১৮. এক থালা মিষ্টান্ন

১৮. এক থালা মিষ্টান্ন

‘ওয়াজিম খান, এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা তথ্য। যদি এটা নিশ্চিত করতে পার, তাহলে গত আটমাস ধরে আমরা যে অবরোধ করছি তার অবসান ঘটাবার একটা চমৎকার সুযোগ পাওয়া যাবে। এই আফগান লোকটির সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য বল…’

হঠাৎ একটা কান ফাটানো বিস্ফোরণের শব্দ আওরঙ্গজেবের তাবুর বাইরে শোনা গেল। তাবুর ছাউনিতে কতগুলো জিনিস পড়তেই তার পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠতেই তিনি তাঁবুর একটা খুঁটি ধরে নিজেকে সামলালেন। এটা আবার কি? ভূমিকম্প তো এরকম বস্তু ছুঁড়ে ফেলে না। কাঁপুনিটি কমে যেতেই কি হয়েছে দেখার জন্য আওরঙ্গজেব তাবুর বাইরে ছুটে গেলেন। হাতিগুলো যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে হাতির ডাক শোনা গেল। কয়েকজন সেনাপতি তাদের তাবু থেকে বের হয়ে হতভম্ব হয়ে চারদিকে তাকাল। সর্বত্র বড় বড় পাথরের টুকরা আর মাটি ছড়িয়ে রয়েছে। তারপর তিনি এর কারণটি দেখলেন।

তার চারশো গজ সামনে মাটিতে একটি বিরাট ফাটল দেখা গেল। গোলকুন্ডা দুর্গের সবচেয়ে বুরুজের দিকে যাওয়ার জন্য তার অর্ধেক দূরত্বে একদল মোগল প্রকৌশলী মাটিতে একটি সুরঙ্গ খুঁড়ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সুরঙ্গ দিয়ে এর নিচে পৌঁছে যতবেশি সম্ভব বারুদ চেপে এটাকে ভেঙ্গে ফেলা, যাতে গোলকুন্ডিদের প্রতিরক্ষায় একটা ফাটল ধরান যায়, যা মোগলদের সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। এখন সেই সুরঙ্গের সরু আর নিচু মুখ থেকে রক্তাক্ত আর কাদামাখা দেহে কয়েকজন প্রকৌশলী কোনোমতে বের হয়ে এল। নিশ্চয়ই কোথাও কোনো একটা গোলমাল হয়েছে, কিন্তু কী সেটা?

আওরঙ্গজেব তার পুরোনো দেহরক্ষীদলের প্রধান উমর আলিকে বললেন, ‘একজন প্রকৌশলীকে ডেকে আন, যে কথা বলার অবস্থায় আছে। কয়েক মিনিট পর মুখ, মাথায় আর পোশাকে কাদামাখা একজন লোককে তার কাছে। নিয়ে আসা হল।

সুরঙ্গে বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় কী তোমাদের বারুদ ফেটে গিয়েছিল?

 ‘না, জাঁহাপনা, এটা গোলকুন্ডিদের বারুদের বিস্ফোরণ।

কী বলতে চাও? কী ভাবে হল?

 ‘ওরা হয়তো কোনোভাবে আমাদের সুরঙ্গ খুঁড়া টের পেয়েছিল। আমাদের শ্রমিকরা সুরঙ্গ দিয়ে আসা যাওয়ার শব্দ কিংবা নড়াচড়ার কারণে হয়তো ওরা টের পেয়েছিল। তাছাড়া সুরঙ্গের উপরের মাটিও একটু দেবে গিয়েছিল। বুরুজর নিচে আমরা বারুদ পেতে ফাটাবার প্রস্তুতি নেবার আগেই ওরাও একটা সুরঙ্গ কেটে আমাদের সুরঙ্গ বারুদ দিয়ে উড়িয়ে দেয়।

আওরঙ্গজেব মাথা নেড়ে বললেন, “আচ্ছা তাই বল।’ গোলকুন্ডিরা নিশ্চয়ই এখনও অনেক সুসংগঠিত আর সুশৃঙ্খল। আর একই সাথে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর সতর্ক। আমাদের সুরঙ্গ খুঁড়া টের পাওয়ার জন্য ওরা চর বসিয়েছিল। যে আফগান লোকটির কথা ওয়াজিম খান বলেছিল, এখন তার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেল। তার সম্পর্কে আরো কিছু জানতে হবে। তবে তাকে আগে সুরঙ্গ খুঁড়ার কাজে নিযুক্ত লোকজনদের প্রতি কৃতজ্ঞতা আর সমর্থন জানতে হবে। তিনি কল্পনাও করতে পারলেন না মাটিতে পেট লাগিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে একটি সরু সুরঙ্গের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া কি কষ্টকর হতে পারে। ছাদ ঠেকা দেবার উপযুক্ত কোনো জিনিসপত্র নেই। আর বারুদের থলে টেনে নিয়ে যাওয়া কি বিপজ্জনক, সর্বক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকা, যেকোনো মুহূর্তে একটি স্ফুলিঙ্গ বারুদে আগুন ধরিয়ে দেবে কিংবা উপর থেকে মাটি পড়ে ফিরে যাওয়ার একমাত্র পথ বন্ধ হয়ে ধীরে ধীরে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে করুণ মৃত্যু।

 ‘তোমরা সবাই বীরের মতো কাজ করেছ। আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি একান্ত আনুগত্য দেখিয়েছ। আমি কথা দিলাম যারা বেঁচে রয়েছে তাদের সবাইকে যথোপযুক্ত পুরস্কৃত করা হবে আর যারা হতাহত তাদের পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হবে।’

লোকটি মাথা ঝুঁকিয়ে বললো, ‘ধন্যবাদ জাহাপনা।’

আওরঙ্গজেব পেছনে ঘুরে ওয়াজিম খানকে সাথে নিয়ে দ্রুত তাবুর দিকে ফিরে চললেন। সেখানে পৌঁছে বসার আগেই তিনি ওয়াজিম খানকে বললেন, “তুমি বললে, এই আফগান লোকটি গোলকুন্ডি সেনাবাহিনীর সহকারী প্রধান সেনাপতি। তারপরও সে বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাদের জন্য দুর্গে ঢোকার পথ করে দেবে?

‘হা, জাঁহাপনা। এই লোকটির নাম রশিদ খান। আপনার মনে আছে এক বার্তাবাহককে আমরা ধরেছিলাম যখন সে গোপনে রাতে দুর্গ থেকে বের হয়ে এল? তার কাছ থেকে বার্তাগুলো কেড়ে না নিয়ে, তাকে মেরে না ফেলে কিংবা বন্দী না করে আমরা তাকে ঘুষ দিয়ে বললাম সে তার কাজ চালিয়ে যেতে পারবে, তবে সমস্ত বার্তা আমাদেরকে দেখাতে হবে। এই বার্তাগুলোর মধ্যে একটা বার্তা রশিদ খান তার চাচাত ভাইকে লিখেছিল। সে একটি হীরার খনিতে সৈন্যদের নেতৃত্বে রয়েছে। আফগান লোকটি তার বার্তায় আদিল খানের চাকরিতে ঢোকার জন্য এখন আফসোস করছিল। যদিও সে অনেক উঁচু পদে উঠতে পেরেছে আর তার অনেক সম্পদ লাভ হয়েছে। তবে তার আশঙ্কা বাইরে থেকে দুর্গে কোনো সাহায্য আসবে না। গোলকুন্ডার কোনো সেনাদল তেমন শক্তিশালী নয়। কাজেই কোনো সেনাপতি এই ঝুঁকি নেবে না। যদিও দীর্ঘদিন তারা প্রতিরোধ করতে পারবে তবে পরিশেষে ঠিকই এর পতন হবে। সে নিজেও মারা যেতে পারে, আর যে সম্পদ এতদিন জমিয়েছিল তা সমস্ত হারাবে। আমি তার চাচাত ভাইয়ের হয়ে তাকে একটা উত্তর লিখলাম, তাতে তাকে সমবেদনা জানালাম আর বললাম যে, এখানে বন্দীরা বলাবলি করছে, যদি কেউ মোগলদের দুর্গে ঢোকার পথের খোঁজ দিতে পারে তবে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। আর সে যদি এতে আগ্রহী হয় তবে যেন একই বার্তাবাহকের মাধ্যমে তার উত্তর পাঠায়। তারপর তার ভাই আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠাবে। এই বার্তাটি সেই বার্তাবাহকের হাতে দিয়ে তার কাছে পাঠালাম। সে সাথে সাথে উৎসাহিত হয়ে উত্তর দিল, সেটা পাওয়ার সাথে সাথেই আমি আপনার কাছে এলাম যাতে আপনি নিজে তাকে একটা ক্ষমা আর পুরস্কারের প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লিখতে পারেন।’

 ‘আমি চিঠি লিখতে রাজি আছি, কিন্তু এখানে কী নিশ্চয়তা আছে যে, সে আমাদেরকে একটা ফাঁদে ফেলবে না? তার সম্পর্কে আর তার চরিত্র সম্পর্কে আমরা কতদূর জানি?

‘সে সারাজীবন একজন ভাড়াটে সেনা হিসেবে কাটিয়েছে। কোনো অস্থায়ী প্রভুর চেয়ে ভাড়াটে সেনাদের নিজের আর নিজেদের সম্পদের প্রতি যথেষ্ট মায়া আছে। আমার বিশ্বাস সে এর আগে অন্তত একবার হলেও তার আনুগত্য বদল করেছে। দুর্গের ভেতরে তার কোনো পরিবার নেই। নিজেকে ছাড়া আর কারও জন্য ভাবার মতো তার কেউ নেই। আর তার প্রথম চিঠি থেকে আমরা জানতে পেরেছি চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের পরাজয় অবধারিত।

‘সে সব ঠিক আছে। তবে সে যদি আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে, সেজন্য দুৰ্গটা তাকে আমাদের হাতে তুলে দেবার জন্য, আমাদেরকে এমন একটা পথ খুঁজে বের করতে হবে, যাতে আমাদের খুব বেশি লোকবল প্রয়োজন না পড়ে। এটা বলার পর আমি একটা চিঠি লিখে তাকে ক্ষমার প্রস্তাব দেব আর সেই সাথে উত্তরে পাঞ্জাবের বিদ্রাহী শিখদের কাছ থেকে আমরা যে জায়গা দখল করেছি, সেখান থেকে তাকে বড় একটা জায়গির দেব।’

*

ভোরের একটু আগে যখন বাদুড়েরা নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন আওরঙ্গজেবের দেহরক্ষী দলের ত্রিশজন সদস্য, তাদের দলপতি উমর আলির নেতৃত্বে কালো পোশাক পরে আর মুখে কালি মেখে মোগল সীমানা থেকে বের হয়ে গোলকুন্ডা দুর্গের দিকে চুপিসারে রওয়ানা দিল। কেউ কোনো ধাতব বর্ম কিংবা শিকলের বর্মও পরলো না এই ভয়ে যে, এর টুংটাং আওয়াজে ওদের অস্তিত্ব প্রকাশ হয়ে যেতে পারে, বিশেষত কেউ যদি মাটিতে পড়ে যায়। ছোট ছোট বারুদের পিপার ওজনে পাঁচজন নিচু হয়ে হাঁটছিল। গোলকুন্ডা দুর্গের মূল ফটকের দিকে গিয়ে ওরা পূর্বদিকের একটি বুরুজের দিকে চলছিল। আফগান সেনাপতি সেখানে মাটির কাছে গোড়ায় লোহার শিকের ছোট দরজা দিয়ে ওদেরকে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করার কথা বলেছিলেন। সবকিছু প্রস্তুত হওয়ার পর সে দরজাটি সামান্য খুলে একটি লণ্ঠন দিয়ে ওদেরকে পথ দেখাবে।

 ত্রিশজন লোক এক সারিতে নিঃশব্দে হেঁটে চললো। কেবল মাঝে মাঝে অন্ধকারে একটা পাথর কিংবা মরা গাছের গুঁড়িতে হোঁচট খাচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা পূর্বদিকের বুরুজের কাছাকাছি পৌঁছল। এখানে পাঁচ-ছয়জন মোগল শ্রমিকের মৃতদেহ পচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। গত সপ্তাহে বুরুজের প্রাকার থেকে গোলকুন্ডি বরকন্দাজরা গুলি ছুঁড়ে এদেরকে মেরেছিল। ওরা মাটি খুঁড়ে একটি সুরঙ্গ খুঁজে বের করার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। গুজব ছিল যে এখান দিয়েই গোলকুন্ডা দুর্গে রসদ সরবরাহ করা হত। অন্ধকারে শবদেহ থেকে মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছিল একটি নেড়ি কুকুর। ওদেরকে দেখে হঠাৎ কুকুরটি দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে এসে একজন সৈনিকের ঊরুতে দাঁত বসিয়ে দিল। অতিকষ্টে চিৎকার দমন করে সে একটা ছুরি বের করে কুকুরটির ঘাড়ে দুইবার আঘাত করতেই কুকুরটি সাথে সাথে মারা গেল। তারপর অন্যান্য প্রহরীর মতো সেও মাটিতে শুয়ে পড়লো। যদি কেউ দুর্গের দেয়াল থেকে কুকুরটার গর্জন কিংবা মরণ আর্তনাদ শুনে থাকে সে ভয়ে। তবে ওরা এখনও দুর্গ থেকে বেশ দূরে রয়েছে।

উমর আলি সাবধানে উঠে দাঁড়াল, তারপর তার লোকদেরকে অনুসরণ করতে ইশারা করে আবার চুপিসারে সামনে এগোতে লাগলো। দিগন্তে ভোরের বেগুনি আলোর ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ওরা এবার রুক্ষ আর কঠিন গ্র্যানাইট পাথরের উপর উঠে এসেছে, যার উপর দুর্গটি নির্মাণ করা হয়েছিল। উমর আলি দুর্গের দিকে তাকাল যদি কোনো লণ্ঠনের ম্লান আলো দেখা যায়, যা ওদেরকে দুর্গে ঢোকার পথ দেখাবে। কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। হয়তো সম্রাট ঠিকই বলেছিলেন যে, ওদেরকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে একটা ফাঁদে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে ওদের উপর আক্রমণ করার আগে গোলকুন্ডিরা কি ওদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না?

 তারপর প্রায় একশো গজ দূরে সবচেয়ে উঁচু বুরুজের নিচে একটা আলো দেখা গেল। বাকি লোকদেরকে সাবধান হতে বলে উমর আলি বেশ দ্রুত পাথরের উপর দিয়ে আলোটার দিকে ছুটলো। দেয়ালের ছায়ার কাছে পৌঁছতেই তার নাকে একটা প্রচণ্ড দুর্গন্ধ এল, আর পা ডুবে গেল নরম আঠাল পদার্থে– সম্ভবত এর উপরে একটি পায়খানা রয়েছে। পা উঠিয়ে সে আবার দ্রুত আলোর কাছে অর্ধেক খোলা দরজাটির কাছে গেল, চার ফুটের বেশি উঁচু হবে না। সে কাছে পৌঁছতেই দরজাটা পুরোপুরি খুলে গেল। তরোয়ালের বাটে হাত রেখে সে মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকে দেখলো ছোট একটি ভূগর্ভস্থ কামরার মতো জায়গায় একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাজপাখির মতো বাকা নাকের লোকটির হাতে একটি বড় লণ্ঠন।

লোকটি বললো, আমি রশিদ খান।

আর আমি উমর আলি, সম্রাট আওরঙ্গজেবের দেহরক্ষী দলের প্রধান। আপনি একা?’

 ‘হ্যাঁ। আর আপনিও তাই। আপনার বাকি লোক কোথায়?

 ‘ওরা কাছেই আছে। আমি দেখতে এসেছি যে এটা একটা ফাঁদ কি-না।

 ‘আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি সেরকম কিছু নেই। তবে আমার কথা না শুনে আপনি নিজে লণ্ঠন নিয়ে ভালোমতো দেখে আসুন।

একহাতে লণ্ঠনটা উঁচু করে ধরে অন্য হাত তরোয়ালের বাটে রেখে, উমর আলি দ্রুত জানালাহীন গোলাকার কামরাটির চতুর্দিক অন্ধকারে উঁকি দিয়ে ঘুরে দেখলো। একবার একটা ইঁদুর তার সামনে দিয়ে ছুটে যেতেই সে চমকে উঠলো, তবে কামরাটি খালি, কিছুই নেই, এমনকি একটা আসবাবও নেই যার পেছন থেকে কোনো হামলাকারী লুকিয়ে থাকতে পারে। সে কামরার ভেতর থেকে বের হবার সময় পাথরের সিঁড়ির কয়েকটি ধাপ বেয়ে উঠে দেখলো উপরে একটি শক্ত দরজা ভেতরের দিক থেকে খিল আটকে রাখা আছে, তার মানে বাইরে থেকে কেউ ভেতরে আসতে পারবে না। পেছন ফিরে রশিদ খানের দিকে তাকিয়ে সে বললো, আমি সন্তুষ্ট। আমি আমার লোকদেরকে এখানে আসার জন্য সংকেত দেব। ওদের সাথে আমার কথা হয়েছে, আমি দ্রুত তিনবার দরজাটা খুলবো আর বন্ধ করবো যাতে আলোটা তিনবার সংকেত দেয়।

একটু পরই উমর আলির সঙ্গীরা চলে এল। উমর আলি জিজ্ঞেস করলো, বারুদের পিপাগুলো কোথায় স্থাপন করলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে? বাইরের দেয়াল ঘেঁসে দরজার কাছে।

 উমর আলির লোকজন যথারীতি ভারী পিপাগুলো টেনে নিয়ে যথাস্থানে রেখে বারুদ বিস্ফোরিত করার জন্য স্ফুলিঙ্গবহ দড়ি লাগাতে লাগলো। জায়গামতো বারুদ স্থাপন করার পর উমর আলি বললো, বারুদ বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে আমাদের কয়েকটি পল্টনের চৌকশ সৈন্যরা ফাটলের দিকে ছুটে আসবে।’

আফগান সেনাপতি জিজ্ঞেস করলো, খুব ভাল। তবে পলিতার রশিটি কি যথেষ্ট লম্বা, যাতে বিস্ফোরণের সাথে সাথে আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে পারি?

 ‘হ্যাঁ, তা আছে। তবে এখান থেকে আমরা কোনদিকে যাব সেটা আপনাকে দেখাতে হবে।

রশিদ খান মাথা নাড়তেই উমর আলি তার লোকদেরকে পলিতায় আগুন লাগাতে ইশারা করলো। চকমকি পাথরের বাক্স থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হতেই চারটা পলিতায় হিস হিস করে উঠলো, তবে পঞ্চম চকমকি পাথরের বাক্সটি যে লোকটি জ্বালাচ্ছিল সেটা তার হাত ফস্কে অন্ধকারে মেঝেতে পড়ে গেল। সে বাক্সটা খোঁজার জন্য অন্ধকার মেঝেতে হাতড়াতে লাগলো।

উমর আলি বললো, “তোমরা সবাই রশিদ খানকে অনুসরণ কর। আমি কাজটা শেষ করে আসছি। সাথে সাথে সেনাপতি অন্যদেরকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে নিয়ে চললো। উমর আলি নিচু হয়ে চকমকি পাথরের বাক্সটি খুঁজতে শুরু করতেই শুনতে পেল উপরের সিঁড়ির দরজার খিল টেনে খোলা হচ্ছে। সে চকমকির বাক্সটি খুঁজে পেয়েই পঞ্চম পলিতায় আগুন জ্বালিয়ে দিল। অন্য পলিতাগুলো পুড়তে পুড়তে বারুদের পিপাগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, পঞ্চমটি ঠিকমত জ্বলছে নিশ্চিত হয়ে সে সিঁড়ির দুটো করে ধাপ পার হয়ে উপরের দরজার দিকে ছুটলো। উপরে উঠে খোলা দরজার কাছে পৌঁছতেই তাজা বাতাস তার দিকে ভেসে এল। দরজা থেকে বের হয়ে সে দ্রুত দুই সারি গোলাকার পাথরের বাঁধের মাঝখানে সমতল জায়গায় এল। তারপর দেখলো কয়েকটি পাথরের আড়াল থেকে রশিদ খান লণ্ঠন দিয়ে তাকে ইশারা করছে, সে সেদিকে ছুটে গেল। সেখানে পৌঁছে ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়তেই বারুদের পিপায় বিস্ফোরণ ঘটলো। বুরুজটি প্রথমে একটা মাতালের মতো এদিক সেদিক টলতে টলতে তারপর প্রচণ্ড শব্দে ভেঙ্গে পড়লো। বালু আর পাথরের টুকরার একটা জঞ্জালে পরিণত হল। একটা বড় পাথরের টুকরা উমর আলির কাছেই ধপ করে মাটিতে পড়লো, তবে রশিদ খান ইতোমধ্যেই উঠে দাঁড়িয়ে মোগলদেরকে তার সাথে ভেতরের দেয়ালের বেষ্টনির দিকে যাওয়ার জন্য হাত নেড়ে ইশারা করলো।

 উমর আলি আর তার লোকজন ছুটতে শুরু করতেই দুর্গের বাইরের আর ভেতরের দুইদিকের বুরুজের ছাদ থেকে গাদা বন্দুক আর কামানের গোলা বর্ষণ শুরু হল। তবে মনে হয় গোলাগুলি ওদের দিকে হচ্ছে না, বাইরে থেকে মোগল সৈন্যরা বুরুজের ফাটলের দিকে ছুটে আসছে দেখে ওরা সেদিকে গুলি বর্ষণ করছিল। উমর আলি তার দলনিয়ে নিরাপদে ভেতরের দেয়ালের কাছে পৌঁছে দেয়ালের সাথে গা ঘেসে দাঁড়াল। রশিদ খান ফিস ফিস করে উমর আলিকে বললো, দেয়ালে ঘুরলেই এখান থেকে বাম দিকে তিনশো ফুট সামনে একটা বুরুজের মধ্যে একটা প্রহরা কক্ষ আছে। আমি সেখানে একা যাব, তারপর যে রক্ষীরা সেখানে আছে তাদেরকে বলবো সেখান থেকে বের হয়ে বাইরের দেয়ালের প্রতিরক্ষার জন্য ছুটে যেতে। কেউ যদি যেতে অমান্য করে কিংবা বাইরে ঘোরাফেরা করে তাকে মেরে ফেলতে হবে। প্রহরীকক্ষে ঢোকার পর ভেতর থেকে ভালোভাবে সবদিক বন্ধ করে আপনাদের মূল বাহিনী আসা পর্যন্ত আপনাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।

উমর আলি মাথা নেড়ে বললো, ঠিক আছে বুঝেছি।’ রশিদ খান চলে যেতেই সে ভাবলো এই আফগান লোকটি কিভাবে পুরোপুরি তার আনুগত্য পাল্টে ফেললো। যে সেনাদের সে নেতৃত্ব দিয়েছে আর নিঃসন্দেহে যারা তাকে বিশ্বাস করে কিভাবে এত সহজভাবে তাকে মেরে ফেলার কথা বলতে পারলো। সে নিজে কখনও এটা করতে পারতো না…আফগান লোকটির কোনো বিবেক নেই আর সে অত্যন্ত স্বার্থপর। যাইহোক সে তার নতুন প্রভু-সম্রাটের জন্য যা যা করার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা সবই করছে, কাজেই সে আর তার লোকজন অবশ্যই তার নির্দেশ অনুযায়ীই কাজ করবে। কয়েকমিনিট পর উমর আলি দেখলো আফগান সেনাপতি আরেকটি লণ্ঠন হাতে নিয়ে ওদেরকে সেদিকে এগোতে ইশারা করছে। তখনও দেয়াল ঘেঁসে ওরা অস্ত্র হাতে নিয়ে বুরুজের বাঁক ঘুরে চুপিসারে এগোল। কেউ প্রতিরোধ করলো না আর দ্রুত ছোট পাহারা কক্ষে ঢুকে ওরা দেখলো রশিদ খান একা সেখানে রয়েছে। এখানে আগে যারা ছিল তাদের ব্যবহৃত কয়েকটি গুটিয়ে রাখা বিছানা, মোটা কম্বল আর একটা লম্বা লোহার টেবিলের উপর আধখাওয়া রুটির টুকরা পড়ে রয়েছে। রশিদ খানের নির্দেশে প্রহরীরা নিশ্চয়ই লড়াই করার জন্য সাথে সাথে ছুটে চলে গেছে।

উমর আলি তার লোকদেরকে বুরুজের কামরায় ঢোকার সমস্ত পথ বন্ধ করতে নির্দেশ দিল। ওরা সাথে সাথে কাজে লেগে পড়লো। টেবিল উল্টে বাইরের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে খিল আটকে দিল। তারপর সে উপরে ছাদে উঠে দেয়ালের গায়ে গাদা বন্দুক ছোঁড়ার জন্য বড় একটা ছিদ্রের ফাঁক দিয়ে বাইরের দেয়ালের ফাটলের দিকে তাকাল। ভোরের ফুটি ফুটি আলোয় সে দেখতে পেল মোগল পদাতিক সেনারা পতাকা উড়িয়ে জঞ্জালের উপর দিয়ে এদিকে আসছে। গোলকুন্ডিরা তখনও প্রাণপণে লড়ে চলেছে। তবে ধীরে ধীরে ওরা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে।

তারপর মোগল অশ্বারোহীর একটি বড় দল দেয়ালের ফাটলের কাছে ছুটে এল। জঞ্জাল টপকে পার হতে গিয়ে একটা ঘোড়া আরোহীসহ ঘুরে পড়লো। আরেকটি ঘোড়া লাফ দিতে গিয়ে তার আরোহীকে পিঠ থেকে ফেলে দিল। তবে বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলেও শীঘ্রই অনেক মোগল অশ্বারোহী জঞ্জাল পার হয়ে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে ওরা ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে পেছন দিক থেকে গোলকুন্ডিদের উপর হামলা করলো। ঘোড়ার পিঠ থেকে নিচু হয়ে ওরা তরোয়াল দিয়ে ওদের পেছন দিকে কোপাতে শুরু করলো। দুই দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে গোলকুন্ডিরা কোনোরকমে পেছন দিকে ভেতরের বুরুজের দিকে ছুটতে শুরু করলো, যেখানে উমর আলি দাঁড়িয়ে ছিল। মোগল অশ্বারোহীরাও তাদেরকে অনুসরণ করলো। কয়েকজন অবশ্য গোলকুন্ডিদের বুরুজের ছাদ থেকে ছোঁড়া গাদা বন্দুকের গুলিতে আহত হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল।

উমর আলি উপর থেকে নিচে তার লোকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললো, দরজাগুলো খুলে দাও! যে গোলকন্ডিরা ফিরে আসছে তাদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়। যেভাবে হোক আমাদের অশ্বারোহী সেনাদের এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ কর। বুরুজের মধ্য দিয়ে ওদেরকে ভেতরের উঠানে ঢোকার সুযোগ করে দাও। আর আমাদের পতাকাটা এনে দাও আমাকে। একজন সৈনিক তার কালো পোশাকের নিচে একটা পতাকা পেঁচিয়ে নিয়েছিল। সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ছুটে গেল তারপর সে আর উমর আলি মিলে দেয়ালের গাদা বন্দুক ছোঁড়ার ছিদ্র দিয়ে পতাকাটা দোলাতে লাগলো।

শীঘ্রই মোগল সেনারা ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নেমে বুরুজের দিকে ছুটলো। পেছন ফিরে বাইরের দেয়ালের ফাটলের দিকে তাকিয়ে উমর আলি দেখতে পেল লড়াই প্রায় থেমে গেছে। পদাতিক আর অরাহী মোগল সেনারা দলে দলে আসছিল। বেশিরভাগই ভেতরের বুরুজের দিকে চেপে এল। কেউ কেউ মাটিতে পড়ে থাকা তাদের সহযোদ্ধাদের দিকে তাকাল, কেউ বেঁচে আছে কি-না দেখে তার ক্ষতস্থানে পট্টি বেঁধে তাদেরকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলো। তারপর আরেকদল অশ্বারোহী দেয়ালের ফাটলের কাছে এল। এতদূর থেকেও সে তাদের কয়েকজনকে চিনতে পারলো, ওরা তার অধীনস্থ সম্রাটের দেহরক্ষীদল। তাদের মাঝখানে স্বয়ং সম্রাটও রয়েছেন। তিনি একটি কালো ঘোড়ার পিঠে চড়ে এসেছেন, তার বুকের বর্ম চকচক করছিল। প্রায় সত্তর বছর বয়স হলেও তিনি যুদ্ধের এই মুহূর্তে তার বিজয়ের মুহূর্তে তার সৈন্যদের মাঝে আসতে অধীর ছিলেন। সম্রাটকে স্বাগত জানিয়ে দুর্গের ভেতরে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উমর আলি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে ছুটে এগোল।

আধঘণ্টা পর উমর আলি আর তার চারপাশে বাদবাকি দেহরক্ষীদলের সদস্যদের নিয়ে আওরঙ্গজেব একটি বড় পাথরের দালানে ঢুকলেন। সদ্য ধৃত বন্দীরা বলেছে এটা আদিল হাসানের ব্যক্তিগত আবাসস্থল আর লড়াই যখন তার সেনাদলের বিরুদ্ধে যেতে শুরু করেছে তখন তিনি সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে গোলকুন্ডি সেনারা প্রায় সবাই অস্ত্র ফেলে দিয়ে মোগলদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। মোগল সৈন্যরা তাদের হাত পিছমোরা করে বেঁধে দলে দলে ভাগ করে মাটিতে উবু করে বসিয়ে রাখছিল।

আওরঙ্গজেবের দেহরক্ষীদলের প্রথম সারিটি যখন একটি মার্বেল পাথরের স্তম্ভশোভিত উঠান পার হচ্ছিল তখন দুটি গাদা বন্দুকের গুলির আওয়াজ শোনা গেল। একজন দেহরক্ষী মাটিতে পড়ে গিয়ে তার পায়ের ডিম চেপে ধরলো, সেখানে একটি ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে পড়তে লাগলো। তার সঙ্গীরা থামগুলোর পিছনে ছুটে গেল যেখান থেকে বন্দুকের গুলি ছোঁড়া হয়েছিল। থামের আড়াল থেকে ভালুকের মতো আকৃতির একজন গোলকুন্ডি হাতের গাদা বন্দুকটির নল ধরে একটি লাঠির মতো মাথার উপর ঘুরাতে ঘুরাতে ছুটে এল। তার প্রথম আঘাতে সামনের মোগল সেনাটির মাথা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যেত, যদি সে সময়মতো মাথা না সরাত। লোকটি আবার আঘাত করার আগেই আরেকজন দেহরক্ষী তার তরোয়ালের এক কোপে লোকটির মাথা কেটে ধর থেকে প্রায় আলাদা করে ফেললো।

ইতোমধ্যে দ্বিতীয় গোলকুন্ডি সেনাটি তার বন্দুক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পেছনের দিকে একটি পর্দায় ঢাকা দরজার ভেতর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। পর্দার পেছন থেকে গানবাজনার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। ঐ লোকটিকে অনুসরণ করে ভেতরে ঢুকতেই আওরঙ্গজেব আর তার দেহরক্ষীরা একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলেন। এমব্রয়ডারি করা দুধসাদা রঙের আলখাল্লা আর মাথায় ঝলমলে হীরকখচিত লাল পাগড়িপরা একজন লোক কামরার মাঝখানে একটি সোনার সিংহাসনে বসে একটি রূপার ট্রে থেকে মিষ্টি তুলে আয়েস করে খাচ্ছিলেন। তার চারপাশে ঘিরে  বিশজন নর্তকি পেছনে দাঁড়ান পাঁচজনের একটি বাদকদলের সাথে তাল মিলিয়ে ঘুরে ঘুরে গান গাইছিল। ওদের চুলে উঁইফুল আর পরনে পাতলা মসলিনের পোশাক। সিংহাসনে বসা লোকটি আদিল হাসান ছাড়া আর কেউ নয়। আওরঙ্গজেব তার দেহরক্ষীদের মাঝ দিয়ে তার দিকে এগোলেন। তিনি কিছু বলার আগেই আদিল হাসান মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে বললেন, “আমার ধারণা আপনি নিশ্চয়ই সম্রাট আওরঙ্গজেব। আসুন আমার সাথে একটু আমোদ ফুর্তিতে যোগ দিন। শেষ সময়টুকু পর্যন্ত আমি উপভোগ করে নিতে চাই আর তারপর সেই আনন্দময় স্মৃতি আমার মনে সংরক্ষণ করে রাখবো। তারপর আমার ভাগ্যে আপনি যা রেখেছেন তা সহ্য করার সময় যাতে তা আমার মনে সান্ত্বনা হিসেবে কাজ করে। একথা বলে তিনি তার আংটিপরা হাত দিয়ে ইশারা করতেই যন্ত্রীরা তাদের বাজনা দ্রুত লয়ে বাজাতে শুরু করলো। আর নতকীরা সেই তালে আরো জোরে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলো, তাদের খাটো জামা দেহের চারদিকে উড়তে লাগলো।

 আওরঙ্গজেব গর্জে উঠলেন, গ্রেপ্তার কর এই অধঃপতিতদের। মাটির নিচে সবচেয়ে গভীর কারাগারে এদের বন্দী করে রাখ।

সেদিন সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের পর নামাজ শেষে আওরঙ্গজেব হেঁটে বেলকনিতে এসে ওয়াজিম খানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে দেখলেন, সে নিচে মোগলদের বিজয় উৎসব দেখছে। তিনি বললেন, “আমরা এখন গর্ব করতে পারি ওয়াজিম খান, মোগল সাম্রাজ্য এখন সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত হয়েছে। আর সামান্য কিছু গোলকুন্ডি সেনা আর মারাঠিদের দমন করতে হবে। তারপর আমি সেনাবাহিনী নিয়ে উত্তরে ফিরে যেতে পারি। তারপর ভূমি সংক্রান্ত প্রশাসনের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমার অবর্তমানে সেখানে যে দুর্নীতি হচ্ছে আর অর্থের জন্য অসৎ কাজ করার প্রবণতার কারণে কোষাগার শূন্য হচ্ছে আর কর্তৃত্ব বিনষ্ট হচ্ছে, তা সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে।

ওয়াজিম খান বললো, আজকের দিনটি সত্যি আপনার জন্য এক বিশাল বিজয়ের দিন, জাহাপনা। আজ সন্ধ্যায় আমার জন্য কোনো কাজ আছে?”

না, আজ রাতে তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই। সারাদিনের পরিশ্রমে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমার পরিচারকরা মূল তাবুতে আমার জন্য যে শোয়ার ব্যবস্থা করেছে সেখানে গিয়ে এখন বিশ্রাম নেব। তুমি বরং ঐ উৎসবে যোগ দাও।’

মাঝরাত পর্যন্ত ঘুম না আসায় আওরঙ্গজেব অবাক হলেন। তার দেহ ক্লান্ত হলেও মনের মধ্যে ভাবনা চলছিল কত দ্রুত সম্ভব আর জান-মালের তেমন ক্ষতি না করে কিভাবে গোলকুন্ডার বাকি এলাকা, বিশেষত হীরার খনিগুলো তার আয়ত্তে আনা যায়। আফগান সেনাপতির মতো বাকি গোলকুন্ডি সেনাপতিদের মধ্য থেকে কাউকে কি ঘুষ দিয়ে বশ করা যাবে? ওয়াজিম খান বলেছিল, রশিদ খানের একজন চাচাত ভাই হীরার খনির প্রতিরক্ষায় নিযুক্ত গোলকুন্ডা বাহিনীর একজন সেনানায়ক। তাকে কি বাগে আনার জন্য প্রস্তাব পাঠাবেন? লোকটির কী অবস্থান এখানে? কতটুকু ক্ষমতা সে ধরে? ওয়াজিম খান নিশ্চয়ই এসব জানে আর হয়তো কিভাবে এগোন যায় সে ব্যাপারে ভালো কোনো পরামর্শও দিতে পারে। এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার এখনই ভালো সময়। বিছানা থেকে উঠে আওরঙ্গজেব তাবুর দরজার কাছে গিয়ে বাইরে যে দুজন দীর্ঘদেহী দেহরক্ষী পাহারায় নিযুক্ত ছিল, তাদের একজনকে ডেকে বললেন, ‘ওয়াজিম খানকে এখানে আসতে বল।

প্রায় আধঘণ্টা পর ওয়াজিম খান হাজির হল। তার চুল আর মুখ ঘামে ভেজা আর তাঁবুর ভেতরে নিচু হয়ে ঢোকার সময় একবার হোঁচট খেল আর কুর্নিশ করার সময় আরেকবার–সম্ভবত সে এখনও ঘুমের ঘোরে রয়েছে।

 আওরঙ্গজেব বললেন, আমি আমাদের পরবর্তী অভিযানের কথা ভাবছিলাম আর তোমার পরামর্শ দরকার।

 সে বললো, হ্যাঁ, জাঁহাপনা…আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।’ তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল আর একটু পর পর থেমে যাচ্ছিল। একহাত দিয়ে ভ্রূ থেকে ঘাম মুছলো।

‘গোলকুন্ডি সেনাবাহিনীর অন্যান্য সেনাপতিদের সম্পর্কে তুমি কতটুকু জান, বিশেষত রশিদ খানের চাচাত ভাইয়ের সম্পর্কে?

 ‘জাহাপনা…হা…জাহাপনা…ওদের সেনাপতি…’ ওয়াজিম খানের মনে হল মাথা ঘুরাচ্ছিল আর সে টলছিল। হঠাৎ আওরঙ্গজেব বিষয়টা বুঝতে পারলেন, তারপর তার কাছে একটু এগিয়ে গেলেন। হ্যাঁ সারা গায়ে মদের গন্ধ ভুর ভুর করছে।

‘ওয়াজিম খান, তুমি মদ খেয়েছ?”

ওয়াজিম খান প্রথমে বললো, না, জাঁহাপনা…’ তারপর যখন তার মাথায় একথাটা ঢুকলো এটা সে অস্বীকার করতে পারবে না, তখন সে বললো, আমি দুঃখিত…জাহাপনা…হ্যাঁ, আমাদের এই মহান বিজয় উৎসবে মেতে উঠে… আমি জাহাপনা, ক্ষমা করুন।

‘সত্যি করে বল তুমি কি প্রায়ই মদ খাও কি-না? আর কেউ না হলেও তুমি নিশ্চয়ই জান তথ্য পাওয়ার আমার কত উৎস আছে, কাজেই সত্যি কথাটা বল।’

মাঝে মাঝে জাঁহাপনা,…সপ্তাহে একবারের বেশি না, শপথ করে বলছি। যখন বেশি চিন্তা করি, তখন এটা মনের চাপ কমিয়ে দেয়। আমার কয়েকটা ভালো পরিকল্পনা…’ ওয়াজিম খানের কথা থেমে গেল।

‘কি করে তুমি এটা পারলে! মদ পান করার ব্যাপারে আমার কঠোর নিষেধ অমান্য করলে? তুমি কী সমস্ত ব্যাপারে আমার অনুগত নও?

 ‘আমি আপনার একান্ত অনুগত আর বিশ্বস্ত, জাঁহাপনা…আপনার মনে আছে ঐ আফগান লোকটিকে আমি খুঁজে বের করেছি…দয়া করে…’।

 আওরঙ্গজেব অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে পেছন দিকে ঘুরলেন। ওয়াজিম খান যদি ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে থাকে তাহলে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে কিভাবে তাকে বিশ্বাস করা যায়? দুষ্টক্ষতের মতো অবিশ্বস্ততা আর অবাধ্যতা একবার মানুষের মনে ঢুকলে এটা দ্রুত সবাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।

 ‘তোমার এই অসদাচরণের শাস্তি হিসেবে পুরো দরবারের সামনে তোমাকে পাঁচবার চাবুকের ঘা খেতে হবে। তারপর তুমি তোমার জায়গিরে তোমার পরিবারের কাছে ফিরে গিয়ে আমি আর না বলা পর্যন্ত সেখানেই থাকবে।

না, জাঁহাপনা…আমি মিনতি করছি দয়া করুন, না…! আমার মান সম্মানের কি হবে…?

‘আমার নিষেধ অমান্য করার আগে একথা তোমার ভাবা উচিত ছিল। তাবুর বাইরে পাহারারত যে দীর্ঘদেহী প্রহরীদেরকে তিনি ডেকে এনেছিলেন, মোটাসোটা টলমল করতে থাকা ওয়াজিম খানকে ওরা তবু থেকে বের করে নিয়ে যেতেই আওরঙ্গজেব তার শোয়ার ঘরের দিকে ফিরলেন। কেন তিনি কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না? কেন তার অতি ঘনিষ্ঠরা কোনো প্রশ্ন না করে শুধু তার নির্দেশ মানছে না আর বুঝতে পারছে না যে, তাদেরসহ কোনটা তার সাম্রাজ্য, আর সমস্ত প্রজাদের জন্য ভাল তিনি তা ভাল করেই জানেন। এটা ওদের দায়িত্ব। কি পাপ তিনি করেছিলেন যে, মাঝে মাঝে এরকম খারাপ ব্যাপার তার সাথে হচ্ছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *