দেখিতে দেখিতে এক বৎসরেরও বেশি সময় চলিয়া গেল। এক পৌষ-সংক্রান্তি হইতে আর এক পৌষ সংক্রান্তিতে এক বৎসর পূর্ণ হইয়া মাঘ-ফাল্গুন আরও দুইটি মাস কাটিয়া গেল। সেদিন চৈত্রের পাঁচ তারিখ। দেবু ঘোষ জংশন স্টেশনে নামিল। চৈত্র মাসের শীর্ণ ময়ূরাক্ষী পার হইয়া শিবকালীপুরের ঘাটে উঠিয়া সে একবার দাঁড়াইল। দীর্ঘ এক বৎসর তিন মাস কারাদণ্ড ভোেগ শেষ করিয়া সে আজ বাড়ি ফিরিতেছে। পনের মাসের মধ্যে কয়েকদিন সে মকুব পাইয়াছে। এতক্ষণে আপনার গ্রামখানির সীমানায় পদাৰ্পণ করিয়া যেন পরিপূর্ণ মুক্তির আস্বাদ সে অনুভব করিল।
ওই তাহার গ্রাম শিবকালীপুর, তাহার পরই মহাগ্রাম। পশ্চিমে শেখপাড়া কুসুমপুর, তাহার পশ্চিমে ওই দালানকোঠায় ভরা কঙ্কণা, একেবাবে পূর্বে ওই দেখুড়িয়া। আর দক্ষিণে ময়ূরাক্ষীর ওপারে জংশন। শেখপাড়া কুসুমপুরের মসজিদের উঁচু সাদা থামগুলি সবুজ গাছপালার ফাঁক দিয়া দেখা যাইতেছে। শিবকালীপুরের পূর্বেওই মহাগ্রামে ন্যায়রত্ন মহাশয়ের বাড়ি। মহাগ্রামের পূর্বে ওই দেখুড়িয়া। দেখুড়িয়ার খানিকটা পূর্বে ময়ূরাক্ষী একটা বাঁক ফিরিয়াছে। ওই বাঁকের উপর ঘন সবুজ গাছপালার মধ্যে বন্যায় নিশ্চিহ্ন ঘোষপাড়া মহিষডহর।
ঘাট হইতে সে ময়ূরাক্ষীর বন্যারোধী বাঁধের উপর উঠিল। চৈত্র মাসের বেলা দশটা পার হইয়া গিয়াছে, ইহারই মধ্যে বেশ খরা উঠিয়াছে। বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত্র এখন প্রায় রিক্ত। গম, কলাই, যব, সরিষা, রবিফসল প্রায়ই ঘরে উঠিয়াছে। মাঠে এখন কেবল কিছু তিল, কিছু আলু এবং কিছু কিছু রবি ফসলও রহিয়াছে। তিলই এ সময়ের মোটা ফসল, গাঢ় সবুজ সতেজ গাছগুলি পরিপূর্ণরূপে বাড়িয়া উঠিয়াছে। এইবার ফুল ধরিবে। চৈত্রলক্ষ্মীর কথা দেবুর মনে পড়িল—এই তিলফুল তুলিয়া কৰ্ণাভরণ করিয়া পরিয়াছিলেন। মা-লক্ষ্মী, তাই চাষী ব্রাহ্মণের ঘরে তাহাকে আসিতে হইয়াছিল। তিলফুলের ঋণ শোধ দিতে। বেগুনি রঙের তিলফুলগুলির অপূর্ব গঠন। মনে পড়িল তিলফুল জিনি নাসা।
আজ এক বৎসরেরও অধিককাল সে জেলখানায় ছিল—সেখানে ভাগ্যক্রমে জনকয়েক রাজবন্দির সাহচর্য সে কিছুদিনের জন্য লাভ করিয়াছিল। ওই লাভের সম্পদ-কল্যাণেই তাহার বন্দিজীবন পরম সুখে না হোক প্রচুর আনন্দের মধ্যে কাটিয়া গিয়াছে। দেহ তাঁহার ক্ষীণ। হইয়াছে, ওজনে সে প্রায় সাত সের কমিয়া গিয়াছে কিন্তু মন ভাঙে নাই। মুক্তি পাইয়া আপনার গ্রামের সম্মুখে আসিয়াও সাধারণ মানুষের মত অধীর আনন্দে ছুটিয়া বা দ্রুতপদে চলিতেছিল না। সে একবার দাঁড়াইল। চারিদিকে ভাল করিয়া দেখিয়া লইল। শিবকালীপুর স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। আম, কাঁঠাল, জাম, তেঁতুল গাছগুলির উঁচু মাথা নীল আকাশপটে অ্যাঁকা ছবির মত মনে হইতেছে। দুলিতেছে কেবল বাঁশের ডগাগুলি। ওই মৃদু দোল-খাওয়া বাঁশগুলির পিছনে তাদের ঘর। গাছের ফাঁকে ফাঁকে কতকগুলি ঘর দেখা যাইতেছে।
এদিক বাউরিপাড়া বায়েন-পাড়া; ওই বড় গাছটি ধর্মরাজতলার বকুলগাছ। ছোট ছোট কুঁড়েঘরগুলির মধ্যে ওই বড় ঘরখানা দুর্গার কোঠা-ঘর। দুর্গা! আহা, দুর্গা বড় ভাল মেয়ে। পূর্বে সে মেয়েটাকে ঘৃণা করিত, মেয়েটার গায়েপড়া ভাব দেখিয়া বিরক্তি ভাব প্রকাশ করিত। অনেকবার রূঢ় কথাও বলিয়াছে সে দুর্গাকে। কিন্তু তাহার অসময়ে, বিপদের দিনে দুৰ্গা দেখা দিল এক নূতন রূপে। জেলে আসিবার দিন সে তাহার আভাস মাত্ৰ পাইয়াছিল। তারপর বিলুর পত্রে জানিয়াছে অনেক কথা। অহরহ-উদয়াস্ত দুর্গা বিলুর কাছে থাকে, দাসীর মত সেবা করে, সাধ্যমত সে বিলুকে কাজ করিতে দেয় না, ছেলেটাকে বুকে করিয়া রাখে। স্বৈরিণী বিলাসিনীর মধ্যে এ রূপ কোথায় ছিল—কেমন করিয়া লুকাইয়া ছিল?
ওই যে বড় ঘরের মাথাটা দেখা যাইতেছে-ওটা হরিশ-খুড়ার ঘর; তারপরেই ভবেশদাদার বাড়ি, সেটা দেখা যায় না। ওই যে ওধারের টিনের ঘরের মাথা রৌদ্রে ঝকমক করিতেছে-ওটা শ্ৰীহরির ঘর। শ্ৰীহরির ঘরের পরেই সর্বস্বান্ত তারিণীর ভাঙা ঘর। তারপর পথের একপাশে গ্রামের মধ্যস্থলে চণ্ডীমণ্ডপ। তারপর হরেন ঘোষালের বাড়ি। ঠিক বাড়ি নয়, হরেন ঘোষাল বলে—ঘোষাল হাউস। ঘোষাল বিচিত্রচরিত্র। তাহার বাহিরের ঘরের দরজায় লেখা আছে পার্লার, একটা ঘরে লেখা আছে স্টাডি। দেবু ঘোষালের সেই গাঁদা মালার কথা জীবনে কোনোদিন ভুলিতে পারিবে না। ঘোষালের সম্পূর্ণ পরিচয় সে জানে। ম্যাট্রিক পাস করিলেও মূৰ্খ ছাড়া সে কিছু নয়; ভীরু, কাপুরুষ সে; ব্রাহ্মণ হইয়াও সে পাতু বায়েনের স্ত্রীর প্রতি আসক্ত। কিন্তু সেদিন ঘোষালকে তাহার মনে হইয়াছিল যেন সত্যকালের ব্রাহ্মণ। তাহার মালাকে সে পবিত্র আশীর্বাদ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিল, ওই আশীৰ্বাদই তাহাকে সেই যাবার মুহূর্তে অদ্ভুত বল দিয়াছিল। জেলের মধ্যেও বোধহয় ওই আশীর্বাদের বলেই রাজবন্দি বন্ধুদিগকে পাইয়াছিল।
বন্ধু কে না? বিলুর পত্রে সে পরিচয় পাইয়াছে, তাদের গ্রামের মানুষগুলির প্রতিটি জনই যেন দেবতা। তাহার মনে পড়িল একটি প্রবাদ-গায়ে মায়ে সমান কথা। হামা! এই পল্লীই তাহার মা! সে নত হইয়া পথের ধুলা মাথায় তুলিয়া লইল।
আরও খানিকটা অগ্রসর হইয়া নজরে পড়িল পলাশগাছে ফুল ধরিয়াছে, লাল টকটকে। ফুল! একটি বাড়ির চালের মাথায় অজস্র সজিনার ডাটা ঝুলিয়া আছে। গ্রামের উত্তর প্রান্তে দিঘির পাড়ের রিক্তপত্র শিমুলগাছটিতেও লাল রঙের সমারোহ। তাঁহারই পাশে একটা উচু তালগাছের মাথায় বসিয়া আছে একটা শকুন। এখন স্পষ্ট দেখা যাইতেছে—জগন ডাক্তারের খিড়কির বাঁশঝাড়ের একটা নুইয়া-পড়া বাঁশের উপর সারবন্দি একদল হরিয়াল বসিয়া আছে; সবুজ ও হলুদের সংমিশ্রণে পাখিগুলির রঙও যেন অপূর্ব, ডাকও তেমনি মধুর জলতরঙ্গ বাজনার ধ্বনির মত। বাতাসে এইবার গ্রামের নাবি আমগাছগুলির মুকুলের গন্ধ ভাসিয়া আসিতেছে। চৈত্র মাসে সকল আমগাছেই আম ধরিয়া গিয়াছে; শুধু চৌধুরীদের পুরনো খাস আমবাগানের গাছে চৈত্র মাসে মুকুল ধরে, এ গন্ধ চৌধুরীর বাগানের মুকুলের গন্ধ।
—পণ্ডিতমশায়!
কিশোর কণ্ঠের সবিস্ময় আনন্দধ্বনি শুনিয়া ফিরিয়া চাহিয়া দেবু দেখিল—অদূরবর্তী পাশের আলপথ ধরিয়া আসিতেছে কালীপুরের সুধীর, দ্বারকা চৌধুরীর নাতি; বড় ছেলের ছেলে। পাঠশালায় তাহার ছাত্র ছিল।
দেবু হাসিয়া সস্নেহে বলিল—সুধীর? ভাল আছিস?
সুধীর ছুটিয়া কাছে আসিয়া তাহাকে প্রণাম করিল—আপনি ভাল ছিলেন স্যার? এই আসছেন বুঝি?
–হ্যাঁ। এই আসছি। তুমি স্কুলে যাচ্ছ বুঝি কঙ্কণায়?
–হ্যাঁ। আপনার বাড়ির সকলে ভাল আছে, পণ্ডিতমশায়। খোকা খুব কথা বলে এখন। আমরা যাই কিনা প্রায়ই বিকেলে, খোকাকে নিয়ে খেলা করি।
দেবু গভীর আনন্দে যেন অভিভূত হইয়া গেল। ছেলেরা তাহাকে এত ভালবাসে?
–পাঠশালার নূতন বাড়ি হয়েছে স্যার।
–তাই নাকি?
–হ্যাঁ বেশ ঘর, তিনখানা কুঠুরি। নতুন পালিশ-করা চেয়ার-টেবিল হয়েছে স্যার। ইহার পর সে ঈষৎ কুণ্ঠিতভাবেই প্রশ্ন করিল—আর তো আপনি স্কুলে পড়াবেন না স্যার?
দেবু একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলনা সুধীর, আমি আর পড়াব না। নতুন মাস্টার এখন কে হয়েছেন?
কঙ্কণার বাবুদের নায়েবের ছেলে। ম্যাট্রিক পাস, গুরু-ট্রেনিংও পাস করেছেন। কিন্তু আপনি কেন?
সুধীরের কথা শেষ হইবার পূর্বেই ওদিক হইতে আগন্তুক একজন খুব অল্পবয়সী ভদ্রলোক সুধীরকে ডাকিয়া বলিল–খোকা বুঝি ইস্কুলে যাচ্ছ? দেখি, তোমার খাতা আর পেন্সিলটা একবার দেখি।
সুধীর খাতা-পেন্সিল বাহির করিয়া দিল। এ ছেলেটি-হাভদ্ৰলোক অপেক্ষা ইহাকে ছেলে বলিলেই বেশি মানায়। কে এ ছেলেটির বয়স বোধহয় আঠার-উনিশ বৎসর। চোখে চশমা গায়ে একটা ফরসা পাঞ্জাবি; এখানকার লোক নিশ্চয়ই নয়। সুন্দর ধারালো চেহারা। সুধীর অবশ্য ভদ্রলোকটিকে চেনে। কিন্তু ভদ্রলোকের সামনে দেবু তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিতে পারি না। অন্য প্রসঙ্গই উত্থাপন করিল—চৌধুরীমশায়—তোমার ঠাকুরদা ভাল আছেন?
–হ্যাঁ। তিনি আপনার কত নাম করেন!
দেবু হাসিল। চৌধুরীকে সে বরাবরই শ্রদ্ধা করে; চমৎকার, মানুষ। তিনি তাহার নাম করেন? দেবুর আনন্দ হইল। সে আবার প্রশ্ন করিল-বাড়ির আর সকলে?
—সবাই ভাল আছেন। কেবল আমার একটি ছোট বোন মারা গিয়েছে।
–মারা গিয়েছে?
হ্যাঁ। বেশি বড় নয়, এই এক মাসের হয়ে মারা গিয়েছে।
ভদ্রলোকটি এইবার খাতা ও পেন্সিল সুধীরকে ফেরত দিল, হাসিয়া বলিলবল তো সংখ্যা কত?
সুধীর সংখ্যাটার দিকে চাহিয়া বিব্রত হইয়া পড়িল। দেবুও দেখিল-বিরাট একটা সংখ্যা। কয়েক লক্ষ বা হাজার কোটি।
ভদ্রলোকই হাসিয়া সুধীরকে বলিলপারলে না? বাইশ হাজার আটশো ছিয়ানব্বই কোটি, চৌষট্টি লক্ষ, ঊনব্বই হাজার।
সবিস্ময়ে সুধীর প্রশ্ন করিল–কি?
–টাকা।
–টাকা!
–হ্যাঁ। ইউনাইটেড স্টেটস্ অব আমেরিকার খনি থেকে আর কলকারখানা থেকে এক বছরের উৎপন্ন জিনিসের দাম।
সুধীর হতবাক হইয়া গেল। বিমূঢ় হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। দেবুও বিস্মিত হইয়া গিয়াছিল, কে এই অদ্ভুত ছেলেটি!
ভদ্রলোকটি সুধীরের পিঠের উপর সস্নেহে কয়েক চাপড় মারিয়া বলিল-আচ্ছা যাও, স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তারপর দেবুর দিকে চাহিয়া বলিল—আপনি বুঝি এদের বাড়ি যাবেন? চৌধুরীমশায়ের বাড়ি?
দেবু আরও বিস্মিত হইয়া গেলভদ্রলোক চৌধুরীকেও চেনেন দেখিতেছি! বলিলনা। আমি যাব শিবপুর।
—কার বাড়ি যাবেন বলুন তো?
–আপনি কি সকলকে চেনেন? দেবু ঘোষকে জানেন?
বেশ সম্ভ্রমের সহিত যুবকটি বলিলতার বাড়ি চিনি, তার ছোট খোকাটিকেও চিনি, কিন্তু তাকে এখনও দেখি নি। আমি আসবার আগেই তিনি জেলে গিয়েছেন। শিগগির তিনি আসবেন বেরিয়ে।
সুধীর বলিল–উনিই আমাদের পণ্ডিতমশায়।
–আপনি! ছেলেটির চোখ দুইটি আনন্দের উত্তেজনায় প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল; দুই হাত মেলিয়া সাগ্রহে দেবুকে জড়াইয়া ধরিয়া সে বলিল—উঃ, আপনি দেবুবাবু! আপুন আসুন-বাড়ি আসুন।
দেবু প্রশ্ন করিল—আপনি? আপনার পরিচয় তো—
চোখ বড় করিয়া সম্ভ্রমের সহিত সুধীর বলিল—উনি এখানে নজরবন্দি হয়ে আছেন স্যার।
—এখানে রেখেছে আমাকে। অনিরুদ্ধ কৰ্মকার মশায়ের বাড়ির বাইরের ঘরটায় থাকি। সুধীর, তুমি দৌড়ে যাও; ওঁর বাড়িতে খবর দাও, গ্রামে খবর দাও। ওয়ান-টু-থ্রি। পু-ভস্-ভস্ ঝিক-ঝিক–! ধর মেল ট্রেন—তুফান মেলে চলেছ তুমি!
মুহূর্তে সুধীর তীরের মত ছুটিল।
হাসিয়া ভদ্রলোকটি বলিলবুঝতে পারছেন বোধহয়, এখানে ডেটিনিউ হয়ে আছি আমি।
গ্রামে ঢুকিবার মুখেই ক্ষুদ্র একটি জনতার সঙ্গে দেখা হইল। জগন, হরেন, অনিরুদ্ধ, তারিণী, গণেশ আরও কয়েকজন। চণ্ডীমণ্ডপে ছিল অনেকেই শ্ৰীহরি, ভবেশ প্রমুখ প্রবীণগণ। সকলেই তাহাকে সাদরে সস্নেহে আহ্বান করিল—এস, এস বাবা। এস, বস! দেবু চণ্ডীমণ্ডপে প্ৰণাম করিল, সমস্ত গুরুজনদিগকে প্রণাম করিল; শ্রীহরি পর্যন্ত আজ তাহাকে খাতির করিল। দেবু সম্বন্ধে খুড়া হইলেও শ্ৰীহরি বয়সে অনেক বড়। তাহার ওপর অবস্থাপন্ন ব্যক্তি হিসাবে শ্ৰীহরি প্রণামের খাতির বড়-একটা কাহাকেও দেয় না। সেই শ্ৰীহরিও আজ তাহাকে প্ৰণাম করিল।
চণ্ডীমণ্ডপের খানিকটা দূরে ওই যে তাহার বাড়ি। দাওয়ার সম্মুখেই ওই যে শিউলি ফুলের গাছটি। ওই যে সব ভিড় করিয়া কাহারা দুয়ারে দাঁড়াইয়া আছে।
তাহার বাড়ির দুয়ারে দাঁড়াইয়া ছিল গ্রামের মেয়েরা। দুইটি কুমারী মেয়ের কাঁধে দুইটি পূৰ্ণঘট। দেবু অভিভূত হইয়া গেল। তাহাকে বরণ করিয়া লইবার জন্য গ্রামবাসীর এ কি গভীর আগ্রহ—এ কি পরমাদরের আয়োজন। সহসা শঙ্খধ্বনিতে আকৃষ্ট হইয়া দেখিল, একটি দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে শাঁখ বাজাইতেছে। দেবু তাহাকে চিনিল, সে পদ্ম।
বাড়িতে ঢুকিতেই তাহার পায়ের কাছে খোকাকে নামাইয়া ঢিপ করিয়া প্ৰণাম করিল দুর্গা।
আবক্ষ ঘোমটা দুয়ারের বাজুতে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া ছিল বিলু। খোকাকে কোলে লইয়া দেবু বিলুর দিকে চাহিল। বুড়ি রাঙাদিদি তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া বলিলই ঘোড়ার কোনো আক্কেল নাই। পণ্ডিত না মুণ্ডু। আগে ই দিকে আয়! বদ-রসিক কোথাকার!
—ছাড়, রাঙাদিদি, পেণাম করি।
–পেনাম করতে হবে না রে ছেড়া। বৃদ্ধা তাহাকে হিড়হিড় করিয়া টানিয়া ঘরের ভিতর লইয়া গেল। তারপর বিলুকে টানিয়া আনিয়া বলিল—এই লে।
তারপর সমবেত মেয়েদের দিকে চাহিয়া বলিল—চল গো সব, এখন বাড়ি চল। চল চল! নইলে গাল দেব কিন্তু।
সকলে হাসিতে হাসিতেই চলিয়া গেল। বিলুর হাত ধরিয়া সস্নেহে সে ডাকিল—বিলু-রানী!
বিলুর মুখে-চোখে জলের দাগ, চোখ দুটি ভারী। চোখ মুছিয়া সে হাসিয়া বলিল—সাঁড়াও, পেনাম করি।
—মনিবমশায়! আকৰ্ণবিস্তার হাসি হাসিয়া সেই মুহূর্তে রাখাল-ঘোড়াটা আসিয়া দাঁড়াইল। ঘোড়াটা হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, মাঠে শোনলাম। এক দৌড়ে চলে আইচি।
সে ঢিপ করিয়া একটা প্রণাম করিল।
–পণ্ডিতমশায় কই গো! এবারে আসিল সতীশ বাউরি, তাহার সঙ্গে তাহার পাড়ার লোকেরা সবাই।
আবার ডাক আসিল,–কোথা গো পণ্ডিতমশায়!
এ ডাক শুনিয়া দেবু ব্যস্ত হইয়া উঠিল,–বৃদ্ধ দ্বারকা চৌধুরীর গলা।
দেবুর জীবনে এ দিনটি অভূতপূর্ব। এই দুঃখ-দারিদ্র-জীৰ্ণ নীচতায়-দীনতায়-ভরাগ্রামখানির কোন্ অস্থিপঞ্জরের আবরণের অন্তরালে লুকানো ছিল এত মধুর, এত উদার স্নেহ মমতা! বিলুকে সে বলিল আসি বাইরে থেকে। চৌধুরীমশায় এসেছেন। সুখের মধ্যে মানুষকে চিনতে পারা যায় না, বিলু। দুঃখের দিনেই মানুষকে ঠিক বোঝা যায়। আগে মনে হত এমন স্বার্থপর নীচ গ্রাম আর নাই!
বিলু হাসিয়া বলিল—কত বড় লোক তুমি, ভালবাসবে না লোকে? জান, তুমি জেলে যাওয়ার পর জরিপের আমিন, কানুনগো, হাকিম কেউ আর লোককে কড়া কথা বলে নাই, আপনি ছাড়া কথা ছিল না। পাঁচখানা গায়ের লোক তোমার নাম করেছে। দু হাত তুলে আশীর্বাদ করেছে।
***
এক বৎসরের মধ্যে অনেক কিছু ঘটিয়া গিয়াছে। গ্রামের প্রতি জনে আসিয়া একে একে একবেলার মধ্যেই সব জানাইয়া দিল। জগন খবর দিল, সঙ্গে সঙ্গে হরেন ঘোষাল সায় দিল—
কিছু কিছু সংশোধনও করিয়া দিল।
গ্রামে প্রজা-সমিতি হইয়াছে, ওই সঙ্গে একটি কংগ্রেস-কমিটিও স্থাপিত হইয়াছে। জগন প্রেসিডেন্ট, হরেন সেক্রেটারি।
হরেন বলিল কথা আছে, তুমি এলেই তুমি হবে একটার প্রেসিডেন্ট যেটার খুশি। আমি বলি, তুমি হও কংগ্রেস-কমিটির প্রেসিডেন্ট। ডেটিনিউ যতীনবাবু বলেন–না, দেবুবাবু হবেন প্রজা-সমিতির প্রেসিডেন্ট।
—ছিরে পাল এখন গণ্যমান্য লোক। একটা গুড়গুড়ি কিনেছে, চণ্ডীমণ্ডপে শতরঞ্জি পেতে একটা তাকিয়া নিয়ে বসে। বেটা আবার গোমস্তা হয়েছে, গায়ের গোমস্তাগিরি নিয়েছে। একে মহাজন, তারপর হল গোমস্তা, সর্বনাশ করে দিলে গাঁয়ের!
জমিদারের এখন অবস্থা খারাপ, শ্ৰীহরির টাকা আছে, আদায় হোক না হোক, সমস্ত টাকা শ্ৰীহরি দিবে—এই শর্তে জমিদার শ্ৰীহরিকে গোমস্তাগিরি দিয়াছে। শ্ৰীহরি এখন এক ঢিলে দুই পাখি মারিতেছে। বাকি খাজনার নালিশের সুযোগে লোকের জমি নিলামে তুলিয়া আপন প্রাপ্য আদায় করিয়া লইতেছে সুদে-আসলে। সুদ-আসল আদায় হইয়াও আরও একটা মোটা লাভ থাকে।
গণেশ পালের জোত নিলাম হইয়া গিয়াছে, কিনিয়াছে শ্ৰীহরি; এখন গণেশের অবশিষ্ট শুধু কয়েক বিঘা কোফা জমি।
সর্বস্বান্ত তারিণীর ভিটাটুকুও শ্রীহরি কিনিয়াছে; এখন সেটা উহার গোয়ালবাড়ির অন্তর্ভুক্ত। তারিণীর স্ত্রীটা সেটেলমেন্টের একজন পিয়নের সঙ্গে পলাইয়া গিয়াছে। তারিণী মজুর খাটে; ছেলেটা থাকে জংশনে, স্টেশনে ভিক্ষা করে।
পাতু মুচির দেবোত্তর চাকরান জমি উচ্ছেদ হইয়া গিয়াছে। তাহার জন্য নালিশ-দরবার করিতে হয় নাই, সেটেলমেন্টেই সে-জমি জমিদারের খাস খতিয়ানে উঠিয়া গিয়াছে। পাতু নিজেই স্বীকার করিয়াছিল, সে এখন আর বাজায় না, বাজাইতেও চায় না।
অনিরুদ্ধের জমি নিলামে চড়িয়াছে। অনিরুদ্ধ এখন মদ খাওয়া ভবঘুরের মত বেড়ায় দুর্গার ঘরেও মধ্যে মধ্যে যায়। তাহার স্ত্রীও পাগলের মত হইয়া গিয়াছিল। এখন অনেকটা সুস্থ। দুর্গার যোগাযোগেই দারোগা ডেটিনিউ রাখিবার জন্য অনিরুদ্ধের ঘরখানা ভাড়া লইয়াছে। ওই ভাড়ার টাকা হইতেই এখন তাহাদের সংসার চলে।
দেবু বলিল–কামার-বউকে আজ দেখলাম শাঁখ বাজাচ্ছিল।
জগন বলিল–হ্যাঁ, এখন একটু ভাল আছে। একটু কেন, যতীনবাবু আসার পর থেকেই বেশ একটু ভাল আছে। ঠোঁট বাঁকাইয়া সে একটু হাসিল।
হরেন চাপা গলায় বলিল—মেনি মেন সে বুঝলে কিনা—যতীনবাবু অ্যান্ড কামার-বউ—
দেবু বিশ্বাস করিতে পারি না, সে তিরস্কার করিয়া উঠিল—ছিঃ হরেন! কি যা-তা বলছ!
–ইয়েস; আমিও তাই বলি, এ হতে পারে না। যতীনবাবু কামার-বউকে মা বলে।
তারপর আবার সে বলিল যতীনবাবু কিন্তু বড় চাপা লোক। বোমার ফরমুলা কিছুতেই। আদায় করতে পারলাম না।
হরিশ এবং ভবেশ আসায় তাদের আলোচনা বন্ধ হইল, কিছুক্ষণ পরে সে উঠিয়া গেল।
হরিশ বলিলবাবা দেবু, সন্ধেবেলায় একবার চণ্ডীমণ্ডপে যেয়ো। ওখানেই এখন আমরা আসি তো। শ্ৰীহরি বসে পাঁচজনকে নিয়ে। আলো, পান, তামাক সব ব্যবস্থাই আছে। শ্ৰীহরি এখন নতুন মানুষ। বুঝলে কিনা!
ভবেশ বলিল, হ্যাঁ, দুবেলা চায়ের ব্যবস্থা পর্যন্ত করেছে আমাদের শ্ৰীহরি, বুঝেছ কিনা?
দেবু তাদের নিকট হইতে আরও অনেক খবর শুনিল।
গ্রামের পাঁচজনকে লইয়া উঠিবার-বসিবার সুবিধার জন্যই শ্ৰীহরি পৃথক পাঠশালা-ঘরের ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছে। জমিদার তরফ হইতে জায়গার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছে সে-ই। ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার সে, সে-ই দেওয়ালের খরচ মঞ্জুর করাইয়াছে; নিজে দিয়াছে নগদ পঁচিশ টাকা। তা ছাড়া চালের কাঠ, খড়, দরজা-জানালার কাঠও যে দিয়াছে শ্ৰীহরি।
দুই বেলা এখন চণ্ডীমণ্ডপে মজলিস বসে দেখিয়া শ্ৰীহরির বিপক্ষ দলের লক্ষ্মীছাড়ারা হিংসায় পাটু পাটু হইয়া গেল। তাহারা নানা নিন্দা রটনা করে। কিন্তু তাহাতে শ্ৰীহরির কিছু আসে যায় না। তাহার গোমস্তাগিরির অসুবিধা করিবার জন্যই তাহারা প্রজা-সমিতি গড়িয়াছে, কংগ্রেস কমিটি খাড়া করিয়াছে। দেবু যেন ওসবের মধ্যে না যায়।
তারা নাপিত আরও গৃঢ় সংবাদ দিল। জমিদার এ গ্রামখানা পত্তনি বিলি করিবে কি না ভাবিতেছে। শ্ৰীহরি গিলিবার জন্য হাঁ করিয়া আছে। পত্তনি কায়েম হইলে, শ্ৰীহরি বাবা বুড়োশিবের অর্ধসমাপ্ত মন্দিরটা পাকা করিয়া দিবে, চণ্ডীমণ্ডপের আটচালার উপর তুলিবে পাকা নাটমন্দির। শ্ৰীহরির বাড়িতে এখন একজন রাঁধুনী, একজন ছেলে পালন করিবার লোক।
তারাচরণ পরিশেষে বলিলই যে হরিহরের দুই কন্যে যারা কলকাতায় ঝি-গিরি করতে গিয়েছিল—তারাই। বুঝলেন তার মানে রীতিমত বড়লোকের ব্যাপার, দুজনকেই এখন ছিরু রেখেছে। বুঝলেন, একেবারে আমীরী মেজাজ। হরিহরের ছোট মেয়েটা যখন এইএ-ই রোগা, শণফুলের মত রঙ। ক্রমে শোনা গেল কলকাতায়—বুঝলেন?
অর্থাৎ মাতৃত্ব-সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করিয়াছিল মেয়েটি। তাই গ্ৰাম্য-সমাজ তাহাদিগকে পতিত করিল। কিন্তু শ্রীহরি দয়া করিয়া আশ্রয় দিয়াছে; তাহারই অনুরোধে সমাজ তাহাদের টি মার্জনা করিয়াছে; তারা বলিল-দু-দুটো মেয়ের ভাত-কাপড়, শখ-সামগ্ৰী তো সোজা কথা নয়, দেবু-ভাই।
বৃদ্ধ চৌধুরী শুধু আপন সংসারের সংবাদ দিলেন, দেবুর জেলের সুখ-দুঃখের সংবাদ লইলেন। পরিশেষে আশীৰ্বাদ করিলেন পণ্ডিত, তুমি দীর্ঘজীবী হও। দেখ, যদি পার বাবা তবে শ্রীহরির সঙ্গে ডাক্তারের, আর বিশেষ করে কর্মকারের মিটমাট করিয়ে দাও। অনিরুদ্ধ লোকটা নষ্ট হয়ে গেল। এরপর সর্বনাশ হয়ে যাবে।
কথাটার অর্থ ব্যাপক।
রামনারায়ণ আসিয়া বলিল ভাল আছ দেবু-ভাই? আমার মা-টি মারা গিয়েছেন।
বৃন্দাবন দোকানি বলিলচালের ব্যবসায় অনেক টাকা লোকসান দিলম দেবু-ভাই। যারা চালের ব্যবসা করেছিল তারা সবাই দিয়েছে। জংশনের রামলাল ভকত তো লালবাতি জ্বেলে দিল।
বৃদ্ধ মুকুন্দ একটি খোকাকে কোলে করিয়া দেখাইতে আসিয়াছিল, আমাদের সুরেন্দ্রের ছেলে, দেখ বাবা দেবু।
মুকুন্দের পুত্র গোবিন্দ, গোবিন্দের পুত্র সুরেন্দ্র, সুতরাং সুরেন্দ্রের ছেলে তাহার প্রপৌত্র।
সন্ধ্যার মুখে নিজে আসিল শ্ৰীহরি। শ্ৰীহরি এখন সম্ভ্ৰান্ত লোক। লম্বা চওড়া পেশি-সবল যে জোয়ান চাষী নগ্নদেহে কোদাল হাতে ঘুরিয়া বেড়াইত, দুর্দান্ত বিক্ৰমে দৈহিক শক্তির আস্ফালন করিয়া ফিরিত, সামান্য কথায় শক্তি প্রয়োগ করিত, জোর করিয়া পরের সীমানা খানিকটা আত্মসাৎ করিয়া লইত, কর্কশ উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিত—সে-ই গ্রামের প্রধান ব্যক্তি, তাহার অপেক্ষা বড় কেহ নাই, সেই ছিরু পালের সঙ্গে এই শ্ৰীহরির কোনো সাদৃশ্য নাই। শ্ৰীহরি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মানুষ! তাহার পায়ে ভাল চটি, গায়ে ফতুয়ার উপর চাদর; গম্ভীর সংযত মূৰ্তি, সে এখন গ্রামের গোমস্তা—মহাজন। বলিতে গেলে সে এখন গ্রামের অধিপতি।
–দেবু-খুড়ো রয়েছ নাকি হে? হাসিমুখে শ্ৰীহরি আসিয়া দাঁড়াইল।
–এস ভাইপো এস। দেবুও তাহাকে সম্ভ্ৰম করিয়া স্বাগত সম্ভাষণ জানাইল। দেবু বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছিল। অনিরুদ্ধের ওখানে যাইবার ইচ্ছা ছিল। ডেটিনিউ যতীনবাবু সেই তাহাকে চণ্ডীমণ্ডপে পৌঁছাইয়া দিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহার সঙ্গে একবার দেখা করিবার জন্য সে ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল। অনিরুদ্ধও সেই চলিয়া গিয়াছে। সে নাকি এখন মাতাল, দুর্গার ঘরে রাত্রি যাপন করে, তাহার অনুগ্রহণেও অরুচি নাই তাহার, জমি-জমা নিলামে উঠিয়াছে।
অনি-ভাইয়ের জন্য দুঃখ হয়। কি হইয়া গেল সে! তাহার একটা কথা মনে পড়িয়া গেল, চৌধুরীই বলিয়াছেন পণ্ডিত! মা-লক্ষ্মীর নাম শ্ৰী শ্ৰী যার আছে—তারই শ্ৰী আছে; সে মনে বল, চেহারায় বল, প্রকৃতিতে বল। শ্ৰীহরির পরিবর্তন হবে বৈকি! আবার অভাবেই ওই দেখ, অনি-ভাইয়ের এমন দশা। তার ওপর কামার-বউয়ের অসুখ করে আরও এমনটি হয়ে গেল।
শ্ৰীহরি তাহাকে ডাকিয়া বলিল তোমাকে ডাকতে এসেছি। চল খুড়ো, চণ্ডীমণ্ডপে চল। ওখানেই এখন বসছি। চা হয়ে গিয়েছে, চল।
দেবু না বলতে পারি না। চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া শ্ৰীহরি বলিয়া গেল অনেক কথা।
এই চণ্ডীমণ্ডপে বসিবার জন্যই গ্রামে স্কুল-ঘর করা হইয়াছে। স্কুল-ঘরের মেঝে-বারান্দা সব পাকা করিয়া দিবার ইচ্ছা আছে। একজন ডাক্তারের সঙ্গেও তাহার কথা হইয়াছে। তাহাকে আনিয়া সে গ্রামে বসাইতে চায়। শ্ৰীহরিই তাহাকে থাকিবার ঘর দিবে, খাইতেও দিবে। জগনকে দিয়া আর চলে না। উহার ওষুধ নাই, সব জল, সব ফাঁকি।
দেবু চুপ করিয়া রহিল।
সেটেলমেন্টের খানাপুরী বুঝারত দুইটা শেষ হইয়া গিয়াছে। আর কোনো গণ্ডগোল হয় নাই। এই সমস্তই দেবুর জন্য, তাহা শ্ৰীহরি অস্বীকার করিল না। বলিলবুঝলে খুড়ড়া, শেষটা আমিন, কানুন্গো—আপনি ছাড়া কথা বলত না। আমরা তোমার নাম করতাম। এইবার হবে তিনধারা, তারপর পাঁচধারা।
শ্ৰীহরি আরও জানাইল দেবুর জমা-জমি সমস্তই সে নির্ভুল করিয়া সেটেলমেন্টে রেকর্ড করাইয়াছে। এমনকি কঙ্কণার বাবুদের কর্মচারী যে জমির টুকরাটি আত্মসাৎ করিয়াছিল—সেটি পর্যন্ত উদ্ধার করিয়াছে।
–তাও উদ্ধার হইয়াছে? দেবু বিস্মিত হইয়া গেল।
–হবে না! জমিদারির সেরেস্তার তামাম কাগজপত্র আমাদের হাতে, তার উপর দাশজীর পাকা মাথা! আমি দাশজীকে বললাম—দেবু-খুড়ড়া উপকার করলে দেশের লোকের, বাঘের দাঁত ভেঙে দিয়ে গেল, তার তার জমি কুকুরে খাবে তা হবে না। আমাদের এ উপকারটি না করলে চলবে না; আর তা ছাড়াতা ছাড়া; শ্রীহরি আকাশের দিকে চাহিয়া জোড়হাতে প্ৰণাম করিলভগবান যখন জন্ম দিয়েছেন, তখন উপকার ছাড়া অপকার কারুর করব না, খুড়ো। এই দেখ না হরিহরের কন্যে দুটিকে নিয়ে কি কেলেঙ্কারি কাণ্ড! কলকাতায় তো খাতায় নাম লিখেছিল। শেষে বিশ্রী কাণ্ড করে দেশে এল। গায়ের লোক পতিত করলে। আমি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ক্ষান্ত করে আমার বাড়িতেই রেখেছি। লোকে বলে নানা কথা। তা আমি মিথ্যে বলব না খুড়ো, তুমি তো শুধু খুড়ো নও, বন্ধুলোক, একসঙ্গে পড়েছি! বাজারে-খাতাতেই যারা নাম লিখিয়েছিল, তাদের যদি আমি ওই জন্যে ঘরের একপাশে রেখে থাকি তো কি এমন দোষ করেছি, বল?
গড়গড়ার নলটা দেবুর হাতে দিয়া শ্ৰীহরি বলিলখাও খুড়ো।
–না। জেলখানায় গিয়ে বিড়ি তামাক ছেড়ে দিয়েছি।
–বেশ করেছ।
শ্ৰীহরির কথা ফুরাইতেই চায় না; কাহার বিপদের সময় তাহার উপকারের জন্য কত টাকা সে ধার দিয়াছে, আর সে এখন দিবার নাম করিতেছে না—সেই ইতিহাস আরম্ভ করিল।
শ্ৰীহরিকে দোষ দেওয়া যায় না। টাকা থাকা পাপ নয়, বে-আইনি নয়। কাহারও বিপদে টাকা ধার দিলে, খাতক সে সময়ে উপকৃতই হয়। কিন্তু সুদে-আসলে আদায়ের সময় তাহার যে কদর্য রূপটা বাহির হইয়া পড়ে, তাহা দেখিয়া খাতক আতঙ্কিত হয়, মহাজন ক্ষেত্রবিশেষে সঙ্কুচিত হইলেও সর্বক্ষেত্রে হয় না, কিন্তু ইহার জন্য দায়ী কে তাহা বলা শক্ত। সুদের জন্য মহাজনকে ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয়; হক পাওনা আদায়ের জন্য আদালতে কোর্ট-ফি লাগে; ইউনিয়নকে দিতে হয় চৌকিদারি ট্যাক্স।
সুদ শ্ৰীহরি ছাড়ে কি করিয়া?
দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল; শ্রীহরির দিকটা ভাবিতে ভাবিতে তাহার মনে পড়িয়া গেল—বাল্যকালের স্মৃতি। ঋণের দায়ে কঙ্কণার বাবুদের দ্বারা তাহাদের অস্থাবর-ক্রোকের কথা। সে শিহরিয়া উঠিল। খাতকের দিকটা দেবুর চোখের উপর ভাসিতে লাগিল। জমিজমা যায়, পুকুর-বাগান যায়, ক্ষেত-খামার যায়, তাহার পর গরু-বাছুর যায়; তাহার পর থালা-কাসা যায়, তাহার পর যায় বাস্তুভিটা। মানুষ পথের উপর গিয়া দাঁড়ায়। তিন বছর অন্তর অন্তর হ্যান্ডনোট পাল্টাইয়া একশো টাকা কয়েক বছরে অনায়াসে হাজার টাকায় গিয়া দাঁড়ায়, ইহাও আইনসম্মত। যখন আইনসম্মত তখন ইহাই ন্যায়। ইহাই যদি ন্যায় তবে সংসারে অন্যায়টা কি?
তাহার চিন্তাকে বিঘ্নিত করিয়া শ্ৰীহরি বলিল, এই দেখ, সেটেলমেন্টের তিনধারা আসছে, পাঁচধারার কোৰ্ট আসছে! এদিকে প্রজা-সমিতি করে ডাক্তার ধুয়ে তুলেছে—এ গাঁয়ের সব জমি মোকররী জমা। এ মৌজায় নাকি কখনও বৃদ্ধি হয় না! তোমাকে আমি কাগজ দেখাব, বার শো সত্তর সালের কাগজ; তামাম জমায় বৃদ্ধি করা আছে; একটি জমাও মিেকররী দাঁড়াবে না। জমিদার বৃদ্ধি দাবি করবে। হয়ত হাঙ্গামা বাধাবে ওরা। মামলা হবে। আইনে জমিদারের প্রাপ্য—সে পাবেই। আর যখন আইনসম্মত তখন আর তার অপরাধটা কোথায় বল? পঞ্চাশ বছরে ফসলের দাম অন্তত তিনগুণ বেড়েছে! জমিদার পাবে না?
দেবু এ কথারও কোনো উত্তর দিতে পারিল না। ফসলের দাম সত্যই বাড়িয়াছে। কিন্তু তাহাতে প্রজাদের আয় বাড়িয়াও বাড়ে নাই, বাজারদরে সব খাইয়া গেল। মানুষের অভাব বাড়িয়াছে, ইহার ওপরে খাজনা বৃদ্ধি!
শ্ৰীহরি বলিল—শোন খুড়ো, দৈবের বিপাকে অনেক কষ্ট পেলে। আর বাবা, আর ওসব পথে যেয়ো না তুমি; খাও-দাও, কাজকর্ম কর, লোকের উপকার করা–তোমার উপরে লোকেও আশা করে—আমরাও করি। সেই কথাই আজ দারোগা বললেন, পণ্ডিতকে বারণ করে দিও, ঘোষ, ওসব যেন না করে। তা একটা কথা লিখে দাও তুমিওরা তোমাকে নির্ঝঞ্ঝাট করে দেবে। স্কুলের চাকরিও তোমারই আছে, একটা বন্ড লিখে দিলেই তুমি পাবে। আর ওই নজরবন্দি ছোকরার সঙ্গে তুমি যেন মিশো-টিশো না বাপু, বুঝলে?
এবার দেবু হাসিয়া বলিল–বুঝলাম সব।
—তা হলে কালই চল আমার সঙ্গে।
–না, তা পারব না ছি। আমি তো অন্যায় কিছু করি নি।
–কাজ ভাল করছ না খুড়ো। আচ্ছা, দুদিন ভেবে দেখো তুমি।
–আচ্ছা।
হাসিয়া দেবু উঠিয়া চলিয়া আসিল। চণ্ডীমণ্ডপ হইতে পথের উপর নামিতে নামিতেই কাহারা জনদুয়েক তাহাকে হেঁট হইয়া নমস্কার করিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল।
—কে, সতীশ?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–কি ব্যাপার?
–আজ্ঞে, আমাদের পাড়ায় একবার পদান করতে হবে আপনাকে।
–কেন? কি হল? ও ঘেটু-গান? আজ থাক সতীশ অন্য একদিন হবে।
–আজ্ঞে, আপনাকে শোনাবার জন্যে আসর পেতেছি আমরা। তারপর ফিসফিস করিয়া বলিলনজরবন্দি বাবুও আইচেন; তিনি বসে রইচেন; ডাক্তারবাবু রইচেন।
–নজরবন্দি বাবুটি আছেন? আচ্ছা চল তবে।
***
চৈত্র মাসে ঘণ্টাকর্ণের পূজা। ঘেঁটুপূজা, পঞ্জিকার ঘণ্টাকর্ণ নয়। পঞ্জিকার ঘণ্টাকর্ণ বসন্ত–রোগ-নিবারক মহাবল ঘণ্টাকর্ণের পূজা। এই ঘণ্টাকর্ণঘেঁটু গাজনের অঙ্গ। বিষ্ণুবিরোধী শিবভক্ত ঘণ্টাকর্ণ ছিল পিশাচ। সে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়া রুদ্র দেবতার এবং বিষ্ণু দেবতার উভয়েরই প্রসাদ লাভ করিয়াছিল। এই একাধারে ভক্ত ও পিশাচ ঘণ্টাকর্ণের পূজা করে বাংলার নিম্ন জাতীয়েরা। সমস্ত মাস ধরিয়া ঘেঁটুর গান গাহিয়া বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া বেড়ায়। চাল-ডাল সিধা মাগিয়া মাসান্তে গাজনের সময় উৎসব করে।
চৈত্র মাসের সন্ধ্যা। ধর্মরাজের স্থানে বকুলগাছতলায় আসন পড়িয়াছে। বকুলের গন্ধে সমস্ত জায়গাটা ভুরভুর করিতেছে। আকাশে চাঁদ ছিল—শুক্লপক্ষের দ্বাদশীর রাত্রি। একদিকে মেয়েরা অন্যদিকে পুরুষদের আসর। দুই আসরের মাঝখানে বসিলনজরবন্দি বাবুটি, পণ্ডিতমশায়, ডাক্তারবাবু ও হরেন ঘোষাল। চারিটি মোড়াও তাহারা যোগাড় করিয়াছে। বাসন্তী সন্ধ্যার জ্যোৎস্না-আকাশ হইতে মাটির বুক পর্যন্ত যেন এক স্বপ্নকুহেলিকাময় আলোর জাল বিছাইয়া দিয়াছিল।
দেবুর মনে পড়িয়া গেল—বাল্যকালে তাহারা ঘেঁটু-গান শুনিতে এখানে আসিত। এমনই জ্যোত্মার আলোতে আসর বসিত। যাইবার সময় আঁচল ভরিয়া কুড়াইয়া লইয়া যাইত বকুল ফুল। তখন সতীশেরা সদ্য জোয়ান, উহারাই গাহিত গান—আর তাহাদের বয়সীরা ধুয়া গাহিত, নাচিত। তখন কিন্তু ঘেঁটুর আসর ছিল জমজমাট। সে কত লোক! সে তুলনায় এ আসর অনেক। ছোট। বিশেষ করিয়া পুরুষের দলই যেন অল্প। দেবু বলিল—সে আমলের মত কিন্তু আসর নাই। তোমাদের, সতীশ।
সতীশ বলিলপাড়ার সিকি মরদই এখনও আসে নাই, পণ্ডিতমশাই।
—কেন? কোথায় গিয়েছে?
–আজ্ঞে, প্যাটের দায়ে। গায়ে চাকরি মেলে না; গেরস্তরা ফেরার হয়ে গেল, মুনিষ-জন রাখতে পারে না। আমাদেরও ছেলে-পিলে বেড়েছে। এখন ভিন্গায়ে চাকরি করতে হয়। চাকরি সেরে ফিরতে একপহর রাত হয়ে যায়। তা ঘেটু-গান করবে কখন শুনবে কখন, বলেন?
জগন বলিল—পেটেই তোদের আগুন লেগেছে রে, পেট আর কিছুতেই ভরছে না!
সতীশ হাত জোড় করিয়া বলিলতা আজ্ঞে আপুনি ঠিক বলেছেন ডাক্তোরবাবু; প্যাটে আগুনই নেগেছে বটে। মেয়েরা পর্যন্ত রোজ খাটতে যাচ্ছে। কি করব বলুনঃ পঞ্চায়েত করে বারণ করলাম। তা কে শুনছে? সব ছুটছে তো ছুটছে। আর অভাবও যা হয়েছে, বুঝলেন!।
বাধা দিয়া যতীন বলিল-নাও, গান আরম্ভ কর।
গায়ক ও বাদকের দল অপেক্ষা করিয়াই ছিল, তাহারা আরম্ভ করিয়া দিল। ঢোলকের বাজনার সঙ্গে মন্দিরার ধ্বনি; গায়কের দল আরম্ভ করিল—
শিব-শিবরাম-রাম।
ছোট ছেলের দল নাচিতে নাচিতে হাতে তালি দিয়া ধুয়া ধরিল—
শিব-শিবরাম-রাম।
গায়কেরা গান গাহিল—
এক ঘেঁটু তার সাত বেটা।
সাত বেটা তার সাতান্ত।
এক বেটা তার মহান্ত।
মহান্ত ভাই রে,
ফুল তুলতে যাই রে,
যত ফুল পাই রে,
আমার ঘেঁটুকে সাজাই রে!
সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক লাইনের পর ছেলেরা তালি দিয়া গান গাহিয়া গেল—শিব-শিব-রাম-রাম।
এই গান শেষ হইবার পর আরম্ভ হইল অন্য গান। স্থানীয় বিশেষ ঘটনাকে অবলম্বন করিয়া ইহাদের গান আছে—
হয় এ জল কোথায় ছিল।
জলে জলে বাংলা মুলুক ভে-সে গেল!
বহুদিন আগে যখন রেলওয়ে-লাইন পড়িয়ছিল, সে গান আজও ইহারা গায়—
সাহেব রাস্তা বাঁধালে।
ছমাসের পথ কলের গাড়ি দণ্ডে চালালে!
অজন্মার বৎসরের গান–
ঈশান কোণে ম্যাঘ লেগেছে দেবতা করলে শুকো।
এক ছিলম তামুক দাও গো সঙ্গে আছে হুঁকো।
আজ তাহারা আরম্ভ করিল–
দেশে আসিল জরিপ!
রাজা-পেজা ছেলে-বুড়োর বুক টিপটিপ।
ছেলেরা ধুয়া ধরিল—
হয় বাবা কি করি উপায়?
প্ৰাণ যায় তাকে পারিমান রাখা দা-য়।
গায়কেরা গাহিয়া চলিল—
পিয়ন এল, আমিন এল, এল কানুনগো,
বুড়োশিবের দরবারে মানত মানুন্ গো।
বুঝি আর মান থাকে না।।
ছেলেরা গাহিল,
হায় বাবা, কি করি উপায়?
হাকিম এল ঘোড়ায় চড়ে, সঙ্গেতে পেশকার,
আত্মারাম খাঁচা-ছাড়া হল দেশটায়।
বুঝি আর মান থাকে না।।
তাঁবু এল, চেয়ার এল, কাগজ গাড়ি গাড়ি,
নোয়ারই ছেকল এল চল্লিশ মন ভারী।
ক্ষেতে বুঝি ধান থাকে না।।
তে-ঠেঙে টেবিল পেতে লাগিয়ে দূরবীন,
এখানে ওখানে পোতে চিনেমাটির পিন।
কুলিদের প্রাণ থাকে না।।
কুঁচবরন রাঙা চোখ তারার মতন ঘোরে।
দন্তকড়মড়ি হাঁকে—এই উল্লুক ওরে
হায় কলিতে মাটি ফাটে না।।
পণ্ডিতমশায় দেবু ঘোষ তেজীয়ান বিদ্বান,
জানের চেয়ে তার কাছে বেশি হল মান।
ও সে আর সইতে পারে না।।
কানুনগো কহিল তুই, সে করে তুকারি
আমার কাছে খাটবে না তোর কোনো জুরি-জারি
দেবু কারুর ধার ধারে না।।
দেবু ঘোষের পাকা ধানে ছেকল চল্লিশ মন,
টেনে নিয়ে চলে আমিন ঝন্-ঝন্-ঝন্।
ও সে কারুর মানা মানে না।।
দেবু হাসিল। বলিল—এসব করেছ কি সতীশ?
যতীন মুগ্ধ হইয়া শুনিতেছিল। গায়কেরা তাহার পরের ঘটনাও নিখুঁতভাবে বর্ণনা করিল। শেষে গাহিল—
দেবু ঘোষে বাঁধল এসে পুলিশ দারোগা,
বলে, কানুনগোর কাছে হাত জোড় করগা।
দেবু ঘোষ হেসে বলে না।।
থাকিল পিছনে পড়ে সোনার বরন নারী,
ননির পুতলি শিশু ধুলায় গড়াগড়ি।
তবু ঘোষের মন টলে না।।
চোখ মুছিতে মুছিতে দুর্গা বলিলতা তুমি পাষাণই বটে জামাই। মাগো, সে কি দিন। শুধু দুর্গা নয়, সমবেত মেয়েগুলি সকলেই আঁচল দিয়া চোখ মুছিতেছিল। সেদিনের কথা তাহাদের মনে আছে।
গায়কেরা গাহিল—
ফুলের মালা গলায় দিয়ে ঘোষ চলেন জেলে,
অধম সতীশ লুটায় এসে তাঁরই চরণ-তলে
দেবতা নইলে হায় এ কাজ কেউ পারে না।।
গান শেষ হইল। সতীশ আসিয়া দেবু ঘোষকে প্রণাম করিল। দেবুর বুকেও একটা আবেগ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছিল; সে মুখে কিছু বলতে পারিল না, সতীশকে সস্নেহে ধরিয়া তুলিল।
জগন বলিল—তোকে আমি একটা মেডেল দেব সতীশ!
হরেন বলিল-আচ্ছা সতীশ, মালাটা যে আমিই দিয়েছিলাম সে কথাটা বাদ গিয়েছে কেন? মালা আছে, গলা আছে, আমি নাই! বাঃ!
যতীন স্বপ্নাচ্ছন্নের মত উঠিয়া দাঁড়াইল। সমস্ত অনুষ্ঠানটাই তাহার কাছে অদ্ভুত ভাল লাগিয়াছে। সতীশকে মনে মনে নমস্কার করিল। বলিল—তোমাদের গানগুলো আমাদের লিখে। দেবে সতীশ?
–আজ্ঞে? সতীশ অপ্রস্তুতের মত হাসিতে লাগিল।—আপনি নিকে নেবেন?
–হ্যাঁ।
–সত্যি বলছেন, বাবু!
–হ্যাঁ হে।
নিঃশব্দে আকৰ্ণবিস্তার হাসিতে সতীশের মুখ ভরিয়া গেল। সে কৃতার্থ হইয়া গিয়াছে।
দেবু বলিল, আজ তো আপনার সঙ্গে আলাপ হল না, কাল—
যতীন বলিল-আলাপ তো হয়ে গেছে। আলোচনা বাকি আছে। কাল আমিই আপনার বাড়ি যাব।