এ এক অপূর্ব আনন্দ। সমস্ত উত্তেজনা, উৎকণ্ঠায় সিটিয়ে থাকা নাৰ্ভগুলো আচমকা মোলায়েম হয়ে গেল। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রগুলো একের পর এক যখনই হাতে আসছিল তখনই একই অভিজ্ঞতা। সে সব জানে, সব। এই কয়েক মাস দিনরাত এবং পৃথিবী ভুলে জ্ঞানসমুদ্রের ঢেউগুলো ভাঙতে ভাঙতে যে দিশেহারা অবস্থায় পৌঁছেছিল তা উধাও হতে সময় লাগেনি। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর মনের মত করে লিখতে পারার যে আনন্দ তার সঙ্গে অন্য কোন সুখের তুলনা ওই মুহূর্তে তার মনে পড়েনি। প্রশ্নগুলো এত চেনা, উত্তরগুলো। এমন পরিচিত যেন সে চোখ বন্ধ করে এঘর থেকে ওঘরে হেঁটে যেতে পারল।
শেষ পরীক্ষার পর বাইরে বেরিয়ে এসে দীপাবলী প্রথম ক্লান্তিবোধ করল। এতদিন অথবা এই পরীক্ষার দিনগুলোতে তার মনে কখনও ক্লান্তি আসেনি। তার মনে পড়ল এখন আর কিছুই করার নেই। চাকরি নেই, পড়াশুনো নেই, কোন কিছুতে সে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারবে না। আর এটা মনে হওয়ামাত্র এতদিনের চাপা থাকা ক্লান্তি ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এই সময় রোজ বাড়িতে ফিরে গিয়েই পরের দিনের জন্য তৈরি হত সে। আজ তার প্রয়োজন নেই। নিজেকে একদম বিচ্ছিন্ন করে রাখায় পুরোন বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ তৈরি হয়নি। এই সময় মায়া অবথা সুদীপের বাড়িতে থাকার কথা নয়। ভরদুপুরে অকেজো লোকের সন্ধান পাওয়া মুশকিল। কিন্তু দীপাবলীর খুব ইচ্ছে করছিল কারো সঙ্গে কথা বলতে। খানিকক্ষণ আড্ডা দিতে। অথচ তেমন কেউ নেই এই কলকাতায়। এবং অবশ্যম্ভাবী যে নাম মাথায় এল আর ওখানে যেতে অনেক কুঠা। কুঠা না বলে অনিচ্ছাই বলা ভাল। হিসেব মত অমলকুমারের বিয়ে কয়েক মাস হয়ে গিয়েছে। বিবাহিত অমলকুমারের সঙ্গে আড্ডা মারতে যে মানসিকতা দরকার তা এখনও তার তৈরি হয়নি। মাসীমার সঙ্গে গিয়ে কথা বলা যায়। কিন্তু কি কথা বলবে সে? যে কোন বিষয়ই হবে ভাসা ভাসা, ওপর ওপর। এবং সেখানে ওঁর বউমা নিশ্চয়ই থাকবে। একটি অপরিচিতা মেয়ে যার চোখে শুধু কৌতূহল থাকবে তার সম্পর্কে, তাকে শত্ৰু ভাবার কোন কারণ নেই। শত্ৰু শব্দটি মনে আসতেই সে মাথা নাড়ল। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে নিজেকে ধিক্কার দিল। তার মন কি আজকাল খুব ছোট হয়ে যাচ্ছে। এরকম একটা ভাবনা সে ভাবতে পারল কি করে? অমলকুমারকে সে খুবই পছন্দ করেছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে এমন কথা হয়নি যে চুক্তিভঙ্গ করার অপরাধে সে অপমানিত হবে এবং এর স্ত্রী সম্পর্কে ঈর্ষান্বিত বোধ করবে। যা কিছু হয়েছে এবং সেই জন্য মনে কোন চাপ যদি এসে থাকে তবে সেটা একান্তভাবে তার নিজের সমস্যা। ওদের কোন সংযোগ নেই এর সঙ্গে। কিন্তু শব্দটা সে ভাবতে পারল কি করে? হ্যাঁ, এটা ঠিক, সে মহিলার সঙ্গে সচ্ছলে কথা বলতে পারবে না। যেখানে অস্বস্তি সেখানে না যাওয়াই ভাল।
দীপা!
ডাকটা কানে আসতেই মুখ ফিরিয়ে চমকে উঠল সে। কিন্তু সেটা লহমা মাত্র। তারপর হেসে ফেলল, আরে, তুমি! কেমন আছ?
যাক, চিনতে পারলে তাহলে!
না চেনার কিছু নেই। একটু স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে, এই যা।
অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ্য করছিলাম কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটছ। ডাকব কিনা বুঝতে পারছিলাম না।
আমি দেখতে পেলে দ্বিধা করতাম না।
তাই!
পরিচিত মানুষকে অনেক দিন বাদে দেখলে যদি কথা বলতে ইচ্ছে করে তাহলে ইতস্তত করব কেন? যাক, কেমন আছ বল? দীপাবলী সহজ গলায় জিজ্ঞাসা করল।
চলছে। তুমি এখানে কি করছিলে?
একটা পরীক্ষা দিতে এসেছিলাম। চাকরির।
চাকরি? তুমি তো চাকরি করছ বলে শুনেছিলাম।
ও। হ্যাঁ করতাম, কিন্তু ছেড়ে দিয়েছি।
দীপাবলী লক্ষ্য করছিল অসীম এখন পুরোপুরি ভদ্ৰলোক হয়ে গিয়েছে। সেই ছাত্ৰসুলভ ছেলেমানুষী যা স্বভাবের সঙ্গে চেহারায় জড়িয়ে থাকে তা আর নেই। ওর চোখে এখন পাতলা ফ্রেমের চশমা, শরীরেও ভারিক্কী ভাব, সু মানুষদের চেহারা যেমন হয়। এবং তখনই সে আবিষ্কার করল কোন কথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অসীমও কেমন জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কথার অভাবে। যে সময়টা কথা না বলে পার করল তারা তারপরে আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। আবার হুট করে চলে যাওয়া যাচ্ছে না। তবু দীপাবলী নিচু গলায় বলতে পারল, ঠিক আছে, চলি।
অসীমকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীপাবলী পা বাড়াল। আর তখনই অসীম বলে উঠল, দীপা, তোমার হাতে সময় আছে?
কেন? দীপাবলী মুখ ফেরাল।
আমি, আমরা কোথাও বসতে পারি না। এই, খানিকক্ষণ।
দীপাবলী দেখল অসীমের মুখ কোমল হয়ে গেছে। এবং সেটা মোটেই অভিনয় নয়। এক মুহূর্ত ভাবল সে। অসীম শত্ৰু নয়। বরং কলকাতায় আসার পর বন্ধু হিসেবে সে ওকেই প্রথমে পেয়েছিল। পরে তার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলা, কিছুটা নিচুতে নামায় সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অসীম তাকে কিছুটা ভাল সময় উপহার দিয়েছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। এখন অসীম সম্পর্কে কোন দুর্বলতা তার মনে অবশিষ্ট নেই। প্রথম যৌবনে সম্পূর্ণ অপরিচিত কোন পুরুষ যখন বন্ধুর মত পাশে এসে দাঁড়ায় তখন মন নরম হয়ই। অন্তত প্রথমবার জলপাইগুড়িতে যাওয়ার সময় সারারাতের ট্রেনে, গঙ্গার ওপর স্টিমারে মনে সেই ভাল লাগা জন্মেছিল। তবু সে এখন জিজ্ঞাসা না করে পারল না, তুমি কেন বসতে চাইছ অসীম?
এই সময়টুকু পেয়েই অসীম বোধ হয় দ্রুত নিজেকে ফিরে পেয়েছিল। সে শান্ত গলায় জবাব দিল, তোমার সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। এই ইচ্ছেটা কিন্তু অনেকদিনের। তোমার আপত্তি না থাকলে আমার খুব ভাল লাগবে।
মাথা দোলাল দীপাবলী, ঠিক আছে। এখন আমার বাড়িতে ফিরতে ভাল লাগছিল না। কথা বললে কিছুটা সময় কাটবে। কোথায় বসবে?
আমরা ফুরিসে বসতে পারি। পার্ক স্ট্রীট এখান থেকে বেশী দূরে নয়।
না, তার চেয়ে কলেজ স্ট্রীট কফি হাউসে চল। অনেকদিন ওখানে যাইনি।
যাইনি আমিও। কিন্তু সেখানে তো বাজারের আবহাওয়া।
এক সময় তো তুমিই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলে ওখানে। ঠিক আছে, তোমার জায়গায় যাওয়া যাক। অসীমের ইচ্ছেটাকে মেনে নিল দীপাবলী।
অসীম তাকে অনুসরণ করতে বলল। খানিকটা পিছিয়ে দীপাবলী দেখল রাস্তার পাশে পার্ক করা একটা গাড়ির দরজায় চাবি ঢোকাল অসীম। চমৎকার দেখতে ফিয়াট। ওপাশের দরজার লক্ খুলে গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে গিয়ে সেই দরজা টেনে ভদ্ৰভাবে দাঁড়াল অসীম। এটুকু দীপাবলী নিজেই করতে পারত কিন্তু এই মুহূর্তে ভাল লাগল। ইংরেজি ছবির পুরুষ চরিত্রদের সে মেয়েদের এইভাবে সৌজন্য দেখাতে দেখেছে। যে দেশের ছেলেরা একসঙ্গে রাস্তায় নেমে মেয়েদের দশ হাত পেছনে ফেলে হেঁটে যায় একই লক্ষ্যে সে দেশে এমন ব্যবহার নিশ্চয়ই আলাদাভাবে চোখে পড়ে।
অসীম গাড়ি ফার্স্ট গিয়ার থেকে সেকেন্ড গিয়ারে নিয়ে যাওয়ামাত্র দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, তুমি এখন কি করছ?
ব্যবসা। চামড়ার জিনিসপত্র বিদেশে এক্সপোর্ট করি।
সেই দিল্লির চাকরিটা নাওনি?
না। গাড়ি চালাতে চালাতে উত্তর দিল অসীম।
তোমার ব্যবসা মনে হচ্ছে ভালই চলছে?
কি করে বুঝলে? ও গাড়িটা দেখে! অসীম হাসল।
তা তো বটেই, তোমার চেহারাতেও তার প্রকাশ ঘটেছে।
সাদা বাংলায় বল মোটা হয়েছি। হ্যাঁ, আপাতত মন্দ চলছে না। বাঁধা খদ্দের। নিজের কারখানা আছে। ধারধোর করে শুরু করেছিলাম, সে সব শোধ দিতে পেরেছি।
অসীম হাসল, তুমি কিন্তু, দীপা, অনেক সুন্দর হয়েছ দেখতে।
খচ্ করে লাগল শব্দটা। তার সুন্দর হবার কোন অবকাশ ছিল না। না আছে মনের শান্তি, না স্বস্তি। গত কয়েক মাস যে পরিশ্রম করেছে তাতে শরীরের হাল মোটই সুবিধের নয়। এই অবস্থায় তাকে সুন্দর বলা মানে কথা খুঁজে না পাওয়া।
সে বলল, তুমি বোধহয় পাল্টানি।
মানে!
এখনও আগের মত কোন কথা মিন না করেই বলে ফেল।
বুঝলাম না।
আমাকে দেখে যদি তোমার সুন্দর বলে মনে হয় তাহলে বলতে হবে তুমি সৌন্দর্যের মানেই বোঝ না। একটুও উত্তেজিত না হয়ে কথাগুলো বলল দীপাবলী।
এই বোঝাটা ব্যক্তিবিশেষে তফাত হয়, হয় না?
তবু তার একটা সীমা থাকে।
তুমিও পাল্টাওনি। একই রকম অহঙ্কারী রয়ে গেলে।
দীপাবলী ঠোঁট কামড়ালো। তার মেজাজ চট করে খারাপ হয়ে গেল কথাটা শুনেই। এরা সবাই যখন তাকে অহঙ্কারী বলে তখন তাতে একটু তেতো মিশে থাকে। মুখ ফিরিয়ে জানলা দিয়ে ফুটপাত দেখল সে। কোন মতে নিজেকে সামলে নিল একসময়। কথা বলতে আর ভাল লাগছে না। এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে একই কথা আওড়াতে হবে।
মুখ ফিরিয়ে দীপাবলীকে দেখে অসীমও বুঝেছিল ব্যাপারটা। সের আর কথা না বলে নিঃশব্দে গাড়ি চালাতে লাগল। কিন্তু মাঝে মাঝে আড়চোখে দীপাবলীকে দেখার লোভ সংবরণ করতে পারল না। হঠাৎ দীপাবলী নড়েচড়ে বসল। তার মনে হল সে কেন। অসীমের সঙ্গে চা খেতে যাচ্ছে? যে কোন সিনেমা হলে ঢুকে সময় কাটাতে পারত। অসীম তার কাছে আলাদা গুরুত্ব পাবে কেন? যে কেউ চা খেতে বললে তার সঙ্গে চলে যেতে হবে।কিন্তু এখন গাড়ি থামাতে বলে নেমে গেলে খুব নাটকীয় হবে। অন্তত অসীমের শেষ কথার পর। হয়তো এই মনে হওয়াটাও ওই কথা শোনার প্রতিক্রিয়া।
মিডলটন রোডে গাড়ি পার্ক করে অসীম যে সহজ ভঙ্গিতে ফুরিসে ঢুকল তাতে বোঝা গেল এখানে তার নিয়মিত যাতায়াত আছে। মুখোমুখি বসার পর সে বেয়ারাকে বলল, আব্দুল, কি খাওয়াতে পার বল?
আব্দুল জবাব দেবার আগেই দীপাবলী বলল, আমি শুধু চা খাব।
হাত তুলল অসীম, শুধু চা কেন? এখানে যখন এসেছ তখন নিদেনপক্ষে প্যাস্ট্রি খাও। এদের প্যাস্ট্রি কলকাতার সেরা।
নাঃ, শুধু চা।
সেটাই আব্দুলকে আনতে বলে অসীম হাসল, আমার কথায় সেই যে রেগেছ এখনও তার কোন উপশম হল না। আগে হল তর্ক করতে।
এখন কিছু করার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছে।
বাঃ। এটা একটা পরিবর্তন। কলকাতায় কোথায় আছ?
মায়ার বাপের বাড়িতে ঘর ভাড়া করে আছি।
একা?
হাসল দীপাবলী, সেটাই তো আমার স্বভাব। তোমার খবর বল।
এই তো, ব্যবসা করছি।
বিয়ে করছে তো?
নাঃ।
এত জোর দিয়ে না বললে!
ইচ্ছে হয়নি বলব না, হয়েছে, কিন্তু করা হয়নি। আর বয়স তো খুব বেশী নয়।
এই প্ৰথম অসীমকে ভাল লাগল দীপাবলীর। সহজ কথাটা স্বাভাবিকভাবে বলতে পারায় মনে হল অসীমের সঙ্গে আড্ডা মারা যায়। পূর্বপরিচিতা মেয়ের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হলে বেশীর ভাগ ছেলেরা এই বিষয় নিয়ে কিছুটা নাটক করে। অসীম সেই জড়তা দেখাল না। সে বলল, এখানে তোমার নিয়মিত আসার অভ্যেস আছে, না?
হ্যাঁ, জায়গাটাকে আমার ভাল লাগে।
ভাল দীপাবলীরও লাগছিল। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত চায়ের দোকান। টেবিলে টেবিলে যারা বসে গল্প করছে তাদের গলার স্বর নিচুতেই। আদবকায়দা মানা ভদ্ৰ সভ্য মানুষেরা কোনরকম বেপরোয়া ছবি তৈরি করছেন না। ক্লান্তির পর এই নরম ঠাণ্ডায় বসতে খুব আরাম হচ্ছিল। একটা মেনুকার্ড টেবিলে রাখা ছিল। সেদিকে তাকাতেই চমকে উঠল দীপাবলী। চায়ের পট পাঁচ টাকা? তাও দুকাপের বেশী থাকবে না। কফি হাউসে এক কাপ কফি পঞ্চাশ পয়সায় পাওয়া যায়। বসন্ত কেবিনের চা আরও শস্তা। পকেটে কি পরিমাণ পয়সা থাকলে লোকে এখানে আসতে পারে। সে বিস্ময় প্রকাশ না করে পারল না।
অসীম বলল, আসলে এরা যে মানের চা দেয় তা মধ্যবিত্ত কোন রেস্টুরেন্টে পাবে না। যে আরামে বসে তুমি সময় কাটাচ্ছ তার জন্যেও তো একটা দাম দেওয়া উচিত। তুমি যদি আরাম করতে চাও তাহলে তার জন্যে উপযুক্ত দাম তো দিতেই হবে।
আমরা সাধারণ মানুষ, দাম দেখলেই চমকে উঠি।
আমি অসাধারণ নই কিন্তু, তবে একটু আরামে থাকার চেষ্টা করি। কেউ কেউ প্রচুর রোজগার করেন কিন্তু তাঁদের এমন অভ্যেস হয়ে যায় যে ইচ্ছে থাকলেও পয়সা খরচ করতে পারে না। যদি কখনও টাকা পকেটে না থাকে তাহলে এখানে আসব না কিন্তু তাই বলে আফসোসও করব না।
বাঃ, চমৎকার থিওরি তৈরি করে নিয়েছ তো। দীপাবলী হাসল, মনে হচ্ছে এর মধ্যেই তুমি সাফল্যের সুবিধেগুলো রপ্ত করে ফেলেছ। মদ খাও?
খাই না বললে মিথ্যে বলা হবে। তবে লোকে যেমন পায়েস খায় তেমনি আমি মদ খাই। অসীম চা আসছে দেখে একটু সরে বসল।
পায়েস খাওয়ার সঙ্গে মদের কি সম্পর্ক?
হাসল অসীম, বাঙালি পায়েস খায় জন্মদিনে আর শীত পড়লে। বাকি মাসগুলোতে সচরাচর কেউ পায়েস রাঁধে না। আমারও তেমনি বড় অর্ডার পেতে পার্টি দিলে বা তেমন কেউ নেমন্তন্ন করলে হাতে মদের গ্লাস তুলতেই হয়। কিন্তু মদ খাওয়ার পর নিজেকে স্বাভাবিক রাখার মধ্যে অদ্ভুত আনন্দ খুঁজে পাই। অবশ্য সেরকম ব্যাপার বছরে কয়েকবারই ঘটে।
আবার ভাল লাগল দীপার। আজ অবধি সে কাউকে বলতে শোনেনি যে সে মদ খায়। বাঙালির মদ লুকোবার সহজাত প্রবণতা আছে। যে শমিত অমন বেপরোয়া সে যখন নেখালিতে গিয়ে দিশি মদ গিলেছে তখন বোঝাই যায় কলকাতায় তার মদ খাওয়ার অভ্যেস ছিল। কিন্তু কখনই তার কথাবার্তায় সেটা আগে বুঝতে দেয়নি। হয়তো অসীম প্রচুর পরিমাণে খায়, নিজেকে ঢাকতে আগেভাগে স্বীকার করে ভদ্র সাজতে চাইছে। কিন্তু তাই বা কজন করে। আর তখনই তার চোখের সামনে অর্জুন নায়েকের মুখ ভেসে উঠল। সন্ধে নামলে যে লোকটা মদ ছাড়া থাকতে পারে না, মদ খাওয়ার ব্যাপারে যার কোন লাজলজ্জা নেই তাকে সে কোন পর্যায়ে ফেলবে? অর্জুনের চোখমুখের ওপর সুরার ছাপ পড়েছে। চোখের তলায় চর্বি জমেছে। সে হঠাৎ মুখ তুলে অসীমকে দেখল। অসীমের মুখের চামড়া টানটান, কোথাও সামান্য ভাঁজ নেই। অর্জুনের সঙ্গে ওর কোন মিল নেই। অসীম বলল, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি খুঁজছ?
স্বীকার করল দীপাবলী, আমি একজন মদ্যপায়ীকে চিনতাম। তার মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায় মদ কতখানি অধিকার করেছে। লোকটার অনেক দুনাম ছিল কিন্তু কখনই আমাকে অসম্মান করেনি। কারণটা আমি আজও বুঝতে পারি না।
তুমি কি বলতে চাইছ? হঠাৎ অসীমের গলা পাল্টে গেল। কানে যেতেই নিজের ভুল বুঝতে পারল দীপাবলী। সে চা ঢালতে লাগল কাপে, কি বলতে কি বলেছি। দোহাই, নিজেকে এর সঙ্গে জড়িয়ে ফেল না।
চা খাওয়া হল চুপচাপ। দাম মেটাল অসীম। তারপর বলল, তোমাকে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিতে আমার কোন অসুবিধে নেই। অবশ্য তোমার আপত্তি যদি না থাকে।
নাঃ, এই থাক। একদিনে অত আরাম সহ্য হবে না।
তোমার সঙ্গে আবার দেখা হতে পারে?
বাঃ, এক শহরে যতক্ষণ আছি ততক্ষণ তো হতেই পারে।
যতক্ষণ মানে? তোমার কি অন্য শহরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে?
কে বলতে পারে। চাকরিবাকরি নেই, যদি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হই যে-কোন চাকরি করতে, তাহলে ভারতবর্ষের যে-কোন জায়গায় চলে যেতে পারি।
দীপা–।
বলতে পার।
দীপা, তুমি বিয়ে করবে না?
মুখ নামাল দীপাবলী। তারপর এক ঝটকায় নিজেকে সোজা করল, করব না বলে এখনও ভাবিনি। আসলে এ নিয়ে ভাবার মত মানুষের দেখাই এখনও পেলাম না।
তুমি কি ঠিকঠাক কথা বলছ দীপা?
আমি অকারণে অসত্য বলি না।
কিন্তু তোমার ব্যবহারে একসময় অন্য কিছু প্রকাশ পেত।
ও। হ্যাঁ, সে একটা সময় ছিল। তখন ভাল লাগাটাকেই ভালবাসা বলে মনে হত। সেটা মানুষরে এমন একটা বয়স যখন বিচারশক্তি তৈরিই হয় না। তোমাকে ধন্যবাদ, তুমি নিজের অজান্তে বিপরীত আচরণ না করলে হয়তো ভুল বুঝতে পারতাম না।
ভুল বলছ দীপা?
অসীম, এখন এ নিয়ে কথা বলা মানে পোস্টমর্টেম করা। অতগুলো বছর চলে গিয়েছে, সব কিছু খুঁটিনাটি স্মৃতিতে নেইও। কি দরকার ওই প্রসঙ্গ টেনে আনার!
অসীম মাথা নাড়ল। তারপর বলল, চল, উঠি। তোমাকে পৌঁছে দিতে পারলে আমার ভাল লাগত। আমি গাড়িতে যাব আর তুমি ভিড় বাসে যাবে!
অসীম, তোমার তো এখন প্র্যাকটিক্যাল হওয়া উচিত। জীবনের সত্য স্বীকার করে নিতে এত সঙ্কোচ করছ কেন? আমার এখন যা অবস্থা তাতে বাসই তো স্বাভাবিক।
বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। বিদায় নেবার জন্যে অসীম দাঁড়াল, শোন, আমি আমার অতীতের আচরণের জন্যে ক্ষমা চাইতে পারি না। সেই অধিকারও আমার নেই। কিন্তু তোমাকে এটুকু বলতে পারি সেই আমি আর এই আমি এক নই। তাকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছি।
তুমি কি বলতে চাইছ?
তোমার মনে কি আমার জন্যে কোন ইমোশনাল ইনভলমেন্ট অবশিষ্ট নেই?
অসীমের মুখের দিকে তাকাল দীপাবলী, তারপর নীরবে মাথা নেড়ে না বলল।
অসীম মুখ নিচু করল। তারপর সেই অবস্থায় বলল, কিন্তু আমার আছে।
সেটা তোমার সমস্যা সমাধান তোমাকেই করতে হবে।
তুমি এত নিষ্ঠুর কেন?
নাঃ, আমি জীবন দেখেছি। অসীম, সেই তুমি আমার মানসিকতার নও।
মানলাম। কিন্তু এই আমি?
এখনকার তোমাকে তো আমি চিনিই না।
চিনতে তো অসুবিধে নেই।
তার জন্যে এফৰ্ট দিতে হয়।
তাই দাও।
হাসল দীপাবলী, আর যাই হোক, এই সম্পর্ক এফর্ট দিয়ে হয় না অসীম। স্বাভাবিকভাবেই আসে। ঠিক আছে, তুমি আমাকে পৌঁছে দিতে চাইছিলে, চল।
তুমি আমাকে অনুগ্ৰহ করছ?
বাঃ! তোমার গাড়িতে লিফট নেব, অনুগ্রহ তে তুমিই করছ।
অসীম ঘুরে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। পাশাপাশি বসে ওরা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে রইল। পার্ক স্ট্রীট পাড়ার হোটেল চত্বর ছাড়িয়ে নিরিবিলিতে আসার পর দীপাবলী বলল, বাঙ, কি সুন্দর জায়গা। এখানে যদি একটা ফ্ল্যাট পাওয়া যেত।
ফ্ল্যাট চাও? গাড়ি চালাতে চালাতে জিজ্ঞাসা করল অসীম।
হ্যাঁ। আছে সন্ধানে? বেশী টাকা দিতে পারব না কিন্তু আমার মত কুঁজোর অবশ্য চিৎ হয়ে শোওয়ার স্বপ্ন দেখাই উচিত নয়। তবু এসব জায়গা দেখলে ইচ্ছে হয়।
কিছু দূর যাওয়ার পর অসীম গাড়ি দাঁড় করাল একটা পাঁচতলা বাড়ির সামনে। ইশারায় বাড়িটাকে দেখিয়ে বলল, এই বাড়ির টপ ফ্লোরে আমার মাসতুতো দিদি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। জামাইবাবু আমেরিকায় থাকেন। সারা বছর ফ্ল্যাট তালাবন্ধ থাকে। উনি একজন কাউকে খুঁজছেন যিনি ভদ্র শিক্ষিত, কেয়ারটেকার হয়ে থাকবেন এবং আলো ও অন্যান্য বিলগুলো পে করবেন। আর ওঁরা যখন আসবেন তখন একটা ঘর ছাড়া বাকি ঘরগুলো ওঁদের জন্যে ছেড়ে দেবেন ছুটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত। এমন লোক পাওয়া খুব কঠিন। তুমি যদি এই প্রস্তাবে রাজি থাক তাহলে এখনই গিয়ে কথা বলতে পার। ওঁরা আগামী সপ্তাহে আমেরিকায় ফিরে যাচ্ছেন। একটানা বলে গেল অসীম।
কত ভাড়া দিতে হবে?
বললাম তো, ওঁরা কেয়ারটেকার চাইছেন। ভাড়া নয়, তার বদলে ফ্ল্যাটটাকে দেখাশোনা করতে হবে। ভাড়ার ঝামেলায় ওরা যেতে চান না।
তাহলে আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। একেবারে বিনা পয়সায় থাকলে হীনমন্যতায় ভুগব। তা ছাড়া, ওঁরা আমাকে চেনেন না, জানেন না, আমাকে ফ্ল্যাট দেবেন কেন?
আমি তোমার সম্পর্কে যতটুকু জানি ততটুকু বলব।
তুমি আমার এই কয় বছরের জীবনযাপন জানোনা। মাথা নাড়ল দীপাবলী, নাঃ, হল না একটু আরাম করে থাকা। চল।
তুমি কিন্তু মিছিমিছি ব্যাপারটাকে জটিল করে ফেলছ। ওঁদের সঙ্গে আলাপ হলে দেখবে তোমার ধারণা বদলে যাবে। অসীম দীপাবলীর দিকে ফিরল।
দ্যাখো, আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব টাকা, যদি ওরা নিতে রাজি থাকেন তাহলেই কথা বলা যেতে পারে। নইলে মনে হবে অন্যের দয়ায় আছি।
অসীম স্টিয়ারিং-এর দিকে ফিরল, তাহলে তো কিছুই করার নেই।
হাসল দীপাবলী, তা ছাড়া এভাবে ফ্ল্যাট নিলে আমি তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকব। আমার যদি ইচ্ছে হয় তবু তোমাকে বলতে পারব না ফ্ল্যাটে এসো না। এটা ঠিক নয়।
অসীম আর কথা বলল না। চুপচাপ ওরা কলকাতার উত্তরপ্রান্তে চলে এল। এইভাবে প্রত্যাখ্যান করে দীপাবলীর মন ভাল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এক সময় যে লোভ মাথা তুলেছিল সেটাও সত্যি। নিজেকে মাঝে মাঝে দুর্বোধ্য মনে হয়।
গলির মুখে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল সে; অসীম সেটা মান্য করে জিজ্ঞাসা করল, এখান থেকে কি অনেকটা হাঁটতে হবে?
দীপাবলী দেখল এর মধ্যে অনেকে তাদের দেখছে। চায়ের দোকানে ঢোকার কল্যাণে। সে এখনও পাড়ার লোকের কৌতূহলের বস্তু। তাড়াতাড়ি কথা শেষ করার জন্যে বলল, অল্পই।
সে যখন গাড়ি থেকে নামছে তখন অসীম বলল, একটা কথা বলি। তখন তুমি বলছিলে তোমার এই কয় বছরের জীবনযাপনের কথা আমি জানি না। ব্যাপারটা হচ্ছে আমি কতটা জানি তা তুমি জানোনা।
মানে? দরজা খুলে রেখেই ফিরে তাকাল দীপাবলী।
আমি জানতে চাইনি মানে এই নয় আমি জানি না। অসীম হাসল, আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছি। এতক্ষণ একসঙ্গে থাকলাম তবু তুমি আমার বাড়ি বা অফিসের হদিশ জানতে চাইলে না। স্পষ্ট বললে কোথাও আমার জন্যে জায়গা রাখনি। শুনতে নিশ্চয়ই একটুও ভাল লাগেনি আমার। তবু মেনে নিচ্ছি পাওনা বলেই মানছি। সে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে এগিয়ে ধরল, তুমি যদি এটা রাখো তাহলে খুশী হয়।
তোমার কার্ড?
আমার হদিশ। আচ্ছা চলি। দীপাবলী নেমে দরজা বন্ধ করতেই অসীম গাড়ি ঘুরিয়ে গতি বাড়িয়ে চলে গেল। দীপাবলী লক্ষ্য করল অসীম একবার ফিরে তাকাল না। কার্ডটাকে সে অন্যমনস্কভাবেই ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। হঠাৎ সেই ক্লান্তিটা ফিরে এল শরীরে। দীপাবলী ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে। তার মস্তিষ্ক এবং শরীর ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ছিল।
সিড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই সীমার সঙ্গে দেখা। দীপা হাসার চেষ্টা করল। মায়ার মা বললেন, তোমার আবার কি হল?
কিছু না তো! দীপাবলী সোজা হয়ে দাঁড়াল।
ততামুখ চোখ শুকনো লাগছে! এবার তো পরীক্ষা শেষ, এখন কিছুদিন আরাম করো। আর হ্যাঁ, ওপরে যাও, তিনি দুপুরবেলায় এসে বসে আছেন।
মায়া এসেছে? জিজ্ঞাসা করল বটে কিন্তু ভাল লাগল না উত্তরটা। এখন মায়া সঙ্গে থাকলে কথা বলে যাবে সমানে। তার কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছে না।
মাসীমা কাছে এগিয়ে এলেন, তুমি তো সব জানো। মায়া বলছে এখন থেকে এ বাড়িতে থেকেই অফিস করবে। আমি বিয়ের আগে পইপই করে নিষেধ করেছিলাম, তখন শুনলে আজ এ অবস্থা হত না। আমি যে কি করি! তুমি একটু ওকে বুঝিয়ে বল।
দীপা চুপচাপ ছাদের ঘরে চলে এল। তারই চেয়ারে বসে বই পড়ছে মায়া নিবিষ্ট হয়ে। এই মুহূর্তে ওকে দেখলে কেউ আন্দাজ করতে পারবে না যে, সুদীপকে অস্বীকার করে এসেছে। দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, কি রে, কি ব্যাপার?
মায়া মুখ তুলল, এই, এসে গেছি! মুজতবা আলির দেশে বিদেশেটা আবার পড়ছি, কি দারুণ লেখা।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু তোর খবর কি? দীপাবলী খাটে গিয়ে বসল।
ও, নিচেই রিপোর্ট পেয়ে গেছিল। মায়ার গলার স্বর পাল্টানো, হ্যাঁ, আর পারলাম না। এখন থেকে একা থাকব।
কি পাগলামি করছিস?
এতদিন পাগলামি করেছি এখন স্বাভাবিক হলাম। ওর সঙ্গে বাস করা যায় না।
হঠাৎ এই উপলব্ধি হল কেন?
দ্যাখ, দীপাবলী, আমি এ নিয়ে আর ভাবতে চাই না।
সুদীপকে জানিয়ে এসেছিস?
নিশ্চয়ই। অন্যায় কিছু করিনি যে চোরের মত চলে আসব। মায়া উঠে দাঁড়াল, আমি মন স্থির করে ফেলেছি। তুই যদি জীবনের প্রথম সরকারি চাকরি কিছুকাল করে সেটা ছেড়ে দিয়ে নতুন করে পরীক্ষায় বসতে পারি তাহলে আমিই বা কেন জীবনটাকে নতুন করে শুরু করতে পারব না? ভুল হলে সংশোধন করে নেওয়াই তো উচিত।
কিন্তু ভুলটা তুই ইচ্ছে করে করেছিলি।
ব্যস। আমি পুরোনো কথা ভুলতে চাই দীপা।
শমিত জানে?
মায়া থমকে গেল। তারপর বলল, হুঁ!
দীপাবলী মুখ ফিরিয়ে মায়াকে দেখল। মায়া চোখ সরিয়ে নিল। দীপাবলী নিচু গলায় বলল, মায়া, একটা ভুল সংশোধন করতে গিয়ে তুই আর একটা ভুল করছি।
মায়া জবাব দিল, ঠিক আছে, তাই যদি হয় দামটা আমিই দেব।
তুই এখনও শমিতের কথা ভাবছিস!
ভাবতে তো কোন অসুবিধে নেই। ওর কথা আমি ভুলতে পারব না।
কিন্তু শমিত বিবাহিত।
হোক না। আমি তো ওর সংসারে নাক গলাতে যাচ্ছি না।
তুই কি ওর দলে নাটক করতে যাচ্ছিস?
এখনও ভাবিনি। কিন্তু ঠিক করেছি ফিল্ম করব।
ফিল্ম। হ্যাঁ। এতদিন দলের কথা ভেবে ফিল্মে যেতে চাইনি। এখন তো সেসব বাধা রইল না।
দলে থেকেও তো শমিত ফিল্মে অভিনয় করছে।
পরিচালকরা যা খুশী করতে পারে, সাধারণ সদস্যদের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য ছিল না। যাক, আমার নাটকের অভিনয় দেখে কিছু প্রস্তাব এসেছে ফিল্মের জন্যে, এবার রাজি হব।
কিন্তু সুদীপকে ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলি কেন?
লোকটা অমানুষ। বাইরে প্রগতিবাদী, পড়াশুনা করা নাট্যকর্মী, আর ভেতরে, যখন একা থাকে তখন যত রকমের মেন্টাল টর্চার করা সম্ভব তাই আমার ওপর করে যায়। শমিতের সঙ্গে টেক্কা দিতে চায় ও এবং সে ব্যাপারে আমাকে ব্যবহার করেছে এতদিন।
মানে!
ওর ধারণা শমিতের কাছ থেকে আমাকে কেড়ে নিয়ে ও জিতে গেছে। আমি যেন একটা খেলার পুতুল! এই ভুলটা আমি ভেঙে দিতে চাই। মায়া দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে থামল, এ নিয়ে আর কথা বলিস না দীপা, আমার ভাল লাগছে না।
মায়া বেরিয়ে গেলে চুপচাপ শুয়ে রইল দীপাবলী। এখন যেন তার ক্লান্তি আরও বেড়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর মনে হল গলা শুকিয়ে আসছে, জিভ বিস্বাদ। যে মায়াকে দেখে কলকাতায় আসার পর সে স্বাধীনভাবে বাঁচার স্বপ্ন জোরালো করেছিল সেই মায়া আজ গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছে। জীবন কখনই একটা জায়গায় সমানভাবে বয়ে যায় না। যেসব মেয়েদের তাদের বাপমায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে সারা জীবন মুখ বন্ধ করে কাটাতে হয় তারা, আর নিজের ভুল নিজে সংশোধন করে আবার ভুলের মধ্যে জড়িয়ে যাওয়া মেয়েরা, কারা সুখী? কারা ভাল আছে? যারা ভালবেসে বিয়ে করে তাদের কজন শেষ পর্যন্ত ভালবাসা ধরে রাখতে পারে? দাম্পত্যজীবনে শুধু ভালবাসা নয় আরও কিছু চাই। একটা শেকড়ের ওপর গাছ দাঁড়িয়ে থাকে না, তাকে আরও শেকড়ের বাঁধন ছড়াতে হয়। মায়া আর অসীমের কি একই অবস্থা? অসীম যা বলে গেল তা যদি সত্যি হয়! দীপাবলী কেঁপে উঠল। না, আর নয়। সে ব্যাগ থেকে অসীমের কার্ড বের করে কুচি কুচি করল, করে নিশ্চিন্ত হল। অন্তত সেই সময়ে।
কয়েক মাস পরে সরকারি চিঠি এল। একা, ভীষণ একা দীপাবলী উত্তেজিত হাতে খাম খুলে পড়ল, তাকে দিল্লি যেতে হবে। পরীক্ষার ভাল ফলের সুবাদে বোর্ডের সামনে যেতে হবে ইন্টারভিউ-এর জন্য।