মহসিন হলে আমার সিঙ্গেল সিটের রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আমি জানালার দিকে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। জানালা বিশাল। শীতের হাওয়া আসছে। গায়ে চাদর দিয়েছি। চাদরের ওম ওম উষ্ণতা। আমার হাতে টমাস হার্ডির লেখা বই এ পেয়ার অব ব্লু আইজ। মূল ইংরেজি বই না, অনুবাদ। আমি মুগ্ধ হয়ে প্রেমের উপন্যাস পড়ছি।
হল ছাত্রশূন্য। প্রতিদিনই মিটিং মিছিল চলছে। রাস্তায় নামলেই মিছিলে ঢুকে যেতে হয়। দেড় দু’মাইল হাঁটা। মিছিলে হিংস্রভাব চলে এসেছে। পুলিশের পাশাপাশি নেমেছে ইপিআর। পুলিশ রাস্তায় থাকে। ইপিআর ট্রাকের ওপর। পুলিশের চোখে থাকে আতঙ্ক, পাশাপাশি ইপিআরদের দেখায় যমদূতের মতো। কী প্রয়োজন এইসব ঝামেলায় যাবার! আমি দু’টি নীল চোখ নিয়ে ভালোই তো আছি। ‘য পলায়তি স জীবিত’। যে পালিয়ে থাকে সে-ই বেঁচে থাকে। আমি পালিয়ে আছি। তবে খুব যে সুখে আছি তা না। আমার প্রচণ্ড চিন্তা আমার পুলিশ অফিসার বাবাকে নিয়ে। মানুষজন আধাপাগলের মতো হয়ে গেছে। পুলিশ দেখলেই ইট মারছে। ধাওয়া করছে।
একদিন ডাইনিং হলে খেতে বসেছি, আমার ঠিক সামনে বসা এক ছাত্র গল্প করছে—কী করে তারা দৌড়ে এক পুলিশ কনস্টেবলকে ধরে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দেয়। মাথা থেঁতলাবার আগে আগে সে নাকি বলছিল—বাবারা, আস্তে বাড়ি দিয়ো। আস্তে। গল্প শুনে আশেপাশের সবাই হেসে উঠল। আমি স্পষ্ট চোখের সামনে দেখলাম, আমার বাবার মাথা ইট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হচ্ছে। বাবা বলছেন, আস্তে মারো। আস্তে। আমি খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লাম।
জনতার আক্রোশ সরকারের দিকে। সরকারকে তারা হাতের কাছে পাচ্ছে। পাচ্ছে ঠোল্লা অর্থাৎ পুলিশকে। তাদের স্লোগানে আছে–একটা দুইটা ঠোন্না ধরো, সকাল বিকাল নাশতা করো।
‘৬৯ সনে ছাত্রজনতার ঘৃণা এবং রাগের কেন্দ্রবিন্দুর পুলিশরাই আবার মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকসেনার বিরুদ্ধে প্রথম অস্ত্রধারী। ইতিহাসের কী আশ্চর্য খেলা!
থাক এই প্রসঙ্গ, হলের গল্পে ফিরে যাই। এ পেয়ার অব ব্লু আইজ অনেকক্ষণ পড়া হয়েছে। এখন ব্যক্তিগত মিছিলে অংশ নেওয়া যায়। আমার ব্যক্তিগত মিছিল হলো, করিডরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাওয়া। এই হাঁটাহাঁটির সময় অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে ভালো লাগে। বয়সের কারণেই হয়তো আমার চিন্তায় একজন তরুণী থাকে। যে সারাক্ষণই আমার হাত ধরে থাকে। তরুণীর গা থেকে বালি বকুল ফুলের সৌরভ ভেসে আসে।
কল্পনার বকুলগন্ধা তরুণী পাশে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছি এমন সময় এক কাও—কানে এল ডিম ভাজার শব্দ। প্রতিটি রুম তালাবন্ধ। বাইরে থেকে তালা ঝুলছে। এর মধ্যে একটা ঘরের ভেতর ডিম ভাজা হচ্ছে, এর অর্থ কী? কানে কি ভুল শুনছি? যে রুম থেকে ডিম ভাজার শব্দ আসছে আমি তার সামনে দাঁড়ালাম। চামচের টুং টাং শব্দ। পায়ে হাঁটার শব্দ। আমি দরজায় টোকা দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সব শব্দের অবসান। কিছু রহস্য অবশ্যই আছে। রহস্যটা কী? আমি নিজের ঘরে ফিরে গেলাম। রহস্যের কিনারা করতে হবে। (পাঠক, মিসির আলির জন্মলগ্ন।) রহস্যের সমাধান করলাম। এখন সমাধানের ধাপগুলি বলি—
১. ওই ঘরে একজন বাস করে। তাকে লুকিয়ে রাখতে হয় বলেই বাইরে থেকে তালা দেওয়া।
২. সে ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে। ডিম ভাজার শব্দ তার প্রমাণ।
৩. সে বেশ কিছুদিন ধরেই ওই ঘরে আছে। ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে বাস করলে ডিম ভেজে খেত না।
৪. চামচের টুং টাং শব্দ থেকে মনে হয় সে একজন মেয়ে। মেয়েদের চামচের শব্দের ভঙ্গি আলাদা। পুরুষ জোরে শব্দ করে।
৫. তাকে কেউ আটকে রাখেনি। আমি দরজায় টোকা দিয়েছি, সে চুপ করে গেছে। বন্দি কেউ হলে নিজেকে ঘোষণা করত।
সন্ধ্যাবেলায় আমি গেলাম হাউস টিউটর অধ্যাপক ইমরানের কাছে। আমি তাকে ঘটনা খুলে বললাম। অধ্যাপক ইমরান চোখ কপালে তুলে বললেন, তোমার মাথা খারাপ। তুমি মাথার চিকিৎসা করাও।
আমি বললাম, জি আচ্ছা স্যার।
জি আচ্ছা না। কাল পরশুর মধ্যে ডাক্তার দেখাবে।
জি আচ্ছা স্যার।
ইমরান স্যার বললেন, পড়াশোনায় মন দাও। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তোমার মাথায় শয়তান কারখানা বানিয়েছে। যাও আমার সামনে থেকে বিদায়।
আমি বিদায় হলাম। রাত আটটায় ইমরান স্যার দু’জন অ্যাসিসটেন্ট হাউস টিউটর নিয়ে আমার ঘরে উপস্থিত। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, কোন ঘরে মেয়ে আটকে রাখা হয়েছে আমাকে দেখাও? যদি কিছু না পাওয়া যায় তোমাকে আমি ইউনিভার্সিটি থেকে তাড়াব।
রুমটা স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র আবু সুফিয়ানের। সে তার ঘরে ছিল। ইমরান স্যার দলবল নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, আমি রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। রুম খালি, রুমে কেউ নেই। আমার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল। কী সর্বনাশ!
সুফিয়ান বিস্মিত হয়ে বলল, স্যার কী ব্যাপার?
ইমরান স্যার বললেন, কোনো ব্যাপার না। রুটিন চেক। তুমি কি ঘরে ইলেকট্রিক হিটার ব্যবহার করো? ইলেকট্রিক হিটার দেখতে পাচ্ছি। হিটার জব্দ করা হলো। এখন নিব না। সকালে তুমি অফিসে জমা দিবে।
জি আচ্ছা স্যার।
পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে, নাকি মিটিং মিছিল নিয়ে আছ?
ঠিকমতো পড়ছি স্যার।
ইমরান স্যার উঠলেন। রুম থেকে বের হওয়ার সময় কাপড় রাখার কাবার্ড থেকে হঠাৎ কাচের চুড়ির টুং শব্দ পাওয়া গেল। ইমরান স্যার থমকে দাঁড়ালেন। কাবার্ড খুললেন। ষােল-সতেরো বছরের একজন তরুণী মাথা নিচু করে হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। তার চোখভর্তি পানি।
জানা গেল এই তরুণীকে সুফিয়ান বিয়ে করেছে। বিয়ে আত্মীয়স্বজন কেউ স্বীকার করেনি। মেয়েটির থাকার জায়গা নেই বলে সুফিয়ান তাকে হলে এনে তুলেছে। গত ছয় মাস ধরে সে এখানেই আছে। অমানবিক এক জীবনযাপন করছে। মেয়েটিকে পশুর এক জীবন থেকে আমি উদ্ধার করেছি এতে সন্দেহ নেই। আবার মেয়েটির স্বামীকে এই কারণেই কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে তাতেও সন্দেহ নেই।
মেধাবী এই ছাত্রকে গুরুতর অপরাধের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দু’বছরের জন্যে বহিষ্কার করে। সুফিয়ান দু’বছর পর আবার পড়াশোনায় ফিরে আসে। পড়াশোনা শেষ করে, দেশের বাইরে থেকে Ph.D ডিগ্রি এনে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করে।
আমার কাছে ‘৬৯-এর গণআন্দোলনের একটি দিক হলো বন্দিনী এক তরুণী।
হলের রিডিংরুমে দেশের সব কটা খবরের কাগজ আসে। আমি প্রতিটি খবরের নিবিষ্ট পাঠক। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি জানার জন্যে কাগজ পড়ি তা কিন্তু না। আমার প্রধান আকর্ষণ চন্দ্র অভিযান বিষয়ে। আমেরিকা চাদে মানুষ পাঠাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট কেনেডির স্বপ্ন পূরণের জন্যে আমেরিকা মরিয়া হয়ে উঠেছে। খবরের কাগজে রোজই কোনো-না-কোনো খবর ছাপা হয়। তৈরি হচ্ছে এপলো ১১, চন্দ্ৰতরীর নাম ইগল, পৃথিবী থেকে চাঁদে যেতে লাগবে চার দিন। নভোচারীদের একজনের নাম নীল আর্মস্ট্রং, তার পছন্দের খাবার ইতালির পিজা। তার বাচ্চা মেয়ে বাবাকে বলেছে—বাবা, চাঁদকে তুমি আমার হয়ে একটা চুমু দিবে। কেমন?
মজার মজার কত খবর। পড়লে অদ্ভুত লাগে। সত্যি সত্যি মানুষ দে পা দিবে। আমি দেখে যেতে পারব। আমি এত ভাগ্যবান?
চন্দ্র অভিযানের আনন্দময় খবরের পাশাপাশি ভয়ঙ্কর সব খবর। পড়লে দমবন্ধ হয়ে আসে। তবে মাঝে মাঝে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মতো ঘটনাও ঘটে। পহেলা ফেব্রুয়ারি এরকম এক ঘটনা ঘটল। আয়ুব খান বেতার ভাষণে বললেন, শীঘই আলাপ আলোচনার জন্যে আমি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিবর্গকে আমন্ত্রণ জানাব।
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কেমিস্ট্রির বইখাতা খুললাম। ধুলা ঝাড়লাম। সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। এখন কেমিস্ট্রির বইখাতা খোলা যেতে পারে।
পনের দিনের মাথায় ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক বন্দি অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন। সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়, বন্দি পালাতে যাচ্ছিল বলে তাকে গুলি করা হয়েছে। ঘটনা এখন ঘটলে বলা হতো ‘ক্রসফায়ার’। পাকিস্তান সরকারের মাথায় ক্রসফায়ারের বুদ্ধি আসেনি।
আবারও কেমিস্ট্রির বইখাতা বন্ধ। জমুক ধুলো কেমিস্ট্রির বইখাতায়।
১৬ ফেব্রুয়ারি খবর বের হলো, পিণ্ডিতে আয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডেকেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি শেখ মুজিবুর রহমান প্যারোলে মুক্তি নিয়ে সেই আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছেন।
আবার আমার স্বস্তির নিঃশ্বাস। যাক সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। এখন ভাসানী কোনো ঝামেলা না করলেই হলো। এই মানুষটা বাড়া ভাত নষ্ট করতে পারদর্শী। হে আল্লাহ, তাকে সুমতি দাও সব যেন ঠিক হয়ে যায়। দেশ শান্ত হোক। দেশ শান্ত হোক।
মাওলানা ভাসানীর সেই সময়ের কাণ্ডকারখানা আমার কাছে যথেষ্টই রহস্যময় মনে হচ্ছিল। আয়ুববিরোধী আন্দোলনে তিনি যাননি। আয়ুব খানের
(এর পরের একটা পেজ মিসিং আছে)
ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। একসময় মিছিলে ঢুকে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে ভয় কেটে গেল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছি। বুক ফুলিয়ে হাঁটছি। মিছিল শুরু হয়েছে পল্টন ময়দানে। শহিদ মতিয়ুরের জানাজা শেষের মিছিল। মিছিল কোনদিকে যাচ্ছে কোথায় যাচ্ছে কিছুই জানি না। মিছিলে লক্ষ লক্ষ মানুষ। আমি একসঙ্গে এত মানুষ জীবনে দেখিনি। মিছিল ইকবাল হলে শেষ হলো। সেখানে বক্তৃতা করেন শহিদ মতিয়ুরের বাবা। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এক মতিয়ুরকে হারিয়ে আমি হাজার মতিয়ুরকে পেয়েছি।
পুত্রহারা কোনো বাবার বক্তৃতা দেওয়ার মানসিকতা থাকার কথা না। তিনি দিতে পেরেছেন কারণ তিনি সত্যি সত্যি তার সামনে লক্ষ মতিয়ুরকে দেখেছিলেন।
মিটিং-এর পরপর চারদিকে নানান গণ্ডগোল হতে লাগল। পুলিশের গুলি, কাঁদানে গ্যাস। শুধু যে ঢাকায় গণ্ডগোল হচ্ছে তা-না। সারা পূর্বপাকিস্তানেই। গুজব রটল সেনাবাহিনী তলব করা হচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে কার্ফ দেওয়া হবে।
আনিস ভাই বললেন, হলে ফিরে যাবে?
আমি বললাম, না।
আমরা এক মিছিল থেকে আরেক মিছিলে ঘুরতে লাগলাম। মেয়েদের একটা মিছিল বের হয়েছিল। নেতৃত্বে ছিল ইডেন কলেজের মেয়েরা। তাদের ভাবভঙ্গি অত্যন্ত উগ্র। মেয়েদের মিছিল দুই ট্রাক ইপিআরের সামনে পড়ল। মেয়েদের একজন এগিয়ে গেল। কঠিন গলায় বলল, গুলি করতে চান? করুন গুলি। যদি সাহস থাকে গুলি করুন।
তরুণীর দৃপ্ত ভঙ্গি, কণ্ঠের বলিষ্ঠতা এখনো চোখে ভাসে।
সন্ধ্যার পরপর ঢাকা শহরে সত্যি সত্যি সেনাবাহিনী নামল। গভর্নর মোনায়েম খান বেতার এবং টেলিভিশনে ঘোষণা করলেন, বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করার জন্যে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছে। শহরের নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা শহরে কাফু জারি করা হয়েছে। পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত কার্টু বলবৎ থাকবে।
আমি হলে ফিরে এসেছি। বাইরের ঝড়ের জগৎ থেকে ব্যক্তিগত শান্তির জগতে। আমার হাতে টমাস হার্ডির প্রেমের উপন্যাস। আমি নীল নয়না এক তরুণীর দুঃখগাথা পড়ছি। আবেগে আমার চোখ ভিজে ভিজে উঠছে।