১৮. অপালা নিচে নেমে এল

ওরা চলে যাবার পরপরই খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অপালা নিচে নেমে এল। তাকে দেখে মনে হল, সে দীর্ঘ সময় নিয়ে সাজগোজ করেছে। গায়ে হালকা লাল রঙের শাড়ি। গলায় গাঢ় লাল রঙের রুবি-বসানো হার। কানের দুলের পাথর অবশ্যি রুবি নয়। স্বচ্ছ টোপাজ। লাল শাড়ির প্রতিফলনে সেগুলোও লালচে দেখাচ্ছে। অপালাকে দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি কোথাও বেরুবে।

বারান্দায় গোমেজ দাঁড়িয়ে ছিল। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। অপালা লাজুক গলায় বলল, আমাকে কেমন লাগছে?

খুব সুন্দর লাগছে আপা।

বাবা কোথায়?

বাগানে বসে আছেন।

আমাদের দুকাপ চা দাও।

অপালা হালকা গায়ে বাগানে নেমে গেল। বাগান অন্ধকার। বারান্দার বাতি নেভানো বলে সব কিছুই কেমন অস্পষ্ট লাগছে। ফখরুদিন সাহেব অরুণা এবং বরুণাকে দুপাশে নিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। তার হাতে জুলন্ত চুরুট। অন্ধকারে চুরুটের আগুন ওঠানামা করছে। অপালা তার সামনে এসে দাঁড়াল।

অন্ধকারে বাগানে বসে আছ কেন বাবা?

এমনি বসে আছি, কিছু করার নেই।

তোমার শীত লাগছে না?

কিছুটা লাগছে।

এস ঘরে এস। এই ঠাণ্ডায় তোমার পাশে বসতে পারব না।

অপালার গলা সতেজ। কথায় ফুর্তির একটা ভঙ্গি, যা তার স্বভাবের সঙ্গে একেবারেই মিশছে। না। সে বড় একটা সাদা চন্দ্রমল্লিকা ছিঁড়ে খোপায় পরল।

বসে রইলে কেন বাবা, এস।

অপালা ফখরুদ্দিন সাহেবের হাত ধরল। তিনি বিস্মিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

তোকে খুব খুশি-খুশি মনে হচ্ছে।

সবাই মুখ গোমড়া করে রাখলে চলবে? তোমার কারখানার ঝামেলা মিটেছে?

প্ৰায় মিটেছে। কিছু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। আরো টাকা খরচ হবে, এই আর কি।

ধনী হবার কত সুবিধা, তাই না বাবা? সব সমস্যা চট করে মিটিয়ে ফেলা যায়।

গরিব হবারও সুবিধা আছে। গরিবদের এ ধরনের কোনো সমস্যা থাকে না।

অপালা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে হালকা গলায় বলল, তা ঠিক, গরিবদের একমাত্র সমস্যা কীভাবে বেঁচে থাকবে। এই বেঁচে থাকার জন্যে কত কাণ্ড এরা করে! নিজের ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়।

ফখরুদ্দিন সাহেব হাতের চুরুট ছুড়ে ফেললেন। তাকালেন মেয়ের দিকে। অন্ধকারে অপালার মুখের ভাব দেখতে পেলেন না। শুধু মনে হল, মেয়েটির গলার স্বর হঠাৎ করে যেন খানিকটা বিষগ্ন হয়ে গেছে এবং মেয়েটি নিজেও তা বুঝতে পেরে প্রাণপণ চেষ্টা করছে বিষণুতা ঝেড়ে ফেলতে।

তারা বসল। বারান্দায়। গোমেজ চায়ের ট্রে নামিয়ে বাতি জেলে দিল। অপালা চায়ে চিনি মেশাতে-মেশাতে বলল, আমাকে কেমন লাগছে বাবা?

সুন্দর লাগছে। তবে লাল চন্দ্রমল্লিকা হলে বোধহয় আরো ভাল লাগত।

না, তা লাগত না। কালো চুলের সঙ্গে সাদা ফুলের সুন্দর কনট্রাস্ট হয়। কালোর সঙ্গে লাল মিশ খায় না। তোমার চায়ে চিনি হয়েছে?

হ্যাঁ, হয়েছে! হঠাৎ আজ এত সাজের ঘটা?

ইচ্ছা করল, তাই। কারণ নেই কোনো।

চল, বাইরে কোথাও গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে আসি। যাবে?

কোন যাব না?

মন ভাল না লাগলে থাক।

মন ভাল লাগবে না কেন? আমার খুব ভাল লাগছে।

 

রেস্তোরাঁতে অপালা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। কথা বললেন ফখরুদিন সাহেব। সবই ব্যবসায়িক কথা। মোট সম্পদের একটা আবছা ধারণা দিতে লাগলেন। অপালা বিস্মিত হয়ে বলল, আমাকে এ-সব কেন বলছি বাবা?

তোমাকে ছাড়া কাকে বলব? আমার শরীর ভাল না। যে কোনো সময় কিছু একটা হবে। তখন হাল ধরবে কে?

আপলা ক্ষীণ স্বরে বলল, মার কথা তুমি আমাকে অনেক দিন ধরেই কিছু বলছি না। তার শরীর কি খুব খারাপ?

না তো! শরীর মোটামুটি ভাল আছে।

না বাবা, ভাল নেই। আমি আজ খুব ভোরে হাসপাতালে টেলিফোন করেছিলাম। ডাক্তাররা

বলেন, অবস্থা খুবই খারাপ বাবা।

বল।

তুমি এখনো কেন এখানে বসে আছা? তুমি যাচ্ছ না কেন?

অপলা খুব শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল, মার এখন জ্ঞান নেই, কিন্তু যদি জ্ঞান ফেরে, তখন মা একজন প্রিয় মানুষের মুখ দেখতে চাইবেন। মা তখন কাকে দেখবো?

রাইট। রাইট আসলেই তাই। মৃত্যুর সময় প্রিয়জনদের দেখতে ইচ্ছা করে। আমি এটা খুব ভাল জানি। আমার মাও তাই চেয়েছিল। আমি, আমি.

ফখরুদ্দিন সাহেব কথা শেষ করলেন না। অপালা বলল, চল উঠে পড়ি, আমার আর খেতে ইচ্ছা করছে না।

রাত প্ৰায় একটার মত বাজে। অপালা এখনো তার খোপা থেকে চন্দ্রমল্লিকা তুলে ফেলেনি। তার গায়ে এখনো লাল শাড়ি। গলার হার আগুনের মত জ্বলছে। তাকে দেখাচ্ছে তার ডাইরিতে আঁকা নর্তকীর মত। সেই রকম চোখ, সেই রকম মুখ। এই অদ্ভুত ব্যাপারটা আগে অপালা লক্ষ্য করেনি। সে অনেক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখল। ফিসফিস করে বলল, আয়নার এ মেয়েটি তো ভারি সুন্দর! বলেই সে তাকাল তার ডায়েরির ছবির দিকে। এত মিল আমাদের মধ্যে, কিন্তু আগে কেন এটা চোখে পড়ল না? এই বলেই সে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ডাইরি খুলে ছোটছোট অক্ষরে লিখল–

বাবা, তোমার ওপর আমার কোনো রাগ নেই।

তার কাছে মনে হল, এই লেখা পড়ে সবাই ভাববে, মেয়েটি কোন বাবার কথা বলছে? কেউ তা বুঝতে পারবে না। বোঝার কথাও নয়। বেশ চমৎকার একটা ধাঁধা। যে ধাঁধার উত্তর শুধু একজনই জানে। সে সেই উত্তর কাউকে দিয়ে যাবে না। থাকুক না খানিকটা রহস্য।

ঘরের বাতি নিভিয়ে অপালা টেবিল-ল্যাম্প জেলে দিল। তার ডাইরির শেষ লেখাটি অতি দ্রুত লিখতে লাগল।

ফিরোজ সাহেব,
আপনাদের দু’জনকে আমি জানালা দিয়ে আসতে দেখলাম। বিকেলবেলার আলোয় সব কিছুই ভাল দেখায়, কিন্তু আপনাদের দু’জনকে যে কী সুন্দর লাগছিল। আমি দেখলাম, আপনার বান্ধবী (নাকি স্ত্রী?) একটা হোচট খেলেন, আপনি সঙ্গে-সঙ্গে হাত দিয়ে তাকে ধরে ফেলে কী যেন বললেন, তারপর দু’জন অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন। কী যে অপূর্ব দৃশ্য! আনন্দে আমার চোখ ভিজে গেল। কত আনন্দ আমাদের চারদিকে, তাই না?
আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আসিনি। কারণটি জানলেই আপনারা দু’জনই সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ক্ষমা করবেন। কারণটা হচ্ছে, কেন জানি গোড়া থেকেই আমার মনে হচ্ছিল, আপনার এই বান্ধবীর ব্যাপারটা সব বানানো। মিথ্যা অজুহাতে আপনি বার-বার আমার কাছেই আসেন। কিন্তু তা তো নয়। এটা আমি কিছুতেই সহজভাবে নিতে পারছিলাম না। আপনি আমাকে সত্যি কথা বলেছিলেন। আমিও সত্যি কথাই বললাম। আমি আপনাকে নিয়ে একটা বাড়িতে যেতে চেয়েছিলাম। সেটা আর সম্ভব হল না। তবে আপনাকে একটা মজার কথা বলি যদি হঠাৎ কোনোদিন অবিকল আমার মত কোনো মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়, আপনি কিন্তু চমকে উঠবেন না। তার কাছে গিয়ে বলবেন অপলা নামের খুব চমৎকার একটি মেয়ে ছিল। তাকে আমি চিনতাম। সেই মেয়েটি খুব দুঃখী ছিল, কিন্তু তার দুঃখের কথা সে কাউকেই কোনোদিন বলেনি। এবং কারে ওপর তার কোনো রাগ নেই। মেয়েটির ঠিকানা আমি আপনাকে দেব না! কারণ আমি জানি, এক’দিন-না-এক’দিন তার সঙ্গে আপনার দেখা হবে। আপনি ভীষণ চমকে উঠবেন। কল্পনায় আপনার সেই চমকে ওঠার দৃশ্য আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। আমার খুব মজা লাগছে।

 

ফখরুদিন সাহেব ঘুমুতে যাবার আগে দু’টি ঘুমের ট্যাবলেট খান। সোনারিলের বড় একটা কৌটা। তাঁর বিছানার পাশের সাইড-টেবিলে থাকে। আজ কৌটাটা খুঁজে পাচ্ছেন না। হয়ত হাত লেগে নিচে পড়ে গেছে। খুঁজতে ইচ্ছে করছে না। তিনি বিছানায় উঠে বাতি নিভিয়ে দিলেন; খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই রাতে তাঁর খুব ভাল ঘুম হল। চমৎকার একটা স্বপ্নও দেখলেন। নদী, বন, ফুল, পাখি নিয়ে স্বপ্ন। ঘুমের মধ্যেই তিনি বুঝলেন, এটা স্বপ্ন এর কোনো অর্থ নেই, তবু তার মন গভীর প্রশান্তিতে ভরে গেল। অনেক দিন স্বপ্ন দেখা হয় না।

2 Comments
Collapse Comments
হামিদুল August 21, 2021 at 1:01 pm

Firoz character ta lekhok khub sundor ekecen.

আরেকটু সুন্দর করে যদি লিখতেন….।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *