হীরুর খুব ইচ্ছা ছিল তার চায়ের দোকানের নাম রাখবে এ্যানা টি স্টল। এ্যানার কারণে তা হল না। এ্যানা কঠিন গলায় বলল, ফাজলামি করবে না তো। ফাজলামি করলে চড় খাবে। হীরু অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে বলল, চড় খাব মানে? এটা কী ধরনের কথা! ওয়াইফ হয়ে হাসবেন্ডকে চড় দেয়ার কথা বলছি। সান কী আজ পূর্বদিকে রাইজ করল?
হ্যাঁ, করল। চায়ের দোকানের কোনো নাম লাগবে না।
একটা দোকান দেব তার নাম থাকবে না?
না। পাঁচ পয়সা দামের দোকান তার আবার নাম।
পাঁচ পয়সা দামের দোকান মানে? নগদ চার হাজার সাতশ টাকা নিজের পকেট থেকে দিলাম।
নিজের পকেট থেকে তুমি একটা পয়সাও দাওনি। তিথি আপা টাকাটা দিয়েছে।
একই হল।
না একই হয়নি। এখন যাও–যথেষ্ট বকবক করেছ।
হীরু মন খারাপ করে বের হয়ে এল। তার এখন সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে এই মেয়েকে বিয়ে করে গ্রেট ভুল করা হয়েছে। এই মেয়ে তার জীবনটা ভাজা ভাজা করে ফেলবে। দিনরাত ঝগড়া করবে। ঘরের চালে কাক-পক্ষী বসতে দেবে না।
মিনুর সঙ্গে এ্যানার বড় রকমের একটা ঝগড়া হয়ে গেল। তিন দিন না পেরুবার আগেই। এ্যানা রান্নাঘরে ভাত বসিয়েছে। মিনু বললেন–কী করছ?
ভাত বসিয়েছি। তোমাকে ভাত বসাতে বলেছি? না, বলেননি। বলতে হবে কেন? আপনার কী ধারণা আমি ভাত রাঁধতে জানি না?
মিনু স্তম্ভিত গলায় বললেন, এ রকম করে কথা বলা তোমাকে কে শিখিয়েছে?
কেউ শেখায়নি। ভাত বসিয়েছি তা নিয়ে আপনিই বা এত হৈচৈ করছেন কেন?
মিনু চাপা গলায় বললেন, তুমি তো ভয়ংকর বদ মেয়ে।
এ্যানা সহজ স্বরে বলল, আমি বদ মেয়ে না। আপনার ছেলেটা বদ। আপনার ছেলের ভাগ্য ভাল যে আমি তাকে বিয়ে করেছি।
মেয়েটির গালে প্রচণ্ড একটা বড় চড় কষিয়ে দেবার ইচ্ছা মিনু অনেক কষ্টে দমন করলেন। নতুন বউয়ের গায়ে এত তাড়াতাড়ি হাত তোলা ঠিক হবে না। তাছাড়া ছেলের বউকে শায়েস্তা করতে হয় ছেলেকে দিয়ে। তিনিও তাই করবেন।
জালালুদ্দিন এ্যানাকে বেশ পছন্দ করলেন। তেজী মেয়ে। এই সংসারের জন্যে এ রকম তেজী মেয়েই দরকার। মেয়েটির সঙ্গে খাতির রাখলে ভবিষ্যতে সুবিধা হবে–এই ধারণা নিয়ে তিনি ভাব জমানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন। মধুর স্বরে যখন-তখন ডাকেন–মা এ্যানা, একটু শুনে যাও তো। এ্যানা সঙ্গে সঙ্গে এসে পুরুষালী গলায় বলে, কী জন্যে ডাকছেন?
এমনি ডাকাছি মা। এমনি। গল্প করি।
কী গল্প করবেন?
সুখ-দুঃখের গল্প।
গল্প শুনতে আমার ভাল লাগে না। চা খেতে চাইলে বলুন চা এনে দিচ্ছি।
আচ্ছা দাও, তাই দাও। চোখ দু’টা যাওয়ায় একেবারে অচল হয়ে পড়েছি। চিকিৎসাও হচ্ছে না।
চিকিৎসা হচ্ছে না কেন?
কে করাবে চিকিৎসা?
কেন–আপনার ছেলে করাবে।
আমার ছেলে আমার চিকিৎসা করাবে?
আপনার ছেলে আপনার চিকিৎসা করাবে না তো বাইরের মানুষে চিকিৎসা করাবে? এই সংসারের মানুষ তুমি চিন না মা। এই সংসারের মানুষগুলি কেমন তোমাকে বলি…
জালালুদ্দিন বিমলানন্দ ভোগ করছেন। সংসারের মানুষ চিনিয়ে দেবার দায়িত্ব খুব সহজ দায়িত্ব নয়। মনোযোগী শ্রোতার সঙ্গে দার্শনিক কথাবার্তা বলতে তার ভাল লাগে। এই মেয়েটার মনোযোগী শ্রোতা হবার সম্ভাবনা আছে।
সংসারে মানুষ থাকে তিন রকমের–অগ্নি-মানুষ, মাটি-মানুষ আর জল-মানুষ। অমানুষও থাকে তিন পদের… জালালুদিনের হঠাৎ সন্দেহ হল সামনে কেউ নেই। মানুষ কয় প্রকার ও কী কী এই প্রসঙ্গ বন্ধ রেখে মৃদু স্বরে ডাকলেন–মা কোথায় গো? মা কোথায়? মার জবাব পাওয়া গেল না। মা চা বানাতে গেছে। শ্বশুরের দার্শনিক কথাবার্তায় তার কোনো আগ্রহ নেই।
বাবা চা নিন।
জালালুদ্দিন গম্ভীর মুখে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিলেন। চায়ে চুমুক দিলেন–চমৎকার চা, কিন্তু তার গভীর মুখভঙ্গির বদল হল না। এ্যানাকে তিনি বুঝতে পারছেন না। কাউকে বুঝতে না পারলে অস্বস্তি লেগে থাকে। কে জানে এই মেয়েটা ঘর ভাঙনি মেয়ে কি-না। ঘর যদি ভেঙে দেয় তাহলে তিনি যাবেন কোথায়? তাঁর এই বয়সে, শরীরের এই অবস্থায় একটি শক্ত আশ্রয় প্রয়োজন। চা তার বিস্বাদ মনে হল।
হীরুর ইচ্ছা ছিল তার চায়ের দোকানের প্রথম চা খাওয়াবে পীর সাহেবকে। তাকে হাতেপায়ে ধরে নিয়ে আসবে। এতে দোকানের একটা পারলিসিটিও হবে। এত বড় পীর এসে চা খেয়ে গিয়েছে কম কথা না। পীর সাহেব আসতে রাজি হলেন না। তবে চায়ের বিশাল কেতলিতে ফুঁ দিয়ে দিলেন। বললেন, এতেই কাজ হবে। হীরু বিশেষ ভরসা পেল না।
জুন মাসের তিন তারিখ ভোর ছ’টায় তার চায়ের দোকান চালু হল। চা, পরোটা, সবজি ভাজি এবং ডাল এই তিন আইটেম। পরোটা, ভাজি এবং ডালের জন্য একজন কারিগর রাখা হল। কারিগরের নাম–মজনু মিয়া। কারিগরের দেশ ফরিদপুর। বয়স পঞ্চাশ। ছোটখাটো মানুষ, কথা বলে ফিসফিস করে এবং সেই সব কথার বেশির ভাগই বোঝা যায় না। কারিগরের বা হাতটা আচল। সেই অচল হাত শুকিয়ে দড়ির মত হয়ে আছে। শরীরের অনাবশ্যক অঙ্গ হিসেবে হাতটা কাঁধের সঙ্গে ঝুলতে থাকে। একটি সচল হাত কারিগর মজনু মিয়ার জন্যে যথেষ্ট। এই হাতে অতি দ্রুতগতিতে সে পরোটা ভাজে। সেই দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো দৃশ্য।
মজনু মিয়া নামকরা কারিগর। তাকে নিয়ে যে কটা রেস্টুরেন্ট শুরু হয়েছে সব ক’টা টিকে গেছে। রমরমা বিজনেস করছে। মজনু মিয়ার নিয়ম হল–কোনো রেস্টুরেন্ট যখন টিকে যায় তখন সে সরে পড়ে। রেস্টুরেন্ট বড় হওয়া মানে নতুন নতুন কারিগরের নিযুক্তি। নতুনদের সঙ্গে তার বনে না। সে কাজ করতে চায় একা। কাজের সময় সে কারো দিকে তাকায় না, কথা বলে না, হ্যাঁ-ই পর্যন্ত না। কাজের সময় সে শুধু ভাবে। ভাবে নিজের একটা রেস্টটুরেন্ট হয়েছে। গমগম করছে রেস্টটুরেন্ট। কাস্টমার আসছে যাচ্ছে। পরোটা ভেজে সে কুল পাচ্ছে না। এই স্বপ্ন সে গত ত্ৰিশ বছরে ধরে দেখছে। আজ সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার মতো ক্ষমতা তার আছে। ত্ৰিশ বছর সে কম টাকা জমায়নি। টাকা না জমিয়েই বা কী করবে? টাকা খরচের তার জায়গা কোথায়? আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউ নেই। থাকার আলাদা ঘর। এই জীবনে করা হয়নি। যে রেস্টটুরেন্টে কাজ করেছে সেই রেস্টুরেন্টর বেঞ্চিতেই রাত কাটিয়েছে। নিজের একটি ঘরের প্রয়োজন সে ত্ৰিশ বছর। আগেও বোধ করেনি। আজো করে না।
রেস্টুরেন্ট চালুর দিনে হীরু অসম্ভব উত্তেজনা বোধ করল। তার মনে হচ্ছে কানের পাশ দিয়ে ভো-ভো করে গরম হাওয়া বের হচ্ছে। এই গরম হওয়া শরীরের ভেতরই তৈরি হচ্ছে কিন্তু বের হচ্ছে কোন পথে তা সে ধরতে পারছে না। বুকে হপিণ্ড বেশ শব্দ করেই লাফাচ্ছে। তার হাটের কোনো অসুখ আছে কী-না কে জানে। সম্ভবত আছে। আগে ধরা পড়েনি। এখন ধরা পড়ছে। পীর সাহেব বলে দিয়েছেন, প্রতিদিন দোকান খোলার আগে তিনবার সুরা ফাতেহা এবং তিনবার দরুদ শরীফ পড়তে। লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে হীরুর কোনো দরুদ শরীফ মুখস্থ নেই। ভেবেছিল একটা নামাজ শিক্ষা এনে রাখবে। নামাজ শিক্ষায় সব দোয়া-দরুদ বাংলায় লেখা থাকে। দেখে দেখে তিনবার পড়ে ফেললেই হবে। কিন্তু নানান ঝামেলায় নামাজ শিক্ষা কেনা হয়নি। বিরাট খুঁত রয়ে গেল। হীরু খুবই বিষণু বোধ করল। তার বিষগ্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হল না। প্রথম দিনেই রেস্টুরেন্ট জমে গেল। কারিগর মজনু মিয়ার ভাজি এবং পরোটা দুইই অতি চমৎকার হল। ভাজির রঙ লালাভ, একটু টকটক এবং প্রচণ্ড ঝাল। শুধু খেতেই ইচ্ছা করে। মজনু মিয়া কিছু একটা দিয়েছে সেখানে–কী কে জানে। হীরুর মনে হল ভাজির রান্নার গোপন কৌশল শিখে রাখা দরকার। না শিখে রাখলে পরে সমস্যা হবে। মজনু মিয়া যদি দোকান ছেড়ে যায় তাহলে সে একেবারে পথে বসবে। তার রেস্টটুরেন্টে তখন কেউ থুথু ফেলতেও আসবে না।
টুকু অরুকে নিয়ে বের হয়েছে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিছুই বলছে না। কযেকবার জিজ্ঞেস করেও অরু কোনো জবাব পায়নি। টুকু শুধু বলেছে চল না। যাই।
অরু সুতির একটা শাড়ি পরেছে। সাধারণ শাড়ি, কিন্তু কোনো বিচিত্র কারণে এই সাধারণ শাড়িটি তাকে খুব মানিয়ে গেছে। তাকে দেখাচ্ছে কিশোরী একটি মেয়ের মতো। যে মেয়ের চোখে পৃথিবী তার রহস্য ও আনন্দের জানালা একটি একটি করে খুলতে শুরু করেছে।
টুকু বলল, এইখানে একটু দাঁড়াও আপা। একতলা সাদা রঙের একটা দালানের সামনে অরু দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সামনের জায়গাটা ফুলের গাছে ভর্তি। নিকেলের চশমা পরা বৃদ্ধ একজন ভদ্রলোক বাগানে কাজ করছেন। আরু বলল, এটা কার বাড়ি?
ওসমান সাহেবের বাড়ি।
এই বাড়িতে কী?
আছে একটা ব্যাপার। তুমি দাঁড়াও। আমি উনার সঙ্গে কথা বলে আসি।
ব্যাপারটা কী তুই আমাকে বলবি না?
একটা চাকরির ব্যাপার। তোমার একটা চাকরি হয়। কী-না দেখি।
তুই আমার চাকরি জোগাড় করে দিবি?
না, আমি দেব কিভাবে? বজলু ভাই চেষ্টা-চরিত্র করছেন।
বজলু ভাইটা কে?
তুমি চিনবে না, গ্রিন বয়েজ ক্লাবের সেক্রেটারি। বজলু ভাইয়ের এখানে থাকার কথা। দাঁড়াও, আমি খোঁজ নিয়ে আসি। বজলু ভাই এসে চলে গেলেন। কী-না কে জানে।
অরু দাঁড়িয়ে রইল। সুন্দর একটা বাড়ির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার এক ধরনের লজ্জা আছে। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার মানে এই সুন্দর বাড়ির ভেতরে ঢোকার অনুমতি তার নেই। সে বাইরের একজন। অরু দেখল। বুড়ো ভদ্রলোক নিজের মনে কাজ করছেন। টুকু হাত কচলে কচলে কী-সব বলছে। টুকুর ভঙ্গি বিনীত প্রার্থনার ভঙ্গি। অভাব দুঃখ-দুৰ্দশার কথা বলছে বোধ হয়। অরুর খুব লজ্জা লাগছে। কী আশ্চর্য, ভদ্রলোক একবার মুখ তুলে তাকাচ্ছেনও না। কী হয় একবার তাকালে? একটা মানুষ নিশ্চয়ই বাগানের গাছগুলির চেয়েও তুচ্ছ না।
টুকু ফিরে এল। তার মুখ লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেছে। ছোট ছোট নিঃশ্বাস ফেলছে। কী কথা হয়েছে কে জানে। অরু বলল, চল যাই। টুকু বলল, আচ্ছা চল শুধু শুধু আসলাম।
অরু বলল, তোকে অপমান করেনি তো?
আরে না। অপমান করবে। কী। খুব যারা বড় মানুষ তারা কাউকে অপমান করে না। তারা খুব মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলে। অভাবী মানুষদের কথা শুনলে আবেগে আপুত হয়ে যায়। তখনি আমার রাগ লাগে। অসম্ভব রাগ লাগে।
তোকে দেখে কিন্তু মনে হয় না তোর শরীরে রাগ আছে। তোর চেহারাটা কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা।
টুকু হঠাৎ গলার স্বর খাদে নামিয়ে ফেলে বলল, তুমি কোনো রকম চিন্তা করবে না আপা, বজলু ভাই একটা ব্যবস্থা করবেই। খুব ছোটাছুটি করছে।
তোর বজলু ভাইয়ের হাতে বুঝি অনেক চাকরি?
না। বজলু ভাই আমাদের মতই গরিব মানুষ। তবে অন্য গরিবের জন্যে খুব ছোটাছুটি করতে পারে।
কেন ছোটাছুটি করে?
জানি না। ছোটাছুটি করতে বোধ হয়। ভাল লাগে।
একটা রিকশা নে টুকু, আর হাঁটতে পারছি না। আমার কাছে টাকা আছে।
টুকু রিকশা নিল; অরু বলল, ফেরার পথে হীরুর রেস্টুরেন্ট দেখে যাই চল।
টুকুর রেস্টুরেন্টে যাবার কোনো ইচ্ছা নেই। সে ক’দিন ধরেই হীরুকে এড়িয়ে চলছে। কারণ হীরু চায় টুকু ক্যাশে এসে বসুক। হীরু হচ্ছে দোকানের মালিক তাকে তো সারাক্ষণ ক্যাশ বাক্স নিয়ে বসে থাকলে চলে না। ক্যাশে বসবে টুকু। সে হবে ম্যানেজার। রেস্টুরেন্টর ম্যানেজার। খুব সহজ ব্যাপার তো না। এই বাজারে ম্যানেজারি পাওয়া আর বাঘের দুধ পাওয়া এক কথা। টুকু রাজি হয় না। তার ভাল লাগে পথে পথে ঘুরতে!
হীরু ক্যাশে বসে ছিল। টুকুদের নামতে দেখে অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেল। এই প্রথম নিজের লোক রেস্টুরেন্ট দেখতে আসছে। এ্যানা বা তিথি এখনো আসেনি। বাসায় কারো মনে হচ্ছে কোনো আগ্রহ নেই। যাক তবু দু’জন এল।
অরু বলল, হীরু তোর কাজকর্ম দেখতে এলাম। বাহ সুন্দর তো। হীরুর মনটা ভাল হয়ে গেল। চারদিকে সবুজ কাগজ সেঁটে দোকানটাকে সে মন্দ সাজায়নি? টেবিলে ধবধবে সাদা ওয়াল ক্লথ। তিন দিকের দেয়ালে ক্যালেন্ডার থেকে সুন্দর সুন্দর ছবি কেটে বসানো হয়েছে। তার সীমিত সাধ্যে যতটুকু সম্ভব সে করেছে। হীরু বলল, গরিব মানুষের রেস্টুরেন্ট আপা। দেখার কিছু নেই। কেবিনে চলে যাও। কেবিনে বসে চা খাও। এই এক নম্বর কেবিনে দু’টা চা দে। কাপ গরম পানি দিয়ে ধুয়ে আনবি।
কেবিনও আছে না-কী?
থাকবে না! কী বল তুমি! মেয়েছেলের জন্যে দু’টা কেবিন। এক নম্বর কেবিন আর দুনম্বর কেবিন।
চা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না?
পরোটা-ভাজি আর ডাল আছে। আগামী সপ্তাহ থেকে দুপুরে তেহারি হবে। ফুল প্লেট দশ, হাফ প্লেট ছ’টাকা। তেহারির সঙ্গে সালাদ ফ্রি।
অরু এবং টুকু চা খেল। কেবিন অরুর খুব পছন্দ হল। পর্দা টেনে দিলেই নিজদের ছোট্ট আলাদা একটা জগৎ। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল। তার যদি সত্যি কোনোদিন চাকরি-টাকরি হয় তাহলে সে প্রায়ই কোনো বন্ধু-বান্ধব জোগাড় করে এই রেস্টটুরেন্টের কেবিনে বসে চা খেতে খেতে গল্প করবে। সুখ-দুঃখের একান্ত কিছু গল্প।
অরুরা চলে যাবার সময় হীরু বলল, চায়ের দাম দিয়ে যাও আপা। ফ্রির কোনো কারবারই নেই। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সবার নগদ পয়সা দিতে হবে। রাগ কর বা না করি–এটা হল ব্যবসা।
অরু বলল, কত দিতে হবে রে? দু’টাকা। অরু, হাসিমুখে দু’টাকা বের করল।
হীরুর সময় এত ব্যস্ততায় কাটছে যে এ্যানার সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করারও সময় পাচ্ছে না। অফিস-আদালত ছুটির দিনে বন্ধ থাকে। কিন্তু রেস্টুরেন্ট ছুটির দিনে সকাল সকাল খুলতে হয়, বন্ধ করতে হয় গভীর রাতে। অবশ্যি রাত যতই হোক এ্যানা তার জন্য অপেক্ষা করে। কড়কড়া ঠাণ্ডা ভাত খেতে হয় না। হীরু বাসায় পা দেয়ামাত্র এ্যানা সব কিছু গরম করতে বসে। একজন তার জন্যে না খেয়ে অপেক্ষা করছে এটা ভাবতেও ভাল লাগে।
রাতে পাশাপাশি ঘুমুতে গিয়ে হীরুর প্রায়ই মনে হয় সবটাই বোধ হয় কল্পনা। তার মত একটা ছেলেকে এ্যানা বিয়ে করবে। কেন? এ্যানা নিশ্চয়ই অন্য কাউকে বিয়ে করে মহাসুখে আছে। তার পাশে যে শুয়ে আছে সে ধরা-ছোঁয়ার কেউ না। কল্পনার একজন মানুষ। হীরু খুব দীর্ঘ একটা স্বপ্ন দেখে চলছে। এক’দিন স্বপ্ন কেটে যাবে। সে দেখবে তার পাশে কেউ নেই। পকেটে দু’টা ডেম্প সিগারেট, একটা দেয়াশলাইয়ের ব্যাক্স এবং ন্যাতন্যাতে মযলা কয়েকটা নোট নিয়ে সে রাস্তায় হাঁটছে। ঘুমুতে যাবার আগে হীরুর খুব ইচ্ছা করে এ্যানার সঙ্গে আবেগ এবং ভালবাসার কিছু কথা বলতে। রেস্টটুরেন্টের কথা না, সংসারের কথা না, অন্য রকম কিছু কথা। যা বলতে হয় অস্বাভাবিক নরম গলায়। যা বলার সময় গলার স্বর কেঁপে যায়, বুকের গভীরে সুখের মত কিছু ব্যথা বোধহয়। হীরু এসব কথা কখনো বলতে পারে না। বলতে গেলেই এ্যানা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, চুপ কর তো। এই সব কথা কোথেকে শিখলে। ছিঃ! হীরু আহত হয়ে বলে–ছিঃর কী আছে?
ঘুমাও। সিনেমা সিনেমা কথা আমার অসহ্য লাগে।
হীরুর চোখে পানি আসার উপক্রম হয়। চোখের পানি আটকাতে তার খুব বেগ পেতে হয়। এ্যান্য এই ফাকে সংসারের কথা নিয়ে আসে। এইসব কথা শুনতে হীরুর একেবারে ভাল লাগে না। তবু সে মন দিয়ে শোনে। এ্যানার সঙ্গে কথা বলারও আলাদা আনন্দ আছে। এই মেয়েটি একান্তই তার অন্য কারোর নয়। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে তারা দু’জন কথা বলছে এও তো এক পরম বিস্ময়। তার মতো কজন মানুষের এই সৌভাগ্য হয়? হীরু ভয়ে ভয়ে এ্যানার গায়ে হাত রাখে। সারাক্ষণই তার মনে হয় এই বুঝি এ্যানা তার হাত সরিয়ে দিল। এ্যানা হাত সরায় না। এও কী কম আনন্দের ব্যাপার? এ্যানা ঘুম ঘুম গলায় বলে, তিথি আপা সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বল তো?
জানি না।
কারো সঙ্গে কথাও বলে না। চুপচাপ থাকে।
একেক জনের একেক স্বভাব।
তিথি আপাকে নিয়ে অনেক আজেবাজে কথা শুনি–এসব কী সত্যি?
না।
টুকু যে কিছু করে না, পড়াশোনা না কিছু না রাতদিন ঘোবাফিরা। তোমরা কিছু বল না কেন?
বললে শুনে না।
বলে দেখেছ কখনো?
হীরুর ঘুম পায়। সে কোনো উত্তর দেয় না। এ্যানা শান্তভঙ্গিতে বলে, তুমি হচ্ছে সংসারের বড়। তোমাকেই তো সব দেখতে হবে।
দেখাদেখি করে কিছু হয় না। সব ভাগ্য।
আমার কলেজে ভর্তির ব্যাপারেও তো তুমি কিছু বলছ না।
হীরুর ঘুম কেটে যায়। সে শংকিতে গলায় বলে, তুমি কলেজে পড়বে না-কী?
পড়ব না–পড়ব না কেন?
মেয়েছেলের পড়াশোনার কোনো দরকার নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট আর পয়সা নষ্ট।
এইসব বাজে কথা তোমাকে কে শিখিয়েছে?
শেখানোর কী আছে? সবাই তো জানে।
আজেবাজে কথা আর আমার সামনে বলবে না।
আচ্ছা।
গা থেকে হাত সরাও। হাত সরিয়ে ঘুমাও।
একবার ঘুম কেটে গেলে হীরুর আর সহজে ঘুম আসতে চায় না। সে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। এ বাড়িতে গভীর রাত পর্যন্ত আরো অনেকেই জাগে। জাগেন মিনু, প্রায় রাতেই তাঁর এক ফোঁটা ঘুম আসে না। জাগে তিথি ও অরু। দু’জন এক খাটে ঘুময়। দু’জনই জানে অন্যজন জেগে৷ আছে তবু একজন অন্যজনকে তা জানায় না। শুধু নিশ্চিন্ত মনে ঘুমান জালালুদ্দিন। আজকাল রাতে তার ভাল ঘুম হয়। এক ঘুমে রাত শেষ করে দেন। ঘুমের মধ্যে নানান রকম স্বপ্ন দেখেন। চোখে দেখতে পান না বলেই বোধ হয় রাতের স্বপ্নগুলির জন্যে মনে মনে অপেক্ষা করে থাকেন। তার কাছে স্বপ্নের মানুষগুলিকে বাস্তবের মানুষদের চাইতেও অনেক বেশি সুন্দর মনে হয়।