এক-একটি দিল-বড় তীব্র অভিঘাতে মানুষের ঘুম কেড়ে নেয়। উত্তেজিত স্নায়ুসমূহ বিশ্রাম নিতে চায় না। সে কেবলই জেগে থাকে আর পাশে ঘুমন্ত বিশ্বদীপের ভারী নিঃশ্বাস পতনের শব্দ শুনতে পায়।
আগে তারা দু’জন অনেক রাত অবধি জেগে জেগে কথা বলত। বিশ্বদীপ কাজে যোগ দেবার পর থেকে কথা থেমে গেছে। কথা বলত বিশ্বদীপই বেশি। সে শুনত। এখন সে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে থাকে খেতে খেতেই কথা জড়িয়ে আসে। ঘুমে বন্ধ হয়ে আসে চোখ। বিছানায় শোয়া মাত্রই সে তলিয়ে যায়।
ছুটছে বিশ্বদীপ। লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করার জন্য ছুটছে। পিয়ে পড়াকে পরোয়া করছে না। শীর্ণতর হয়ে ওঠাকে তোয়াক্কা করছে না। তার সামনে সুদূরতম নক্ষত্রের মতো ঝুলে ছিল চাকরি। এই তিন মাসে সেই নক্ষত্রকে একটু একটু করে বড় করেছে সে। বাকি ৰ্ত্তিন মাস টিকে থাকলেই আর ভাবনা নেই। আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ সে হাতে পেয়ে যাবে। চাকরি। ভাল বেতনের চাকরি আর প্রচুর সুবিধা।
গত তিনমাস ধরে সে সফল থাকতে পেরেছে। চোখের তলায় অসম্ভব পরিশ্রমের ছাপ। কিন্তু ঔজ্জ্বল্য দৃষ্টিময়। এ ভাবেই সে সাফল্যের সংবাদ প্রতি মাসে পরিবেশন করেছে শুভদীপকে। এবং সহাস্যে জানিয়েছে, তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল যারা, তার মধ্যে টিকে আছে অল্পই। পারছে না, এই পরিশ্রম পারছে না আলুভাতে খাওয়া বাঙালির ছেলে।
বলার সময় আত্মগর্বে তার মুখ টসটসে। সঙ্গে সঙ্গে মায়েরও। শুনতে শুনতে একটি চমকদার চাকরি এবং একটি সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন মাকেও অধিকার করে বয়ে আছে।
আর সব সুসংবাদের শেষে একটি আশ্চর্য কথা বলেছে বিশ্বদীপ। এই সব সংস্থা, পণ্যবিক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত হলে যা হয়, তার থেকে বাড়িয়ে রাখে সব সময়। যদি লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত হয় তেরো, তারা দেবে তেইশ। কারণ তারা চায় তাদের পণ্য বিক্রয় হোক, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হোক চায় না।
এর দু’রকম ব্যাখ্যা আছে। সে সিগারেট ধরিয়ে বলেছিল। এই কৃত্রিম লক্ষ্যমাত্রার দার্শনিক দিকটি সহজ। কোন লক্ষ্যের চুড়ান্ত কী, তা কে বলে দেবে! চূড়ান্ত বস্তুটি কেবলই সরে সরে যায়। ধরতে গেলেই পিছলে যায় পারদ কণিকার মতো।
বলতে বলতে হাসছিল সে, যেমন তার স্বভাব, হাসির দমকে কঠিনকে সহজ করে তোলে, আর হাসতে হাসতে দ্বিতীয় ব্যাখ্যার কথা বলেছিল।
গাধার সামনে গাজর ঝুলিয়ে দুটিয়ে নেবার মতো খুডাের কলে ফেলে দেওয়া হবে ছেলেমেয়েদের। চাকরির টোপ নিয়ে তারা ছুটবে। লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করার জন্য চূড়ান্ত অভিনিবেশে চূড়ান্ত পরিশ্রম করবে এবং পৌঁছবে সেখানেই যেটা প্রকৃত লক্ষ্যমাত্রা। কিন্তু.. এই কিস্তুলই সব। কৃত্রিম লক্ষ্যমাত্রা পর্যন্ত পৌঁছল না কেউ, তাই চাকরিও দিতে হল না। বেতনও দিতে হল না ছ’মাস। কিন্তু সামান্য বাস ভাড়ার বিনিময়ে কোটি টাকার পণ্য বিকিয়ে গেল! একদল ছেলেমেয়ে না পেরে ছেড়ে দিল একমাস দু’মাস পর, অন্য একদল এল। বিক্রি অব্যাহত রইল।
হঠাৎই, ছোটবেলায় যেমন ভাইকে আদর করত, তেমনই ইচ্ছে হয়েছিল তার। সে বোঝে, বুঝতে পারে, তার নিজের চেয়ে তার ভাইয়ের দৃষ্টিতে অনেক বেশি স্বচ্ছ। আর ভাই তখন দু’আঙুলে জ্বলতে জ্বলতে ছাই ওগড়ানো সিগারেটের শেষাংশ ধরে দু’হাত ছড়িয়ে শুনিয়েছিল ব্যান্ডের গান। সে শোনে না যেসব, সেই ব্যান্ডের গান–
সকালে উঠে দেখি
দেখি এক মুমূর্ষ গাধা
চোখ দুটো ঢুলুঢুলু তার
ঠোঁট দুটো সাদা
এম বি এ করে যায়
ল্যাজে গিট বাঁধা
গাধার অবস্থা কী করেছেন
কী করেছেন দাদা
গাধাটাকে জল দাও…
সে, হাস্যবিরল মানুষ হয়ে যেতে থাকা, সে-ও শুনে হেসে উঠেছিল শব্দ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হাসির কিছু ছিল না। বিদেশ পাড়ি দেওয়া গাধারা তবু অর্থমূল্য পেয়ে যায়। যে-গাধারা দেশি থেকে গেল তাদের ভঁড়া শূন্য।
তা হলে প্রশ্ন ওঠে সে পারছে কী করে? কী করে পারল তিন মাস!
সাধ্যাতিরিক্ত করে। সাধ্যাতিরিক্ত করে সাধ্যাতীতকৈ সে আয়ত্ত করেছে।
সে আপত্তি করেছিল। অতিরিক্ত পরিশ্রমে হিতে বিপরীত হতে পারে বলেছিল। মা তখন ঝাঝিয়ে ওঠে তার ওপর। বলে, উপার্জন বাড়ানোর চেষ্টা করাই পুরুষমানুষের কর্তব্য। এবং এই বয়সই পরিশ্রমের উপযুক্ত!
পরিশ্রমের উপযুক্ত বয়সে পরিশ্রম করছে অতএব বিশ্বদীপ। সকাল সাতটায় বেরিয়ে যায় কারণ ঘরে ঘরে বাবু ও বিবিরা তখন উপস্থিত থাকেন। তাকে গ্রহণ করা বা বিতাড়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের পক্ষে সহজ হয়। সেইভাবে দেখতে গেলে জনগণ অত্যন্ত দয়ালু। তাদের দেখার বা শোনার সময় নেই। তবু কয়েকজন সময়ের থেকে সময় রাহাজানি করে তাকে সুযোগ দিয়েছেন। অন্তত বলার সুর্যোগ। দশটা বাড়ি ঘুরলে একটা বাড়িতে বিক্রি। বাকি সব বাড়িতে সকালে সময় নেই কারণ আপিস যাবার তাড়া। দুপুরে সময় নেই দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত। বিকেলে সময় নেই ইস্কুলফেরত আপিস-ফেরতদের জন্য খাবার-দাবারের ব্যস্ততা। সন্ধের পর থেকে তো হরেক কাজ।
পৃথিবীতে মানুষের কাজের কোনও শেষ নেই। তারও নেই প্রচেষ্টার শেষ। সপ্তাহে তিনদিন বিশ্বদীপ সকাল সাতটায় বেরিয়ে সন্ধে সাতটায় ফিরে আসে। তারপর পড়াতে যায়। বাকি চারদিন সে বেরোয় একই সময়, কিন্তু ফিরে আসে রাত দশটায়। লক্ষ্যমাত্রা অভিমুখে সারাদিন ছুটে ছুটে ক্লান্ত। তার কোনও রবিবার নেই।
সেদিক থেকে বরং পাঁচ টাকার হরেক মাল ফিরিওয়ালাদের সুবিধে, পথ দিয়ে বোঝা সঙ্গে করে তারা হেঁকে যায়। তাদের টানা স্বরে পাড়ায় পাড়ায় উদাসী আবহ তৈরি হয়। যার প্রয়োজন, ডেকে নেয় তাকে। দোরে দোরে ঘুরে বেড়ারার দায় নেই তার। পকেটে কানাকড়ি, এদিকে ঝলমলে পোশাক পরে সংস্থার মান রাখার দায় নেই।
ঝলমলে পোশাক। কাজে যোেগ দেবার সময় বিশ্বদীপের এই ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা। তখন দেবনন্দন সব সমাধান করে দেয়। ছোট শ্যালক হিসেবে বিশ্বদীপকে সে উপহার দেয় দু’প্রস্ত মূল্যবান পোশাক।
দেবনন্দন! দেবনন্দন। তার আশৈশবের বন্ধু। তার বোনের স্বামী। দেবনন্দন। সে দেবনন্দনকে আজ খারাপ পাড়ায় দেখেছে।
খারাপ পাড়া কেন? সে জানে না। ভাবেনি কখনও। লোকে বলে। সেও বলছে। চোর, ছাচোড়, অসৎ, ভণ্ড, প্রবঞ্চক, মিথ্যেবাদী গিস-গিস করা এই সব ভদ্রপাড়া ভাল পাড়া। আর ও পাড়া হল খারাপ পাড়া। সে আজ খারাপ পাড়ায় দেবনন্দনকে দেখেছে। আর দেখামাত্র, যাতে,তাদের চোখাচোখি হয়ে না যায়, সে পালিয়ে এসেছে দ্রুত পায়ে।
কেন গিয়েছিল দেবনন্দন? কখন গিয়েছিল? কবে থেকে যায়? সে তো জানেনি কোনও দিন। শোনেনি তো! আশৈশব বন্ধু তার, একসঙ্গে দেখতে শুরু করেছিল ন্যাংটো মেয়ের ছবি, আজ কত দূরে চলে গিয়েছে পরস্পর?
নে গিয়েছিল দেবনন্দন? কেন?
সে মরে গেলেও এ কথা শুচুকে বলতে পারবে না। জানতে চাইতে পারবেনা, শুচু,নীলচে রোগী শুচু, যৌনতায় অপারঙ্গম কিনা। সে এ কথা বলতে পারবে না এমনকী বিশ্বদীপকেও। তা হলে কাকে বলবে? কার সঙ্গে আলোচনা করবে এর ভয়াবহতা নিয়ে? কাকে বলতে পারত?
চন্দ্রাবলীর মুখ তার মনে পড়ে। চন্দ্রাবলীকে সব বলা যেত। সব।
সে ছটফট করে। এপাশ ওপাশ করে। ঘুম কামনা করে কিন্তু ঘুম আসে। চন্দ্রাবলী, শুচু, দেবনন্দন, সমাধিক্ষেত্র, পাপ, পুণ্য, জীবন-মৃত্যু তাকে ঘিরে ঘুরপাক খায়। মা, বিশ্বদীপ, মহুলি, মালবিকা, চম্পা একসঙ্গে হাত পা নেড়ে কথা বলে। সে পরিষ্কার দেখতে পায় সেই কুয়ো, যার মধ্যে মৃতদেহ শুয়ে আছে। সেই জন লোকটাকে দেখতে পায় যে সমাধিক্ষেত্র পাহারা দেয়, সারাদিন সমস্ত জায়গাটা ঘুরে বেড়ানো ছাড়া যার কাজ শুধু কুকুরকে খাওয়ানো। তার পাশে নির্বিকার এসে দাঁড়ায় মেয়েদের মতো ছেলেটা। আর পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যায় যিশু যিশু বলতে বলতে আলোকবর্তিকা হাতে পুরুষ। আর আসে একটি সাপ। বিশাল কালো সাপ। মুহূর্তে সে সাদা হয়ে যায়। মুহূর্তে কালো। আর এক চতুর্দশীকে ঘিরে পাক খায়। পাক খেতে থাকে। আর সে, অবাক হয়ে দেখে সেই চতুর্দশী শুচু। শুচু চিকার করে। শুভদীপ বলে চিৎকার করে। অতঃপর শুভদীপ শুভ হয়ে যায়। বিশ্ব হয়ে যায়। শুভ শুভ বিশ্ব বিশ্ব…।
সে ধড়ফড় করে উঠে বসে। মা ডাকছে। তাড়াতাড়ি যেতে বলছে তাদের। বাবা কেমন যেন করছে। কীরকম করছে? কীরকম? সে ভাইকে ঠেলছে। ভাই উঠছে না। উঠতেই চাইছে না। সমস্ত শরীর জুড়ে এক মহাসমুদ্র ঘুম তাকে জড়িয়ে আছে। সে তখন ঝাঁকানি দেয় ভাইকে আর ভাই ঘোর ভেঙে, ঘুম তাড়িয়ে আরক্ত চোখে উঠে বসে। ভাইকে বাবার অসুস্থতার সংবাদ দিয়ে পাশের ঘরে যায় সে।
দৃষ্টিহীন চোখে শুয়ে আছে বাবা। মুখের ডান পাশ বাঁকা লাগছে, স্থির, নিস্পন্দ। কিন্তু বুক উঠছেনামছে। সে বাবার পায়ে হাত দেয়া বরফশীতল পা। বিশ্বদীপও এসে দাঁড়ায় তখন। সে ডাক্তার ডাকতে যাবার জন্য তৈরি হয়। বিশ্বদীপও সঙ্গে সঙ্গে আসে। দু’জনে মিলে ভুটতে থাকে ডাক্তারের বাড়ি। দরজায় ঘন্টি বাজায় একযোগে, একযোগে কড়া নাড়ে। একযোগে ডাক্তারের নাম ধরে চিৎকার করে। এক মিনিট, দুমিনিট, তিন মিনিট, চার মিনিট পাঁচ মিনিটের মাথায় ডাক্তারের তিনতলার জানালা খুলে যায়। তারা একসঙ্গে ওপরের দিকে মুখ তোলে। পরিবেশন করে বাবার অসুস্থতার সংবাদ। পাড়ার চেনাশোনা সদাসম্বল ডাক্তার লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে নেমে আসেন নীচে। তারা তাঁকে বাড়ি যাবার জন্য অনুরোধ করে। তিনি আরও তিন মিনিট ব্যয় করে গেঞ্জির ওপর পাঞ্জাবি চাপিয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে আসেন। বিশ্বদীপ তাঁর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে নেয়। এবং বাবাকে পরীক্ষা করেই তিনি হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন। একটুও সময় নষ্ট না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতাল।
ডাক্তারের পাওনা চুকিয়ে দেয় মা। বিশ্বদীপ ব্যাগ হাতে করে ডাক্তারকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। দু’জনে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। বিশ্বদীপ ট্যাক্সির খোঁজে বেরোবার জন্য পা বাড়ায়। আর তখন মা দেবনন্দনকে খবর দেবার কথা বলে। দেবনন্দনের সঙ্গে একবার পরামর্শ করে নেবার কথা বলে। শুভদীপ হঠাৎ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। টের পায় দেবনন্দনের নামে তার মধ্যে ঘৃণার উদগিরণ। এবং, উপলব্ধি করে তাদের দুই ভাইয়ের তৎপরতা সত্ত্বেও মা দেনন্দনের পরামর্শ চাইছে। আসলে মা দেনন্দনকে গোড়া থেকে পাশে চাইছে। তার টাকা আছে বলে। সঙ্গে সঙ্গে সে মনে মনে সংকল্প করে, বাবার চিকিৎসার জন্য একটি পয়সাও দেবনন্দনের কাছ থেকে নেবে না।