বিশ্বব্যাপী শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রীয় সংস্থা ইউনেস্কোতে বছর তিনেক ছিলাম। নানা কাজে সারা পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণী ও মনীষীদের সমাগম হয় ইউনেস্কো হেড কোয়াটার্সে। কখনও কাজে, কখনও ককটেল-ডিনার রিসেপশনে তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার দেখা হতো। আলাপ হতো। কখনও কখনও এদের সঙ্গে ঘুরতে হতো বিভিন্ন দেশে।
ওই তিন বছরে এমন অনেককে কাছে পেয়েছি যাদেব সান্নিধ্যলাভে আমার জীবন ধন্য হয়েছে। এদের কাছে কত কথা শুনেছি, কত কথা জেনেছি। আমি বিস্মিত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি এদের পাণ্ডিত্য ও মহানুভবতা দেখে।
তন্ময় আমাকে অনেক দুঃখ, ব্যথা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মনে মনে আমি ওর প্রতি কৃতজ্ঞ। কারণ? কারণ ওরই আগ্রহে ও প্রচেষ্টায় আমি ডক্টর রবার্ট কিং-এর সামধ্যে আসি এবং আমার জীবনে এক অনন্য অধ্যায়ের সূচনা হয়। আজ যে আমি ইউনাইটেড নেশনস্ এ আছি, তার পিছনেও তো ওদেরই অবদান।
একদিন রাগ করেই কাকুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সুপর্ণা-অমিয়র আস্তানায় উঠি। কিন্তু আজ যখন নিজের অতীতের কথা ভাবি, ভালো মন্দের হিসাব দেখতে বসি, তখন মনে হয়, আমার জীবনে ওই চরিত্রহীন কাকুর অবদানও কম নয়। হাজার হোক, পিতৃ-মাতৃহীন তোমার এই দিদি তারই স্নেহচ্ছায়ায় উচ্চ শিক্ষালাভ করে। আমি লেখাপড়ায় নেহতি খারাপ ছিলাম না কিন্তু পড়াশুনার জন্য খুব বেশি পরিশ্রম করতে একটুও ভালো লাগত না। বিশেষ করে বাবা-মাকে হারাবার পর এমন একটা সময় এসেছিল যখন আমি সত্যি সত্যি লেখাপড়া ছেড়ে দেবার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু না, তা হয়নি; হতে পারেনি শুধু ওই মানুষটার জন্য। যখন রিসার্চ করছি, তখন মাঝে মাঝেই মনে হতো, কী হবে রিসার্চ করে? ডক্টরেট হব? অধ্যাপনা করব? না, না, পোষা ময়না পাখির মতো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর একই কথা ছাত্রছাত্রীদের বলতে পারব না।…
পর পর তিন-চারদিন শুধু গল্প-উপন্যাস পড়ছিলাম আর বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখছিলাম। প্রথম কদিন কাকু কিচ্ছু বললেন না। তারপর একদিন ইভনিং শোতে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরতেই কাকু হাসতে হাসতে বললেন, আই ফিল হ্যাপি টু সী ইউ এনজয়িং।
আমি একটু হেসে বললাম, থ্যাঙ্কস।
মাঝে মাঝে এই রকম আনন্দ করা খুব ভালো।
আমি তো ভাবছি এইভাবে আনন্দ করেই জীবনটা কাটিয়ে দেব।
শুধু আনন্দ করেই কাটিয়ে দেবে?
হ্যাঁ।
পারবে?
না পারার কি আছে?
কাকু মাথা নেড়ে বললেন, না কবিতা, পারবে না। কোনো মানুষই শুধু আনন্দ করে জীবন কাটাতে পারে না। কম-বেশি কিছু কাজ কর্ম দায়িত্ব পালন না করে মানুষ বাঁচতে পারে না। তুমিও পারবে না।
আমি তর্ক না করে চুপ করে রইলাম।
পরে, রাত্রে শোবার পর কাকু বললেন, সবাই লেখাপড়া করে না। সম্ভবও না। তোমার বাবা-মা বেঁচে থাকলে কেউ কিছু বলতে পারত না, কিন্তু এখন তুমি লেখাপড়া বন্ধ করালে সবাই আমাকে দোষারোপ করবে। সবাই মনে করবে, লেখাপড়ার ব্যাপারে আমার কোনো উৎসাহ নেই বলেই তোমার লেখাপড়া হল না।
তাই কী?
হা কবিতা, সবাই তাই ভাববে। তাছাড়া তুমি লেখাপড়া না করলে আমি নিজেও মনে মনে অপরাধী হয়ে রইব।
আমি চুপ করে থাকি।
কাকু আবার বলেন, তুমি এম. এ. পাশ করলে, ডক্টরেট হলে আমিও সবাইকে গর্ব করে বলতে পারতাম…।
বিশ্বাস কর ভাই, কাকু কত রাত্রি না ঘুমিয়েও আমার নোটস টুকে দিয়েছেন। রিসার্চ করার সময় যে বই আমি কোথাও খুঁজে পেতাম না, সে বই কাকুই জোগাড় করে এনে দিতেন। শুধু কী তাই? কাকু নিজে টাইপরাইটারে টাইপ করে দিয়েছিলেন আমার থিসিস। অত্যন্ত পরিশ্রমের ও একঘেয়ে কাজ। আমি বার বার বারণ করেছিলাম কিন্তু না, উনি কিছুতেই শুনলেন
দুহাত দিয়ে হুইস্কীর গেলাসটা ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে কাকু বললেন, আমি জানি কবিতা, তুমি কিছু টাকা খরচ করলেই থিসিসটা ছাপিয়ে দিতে পারে কিন্তু তোমার থিসিস আমি নিজে টাইপ করলে আমি যে আত্মতৃপ্তি পাব যে আনন্দ পাব…
কিন্তু কাকু বড্ড পরিশ্রমের কাজ।
হোক। এবার কাকু এক চুমুক হুইস্কি খেয়ে আমার কাঁধের ওপর একটা হাত রেখে বলেন, একদিন হয়তো তুমি অনেক দূরে চলে যাবে। হয়তো আমার সঙ্গে তোমার সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, কিন্তু আর কোনো কারণে না হোক, অন্তত এই থিসিস টাইপ করার জন্য।
তুমি আমাকে ভুলবে না।
সেদিন আমি কাকুর কথার প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, আপনি থিসিস টাইপ না করলেও আমি কোনোদিন আপনাকে ভুলব না।
কাকু একটু হেসে বললেন, ও কথা বোলো না কবিতা। অনেক প্রিয়জনকেই মানুষ ভুলে যায়। তুমি যে একদিন আমাকে ভুলে যাবে না এ কথা জোর করে বলা যায় না।
সেদিন কাকুর সঙ্গে আমি অনেকক্ষণ তর্ক করেছিলাম কিন্তু এতদিন পরে আজ আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে, কাকু ঠিকই বলেছিলেন।
কাকু আমার বাবার বন্ধু হলেও বয়স ও মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতে কোনো সংশয় হয়নি। তারপর ওর ফ্ল্যাটে থাকার সময় আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। আমার সঙ্গে ওর দৈহিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কাকুকে কোনোদিনই চরিত্রহীন মনে করিনি। রমলাকে দেখার পরই মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেলাম। হঠাৎ একটা ঘটনাবহুল অধ্যায়ের যবনিকা টেনে আমি সুপর্ণার কাছে চলে গেলাম।
কাকুর কথা, আমার পুরনো দিনের কথা আজকাল আমি মনে করি না। বোধহয় মনে করতে চাই না। প্রয়োজনও অনুভব করি না। তোমাকে চিঠি লিখতে গিয়ে আমার পুরনো দিনের অনেক কথাই নতুন করে মনে পড়ছে। আজ তোমার কাছে স্বীকার করছি, ইদানীং কালে মাঝে মাঝেই আমার কাকুর কথা মনে হয়। জানি না তিনি কোথায়। তিনি বেঁচে আছেন কিনা তাও জানি না। বেঁচে থাকলেও হয়তো সুস্থ নেই। হয়তো সালাউদ্দিন কাকুর ওখানে কাজ করছে না। তার কোনো খবরই জানি না। তাই তো হাজার রকমের খারাপ চিন্তা মনের মধ্যে ভীড় করে। কাকু ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছেন কী? উনি অর্থনৈতিক কষ্ট পাচ্ছেন না তো?
যে মানুষটাকে একদিন অসহ্য মনে হয়েছিল, যাকে অসম্ভব ঘৃণা করেছি, এখন মাঝে মাঝে সারারাত তারই কথা ভাবি। না ভেবে পারি না। মাঝে মাঝেই ওকে দেখতে খুব ইচ্ছা করে। এখন বোধহয় কাকুকে আর ঘৃণা করি না।
বলতে পারো ভাই, কেন এমন হয়? তাই তো বলছি, যারাই আমার কাছে এসেছেন, তারাই আমার কাছ থেকে কিছু নিয়েছেন, কিছু দিয়েছেন। এই পৃথিবীতে অমিয়র মতো পুরুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য না করলেও এই সংসারের চোদ্দ আনা মানুষই ব্যবসাদার। সবাই লেনদেন চায়।
অমিয় স্বতন্ত্র নয়, অনন্য, অসাধারণ। ওদের কথা আলাদা। অমিয়কে শুধু ভালোবাসিনি, শ্রদ্ধাও করি। ইউনেস্কোর আজিজুল ইসলাম ওই ধরনের।
ইন্ডিয়ান এম্বাসির কালচারাল কাউন্সিলার মিঃ গিদওয়ানীর বাড়ির এক পার্টিতে আমার সঙ্গে আজিজুলের প্রথম আলাপ। সেইদিনই বুঝেছিলাম, এই ঢাকাই বাঙালি সত্যি অনন্য। আর দশজনের মধ্যেও ওকে চিনতে কষ্ট হয় না।
গিদওয়ানী আমাদের আলাপ করিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই ও আমাকে বলল, আপা, তুমি আমাকে আজিজ বলেই ডাকবে।
আপা মানে?
দিদি! দিদি! আজিজ হেসে বলল, জানো আপা, ইউরোপ আমেরিকা অনেকদিক থেকে এগিয়ে আছে কিন্তু হালাগো সমাজে আপাও নাই, ভাবীও নাই।
আমি বলি, ঠিক বলেছ।
আজিজ এবার একটু গম্ভীর হয়েই বলে, হতভাগারা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে বড্ড বেশি নাচানাচি করে কিন্তু দিদি বা বৌদির চাইতে ভালো গার্ল ফ্রেন্ড কী হতে পারে?
আমি চুপ করে থাকি।
ও আবার বলে, এ ছাড়া শালী বা দেওর যে কী অদ্ভুত জিনিস তাও শালারা বুঝল না।
আমার মতো আজিজও একটা ইউনেস্কো প্রজেক্ট কাজ করত। বছর দুই শুধু আজিজ ছাড়া আর কোনো পুরুষকে আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসতে দিইনি।
তন্ময়ের জন্য সমস্ত পুরুষকেই আমি ঘেন্না করতে শুরু করেছিলাম কিন্তু আজিজকে পেয়ে বুঝলাম, না, এই পৃথিবীর সব পুরুষই কামনা-বাসনার আগুনে জ্বলে না।
আজ আর লিখছি না। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। দু-চারদিন পরেই আবার চিঠি দিচ্ছি। তোমাদের। দুজনের চিঠি আজই পেলাম।