মানিকদা, তপন এরা সবাই অতীনের জীবনের অঙ্গ। এদের কাছাকাছি এলেই অলি তার বাবলুদার সংস্পর্শ বোধ করে।
পমপমের ঠাকুর্দা এখনও বেঁচে আছেন, তবে চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পান না, কানেও কম শোনেন। পমপমের এক কাকা এখানকার চাষবাস দেখেন। আর রয়েছেন দু’জন বিধবা পিসিমা। কিছুদিন আগে এ বাড়িতে একবার পুলিসের হামলা হয়ে গেছে।
পমপমকে পৌঁছোতে এসে অলি পুরো দুটো দিন রয়ে গেল এখানে। পমপম তাকে ছাড়তে চায় না। অলিও অনুভব করলো, পমপম এখানে একা থাকবে কী করে? এ বাড়ির কারুর সঙ্গে তার আর মানসিক যোগাযোগ নেই; কাকিমা, পিসিমাদের সঙ্গে একটুক্ষণ কথা বলেই সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শরীর সারাবার জন্য পমপমের এখন বিশ্রাম নেওয়া খুবই দরকার, কিন্তু তার একজন সঙ্গী তো চাই।
অলির পক্ষেও এখানে বেশিদিন থাকার উপায় নেই। তারও যে অনেক কাজ!
মে মাসের সাঙ্ঘাতিক গরমেও খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘরের মধ্যে তেমন কষ্ট হয় না। চতুর্দিকে অনেক গাছপালা। দ্বিতীয়দিন বিকেলে বেশ একটা ঝড়ের দাপট দেখা দিল, তার সঙ্গে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি। সারাদিন শুয়েই থাকে পমপম, এই সময় সে অলির হাত ধরে ধরে দাওয়ায় এসে বসলো ঝড় দেখার জন্য। অলি যেন তার নার্স, সকালবেলা পমপমের মুখ ধুইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে তাকে দুধ খাওয়ানো, জোর করে ভাত খাওয়ানো, সবই অলি করে। অলি এর আগে কোনোদিন এভাবে কারুর সেবা করেনি, কিন্তু এ-সব যেন শিখতে হয় না, প্রয়োজনের সময় মানুষ সবই পারে।
পমপম এক সময় বললো, আমি একটু বৃষ্টিতে ভিজবো! দু-দুটো বছর বৃষ্টি দেখিনি।
এই দুর্বল শরীর নিয়ে পমপমের বৃষ্টি ভেজা উচিত কি না তা বুঝতে পারলো না অলি। কিন্তু দু বছর জেলে-হাসপাতালে কাটিয়ে সত্যিই তো বৃষ্টি দেখেনি পমপম। এ যে এক অপূরণীয়
পমপমকে সে উঠোনে নিয়ে আসতেই অন্য একটা ঘর থেকে একজন পিসিমা চেঁচিয়ে উঠলেন, ওমা, একী অলক্ষুণে কাণ্ড! এই অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজলে মরবি যে। ঘরে যা, ঘরে যা!
পমপম বললো, ওদের কথা শুনিসনি, অলি। চল, আমরা আমবাগানের দিকে যাই। ঝড়ের সময় গাছ থেকে কাঁচা আম খসে পড়ে, কতদিন সেই আম কুড়োইনি রে! চল।
অলির মনে হলো, বৃষ্টি ভিজলে পমপমের যেটুকু শারীরিক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা, তার চেয়েও তার এই বাসনা পূর্ণ করার মূল্য অনেক বেশি। পমপম যদি আর না বাঁচে!
আমবাগানে যাওয়া হলো না, তখুনি বাড়ির সামনে একটি জিপ এসে থামলো। প্রথমে সেই জিপ থেকে নামলো দু’জন বলিষ্ঠকায় পুরুষ, এই দু’জনকেই অলি দেখেছিল ট্রেনে আসবার সময়। তারা জিপের দু পাশে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখে নিল, তারপর নামলেন পমপমের বাবা। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, মুখে অন্যমনস্কতার ছাপ।
ঝড় থেমে গেছে, বৃষ্টি পড়ছে বড় বড় ফোঁটায়, ঠিক বর্ষার বৃষ্টি নয়, এ শুধু ভ্রাম্যমান মেঘের ছিটেফোঁটা দাক্ষিণ্য। তবে উত্তাপ অনেকটা কমে গেছে।
অশোক সেনগুপ্ত তাঁর মেয়ের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে বললেন, বৃষ্টি ভিজছিস? শরীরটা এখন একটু ভালো লাগছে বুঝি?
পমপম অলির হাত ছেড়ে দিয়ে নিজেই হেঁটে হেঁটে ফিরে গেল ঘরে।
একটু পরেই সেই ঘরে এলেন অশোক সেনগুপ্ত। পমপমের কপালে হাত দিয়ে তাপ দেখলেন। তারপর অলির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ব্যবহারে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি। আমি খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, তুমি ওদের পার্টির অ্যাকটিভিটির সঙ্গে জড়িত ছিলে না, তোমার কোনো পলিটিক্যাল ইনভলভমেন্ট নেই, তবু তুমি আমার মেয়ের জন্য এতটা করেছে, এটা সত্যিই আশ্চর্য ব্যাপার। তোমার ওপর পুলিসের নজর পড়তে পারে।
পমপম বললো, ও আমার বন্ধু।
অশোক সেনগুপ্ত বললেন, তা হতে পারে। কিন্তু বিপদের সময় কত বন্ধুই তো বন্ধুকে ছেড়ে যায়। তোদের স্টাডি সার্কেলে কত ছেলেমেয়েই তো ছিল, কই আর কেউ তো তোর খবর নিতে আসে না!
ঘরে একটিই বড় চৌকি, তার ওপর পাতলা তোষক পাতা বিছানা। আর একটি বেতের চেয়ার। সেই চেয়ারে বসে পড়ে তিনি অলিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সাপটাপের ভয়। নেই? আসবার সময় বুড়োশিবতলায় দেখলুম, ছেলেরা একটা সাপ মেরেছে। খুব সম্ভবত দাঁড়াস সাপ। এই সময়টায় খুব সাপের উপদ্রব হয়। এই ঘরটায়, এক সময় আমি থাকতুম। একদিন রাত্তিরবেলা দেখি আমার মশারির ওপর একটা সাপ, সেটা ছিল খরিস সাপ। তুই তখন। খুব ছোট ছিলি, তোর মনে আছে, পমপম! কত কাণ্ড করে সেটাকে মারা হলো।
পমপম জিজ্ঞেস করলো, বাবা, তুমি কি অলিকে ভয় দেখাতে এসেছো? তুমি অলিকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাও?
অশোক সেনগুপ্ত হাসলেন। তাঁর মুখোনি রেখাবহুল। চোখের নীচে গভীর কালো ছাপ। সচ্ছল পরিবারের সন্তান হলেও সারাজীবন তাঁকে অনেক দুভোর্গ সইতে হয়েছে। ছাত্র বয়েস থেকেই বাড়ির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব কম, এক সময় কংগ্রেসী ছিলেন, বেয়াল্লিশ সালে জেল খাটার সময়ে মার্ক্সবাদে দীক্ষা নেন। তারপর থেকে অনেকবার কারাবাস, পুলিসের নির্যাতন, অজ্ঞাতবাসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে বছরের পর বছর। কিন্তু তাঁর স্বভাবে তিক্ততা নেই, হাসতে পারেন যখন তখন।
হাসতে হাসতে তিনি বললেন, শুধু তোরাই আমাদের ভয় দেখাবি, আমরা কিছু বলতে পারবো না? তোর দলের ছেলেমেয়েরা আমাকে খুন করলে তুই খুশি হবি নাকি রে, পমপম?
পমপম কোনো উত্তর না দিয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো।
অশোক সেনগুপ্ত পাঞ্জাবির পকেট থেকে কিছু একটা বার করতে করতে বললেন, ফরোয়ার্ড ব্লকের অজিত বিশ্বাস কাল খুন হয়ে গেছেন। তারা শুনিসনি নিশ্চয়ই। যারা হেমন্ত বসুকে খুন করেছিল, এটা নিশ্চয়ই তাদেরই কাণ্ড। হেমন্তবাবুর জায়গায় অজিতবাবু ইলেকশানে। দাঁড়াচ্ছিলেন…এ সব কী পাগলামি হচ্ছে বল তো?
পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে তিনি ভাঁজ খুলে দেখালেন। একটা মাথার খুলি আঁকা লাল কালিতে চিঠি। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, অশোক সেনগুপ্ত, এবার তোমার পালা!
অলির মুখখানা বেদনায় কুঁকড়ে গেল, পমপমের মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। অশোক সেনগুপ্ত চিঠিখানা কুচি কুচি করে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন, যতসব ছেলেমানুষী! এই সব করে কী লাভ হচ্ছে বল তো? এই অকারণ খুনোখুনি, এর নাম মার্ক্সবাদ? এই শিখেছিস তোরা?
পমপম বললো, ওরকম চিঠি আমাদের দলের কেউ লেখে না!
অশোক সেনগুপ্ত বললেন, তোদের পার্টির নাম লেখা আছে, সেটা তো দেখলি? তা হলেই বুঝে দ্যাখ, একটা স্ট্রং পাটিবেস পর্যন্ত তোরা গড়ে তুলতে পারিসনি, এক একটা ইউনিট যা খুশি। তাই করছে, সেন্ট্রালি কোনো কনট্রোল নেই তাদের ওপর, তার আগেই তোরা বিপ্লবে নেমে পড়েছিস? বিপ্লব কি গাছের ফল? এক একটা দেশে মার্ক্সবাদের প্রয়োগ এক একরকম হবে। হতে বাধ্য। যে সব দেশে গণতন্ত্রের একটা কাঠামো অন্তত আছে, সেখানে বিপ্লব করা এত সহজ! সেখানে গণতান্ত্রিক পথেই আগে ক্ষমতা দখল করতে হয়, আমরা সেই পথেই এগোচ্ছি, তোরা সেটা বানচাল করে দিতে চাস, তার মানে তোরা যে প্রতিক্রিয়াশীলদেরই সাহায্য করছিস, তা তোরা বুঝতে পারিস না?
পমপম বললো, ক্ষমতা দখলের নামে তোমাদের ক্ষমতার মোহ পেয়ে বসেছে। পার্লামেন্ট-অ্যাসেম্বলিতে যাওয়াই এখন তোমাদের জীবনের চরম সার্থকতা, এখন কেউ বিপ্লবের কথা বললেই তোমরা ভয় পেয়ে যাও!।
–এসব তোদের মুখস্থ করা বুলি, পমপম। একজন দু’জনের মধ্যে ক্ষমতার মোহ এসে যেতে পারে, কেউ কেউ দুর্বল হয়ে যায়, তবু আমরা পার্টি থেকে ওয়াচ রাখি। কিন্তু দিন দিন আমাদের শক্তি বাড়ছে। অজয় মুখার্জির এই পাপেট সরকারের আয়ু কতদিন! এই সময়ে মার্ক্সবাদীদের মধ্যেই আত্মকলহ যে কত ক্ষতিকর…আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে, তোদের দলের দু’একজন চীনে পৌঁছে গিয়েছিল, সেখানে তো চৌ-এন লাইয়ের কাছে ওরা ধমক খেয়েছে। মাও সে তুং নাকি বলেছেন, কলকাতার দেওয়ালে চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান লিখতে কে বলেছে তোমাদের? আমি মোটেই তোমাদের চেয়ারম্যান নই! জানতুম, উনি এই রকম কথাই বলবেন!
–বাবা, এটা কি তোমাদের পার্টির রিপোর্ট, না সি আই এর রিপোর্ট?
–পমপম, তুই এতদিন জেলে ছিলি, জানিস না এর মধ্যে কত কী ঘটে গেছে। চারুবাবু অতি বিপ্লবীপনার থিয়োরি দিয়ে এতগুলো ভালো ভালো ছেলে-মেয়েকে কোথায় ঠেলে দিলেন? এখন তারা হয় মারছে অথবা মরছে। অথচ এ দুটোর কোনোটারই দরকার ছিল না। এই সময় এই হাজার হাজার ডেডিকেটেড ছেলে-মেয়েদের যদি আমাদের সঙ্গে পেতাম, চারুবাবু যদি আমাদের লাইনটা অ্যাকসেপট করতেন, তা হলে আমরা এতদিন কংগ্রেসকে কোথায় ঠেলে দিতুম!
–বিপ্লবের পথ ছাড়া আমরা কোনো পথই স্বীকার করি না। একবার যখন শুরু হয়ে গেছে।
-–তোরা যা শুরু করেছিলি, তা শেষ হতে আর দেরি নেই। এটা বিপ্লব, না রোমান্টিক অ্যাভভেঞ্চার? ইস্ট পাকিস্তানে যেরকম গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেছে, এখন সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট ওয়েস্ট বেঙ্গলে কোনোরকম বিশৃঙ্খলার প্রশ্রয় দেবে না। আমরা খবর পেয়েছি, শিগগিরই অজয় মুখার্জিকে সরিয়ে এখানে প্রেসিডেন্ট রুল হবে, তারপর আর্মি নামিয়ে দেবে। ডেবরা-গোপীবল্লভপুরে আমি মার্চ করাবে, ইস, আরও কত ছেলে-মেয়ে যে মরবে! দ্যাখ পমপম, মানিককে আমি কত ভালোবাসতুম একসময়, ছোটবেলা থেকে তাকে দেখছি, সেই মানিক তোদের ক্ষ্যাপালো-পাটির অনেকে আমাকে দোষ দেয়, আমি নিজের মেয়েকে কেন বোঝাতে পারিনি… মানিকের খবরটা শুনে আমি চোখের জল সামলাতে পারিনি, যতই মিসগাইডেড হোক, একসময় সে ছিল খুবই সিনসিয়ার ওয়ার্কার।
পমপম ঝট করে একবার অলির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, মানিকদা?
অলি কিছু বলতে পারলো না, মাথা নীচু করলো। অশোক সেনগুপ্ত ভুরু তুলে বললেন, মানিক মারা গেছে সে খবর পাসনি তোরা? সে তো বেশ কয়েক মাস আগে।
পমপম হঠাৎ এই খবর জেনেও কোনো আবেগ দেখালো না। বাবার সামনে সে কিছুতেই মচকাবে না। সে তাকিয়ে রইলো জানলার দিকে।
অশোক সেনগুপ্ত বললেন, অসুস্থ শরীর নিয়ে চারুবাবুও আর কতদিন পালিয়ে থাকতে পারবেন? তোদের পার্টি তছনছ হয়ে যেতে আর দেরি নেই। একটা আন্ডার গ্রাউন্ড পার্টি চালাতে গেলে যে কত নিখুঁত সংগঠনের দরকার হয়, তার কোন অভিজ্ঞতাই তোদর নেই। যেখানে সেখানে ইস্কুল বাড়ি পোড়ানো আর কনস্টেবল খুন, এই ধরনের আলট্রা লেফটিইজমের। প্রতিক্রিয়া কী হবে জানিস? চরম রাইট রিঅ্যাকশনারিরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। তোরা যাকে তাকে খুন করছিস, এবার তারাও এলোপাথারি খুন চালাবে। পুলিসকে ক্ষেপিয়েছিস, তারাও এখন কনফনট্রেশানের নামে মাঠের মধ্যে বন্দীদের ছেড়ে দিয়ে গুলি করে মারছে। ছি ছি ছি ছি, ইতিহাস থেকে তোরা কোনো শিক্ষাই নিতে পারিসনি!
পমপম বললো, বাবা, তুমি কি কলকাতা থেকে আজ এখানে এলে আমাকে এইসব কথা বলার জন্য?
–আমার কথা তুই শুনবি না, মানতে চাইবি না, এই তো? আমি এসেছি, কাল সকালে বর্ধমান টাউনে আমার একটা মিটিং আছে, রাত্তিরটা এখানে থেকে যাবো। আমার ওপর তোর এত রাগ কেন রে, পমপম?
–আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি একটু ঘুমোই?
–হ্যাঁ ঘুমো, বৃষ্টি ভিজেছিস, মাথাটা একটু মুছে নে। আমি এখানে আরও এলাম, তোর বন্ধু অলিকে একটা খবর দিতে।
তিনি অলির দিকে মুখ তুলে বললেন, তোমার বাবা বিমানবিহারীবাবু আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তুমি তো আমেরিকা যাচ্ছো? গতকাল তোমার ভিসা পাওয়া গেছে, তোমার বাবা বললেন, তোমার খুব তাড়াতাড়ি কলকাতায় ফিরে যাওয়া দরকার।
পমপম আবার বড় বড় চোখ মেলে তাকালো অলির দিকে। অলির মুখখানা লজ্জায় একেবারে নীল হয়ে গেছে। এই কথাটাও সে পমপমকে ঘুণাক্ষরে জানায়নি। পমপমের বাবা কি আড়ালে এই খবরটা দিতে পারতেন না।
পমপম বালিসে মাথা দিয়ে দেয়ালের দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। অশোক সেনগুপ্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি আর দেরি করো না, অলি, কালই কলকাতায় ফিরে যাও। পুলিস। তোমার পেছনে লাগলে পাসপোর্ট ইমপাউন্ড করে নিতে পারে। তুমি চলে গেলে, পমপম এখানে একা থাকবে? পমপম, তুই ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে থেকে আয় না কিছুদিন। তোর মাসি মেসো অনেক যত্ন করবে, ওখানকার ওয়েদারও ভালো।
পমপম অস্ফুট স্বরে বললো, না, আমি এখানেই থাকতে পারবো!
অশোক সেনগুপ্ত কাছে এসে পমপমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম গলায়, বললেন তোর দলের ছেলেরা যদি হঠাৎ আমায় খুন করে, তাতে তুই খুশি হবি কিনা, সে কথা তো বললি না খুকী?
এতক্ষণ বাদে পমপম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অশোক সেনগুপ্ত মেয়ের মাথায় হাত বুলোতে লাগলেন। তারপর আঙুল দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন, না রে, তুই ওসব কিছু ভাবিস না। আমার কিছু হবে না!
তিনি চলে যাবার পর অলি পমপমের গায়ে হাত রাখতেই সে একেবারে জোরে জোরে কেঁদে উঠলো। সেই কান্নার সঙ্গে সঙ্গে বলতে লাগলো, মানিকদা! মানিকদা!
একটু পরে সে ধড়ফড় করে উঠে বসে অলির হাত জড়িয়ে ধরে রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করলো, তুই কেন আমাকে মানিকদার খবর দিসনি? ভেবেছিলি আমি দুর্বল? সহ্য করতে পারবো না? আর কে কে মারা গেছেন, তুই বল! খবর্দার, মিথ্যে কথা বলবি না! অতীন, তপন, কৌশিক, সরোজ দত্ত, সুশীতল রায়চৌধুরী, জয়শ্রী, সন্তোষ, বল বল, সত্যি করে বল!
অলিও কাঁদছে। সে অসহায়ের মতন বললো, আমি সকলের খবর জানি না রে! সত্যি জানি না!
–তুই মানিকদার খবর তো আগে জানতিস?
–হ্যাঁ, তা জানতুম। আমার মামা ডাক্তার, তাঁর কাছ থেকে শুনেছি।
–কে মেরেছে মানিকদাকে? সি পি এম? কংগ্রেস?
–না, পুলিস। আমার মামাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল চিকিৎসার জন্য, কিন্তু মামা পৌঁছোবার আগেই…
–তুই আমার সঙ্গে সব সময় সেঁটে আছিস, তার মানে অতীন নেই, তাই না?
–না, না, বাবলুদা বিদেশে গেছে। পালিয়ে বেঁচে গেছে।
–আর কৌশিক?
–কৌশিকের খবর জানি না, তোকে সত্যি কথা বলছি, কোনো খারাপ খবর পাইনি। তারপর দু’জনে হাত ধরাধরি করে মানিকদার নাম করে কাঁদলো অনেকক্ষণ।
পরদিনও অলির কলকাতায় ফেরা হলো না। অশোক সেনগুপ্ত তাঁর মিটিং সেরে ফেরার পথে তাঁর জিপেই অলিকে কলকাতায় নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, অলি রাজি হয়নি। পমপম এমনই ভেঙে পড়েছে, যে তাকে ফেলে যাওয়া অলির পক্ষে অসম্ভব।
সেদিন রাত্তিরবেলা এসে উপস্থিত হলো সমীরণ আর ভানু নামে দুটি ছেলে। তখন রাত। প্রায় দুটো, বাইরে কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে খুব জোরে, সেই শব্দেই অলির ঘুম ভেঙে গেল, তারপর সে শুনলো জানলায় তিনটে টোকার শব্দ। পমপমের পাতলা ঘুম, সেও জেগে উঠেছে, সে মন দিয়ে সেই টোকার শব্দ একটুক্ষণ শুনেই বললো, অলি, দরজা খুলে দে, দরজা খুলে দে, আমাদের দলের ছেলে!
অলি শিউড়ে উঠলো। অশোক সেনগুপ্ত স্পষ্ট বলে গিয়েছিলেন, এ বাড়িতে পমপমের। দলের ছেলেদের আশ্রয় দেওয়া যাবে না। তাঁর লোক কি এ বাড়ির ওপর নজর রাখছে না? এক্ষুনি যদি মারামারি শুরু হয়ে যায়!
তবু তাকে দরজা খুলতেই হলো। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদুটি ভেতরে এসে নিজেরাই দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাতে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালো। একজনের হাতে রিভলভার, অন্যজনের হাতে পাইপ গান। এ ছেলে দুটিকে অলি চেনে না।
সমীরণ বললো, উঃ, আর একটু হলে কুকুরগুলোকেই গুলি করতে হতো। কতক্ষণ ধরে জানলায় ঠকঠক করছি, তোদের ঘুমই ভাঙে না!
পমপম বললো, তোরা কোথা থেকে এলি, সমীরণ? এই গ্রামটা তোদের পক্ষে একদম সেফ নয়!
ভানু বললো, আমরা এক্ষুনি চলে যাবো। পমপম, আমাদের কিছু টাকা লাগবে। কিছু ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?
পমপম বললো, বোস আগে, কোথা থেকে এসেছিস, কী ব্যাপার সব বল।
দরজায় হুড়কো দিয়ে ওরা দু’জনে বিছানার কাছে এসে বললো, বেশি দেরি করা যাবে না। হাতে একদম পয়সা নেই, খেতে পাচ্ছি না, ওষুধ কিনতে হবে। তুই কেমন আছিস পমপম? আজই বিকেলে খবর পেলুম যে তুই কলকাতা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে এসেছিস। আমরা কয়েকজন কাছাকাছিই আছি, জঙ্গলমহলে। কিছু টাকা জোগাড় করে দিতে পারবি না?
পমপম বললো, হাতে তো বিশেষ কিছু নেই। অলি, তোর কাছে কত আছে?
অলি বললো, একশো টাকার মতন।
ভানু বললো, ওতে কিছু হবে না, আমরা সাতজন আছি একসঙ্গে, অন্তত হাজারখানেক টাকা যদি এখন দিতে পারিস!
সমীরণ অলির দিকে তাকিয়ে বললো, কৌশিকের পায়ে গুলি লেগেছে। জেল থেকে পালাবার সময়, গুলিটা ঢুকে বসে আছে, অপারেশন করাতে না পারলে
এই অবস্থাতেও অলির বুক থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। এ যেন তার ইচ্ছাশক্তিরই জয়। কৌশিক বেঁচে আছে!
খানিকক্ষণ ওদের কাহিনী শোনার পর পমপম বললো, গ্রামের বাড়িতে তো টাকা পয়সা বিশেষ থাকে না। অলির কাছে আর আমার কাছে যা আছে, সব মিলিয়ে বড়জোর শ দেড়েক। আর একটা কাজ করা যায়, আমি তোদর কিছু জিনিস দিতে পারি, তা বিক্রি করলে অন্তত সাত-আটশো টাকা পাবি।
সমীরণ জিজ্ঞেস করলো, কী জিনিস? গয়না-টয়না বিক্রি করতে গেলেই ধরা পড়ে যাবো!
পমপম বললো, গয়না না। এ জিনিস খুব সহজে বিক্রি করা যায়, যে-কোনো মুদির দোকানে। তোরা একটু বোস, নিয়ে আসছি। আয় তো অলি
মিশমিশ করছে অন্ধকার রাত। সারা বাড়ি ঘুমন্ত। কোথা থেকে যেন গায়ে জোর পেয়ে গেছে পমপম, সে অন্ধকারের মধ্যেই বেশ জোরে জোরে হেঁটে উঠোনটা পেরিয়ে গেল। উল্টো দিকের একখানা ঘরে ওর ঠাকুর্দা থাকেন। দাওয়ায় ঘুমোয় বাড়ির একজন মুনিষ। ঠাকুর্দার কখন কী প্রয়োজন হয়, সেই জন্য দরজাটা খোলাই থাকে। সন্তর্পণে পা টিপে টিপে ঘুমন্ত লোকটির পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকে খাটের নীচে বসে পড়লো ওরা দু’জন। পমপম হাত বাড়িয়ে কয়েকটা কাপড়ের পোঁটলা টেনে বার করলো। সব মিলিয়ে চারটে। পোঁটলাগুলো বেশ ভারি।
সেগুলো নিয়ে আবার খুব সাবধানে ওরা নেমে এলো উঠোনে। অলি এখনও বুঝতে পারছে এই পোঁটলার মধ্যে কী আছে।
পমপম বললো, এগুলো সুপুরি। আমাদের বাগানের। সুপুরির খুব দাম, এগুলো বিক্রি করলে অনেক টাকা হবে।
সুপুরির কত দাম হতে পারে, সে বিষয়ে অলির কোনো ধারণাই নেই। তার খুব আফসোস হচ্ছে, সে কেন সঙ্গে বেশি টাকা আনেনি। বাবার কাছ থেকে সে প্রতিমাসে তিনশো টাকা হাত খরচ পায়।
উঠোনের মাঝখানে হঠাৎ নেমে গিয়ে ভয় পাওয়া গলায় পমপম বললো, কৌশিকের পায়ে গুলি লেগেছে ওরা বললো, পায়ে না লেগে পেটে কিংবা বুকে গুলি লেগে থাকে যদি? তা ওরা। কিছুতেই স্বীকার করবে না! অলি, কৌশিককে বাঁচাতেই হবে! আমি ওদের সঙ্গে যাবো, আমি কৌশিককে নিজের চোখে দেখতে চাই।
অলি বললো, তুই কী করে যাবি? ওরা বললো, জঙ্গলমহলে, পায়ে হেঁটে যেতে হবে অনেকখানি, তুই পারবি না, পমপম। বরং আমি যাই। যদি সেখানে কোনো কাজে লাগতে পারি…।
পমপম বললো, তুই যাবি? তার যে কলকাতায় ফেরা দরকার, তুই বিদেশে যাবি, না রে, অলি, তোর ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি ওদের বলছি, ওরা আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যাবে।
অলি জোর দিয়ে বললো, তুই গেলে, তুই বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে, আবার তোক নিয়েই বিপদে পড়ে যাবে ওরা। তার বদলে আমি যাবো। আমি কৌশিককে দেখে আসবো।
সিদ্ধান্ত নিতে একটুও দ্বিধা করলো না অলি। কৌশিক তার বাবলুদার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কৌশিক আহত হয়েছে শুনলে বাবলুদা কি এক্ষুনি ছুটে যেত না? বাবলুদা নেই, তাকেই যেতে হয়।