১৮. আকাশ মেঘে মেঘে কালো

আকাশ মেঘে মেঘে কালো।

বিছানায় শুয়ে খোলা জানালায় আকাশ দেখার শখ জাহানারার কখনোই ছিল। না। কয়েকদিন ধরে দেখছেন। দেখতে যে ভাল লাগছে তা-না। আবার খারাপও লাগছে না। ঘরের ভেতর থেকে দৃষ্টি বের করতে পারছেন এটাই একমাত্র আনন্দ। ঘরের ভেতর থাকতে ইচ্ছা করছে না। দূরে কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে। বিনুকে নিয়ে কোথাও গেলে হয়। মানুষ তার এক জীবনে কত জায়গায় বেড়াতে যায়— কোলকাতা, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, আমেরিকা। তিনি কোথাও যান নি। শুভ্ৰর বাবার বেড়ানোর অভ্যাস ছিল না। পাসপোর্ট পর্যন্ত করেন নি। যে মানুষ নিজের ঘরের বাইরে পা ফেলে না, তারও একটা পাসপোর্ট থাকে। শুভ্রর বাবার তাও ছিল না। মেয়েদের জীবনতো আয়নার মত। স্বামীর আয়না। স্বামী যা করবে। আয়নায় তারই ছায়া পড়বে। জাহানারারও তাই হল। শুভ্রর বাবার সঙ্গে দোতলা একটা বাড়িতে আটকা পড়ে গেলেন। শুভ্রর বাবার সঙ্গে বিয়ে না হয়ে কোনো ভবঘুরের সঙ্গে যদি তাঁর বিয়ে হত তাহলে তিনিও ভবঘুরে স্বামীর মত ভবঘুরে হতেন।

জাহানারাক্স পানির পিপাসা হচ্ছে। পানির জন্যে কাউকে ডাকতে ইচ্ছা করছে। না। এক সময় না এক সময় বিনু তাঁর ঘরে আসবে। তাকে পানির কথা বললেই হবে। আকাশ এখন ঘন কালো। আজ মনে হয় বৃষ্টিতে শহর ভেসে যাবে। ছোটবেলায় তাঁর বৃষ্টিতে ভেজার শখ ছিল। উঁহু, ভুল বলা হল— তাঁর বাবা কয়েস উদ্দিন আকন্দ সাহেবের বৃষ্টিতে ভেজার শখ ছিল। তিনি ঝুম বৃষ্টি হলেই ছাদে ভিজতে যেতেন। ভিজতে যাবার আগে খুশি খুশি গলায় ডাকতেন— কইরেটুনটুনি, বৃষ্টিতে ভিজবি? বৃষ্টির পানিতে ভিজলে গায়ের ঘামচি মরে। আয় দেখি।

বিয়ের পর আর কোনোদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় নি। শুভ্রর বাবার কোনো আজগুবি শখ ছিল না। কিংবা কে জানে হয়ত তারও অনেক আজগুবি শখ ছিল— অন্যরা জেনেছে, তিনি কখনো জানতে পারেন নি। মানুষ হয়ে জন্মলে আজগুবি শখ থাকবেই। জাহানারার শীত শীত লাগছে। তিনি গায়ের ওপর চাঁদর টেনে দিলেন আর তখনি বিনু ঢুকল। নিচু গলায় বলল, চাচি, পুরনো ম্যানেজার সাহেব এসেছেন, ছালেহ উদ্দিন সাহেব।

জাহানারা বললেন, ওকে গতকাল আসতে বলেছিলাম। একদিন পরে এসেছে কেন?

বিনু জবাব দিল না। জাহানারা বললেন, ও এসেছে বসে থাকুক। আমার যখন ইচ্ছা হবে ডাকব! আবার নাও ডাকতে পারি। তুমি বোস। চেয়ারটা টেনে বোস। তোমার সঙ্গে গল্প করি।

বিনু বসতে গেল। জাহানারা বললেন, এক কাজ কর— এক কাপ চা এবং ঠাণ্ড এক গ্লাস পানি এনে তারপর বোস। বিনু বলল, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?

জাহানারা বললেন, আমার শরীর খারাপ ও লাগছে না, আবার ভালও লাগছে। না। শুভ্ৰ কি ফিরেছে?

না।

কাল রাতেও ফিরে নি?

না।

কোথায় ছিল তুমি জান?

না।

জাহানারা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কাল রাতে ও কোথায় ছিল তা তুমি জান, আমিও জানি। অথচ দুজনই ভাব করছি কিছু জানি না। আচ্ছা যাও, চাপানি নিয়ে এসো। কাজের মেয়েটাকে বলে এসো ম্যানেজারকেও যেন এককাপ চা দেয়।

বিনু চলে গেল। জাহানারা আবারো আকাশের দিকে তাকালেন। দিন এমন অন্ধকার করেছে যে ঘরে বাতি জ্বালাবার সময় হয়ে গেছে। কোনো কিছুই পরিষ্কার চোখে পড়ছে না। ম্যানেজারকে এ ঘরে ডেকে আনবার পর ঘরের সব কটা বাতি জ্বেলে দিতে হবে। কথা বলার সময় মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে না থাকলে তাঁর ভাল লাগে না। মানুষ। শুধু মুখে কথা বলে না। সে তার সমস্ত শরীর দিয়ে কথা বলে। মানুষের সব কথা পুরোপুরি বুঝতে হলে শুধু কথা শুনলেই হয় না- কথা দেখতেও হয়।

চাচি, পানি আর চা এনেছি।

জাহানারা পানির গ্লাস নিয়ে মাত্র দুচুমুক পানি খেয়ে গ্লাস ফেরত দিলেন। বিনু চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল। জাহানারা বললেন, চা তোমার জন্যে। তুমি চায়ের কম্প হাতে আমার সামনে বোস। চা খেতে খেতে গল্প কর।

বিনু বসল। তাকে দেখে বোঝার কোনোই উপায় নেই সে অবাক হয়েছে নাকি বিস্মিত হয়েছে।

জাহানারা আগ্রহ নিয়ে বললেন, শুভ্রর বাবার একটা গল্প তোমাকে বলি শোন। আমাদের বিয়ের দু বছর পরের কথা। শ্রাবণ মাস। খুব বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ একদিন শুভ্রর বাবা বলল, বেড়াতে যাবে?

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, যাব। কোথায়?

শুভ্রর বাবা বললেন, চল কাছেই কোথাও যাই। সমুদ্র দেখেছি কখনো?

আমি বললাম, না।

শুভ্রর বাবা বললেন, চল সমুদ্র দেখে আসি। সমুদ্র আমি নিজেও দেখি নাই।

আমার উৎসাহের কোনো সীমা রইল না। ব্যাগ গোছালাম, নতুন শাড়ি কিনলাম। উত্তেজনায় রাতে ঘুমাতে পারি না। তখন বয়স ছিল কম। আগ্ৰহ উত্তেজনার কোনো সীমা ছিল না। শুভ্রর বাবা রাতের ট্রেনের দুটা ফার্স্টক্লাসের টিকিট এনে দিলেন। সেই টিকিট আমি আমার ব্যাগে খুব সাবধানে রেখে দিলাম। যাতে হারিয়ে না যায়।

শেষ পর্যন্ত আপনাদের যাওয়া হয় নি?

না। যে রাতে যাব সে রাতে সন্ধ্যার সময় শুভ্ৰর বাবা অফিস থেকে ফিরে বলল, রাতের ট্রেনে যাওয়া ঠিক না। প্রায়ই ডাকাতি হয়। দিনের ট্রেনে যাওয়া হবে। সেই দিনের ট্রেন আর আসে নি।

বিনু কিছু বলল না। মাথা নিচু করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল। জাহানারা বললেন, ঘটনোটা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। গত পরশু ট্রাংক গুছাতে গিয়ে হঠাৎ টিকিট দুটা খুঁজে পেলাম। তখন মনে পড়ল। তোমার চা খাওয়া কি হয়েছে?

জ্বি।

এখন ম্যানেজারকে ডেকে নিয়ে এসো। ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় তুমি থাকবে না। ওকে শুধু পাঠিয়ে দেবে।

জ্বি আচ্ছা।

আড়াল থেকেও কিছু শুনবার চেষ্টা করবে না। আড়াল থেকে কথা শোনার তোমার একটা অভ্যাস আছে। এই অভ্যাসের কথা অন্য কেউ না জানলেও আমি জানি।

বিনু কিছু না বলে ঘর থেকে বের হল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ম্যানেজার ঢুকল। জাহানারা ম্যানেজারের নাম মনে করতে চেষ্টা করলেন। একটু আগেই বিনু নামটা বলেছে। এখন আর মনে আসছে না। ম্যানেজারকে ম্যানেজার না বলে নাম ধরে ডাকা উচিত। নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে নামটা শুরু হয়েছে মা দিয়ে। মা দিয়ে শুরু অসংখ্য নাম আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার একটা নাম মনে পড়ছে না। শুধু মনে আসছে মামুন। মামুন তার ছোট ভাই-এর নাম। এই ভাইটা ছ বছর বয়সে পুকুরে সাঁতার কাটতে গিয়ে মারা যায়। ম্যানেজারের মত একটা ফালতু লোকের নাম মনে করতে গিয়ে তাঁর ভাইটার নাম মনে পড়ছে। ছিঃ! কী ঘিন্নার কথা।

জাহানারা বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে থেকে না। বোস। চেয়ারটায় বোস।

ম্যানেজার বসল। জাহানারা এখনো তার নাম করার চেষ্টা করছেন। কথাবার্তা বলতে বলতেই নামটা মনে আসবে। এখন নামটা মনে করার চেষ্টা না করলেই ভালো হত। শান্তিমতি কথা বলতে পারতেন। একই সময় নাম মনে করার চেষ্টা এবং কথা বলার চেষ্টা করার জন্যে সবই এলেমেলো হয়ে যাচ্ছে।

তোমাকে গতকাল আসার জন্যে খবর পাঠিয়েছিলাম।

জ্বি।

বলেছিলাম খুবই জরুরি ব্যাপার। বলেছিলাম না?

জ্বি।

তুমি আস নি কেন?

একটা সমস্যা হয়ে গেছে- সমস্যার জন্যে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম।

কী সমস্যা?

পারিবারিক সমস্যা। আপনি কি জন্যে ডেকেছেন বলেন।

আমার ছেলে তোমাকে চাকরি থেকে বিদায় করে দিয়েছে, কিন্তু আমি করি নাই। বুঝতে পারছ?

জি।

তোমার নাম ভুলে গেছি— নাম কি মামুন?

জ্বি না, ছালেহ উদ্দিন।

তাহলে মামুন কার নাম?

এই নামে অফিসে কেউ নাই।

জাহানারার আবারো পানির পিপাসা হচ্ছে। অথচ একটু আগেই দুচুমুক পানি খেয়েছেন। তাঁর কি পিপাসা-রোগ হয়েছে? প্রবল তৃষ্ণা হয়— পানিতে ঠোঁট ড়ুবানো মাত্ৰই পিপাসার সমাপ্তি। আবার কিছুক্ষণ পর তৃষ্ণা।

জাহানারা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে আবারো দুচুমুক পানি খেলেন। তাঁর তৃষ্ণা মিটে গেল। তিনি খাটে পা ঝুলিয়ে বসতে বসতে হঠাৎ নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, শুভ্ৰ যে একটা খারাপ মেয়ের কাছে যায় এটা তোমরা জান?

ম্যানেজার সহজ গলায় বলল, জানি।

কীভাবে জান?

ছালেহ উদ্দিন চুপ করে রইল।

এই বিষয়ে তোমার মতামত কী?

দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার মত কিছু না।

আমার ছেলে একটা খারাপ মেয়ের কাছে যায় এটা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার মত কারণ না? তুমি কি জন্ম থেকেই বোকা না বয়স বাড়ার সাথে সাথে বোকামি বাড়ছে।

আপনি হুকুম দিলে মেয়েটাকে সরায়ে দিব।

কোথায় সরিয়ে দিবে?

কোথায় সরাব সেটা আমার ব্যাপার। সব কিছুতো বলা যায় না। বলা ঠিকও না।

কবে সরবো?

সেটাও আমার ব্যাপার।

তুমি পারবে?

না পারার কিছু না।

এই কথাগুলি বলার জন্যেই তোমাকে ডেকেছিলাম।

এখন চলে যাব?

হ্যাঁ যাও।

ম্যানেজার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনি ছোট সাহেবের এই মেয়ের কাছে যাওয়া নিয়ে কোনো রকম দুঃশ্চিস্তা করবেন না। এটা আমার ব্যাপার। আপনি কারো সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনাও করবেন না। ছোট সাহেব আমাকে বিদায় করে দিলেও আমি আছি। বড় সাহেব কোরান মজিদ হাতে দিয়ে আমাকে ওয়াদা করিয়ে ছিলেন- আমি যেন শুভ্ৰকে ছেড়ে না যাই। আমি ওয়াদা রক্ষা করব। আপনি বললেও করব না বললেও করব।

আচ্ছা। তুমি চ খেয়েছ?

আমি চা খাই না।

তোমাদের অফিস কেমন চলছে?

জানি না কেমন চলছে, আমি অফিসে যাই না।

শুভ্ৰ যায় অফিসে?

খবর পেয়েছি উনি নিয়মিত অফিসে যান।

আচ্ছা মামুন তুমি এখন যাও। তোমার সঙ্গে কথা বলে মনে শান্তি পেয়েছি। তোমার নাম ঠিক মত বলেছিতো। মামুন না তোমার নাম?

ম্যানেজার কোনো উত্তর দিল না। জাহানারা চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তাঁর ঘুম পাচ্ছে। শান্তির ঘুম।

ম্যানেজার চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই জাহানারা বিনুকে ডেকে পাঠালেন। হালকা গলায় বললেন, বিনু কপালে হাত দিয়ে দেখতো জ্বর কি-না।

বিনু কপালে হাত দিয়ে বলল, সামান্য গা গরম।

জাহানারা বললেন, আমি ঠিক করেছি আজ বৃষ্টিতে ভিজব। ঝুম বৃষ্টি নামলে তুমি আমাকে ছাদে নিয়ে যাবে।

বিনু হাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। জাহানারা বললেন, আমি যখন ছোট ছিলাম, খুব বৃষ্টিতে ভিজতাম। আমার বাবার বৃষ্টি খুব পছন্দের জিনিস ছিল। তোমার বৃষ্টিতে ভিজতে কেমন লাগে বিনু?

বিনু তাকিয়ে আছে, জবাব দিচ্ছে না। জাহানারা বললেন, আজ বৃষ্টিটা নামুক তোমাকে নিয়েই ভিজব। ছাদে দুটা প্লাষ্টিকের চেয়ার পাঠাতে বল। চেয়ারে বসে বসে ভিজব।

আমার বাবা যে নামাজের পার্টিতে মারা গিয়েছিলেন। সেই গল্প কি তোমাকে বলেছি?

না।

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গল্পটা বলব।

আচ্ছা।

বিনু তোমার বাবা কি খুব নামাজী?

জ্বি।

তুমি এখানে পড়ে আছ এতদিন হয়ে গেছে। উনিতো তোমাকে দেখতেও আসছেন না।

উনি অসুস্থ। বিছানা থেকে নামতে পারেন না।

অসুখটা কী?

পা পিছলে কোমরে ব্যথা পেয়েছিলেন।

চিকিৎসা হচ্ছে না?

করিবাজি চিকিৎসা হচ্ছে। কোমরে তেলমালিশ করা হচ্ছে।

কবিরাজি চিকিৎসায় কাজ হবে না। ঢাকায় এনে তাঁর চিকিৎসা করতে হবে। তাঁকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা কর।

জ্বি আচ্ছা।

তিনি ঢাকায় এলে আমি তাঁর কাছে একটা প্ৰস্তাব দেব। শুভ্ৰর বিয়ের প্রস্তাব। আমি তাকে বলব— ভাই সাহেব আপনার বড় মেয়ের সঙ্গে আমি আমার ছেলের বিবাহ দিতে চাই। আচ্ছা বিনু, উনি কি রাজি হবেন? আমার ছেলের মত ছেলে কি হয়? তুমি বল— হয়?

বিনু ক্ষীণ গলায় বলল, চাচি বৃষ্টি নেমেছে। ভিজবেন না?

জাহানারা বললেন, ম্যানেজার ছাগলটার নাম যেন কী?

ছালেহ উদ্দিন।

এর নামটা মনে থাকছে না কেন? একটা কাগজে তার নাম লিখে আমার ঘরে টানায়ে দাও।

জ্বি আচ্ছা।

বাপ-মা কেমন নাম রাখে দেখ। লক্ষবার শুনলেও মনে থাকে না। আর দেখ শুভ্রর নাম- একবার শুনলে আর কোনোদিনই ভুলবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *