বেতাল কহিল, মহারাজ!
কুবলয়পুরে, ধনপতি নামে, এক সঙ্গতিপন্ন বণিক ছিলেন। তিনি, ধনবতীনাম্নী নিজ কন্যার, গৌরীকালে, গৌরীদত্ত নামক ধনাঢ্য বণিকের সহিত বিবাহ দিলেন। কিয়ৎ কাল পরে, ধন্যবতীর এক কন্যা জন্মিল। গৌরীদত্ত কন্যার নাম মোহিনী রাখিলেন। কালক্রমে, তিনি লোকান্তর প্রাপ্ত হইলে, তদীয় জ্ঞাতিবর্গ, ধনবতীকে অসহায়িনী দেখিয়া, তাহার সর্বস্ব অপহরণ করিল। সে, নিতান্ত দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়া, কন্যা লইয়া, এক তমিস্রা রজনীতে, পিত্ৰালয়ে প্রস্থান করিল।
কিয়ৎ দূর গমন করিয়া, পথ ভুলিয়া, উহার এক শ্মশানে উপস্থিত হইল। তথায় এক চোর, রাজদণ্ড অনুসারে, তিন দিন, শূলে আরোহিত ছিল; বিধিবিপাকে, সে পর্যন্ত, তাহার প্রাণপ্ৰয়াণ হয় নাই। দৈবযোগে, ধনবতীর দক্ষিণ কর চোরের চরণে লগ্ন হইলে, সে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া কহিল, তুমি কে, কি নিমিতে, এমন দুঃখের সময়ে, আমায় মর্মান্তিক যাতনা দিলে। ধনবতী কহিল, জ্ঞানপূর্বক তোমাকে যাতনা দি নাই। যাহা হউক, আমার অপরাধ ক্ষমা কর। অনন্তর, আত্মপরিচয় দিয়া, সে চোরকে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কে, কি নিমিত্তে শ্মশানে আছ, ও কিরূপ দুঃখভোগ করিতেছি, বল।
চোর কহিল, আমি বণিকজাতি, চৌর্যাপরাধে শূলে আরোহিত হইয়াছি; অন্য তৃতীয় দিবস, তথাপি প্ৰাণ নিৰ্গত হইতেছে না; তাহাতেই যার পর নাই যাতনাভোগ করিতেছি। জন্মকালে, জ্যোতির্বিদেরা, গণনা দ্বারা, স্থির করিয়াছিলেন, অবিবাহিত অবস্থায় আমার মৃত্যু হইবেক না। যাবৎ বিবাহ না হইতেছে, তাবৎ আমায়, এই অবস্থায়, দুঃসহ যাতনাভোগ করিতে হইবেক। যদি তুমি কৃপা করিয়া কন্যাদান কর, তবেই আমি এ অসহ্য যাতনা হইতে পরিত্রাণ পাই। আমার চিরসঞ্চিত সুবৰ্ণরাশি আছে; যদি আমার প্রার্থনা পূৰ্ণ কর, সমস্ত তোমায় দি।
ধনবতী, অৰ্থলোভে বিমূঢ় হইয়া, মনে মনে, মলিম্লুচের প্রার্থনায় সম্মতপ্রায় হইল; এবং কহিল, তুমি যে প্রস্তাব করিলে, তাহাতে আমার আপত্তি নাই; কিন্তু, আমার দৌহিত্রমুখদর্শনের ঐকান্তিক অভিলাষ আছে; তোমায় কন্যাদান করিলে, আমার সে অভিলাষ পূর্ণ হয় না। এ কথা শুনিয়া, চোর কহিল, তুমি এখন, কন্যাদান করিয়া, আমায় যাতনা হইতে মুক্ত কর। আমি অনুমতি দিতেছি, তোমার কন্যার বয়ঃপ্রাপ্তি হইলে, কোনও ব্রাহ্মণতনয়কে ধনদান দ্বারা সম্মত করিয়া, তাহা দ্বারা ক্ষেত্ৰজ পুত্ৰ উৎপন্ন করিয়া লইবে; তাহা হইলে, তোমারও বাসনা পূৰ্ণ হইল; আমিও দুঃসহ যাতনা হইতে পরিত্ৰাণ পাইলাম।
ধনবতী কন্যাসম্প্রদান করিল। তখন চোর কহিল, ঐ পুরোবর্তী গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে আমার গৃহ। গৃহের পূর্ব ভাগে, কুপের নিকট, এক বটবৃক্ষ দেখিতে পাইবে; তাহার মূলে আমার সমস্ত সম্পত্তি নিহিত আছে; যাইয়া গ্রহণ কর। ইহা কহিবামাত্র, চোরের প্রাণবিয়োগ হইল; ধনবতীও, চৌরনির্দ্দিষ্ট ন্যগ্ৰোধবৃক্ষের মূলখননপূর্বক, সমস্ত স্বর্ণমুদ্রা হস্তগত করিয়া, পিত্ৰালয়ে প্রস্থান করিল। পরে সে, পিতাকে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত করাইয়া, তাহার হস্তে সম্পত্তিসমর্পণপূর্বক, তদীয় আবাসে অবস্থিতি করিতে লাগিল।
কালক্রমে, মোহিনী যৌবনবতী হইল। সে, এক দিন, স্বীয় সহচরীর সহিত, গবাক্ষ দিয়া রাথ্যানিরীক্ষণ করিতেছে; এমন সময়ে, দৈবযোগে, এক পরমসুন্দর বিংশতিবর্ষীয় ব্ৰাহ্মণতনয় তথায় উপস্থিত হইল। তাহাকে উন্নয়নগোচরণ করিয়া, মোহিনীর মন মোহিত হইল। তখন, সে আপন সহচরীকে কহিল, তুমি এই ব্ৰাহ্মণকুমারকে আমার মার নিকটে লইয়া যাও। সখী ব্ৰাহ্মণতনয়কে তাহার জননীর নিকট উপস্থিত করিলে, সে চৌরবৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া, তাহাকে প্রার্থনারূপ অৰ্থ দিয়া, মোহিনীর পুত্ৰোৎপাদনাৰ্থে নিযুক্ত করিল।
মোহিনী গর্ভবতী ও যথাকালে পুত্রবতী হইল। সূতিকাষষ্ঠীর রজনীতে, সে স্বপ্নে দেখিল, দুই হস্ত, পঞ্চ মস্তক, প্রতি মস্তকে তিন তিন চক্ষুঃ ও এক এক অর্ধচন্দ্ৰ, অতি দীর্ঘ জটাভার পৃষ্ঠদেশে লম্বমান, দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল, বাম হস্তে নরকপাল, ব্যাঘ্রচর্ম পরিধান, ভুজঙ্গের মেখলা, উজ্জ্বল রজতগিরির ন্যায় কলেবর, অতিশুভ্ৰ নাগযজ্ঞোপবীত, সৰ্বাঙ্গ ভস্মভূষিত; এবংবিধ আকার ও বেশ বিশিষ্ট বৃষভারূঢ় এক পুরুষ, তাহার সম্মুখে আসিয়া, কহিতেছেন, বৎসে মোহিনী! তোমার পুত্র জন্মিয়াছে, এজন্য আমি অতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছি। এই বালক ক্ষণজন্ম। তুমি, আমার আজ্ঞা অনুসারে, ঐ শিশুকে, সহস্ৰ সুবৰ্ণ সহিত, পেটকের মধ্যগত করিয়া, কল্য অর্ধারাত্র সময়ে, রাজদ্বারে রাখিয়া আসিবে। রাজা তাহার, পুত্রনির্বিশেষে, প্রতিপালন করিবেন। রাজার স্বৰ্গারোহণের পর, তোমার পুত্র, তদীয় সিংহাসনে অধিরূঢ় হইয়া, ক্ৰমে ক্ৰমে, নিজ প্ৰতাপে ও নীতিবিদ্যাপ্রভাবে, সসাগর সদ্বীপা পৃথিবীর অদ্বিতীয় অধিপতি হইবেক।
মোহিনীর নিদ্রাভঙ্গ হইল। সে সমস্ত স্বপ্নবৃত্তান্ত স্ত্রীয় জননীর গোচর করিল। ধনবতী শুনিয়া নিরতিশয় আনন্দিত হইল; এবং, পর দিন নিশীথসময়ে, ঐ শিশুকে, সহস্ৰ স্বর্ণমুদ্রা সহিত, পেটকের মধ্যে স্থাপিত করিয়া, রাজদ্বারে রাখিয়া আসিল। সেই সময়ে, রাজাও স্বপ্নে দেখিতেছেন, পূর্বোক্তপ্রকার পুরুষ, তাহার সম্মুখবর্তী হইয়া, কহিতেছেন, মহারাজ! গাত্ৰোত্থান কর; এক পেটকমধ্যশায়ী চক্ৰবর্তিলক্ষণাক্রান্ত সন্তান তোমার দ্বারদেশে উপনীত। অবিলম্বে উহারে আনিয়া, পুত্রনির্বিশেষে, প্ৰতিপালন কর। উত্তর কালে, সেই তোমার উত্তরাধিকারী হইবেক।
রাজার নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখন তিনি, রাজমহিষীকে জাগরিত করিয়া, স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনাইলেন। অনন্তর, উভয়ে, দ্বারদেশে গিয়া পেটক পতিত দেখিয়া, যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইলেন, এবং তৎক্ষণাৎ পেটকের মুখ উদ্ঘাটিত করিয়া দেখিলেন, বালকের রূপে পেটক আলোকপূৰ্ণ হইয়া আছে। রাজ্ঞী, সেই শিশুকে ক্ৰোড়ে লইয়া, অগ্ৰগামিনী হইলেন; রাজা, স্বর্ণমুদ্রাগ্রহণপূর্বক, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।
প্রভাত হইবামাত্র, রাজা, সামুদ্রিকবেত্তা পণ্ডিতগণকে আনাইয়া, দেবপ্রসাদলব্ধ বালকের লক্ষণপরীক্ষার্থে, আজ্ঞাপ্ৰদান করিলেন। তাঁহারা সেই শিশুকে দৃষ্টিগোচর করিয়া কহিলেন, মহারাজ! আপাততঃ তিন স্পষ্ট সুলক্ষণ দৃষ্ট হইতেছে; দীর্ঘ আকার, উন্নত ললাট, বিস্তৃত বক্ষঃস্থল। অনন্তর, তাঁহারা সবিশেষ পরীক্ষা করিয়া কহিলেন; সামুদ্রিক শাস্ত্রে পুরুষের দ্বাত্রিংশৎ শুভ লক্ষণ নির্দ্দিষ্ট আছে; মহারাজ!
সেই সমুদয় এই একাধারে লক্ষিত হইতেছে। এই বালক সমস্ত পৃথিবীর সম্রাট হইবেন, সন্দেহ নাই।
রাজা পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইলেন, এবং, পারিতোষিকপ্ৰদানপূর্বক, ব্রাহ্মণদিগকে বিদায় করিয়া, দীন, দরিদ্র, অনাথ প্রভৃতিকে প্রার্থনাধিক অর্থদান করিলেন। ষষ্ঠ মাসে অন্নপ্রাশন দিয়া, তিনি বালকের নাম হরদত্ত রাখিলেন। বালক, অল্পকালমধ্যে, চতুৰ্দশ বিদ্যায় পারদর্শী হইলেন; এবং, রাজার লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, তদীয় সিংহাসনে অধিরোহণ করিয়া, ক্ৰমে ক্রমে, সমস্ত ভূমণ্ডলে একাধিপত্য স্থাপন করিলেন। কিয়ৎ কাল পরে, হরদত্ত, তীর্থযাত্রায় নিৰ্গত হইয়া, প্রথমতঃ, পিতৃকৃত্যসম্পাদনাৰ্থে, গয়াধামে উপস্থিত হইলেন। ফল্গু তীরে যথাবিধি শ্ৰাদ্ধ করিয়া, রাজা পিতৃপিণ্ডপ্রদানে উদ্যত হইলে, নদীর মধ্য হইতে, পিণ্ডগ্রহণার্থে, তিন জনের তিন দক্ষিণ হস্ত যুগপৎ নির্গত হইল; প্রথম ক্ষেত্রিক চোরের, দ্বিতীয় বীজী ব্ৰাহ্মণের, তৃতীয় প্রতিপালক রাজার।
ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! ইহাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি, শাস্ত্র ও যুক্তি অনুসারে, হরদত্ত-দত্ত পিণ্ডের অধিকারী হইতে পারে। রাজা বলিলেন, চোর। বেতাল কহিল, অন্যেরা কি অপরাধ করিয়াছে। রাজা বলিলেন, ব্ৰাহ্মণ, অর্থ লইয়া বীজবিক্রয় করিয়াছেন; রাজাও, সহস্ৰ সুবৰ্ণ লইয়া, প্রতিপালন করিয়াছেন; এজন্য তাঁহারা পিণ্ডগ্রহণে অধিকারী হইতে পারেন না।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।