১৮. ইরতাজুদ্দিন খেতে বসেছেন

রাত নটা। ইরতাজুদ্দিন খেতে বসেছেন। তাঁর সামনে শাহানা বসেছে। সহজ ভঙ্গিতেই বসেছে। সে তার দাদাজানের দিকে প্লেট এগিয়ে দিল। ইরতাজুদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন, নীতু খাবে না?

শাহানা বলল, না।

সে কাল রাতে খায়নি। আজ সারাদিনেও না। শাহানাকে তা নিয়ে মোটেও। বিচলিত মনে হচ্ছে না। ইরতাজুদ্দিনের বিস্ময়ের সীমা রইল না। মেয়ে দুটি আশ্চর্য স্বভাবের।

ইরতাজুদ্দিন বললেন, তুই ওকে সাধাসাধি করিসনি?

করলে লাভ হবে না। কঠিন মেয়ে।

না খেয়ে কদিন থাকবে?

আরো তিনদিন।

এতো মারা পড়বে।

শাহানা শান্ত গলায় বলল, না, মারা পড়বে না। পানি খাচ্ছে, চা খাচ্ছে। চায়ে চিনি আছে–শর্করা। ক্যালোরি খানিকটা চিনি থেকে পাবে।

তোর কাছ থেকে ডাক্তারিবিদ্যা শুনতে চাচ্ছি?

কি শুনতে চাচ্ছেন তা তো জানি না দাদাজান।

কিছুই শুনতে চাচ্ছি না। আমি ওর মুখ হা করে ধরব–তুই দুধ ঢেলে দিবি।

শাহানা সহজ গলায় বলল, সেটা ঠিক হবে না দাদাজান। শ্বাসনালীতে দুধ চলে যেতে পারে। ফোর্স ফিডিং যদি করাতেই হয় টিউব দিয়ে করাতে হবে।

তোর কি মোটেই দুঃশ্চিন্তা লাগছে না?

দুঃশ্চিন্তা করার এখনো কিছু হয়নি।

বাড়িতেও কি সে এ রকম করে?

না, হাঙ্গার স্ট্রাইক এই প্রথম করল।

ইরতাজুদ্দিন কঠিন গলায় বললেন, তোদের খুব বেশি হয়ে গেছে। এত তেজ হবার কারণটা কি?

কারণটা জেনেটিক। বংশসূত্রে পাওয়া।

ইরতাজুদ্দিন খেতে বসেও খেতে পারছেন না। তিনি দুপুরে খাননি। প্রচণ্ড খিদে থাকা সত্ত্বেও তিনি প্লেট সরিয়ে উঠে পড়লেন। অথচ শাহানা শান্ত ভঙ্গিতে খেয়ে যাচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি।

ইরাতাজুদ্দিন পুষ্পকে আনতে লোক পাঠিয়ে ঢুকলেন নীতুর ঘরে। নীতু শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল, সে উঠে বসল। দাদাজানের দিকে তাকিয়ে হাসল। ইরতাজুদ্দিন বসলেন তার পাশে।

কি বই পড়ছিস?

ভূতের বই দাদাজান। নিশিরাতের আতংক।

খুব ভয়ের?

খুব ভয়ের না, মোটামুটি ভয়ের?

ইরতাজুদ্দিন ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, পুষ্পকে আনতে লোক। পাঠিয়েছি।

থ্যাংক য়্যু দাদাজান।

ও এলে কি করতে হবে–তোর সামনে ক্ষমা চাইতে হবে?

আমার সামনে না চাইলেও হবে।

ইরতাজুদ্দিন পকেট থেকে সিগারেট বের করলেন। তিনি সিগারেট খান না। বললেই হয়। হঠাৎ হঠাৎ সিগারেট ধরান।

নীতু!

জ্বি।

পুষ্প মেয়েটা রাতে কোথায় ঘুমায়? তোর সাথে, না নিচে তার নিজের মাদুরের বিছানায়?

ও নিচে ঘুমায়।

ইরতাজুদ্দিন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন—মেয়েটা তোর হাত ধরে হাঁটছিল বলে আমি রাগ করেছিলাম। তোর কাছে মনে হল কাজটা খুব অন্যায় হয়ে গেছে। মানুষে মানুষে আমি প্রভেদ করে ফেলেছি। সেই প্রভেদটা তো তোর মধ্যেও আছে। তুই তো মেয়েটাকে পাশে নিয়ে ঘুমুচ্ছিস না? ওকে ঘুমুতে হচ্ছে মেঝেতে।

নীতু তাকিয়ে আছে। কিছু বলছে না।

ইরতাজুদ্দিন বললেন–যে ত্রুটি নিজের মধ্যে আছে সেই ত্রুটির জন্যে অন্যের উপর কি রাগ করা যায়?

নীতু বলল, না।

আমরা মুখে বলি–সব মানুষ সমান। মনে কিন্তু বিশ্বাস করি না। শুধুমাত্র মহাপুরুষরাই এই কাজটা পারেন। মনে যা বিশ্বাস করেন মুখে তাই বলেন। মহাপুরুষ চেষ্টা করে হওয়া যায় না। মহাপুরুষের বীজ ভেতরে থাকতে হয়। তোর ভেতর এই জিনিশটা নেই।

নীতু চুপ করে রইল। ইরতাজুদ্দিন বললেন–তোর ভেতর না থাকলেও শাহানার ভেতর এটা আছে।

কি করে বুঝলেন আপার আছে?

বোঝা যায়।

নীতু নিচু গলায় বলল–দাদাজান, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আপার মধ্যে এটা আছে। আমাদের বাসায় কাজের মেয়েদের যখন অসুখ হয় তখন ভাত মেখে আপা তাদের মুখে তুলে খাওয়ায়। দেখেই আমার যেন কেমন কেমন লাগে। আমি এই কাজটা কখনো করতে পারব না।

ইরতাজুদ্দিন বললেন, আয়, খেতে আয়। নীতু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। ইরতাজুদ্দিন বললেন, আমি যদি ভাত মেখে তোর মুখে তুলে দেই তাহলে কি তোর কেমন কেমন লাগবে?

নীতু বলল, লাগবে।

খাবার টেবিলে ইরতাজুদ্দিন নীতুকে নিয়ে বসেছেন। নতুন করে মাছ ভাজা হচ্ছে। গরম গরম ভেজে পাতে তুলে দেবে। নীতু প্লেটে ভাত নিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে অপেক্ষা করছে। ইরতাজুদ্দিন বললেন, কাল ভোরে মজার একটা ব্যাপার হবে। ভাবছিলাম তোদের বলব না, অবাক করে দেব। বলেই ফেলি–মিতু আসবে। সম্ভবত মোহসিনও আসবে।

বলেন কি?

শাহানাকে কিছু বলার দরকার নেই। ওকে চমকে দেব।

আপাকে চমকে দেবার জন্যেই কি এটা করেছেন?

না। আমি কাজটা করেছি নিজের স্বার্থে। ওরা এলে তোরা হয়ত আরো কয়েকদিন বেশি থাকবি। বাড়িটা গমগম করবে। মানুষ খুব স্বার্থপর প্রাণী, তারা নিজের স্বার্থটা দেখে।

প্রকাণ্ড এক টুকরা ভাজা মাছ চলে এসেছে। ভাজা মাছের গন্ধে বাড়ি ম-ম করছে। নীতুর জিবে পানি চলে এসেছে। এরকম তার আগে কখনো হয়নি। ইরতাজুদ্দিন হাসিমুখে নীতুর খাওয়া দেখছেন।

নীতুর অনেকদিন পর আজ প্রথমৃশ–তার দাদাজান মানুষটাকে যতটা খারাপ ভাবা গেছে তত খারাপ না।

দাদাজান!

হুঁ।

আপনি কি কোন ভয়ংকর ভূতের গল্প জানেন?

জানি। শুনবি?

হ্যাঁ শুনব।

খাওয়া শেষ করে আয় আমার ঘরে।

পুষ্প যদি আসে তাকে কি সঙ্গে করে নিয়ে আসব?

নিয়ে আসিস।

 

পুষ্প এল না। আসবে কি করে? তার বাড়িতে আনন্দের সীমা নেই। বাপজান এসেছে এতদিন পর। বাপের সঙ্গে এসেছে সুরুজ ভাই। ভাবভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে, সুরুজ ভাইয়ের সঙ্গে কুসুম বুর বিয়ে হবে। বাপজান আর মার মধ্যে ফিসফাস কথা হচ্ছেই। নিন্দালিশের বড় খালা এসেছেন। ফিসফাসের সঙ্গে তিনিও যুক্ত হয়েছেন। কুসুম বু সেজেগুজে ঘুরঘুর করছে। রোজ রাতে নারকেল তেল দিয়ে তার চুল বেঁধে দেয়া হচ্ছে। নিন্দালিশের বড় খালা নীলরঙা একটা শাড়ি এনেছেন। সেই শাড়ি পরার পর কুসুমবুকে আর পৃথিবীর মেয়ে বলে মনে হয় না। মনে হয় সে আকাশের মেয়ে–এক্ষুণি উড়ে আকাশে গিয়ে মিশে যাবে। এত মজা ছেড়ে রাজবাড়িতে আসার তার ইচ্ছে হচ্ছে না। ইরতাজুদ্দিন সাহেবের সামনে পড়তেও তার ভয় লাগছে। রাজবাড়ি থেকে দূরে থাকাই ভাল।

 

নীতুর দাদাজানের খাটটা ফুটবল খেলার মাঠের মত বিশাল। নীতু সেই বিশাল খাটের মাঝামাঝি বসে আছে। তার সামনে বালিশে হেলান দিয়ে ইরতাজুদ্দিন ভূতের গল্প শুরু করলেন—

আমি তখন যুবক মানুষ। এলএলবি পাশ করেছি। ময়মনসিংহ কোটে এসেছি–হাবভাব বুঝব। বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টারী পড়ার কথা হচ্ছে। আমার বাবা ময়েজউদ্দিন চৌধুরী যেদিন বলবেন বিলেত যা, সেদিনই যাব। তার কথার উপর কথা বলার সাহস কারোর নেই। তিনি বলেছেন, কিছুদিন কোটে ঘোরাফিরা কর। তাই করছি। ময়মনসিংহে বিরাট একটা বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে।একা থাকি। মাঝে মাঝে ময়মনসিংহ কোর্টের পেশকার ফখরুল আমিন সাহেবের বাড়িতে যাই দাবা খেলার জন্যে। আমার তখন দাবা খেলার খুব নেশা…

নীতু বলল, দাদাজান, এটা কি ভূতের গল্প।

না, ঠিক ভূতের গল্প না। এটা শুনে, তারপর ভূতের গল্প বলব। একদিন আমিন সাহেবের বাড়িতে দাবা খেলতে গেছি–গিয়ে শুনি উনি কি কাজে বিক্রমপুর গেছেন। তার বড় মেয়ে পর্দার আড়াল থেকে বলল, আপনি বসুন, চা খেয়ে যান। আমি বসলাম। মেয়েটা চা এনে দিল। নিজেই এনে দিল।

উনিই কি আমার দাদীজান?

ইরতাজুদ্দিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ।

তারপর?

মেয়েটাকে বিয়ে করলাম। বাবা খুব বিরক্ত হলেন। সামান্য পেশকারের মেয়েকে তাঁর ছেলে বিয়ে করবে এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে উঠলাম। বাবা মূল বাড়ির থেকে দূরে–এখানে যে কাঁঠালগাছটা আছে সেখানে ঘর বানিয়ে দিলেন। জোহরার থাকার জায়গা হল ঐ ঘরে।

উনার নাম জোহরা?

হুঁ।

আপনিও ঐ ঘরে থাকতে?

না। বাবা আমাকে বিলেত পাঠিয়ে দিলেন। ও একাই থাকত। বিলেত থাকার সময়ই খবর পাই ছেলে হতে গিয়ে ও মারা গেছে। ডাক্তার ছিল না, ওষুধপত্র ছিল না। অনাদর অবহেলায় তোর বাবার জন্ম হয়। তোর বাবা কি কখনো এইসব নিয়ে তোদের সঙ্গে গল্প করেছে?

না, তবে বাবা বলেছেন তিনি মানুষ হয়েছেন তার বড় মামা-মামীর কাছে।

এই বাড়িটা ছিল তোর বাবার কাছে এক দুঃস্বপ্নের বাড়ি। এখনো তাই আছে। সে কখনো আসে না–তার মেয়েদেরও আসতে দেয় না। এই বাড়িটা তার কাছে বন্দিশিবির।

আসলেই তো বন্দিশিবির।

বুবলি রে নীতু, এই বন্দিশিবিরে আমি সারা জীবন একা একা কাটিয়েছি। আমি কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে করিনি। ইচ্ছা করলেই বিয়ে করতে পারত ইচ্ছে হয়নি। এই ব্যাপারটা তোর বাবার চোখে পড়ল না। তোর বাবার শুধু চোখে পড়ল–আমার কারণে তার মা বন্দি হলেন রাজবাড়িতে। আমার কারণে তাঁর মৃত্যু হল।

আমার দাদীজান কি সত্যি সত্যি এই রাজবাড়িতে বন্দি হয়ে ছিলেন?

হ্যাঁ। আমার বাবা তাকে ঐ ঘর থেকে বের হতে দিতেন না। জোহরার মা বাবাভাই-বোন কারো সঙ্গে তাকে দেখা করতেও দেননি। বিলেত থাকার সময় আমি যেসব চিঠিপত্র তাকে লিখেছি সেসবও তাকে দেয়া হয়নি। তার কোন চিঠিও আমার কাছে পাঠানো হয়নি।

উনি কি খুব সুন্দরী ছিলেন দাদাজান?

হ্যাঁ।

উনার কোন ছবি আছে?

একটা আছে। দেখবি?

হ্যাঁ দেখব।

ইরতাজুদ্দিন খাট থেকে নামলেন। চাবি দিয়ে আলমারি খুলে ছবি বের করে। নীতুর হাতে দিলেন। কালো মেহগনি কাঠের ফ্রেমে বাধা ছবি। নীতু ছবি হাতে নিয়ে হতভম্ব গলায় বলল, এ তো অবিকল আপার ছবি!

ইরতাজুদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ, শাহানার সঙ্গে ওর সাংঘাতিক মিল।

ছবিটা আপনি সরিয়ে রাখেননি কেন দাদাজান? লুকিয়ে রেখেছেন কেন?

ইরতাজুদ্দিন জবাব দিলেন না। নীতু বলল, দাদীজানের কথা আরো বলুন, আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। উনি কি খুব হাসিখুশি মহিলা ছিলেন?

না। চুপচাপ থাকত। তবে ভয়ঙ্কর জেদ ছিল। যা বলবে তাই।

আমার মত?

হুঁ। খানিকটা তোর মত; যা নীতু, ঘুমুতে যা–রাত অনেক হয়েছে।

নীতু বলল, আজ আমি আপনার সঙ্গে ঘুমুব দাদাজান। যদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে।

ইরতাজুদ্দিনের পাশে নীতু শুয়ে আছে। এক সময় তার মনে হল তার দাদাজান কাঁদছেন। নীতু ভয়ে ভয়ে একটা হাত তার দাদাজানের গায়ের উপর রাখল। ইরতাজুদ্দিন কাঁদছেন। তার শরীর কাপছে, সেই সঙ্গে কাঁপছে নীতুর ছোট্ট হাত।

যে হাত একজন নিঃসঙ্গ মানুষের প্রতি মমতায় আর্দ্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *