১৮. ইংরেজিতে লেখা একটা ছোট্ট চিঠি

ইংরেজিতে লেখা একটা ছোট্ট চিঠি

ইংরেজিতে লেখা একটা ছোট্ট চিঠি। যার বঙ্গানুবাদ মোটামুটি এ রকম–
প্রিয় হাসান সাহেব,
আশা করি ভালো আছেন। আমার বাবা গত মাসের ৯ তারিখে মাইয়োকাড্রিয়েল ইনফেকশনে মারা গেছেন। তাঁর জীবনের অংশবিশেষ যা আপনি লিখেছেন তা আমাকে দিয়ে গেলে বাধিত হব। আপনি আপনার জনৈক বন্ধুর জন্যে বাবার কাছে চাকুরি চেয়েছিলেন। তিনি সে ব্যবস্থা করে গেছেন। আশা করি ইতিমধ্যে আপনার বন্ধু সে খবর জানেন। আপনি ভালো আছেন তো?
বিনীতা
চিত্রলেখা

অফিস অফিস গন্ধওয়ালা চিঠি। অফিস বস ডিকটেট করেছেন–পি.এ. ডিকটেশন নিয়ে চিঠি টাইপ করেছে। ফাইনাল কপি বাস পড়েছেন, দু-একটা বানান ঠিক করে নাম সই করেছেন। চিঠি চলে গেছে ডিসপ্যাঁচ সেকশনে। চিঠিতে নাম্বার বসিয়ে ডিসপাঁচ ক্লার্ক চিঠি পোষ্ট করে দিয়েছে। চিঠিতে আন্তরিক অংশ হচ্ছে গোটা গোটা অক্ষরে বাং লেখা আপনি ভালো আছেন তো? এটাকেও আন্তরিক ধরার কোনো কারণ নেই। অফিসিয়েল চিঠিকে ব্যক্তিগত ‘ফ্লেভার’ দেয়ার এটা একটা টেকনিক।

হাসান চিঠি পেয়েছে বিকেলে। সন্ধ্যা মিলাবার পরপরই ফাইল হাতে হিশামুদ্দিন সাহেবের বাড়ির গেটের সামনে উপস্থিত হলো। গেটের দুজন দারোয়ানই তাকে খুব ভালো করে চেনে–তারপূরেও তারা এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন তাকে তারা এই প্রথম দেখেছে। হাসান বলল, ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করব। উনি আছেন না?

দারোয়ানের একজন গম্ভীর গলায় বলল, ম্যাডাম বাড়িতে কারো সঙ্গে দেখা করেন না। আপনি অফিসে যাবেন।

দারোয়ানরা দর্শনপ্রাথীদের আটকে দিতে পারলে খুশি হয়। হাসান লক্ষ করল দারোয়ান দুজনেই মুখের তৃপ্তির ভাব।

উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ভেতরে খবর দিয়ে দেখুন। ইন্টারকম তো আছে।

আমাদের ওপর অর্ডার আছে কাউকে ঢুকতে না দেয়ার।

ও আচ্ছা। আমার কাছে ম্যাডামের কিছু জরুরি কাগজপত্র ছিল।

দারোয়ানদের একজন নিতান্ত অনিচ্ছায় ইন্টারকমের দিকে এগোচ্ছে। তার যেতে আসতে প্রচুর সময় লাগবে–হাসান সিগারেট ধরাল। সে অবাক হয়ে লক্ষ করল হিশামুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে কথা বলার আগে বুকের ওপর সে যেমন চাপ অনুভব করত এখনো তাই করছে।

আপনি যান। সিগারেট ফেলে দিয়ে যান।

হাসান সিগারেট ফেলল। সিগারেট হাতে কাউকে ঢুকতে দেয়া যাবে না–এমন নির্দেশ কি আছে? দারোয়ানরা ক্ষমতাবানদের যেমন সম্মান দেখাতে ভালোবাসে তেমনি ক্ষমতাহীনদের অপমান করতেও ভালবাসে। গেটের সামনে চিত্ৰলেখা দাঁড়িয়ে থাকলে সে নিশ্চয়ই বলত না–সিগারেট ফেলে দিয়ে আসুন।

হাসান বসার ঘরে চুপচাপ বসে আছে। কতক্ষণ হয়েছে? তার হাতে ঘড়ি নেই। বসার ঘরেও ঘড়ি নেই। সময় কতটা পার হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না, মনে হয়। অনেকক্ষণ হয়েছে। একা একা বসে থাকতে অদ্ভুত লাগছে। নীরব একটা বাড়ি। শব্দ নেই, হইচই নেই। টিভি চলছে না, কেউ হাঁটাহাঁটি করছে না। এ রকম শব্দহীন ঘরে মানুষ বাস করে কী করে। বাড়িতে নানান রকম শব্দ হবে–শিশুরা চিৎকার করবে–দাপাদাপি করবে। তাদের হাসি এবং কান্নার শব্দ ক্ষণে ক্ষণে শোনা যাবে…

সরি হাসান সাহেব দেরি করে ফেলেছি। দেরিটা ইচ্ছাকৃত না। নিন চা নিন।

চিত্ৰলেখা নিজেই হাতে করে চায়ের কাপ এনেছে। তার এই ভদ্রতা দীর্ঘ অপেক্ষা এবং গেটের সামনের অপমান ভুলে যাওয়া যায়।

আপনি এসেছেন শোনার পর হট শাওয়ার নিতে বাথরুমে ঢুকেছিলাম। সারা দিন নানান জায়গায় ছোটাছুটি করেছি। গা ঘেমে ছিল। একা একা নিশ্চয়ই খুব বোর হচ্ছিলেন?

বোর হচ্ছিলাম না।

বাবার মৃত্যুর খবর জানতেন?

উনি যেদিন মারা গিয়েছিলেন আমি সেদিনই এসেছিলাম। উনার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আসিনি–এমনিতেই এসেছিলাম। বাড়ির সামনে প্রচুর গাড়ি দেখলাম। খবর শুনলাম–তারপর ভাবলাম আমার কিছু করার নেই। চলে গিয়েছি।

আপনি মানুষকে সান্ত্বনা দিতে পারেন না। তাই না?

জ্বি না।

বাবা আপনাকে খুব পছন্দ করতেন, উনাকে একবার শেষ দেখার ইচ্ছাও আপনার হয় নি?

জ্বি না। জীবিত অবস্থায় তাকে দেখেছি সেই স্মৃতিই আমি রাখতে চাই। মৃত মুখের স্মৃতি রাখতে চাই না।

এটা অবশ্য ভালোই বলেছেন। বাবার জীবনী লেখার কাগজগুলো কি এনেছেন?

জ্বি। ফাইলে সব গোছানো আছে। কিছু বানান ভুল থাকতে পারে। বাংলা বানানে আমি খুব কাঁচা।

এখানে ক’পৃষ্ঠা আছে?

পঞ্চাশ পৃষ্ঠার মতো। স্যার যখন যা বলেছেন আমি লিখেছি। সাজাই নি। আপনি যদি বলেন–সাজিয়ে দেব।

চিত্ৰলেখা হাসছে। হাসান বুঝতে পারছে না মেয়েটার হাসির কারণ কী। বাবার এই মেয়ে সামলে উঠেছে। সামলে না। উঠলেও তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার জীবনের ওপর এত বড় একটা ঝড় গেছে।

হাসান সাহেব।

জ্বি।

এই লেখাগুলো আপনি আমার সামনে বসে কুটি কুটি করে ছিঁড়ুন।

কী বলছেন বুঝতে পারছি না।

চিত্ৰলেখা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবা নিজেই আমাকে বলে গেছেন কাগজগুলো যেন ছিঁড়ে ফেলা হয়। আপনাকে যা বলা হয়েছে–তা ঠিক না। ভুল বলা হযেছে। উইসফুল থিংকিঙের মতো উইসফুল পাস্ট বলে এটা ব্যাপার আছে। বাবা তাই করেছেন।

ও আচ্ছা।

তার বড় বোন পুষ্পের কথা আছে না? যিনি হঠাৎ মারা গেলেন। তিনি হঠাৎ মারা যান নি। বিষ খেয়েছিলেন। বিষ খাওয়া ছাড়া তার উপায়ও ছিল না। এই তরুণী মেয়েটিকে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্যে কুৎসিত নোংরামির ভেতরে দিয়ে যেতে হয়েছিল। বাবার উচিত ছিল তার নিজের সংগ্রামের গল্প বলা। কী করে তিনি ধাপে ধাপে এতদূর উঠেছেন। এত শক্তি পেয়েছেন কোথায়? বাবা যে স্কুলে পড়তেন সেই স্কুলের একজন শিক্ষক নজিবুর রহমান তাকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। নিজে দরিদ্র মানুষ হয়েও বাবাকে কলেজে পড়ার খরচ দিয়েছেন। ইউনিভারসিটিতে ভর্তি করিয়েছেন। এই অসাধারণ মানুষটির জন্যে বাবা কিছুই করেন নি। তিনি শেষ জীবনে খুব কষ্টে পড়েছিলেন, বাবা তাকে দেখতে পর্যন্ত যান নি।

চিত্ৰলেখা একটু থামতেই হাসান বলল, এইসব কথা বলতে আপনার বোধহয় খারাপ লাগছে। প্ৰসঙ্গটা থাক।

আমার বলতে খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। আমি মনে হয় বাবাকে একটু একটু বুঝতে পারছি। তার চরিত্রের একটা অদ্ভুত দিক কি জানেন? জীবনে বড় হবার জন্যে তিনি যাদের সাহায্য নিয়েছেন পরবর্তী সময়ে তাদের পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছেন। আবার কারো কারো প্ৰতি অকারণ মমতা পোষণ করেছেন। যেমন ধরুন আপনি। কারোর কথায় বা কারোর সুপারিশে বাবা কাউকে চাকরি দিয়েছেন বা চাকরির যোগাড় করেছেন এমন নজির নেই। কিন্তু আপনার ব্যাপারে ভিন্ন ব্যবস্থা হলো। তাৎক্ষণিকভাবে বাবা সব ঠিকঠাক করলেন। আপনার বন্ধু নিশ্চয়ই খুব খুশি?

জ্বি খুবই খুশি।

উনি কি সিঙ্গাপুর চলে গিয়েছেন?

জ্বি।

আপনার প্রতি নিশ্চয়ই তিনি খুব কৃতজ্ঞ। তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভঙ্গিটা কী একটু বলুন তো শুনি। তিনি কী করলেন? আপনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন?

ও আমার ভূমিকাটা জানে না। ওকে কিছু বলি নি।

কিছুই বলেন নি?

জ্বি না।

বলেন নি কেন?

বলতে ইচ্ছা করে নি।

চিত্ৰলেখা তাকিয়ে আছে। তার চোখে কৌতুক ঝিলমিল করছে। মনে হচ্ছে হাসানের এই ব্যাপারটায় সে খুব মজা পাচ্ছে।

হাসান সাহেব।

জ্বি।

লোকচরিত্র বোঝার ব্যাপারে বাবার ক্ষমতা ছিল অসীম। আমার ধারণা আপনাকে উনি ঠিকই বুঝেছিলেন। আপনি কি জানেন বাবা আপনার পেছনে স্পাই লাগিয়ে রেখেছিলেন?

কী বললেন?

চমকে উঠবেন না। এটাও বাবার পুরনো স্বভাব। কারো সম্পর্কে কিছু জানতে হলে তিনি লোক লাগিয়ে দিতেন। আপনার ওপর বিরাট একটা ফাইল আছে। আপনি কোথায় যান, কী করেন মোটামুটি সবই সেই ফাইলে আছে।

হাসান হতভম্ব গলায় বলল, ও।

তিতলী নামের একটা মেয়ের সঙ্গে আপনার খুব ভাব ছিল তাই না?

জ্বি।

উনাকে নিয়ে আপনি মাঝে মধ্যে বুড়িগঙ্গায় নৌকায় করে ঘুরতেন।

এইসব কি ফাইলে আছে?

জ্বি।

আপনার এক ভাই রকিব সম্পর্কে অনেক কিছু আছে।

কী আছে?

থাক আপনার না জানলেও চলবে। আপনি বরং তিতলীর কথা বলুন। উনার সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়।

জ্বি না।

দেখা করতে ইচ্ছে করে না?

জ্বি না।

ভুল কথা বলছেন কেন? আপনি তো মাঝে মাঝেই তিতলীদের বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে হাঁটাহাঁটি করেন।

ফাইলে লেখা?

জ্বি। ভুল লেখা?

জ্বি না, ভুল লেখা না।

আপনি তো এখনো বুড়িগঙ্গায় নৌকায় চড়ে একা একা ঘোরেন। তাই না?

জ্বি।

আপনার কি মনে হয় না–আপনার কর্মকাণ্ড অস্বাভাবিক।

হতে পারে।

আপনার সঙ্গে অনেকক্ষণ বকবক করলাম। কিছু মনে করবেন না। আসলে কথা বলার কেউ নেই। বাবার সব দায়িত্ব এসে পড়েছে আমার হাতে। সামাল দিতে পাচ্ছি। না। আপনার মতো একটা জীবন আমার হলে মন্দ হতো না। কাজকর্ম নেই। ঘুরে বেড়ানো–হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকের বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি। বিষন্ন মনে বুড়িগঙ্গায় নৌকা ভ্ৰমণ।

চিত্ৰলেখা কিশোরীদের মতো হাসছে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, সরি। ঠাট্টা করলাম, কিছু মনে করবেন না।

হাসান বলল, আজ উঠি?

আচ্ছা। ভালো কথা, হাসান সাহেব আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে বাবা আপনাকে ঘণ্টা হিসেবে টাকা দিতেন না?

জ্বি।

আমিও আপনাকে ঘণ্টা হিসেবে টাকা দেব। মাঝে মাঝে এসে আমার বকবকানি শুনে যাবেন।

হাসান কিছু বলল না। চিত্ৰলেখা বলল, এখান থেকে আপনি কোথায় যাবেন?

বুঝতে পারছি না। সুমিদের বাসায় যেতে পারি।

আপনার ছাত্রী?

জ্বি।

চিত্ৰলেখা হাসতে হাসতে বলল–এখন তো সে আপনার ছাত্রী না। এক সময় ছিল। আচ্ছা যান শুধু শুধু আপনাকে দেরি করিয়ে দিচ্ছি…। আসুন আপনাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দি।

চিত্ৰলেখা হাসানের সঙ্গে নিঃশব্দে হাঁটছে। দারোয়ান দুজন চট করে দাঁড়িয়ে মিলিটারি কায়দায় স্যালুট দিল।

হাসান বলল, যাই।

চিত্ৰলেখা জবাব দিল না। তার বাবা হিশামুদ্দিন সাহেব এই ছেলেটিকে এত পছন্দ কেন করতেন তা সে বোঝার চেষ্টা করছে। হিশামুদ্দিন সাহেব হাসানের ফাইল এত যত্ন করে কেন তৈরি করেছেন। তার মাথায় অন্য কোনো পরিকল্পনা কি ছিল?

বেল টিপতেই সুমি দরজা খুলে দিল। সহজ গলায় বলল, স্যার কেমন আছেন? যেন সে স্যারের বেল টেপার জন্যেই বসার ঘরে চুপচাপ বসেছিল।

হাসান বলল, কেমন আছ সুমি?

সুমি বলল, ভালো। স্ট্রং ডায়রিয়া হয়েছিল— এখন ভালো।

স্ট্রং ডায়রিয়ার জন্যে কি তোমাকে এমন রোগা রোগ লাগছে?

না। বাবা চলে গেছেন তো খুব মন খারাপ। এই জন্যেই রোগা রোগ লাগছে। মন খারাপ হলে মানুষকে রোগা রোগী লাগে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ তাই। আপনারও নিশ্চয়ই মন খারাপ। আপনাকেও খুব রোগা রোগা লাগছে।

আমার মন অবশ্যি একটু খারাপ। তুমি ঠিকই ধরেছ।

স্যার বসুন। কী খাবেন বলুন, চা না কোক?

বাসায় আর কেউ নেই?

কাজের মেয়েটা আছে–রহমত চাচা আছে। মা গিয়েছে মেজোখালার বাসায়। আমারও যাবার কথা ছিল।

যাও নি কেন?

আপনি আসবেন তো–এই জন্যে যাই নি।

হাসান হেসে ফেলল। সুমির এই ব্যাপারটা খুব মজার। এমনভাবে কথা বলে যেন সে ভবিষ্যৎ চোখের সামনে দেখছে। দু’মাস পর আজ হাসান এসেছে। তাও আসার কথা ছিল না। বেবিট্যাক্সি দিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ বেবিট্যাক্সির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। বেবিট্যাক্সিওয়ালা স্ট্রার্টার হাতল ধরে অনেক টানাটানি করে হাল ছেড়ে দিল। হাসান বেবিট্যাক্সি থেকে নেমে দেখে সুমিদের বাসা দুটো বাড়ির পরেই। বাসার আশপাশেই যখন আসা তখন সুমিকে দেখে যাওয়া যাক। এই ভেবে সুমিদের বাসায় আসা। অথচ মেয়েট ভবিষ্যদ্বক্তা জেন ডিক্সনের মতো কথা বলছে।

স্যার।

হুঁ।

আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। তাই না?

কে বললা করছি না। করছি তো।

উঁহুঁ। আপনি বিশ্বাস করছেন না। আপনার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনি মনে মনে হাসছেন। কেউ যখন মনে মনে হাসে তখন তার চোখ হাসতে থাকে। মুখ থাকে খুব গম্ভীর।

হ্যাঁ। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করবেন।

সেটা কীভাবে?

ফুলিকে আমি বলব–আমার পড়ার টেবিলে ওপর থেকে নীল ভেলভেটের ডায়রিটা আনতে। ওই ডায়েরিতে আজকের তারিখে আমি লিখে রেখেছি–আজ হাসান স্যার আমাদের বাসায় আসবেন।

বল কী?

ডায়েরিটা আমি নিজেই আনতে পারতাম। আমি আনলে আপনি ভাবতেন আমি আপনার সামনে থেকে চলে গিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ডায়েরিতে এটা লিখে নিয়ে এসেছি। এই জন্যেই ফুলিকে দিয়ে আনাব।

সুমি গম্ভীরমুখে বসে আছে। পা দোলাচ্ছে। হাসান মনে মনে বলল, মেয়েটা খুব অন্যরকম। বিরাট একটা বাড়িতে এক এক বড় হয়ে মেয়েটা অন্যরকম হয়ে গেছে। যতটুকু ভালবাসা তার প্রয়োজন তার মা একা তাকে ততটুকু ভালবাসা দিতে পারছে না। মেয়েটা নিঃসঙ্গ। সঙ্গপ্রিয় মানুষের জন্যে নিঃসঙ্গতার শাস্তি কঠিন শাস্তি। এই শাস্তি মানুষকে বদলে দেয়।

স্যার।

বল।

আমার বাবার ধারণা আমার ই.এস.পি. ক্ষমতা আছে। ই.এস.পি, হচ্ছে এক্সট্রা সেনাসরি পারসেপশন।

তুমি এই কঠিন বাক্যটা জান!

হ্যাঁ জানি। বাবা আমার সম্পর্কে কী বলে জানেন?

না।

জানতে চান?

হ্যাঁ জানতে চাই।

বাবা বলেন–আমি ইচ্ছা করলে মানুষের ভবিষ্যৎ বলে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাতে পারি। বাবার কথা কিন্তু ঠিক না। আমি সবার ভবিষ্যৎ বলতে পারি না। যাদের খুব পছন্দ করি। শুধু তাদেরটা বলতে পারি।

আমাকে কি তুমি খুব পছন্দ করা?

হ্যাঁ।

কেন?

সেটা আমি আপনাকে বলব না।

ফুলিকে ডেকে বল ডায়েরিটা আনতে। দেখি ডায়েরিতে তুমি কী লিখেছি?

হাসান ডায়েরি দেখে সত্যিকার অর্থে একটা ধাক্কার মতো খেল। ডায়েরিতে গোটা গোটা হরফে লেখা–আজ হাসান স্যার আমাকে দেখতে আসবেন। তবে আমার জন্যে কিছু আনবেন না। খালি হাতে আসবেন।

হাসান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তোমার তো দেখি আসলেই ই.এস.পি, আছে। তুমি আমার সম্পর্কে আর কী বলতে পার?

অনেক কিছু বলতে পারি। আপনি কাকে বিয়ে করবেন—তাও বলতে পারি।

বলতে পারলে বল।

উঁহুঁ আমি বলব না।

বলবে না কেন?

শুধু শুধু কেন বলব? স্যার আপনি চা খাবেন, না কোক খাবেন?

চা খাব।

আগে একটু কোক খেয়ে নিন না। তারপর চা খাবেন। আমি কোক দিয়ে খুব একটা মজার ড্রিংকস বানাতে পারি। বাবা শিখিয়েছেন। কী করতে হয় জানেন-কোকের গ্লাসে দুটা কালো কাঁচা মরিচ মাঝামাঝি চিরে দিয়ে দিতে হয়। তার সঙ্গে এক চামচ লেবুর রস এবং সামান্য বিট লবণ দিতে হয়। তারপর কোকের গ্লাসটা ডিপ ফ্রিজে দিয়ে খুব ঠাণ্ডা করতে হয়। সার্ভ করার আগে সামান্য গোলমরিচের গুড়া গ্লাসে দিয়ে দিতে হয়। না দিলেও চলে। আমি দেই নি। বাসায় গোলমরিচের গুড়া ছিল না, এই জন্যে দেইনি।

তুমি কি ড্রিংকস বানিয়ে রেখেছ?

বেশ তো তাহলে নিয়ে এস খাই।

বাবার ধারণা ড্রিংসটা খুব ভালো। আমার ভালো লাগে না। ঝাল তো এই জন্যে ভালো লাগে না। আপনার কি ঝাল পছন্দ?

পছন্দ।

কাল কম খাবেন। কাল বেশি খেলে পেটে আলসার হবে।

আচ্ছা কমই খাব। তোমাকে আজ অন্যরকম লাগছে কেন?

সুমি পা দোলাতে দোলাতে বলল, চশমা নিয়েছি তো এই জন্যে অন্যরকম লাগছে। চশমা পরলে সবাইকে অন্যরকম লাগে। কাউকে বেশি অন্যরকম লাগে, আবার কাউকে কম অন্যরকম লাগে। আমাকে বেশি লাগছে।

হাসান কাঁচা মরিচের কোক খেল। চা খেল। সে ভেবেছিল মিনিট দশেক থেকে চলে যাবে। সে থাকল প্ৰায় দুই ঘণ্টা। নানা রকম সমস্যায় সে পর্যুদস্ত। বাচ্চা মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার সময় কোনো সমস্যা মাথায় থাকে না। বরং মনে হয়–পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন নয়। বেঁচে থাকার আনন্দ আলাদা। শুধুমাত্র সেই আনন্দের জনেই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা যায়।

হাসান বলল, সুমি আজ উঠি?

সুমি বলল, আচ্ছা।

আবার আসবেন বাক্যটা বলল না। এই মেয়ে কখনো তা বলে না। কারণ কী? সে জানে আবার কবে স্যার আসবেন সেই জন্যেই কি? এই হাস্যকর যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষ ভবিষ্যৎ জানে না। জানে না বলেই তারা মনের আনন্দে বর্তমান পার করতে পারে।

হাসানের বড় মামা–মুকুল মামা ভবিষ্যৎ জেনে ফেলেছিলেন। ডাক্তারেরা তার পেট পরীক্ষা করে বললেন–ক্টোমাক কান্সার মেটাসথিসিস হয়ে গেছে। শরীরে ক্যানসারের শাখা-প্ৰশাখা ছড়িয়ে গেছে। আয়ু আছে তিন মাস। ভবিষ্যৎ জানার পর মুকুল মামার জীবন বিষময় হয়ে গেল। মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে লাগলেন তিন মাস আগে থেকেই। যার সঙ্গে দেখা হয় তাকে জড়িয়ে ধরেই কাদেন-আমার জীবনটা রক্ষা কর। আমার জীবনটা রক্ষা কর। মুকুল মামার জন্যে ভবিষ্যৎ জেনে ফেলাটা সুখকর হয় নি। আনন্দময় কোনো ভবিষ্যৎ আগে ভাগে জেনে ফেললে কী হবে? সেই আনন্দ অনেকখানি কমে যাবে। মানুষকে সুখী থাকা উচিত বৰ্তমান নিয়ে। মানুষ তা পারে না। বর্তমানে সে দাঁড়িয়েই থাকতে পারে না। তার এক পা থাকে অতীতে আরেক পা ভবিষ্যতে। দু নৌকায় পা, সেই দু নৌকা আবার যাচ্ছে দুদিকে।

রাস্তায় নেমে হাসান রিকশা নিল। রাত বেশি হয় নি–নটা বাজে। এখনি বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। বেকারদের রাত দশটার আগে বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে না। হঠাৎ করে তিতলীদের বাড়িতে যেতে ইচ্ছা করছে। মাঝে মাঝে এই ইচ্ছা হয়। যখন হয় তখন আর কিছু ভালো লাগে না। ইচ্ছাটা হু-হু করে বাড়তে থাকে। তিতলীদের বাড়িতে যাবার জন্যে অজুহাত একটা আছে। ভালো অজুহাত। নাদিয়া এমন চমৎকার রেজাল্ট করেছে তাকে কনগ্রাচুলেট করা তার অবশ্যই কর্তব্য। যেদিন নাদিয়ার রেজাল্টের কথা জেনেছে সেদিনই সে নাদিয়ার জন্যে ভালো একটা কলম কিনেছে। কলমের বাক্সটা গিফট র‍্যাপে মুড়েছে। ছোট্ট একটা চিরকুট গিফট র‍্যাপে ঢোকাল।

সেখানে লেখা–
নাদিয়া,
ফার্স্ট হওয়া ছেলেমেয়ে এতদিন শুধু পত্রিকায় দেখেছি। বাস্তবে এদের সত্যি সত্যি কোনো অস্তিত্ব আছে তা মনে হতো না। রেজাল্ট হবার পর তোমাকে বাস্তবের কেউ মনে হয় না। মনে হয়। তুমি অন্য কোনো গ্রহের। তুমি আমার অভিনন্দন নাও।
ইতি
হাসান ভাইয়া

উপহারটা নাদিয়াকে এখনো দেয়া হয় নি। অনেকবারই সে তিতলীদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে। শেষ পর্যন্ত গেট খুলে ভেতরে ঢোকে নি। হয়তো বাড়িতে গল্প করছে। হাসান সেই আনন্দময় মুহুর্তে প্ৰবেশ করামাত্র ছন্দপতন হবে। আজ বোধহয় যাওয়া যায়। তিতলী মার বাড়িতে এলেও এত রাত পর্যন্ত নিশ্চয়ই থাকবে না। নববিবাহিতা তরুণীরা মার বাড়িতে এত সময় নষ্ট করে না। এরা দ্রুত অতীত ভুলতে চেষ্টা করে। মেয়েরা তাদের শরীরে সন্তান ধারণ করে। সন্তান ধারণ করে বলেই হয়তো প্রকৃতি তাদের ভবিষ্যৎমুখী করে রাখে। অতীত তাদের কাছে পুরনো গল্পের বইয়ের মতো। যে গল্প একবার পাঠ করা হয়েছে বলে কৌতুহল মরে গেছে। দ্বিতীয়বার পড়তে ইচ্ছা করে না। বইটি হারিয়ে গেলেও কোনো ক্ষতি নেই।

হাসান তিতলীদের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট শেষ করল। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে যতটুকু মনের জোর দরকার এই মুহুর্তে ততটুকু মনের জোর তার নেই। কেন জানি মনে হচ্ছে তিতলী তার মার বাড়িতে। কারণ ঘরে অনেকগুলো বাতি জ্বলছে। বারান্দায়ও বাতি জ্বলছে। এতগুলো বাতি জ্বলার কথা না। বাইরে বারান্দার বাতি তো কখনোই জ্বালানো থাকে না। ঘটনা কী ঘটেছে হাসান তো অনুমান করার চেষ্টা করছে। তিতলী এসে কলিংবেল টিপৌঁছে। নাদিয়া বাইরে বারান্দায় বাতি জ্বলিয়ে দরজা খুলল। তারপর আপাকে দেখে এতই আনন্দিত হলো যে বাতি নেবাতে ভুলে গেল। তিতলী এ বাড়িতে এলে গেটের ভেতরে একটা গাড়ি থাকার কথা। গাড়ি অবশ্যি নেই। তিতলীর স্বামী এসে হয়তো তিতলীকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। রাত এগারটার দিকে আবার এসে নিয়ে যাবেন।

হাসান হাঁটা শুরু করল। আজ থাক আরেকদিন সে আসবে। নাদিয়ার উপহারটা মনে হয় দীর্ঘদিন পকেটে পকেটে ঘুরবে। গিফট র‍্যাপ কচুকে যাবে, ময়লা হয়ে যাবে উপহার আর দেয়া হবে না। সবচে’ ভালো হত হঠাৎ যদি রাস্তায় নাদিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। উপহারটা তার হাতে দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলা যেত। রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা শূন্য। নাদিয়া এমন মেয়ে যে কখনো ঘর থেকে বের হয় না। ঘর থেকে বের হলেই তার নাকি কেমন দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। চান দেয়ালের ভেতরে সে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই নাকি তার শান্তি শান্তি লাগে। কী অদ্ভুত কথা!

বাসায় ফিরতে হাসানের ইচ্ছা করছে না। আজ বাসার পরিস্থিতি খুব খারাপ থাকার কথা। তারেক একদিনের অফিস টুরের কথা বলে চিটাগাং গিয়েছিল। এক দিনের জায়গায় সাতদিন কাটিয়ে আজ দুপুরে ফিরেছে। টুরের ব্যাপারটা যে মিথ্যা রীনার কাছে তা প্ৰকাশ হয়ে পড়েছে। চারদিনের দিন অফিস থেকে তারেকের এক কলিগ এসেছিল খোঁজ নিতে–তারেকের অসুখ-বিসুখ কিছু করেছে। কিনা, তার কাছেই রীনা জেনেছে। তারেক দুদিনের ক্যাজুয়েল লিভ নিয়েছে। রীনা খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে–দুইয়ে দুইয়ে চার করা তার জন্যে কোনো সমস্যাই না। হাসান এখনো জানে না ভাবি হিসাব মিলাতে বসেছে কি না। সব ঘটনা জানার পর রীনার প্রতিক্রিয়া কী হবে হাসান তাও বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে ধৈৰ্য হারালে সমস্যা হবে। তবে ভাবি সম্ভবত ধৈৰ্য হারাবে না।

 

তারেক দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। সন্ধ্যায় গোসল করে পুরনো খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে। দুবার চা চেয়ে নিয়ে খেয়েছে। তার চেহারা এবং কথাবার্তায় কোনোরকম উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা নেই। বরং মুখটা হাসি হাসি। টগরের কথা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর টগর ঠিকই শব্দে কাশছে তারেক সেটা নিয়ে উদ্বেগও প্ৰকাশ করল। রীনাকে ডেকে বলল, টগরের বুকে কফ বসে গেছে। এক কাজ কর সরিষার তোলে রসুন দিয়ে তেলটা গরম করে বুকে মালিশ করে দাও। আর এক কাপ কুসুমগরম পানিতে এক চামচ মধু দিয়ে ওই পানিটা খাইয়ে দাও। কফ আরাম হবে। ঘরে মধু আছে?

রীনা স্বাভাবিক গলায় বলল, না মধু নেই।

তারেক বলল, এক শিশি মধু ঘরে সব সময় রাখবে। মেডিসিন বক্সে যেমন নানান ধরনের ওষুধপত্র থাকে তেমনি এক শিশি মধু থাকা উচিত। কোরান শরীফে কয়েকবার মধুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাসানকে বল মধু নিয়ে আসুক।

হাসান বাসায় নেই।

আচ্ছা ঠিক আছে-কাগজটা পড়ে দি। আমি এনে দেব।

তারেক মধু এনে দিয়ে রাতের খাবার খেতে গেল। সে সাধারণত চুপচাপ খাওয়া শেষ করে। আজ রানার সঙ্গে গল্প শুরু করল। রাজনৈতিক গল্প। তারেক বিএনপি সমর্থক ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবার পর সে কিছুটা আওয়ামী লীগ ঘেসা হয়ে পড়েছে।

শেখ হাসিনা দেশ তো মনে হয় ভালোই চালাচ্ছে, কী বল?

হুঁ।

সাহস আছে। রাজনীতিতে সাহসটা অনেক বড় জিনিস। কর্নেল ফারুক গং-কে কেমন জেলে ঢুকিয়ে দিল দেখলে?

হুঁ।

ভালো কাজ করলে সাপোর্ট পাবে। তবে মূল সমস্যাটা কোথায় জান?

না।

মূল সমস্যা মানুষের ভেতর না। মূল সমস্যা সিংহাসনে। সিংহাসনে কিছুদিন বসলেই মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। মহাত্মা গান্ধীকে দেখ–লোকে যে তাকে এখনো ভালো বলে কেন বলে? সিংহাসনে বসেন নি বলেই বলে। দু মাস সিংহাসনে বসতেন দেখতে মানুষ গান্ধীজীর নাম শুনে থুতু দিত। ছাগল নিয়ে ঘুরেও লাভ হতো না। ঠিক বলছি না?

হুঁ।

ঘরে কি পান আছে?

আছে।

কাঁচা সুপারি আছে?

না।

কাল অফিস থেকে ফেরার সময় কাঁচা সুপারি নিয়ে আসব। কাঁচা সুপারি হার্টের জন্যে ভালো। কাঁচা সুপারিতে এলাকলিয়েড বলে একটা জিনিস থাকে। নাইট্রোজেনঘটিত কম্পাউন্ড। এটা হার্টের জন্যে উপকারী। পেপারে পড়েছি।

ও আচ্ছা।

আমাদের গ্রামের মানুষদের মধ্যে হার্টের অসুখ নেই তার মূল কারণ ওরা কাঁচা সুপারি খায়।

ও।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তারেক নিজেই বিপুল উৎসাহে ছেলের বুকে তেল মালিশ করে দিল। কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। নিজে ঘুমোতে এল রাত এগারটার দিকে। পান খেয়ে তার মুখ লাল। হাতে সিগারেট। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শেষ সিগারেটটা খাবে। সুখী সুখী চেহারা। রীনা মশারি খাটাল। পানির গ্লাস, জগ এনে রাখল। ঘুমোতে যাবার আগে আয়নার সামনে চুল বাঁধতে বাঁধতে সহজ গলায় বলল, চিটাগাঙের ওয়েদার কেমন?

তারেক বলল, ভালো।

বৃষ্টি হচ্ছে না?

একদিন হয়েছিল।

এই কদিন লাবণীর বাসাতেই ছিলে?

হ্যাঁ। আর বল কেন যন্ত্রণা–ওরা এপার্টমেন্ট দিয়েছে। কমপ্লিট হবার আগেই দিয়ে বসে আছে। ইলেকট্রিসিটির কানেকশন নেই। গ্যাসের কানেকশন নেই। দুটা বাথরুমের একটায় কোনো ফিটিংসই নেই। এই অবস্থার ফেলে রেখে আসতে পারি না।

আমাকে তুমি মিথ্যা কথা বলে গিয়েছ। বলেছ ট্যুরে যাচ্ছ।

তাই বলেছিলাম?

হ্যাঁ।

মিথ্যা না–টুরেই গিয়েছিলাম। চিটাগাং অফিসের হিসাবপত্র অডিট হচ্ছে। ঢাকা থেকে অডিট টিম যাচ্ছে, আমি সেই অডিট টিমে আছি।

চুল বাঁধা শেষ করে রীনা স্বামীর দিকে ফিরল। সহজ গলায় বলল, আমি এর মধ্যে তোমার অফিসে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে জানলাম তুমি দুদিনের ক্যাজুয়েল লিভ নিয়েছ।

ও এই ব্যাপার। আসলে হয়েছে কি–অডিটের ডেট হঠাৎ করে পিছিয়ে দিল। এদিকে মানসিকভাবে আমি তৈরি চিটাগাং যাব। তখন ভাবলাম যাই ঘুরেই আসি।

তুমি তো মিথ্যা কখনো বল না। আজ এমন সহজ ভঙ্গিতে মিথ্যা বলছি কেন? আমি তো কোনো রাগারগিও করছি না হইচই করছি না। মিথ্যা বলার দরকার কী? তুমি কি লাবণী মেয়েটির প্রেমে পড়েছ?

আরে কী যে বল, প্রেমে পড়া পড়ির মধ্যে কী আছে। একটা অসহায় মেয়ে বিপদে পড়েছে তাকে সাহায্য করেছি। এর বেশি কিছু না।

এর বেশি কিছু না?

না।

দয়া করে তুমি আমাকে সত্যি কথা বল–এর বেশি তোমার কাছে কিছু চাচ্ছি না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি। আমি কোনো সমস্যা তৈরি করব না। আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি, আমি কী সমস্যা করব? আচ্ছা তুমি ছদিন ওই মেয়েটির বাড়িতেই ছিলে?

হ্যাঁ। ওর হলো টু বেডরুম এপার্টমেন্ট। আমি একটাতে ছিলাম, ওরা মা-মেয়ে একটাতে ছিল।

রাতে সে তোমার সঙ্গে গল্প করতে আসে নি?

এসেছে।

কী নিয়ে গল্প করলে? পলিটিক্স?

না–লাবণী তার জীবনের নানান গল্প করত, শুনতাম। খুবই দুঃখী মেয়ে।

মেয়েটির সঙ্গে তোমার শারীরিক কোনো সম্পর্ক হয়েছে?

আরো ছিঃ ছিঃ এইসব কী বলছি?

হয়েছে কি না সেটা বল? গল্প করতে করতে হয়তো অনেক রাত হয়ে গেল। মেয়েটা ঠিক করল রাতটা তোমার সঙ্গেই থাকবে।

কী যে তুমি বল রানা, আমি ফেরেশতার মতো মানুষ!

ইবলিশ শয়তানও এক সময় ফেরেশতা ছিল–তারপর সে শযতান হয়েছে।

এইখানে তুমি একটা ভুল করলে। অধিকাংশ মানুষ এই ভুলটা করে। ইবলিশ কিন্তু ফেরেশতা ছিল না। ইবলিশ আসলে ছিল জ্বিন।

জ্বিন ছিল না ফেরেশতা ছিল সেটা পরে দেখা যাবে–এখন বল, মেয়েটার সঙ্গে কি তোমার কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে?

রীনা পানি এনে দিল। তারেক কয়েক চুমুক পানি খেয়ে গ্লাস ফিরিয়ে দিল। রীনা বলল, তুমি আমার প্রশ্নের জবাব কি দেবে, না দেবে না? হ্যাঁ বলবে কিংবা না বলবে। তুমি যা বলবে তাই আমি বিশ্বাস করব। সত্যি কথা বলার অনেক উপকারিতা আছে। তুমি তো বিরাট ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছ–এখন তোমার উচিত। সত্যি কথা বলা। এখন মিথ্যা কথা বললে ঝামেলা আরো বাড়বে। সবকিছু জট পাকিয়ে যাবে। এখন তোমার উচিত জট কমানো। তুমি কি মেয়েটার সঙ্গে ঘুমিয়েছ? আমি খুব ভদ্রভাবে তোমাকে প্রশ্নটি করলাম। আসলে কী বলতে চাচ্ছি তা নিশ্চয়ই বুঝছ? মেয়েটার সঙ্গে রাতে ঘুমিয়েছ?

হ্যাঁ।

মেয়েটি কি তোমাকে বিয়ে করতে চায়?

চাইলেই বা উপায় কী?

উপায় থাকবে না কেন? বিয়ে তো আর কিছুই না এক ধরনের কন্ট্রাক্ট। আরবিতে নিকাহনাকার অর্থ হচ্ছে sex contact। তুমি পুরনো কন্ট্রাক্ট বাতিল করে নতুন কন্ট্রাক্ট করবে।

তুমি রেগে যাচ্ছে রীনা।

আমি মোটেই রাগি নি। তবে আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে বাস করব না। আগামী পরশু আমি চলে যাব। কালকের দিনটা আমার যাবে গোছগাছ করতে। তোমার সংসার তোমাকে আমি বুঝিয়ে দিয়ে যাব। তারপর তুমি আমাকে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবে। ডিভোর্স হয়ে যাবার পর এই মেয়েটিকে বিয়ে কোরো। চাকরিজীবী মেয়ে আছে তোমার জন্যে সুবিধাও হবে। তোমার একার রোজগারে সংসার চলছে না। দুজনের রোজগারে চলবে।

রীনা তুমি খুবই রেগে গেছ বুঝতে পারছি। রাগারই কথা।

আমি মোটেও রাগি নি। ব্যাপারটা জানার পর থেকেই আমি এটা নিয়ে ভাবছি। তোমাকে যে কথাগুলো বললাম। তার প্রতিটি শব্দ নিয়ে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভেবেছি। যাই হোক এখন ঘুমোতে চল।

রীনা বাতি নিভিয়ে বিছানায় উঠে এল। গত চার রাতে তার এক ফোঁটা ঘুম হয় নি। আজ বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। শান্তিময় ঘুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *