ইংরেজ হুকুমত খতম করার সাজিশ
হরেক কিসমের দপ্তর আর তার বড় কর্তাদের শিরদর্দের কারণ হচ্ছে তাঁদের আরও সব ছোট ছোট দপ্তর। সেই দপ্তরগুলোর খিলাফ দর্জ হওয়া নানা রকমের বজ্জাতির নালিশ। আমি এর আগেই কবুল করেছি কেমন করে হাকিমদের বেয়াকুব বানানো হত। এবার আরও কিছু তেমনই কিস্সা শোনাই।
একবার নাজির সাহেবের হুকুম হল, যেতে হবে পটনা। খোঁজ-তল্লাশি করতে হবে কোনও এক বজ্জাতের যে গায়েব হয়েছে তার খাজনা বাকি রেখেই। এই কাজটা করতে গিয়ে এমন সব তাজ্জব কারবার আমার নজরে পড়ে যেগুলো আপনাদের কাছে আমি খোলসা করছি।
পটনা হল বহুত পুরানা আর মশহুর এক শহর। এই শহরেই এক সময় আড্ডা গেড়েছিলেন সৈয়দ বাকুর। সৈয়দ সাহেব ছিলেন ইজ্জতদার আদমি, খোদ ম্যাজিস্ট্রেট বাহাদুরের খাস সওয়ার। এমনই তঁার খুশ নসিব আর সাহেবান আলিসানের মেহেরবানি যে তিনি এই শহরের শবগস্তির (Shubgushtee) সর্দার দারোগা হয়ে গেলেন। এই সময় এক আজব বন্দোবস্ত চালু ছিল। বন্দোবস্ত মোতাবেক বহাল হত দু’জন পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট। ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরকে দারোগাদের কাজ কারবার নিয়ে ওয়াকিবহাল করাটাই যাদের ফর্জ। এ ছাড়াও সময় সময় হুজুরকে কোনও জরুরি মামলার নফসুরত (Nufsoolhat) বেফয়স্যলা হয়ে আছে কি না তা খবর করা। এরকম একটা দপ্তর যে কতটা জরুরি সে আর আমি কী বলব! স্রেফ এটুকুই নয় শবগস্তি দারোগার রোয়াবও বেহদ। তার মর্জিতেই পাল্টে যেতে পারে যে কোনও মামলার হাল। দারোগার বয়ান কী হবে তা ঠিক করার দায়িত্ব ছিল তার হাতে। এর উপরই নির্ভর করত মামলা কোন রাস্তা ধরে চলবে। আমি তো বলব ম্যাজিস্ট্রেটের নাগাল পাওয়াটাই যেখানে এত হয়রানি সেখানে কিছুতেই তাঁর উপর বিশ্বাস তৈরি হয় না। হুজুরের দরকার সবার কথা শোনা। কেবল জোরালো প্রমাণ বা সাক্ষী আছে তাদের কথাই শোনা হবে এমনটা না হওয়াই উচিত।
হুকুমতের কাছে খবর ছিল যে ইংরেজ সরকারের খিলাফ একটা সাজিশ চলছে, কী করে তাদের খতম করা হবে। বহুদিন ধরেই ধিক ধিক করে এই আগুন জ্বলছিল। তবে কোম্পানি বাহাদুরের ইকবাল (iqbal) যে ফৌজের সঙিনের মুখে তা বেলাগাম হয়ে হয়ে পড়েনি। মাফি (muafee) জমির কোনও সুরাহা না হওয়াটাই ছিল এই নারাজির খাস কারণ। হাজারও মুসলমান সর্দার যাদের আরাম আয়েস চলত মাফি থেকে আর হরেক কিসমের লোক-লস্কর যাদের মজুরি মিলত তারা রাতো রাত সব ফকির হয়ে গেল। বুনিয়াদ তখনও পাকা হয়নি অথচ ইশারা মিলছিল কোম্পানির রবরবায় ঘাটা পড়েছে। কাবুলে নাস্তানাবুদ হয়েছে ফৌজ, শিখরা দখল নিয়েছে শতদ্রু এলাকার। তারা হুমকি দিচ্ছে খতম করবে ইংরেজ হুকুমত। তরাই অঞ্চলে নিজেদের মুঠি মজবুত করেছে নেপালিরা। তারা চাইছে কোম্পানির খিলাফ তলোয়ারের টক্কর নিতে। কেবল আর শোনা কথা নয় সাবুদ মিলেছে লাহোর আর কাঠমান্ডুর দরবারে চলছে সাজিশ। দুই তরফই চাইছে হিন্দুস্তান কবজা করতে। শ’য়ে শ’য়ে নওজওয়ান যারা ইংরেজি লব্জে তালিম নিয়েছিল তাদের এই রাজা আর নবাবরা নোকরিতে বহাল করলেন। তাদের কাজ ইংরেজি অখবার (akhbar) তর্জমা করে খোদাবন্দদের সামনে পেশ করা। তাদের তর্জমা করা খবর বেশির ভাগই বেঠিক হত। আসলে দেশি রাজা-মহারাজের কাছে তারা জাহির করতে চাইত যে ইংরেজদের হয়ে তারা তরফদারি করছে না আর ইংরেজ হুকুমত কী কী ভুল করে চলেছে। তবে দেশি অখবার একটা কাজ করত তা হল কোন ছাউনিতে কত ফৌজ মজুদ সেই খবর ঠিকঠাক পেশ করা। নেপালিরা যে ইংরেজ হুকুমতকে নাস্তানাবুদ করতে পেরেছিল তার কারণ এই সব খবর। কারও ভাবনাতেই ছিল না যে দেশি ফৌজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নেপালিরা সাজিশ করেছে তাদের মালিকদের খতম করার আর কে ভাবতে পেরেছিল নেপালের নিশানের তলায় এই ফ্যাসাদিরা জোট বাঁধবে! নেপালের আশপাশে যে সব রাজত্বে ইংরেজের খবরদারি ছিল এবার মনে করা হল এই যোগসাজশে তারাও মদত দিয়েছে।
এই ঘটনার যারা আসল কারবারি তাদের ভিতর একজন হলেন খোজা সাহেব। বহুতই দৌলতমন্দ আর আসরদার জমিদার। শাহ গব্বর উদ্দিন, একজন নেক সৈয়দ। মুসলমান কৌমের উপর যার বহুত দবদবা। লোকে তাকে পিরজাদা বলেও ইজ্জত করত। দাগি ফেরেব্বাজ রাহত আলি, খুব সেয়ানা। এতই বজ্জাত যে লোকে তাকে সেই জন্য ডরাত। শবগস্তির সর্দার দারোগা সৈয়দ বাকুর আর ফৌজের এক মামুলি মুনশি মুফসিদ যে সেই সময় বহাল ছিল রেজিমেন্ট অব নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি। এদের সবার নারাজির একটাই কারণ, মাফি বেদখল আর জেল হাজতের বেহাল খানা। মাফি বাতিল হওয়ায় হাজার আদমির হাল হয়েছিল ফকিরের। সেই সঙ্গে মনে করা হচ্ছিল গোরারা ফন্দি আঁটছে নাপাক খানা খাইয়ে হাজতে আসামিদের খেস্টান বানিয়ে ছাড়বে। পল্টনের মুনশি হররোজ নিয়ম করে ফৌজিদের কান ভাঙাত। মালিকদের কাছে জাতের কোনও ইজ্জত নেই। অথচ তাদের মদত ছাড়া হিন্দুস্তানের সিয়াসত অচল। আংরেজদের দফা করে যদি কোনও নতুন হুকুমতকে তখ্তে (takht) বসানো যায় তবে আলবাত সেই রিয়াসত তাদের অনেক ইজ্জত আর সুযোগ সুবিধা দেবে। মুসলমানদের বার বার হুঁশিয়ার করা হত তারাই হল আসল বাদশা। এই ফিরিঙ্গি কুত্তারা জবরদস্তি তাদের উপর রাজ করছে। হিন্দুদের চেতাবনি দেওয়া হত, দেখতেই পাচ্ছ হাজতের নাপাক খানা আর তোমাদের উপর কালাপানির হুকুম। একবার বন্দোবস্ত চালু হয়ে গেলে ব্রাহ্মণত্বের সত্যনাশ। আংরেজদের খিলাফ হাতিয়ার ইস্তেমালের দিন ঠিক হল মহরম। তাজিয়ার জুলুস, ঢোল-শোহরতের আওয়াজ, হুকুমত আন্দাজই করতে পারবে না যে দাঙ্গা হতে যাচ্ছে।
কিন্তু পল্টনের এক ব্যাটা দেশি মুসলমান জিম্মাদার যাকে এই সাজিশে কিছুটা শামিলও করা হয়েছিল, সে আখেরে ভয় খেয়ে যায়। তার মনে হয়েছিল আংরেজ হুকুমতের দফা হলে তার যে আরাম-আয়েশের জীবন সেটা তছনছ হয়ে যেতে পারে। তাই সে পল্টনের মেজরের কাছে গিয়ে এতদিন ধরে চলা সাজিশের কথা উগরে দিল। হুঁশিয়ার ফরমানদার শুরুতেই গ্রেফতার করল মুনশিকে। বাজেয়াপ্ত হল তার সব কাগজপত্র। খোলসা হয়ে গেল সাজিশের পুরো নকশা। বাকি রইল আর সব চাঁইদের গ্রেফতার করা আর মহরমের জুলুস থেকে যাতে কোনও ফ্যাসাদ না হয় তার দিকে নজর রাখা।
এই খবর শুনে পুরো ইংরেজ জাত যেমন খোফ (khauf) দেখেছিল, আমার জানা নেই তা কেমন করে আমি আপনাদের কাছে বয়ান করব। সবাই কোথায় একজোট হবে তা না করে এই জরুরতের সময় তারা এমন করছিল যাতে সব উলটোপালটা হয়ে যায়। ছাউনিতে, ছাউনিতে খবর চাউর হল আর বেশক সবাই মেনেও নিল যে আশপাশের জেলায় মুজতাহিদ আর জরিপকশদের নাকি কোতল করা হয়েছে। ইংরেজ ফৌজেরও একই হাল হবে। বাড়তি ফৌজ মজুদ রাখা হল তোশাখানা আর গোলঘরে। এই গোলঘর ছিল আগের জামানার বেয়াকুবির নিশান। জেনানাদের বলা হল তারা যেন ফৌজি হেপাজতে থাকে। এক জেরহুকুমিকে একজন সাহিবা সওয়াল করল, তোমার বন্দুক জঙ্গ লড়ার জন্য তৈয়ার? জবাব মিলল, জরুর ম্যাডাম, বন্দুকে বড় বড় দানা ভরা, ইন্তেজার শুধু হুকুমের। খবর মিলতে লাগল চম্পারণ জেলায় যে সব মজুতাহিদ, জরিপকশ আর ইংরেজ অফিসার লোগ ছড়িয়ে ছিল তাদের নাকি বেরহমির সঙ্গে ধরে ধরে কোতল করা হচ্ছে। পটনার যে সব ইংরেজরা আড্ডা গেড়েছিল তাদের তখন বেহাল দশা। জরুরি ছিল হৌসলা বাড়াতে হাওয়ালাদারদের একটা পাল্টা জবরদস্ত জবাব যাতে পিরজাদারের উসকানিতে আরেকটা কাবুলের কিয়ামত খাড়া না হয়।
মুনশির কাছে যে যে নাম পাওয়া গেছে তারা যাতে কোনও ভাবেই ছাড় না পায় তার জন্য কড়া হুকুম জারি করলেন ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু তার সব চেষ্টাই শুরুতে বেকার হল। যাদের গ্রেফতারির হুকুম হয়েছিল, ম্যাজিস্ট্রেটকে জানানো হল তারা নাকি রুপোস। তবুও ধরা গেল রাহত আলিকে আর খাজা সাহেব এড়াল গ্রেফতারি। খোদ ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরই রাতে তার কুঠিতে হানা দেন। বিস্তার কামরায় দাখিল হয়ে দেখেন বিছানা তখনও গরম লেকিন চিড়িয়া হাওয়া। আলবাত সে ওই কামরাতেই ছিল কিন্তু গ্রেফতার করা গেল না। পাঠকরা জেনে রাখুন যে সৈয়দ বাকুর ছিল ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরের খাস আদমি। জরুরত পড়লেই হুজুর তলব করতেন বাকুরকে। আবার এই সৈয়দ বাকুর তনখা পেত খাজা আর রাহত আলির কাছ থেকেও। মখদুম সৈয়দ ছিল ভাড়ুয়াদের মৌরসি সর্দার। পটনা আর তার আশপাশে যে কোয়েলিয়ারা মুজরো করত তাদের আমদানির একটা হিস্সা ছিল তার হক। সৈয়দের এক বহিন ছিল আবার খাজা সাহেবের মনপসন্দ রাখেল। খাজাকে গ্রেফতারির হুকুম হতেই বাকুর গিয়ে সেই খবর তাকে জানিয়ে দেয়। একে একে গ্রেফতার হতে লাগল সাজিশকারেরা। তাদের কয়েদ করা হল আলাদা কুঠরিতে। আম আদমি ইন্তেজার করতে লাগল তাদের কেমন সাজা দেওয়া হবে দেখার জন্য
মামলা তখনও বেহাল। কিন্তু মহরমের দিন এসে পড়ল। এই দিনই তো হচ্ছে, কাতিল-কা-রাত। চারধারে ছড়িয়ে পড়ল ফৌজ। হুকুম হল হেপাজত করতে হবে শহরের আনাচ-কানাচ। আচমকাই আওয়াজ উঠল, ডাকু! ডাকু! তেলিঙ্গা আয়া! ভাগো, ভাগো! বেতাল পল্টনও দৌড় দিল জুলুসের ভিতর। খোলসা হল না ডাকু কোথায়। তবুও ছাউনিতে হুকুম হল, আরও ফৌজ পাঠাও। ডর ছিল আফিমের কারখানা নিয়ে। কারণ আংরেজ আড্ডা ওই এলাকাতেই বেশি। রাতভর পাহারা জারি রইল। সুবাহ হতেই সবাই সবাইকে দাঙ্গা ঠেকানো গেছে বলে বাধাই দিতে শুরু করল। গোরাদের মকানগুলো ছিল গঙ্গার ধারে, খুব বেশি হলে আট থেকে দশ মাইল এলাকা হবে। কিন্তু তাদের জরুরত পড়লে মদত করার মতো হাল ছিল না।
পাঠক আপনারা ইন্তেজার করুন আর দেখতে থাকুন এরপর কী হয়।