একই নামে দুই লেখকের আবির্ভাবের পরিণাম যে কী তার উদাহরণ স্বরূপ দুই শরৎচন্দ্রের কাহিনী বলতেই বৈঠকের সবাই নকল শরৎ চাটুজ্যে সম্বন্ধে আরও কিছু জানবার জন্যে উৎসুক হয়ে উঠলেন। গল্পলহরীতে আমার লেখা গল্প প্রকাশিত হয়েছিল বটে কিন্তু তাঁকে চাক্ষুস দেখার সৌভাগ্য আমার কোন দিন হয় নি। মফস্বল থেকে কলকাতায় এসে যখন স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেছি, তখন তিনি জীবিত কিন্তু লেখকরূপে প্রায় বিস্তৃত। সুতরাং তার সঙ্গে যোগাযোগ হবার সম্ভাবনাও ছিল না, সুযোগও কখনও ঘটে নি।
বৈঠকের গাল্পিক সাহিত্যিক বহুকাল বাদে মুখ খুললেন। তিনি বললেন–এই নকল শরৎ চাটুজ্যের সঙ্গে আমার চাক্ষুষ পরিচয়ের সুযোগ একবার মাত্র হয়েছিল।
আমরা সবাই উৎসুক চিত্তে নড়েচড়ে বসলাম, একটা কিছু নতুন কাহিনী শোনার আশায়।
কিন্তু আমাদের বৈঠকের গাল্পিক সাহিত্যিকের ওই এক কৌশল। তার লেখা গল্প-উপন্যাসে পাঠকদের যেমন আগাগোড়া সাসপেন-এ রেখে লেখার শেষ পরিচ্ছেদে এনে চমকে দেন, আমাদের বৈঠকে গল্প বলতে বসেও সেই একই টেকনিক প্রয়োগ করে থাকেন। চাক্ষুষ পরিচয়ের একবার মাত্র সুযোগ হয়েছিল–এইটুকু বলেই একটা রসাল কাহিনীর আভাস দিয়ে নীরব। আমরা জানি, এরপর পকেট থেকে নস্যির কৌটো বেরোবে, সন্তর্পণে দুআঙ্গুলে নস্যির টিপ ধরা হবে, তারপর বা-হাতের আড়াল দিয়ে সড়াৎ করে নস্যিটা নাকে টেনে নিয়েই কিছুক্ষণ ভোম হয়ে বসে থাকবেন। ভাবখানা হচ্ছে, যেটুকু বলেছি সেইটুকু নিয়েই হাঁকুপাঁকু কর। ততক্ষণে গল্পর আরম্ভটা কি ভাবে হবে এবং কিভাবে শেষ করব ভেবে নিই। গল্প লেখার আর্ট আমাদের সকলেরই কিছু-কিছু জানা বিভিন্ন লেখকের বই পড়ে, কিন্তু গল্প বলারও যে একটা আর্ট আছে তা হৃদয়ঙ্গম করেছিলাম প্রথমত পরলোকগত পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন-এর মুখে গল্প শুনে, দ্বিতীয়ত সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে দিনের পর দিন আড্ডা দিয়ে, তৃতীয়ত আমাদের গাল্পিক সাহিত্যিকের সঙ্গে বৈঠকী আলাপচারিতে।
বৈঠকের সব্যসাচী লেখক আর থাকতে না পেরে বলে উঠলেন—আপনি তো প্রবাসী-ভারতবর্ষে গল্প নিয়ে যাতায়াত করতেন শুনৈছি। গল্পলহরীতেও গল্পের উমেদারী করতেন বুঝি?
নীরবতা ভঙ্গ করে গাল্পিক-সাহিত্যিক বললেন—পাড়ার হাতে-লেখা পত্রিকা বাদ দিলে কলেজ-ম্যাগাজিন-এর পর গল্পলহরীতেই আমার প্রথম আত্মপ্রকাশ। একটা নয়, একাধিক গল্প আমার প্রকাশিত হয়েছিল। ডাকেই লেখা পাঠাতাম এবং দু-এক মাসের ব্যবধানে তা ছাপাও হত। কোন লেখারই দক্ষিণা তখন পাই নি, প্রত্যাশাও করি নি। গল্প প্রকাশিত হচ্ছে সেইটিই ছিল একমাত্র দক্ষিণা। সুতরাং সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজনই তখন ছিল না। কিন্তু একবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল।
গাল্পিক-সাহিত্যিক থামলেন, অন্তত আবার দু মিনিট বিরতি। বিরক্ত হয়ে বৈঠকের মধ্যমণি বিশুদ। একটু খোঁচা দেবার উদ্দেশ্যেই বললেন–লেখা ফেরত এসেছিল বুঝি?
গাল্পিক-সাহিত্যিক বললেন—লেখা ফেরত এলে সম্পাদকের কাছে কৈফিয়ত চাইতে যাওয়া আমার স্বভাব নয়, কোনদিনও আমি তা করি নি। সম্পাদক মহাশয় আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
এবার বিশুদা চোখেমুখে খানিকটা নিশ্চিন্তির ভাব এনে বললেন–তাই বলুন। আমি ভেবেছিলাম অশ্লীল গল্প লিখেছিলেন বলেই বোধ হয় লেখাটা ফেরত এসেছিল।
বৈঠকের সব্যসাচী লেখক বললেন—নিশ্চয় অসাধারণ গল্পই লিখেছিলেন যার জন্য সম্পাদক লেখককে দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়েই ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
গাল্পিকাহিত্যিক এবার বিশুদার দিকে তাকিয়ে বললেন–আপনার অনুমানটাই আংশিক সত্যি। আমি যে গল্পটা পাঠিয়েছিলাম তা চিরাচরিত ধাঁচের গল্প ছিল না, অর্থাৎ একেবারে নিরামিষ গল্প নয়। সেসময় কল্লোল দলের লেখকেরা যে-সব বিষয়বস্তু নিয়ে লিখেছিলেন তাতে সুনাম ও দুর্নাম দুইই সমান জুটেছিল। লেখক-জীবনের শুরুতে সে-সব গল্প পড়ে যে তেতে উঠি নি তা নয়। ইচ্ছে হল এবার এমন একটা গল্প লিখতে হবে যাকে আপনাদের সমালোচকদের ভাষায় বলা হয়ে থাকে বোল্ড স্টোরী। গল্পটা ছিল ইট সুরকির কারবারী এক হঠাৎ-বড়লোকের সুন্দরী বউকে নিয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে মদ আর মেয়েমানুষ নিয়ে দিন কাটানোই স্বামীর একমাত্র আকর্ষণ, স্ত্রীর ভালবাসার মর্যাদা দেয় নি বলেই স্ত্রীর ভালবাসা থেকে সে বঞ্চিত ছিল। প্রথমে সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সন্দেহ, পরে শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। নিরুপায় হয়ে সে কুলত্যাগ করল, আত্মহত্যা সে করে নি। স্বামী আরও বেশি ডুবে রইল মদ আর মেয়েমানুষে, নিত্য নতুন মেয়েমানুষ তার চাই। একদিন তার ইয়ার-বন্ধুদের একজন সন্ধান দিল বেশ্যাপল্লীতে সদ্য অগিতা এক নতুন পাখির। সেদিন সন্ধ্যায় বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মত্ত অবস্থায় বেশ্যাপাড়ার এই নতুন পাখির ঘরে গিয়ে দেখে তারই স্ত্রী মোহিনীমূতি ধরে তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। গল্পের শেষে দুজনের অন্তদ্বন্দ্ব এবং প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আমি বলতে চেয়েছিলাম যে, সমাজকে পরিত্যাগ করলেও মন থেকে সংস্কারকে মুছে ফেলতে তারা পারে নি।
গল্পলহরীর সম্পাদকের চিঠি পেয়েই সেদিন দুপুরে কলেজ কামাই করে চলে গেলাম ওঁর দপ্তরে। মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক নিবিষ্ট মনে লিখে চলেছেন, অনুমানে বুঝলাম উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। এক বুক দাড়ি, গায়ে ফতুয়ার উপর সাদা চাদর জড়ানো।
পরিচয় দিয়ে ওঁর চিঠির কথা উল্লেখ করতেই আমার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বসতেও বললেন না। অবশেষে কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর এনে বললেন–সংস্কার নামে যে-গল্পটা পাঠিয়েছ সেটা তোমার লেখা?
আমাকে দেখে ওর মনে গল্পের লেখক সম্বন্ধে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। তখন আমার বয়েস কতই বা হবে। কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ি, ষোলোসতোরের বেশি নয়। গল্পটা যে আমারই লেখা সে-কথা জানিয়ে দিতে কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবলেন। তারপর চেয়ারে বসার ইঙ্গিত দিয়ে যে খাতায় এতক্ষণ লিখছিলেন সেটা বন্ধ করলেন, কলমটা রাখলেন টেবিলের দেরাজে।
দাড়ি পরিবৃত মুখে থমথমে গাম্ভীর্য। একটা ফাইল থেকে গল্পটা টেনে বার করে আমার হাতে দিয়ে বললেন–তোমার লেখার হাত আছে কিন্তু এসব গল্প লিখে ক্ষমতার অপব্যবহার করছ কেন?
আমি বললাম—লেখাটা কি আপনার খারাপ লাগল?
-লেখা খারাপ নয়, বিষয়বস্তুটাই খারাপ। আজকাল দেখছি একটা ফ্যাশান হয়েছে মেসের ঝি আর বিশেষ পাড়ার মেয়েমানুষ নিয়ে গল্প লেখা। তোমরা এত অল্প বয়সেই এ-সব কেন লিখতে যাও।
গল্পটা যখন ওঁর পছন্দ হয় নি তখন আর বৃথা বাক্যব্যয় করে কি লাভ। আমি তাই বললাম-তাহলে গল্পটা নিয়েই যাই।
বাধা দিয়ে বললেন—নিয়ে যেতে কে তোমায় বলছে। লেখাটা তো খারাপ নয়, একটু বদলে দিলেই গল্পের দোষটা কেটে যাবে।
-গল্পের দোষটা কোথায় সেটা যদি আমাকে বুঝিয়ে দেন
–দোষ ওই একটি জায়গায়। বাড়ির বউকে কুলত্যাগিণী করে বেশ্যাপল্লীতে আনা চলবে না। ওকে কোন দুর সম্পর্কের মাসীর বাড়ি পাঠিয়ে দাও, সেখানে বছরখানেক থাকুক। এদিকে অত্যধিক মদ্যপান করে স্বামী লিভারের রোগে শয্যাশায়ী। খবর পেয়ে স্ত্রীর প্রত্যাবর্তন এবং অমানুষিক সেবা করে স্বামীকে বাঁচিয়ে তোেলা। শেষে স্বামীর ভুল বুঝে অনুশোচনা, মিলন।
আমি বললাম-এ তো মামুলী গল্প।
—মামুলী হতে পারে তবু নীতি-বিরোধী নয়।
—আপনার ফরমুলা অনুসারে গল্প বদলাতে গেলে আমার গল্পর মূল বক্তব্যটাই ব্যর্থ হয়ে যায়। তাছাড়া গল্পের চরিত্র একরকম ভেবে পাড়া করেছি তাকে এখন এক কথায় উল্টে দিই কি করে। আর তা করতে গেলে চরিত্রগুলিকে আবার নূতন করে ঢেলে সাজতে হয়, সে তো পরিশ্রম সাপেক্ষ ব্যাপার।
–কেন? এতে পরিশ্রমের কি আছে। সহজ ব্যাপার। কলম যখন তোমার হাতে তখন সেই কলমের খোঁচায় কুলটাকে কুলবধু করতে কতক্ষণ।
গাল্পিক-সাহিত্যিক আবার থামলেন। পকেট থেকে কৌটো বার করে আরেক টিপ নস্যি নিয়ে চুপ করে করে বসে রইলেন। আমাদের মধ্যে থেকে একজন কেউ প্রশ্ন না করলে আর মুখ খুলবেন না। অগত্যা আমাকেই প্রশ্ন করতে হল।
গল্পটা কি শেষ পর্যন্ত সম্পাদকের কথামতই বদলে দিয়েছিলেন? গাল্পিক-সাহিত্যিক নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন–না। সে-গল্প আর বদলানও হয় নি, কোন পত্রিকাতেই আর ছাপা হয় নি। তবে গল্পটা হারায় নি, মাথার মধ্যে আজও রয়েছে। গল্পের প্লটটা নিয়ে এক বিরাট উপন্যাসের পরিকল্পনা ফেঁদে বসেছি, এখন লিখে ফেলতে পারলেই হয়।
বিশুদা বললেন–গল্পটা কি তাহলে গল্পলহরী সম্পাদকের কাছ থেকে ফেরত নিয়ে চলে এলেন?
তাছাড়া আর উপায় কি। সাহিত্য সম্বন্ধে ওঁর রক্ষণশীল ধারণার সঙ্গে আমার ধারণার আসমান জমিন ফারাক। এক্ষেত্রে তর্ক করার কোনই অর্থ হয় না। তাই ওঁর কথার প্রতিবাদ না করে পাণ্ডুলিপি বগলদাবা করে সেই যে চলে এসেছি আর ও-মুখে যাই নি, গল্পও আর পাঠাঁই নি। নকল শরৎচন্দ্রর সঙ্গে সেই আমার প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ।
সব্যসাচী লেখক বললেন–সম্পাদক মশাই তো ভাল কথাই বলেছিলেন। কলম যখন আপনার তখন কলমের এক খোঁচায় গল্প পালটে দিলেই তো হত।
-যা হয় নি তা নিয়ে আর আফসোস করে লাভ নেই। তবে কলমের এক খোচায় কি হয় আর কি না হয়, তা নিয়ে আসল শরৎচন্দ্র সম্বন্ধে একটা মজার গল্প আছে সেটাই আপনাদের বলি।
এ-কথা বলেই গাল্পিক-সাহিত্যিক পকেট থেকে আবার নস্যির কৌটো বার করলেন।
একটা রসাল গল্প, তাও আবার আসল শরৎচন্দ্রকে নিয়ে। বৈঠকের বিশুদাকে আর পায় কে। হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল—চা কোথায়, সিগ্রেট আসুক, পান চাই ইত্যাদি।
নস্যির কৌটোর ঢাকনাটায় টকাস টকাস করে আঙ্গুলের টোকা মারতে মারতে গাল্পিক সাহিত্যিক ফরমাশ করলেন-নস্যি ফুরিয়ে গেছে। দুপয়সার র নস্যি আনিয়ে দিন তো।
ছোকরা অমরের তৎপরতায় একে-একে সবই ঝটপট এসে গেল।
মোড়ক থেকে র নস্যি কৌটোয় ভরবার সময় গাল্পিক-সাহিত্যিক বললেন–দোকানের খুচররা নস্যি নেওয়া বিপজ্জনক। Saw dust আর লঙ্কার গুড়ো মিশিয়ে দেয়।
আমি বললাম-তাহলে আনালেন কেন?
-ওটা অভ্যেস। পকেটে নস্যির কৌটা না থাকলে আর তাতে নস্তি ভরা না থাকলে সে যে কী মানসিক যন্ত্রণা আপনারা বুঝবেন না। কোন কাজেই মন বসে না। নস্যি নেওয়াটা বড় কথা নয়। নস্যি-ভর্তি কৌটোটা হাতে থাকা চাই। বাঁ হাতের তালুতে কৌটোটা মুঠো করে ধরে গাল্পিক সাহিত্যিক আসল শরৎচন্দ্রকে নিয়ে আরেকটি কাহিনীর অবতারণা করলেন।
শরৎবাবুর তখন খুব নাম-ডাক। ওঁর বইয়ের পাঠকসংখ্যা অগণিত এবং লেখক সম্বন্ধে পাঠকদের কৌতূহলের শেষ নেই। গ্রাম ছেড়ে কলকাতা শহরে অশ্বিনী দত্ত রোড-এ দোতলা বাড়ি করেছেন, গাড়ি করেছেন, টাকাও করছেন প্রচুর। বছর না ঘুরতেই বইয়ের নতুন সংস্করণ বেরোচ্ছে, ওদিকে ওঁর গল্পউপন্যাস নিয়ে তখন থিয়েটারে আর সিনেমায় চলছে কাড়াকাড়ি। ওদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া হয়েছে ডি-লিট উপাধি, এদিকে কলকাতায় বিরাট সম্বর্ধনার আয়োজন।
শৈশবে শরৎবাবু যখন ভাগলপুরে থাকতেন তখন ওঁর বন্ধুরা মিলে একটি ক্লাব করেছিলেন, তার নাম ছিল আদমপুর ক্লাব। শরৎচন্দ্র ছিলেন এই ক্লাবের একজন হো-টাইম সদস্য। থিয়েটার, খেলাধুলা, গানবাজনা, চড়ইভাতি এইসব কাজে শরৎবাবু ছিলেন পাণ্ডা আর তার সমবয়সী বন্ধুরা ছিলেন যোগানদার।
শরৎচন্দ্রের এই খ্যাতি ও প্রতিভা যখন সারা দেশব্যাশী বিস্তৃত তখনও আদমপুর ক্লাবের বাল্যবন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন, যথা বিজয় বাড়জে, সতীশ বসু, সুকুমার মিত্র, রাজেন মজুমদার, রাজেন গাছি জীবিত। আজ তারাও বৃদ্ধ হয়েছেন কিন্তু তাদের শৈশবের বন্ধু শরৎচন্দ্রের এই খ্যাতিতে যুগপং, গর্বিত ও বিস্মিত না হয়ে পারেন নি। বন্ধুর গৌরবে গর্বিত হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু বিস্মিত হয়েছিলেন এই কারণে যে, তাদের আদমপুর ক্লাবের সেই বাউণ্ডুলে ডানপিটে ল্যাড়ার আজ দেশজোড়া নাম, বাংলা সাহিত্যে সে আজ একজন কেউ-কেটা। শৈশবে শরৎবাবুর মাথায় একরাশ চুল থাকা সত্ত্বেও ওঁর ডাক নাম ছিল ন্যাড়া, আদমপুর ক্লাবের বন্ধুরা ওকে ল্যাড়া বলেই ডাকতেন। শরৎবাবুর তাতে কোন আক্ষেপ ছিল না। এমন একটা কুৎসিত নামকে মর্যাদা দিলেন তার ইংরেজী রূপান্তরে। সেই সময় ওঁর বই ও খাতাপত্তরে সব সময়ে উনি ইংরেজী স্বাক্ষর দিতেন St. c. Lara। যেন বেলজিয়ম বা হল্যাণ্ডের একজন পাদ্রী। ক্লাবের বন্ধুদের মধ্যে যখনই দুঃসাহসিক সুকর্ম অথবা কুকর্মের কোন প্ল্যান হত তখনই শরৎচন্দ্রকে এগিয়ে দিয়ে সবাই বলত—ল্যাড়া, তুই তো বাবা পাদ্রী আছি, লেগে যা। খলিফা অর্থে পাদ্রী কথাটার ব্যবহার অদমপুর ক্লাবেই শুরু হয়, পরে শরৎবাবুই কথাটা কলকাতায় চালু করেছিলেন।
আদমপুর ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে যারা জীবিত তাদের কয়েকজন ভাগলপুরে একজোট হয়ে স্থির করলেন কলকাতায় গিয়ে একবার তাদের বাল্যবন্ধু ল্যাড়ার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। যদিও আজ সে মস্ত নামী লোক তবু ছেলেবেলাকার বন্ধু যখন অনাদর করবে না।
আদমপুর ক্লাবের সভ্যরা আজ বৃদ্ধ হলে কি হবে। মাথায় যখন প্ল্যান এসেছে কার্যে পরিণত করা চাই। ক্লাবের তিনজন সভ্য পরামর্শ করে ভাগলপুর থেকে এক রবিবার সকালে সোজা চলে এলেন কলকাতায় শবাবুর বালীগঞ্জের বাড়িতে।
ছেলেবেলার বন্ধুদের পেয়ে শরৎবাবু বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সারা সকাল ধরে গল্প আর গল্প, ছেলেবেলার দিনগুলির কথা যেন আর ফুরোতে চায় না। অতবড় সাহিত্যিকের কাছে যখন এসেছেন তখন সাহিত্য নিয়ে আলোচনা তো হবেই। বাল্যবন্ধুদের মধ্যে একজন বললেন—দ্যাখ ল্যাড়া, তুই তো অনেক লিখেছিস, আর তোর গল্প-উপন্যাস বেরলেই আমরা পড়ি। তোর গোড়ার দিকের লেখা শ্রীকান্ত প্রথম পর্ব যত ভাল এবং রিয়ালিস্টিক, তোর এখনকার বইগুলো সে-তুলনায় বড় বেশী আন-রিয়াল মনে হয়।
শরৎবাবু বললেন–তা মনে হওয়া স্বাভাবিক। একান্ত প্রথম পর্ব তো তোদের কীর্তি-কাহিনী নিয়েই লেখা, ও কি আনরিরাল হতে পারে?
আজকাল গল্প-উপন্যাস কে কিরকম লিখছে সে-প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু হতেই বাল্যবন্ধুদের মধ্যে একজন বললে-জানিস ল্যাড়া, সেদিন একজন নতুন লেখকের লেখা একটা গল্প পড়লাম—ওয়াণ্ডারফুল। যেমন গল্পের প্লট, তেমনি কনক্লুশন। আর স্টাইল যেন হীরকদ্যুতি। আজকাল সমাজ নিয়ে প্রোগ্রেসিভ গল্প লেখার একটা ফ্যাশান হয়েছে, এ সে-জাতের লেখা নয়। যেমন হাইসিরিয়াস, তেমনি হাই-থিংকিং। তাছাড়া লেখক গল্পের মধ্যে এমন একটা মরাল তুলে ধরেছেন যা আজকের দিনের ভেঙ্গে-পড়া সমাজে শিক্ষণীয় বস্তু।
শরৎবাবুর কৌতূহল জেগে উঠল। কি এমন গল্প যে তার এত উচ্ছসিত প্রশংসা! বললেন—গল্পটা একবার মুখে-মুখে বল তো, শুনি।
উৎসাহের সঙ্গে বাল্যবন্ধু সমস্ত গল্পটা শরৎবাবুকে বলতে শুরু করলেন
পূর্ববঙ্গের সমৃদ্ধিশালী গ্রাম। গ্রামের জমিদার কৃষ্ণনয়ন রায়চৌধুরী বিত্তশালী কিন্তু সাত্ত্বিক লোক। প্রজাদের সঙ্গে চিরকালই তিনি সৌহার্দ্যের সম্পর্ক রেখে এসেছেন। তার একমাত্র পুত্র কমলনয়নকে গ্রামের ইস্কুলেই ভর্তি করে দিয়েছেন যাতে প্রজাদের ছেলেদের সঙ্গে মিলেমিশে বড় হয়ে ওঠে, সহপাঠীদের প্রতি মায়া মমতা বন্ধুত্ব কৈশোরকাল থেকেই দেখা দেয়।
স্কুলের সহপাঠী বিষ্ণুচরণ দাস চাষার ছেলে, যেমন ডানপিঠে তেমনি ফুর্তিবাজ। কমলনয়নের সঙ্গে বিষ্ণুচরণের খুব ভাব, একেবারে হরিহর আত্মা। স্কুলের বেঞ্চিতে সব-সময় পাশাপাশি বসে, মাঠে গিয়ে একসঙ্গে ঘুড়ি ওড়ায়, পুকুরে একসঙ্গে ছিপ ফেলে মাছ ধরে, পুজোর সময় যাত্রার আসরে একসঙ্গে বসে রাত জাগে।
এন্ট্রান্স পরীক্ষা একসঙ্গে পাশ করার পর কমলনয়নকে চলে যেতে হল কলকাতায় কলেজে পড়বার জন্য, বিষ্ণুচরণ থেকে গেল গ্রামেই। চাষীর বংশের ছেলে, বি-এ এমএ পাস করলে চলবে কেন। বৃদ্ধ বাপ ক-দিনই বা আর আছেন, এখন থেকেই জোত জমি চাষবাসের কাজ বুঝে নিতে হবে। কমলনয়ন যেদিন কলকাতায় চলে গেল—তিন মাইল হেঁটে স্টিমার-ঘাটায় এসেছিল বিষ্ণুচরণ বন্ধুকে বিদায় দেবার জন্যে। দুজনেরই চোখে জল।
মহানগরীতে এসে কমলনয়ন যেন মহাসমুদ্রে পড়ল। কলেজের পড়াশোনায় ডুবে রইল, অবসর সময় মেতে রইল খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে।
দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর কেটে গিয়েছে। কমলনয়নের পিতৃ বিয়োগের পর সে জমিদারীর কাজকর্মের ভার সরকার মহাশয়ের হাতে তুলে দিয়ে বালীগঞ্জে দোতলা বাড়ি করে কলকাতাতেই থাকে। এম-এ পাস করে বাড়িতে বসেই সে গবেষণা কাজে ব্যস্ত থাকে, ওদিকে নানাবিধ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন নিয়ে অবসর সময় কাটায়। অকৃতদার হলেও কমলনয়ন উছুল নয়।
একদিন সকালে একতলার লাইব্রেরী ঘরে বসে একরাশ বই নিয়ে কমলনয়ন নোট নিতে ব্যস্ত, সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলার নৌ-বাণিজ্য নিয়ে তাকে একটা থসিস্ তৈরী করতে হচ্ছে। এমন সময় চাকর এসে বললে, দেশ থেকে একজন দেখা করতে এসেছে। লাইব্রেরী ঘরেই ডেকে পাঠালেন তাকে।
বলিষ্ঠ চেহারার একটি যুবক এসে ঘরে প্রবেশ করতেই কমলনয়ন বই পত্র ফেলে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন–আরে, বিষ্ণুচরণ, তুমি? এস এস, কতকাল বাদে তোমার সঙ্গে দেখা। বলতে বলতে এগিয়ে এসে দুই হাত প্রসারিত করে তার বাল্যবন্ধু বিষ্ণুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
বিষ্ণু বললে-তুমি তো আমাকে ঠিক চিনতে পেরেছ। ভয় ছিল গ্রামকেই যে ভুলে গেছে, আমাকে কি সে আর মনে রাখবে?
কমলনয়ন বললে-গ্রামকে ভুললেও তোমাকে কোনদিনও ভুলব না ভাই। শৈশবস্মৃতি কি কেউ কখনও ভুলতে পারে? কিন্তু কোথায় উঠেছ? কি মনে করে কলকাতায় এলে?
বিষ্ণু বললে কোথাও এখনও উঠি নি, সোজা শিয়ালদা থেকে তোমার সঙ্গে দেখা করতেই এসেছি। এখন বেশ কিছুকাল কলকাতাতেই আমাকে থাকতে হবে।
খুশী হয়ে কমলনয়ন বললেন—খুবই আনন্দের কথা। ভালই হল। এতবড় বাড়িতে আমি একা থাকি, আজ থেকে তুমিও থাকবে। কই, তোমার জিনিসপত্র কোথায়? চল চল ওপরে চল।
কিন্তু-কিন্তু করে বিষ্ণুচরণ বললে-আমার সঙ্গে আমার ইয়ে-ও এসেছেন—
ব্যস্ত হয়ে কমলনয়ন বললেন–বউকে নিয়ে এসেছ বুঝি। কোথায়, কোথায় তিনি, বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছ?
না, ঘোড়ার গাড়িতে বসিয়ে রেখে এসেছি। তোমার দেখা পাব কি পাব না আগে তো বুঝতে পারি নি।
ধমকের সুরে কমলনয়ন বললেন–আমার কাছে তোমার সংকোচ কি হে, তা ছাড়া তোমার আক্কেলটাই বা কি রকম। বউকে গাড়িতে বসিয়ে রেখেছ? যাও যাও, তাকে ডেকে নিয়ে এস। হরিচরণ, এই হরিচরণ, শিগগির গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নামা।
হইচই বাধিয়ে দিলেন কমলনয়ন। হাঁক-ডাকে বাড়িময় চাকরবাকরদের ছুটোছুটি পড়ে গেল। চিবুক পর্যন্ত অবগুণ্ঠনাবৃতা একটি স্বাস্থ্যবতী তরুণী বিষ্ণুচরণের পিছনে পিছনে গাড়ি থেকে নেমে আসতেই কমলনয়ন বললেন–নমস্কার বউঠান। হতভাগা বিষ্ণুটা বিয়ে করল, অথচ আমাকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ালোও না। এবার তার শোধ তুলব আপনার হাতের শাক-চচ্চড়ি খেয়ে। কতকাল যে দেশের রান্না খাই নি।
বিষ্ণুর দিকে আড় চোখে চেয়ে ফিসফিস করে বললেন—খাসা বউ হয়েছে ভাই। তুমি ভাগ্যবান। তার পরেই কমলনয়ন বিষ্ণুর হাত ধরে একতলার লাইব্রেরী ঘরটার পাশে যে দুটো ঘর খালি ছিল সে ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন–এ দুটো ঘর সব সময় খালিই পড়ে থাকে। এখন থেকে স্বচ্ছন্দে তোমার বউ নিয়ে তুমি থাক, আমি খুব খুশী হব।
বিকেলে গাড়ি করে বিষ্ণুচরণকে নিয়ে নিউ মার্কেট থেকে জানলা-দরজার দামী পর্দা কিনলেন, তাছাড়া ঘর সাজানোর টুকিটাকি আরও অনেক কিছু গাড়ি বোঝাই করে কিনে এনে বিচরণের বউয়ের কাছে দিয়ে বললেন–বউঠান, আপনার মনের মত করে ঘর-দোর সাজিয়ে নিন। যখন যা-কিছু প্রয়োজন আমাকে জানাতে কিছুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করবেন না।
বিষ্ণুচরণ বললেন–দেখ কমলনয়ন, তোমার বউঠানের ইচ্ছে আমাদের দুজনের রান্নাবান্নাটা উনি নিজেই করে নেন। তুমি আমাদের থাকবার জায়গা দিয়েছ, এতেই আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এর পরে আর তোমার উপর বোঝা চাপাতে চাই নে।
ক্ষুণ্ণ হয়েই কমলনয়ন বললেন—আমি তোমার বাল্যবন্ধু। আমাকে তুমি পর মনে করছ কেন ভাই। আমার এখানে ডাল-ভাত যা হয় সবাই সমান ভাগ করে খাব। তাছাড়া বউঠানও মাঝে মাঝে রান্না করে আমাদের খাওয়াবেন বই কি। আমার এখানে বামুন ঠাকুর রান্না করে, মুসলমান বাবুর্চি নয়। সুতরাং জাত যাবার ভয় নেই।
বিষ্ণুচরণ লজ্জায় পড়ে বললে-ওসব ভেবে তোমাকে ও কথা বলি নি। যাক, তুমি যখন ক্ষুণ্ণ হচ্ছ তখন তোমার কথায় আর আমরা আপত্তি করব না।
আনন্দেই দিন কাটতে লাগল। কমলনয়ন নোজই ওদের নিয়ে বেরোয়। বায়োস্কোপ, থিয়েটার, গানের জলসা, যাদুঘর, চিড়িয়াখানা ইত্যাদি নোজই একটা না একটা প্রোগ্রাম আছেই। কমলনয়নের নিঃসঙ্গ জীবন ওদের পেয়ে খুশীতে উচ্ছল হয়ে উঠল।
মাস তিনেক কেটে যাবার পর দেশ থেকে সরকার মশাই এসেছেন কমলনয়নের কাছে জমিদারী সংক্রান্ত কাজে পরামর্শ করতে। কলকাতার বাড়িতে এসে হঠাৎ বিষ্ণুচরণকে দেখে সরকার মশাই চমকে উঠলেন। কিছু
বলে সোজা দোতালায় চলে গেলেন কমলনয়নের কাছে। এক ঘণ্টাও পার হয় নি, হঠাৎ বিষ্ণুচরণ শুনতে পেল ওদের ঘরের বাইরে পরদা-দেওয়া দরজার ওপাশে ভারী জুতোর পায়চারির শব্দ। কমলনয়ন কিছু একটা বলবার জন্যে বোধ হয় বাইরে অপেক্ষা করছে মনে করে বিষ্ণুচরণ বললেএস কমলনয়ন, ভিতরে এস, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?
গম্ভীর গলায় কমলনয়ন বললে-ভিতরে যাবার আর আমার প্রবৃত্তি নেই। তুমি একবার বাইরে এস, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে।
বিষ্ণুচরণ তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখে কমলনয়ন স্থির দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। মুখে গাম্ভীর্যের ভাব, চোখে বিরক্তির চিহ্ন।
বিষ্ণুচরণের দিক থেকে মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে জলগম্ভীর কণ্ঠে কমলনয়ন জিজ্ঞাসা করলেন —কথাটা কি সত্যি? সরকার মশাই যা বলেছেন?
–সরকার মশাই কি বলেছেন সেটা তো আমার জানা দরকার।
–তুমি আমাদের গ্রামের হারাণ ভটচায্যের বিধবা মেয়েকে ভাগিয়ে এনেছ?
–ভাগিয়ে আনি নি, আশ্রয় দিয়েছি।
–তোমার মুখে ওসব বড় বড় নাটক নভেলের কথা শুনতে চাই না। যাকে তুমি সঙ্গে করে এনেছ সে তোমার বিবাহিতা স্ত্রী নয়, এটা তো সত্যি।
–মন্ত্ৰপড়া স্ত্রী নয়, সে আমার আশ্রিতা।
এবার প্রচণ্ড ধমক দিয়ে কমলনয়ন বললেন–চোপরাও বদমাশ। আশ্রিতা নয়, রক্ষিতা। একটা রক্ষিতাকে নিয়ে আমার বাড়িতে এসে উঠেছ, আগে সে-কথা আমাকে বল নি কেন?
–তোমার সংস্কারে বাধতো বলেই বলি নি।
রাগে ফেটে পড়লেন কমলনয়ন–তুমি আমার বাল্যবন্ধু হয়ে আমার সঙ্গে শঠতা করেছ, মিথ্যাচার করেছ, আমার ঐতিহ্য মর্যাদা সংস্কৃতির মূলে আঘাত দিয়েছ, আমার বাড়ি অপবিত্র করেছ। এই মুহূর্তে ওই মেয়েমানুষটাকে নিয়ে তুমি আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাও, আমি তোমার মুখদর্শন করতে চাই না।
কমলনয়ন বিষ্ণুচরণের আর কোন কথা শোনবার অপেক্ষা না করেই দ্রুত হনহন করে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলেন।
পরদিনই দেখা গেল এক ফার্নিচারওয়ালা একতলার ঘরের সব আসবাবপত্র লরী বোঝাই করে নিয়ে গেল। একদল রাজমিস্ত্রী এসে ঘর দুটোর দেয়াল আর ছাতের সব পলেস্তারা খুলে ফেলে চুন-সুরকি দিয়ে নতুন পলেস্তারা লাগাল। মেজের সিমেন্ট খুড়ে ফেলে নতুন সিমেন্ট এনে আবার মেজে তৈরি হল। কলকাতার সেরা কীর্তনের দল এনে অষ্টপ্রহরব্যাপী নাম-কীর্তনের ব্যবস্থা হল—অপবিত্র ঘর দুটো পবিত্র করে কমলনয়ন নিশ্চিন্ত হলেন।
শরৎবাবুর বাল্যবন্ধু গল্পটা এইখানেই শেষ করে সপ্রশংস দৃষ্টিতে শরৎবাবুর দিকে তাকালেন। শরৎবাবু অসীম ধৈর্যের সঙ্গে নীরবে গল্পটি শুনছিলেন, শোনা শেষ হলেও কোন মন্তব্য করলেন না, চুপ করে বসে আলবোলায় তামাক টানতে লাগলেন।
বন্ধু ছাড়বার পাত্র নন। বললেন—কিরে ল্যাড়া, কী রকম মনে হল?
এবার শরৎবাবু মুখ খুললেন। বললেন–ভালই তো মনে হল। তবে গল্পের শেষটা আমি হলে অন্যরকম করতাম।
কৌতূহলের সঙ্গে বাল্যবন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন—কি করতিস শুনি?
গম্ভীরভাবে শরৎবাবু বললেন–আমি হলে পলেস্তারা বদলানো নয়, সমস্ত বাড়িটা রাতারাতি ভেঙ্গে ধুলিসাৎ করে দিতাম। শুধু তাই নয়, বহু কুলিমজুর লাগিয়ে বাড়িটার ভিত খুড়ে জমির মাটি কেটে একটা মস্ত পুকুর তৈরি করে শ্বেত পাথরের ঘাটলা বাঁধিয়ে দিতাম এবং সেই ঘাটের প্রত্যেক সিঁড়িতে লাল পাথরে লিখিয়ে দিতাম সতীলক্ষ্মীর ঘাট। পাড়ার কুললক্ষ্মীরা সেই ঘটে স্নান করে পুণ্য অর্জন করত।
বিমূঢ় দৃষ্টিতে শরৎবাবুর দিকে তাকিয়ে বাল্যবন্ধু বললে-অতবড় দোতলা বাড়িটাকে ভেঙ্গেচুরে পুকুর বানিয়ে ফেলতিস? সে কি কখনও হয়?
শরৎবাবু বললেন–কেন হবে না বল। আরে, ওই বাড়িও তোর আমার নয়, জমিও তোর আমার নয়। হাতে যখন কলম আছে তখন সেই কলমের এক খোঁচায় বাড়ি ভাঙ্গতে কতক্ষণ আর পুকুর কেটে ঘাট ধাঁধাতে কতক্ষণ।