ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে সেদিন মেলা মানুষ। দুই দিকে পাথরের ওপর গথিক অক্ষরে যথাক্রমে হোসেন মঞ্জিল ও এম. টি হোসেন খোদাই-করা দুই পিলারের মাঝখানে কাঠের ফ্রেমে বাঁধা টিনের গেট হাট করে খোলা। দুই পাশের কামিনী গাছ দুটো পড়ে গেছে গেটের দুই পাল্লার আড়ালে।
ভেতরে পাঁচিল ঘেঁষে দুটো গোলঞ্চ, একটা বকুল ও একটা কণকচাঁপা গাছ। প্রতিটি গাছের নিচে দুই থেকে তিনজন লোক দাঁড়িয়ে জটলা করছে। তাদের কেউ কেউ কাদেরের মুখ-চেনা, কিন্তু তারা তাকে আমল না দিয়ে নিজেদের মধ্যে গুজুরগাজুর চালিয়ে যায়। লন পেরিয়ে জোড়া ঝাউগাছের মাঝখানে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠেও কাদেরের সুবিধা হয় না, সেখানে পেতে রাখা চেয়ার ও বেঞ্চের একটিও খালি নাই। হলঘরের কপাট একটা ভেজানো, আরেকটা প্রায়-খোলা। খোলা কপাটের সামনে দাড়িয়েই কাদের ইসমাইলের হাতের ইশারা টের পায়। ঘরের ভেতরেও বসবার আসন সব ভর্তি। কর্মী গোছের কয়েকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাদেরকেও দাঁড়িয়েই থাকতে হয়।
সোফায় বসে অবিরাম কথা বলে চলেছে ডাক্তার শামসুদ্দিন খোন্দকার। জেলা মুসলিম লীগের প্রবীণ নেতা, থার্টি সেভেনে প্রজা পার্টির টিকেটে এম এল এ হয়ে বছর তিনেক পর মুসলিম লীগে জয়েন করে। মানুষটা রাশভারী না হলেও স্বল্পবাক, এ্যাসেম্বলি কিংবা বাইরে কখনো মুখ খোলে না। রোগীদের সঙ্গে প্যাচাল পাড়তে হয় বলে ডাক্তারি ছেড়েছে এম বি পাস করার দুই বছরের মাথায়। এখন রাইস মিল, বাংলা সাবানের কারখানা ও কেরোসিনের ডিলারশিপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। লীগ অফিসেও তার যোগাযোগ নাই বললেই চলে। রাজনীতি সম্বন্ধে তার চিন্তাভাবনা বা প্রতিক্রিয়া যা প্রকাশ করার সব পেশ করে আসে জেলা মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট খান বাহাদুর সৈয়দ আলি আহমদের দরবারে।
তা সেই মানুষ আজ এসেছে ইসমাইলের বাড়িতে এবং এতোটাই সবাক হয়ে উঠেছে যে, সবাই চুপচাপ তার কথা শোনে। শ্রোতাদের নিরঙ্কুশ মনোযোগে তার বাক্য পায় বাণীর মর্যাদা, সূর্যের চড়া তাপ সহ্য করা যায়। না কী বলেন? কিন্তু তপ্ত বালুতে হাঁটতে গেলে পায়ে ফোস্কা পড়ে। না কী?
শ্রোতাদের মৌনকে সম্মতির লক্ষণ বিবেচনা করে খন্দকার তার বাণীর ব্যাখ্যা শোনায়, বুঝলেন না? সবার দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে শ্রোতাদের বোঝার ক্ষমতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে সে বোঝায়, জমিদারের অত্যাচার সহ্য করা যায়। কেন? না, তার আগামাথা আছে, নিয়মকানুন আছে। কিন্তু ছোটলোকরা তো নিয়ম জানে না, আইন মানে না। না কী? এইগুলো হলো বেয়াদব, বেয়াদবের জুলুম গায়ে জ্বলে। জ্বলে না? এখন মুসলিম লীগের ওয়ার্কাররা যদি এদের সঙ্গে থাকে তো পার্টি করতে পারবেন? বলেন, পারবেন? * ইসমাইল তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে, আরে ডাক্তার সাহেব, ওসব হলো তেভাগার এরিয়া। আমাদের ওয়ার্কারদের মধ্যে বর্গা খেটে খায় প্রায় সবাই। এখন অন্য বর্গা চাষীদের তারা অপোজ করে কীভাবে?
এবার ইসমাইলকে উপদেশ দেওয়ার সুযোগ নেয় সাদেক উকিল, ছোঁড়াদের। ডেকে বলে দাও, তোমরা ইসলামের কথা বলো। মাথা গরম না করে পাকিস্তান হাঁসেলের কথা বলো। ইসলাম গরিবদের হক আদায় করে। ইন পাকিস্তান উই উইল ইনট্রোডিউস জাকাত। আল্লা যাকে দৌলত দিয়েছেন সে তার প্রপার্টির টু এ্যান্ড হাফ পার্সেন্ট কন্ট্রিবিউট করবে জাকাত ফান্ডে। ইসলাম ইজ এ ফুল কোড অফ লাইফ। আর কোনো রিলিজিওনে গরিবকে এতো রাইট দেওয়া হয়েছে? আবার কারো প্রপার্টি লুটপাট করাও ইসলাম এ্যাপ্রুভ করে না। কায়েদে আজমের মটোই হলো, লিভ এ্যান্ড লেট লিভ। অর্থাৎ নিজে।
সাদেক উকিলের কথা বলা মানেই বক্তৃতা দেওয়া, তার ইংরেজি বাক্যের বাঙলা অনুবাদ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই শামসুদ্দিন ডাক্তার তার ও কায়েদে আজমের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করে, আমি তো তাই বলি। ওইসব ছোঁড়ারা যা করছে তাতে এলাকার ভদ্রলোকদের পক্ষে আমাদের পার্টিতে থাকা অসম্ভব।
আদমদিঘির মজিদ সরকার বসেছিলো শামসুদ্দিন ডাক্তারের পাশে এবং অনেকটা তার আশ্রয়েও বটে। ইসমাইল তার দিকে মুখ ফিরিয়ে হাসে, দলের ওয়ার্কারদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি এতোই খারাপ? ওদের ওপর আপনার হোল্ড নেই? অন্তত আপনাকে তো মানবে!
ইসমাইলকে এবার বেশ জুত করে ধরা যাচ্ছে দেখে ডাক্তার পুলকিত হয়, আরে এরা তো সব আপনার রিকুট। বলে পুরো অবস্থাটার বিবরণ দেয় দ্বিতীয়বার। আবদুল কাদের প্রথমবার মিস করেছিলো, কিন্তু অন্যান্য শ্রোতার মনোযোগও তার চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়।-জেলার পশ্চিমে অনেকটা এলাকা জুড়ে আধিয়াররা ধান কেটে তুলছে নিজেদের ঘরে। তুলুক। কিন্তু নিজেরাই ধান মেপে এক ভাগ দিতে চায় জোতদারকে আর দুই ভাগ নেবে নিজে। তা এ উৎপাত তো অনেক দিন থেকেই হচ্ছে। টাউনের মানুষ ইসমাইলের তাতে কী? কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো এই যে, ওইসব বর্গাচাষীদের অনেকেই মুসলিম লীগের ওয়ার্কার, লীগের লোক বলে তাদের সবাই চেনে। এমন কি আদমদিঘির দুই মাইল পুবে শান্তিগড় বাজারে মুসলিম লীগের সাইনবোর্ড টাঙানো ঘরটিও ওদেরই দখলে।—এরা নিজেরা জোতদারদের পাওনা তো দিচ্ছেই না, এমন কি কম্যুনিস্টদের সঙ্গে ভিড়ে ধান সব নিজ নিজ ঘরে তোলার জন্যে নিরীহ গ্রামবাসীদের উস্কানি দিচ্ছে; ফলে পাকিস্তান ইস্যু মার খাচ্ছে। এলাকার ভদ্রলোকদের সাপোর্ট ছাড়া দল টেকে কী করে?
সাদেক উকিল তার বক্তৃতা সম্পূর্ণ করার আশা ছেড়ে দিয়ে একটু রাগ করেই পড়তে শুরু করে দিয়েছিলো আগের দিনের দৈনিক আজাদ। দার্জিলিং মেলে কাগজটা টাউনে পৌঁছুবার সঙ্গে সঙ্গেই সে নিশ্চয়ই এটা তন্ন তন্ন করে পড়ে ফেলেছে। এই দৈনিকের চিঠিপত্র কলামে স্থানীয় সমস্যা, স্কুল স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা, ইসলামের আলোকে নানা সমস্যার সমাধান প্রভৃতি বিষয়ে তার লেখা ছাপা হয় তিন মাসে অন্তত একবার। সাদেক এখন কাগজের কোন পৃষ্ঠা পড়ছে আড়চোখে তাই দেখে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে কথা বলছিলো শামসুদ্দিন ডাক্তার। কিন্তু এবার বাধা আসে অন্যদিক থেকে। মজিদ সরকার কথা বলতে চেষ্টা করছিলো অনেকক্ষণ ধরে, এবার সে ডাক্তারের দীর্ঘ কাশিজনিত বিরতির সুযোগ নেয়, হামাগোরে সর্বস্বান্ত করা দিলো। আরে হামার বর্গাচাষা হামার জমির ধান লিয়া গেলো লিজের ঘরত, আবার শুনি ওই চাষা বলে হামারই পার্টির মানুষ। মানষে হাস্যে, ইগলান কী পার্টি করো গো?–আক্কেলপুর ইস্টিশনত ট্রেন লেট করায়া তমিজুদ্দিন খান সাহেবকে দিয়া লেকচার দেওয়ালাম। গাঁয়ের মধ্যে থাকা মানুষ লিয়া আসিছি। কতো ওয়ার্কারেক চিড়াগুড় খিলালাম। এখন ওই নেমকহারামরাই হামার বর্গাদারেক উস্কানি দেয়। হামাক সর্বস্বান্ত কর্যা ফালালো।
তিন হাজার বিঘা জমির মালিকের সর্বস্বান্ত হওয়ার সম্ভাবনায় সবাই খুব চিন্তিত। তাদের সমবেত দীর্ঘশ্বাস পড়ে, এই দীর্ঘশ্বাস ইসমাইলের প্রতি প্রতিবাদ প্রকাশও বটে। কারণ ওই এলাকায় ওইসব ছোটলোকদের লীগে ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছে ইসমাইল। ইসমাইল হোসেন আসলে পুব এলাকার মানুষ। তাও আবার দুই তিন পুরুষ টাউনের বাসিন্দা। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সে ছিলো কলকাতায়। জেলার কোথায় কী হাল সে তার জানেটা কী? তখনি তাকে ইশারা দেওয়া হয়েছিলো, দল করতে গিয়ে যে সে মানুষের কাছে যাওয়াটা পরে দলের জন্যে বিপজ্জনক হতে পারে। ইচ্ছেও তো তাই।
ইসমাইল কোণঠাসা হয়েছে বুঝতে পেরে ডাক্তারের উত্তেজনায় মেশে উল্লাস, কিন্তু নিজেকে সংযত রেখে সে ছোটো ছেলেকে বোঝাবার ভঙ্গিতে ইসমাইলকে বলে, মজিদ সরকার, আলি মামুদ খাঁ, আলতাফ মণ্ডল, আবুল হোসেন, মোহাম্মদ হোসেন পাইকার এরা আজকের বড়োলোক নয়, একেকটা থানা জুড়ে এদের প্রতিপত্তি। এদের মতামত নিয়ে ওইসব এলাকার পুলিস যায় চোর ডাকাত ধরতে। এদের সম্পত্তিতে গতর খাটিয়ে সমস্ত এলাকার মানুষের রেজে আসে। এমন কি পুব এলাকার চাষারা ধান কাটার সময় রোজগার করতে যায় এদের জমিতেই। এখন এইসব মাথা মাথা মানুষের মাজা ভেঙে দিলে ওখানে মুসলিম লীগ করবে কে? ওইসব বেয়াদব ছোটোলোকদের কাছে লীগকে বন্ধক দিলে পাকিস্তান টাকিস্তান সব ফাঁকি।
ইসমাইল এর মধ্যে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে, আরে রাখেন। জয়পুর, আদমদিঘি, পাঁচবিবি, আক্কেলপুরে ফর্টি ওয়ানে আমরা গিয়েছি না? আবুল হাশেম সাহেব এসেছিলেন, মনে আছে ডাক্তার সাহেব?
কিন্তু ডাক্তার শামসুদ্দিন খোন্দকারের স্মরণশক্তির পরীক্ষা না নিয়েই সে বলে চলে, ওদিকে কোনো জোতদারের কোঅপারেশন পাওয়া গেলো না। শ্যামা-হক ক্যাবিনেট, বড়োলোকরা অন্যদিকে ঝুঁকতে ভয় পায়। আরে ভাই, কোথাও মিটিং করা যায় না। পাঁচবিবিতে নাসের মণ্ডল খুব পাওয়ারফুল লোক, তিনি আছেন কম্যুনিস্টদের সঙ্গে। তিন বছর আগের কথা বলতে বলতে ইসমাইল চাঙা হয়ে ওঠে, শেষকালে নাটোরের উকিল কিরণ বাবুর সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, কিরণ মৈত্র, পুরনো কংগ্রেসি, বললেন, নাসির মণ্ডলকে ভালো করে ধরো, তাঁকে হাত করতে পারলে তোমাদের মিটিং হবে। তো গেলাম। বুড়ো কি রাজি হয়?
এই গল্প ডাক্তার ও সাদেক উকিলের জন্যে অস্বস্তিকর, নাসির মণ্ডল এদের কাউকেই এ পর্যন্ত তার এলাকায় ঢুকতে দেয় নি। সাদেক উকিল অস্বস্তি কাটাতে বলে, আরে আপনার নাসির মণ্ডলকে তো আমি এক হাত নিলাম একবার শান্তহারে। বললাম, আপনারা লড়াই করেন আল্লার বিরুদ্ধে, আমরা জেহাদ করি আল্লার হুকুমত কায়েম করতে। ইসলাম ইজ এ ফুল কোড–। এবারেও তার ভাষণ অসমাপ্ত থাকে ইসমাইলের কথার তোড়ে, আঃ! শোনেন না। আমি গিয়ে বুড়োকে বললাম, মণ্ডল সাহেব, আপনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েও যদি কম্যুনিস্টদের শেলটার দিতে পারেন তো আমরা কী দোষ করলাম? আমাদের মিটিং প্রিজাইড করবেন আপনি। আমাদের বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তাই বলবেন। কিন্তু আমাদের নেতাকেও বলতে দিতে হবে। বুড়ো তখন রাজি। নিজের লোকজন নিয়ে মিটিং অর্গানাইজ করালেন। হাশেম সাহেব পাক্কা দেড় ঘণ্টা বক্তৃতা করলেন। দারুণ রেসপন্স পাওয়া গেলো। আমরা তো চাষীদের কথাই বললাম। কয়েকটা ইয়াং ছেলে, চাষী ঘরের ছেলে, আমাদের সঙ্গে জয়েন করলো। ওদের দিয়ে লোকাল কমিটি ফর্ম করে রাত্রে নাসির মণ্ডলের বাড়িতে ভুরিভোজন সেরে দার্জিলিং মেলে নামলাম শান্তাহার।
বুঝলাম। কিন্তু ছেলেগুলো কি আসলে আমাদের ইডিওলজিতে সাদেকের কথায় ফের বাধা দেয় ইসমাইল, তার গল্প এখনো শেষ হয় নি, শোনেন না! শান্তাহারে নেমে দেখি কিরণবাবু। আমাদের মিটিঙের খবর শুনে মহা খুশি। শান্তাহার রেলওয়ে এন্টারটেনমেন্ট রুমে আমাদের লাঞ্চ করালেন। এতে খুশি কেন? তাহলে এবার তারা কংগ্রেসের মিটিং করতে পারবেন। করুন। আমাদের কী? হিন্দুরা যতো খুশি কংগ্রেস করুক। মুসলমান ছেলেরা তো আমাদের সঙ্গেই চলে এলো। ওই মিটিংটা না হলে ঘোড়াগুলোকে কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে সরানো যেতো?
সরিয়ে লাভ কী হলো? ইসমাইল হোসেনের কৃতিত্বকে নস্যাৎ করার উদ্যোগ নেয় সাদেক উকিল, ওদের মাইন্ড তো চেঞ্জ করতে পারলেন না। পাকিস্তানের ইডিওলজি কি ওরা মেনে নিয়েছে?
মাঝখান থেকে মুসলমান ভদ্রলোকেদের বিপদে ফেললেন। মুসলিম লীগের মেম্বার হয়ে মুসলমানদের মধ্যে ডিভিশন তৈরি করতে উঠে পড়ে লেগেছে। ডাক্তারের অভিযাগের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করে চণ্ডিহারের আলতাফ মণ্ডল, কিসের মোসলমান? ওঠাবসা সব সাঁওতালগোরে সাথে। সাঁওতালরা আগে কী সুন্দর বর্গা করিচ্ছিলো, ওরা জমিত হাত দিলেই ফসল, ভাগাভাগির সময় কোনো ক্যাচাল নাই। আপনের এই ছেড়াগুলার পাল্লাত পড়া ওরাও এখন ধান তোলে নিজের ঘরত। সাঁওতাল মোসলমান আধিয়াররা একজোট, আপনের কিসের পাকিস্তান? উপায়ন্তর না দেখ্যা হামরা ডাক্তার সায়েব আর উকিল সায়েবেক ধরা আজ গেলাম খান বাহাদুর সাহেবের দরবারে। তা সাহেব কলেন,।
প্রসঙ্গটি তোলা ডাক্তারের পছন্দ হয় নি। আলতাফ মণ্ডলকে সে থামিয়ে দেয়, আরে তিনি হলেন শরিফ মানুষ। বেন্নার ঘরের বেতমিজ ছোকরাদের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন নাকি?
কিন্তু ছোটোঘরের বেতমিজ ছোরাদের ঠেকাতে না পারলে আলতাফ মণ্ডলের ধানপান, জোতজমি; মানইজ্জত সব রসাতলে যায়। বাঁচার জন্যে খড়কুটো ধরতেও সে ব্যগ্র, তা খান বাহাদুর সাহেব মনে হলো খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন। কলেন, ওরা সব ইসমাইলের লোক। ইসমাইলকে বলেন, ওদের ঠাণ্ডা করুক।
খান বাহাদুরের দুর্বলতার কোনোরকম প্রকাশ ডাক্তার শামসুদ্দিন খোন্দকারের। নিজের অপদস্থ হওয়ার সামিল। সে তাই বিরক্ত হয়ে বলে, আরে আলতাফ মিয়া, অতো ভয় পান কেন? দুশ্চিন্তা তো খান বাহাদুর করেন না, দুশ্চিন্তায় মরেন আপনারা। অতো ঘাবড়ান কেন? দেখেন না, সপ্তাহখানেকের মধ্যে নাজিমুদ্দিন সাহেব আসবেন বালুরঘাট। আমাদের খান বাহাদুর সাহেবও যাবেন। ঢাকা ফেরার পথে খান বাহাদুর যদি নাজিমুদ্দিন সাহেবকে এদিকে এনে জয়পুর কি শান্তাহারে একটা মিটিং করাতে পারেন তো তাতেই কাজ হবে। ভালো একটা মিটিং হলে এইসব ছোঁড়াদের পিটিয়ে গ্রামছাড়া করা যাবে।
আরে রাখেন! ইসমাইল তাকে কিংবা নাজিমুদ্দিন কিংবা দুজনকেই উড়িয়ে দিতে পাশের টেবিলে জোরে চাপড় মারে। টেবিলের ওপর কাপ পিরিচ ঝনঝন করে বাজলে তার প্রভাব পড়ে ইসমাইলের গলায়, ওইসব ছেলেদের হোস্টাইল করে রেখে নাজিমুদ্দিন শান্তাহারে নামতে পারবে? জয়পুর দিয়ে পাস করতে পারে কি-না দেখেন। ইন ফ্যাক্ট, দে আর আওয়ার বেস্ট ওয়ার্কার্স ইন দি হোল ডিস্ট্রিক্ট।
আলতাফ মণ্ডল উঠে দাঁড়াবার ভঙ্গি করে, তাহলে আর কী? আপনারা ওই চ্যাংড়াপ্যাংড়াক লিয়াই থাকেন। হামরা আর থাকি ক্যাংকা করা?
ডাক্তার তার হাত ধরে বসিয়ে দেয়, আরে, পলিটিক্স করেন, এতো রাগ করলে চলে? বসেন।
ভালো করে বসেও আলতাফ মণ্ডলের রাগ আর পড়ে না, হামরা কি আর পলিটিক্স করি? পাড়াগাঁয়ের মানুষ, পলিটিক্সের হামরা বুঝি কী? আপনারা পাকিস্তানের কথা কন, পাকিস্তান হলে এসলামের ইজ্জত হয়, মোসলমানের মাথাটা উঁচা হয়। এসলামের খেদমত করলে আল্লা খুশি হয়, লিজের জানটাও শান্তি পায়। তাই কৃষক প্রজা বাদ দিয়া নাম লেখালাম মুসলিম লীগের খাতৃত। হায় আল্লা, এখন দেখি, আল্লারসুল মানে না, নামাজরোজার তো ধারই ধারে না, এইসব মানুষের পিছে ছোটে যিগলান চ্যাংড়া আপনারা লীগের চাবি দিয়া থুছেন সেইগুলার হাতে। ঠিক আছে, লীগ পাট্টি তারাই করুক।
আলতাফ মণ্ডলের কথার ঝঝে সবাই একটু নড়েচড়ে বসলে আলি মামুদ খা খুব খুশি হয়, আবার মণ্ডলের এক নাগাড়ে এতো কথা বলার শক্তিতে তার হিংসাও একটু হয়। সে বলে, লাল লিশানের পাট্টির চ্যাংড়াপ্যাংড়া লিয়া আপনার লীগের ফায়দা হবি না। গণেশতলাভহামার মামুগোরে জমি বর্গা করে এক চাষা, তার বেটা, বুধা করা কয়, এক্কেরে হালুয়া চাষা, উঁই একজোট হছে ওই তেভাগার হুজুগেত। শালা হালুয়া চাষার বেটা, আল্লারসুল তো মানেই না। সেটা আল্লাই বিচার করবি, ছোঁড়া লিজের আখেরাত লিজেই খোয়ায়, হামার কী?—কথা সেটা লয়। কথাটা কী তাই বলতে গলার স্বর একটু নামায় সে, আপনারা বিশ্বাস করবেন না। হামার মামু লিজে কছে। মামু হামার হাজি মানুষ, নামাজ কাজা করে না। মিছা কথার মানুষ লয়। সত্যবাদী মামার সরবরাহকৃত তথ্যটি জানাতে তার গলা নামে আরো নিচে, ফিসফিস করে বলে, বুধা শালা কাছিমের মাংসও খায়! হারামখোর শালা! তারপর তার গলায় ফের জোর আসে, ইগলান মানষেক ইমাম মানিচ্ছে আপনার মুসলিম লীগের চ্যাংড়াপ্যাংড়া।
এদের সোজা এক্সপেল করে দেওয়া হবে। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে ডাক্তার শামসুদ্দিন খোন্দকার, এসব তো আর ছেলেখেলা নয়। সামনে ইলেকশন, আধিয়ার চাষার হাতে ভোট কটা আছে? ছয় আনা ট্যাক্স দেয় কয়জন?
ইসমাইল বলে, কিন্তু মুসলিম লীগের প্রোগ্রামে তো চাষীদের দাবিই বেশি। বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ—
কিন্তু আমাদের মজিদ সরকার, আলফাত মণ্ডল, আলি মামুদ খা এঁরা কি কেউ জমিদার? না মহাজন? জমিদারদের খাজনা দিতে এদের জান বেরিয়ে যাচ্ছে। এড়ুকেশন সেস ধরেছে জমিদারের ওপর, জমিদার এই টাকা জোগাড় করবে কোত্থেকে?
প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের জন্যে ধার্য এড়ুকেশন সেসের চাপে জমিদাররা একেবারে হেলে পড়েছে, সেই হাহাকার এরা একটু আগে শুনে এসেছে খান বাহাদুর সৈয়দ আলি আহমদের অসহায় কঠে। খান বাহাদুরের এমন সংকটে এরাও খুব দুঃখিত। তবে দুঃখের আর একটি কারণ হলো এই যে, ওই খাজনা তো জমিদার আদায় করবে প্রজাদের ঘাড় ভেঙে। চাষারাই কী কেবল প্রজা? বড়ো প্রজা তো জোতদার। ইসমাইল কি ওই বেয়াদব ছোঁড়াদের বোঝাতে পারে না যে, জোতদাররাও কেমন জুলুমের শিকার?
খান বাহাদুরের ওখানে নিজের বেদনার জন্যে চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটি মজিদ সরকার ছাড়ে এখানে, আমাদের উপরে জুলুম দুই দিক দিয়া। জমিদার লিত্যি খাজনা ধরে। ফ্লাউট কমিশন রেপোট দিলো, কই কিছু তো হয় না। জমিদারি উচ্ছেদ তো হামরাও চাই। আবার দেখেন লিচের দিকের বিপদ, জমির ফসল লিয়া যাচ্ছে আধিয়াররা। হামরা এখন করি কী? উদিন কবির তরফদার সাহেব কলেন, কৃষক প্রজা পার্টি কৃষকের দিকে দেখে, প্রজার দিকেও দেখে। বড়ো প্রজা কারা?-আপনারাই কন।
সাদেক উকিল ভয় পায়, এরা আবার নতুন করে কৃষক প্রজার সঙ্গে না ভেড়ে, আরে ওটা একটা পার্টি হলো? হক সাহেব আউট, পার্টিও শেষ। ইনডিয়ান মুসলমানের পার্টি একটাই। অল ইনডিয়া মুসলিম লীগ।
তা তো বটেই। ইসমাইল সুযোগ নেয়, মুসলমানদের মধ্যে মেজরিটি তো চাষাই। লীগের দাবির বেশিরভাগই তো চাষাদের জন্যে।–কম্পালসারি ফ্রি প্রাইমারি এড়ুকেশন হলে স্কুলে যেতে পারবে তো তাদের ছেলেমেয়েরাই। হাটে এগ্রিকালচারাল প্রোডাক্টস বিক্রির সময় টোল বন্ধ করার দাবি। সবই তো তাদের জন্যেই। তাদের ছেলেরা পার্টির ওয়ার্কার তো হবেই।
কিন্তু ইসমাইল সাহেব, আপনার পার্টির প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্ট করতে হলে ইলেকশনে আসতে হবে না? শামসুদ্দিন ডাক্তারের আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে, গ্রামের মুরুব্বিদের সর্বনাশ করে আপনি ভোট পাবেন না। হিন্দু ক্যানডিডেট সব আসবে কংগ্রেস থেকে, ওদের ইউনিটি আছে। মুসলিম কনষ্টিটিউয়েনসিতে জোতদাররা আমাদের সাপোর্ট নাও দিতে পারে, আমাদের ওয়ার্কাররা ওদের জমি লুট করবে আর ওরা আমাদের পক্ষে থাকবে, এটা আশা করেন কীভাবে? কংগ্রেস, কৃষক প্রজা পার্টি মুসলিম ক্যানডিডেট দেবে। দেবে না? মুসলমান ভোট ভাগ হয়ে গেলে কে আসবে। শিওর করে বলতে পারেন? গ্রামে ভোট অর্গানাইজ করবে কারা? কারা করবে?—গ্রামের মুরুব্বিরাই তো, না কী?
ইসমাইল একটু গম্ভীর হয়ে পড়লে সাদেক উকিল বলে, জোতদারদের ধান লুট করা কি মুসলিম লীগের প্রোগ্রামের মধ্যে আছে নাকি? ইসলামে কি এসব লুটপাট জায়েজ করা হয়েছে?
ইসমাইল চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। তাদের দলের ভালো ভালো কর্মীদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে কম্যুনিস্ট পার্টি,এটা তো ঠিক হচ্ছে না। আর ইলেকশনে গ্রামের মাতব্বররা বড়ো ফ্যাক্টর। ছাত্রজীবনে মেয়র ইলেকশনে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে, কলকাতার শিক্ষিত মানুষও ভোট দেয় দল বেঁধে। তাদের মুরুব্বি আছে, সমাজ আছে, সমাজের ভেতর উপ-সমাজ আছে। ইলেকশন করতে গেলে এসব খেয়াল করতে হয়। এখানে ভোটার হলো পাড়াগাঁয়ের মানুষ। তাদের মধ্যে আবার ছয় আনা ট্যাকস দেয় যারা ভোট দেবে কেবল তারাই। বিয়েশাদি, আকিকা, মুর্দার দাফন, চেহলাম, ভোট এসব তারা করে সমাজ মেনে।
কম্যুনিস্টদের সঙ্গে কাজ করছিলো এরকম কিছু ছেলে লীগে আসায় তার খুব ভালো লাগছিলো। জেলার পশ্চিমে কয়েকটা জায়গায় তেভাগার বেশ জোর, এই ছেলেগুলোকে ধরে রাখতে না পারলে এরা সবাই তো কম্যুনিস্ট হয়ে যাবে। এই বুড়োগুলো এটা বোঝে না কেন? আবার সে নিজে কম্যুনিস্ট না হয়েও যদি গরিব মুসলমানদের কিছু হেলপ করতে পারে কম্যুনিস্টদের সাহায্যে, তাতে তো বরং তার দলেরই লাভ। ওর ছেলেবেলার বন্ধু অজয় আর ওর বোন প্রতিমা তো তার রেডক্রসের দুধ বিলি করতে। মেলা সাহায্য করলো। ফেমিনের সময় ইসমাইল কতো লোককে দাফন করেছে, তখন এইসব বুড়ো ছিলো কোথায়? বীরেন, সমীর, সুকুমার এরাই তো সঙ্গে সঙ্গে থাকতো। গোলাবাড়িতে মুসলিম লীগের সাইনবোর্ড লটকানো কাদেরের দোকান থেকে রেডক্রসের রিলিফের মাল দিলো, এই নিয়ে কংগ্রেসের লোকজন তো ওপরে নালিশও করেছিলো। রেডক্রসের বৃটিশ সাহেব এই ব্যাপারে ইনকুয়ারি করতে এলে অজয়ই তো ইসমাইলের পক্ষে মেলা যুক্তি খাড়া করিয়ে সাহেবকে বুঝিয়ে দিলো। সবই ভালো—কিন্তু তার দলের ছেলেদের দিয়ে ওরা যদি মুসলমানদের মধ্যে ডিভিশন তৈরী করে তো পাকিস্তান দূরের কথা, মুসলিম লীগ টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হবে।
ইসমাইলের এই নীরব অস্বস্তিকর ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে চলে সাদেক উকিলের সরব সিদ্ধান্ত, আপনারা ভাববেন না। আপনাদের ওদিকে মিটিং অর্গানাইজ করেন। ইসলামিক ইডিওলজি ভালো করে বোঝাতে হবে। তাহলেই ওসব লুটপাতের ভুত ঝাড়ানো যাবে। তার ছাড়া ছাড়া কথাগুলোই ইসমাইলকে বেশ ভাবনায় ফেলেছে দেখে নিজের সাফল্যে তৃপ্ত হয়ে সে বেশ লম্বা ডায়ালগ ছাড়ে, লেট আস আর্নেস্টলি হোপ এ্যান্ড ট্রাস্ট দ্যাট দি মোস্ট নোবল টিচিং এ্যানড একজাম্পলস অফ আওয়ার হোলি প্রফেট উইল বি ফলোড বাই অল দি মুসলমানস, দ্যাট ইজ ল্যান্ড টিলার্স এ্যান্ড শেয়ারক্রপার্স, জোতদারস এ্যান্ড লাভলর্ডস, পুওর এ্যান্ড রিচ, এড়ুকেটেড এ্যান্ড ইললিটারেট নট ওনলি অফ দি এরিয়া উই আর টকিং এ্যাবাউট বাট গ্রুআউট দি লেংথ এ্যান্ড ব্রেডথ অফ ইনডিয়া। ব্রাদার্স, নেভার ফরগেট দ্যাট ইসলাম ইজ এ ফুল কোড অফ লাইফ। ইট গিভস আস এভরিথিং উই নিড। ইট অফারস আস দি উইপন টু ফাইট ফর পাকিস্তান হুইচ রিমেইনস আওয়ার গোল টিল উই এ্যাচিভ ইট।
ইসমাইল হোসেন যথেষ্ট কোণঠাসা হয়েছে বিবেচনা করে শামসুদ্দিন ডাক্তার ব্যাপারটা এখানেই খান্ত করতে চায়। ইসমাইলটা চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে বেশি। খান বাহাদুরের সামনে প্রায়ই বেয়াদব হয়ে পড়ে, মুসলিম লীগকে নবাব নাইটদের পকেট থেকে বের করে আনতে হবে বলে তড়পায়। খান বাহাদুরের সামনে তাকে এমনি ঘায়েল করতে পারলে কাজের মতো কাজ হতো একটা! এতো খানদানি লোকটাকে ইসমাইল কম বেইজ্জত করে না। আগে মুসলিম লীগের অফিস ছিলো খান বাহাদুরের বাড়িতে, এই ইসমাইল এখানে এসে জোর করেই ঝাউতলায় অফিস ভাড়া করলো, লোহার প্যাচানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলার সেই খুপরি ঘরে উঠতে খান বাহাদুর হাঁপিয়ে যায়। ফর্সা টকটকে মানুষ, লাল হয়ে যায়। একদিন তার সামনে একে একটু শিক্ষা দিতে হবে। আজ এই পর্যন্তই থাক। একে ঘায়েল অবস্থায় দেখে যাওয়াই ভালো। সাদেক উকিলের লম্বা ইংরেজি ডায়ালগে গেঁয়ো জোতদারগুলো আর ওয়ার্কাররা একেবারে মুগ্ধ হয়ে রয়েছে। ইসমাইলকে ইংরেজি বলার সুযোগ দিলে এই মুগ্ধতা স্থানান্তরিত হতে পারে। ঝুঁকি নেওয়ার দরকার কী?
সবাই উঠে দাঁড়ালে শামসুদ্দিন ডাক্তার ইসমাইলকে একটু তফাতে ডেকে নিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কী যেন বলে।