অনুতপ্ত অন্ধকার
সমুদ্রে তোলা ছবিগুলো দেখে মা বলেন, আমাকে নাকি জলকন্যার মত লাগছে। সমুদ্রের শাদা ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছি, ডুবে যাচ্ছি, জলে ভেজা শরীর রোদে চিকচিক করছে, খালি পায়ে সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যাচ্ছি, অনেক সময় এক দঙ্গল মেয়ে আছে সঙ্গে। মা বলেন, আর কাউরে তো তোমার মত এত সুন্দর লাগতাছে না। তোমারেই মনে হইতাছে জল থেইকা উইঠা আইছো। মা যদি জানতেন কি ঘটেছে আমার জীবনে, আমার শরীর এখন আর জলকন্যার মত পবিত্র নয়, তবে নিশ্চয়ই এ নামে আমাকে ডাকতেন না। মা যদি জানতেন সমুদ্রের হাওয়া খেয়েই আসিনি আমি, কদিনের জন্য হাওয়া হয়েও গিয়েছিলাম। আগুনের হলকা ছিল সে হাওয়ায়। আমি শুকনো হাসি হাসি। কার কাছে বলব নিজের এই পরাজয়ের কথা! না কেউ নেই কোথাও যার কাছে বসে কাঁদি। আমাকে একা একাই কাঁদতে হয়। একা একাই বসে থাকতে হয় ছাদে, নৈঃশব্দের কোলে মাথা রেখে। চোখের জল লুকিয়ে রাখতে হয় জলকন্যার। শওকত টিপ্পনি কেটেছে, কি, হাইমেন রাপচার হইছে?
আমি ম্লান হেসেছি।
কি গো জলকন্যা সমুদ্র নিয়া কবিতা লিখবা না! ইয়াসমিন বার বারই জিজ্ঞেস করে। নাহ, কবিতায় মন নেই, মন শরীরে। দীর্ঘ দিন কবিতা লিখিনা, কবিতা আসে না আজকাল। জলকন্যাকে মনে মনে যাদুর পালঙ্কে ঘুম পাড়াই, মনে মনে বুঝি ঘুম নেই তার চোখে, দুশ্চিন্তার চাদর মুড়ি দিয়ে একা একা জেগে থাকে সে। জলকন্যা চিঠি পায়, এসেই নিয়ে নিয়েছি। ব্যথা তেমন লাগেনি। ক্ষত এখনো অপরিবর্তিত। অভাবিত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছি নিজেকে। তবে শোচনার কষ্ট খুব বেশি। .. দুর্ভাবনা করো না। কিছুই হারাইনি আমরা। সোনা মানিক, বিভ্রান্তির কালো রোদ আর কখনো আমাকে স্পর্শ করবে না। আমি ভাল থাকছি। ভাল থাকবো। আমি তোমার স্বপ্নের মত ভাল থাকব। তোমার শরীরের ঘ্রাণ ছড়িয়ে রয়েছে সারা ঘরে—আমি সেই ঘ্রাণের সাথে খেলি। তোমার হৃদয়ের রোদ উজ্জ্বল করে রেখেছে আমার পরান। আমি সকালের রোদ হয়ে উঠব, সকালের রোদ। রুদ্রকে আমি চিঠিতে রোদ বলে ডাকতাম, রুদ্র ডাকত আমাকে সকাল বলে। ওইসব বাঁধনছেঁড়া প্রেম এখন কী বিষম অর্থহীন মনে হয়। রুদ্র এখন সকালের রোদ হয়ে উঠতে চায়। সে এখন আমার রুদ্র হয়ে উঠতে চায়। এখন কেন? কেন সে সেই প্রথম থেকেই ছিল না আমার! কেন সে বার বার বলেছে সে আমার ছিল! কেন সে ঠকিয়েছে আমাকে! কেন মিথ্যে বলেছে! এখন সে সকালের রোদ হয়ে উঠবে, কি করে বিশ্বাস করি তাকে!কেন আর চিঠি লেখে রুদ্র আমাকে। আমি তো তাকে আর আমার এ জীবনের সঙ্গে জড়াবো না। আমি মন থেকে ঝেড়ে ফেলেছি রুদ্র নামের প্রতারকটির নাম। ধূসর আকাশ থেকে অবিরল বৃষ্টি হয় হোক, জলের প্রপাত বেয়ে বন্যা এসে দুকূল ভাসাক, তবু ভাল নির্বাসন। খানিকটা ঝিকমিক রোদ আচমকা সুখ এনে পণূর্ করে ঘরের চৌকাঠ, গোপনে বিনাশ করে স্বপ্নে ধোয়া সোনার বাসর, ঘণু পোকা খুঁটে খায় শরীরের সুচারু বৈভব, হৃদয়ের রক্ত খায়, খেয়ে যায় বাদামি মগজ। সেই রোদে পুড়ে পুড়ে খাক হয় অনন্ত আগামী, জীবন পুড়িয়ে দিয়ে আগুনের হল্কা ওঠে নেচে। আমার উঠোন জুড়ে মাটি আর খরায় চৌচির, জগত আধাঁর করে নামে যদি তুমুল তুফানতবু ভাল নির্বাসন, রোদহীন বিষণ্ন সকাল। পৃথিবী আধাঁর করে ফিরে যায় অমল রোদ্দুর, পেছনে কালিমা রেখে ফিরে যায় সবুজ সুষমা, শিকার খুবলে খেয়ে ফিরে যায় চতুর শগৃাল, লম্পট জুয়ারি ফেরে, অমানুষ, মদ্যপ শকুন। তুমিও তেমনি করে ফিরে যাও পরানের রোদ, ঘুরঘুট্টি কালো রাত ফেলে তুমি বনবাসে যাও, সোনালী ডানার রোদ উড়ে যাও পরবাসে যাও। এক ফোঁটা জ্যোৎস্না নেই, সেই ভাল, নিকষ আন্ধার, অমাবস্যা ডুবে থাক, তবু রোদ খুঁজো না সকাল। তবু রোদ তার সকালকে খুঁজেই যাবে। আর যা কিছুই হারাক, সে তার সকালকে হারাতে চায় না।
কেবল চিঠি নয়, চিঠির সঙ্গে কবিতাও পাঠায় রুদ্র। কবিতায় সেই রাতের কথা, সেই আমাদের প্রথম মিলন-রাত্রির কথা, আমার রাত জাগা রাতটির কথা।
ধ্বংসস্তূপের উপর বসে আছে একটি শালিক
পাশে এক মৃত্যুমাখা বেদনার বাজপোড়া তরু,
শূন্যতার খা খা চোখ চারপাশে ধূসর আকাশ।
দুঃখিতা আমার, তুমি জেগে আছো স্বপ্নহীন আঁখি।
তোমার চোখের তীর ভেঙে পড়ে পাড়ভাঙা নদী,
তোমার বুকের পাশে জেগে থাকে নিভৃত পাথর।
কিসের পার্বন যেন চারদিকে কোলাহল রটে—
দুঃখিতা আমার, তুমি জেগে আছো পরাজিত পাখি।
সুচাগ্র সুযোগে সাপ ঢুকে গেছে লোহার বাসরে,
বিষের ছোবলে নীল দেহে নামে শীতল আধাঁর,
গাঙুরের জলে ভাসে কালো এক বেদনার ভেলা।
দুঃখিতা আমার, তুমি জেগে আছো বালিয়াড়ি-নদী।
নিখিল ঘুমিয়ে গেছে দিনশেষে রাতের চাদরে,
কামিনীর মিহি চোখে ঘুম এসে রেখেছে চিবুক,
জোনাকিরা নিভে গেছে সংসারের স্বপ্ন শুনে শুনে—
জেগে আছো, শুধু তুমি জেগে আছো আমার দুঃখিতা।
রুদ্র কি সত্যিই অনুভব করেছে আমার কষ্টগুলো! যদি তার হৃদয় বলে কিছু থাকে, তবে কেন সে অন্য মেয়েদের ছুঁয়েছে! হৃদয় বলে কিছু আমার ছিল বলে আমি কখনও কল্পনাও করতে পারিনি রুদ্র ছাড়া অন্য কোনও পুরুষকে। প্রতিদিন কলেজের সুদর্শন বুদ্ধিমান হিরের টুকরো ছেলেদের দেখেছি, কারও দিকে আমি তো ফিরে তাকাইনি। কেবল হাবিবুল্লাহ নয়। আরও অনেক হিরের টুকরো তো আমাকে প্রেমের প্রস্তাব পাঠিয়েছে, সব তো দ্বিধাহীন ছুঁড়ে দিয়েছি। রুদ্র কেন পারেনি! শরীর তো আমারও ছিল, এই শরীর তো কখনও কাউকে কামনা করেনি! এই শরীর প্রতিদিন একটু একটু করে প্রস্তুত হয়েছে রুদ্রর জন্য। এই প্রস্তুত শরীরটি রুদ্র তার বহুভোগী কালিমায় কালো করেছে।
ভাঙনের শব্দ শুনি, আর যেন শব্দ নেই কোনও,
মাথার ভেতর যেন অবিরল ভেঙে পড়ে পাড়।
করাত কলের শব্দে জেগে উঠি স্নায়ুতে শিরায়
টের পাই বৃক্ষ হত্যা সারারাত রক্তের ভেতর।
কেন এত বৃক্ষহত্যা, এত ভাঙনের শব্দ কেন?
আর কোনও ধ্বনি নেই পৃথিবীতে, ব্রহ্মাণ্ডে, নিখিলে?
কোথায় ভাঙছে এত? কোনখানে? নাকি নিজেরই
গভীর মহলে আজ বিশ্বাসের গোপন ভাঙন!
উদাসীন দূর থেকে ডেকে যাই সকাল সকাল..
তবে কি সকাল ভাঙে পৃথিবীতে আমার সকাল!
আমার নগর ভাঙে, প্রিয় এই নিভৃত নগর?
তবে কি আকাঙক্ষা ভাঙে, স্বপ্নময় পরম পিপাসা?
প্লাবনের ক্ষতচিহ্ন মুছে নেয় মানবিক পলি,
আগুনের দগ্ধ শোক কবে আর মনে রাখে গৃহ।
দুর্যোগের রাত্রি শেষে পুনরায় তুলেছি বসত,
চিরকাল তবু এই ভাঙনের শব্দ শুনে যাব?
হ্যাঁ তোমাকে চিরকালই এই ভাঙনের শব্দ শুনে যেতে হবে। আমি আর ফিরব না তোমার ওই নষ্ট জীবনে। কবিতা পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, কবিতা আমাকে কাঁদায়, কিন্তু না, কবিতা আর জীবন এক নয়, কবি হতে হলে যদি বাণিশান্তার বেশ্যার সঙ্গে শুয়ে অসুখ বাধাঁতে হয়, তবে সে কবির কবিতা আমি ভালবাসতে পারি, সে কবির সঙ্গে জীবন জড়াতে পারি না। ফাঁকি তো যথেষ্ট দিয়েছ, আর কত রুদ্র! আমাকে বোকা পেয়ে কাছে টেনে যেটুক অবশিষ্ট আছে আমার, তাও নষ্ট করতে চাও! আর কত ফাঁকি দেবে, আমি কি বুঝি না ভাবো চাতুরি তোমার! ভেতরে নরক রেখে কেমন বাহানা ধরো সুবোধ শিশুর! চুম্বনের স্বাদ দিলে বিষাক্ত সাপের মত ছোবলের ঘায়ে, মুখোশ খুলেই দেখি আসলে তোমার এক বীভৎস আদল। আর কত প্রতারণা, ভাঙনের নৃশংস খেলা এতটা নির্মম! পুন্নিমাবিহীন চাঁদ অশুভ অমাবস্যাকে ডাকে আয় আয়—জোনাকিকে জোৎস্না ভেবে নিকষ আন্ধার রাতে উৎসবে মেতেছি, এই তো আমার ভুল, এই তো আমার পাপ জালেতে জড়ানো.,এখন ছুটতে চাই, দুদাঁতে কামড়ে চাই ছিঁড়তে বাধঁ ন,এখন বাঁচতে চাই, প্রাণপণে পেতে চাই বিশুদ্ধ বাতাস। আর কত ফাঁকি দেবে, আমি কি বুঝি না ভাবো চাতুরি তোমার? জীবনে জঞ্জাল রেখে সুবাসিত হাসি টানো ঠোঁটের কিনারে ! গ্লানিতে অতীত ভরা, গ্লানিতে শরীর ভরা, ঘণৃার জীবন। অমৃতের মত ভেবে তবওু ছুঁয়েছি আমি বিষের অনল। এই কি আমার প্রেম, সাজানো গোছানো সাধ, সাধনার ধন? এই তো আমার ঘর, মাটি নেই, খুঁটি নেই, অলীক মহল, নিশ্চিত মরণ থেকে এবার বাঁচতে চাই, শুভ্র মুক্তি চাই, সুচারু স্বপ্নকে চাই, অমল ধবল চাই হৃদয়ের ঘ্রাণ। কিন্তু শুভ্র মুক্তি আমি পেতে পারি না। অমল ধবল জীবন আমি পেতে পারি না। রুদ্র নিজের অসুখের চিকিৎসা করে অনুতপ্ত অন্ধকার লিখছে। তার অনুতাপ আমাকে অসুখ থেকে রক্ষা করে না। আমি একা, আমার সমস্ত যন্ত্রণা নিয়ে একা আমি। হঠাৎ একদিন লক্ষ করি যৌনাঙ্গে ঘা হচ্ছে। তাহলে সংক্রামিত হয়েছিই! মনে একটি ক্ষীণ আশা ছিল, হয়ত হইনি। কেবল আশায় বসতি। এই চেনা শহরে আমার পক্ষে সম্ভব নয় রক্ত পরীক্ষা করা, কোনও ওষুধের দোকানে গিয়ে পেনিসিলিন ইনজেকশন চাওয়া। সম্ভব নয় নিজের শরীরে নিজে সুঁই ফোটানো। সম্ভব নয় কাউকে সুঁই ফোটাতে বলা। পেনিসিলিন ইনজেকশনের ডোজ দেখেই সকলে জেনে যাবে কোন রোগের চিকিৎসার জন্য এই হাই ডোজ। রুদ্র সুস্থ হচ্ছে, তার ক্ষত সেরে যাচ্ছে একটু একটু করে, ক্ষত আমার যৌনাঙ্গে বাড়ছে একটু একটু করে, আমি অসুস্থ হচ্ছি। এই অসুখ টি আমি লুকিয়ে রাখি শরীরের গভীর গুহায়। কেউ যেন না দেখে, কেউ যেন না জানে। একটি ভয় আমার গায়ে লেগে থাকে সারাক্ষণ, যেখানেই যাই যা কিছুই করি, ভয়টি আমাকে ছেড়ে কোথাও যায় না। হাসপাতালে নার্সের ঘরে শত শত পেনিসিলিন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা লিখে দিচ্ছি, নানারকম পেনিসিলিনের নাম, রোগীর আত্মীয়রা সে ওষধু আনছে, নার্সকে বলছি ইনজেকশন দিতে রোগীদের, চোখের সামনে নার্সও দিচ্ছে। কিন্তু নিজে একটি পেনিসিলিন নিজের জন্য নিতে পারছি না। নিজে কোনও ডাক্তার বা নার্সকে বলতে পারছি না আমাকে একটি ইনজেকশন দিয়ে দিন, একটি হাই ডোজের পেনিসিলিন দিন। এর চেয়ে যদি ক্যান্সার হত আমার, যে কোনও দুরারোগ্য রোগ, স্বস্তি পেতাম, অন্তত বলতে পারতাম আমার অসুখের নাম, চিকিৎসা করাতে কোনও লজ্জা হত না। কাকে বলব এখন কি রোগে ভগু ছি আমি। কণ্ঠুার করাত আমাকে ফালি ফালি করে কাটে। ভয় লজ্জা আমাকে শক্ত দড়িতে বাঁধে। আমার সীমানা কমতে কমতে একটি বিন্দুতে এসে পৌঁছোয়। কিন্তু কতদিন লুকিয়ে রাখব এই রোগ! ক্যানেসটেন মলম ব্যবহার করে জানি কাজের কাজ কিছু হবে না, তবু কিনি ওষধু টি। সঠিক ওষধু টি কেনার উপায় নেই বলে অন্য ওষধু কিনি। এ মলম যৌনাঙ্গের ফাংগাস দূর করে, এ মলম ট্রিপোনেমা পেলিডামএর মত ভয়ঙ্কর ব্যাকটেরিয়া ধং্ব স করতে পারে না। তারপরও প্রতিদিন জামার আড়ালে মলম নিয়ে গোসলখানায় ঢুকি, যেন গোসল করতে বা পেচ্ছাব পায়খানা সারতে যাচ্ছি। আর কারও চোখে কিছু পড়ে না, কেবল মার চোখে পড়ে। মলমটি বিছানার সবচেয়ে তলের তোশকের তলে লুকিয়ে রাখি। কেউ কখনও তোশকের ওই তলে হাত ঢোকায় না। এত লুকোনোর পর মা বলেন, তর হইছে কি রে, বারে বারে বাথরুমে যাস কেন?
কিছু হয় নাই তো! ফ্যাকাসে মুখটি আড়াল করে বলি।
তর কি কিছু অসুখ টসুখ হইছে নাকি?
কি কও এইসব? অসুখ হইব কেন!
আমার কিন্তু মনে হইতাছে তর কিছু হইছে।
মার চোখের দিকে তাকাই না। বুকের ধুকপুক বুকেই থাকতে দিই।
সামনে পরীক্ষা। ছেলেমেয়েরা দিনরাত পড়ছে। কলেজে যাই, ক্লাস করি। অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের বক্তৃতার দিকে চোখ, কিন্তু মনটি অন্য কোথাও, মন শরীরে। বাড়িতে বই সামনে নিয়ে বসে থাকি, মন চলে যায় বইয়ের অক্ষর থেকে শরীরে। শরীরে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। চিকিৎসা এক্ষুনি দরকার। কিন্তু কি করে চিকিৎসা পাবো, কোথায় পাবো! রুদ্র মোংলায় বসে কবিতা লিখছে। ঢাকা গিয়ে চিকিৎসা করারও উপায় নেই। হাই ডোজের পেনিসিলিন সিফিলিস ছাড়াও হৃদপিণ্ডের অসুখে ব্যবহার হয়। হৃদপিণ্ডের অসুখ ও যদি হত আমার, বাঁচা যেত। অন্তত সে কারণে নিশ্চিন্তে একটি ইনজেকশন আমি নিতে পারতাম। চাইলেই তো হৃদপিণ্ডকে অসুখ দিতে পারি না। মাঝে মাঝে কনুইয়ে যে ব্যথা হয়, এক কনুই থেকে আরেক কনুইয়ে লাফ দিয়ে ব্যথা যায়, এই রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিসএর সময় হৃদপিণ্ডের মাইট্রাল স্টেনোসিস ঘটাতে পারে। মাইট্রাল স্টেনোসিস হলে শ্বাসকষ্টের উপসর্গ থাকে। এই যে হঠাৎ রাতে রাতে আমার শা্ব স বন্ধ হয়ে আসে, যেন একটি ছোট্ট ট্রাংকের মধ্যে বন্দি হয়ে আছি, শ্বাস নেওয়ার জন্য বাতাস পাচ্ছি না সেরকম লাগে, শোয়া থেকে উঠে বসে ফুসফুসে বাতাস নিতে থাকি, বসে না হলে দাঁড়িয়ে, তাতেও না হলে জানালা খুলে হলে শ্বাস নিই। সেটিরই তো নাম অকেশনাল নকচারনাল ডিসনিয়া। তবে তো আমি যোগ্যতা রাখি হাই ডোজ পেনিসিলিন পাওয়ার। এই যোগ্যতার সুযোগ পেয়ে আমি ক্লাসের একটি সাদাসিধে ভালছাত্রী নাসিমাকে বলি, আমার নকচারনাল ডিসনিয়া হয়। ভয় করছি মাইট্রাল স্টেনোসিস আবার না হয়ে যায়। ভাবছি পেনিসিলিন ইনজেকশন নেব। নিলে তো মাইট্রাল স্টেনোসিস অন্তত প্রিভেন্ট করা যাবে কি বল। নাসিমা যদি বলে আমার নেওয়া উচিত পেনিসিলিন, তবেই নাসিমাকে সাক্ষী রেখে আমি ইনজেকশনটি নিতে পারি। নাসিমাই আমার হৃদডিণ্ডটি বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু আমার অত বড় অসুখের কথা শুনে নাসিমা হাসে। বলে, আগেই ইনজেকশন নেবে কেন? আগে হার্টটা দেখ। মারমার পাও হাটের্? বিপাকে পড়ি, স্টেথোসকোপ নিজের বুকে কখনও লাগাইনি। রোগির হৃদপিণ্ড নিয়েই ব্যস্ত, নিজের হৃদপিণ্ডের খবর কে রাখে। কেবলই অনুমান। অবশ্য এসব অনুমানের ওপর আমাকে কেউ পেনিসিলিন নিতে দেবে না, কাউকে না জানিয়ে গোপনে কোনও ইনজেকশনও আমাকে দেবে না কেউ, এমন কি নাসিমাও। ভাল ছাত্রীর ভাল কান স্টেথোর নলে, নল বেয়ে আমার হৃদপিণ্ডের কোনও মন্দ শব্দ ভাল কানে পৌঁছে না। কোনও মারমার নেই, সুতরাং পেনিসিলিন নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই আমার। বুঝি, ইনজেকশন ছাড়া উপায় নেই।
রুদ্র মোংলা থেকে ফিরে এলে বাড়ির কাউকে কিছু না বলে আমি ঢাকার বাসে চড়ি। বাড়ির কারও অনুমতির জন্য অপেক্ষা করলে আমার চলবে না। ঢাকায় শাহবাগের এক ওষুধের দোকানে, রুদ্র যেখানে নেয় ইনজেকশন, নিয়ে যায়। নিতম্বের মাংসে লম্বা মোটা সুঁই ফোঁটালো যে লোকটি, বাঁকা একটি হাসি ঝুলে রইল তার ঠোঁটে, ষ্পষ্ট দেখি। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করি সুঁই আর হাসি, দুটোই। ওষুধের দোকানের পাশেই চায়ের দোকান, ওখানে বসে রুদ্র খুব নরম কণ্ঠে বলে আজ থেকে যাও। রুদ্রর চোখদুটোয় তাকালে আমার এখনও, অবাক কাণ্ড,আগের মতই, কীরকম যেন লাগে। ঘরে ফিরে রুদ্র আমার হাতে আঙুল বুলোয়, আঙুলগুলো দেখি যে আঙুল অন্য কোনও নারীর শরীর ছোঁয় ঠিক এভাবেই। রুদ্র চুমু খায় আমাকে, এভাবেই সে চুমু খায় অন্য নারীদের। রুদ্র বুকে হাত রাখে, এভাবেই সে রাখে অন্য নারীর বুকে। রুদ্র বিছানায় নিয়ে আমাকে শুইয়ে দেয়, সারা শরীরে আদর করে, এভাবেই সে করে আর নারীদের। এভাবেই সে আরেক নারীর সঙ্গে শোয়। কোথাও খুব যনণ্ত্রা হয়। বুকের ভেতরে। নিজেকে বার বার বলি, না, এ জীবন আর নয়। আমি ফিরে যাব ময়মনসিংহে আজই, আর কোনওদিন রুদ্র বলে কোনও মানুষের কথা ভাবব না। রুদ্র আমার পাশে শুয়ে আমার চুলে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে ধরা গলায় বলতে থাকে মদ আর মেয়েমানুষের নেশা তার জীবনের শুরু থেকে ছিল। আমাকে সে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছিল, আমি বুঝিনি। আমাকে তার জীবনের সব খুলে বলার ইচ্ছে ছিল খুব, কিন্তু বলা হয়নি তার। আমাকে বিয়ে করার পর তার যে খুব ইচ্ছে ছিল আগের জীবন যাপন করতে, তা নয়। আমি তার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে দ্বিধা করেছি বলেই তাকে যেতে হয়েছে বেশ্যাবাড়ি। কিন্তু আমার প্রতি ভালবাসা কোনও বেশ্যাবাড়ি গিয়ে নষ্ট হয়নি।
যে পেনিসিলিন আমাকে সুস্থ করার কথা, আমাকে অসুস্থ করতে থাকে আরও। একটি গোটার জায়গায় আরও পাঁচটি গোটা জন্ম নেয়। গোটা আর গোটা নেই, মখু খুলে মেলে দেয়, খোলা ঘা থেকে পাজামায় রস গড়িয়ে নামছে। রস থিকথিকে হয়, রস শাদা থেকে কালো হয়। দগুর্ ন্ধ থেকে দগুর্ ন্ধতর হয়। রসের রং শাদা থেকে বাদামি হয়। বাদামি থেকে গাঢ় বাদামি, গাঢ় বাদামি থেকে লালচে, লালচে থেকে কালচে। কালচে থেকে কালো। কালো থেকে আলকাতরার মত কালো। আমি মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে রাখি নিজের শরীর। আতর কিনে গায়ে মাখতে থাকি। যেন কেউ গন্ধ না পায়। সারা রাত কড়া আলো জ্বেলে রাখি ঘরে, রাত জেগে পড়তে হবে বলে। পরীক্ষা সামনে। টেবিলে নয়, বিছানায় বইখাতা এমন ছড়ানো যে আমি আমার আর বইখাতার পর ইয়াসমিনের শোয়ার জায়গা হয় না। আমি চাই না ওর জায়গা হোক। আমি চাই না এই জীবাণু আমার এই শরীর থেকে আমার জামা পাজামা, বিছানার চাদর বালিশ থেকে ইয়াসমিনকে স্পর্শ করুক। গোসলখানায় গোসল করি একবারের জায়গায় দুবার, কখনও তিনবার। বলি যে আমার গরম লাগছে। এত গরম যে বার বার গোসল না করলে আমার হয় না। গোসল করার উদ্দেশ্য পাজামা ধোয়া। পাজামা ভিজে যায় দগুর্ ন্ধ নির্যাসে। শেষ অবদি আমাকে তুলো ব্যবহার করতে হয়। তুলোও বড় লুকিয়ে। কারণ আমার ঋতুর হিসেব আমার না থাকলেও মার কাছে থাকে। প্রতি মাসেই আমাকে তলপেটের ব্যথায় বিছানায় গড়াতে হয়। সেইসব কোনওরকম উপসর্গ ছাড়াই আমি ঋতুর দেখা পেয়েছি এ একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়াবে। গোসলপেচ্ছাবপায়খানার পেছন দিকে একটি বন্ধ বারান্দায় রক্তভেজা কাপড় তুলো ফেলে দেওয়ার অভ্যেস আমার আর ইয়াসমিনের। বাবা মাঝে মাঝে ওই বারান্দা পরিষ্কার করেন।নিজের হাতে আমাদের রক্তের তুলো তোলেন। ওখানে রক্তহীন কোনও তুলো পড়ে থাকতে দেখলে মার সন্দেহ হবে, ভেবে গুটিয়ে যাই। তুলো যদি পায়খানায় ফেলি, বদনি বদনি পানি ঢেলেও সেটি দূর করা যাবে না। আটকে যাবে পথে, গু মুত সব ফোয়ারার মত উত্থিত হবে। মাথা থেকে সার্জারি মেডিসিন গায়নোকলজি গেছে আমার, মাথায় কেবল একটি রোগ, একটি রোগ থেকে বাঁচার উপায়। শরীরে মাথা ফুঁড়ে বেড়ে ওঠা একটি রোগ সবার চোখ থেকে লুকোনো।
হাসপাতালে প্রতিদিন রোগির চিকিৎসা করছি, অথচ নিজের শরীরে একটি রোগ। এই রোগ নিয়ে কোনও চেনা ডাক্তারের কাছে যাওয়া যায় না। এই রোগ এখন আর প্রাথমিক স্তরে নেই, দ্বিতীয় স্তরে চলে গেছে। পেনিসিলিন ইনজেকশন যেটি নেওয়া হয়েছে সেটিও শরীরে কাজ করেনি। রোগটি তৃতীয় স্তরে এসে স্নায়ুতন ্ত্র অচল করে দেবে। নিউরোসিফিলিসে আক্রান্ত হওয়া মানে মৃত্যু। আমি মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকি। রাতে একটি মৃত্যুকে আমি পাশে নিয়ে ঘুমোই। একটি মৃত্যুকে নিয়ে সকালবেলা জেগে উঠি। কলেজে যাই, সঙ্গে একটি মৃত্যু যায়। কলেজ থেকে ফিরি, একটি মৃত্যু ফেরে। সন্ধের বারান্দায় একা একা বসে থাকি উঠোনের দিকে মখু করে। একটি মৃত্যু বসে থাকে পাশে। এ অবস্থায় একদিন মুখে খাওয়ার পেনিসিলিন ট্যাবলেট কিনি।এ কাজে দেবে না জেনেও কিনি। যদি অ−লৗকিক ভাবেও কাজে দেয়। যদি হাই ডোজ খেয়ে এ থেকে সামান্য হলেও মুক্তি পাই। ওষধু লুকিয়ে রাখি তোশকের তলে যেন কেউ না দেখে। একসময় জ্বর হলে ওষধু লুকিয়ে ফেলে দিতাম, ওষধু খেতে,গিলতে ভয় ছিল। এখন লুকিয়ে ওষধু খাই। এখন বারোটির জায়গায় বাহাত্তরটি খাই। এতেও কিন্তু কাজ হয় না। দাদার ফেলে যাওয়া ওষুধের বাক্স ঘেঁটে ঘুমের ওষধু নিয়ে খাই। অন্তত ঘুমিয়ে যদি মৃত্যুকে আড়াল করা যায়। কিন্তু একসময় জাগতে তো হয়। মার মুখোমুখিও দাঁড়াতে হয়। বাড়ির আর কেউ লক্ষ না করলেও মা ঠিকই লক্ষ করেন, আমি ঠিক আগের মত নেই। কড়িকাঠের দিকে চোখ রেখে শুয়ে আছি, মা দরজার কাছে থামেন, কী এত ভাবস?
না কিছু ভাবি না তো! এমনি শুইয়া রইছি।
আমার কাছে লুকাস কেন?
লুকোনো ছাড়া আমার আর উপায় নেই মা, মনে মনে বলি।
তর কিছু একটা হইছে রে। খুব খারাপ কিছু হইছে তর। খুব খারাপ কিছু আমি পাশ ফিরে শুই। মার মখু যেন আমাকে না দেখতে হয়। অথবা আমার মখু টি মাকে।
রুদ্র আবার মোংলা চলে গেছে। ওখানে বসে ধান চালের হিসেব করে। টাকা গোনে। কবিতা লেখে। আর আমার জন্য হঠাৎ হঠাৎ দুশ্চিন্তা করে। তার দুশ্চিন্তার উত্তর লিখি।
অবকাশ
১৬.৮.৮৩
রোদ,
এগারো তারিখে লেখা তোমার ছোট্ট চিঠিটি হাতে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। তোমার কিচ্ছু ভাল লাগে না, আমার কথা ভেবে তুমি একফোঁটা শান্তি পাচ্ছে! না—এসব পড়ে রীতিমত হাসি পায়। দয়া করে এধরণের কথা অন্তত আমাকে তুমি দ্বিতীয়বার বোলো না। বিশ্বাস করো, আর যা কিছুই সহ্য করি, এসব ন্যাকামো কথায় আমার ভেতরে আগুন জ্বলে ওঠে। আর কত আগুন তুমি জ্বালাবে? পুড়ে পুড়ে আমি তো ছাই হয়ে গেছি। এতটুকু টের পাও না? কিচ্ছু বুঝতে পারো না?
তুমি অনুযোগ করতে আমি নাকি কথা বলি না। আমি তো এখন অনর্গল কথা বলি, প্রচুর হাসি, হাসতে হাসতে ইদানিং আমার চোখ ভিজে যায়। চোখের ভেতরে একটা সমুদ্র লুকিয়ে থাকে, একটি নোনা জলের সমুদ্র নিয়ে এসেছি আমি। প্রতিনিয়ত যে রোগ আমাকে খুবলে খাচ্ছে, তা বাজারে সস্তায় বিক্রি হয়ে যাওয়া খারাপ মেয়ে মানুষদের রোগ। নিজেকে খুব বেশি ভালমানুষ ভাবতাম, ফুলের মত সুন্দর পবিত্র ভাবতাম, একফোঁটা পাপ করিনি কোনোদিন। তাই বোধহয় অহংকারের শাস্তি পেতে হল এভাবে। ফুলে যেমন কীট এসে খেয়ে ফেলে পাপঁ ড়ি, সব সৌন্দর্য নষ্ট করে, মানুষের ঘৃণায় অবহেলায় বেঁচে থাকতে থাকতে একদিন সবার অলক্ষ্যে টপু করে মরে যায়। কেউ তাতে দুঃখ করে না।
খুব বেশি স্বপ্ন ছিল আমার। এতটা স্বপ্ন কেউ দেখে না। খুব বেশি বিশ্বাস আর ভালবাসায় নির্মাণ করা স্বপ্ন। চোখের সামনে দেখেছি আকাঙক্ষার ঘরদোর পুড়ে গেল। পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এখন শাদামাটা মানুষ আমি, স্বপ্নের বালাই নেই। বুকে বাসনা নেই, আশা নেই, আকাঙক্ষা নেই। কেবল একটা মানুষের শরীরের মত শরীর। ভেতরে সব ফাঁকা, সব শূন্য। বেশ হালকা মনে হয় নিজেকে। কেউ নেই, কিচ্ছু নেই, ভবিষ্যতের ভাবনা নেই। কোথায় আছি, কি করছি, এসবও ভুলে থাকতে ইচ্ছে করে বলে ডায়জিপাম খাই। মনে হয় আকাশে উড়ছি, রাতের আকাশ। চাঁদ নেই, জ্যোৎস্না নেই, কালো আধাঁর আকাশ।
বাবা মার উচ্চাকাঙ্খাকে পায়ে মাড়িয়ে, সমস্ত আত্মীয় স্বজনের কল্পনাকে গুড়িয়ে দিয়ে, তাবৎ লোকের সমালোচনাকে তুচ্ছ মনে করে আমি তোমার কাছে গেলাম। বিনিময়ে তুমি আমাকে যা দিলে সে তো আমার সারাজীবনের পরম পাওয়া। তোমার এই উপহার আমি মাথায় করে রাখব।
এ থেকে আমার পরিত্রাণ নেই। তাই তো আমি ভাল হচ্ছি না এবং ভাল হবো না। চারপাশে বড় বড় স্যাংকারে ভরে গেছে। আর প্রতিনিয়ত যে ডিসচার্জ হচ্ছে খুব র্যাপিডলি তার ক্যারেকটার পাল্টাচ্ছে। কালো আবর্জনার মত ডিসচার্জ, দগুর্ ন্ধে ডুবে থাকে শরীর। জটিল একটি ব্যাপার, খুব বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটছে, ষ্পষ্ট বোঝা যায়।
এখন একটি কম−প্লক্স এসেছে আমার মধ্যে, ইনফিরিওরিটি কম−প্লক্স। হঠাৎ খুব বেশি নীরব হয়ে গেছি। কারো সঙ্গেই কথাবার্তা বলি না। সব্বাই খুব পড়াশোনা করে। সামনে পরীক্ষা। আমি কোনোকিছু পড়তে পারি না। বইপত্র ছুঁতে ইচ্ছে করে না।
কেবল ওই আকাশ। রাতের স্তব্ধ আকাশ। কেউ নেই, কিচ্ছু নেই, দুঃখ নেই, সুখ নেই। ভুলতে চাই। ভুলতে চাই। সবকিছু ভুলে থাকতে চাই। তুমি আমার যনণ্ত্রাগুলো জানো না। বুঝতে পারো না। মাঝে মাঝে আমার অবাক লাগে। আমি কি মানুষ!
একটা মানুষের মধ্যে তো অভিমান থাকে, রাগ থাকে, প্রতিশোধের ইচ্ছা থাকে। একটা মানুষের মধ্যে তো ঘণৃা থাকে,বিদ্বেষ থাকে, অবিশ্বাস থাকে। কেবল কি নোনা জলের সমুদ্রই থাকে!
দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে। যেখানে কেউ নেই, কিচ্ছু নেই, দুঃখ নেই, সুখ নেই। যেখানে সব কিছু ভুলে থাকা যায়। কষ্টগুলো এভাবে পোড়ায় না। কতটুকু আগুন তুমি আমাকে দিয়েছো, তুমি জানো না। আমি জানি কি হতে যাচ্ছে আমার শরীরে। তুমি এসব বুঝবে না। এসব খুব খারাপ জিনিস। ভাল মানুষদের এসব হয় না, বাজারে সস্তায় বিক্রি হয়ে যাওয়া খারাপ মেয়েমানুষদের হয়।
সকাল
অবকাশ
২০.৮.৮৩
রোদ,
বড় সাধ ছিল তোমাকে রোদ ডাকার। আসলে এ নামে তোমাকে মানায় না। তুমি তো অন্ধকারের মানুষ। তুমি কালো অভিশাপ ডেকে আনো আলোকিত জীবনে। সুন্দর স্বপ্নগুলোয় দুঃস্বপ্নের কালিমা লেপে দাও। তুমি তো জাহান্নামের আগুনের মত, পুড়ে ছাই করে দাও। তুমি তো ভালবাসতে জানো না, তুমি জানো প্রতারণা করতে। তোমাকে বিশ্বাস করা পাপ, তোমাকে ভালবাসা পাপ। এই পাপ আমার শরীরে ঢুকেছে। আমি কেমন জ্বলে মরছি, জ্বালায় যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত আমি ধং্ব স হয়ে যাচ্ছি, তা তো তুমি জানো। আর কতটুকু ধ্বংস দরকার মরতে হলে? আর কতটুকু? বড় সাধনার ধন তুমি। জীবনভর সাধনা করে আমি একটা নষ্ট মানুষ পেয়েছি। আমার ভাগ্য দেখে তোমার হাসি পায় না রোদ, মনে মনে নিশ্চয়ই তুমি অট্টহাসি হাসো।
জানো রোদ, তোমাকে কাছে পেলে আমি, কি অবাক কাণ্ড, সব ভুলে যেতে চাই। আমার আর কোনও আশ্রয় নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, আর কোনও পথ নেই ঘুরে দাঁড়াবার—তাই হয়ত ভুলতে চাই—ভাবতে চাই সাজানো স্বপ্নের কথা, অস্বীকার করতে চাই তোমার নষ্ট অতীত। আসলে এভাবে হয় না, নিজের সাথে বেশি অভিনয় হয়ে যায়। বুকের মধ্যে চেপে রাখা কষ্টগুলো আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তুমি তো ভালবাসতে জানো না, তাই বোঝোনা এ কষ্ট কেমন, কতটা পোড়ায়।
আজ সারা বিকেল প্রাণভরে কেঁদেছি। এখনও কণ্ঠের কাছে কষ্টের মেঘ জমে আছে। পারি না, আমি আর এভাবে পারি না। এখন কেবল দুঃস্বপ্ন দেখি। পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন। এখন আর সৃষ্টির স্বপ্ন নয়, এখন ধ্বংসের, ভাঙনের দুঃস্বপ্ন দেখি। কষ্ট ভুলতে লোকে মদ পান করে, আমি প্রচুর মদ চাই। ঘুমোবার জন্য ট্রাংকুলাইজার চাই, সিডেটিভ চাই। এরপর মরবার জন্য একটু বেশি ডোজ হলেই চলবে।
জীবনের প্রতি এক ফোঁটা মোহ নেই, ভালবাসা নেই। আমি তো পাথর হতে চাই, পারি না। চোখের ভেতর পুরো একটা নোনা জলের সমুদ্র।
সে রাতে তুমি যখন অল্প অল্প করে আবেগের তুমুল জোয়ার আনলে, আমার শরীরে কোনও অনুভূতি ছিল না। এইসব ব্যাপারগুলোয় নরমাল সেস্কুয়াল অরগানে যে নরলাম স্টিমুলেশন হয়, তা আমার হচ্ছিল না। আমার মাথার ভেতর কেবল যন্ত্রণা হচ্ছিল। তীব্র যন্ত্রণা। তীব্র যন্ত্রণা।
তুমি কেন ঘুমোওনি? আমার যন্ত্রণায়? ঘুম হয়নি বলে সারা সকাল ঘুমোতে চেষ্টা করলে!
তোমার অনুশোচনা হয় না রোদ? এতটুকু অনুশোচনা হয় না? তোমার মরে যেতে ইচ্ছে হয় না? বিষ খেয়ে মরতে পারো না? তুমি মরে গিয়ে আমাকে একটু বাঁচাও। তুমি মরে গিয়ে আমাকে একটু শান্তি দাও।
সকাল
ইনজেকশনেও কাজ হয়নি, ট্যাবলেটেও নয়। আর কোনও রকম ওষুধের কথা তো বইয়ে লেখা নেই। কাজ না হলে ডাক্তারের কাছে যে যাবো, সে উপায়ও নেই। অতএব ছেড়ে দাও, অসুখ অসুখের মত বেড়ে যাক। বাড়িতে এমন কঠিন লেখাপড়া সম্ভব নয় বলে আমি কাপড় চোপড় বই পত্র নিয়ে হোস্টেলে চলে যাই। বাড়ির সকলের বাধাকে তুচ্ছ করার দুঃসাহস আমি দেখাচ্ছি। আমার ইচ্ছে যাব। ওখানে থেকে যে দল বেঁধে পড়া হয় আমার, তা নয়। সাফিনাজের ঘরে, যে ঘরে ওর আরও তিনজন রুমমেট আছে, সে ঘরেই ঢুকি। চারজনের জায়গায় পাঁচজন। এতে কারও আপত্তি নেই। ওরা জানে আমি প্রাণোচ্ছঅল এক মানুষ। ওরা জানে যে আমি হাসতে জানি, আনন্দ করতে জানি। চমৎকার চমৎকার কথা বলতে জানি। আমার উদাসিনতা যেমন সুন্দর, আমার উচ্ছ্বলতাও। ওরা সব জানে, কেউ জানে না একটি রোগ খুব গোপনে গোপনে আমি পুষছি। এই মেডিকেল কলেজ, এই হাসপাতাল, এই রোগ এই ওষধু এই চিকিৎসার রাজত্যের মধ্যিখানে বাস করেও আমার একটি রোগ পুষতে হচ্ছে। ঘাগুলো ধীরে ধীরে নির্যাস কমাতে থাকে, ধীরে ধীরে বীভৎস চেহারাটির পরিবর্তন করতে থাকে, আবার হঠাৎ ফুলে ফেঁপে ফুঁসে ওঠে। আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা খেলছে রোগটি। আমার সঙ্গে লুকোচুরি রুদ্রও খেলছে। ঢাকা ফিরে আসবে বলছে, অথচ আসছে না। এক সপ্তাহ পর ফিরবে বলেছে। দুমাস পার হয়ে যায় ফেরার নাম নেই। রুদ্রর চিঠি এখন আর ডালিয়ার ঠিকানায় আসার দরকার হয় না। হাসপাতালের পোস্ট অফিসের ঠিকানায় আসে চিঠি। পোস্ট মাস্টার আমার চিঠি রেখে দেয় যত্ন করে এক পাশে, তুলে নিই দুপুরের দিকে। চিঠির খামে আবারও কবিতা।
জানি না কখন হাতে বিষপাত্র দিয়েছি তোমার,
পিপাসার জল ভেবে তুমি তাকে গ্রহণ করেছ।
জীবনের খামে মোড়া মৃত্যু এনে কখন দিয়েছি
জানি না কখন হাতে দ্রাক্ষা ভেবে দিয়েছি গন্ধম।
রাত নামে, মৃত্যুময় রাত নামে শরীরের ঘরে,
এই রাত জ্যোৎস্নাহীন, জোনাকিও নেই এই রাতে।
কেবল আঁধার, এক ভাঙনের বিশাল আধাঁর,
কেবল মুত্যুর ছায়া স্বপ্নমগ্ন দুটি চোখ জুড়ে।
জানি না গোলাপ ভেবে বিষফুল করবীর স্মৃতি
কখন দিয়েছি তুলে হেমলক-জীবনের ভার,
কখন নিয়েছি টেনে ঘুণেজীণর্ উষর অতীতে—
আজ শুধু শোচনার ম্লান শিখা সেঁজুতি সাজায়।
আধাঁর মরে না এই রুগ্ন ভাঙা আধাঁরের দেশে,
রোদের আকাঙক্ষা বুকে প্রান্তরের পথে নামে তবু
জীবনের গাঢ় তৃষ্ণা অমলিন ঊর্ণনাভ হিয়া—
রাতের আকাশ তবু নিয়ে আসে রোদের সকাল।
হোস্টেলের জীবন অন্য রকম। পড়ার সময় পড়া, গল্পের সময় গল্প, ঘুমের সময় ঘুম। সাফিনাজের নিয়মপালনে কোনও রকম ত্রুটি থাকার জো নেই। আমি এসেই অনেকটা এলোমেলো করে দিই। আমার রুটিন না মানা জীবন, আর হাতের কাছে এত মেয়ে, এত মেয়েদের গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত আমার কাছে এত নতুন যে আমি বই থেকে বার বার উঠে যাই, ঘুমের সময় গল্প, পড়ার সময় অট্টহাস্য আর আড্ড ার সময়ও আড্ডা দিতে থাকি। যাদের এপ্রোন পরা দেখেছি এতবছর কলেজ বা হাসপাতালে, এপ্রোন খুলে ফেললে যে তাদের আর সাধারণ মেয়েদের মতই দেখতে লাগে, তখন আর সাধারণ মেয়েদের মতই তারা হাসে কাঁদে অভিমান করে, তারা খায় দায় ঘুমোয়, গান গায় নাচে আউটবই জাতীয় জিনিস পড়ে, তারাও প্রেম করে তারাও স্বপ্ন দেখে—পড়াশোনার চেয়ে বেশি উৎসাহ আমার এসবে। আমি রুদ্রহীন জীবন চাই এখন। যে জীবন আমাকে ভুলে থাকতে দেবে আমার অতীত। আমি নিজেকে একা হতে দিতে চাই না। একা হলেই একটি রোগ আমার শরীর থেকে মাথায় ভ্রমণ করে। আমি আত্মহত্যার স্বপ্ন দেখতে থাকি। তবু হোস্টেলেও মাঝে মাঝে একা হতে হয়। একা হলে আবার সেই রোগটি আমার স্নায়ুর ওপর শুঁয়োপোকার মত হাঁটে। আবার রুদ্র নামের একটি দুঃস্বপ্ন। আবার চোখের জল, সে জল চিঠির অক্ষরে পড়ে অক্ষর মুছে দিতে থাকে।
হোস্টেল
১৫.৯.৮৩
রোদ
সেই সকাল থেকে হোস্টেলে বসে আড্ডা দিচ্ছি। খেয়ে দেয়ে এখন সবাই খানিকটা ঘুমোচ্ছে। ঘুম আসছে না বলে আমি লিখছি। তোমার সবকিছু জানিয়ে তুমি নাকি খুব বড় করে আমাকে চিঠি লিখবে, কেন? সব কিছুর শেষে, আমার জীবনের চরম সর্বনাশ করে এখন তুমি তোমাকে জানাবে কেন? আগে জানাতে পারোনি? আগে কেন ভাষার খোলসে ঢেকে রেখেছিলে তোমার আসল আদল? তখন তো নষ্ট হওয়ার মানে বুঝি না, তখন তো অন্ধকারের মানে বুঝি না, উড়নচণ্ডি, এলোমেলো এসবের মানে বুঝি না। তখন কেন স্পষ্ট করে কাঠখোট্টা ভাষায় তুমি আমাকে জানালে না? এসব রকমারি শব্দের আড়ালে কেন তুমি আমার সঙ্গে এতকাল অভিনয় করে গেলে?
আমার আর কি জানার বাকি আছে! কি আর জানা দরকার আমার? আর কি জানাতে চাও? এতকাল বাদে এসব জেনে কি দরকার আমার বলো? তোমার নষ্ট জীবনের কথা আর কতভাবে তুমি আমাকে জানাতে চাও?বিশ্বাস করো আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। যতক্ষণ মেয়েদের সঙ্গে কথা বলি, স্ফূর্তিতে থাকি, ভাল থাকি। বাসায় একা থাকি, কষ্ট বাড়ে। এই হোস্টেলে যদি একটা রুম থাকত আমার, কোনোদিন বাসায় যেতাম না।
তুমি ক্ষমাহীন অন্ধকার কি না আসলে—সন্দেহ প্রকাশ করেছো? আশ্চর্য! তোমার লজ্জা হয় না? তোমার এতটুকু লজ্জা হয় না? তুমি কি মানুষ না জন্তু? তোমার মরতে ইচ্ছে করে না কেন? তুমি ক্ষমাহীন অন্ধকার নও, তবে তুমি কি? তুমি আর কি হতে চাও? পৃথিবীতে এমন কোন দয়ার সাগর আছে তাকে বলো, বলো তোমার কীর্তির কথা, কে তোমাকে ক্ষমা করবে? একটি মানুষ আনো, সারা দেশ ঘুরে তুমি এমন একটি মানুষ এনে আমাকে দেখাও যে বলবে তুমি ক্ষমার যোগ্য, যে বলবে তুমি নষ্ট অন্ধকার নও। পারবে?
তুমি শিল্পের মানুষ জানি। তুমি ভাল কবিতা লেখো, তাতো জানিই। তাতে কি? তোমাকে অন্যভাবে দেখবো মানে? কিভাবে দেখতে বলছো? হ্যাঁ, তুমি যদি আমার কেউ না হতে, তুমি যদি কেবল একটি শিল্পের মানুষই থাকতে, তবে হয়ত অন্যভাবে দেখতাম। তুমি একশ একটা মেয়েমানুষ নিয়ে লীলা করতে, বেশ্যাবাড়ি যেতে, তোমার সিফিলিস হতো, তুমি মদ খেতে, গাঁজা খেতে—তাতে আমার কোনোকিছু আসতো যেতো না। তোমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা থাকতো না। তুমি শিল্পের মানুষ। তুমি যা সৃষ্টি করছ, তুমি যা লিখছ, আমি কেবল তা নিয়েই ভাবতাম। কিন্তু তুমি আমার স্বামী। তুমি শিল্পের হও, অশিল্পের হও, তুমি আমার স্বামী। তুমি অন্য কোনো মেয়েমানুষ নিয়ে ভাবলে, কবিতা লিখলে, বুকে বড় লাগে। তুমি গাঁজা খাও, মদ খাও, দুঃখে কাঁদি। আর কত? বিয়ের আগে হাজারটা মেয়ের সাথে প্রেম করেছো, তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু মেয়ে নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মত রাত কাটিয়েছো, উপভোগ করেছো অন্য কোনো নারীর শরীর, বিশ্বাস করো এসব সহ্য করা যায় না। প্রেমে মত্ত হয়ে কোনো মেয়েকে বিয়ে করার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছিলে একথা শুনলে বুকের ভেতরটা ভেঙে যায়। আমাকে বিয়ে করেছো অথচ তুমি নিয়মিত মদ খাও, বেশ্যাবাড়িতে যাও, এসব তো কোনোকালে কল্পনাও করিনি। এসব কোনো মেয়ে সহ্য করতে পারে না, কোনো মেয়েই পারে না, বিশ্বাস করো। তুমি এক্সাইটেড হবে ভাল কথা, অস্বাভাবিক তো কিছু নয়, তুমি মাস্টারবেট করো। তুমি বেশ্যার কাছে যাবে কেন? তুমি আমাকে এত বড় অপমান করবে কেন?
আমাকে ধোঁকা দিয়ে এতটা পথ এনে তুমি তোমার স্বরূপ দেখালে? এ আমার নারীত্বের অপমান। কোনো মেয়েই এসব সহ্য করতে পারে না। কোনো স্ত্রী এসব সহ্য করতে পারেনা। তুমি আমার কাছে ধরা পড়ে গিয়েও বহুবার মিথ্যে বলার চেষ্টা করেছো। মিথ্যে বলাটাকে আমি দারুণ ঘণৃা করি। অথচ তুিম কি অনায়াসে বলে যেতে পারো, নিজেকে কি সুন্দর লুকোতে পারো! অন্য কোনো মেয়ে এ সময়ে কি করত আমি জানি না। সহ্য করার প্রশ্নই তো ওঠে না এখানে। তবে এটা নিশ্চিত, তোমার মত স্বামী নামক প্রতারকের কাছে কেউ এক মুহূতর্ থাকত না। হয় তোমাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলত, নয় নিজে মরত। নয়ত বেরিয়ে গিয়ে অন্য কোনোভাবে কেঁচে থাকত। কিন্তু আমি কেন এখনো নিজেকে মুক্ত করছি না—ভাবলে আমার অবাক লাগে। আমার কিসের অভাব? তোমাকে ছাড়া আমার জীবন যাপনের এতটুকু হেরফের হবে না। তবে? আসলে বোধহয় আমি খুব ভীরু, পাছে লোকে কিছু বলে এসব ভাবি। অথচ এদুটোকে অস্বীকার করেই তোমাকে ভালবেসেছিলাম। আমি তো তোমার রূপ দেখিনি, কেবল শিল্প দেখেছি, আমি তো তোমার ধন দেখিনি, তোমার শিল্প দেখেছি। তোমাকে সম্পণূর্ আমার করে নিয়েছি।
এখন দুজনের আবেগঘন মুহূর্তে স্মৃতিচারণ এলেই তোমার অতীত খুঁড়ে বের করে আনো পচা গলা নষ্ট জীবন, আমি সহ্য করতে পারি না। তুমি আমাকে কি চমৎকার অসুখ দিলে, এ আমার ভেতর শক্ত খুঁটি গেড়ে বাসা বেঁধেছে। আর কি দেবে তুমি আমাকে? আমার জীবন কি শেষ হয়নি, আমার ভবিষ্যত? আমার তো স্বপ্ন শেষ, সাধ শেষ।
তুমি লিখেছো, সব লিখবে, সব।
কি লিখবে? কি জানাবে? তোমার জীবন জেনে আর আমার কি লাভ? তোমার জীবনে তো আমার জন্য একনিষ্ঠতা নেই, ভাল থাকা নেই, ভালবাসা নেই। আমার স্বপ্নের সেই সুন্দর মানুষ তো তুমি আর হতে পারো না!
তোমার জীবন জানলে কি হবে আমার? কি ফিরে পাবো আমি? তুমি তো আমাকে কোনওদিন ভালবাসোনি। নাছোড়বান্দার মত একগুঁয়ে হয়ে তোমাকে ভালবেসেছি কেবল আমিই। তুমি আমাকে ভালবেসে মানুষ হতে পারোনি। কবিতা লিখেই কি তুমি আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাও, শুধু তোমার কবিতা দিয়েই কি আমার নারীত্ব সার্থক করতে চাও? কোনো মেয়ে কি এভাবে চায়?
তুমি তো বোঝোনা, নারী হয়ে দেখোনি, স্ত্রী হয়ে দেখোনি, এই ব্যাপারগুলো ধ্বংস করে দেয়, জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয় মন। তোমার ভালবাসা পাইনি। তোমার ভালথাকা পাইনি আমার জন্য। তবে কিসের বিশ্বাস থাকে? তুমি অবিশ্বাসের আর প্রতারণার ওপর কি ঘর বানাতে চাও?
তাইতো তোমাকে বলেছি, তুমি বন্ধু হিসেবে চমৎকার। কিন্তু স্বামী হিসেবে তোমাকে কোনো মেয়েই সহ্য করতে পারবে না। পারে না। আনো সারা দুনিয়া খুঁজে আনো এমন একটি মেয়ে যে কি না তোমাকে বলবে—তুমি শিল্পের মানুষ বলে তোমাকে অন্যভাবে দেখা যায়।
এতই যদি অন্যের উদারতা পেতে চাও তবে নিজে তুমি উদারতা দেখালে না কেন? কেন যুদ্ধে ধর্ষিতা কোনো বীরাঙ্গনা নারীকে বিয়ে করলে না? কেন অভাব ও দুর্দশা থেকে একজন বেশ্যাকে বিয়ে করে বাঁচালে না? কেন স্বামী পরিত্যক্তা গৃহহারা কোনো অভাগীকে বিয়ে করে সমাজ ও দেশের উপকার করলে না? দেখাও, কালো কুচ্ছিত একটি আইবুড়ি বিয়ে না হওয়া মেয়েকে বিয়ে করে, রাস্তার একটি অনাথ ভিখিরি মেয়েকে বিয়ে করে দেখাও। অথবা নিজের স্ত্রীকে একশ একটা পরপুরুষের কাছে সঁপে দাও, এরকম উদারতা এখন দেখাও! আমার এতে কিছু যায় আসে না। তোমার কোনো কিছুতে এখন আমার কিছু যায় আসে না। তবে অন্যের উদারতা আশা করার আগে নিজের ওই উদারতাটুকু আমাকে দয়া করে দেখিও।
সকাল
আমি ফিরব না রুদ্র, মনে মনে বলি। আমি আর ফিরব না, আমি নৈঃশব্দের সঙ্গে বেঁধেছি ঘর। তুমি আমাকে আর ওই নষ্ট অতীত স্মরণ করিও না। আমাকে একা থাকতে দাও। রুদ্র আমাকে একা থাকতে দেয় না তবু। তবু তার কবিতা এসে আমাকে বিষণ্ন করতে থাকে।
নীরবতা কোনও এক উদাসীন পাথরের নাম—
অহল্যা সে কোনওদিন জানি আর হবে না জীবন।
হবে না সে পারিজাত, কোনোদিন হবে না সকাল,
দিন আর নিশিথের সন্ধিক্ষণে থেকে যাবে জানি—
অহল্যা সে চিরকাল থেকে যাবে, রক্ত মাংস নিয়ে।
যাবে না সে দগ্ধ ক্ষুব্ধ মানুষের মিছিলে কখনও,
পোড়া মানুষের ক্ষত, রক্ত, গ্লানি বুকে সে নেবে না,
যাবে না সে জানি আর কোনওদিন সবুজ নিভৃতে।
ছোঁবে না সে চিবুকের থরো থরো বিষণ্ন উত্তাপ,
সেই হাত কখনও ছোঁবে না আর উদাসীন চুল।
নিঃশ্বাসের ঘ্রাণে আর জাগবে না ভেজা চোখ দুটি,
নক্ষত্রের স্মৃতি শুধু বেঁচে রবে স্নায়ুর তিমিরে।
হবে না বেহুলা জানি সে কখনও গাঙুরের জলে
ভাসবে না ভেলা তার, ভাসবে না স্বপ্নের সাহস,
বেহুলার স্বপ্ন-ভেলা কোনওদিন জলে ভাসবে না—
নীরবতা কার নাম? কার নামে নির্বাসন জ্বলে?
রুদ্র মোংলা থেকে ফিরে এলে হোস্টেল থেকে ঢাকা চলে যাই। বাড়ির কাউকে বলার প্রয়োজন নেই যে আমি ঢাকা যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি সে কথাও কেউ জিজ্ঞেস করার নেই। যাচ্ছি, আমার ইচ্ছে। এই উত্তরটিও আমার প্রয়োজন নেই উচ্চারণ করার। মাসের পর মাস ধরে পুষে রাখা অসুখ টি এখন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে দেখতে হবে। কোনও ডাক্তার চাই, অচেনা ডাক্তার। শাহবাগের মোড়ের একটি ডাক্তারের চেম্বারে রুদ্র আমাকে নিয়ে যায়। ডাক্তারকে সে বলে, এ অসুস্থ। কোথাও ঘা হয়েছে, যাচ্ছে না।
ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় ঘা?
রুদ্র আমার দিকে ফিরে বলে, কোথায় ঘা বল।
তুমি বল।
রুদ্র ডাক্তারের দিকে ফিরে বলে, ওর প্রাইভেট পার্টসে।
কবে হয়েছে? কি রকম ঘা? ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন।
রুদ্র তারিখ গোনার চেষ্টা করে। আঙুলের কড়ায় মাস গোনে। আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে কোনওরকম রাখঢাক না করেই বলি, এ আমার স্বামী, এর সিফিলিস হয়েছিল, আমাকে সংক্রামিত করেছে। পেনিসিলিন নিয়েছিলাম। কিন্তু এখনো ভাল হচ্ছি না।
ও এই কথা।
ডাক্তার অনেকক্ষণ আমাদের দুজনকে দেখলেন বোকার মত। তিনি আগে আমাদের দেখেছেন এ এলাকায়, তার চোখ দেখেই বুঝি। ডাক্তার রক্ত পরীক্ষার কথা লিখে দেন। রক্ত দিয়ে, তাজমহল রোড মুহম্মদপুর। ওখানে বসে থাকো। ওখানে কবিতা পড়ো। ওখানে রুদ্রর সংসার -স্বপ্ন দেখো। রুদ্র থাল বাসন কিনবে। এ বাড়িতে সংসার গড়ে তুলবে সে। ছোট সংসার,সুখী সংসার। রুদ্র আপাদমস্তক শুদ্ধ হয়ে উঠবে। আমাকে আর কোনওদিন দুঃখ পেতে হবে না। কোনওদিন কষ্ট পেতে হবে না আর। একবার যেন আমি তাকে ক্ষমা করি। ক্ষমা জিনিসটি নিয়ে তাকে আগেই আমি বলেছি। রুদ্রর মেয়েমানুষের নেশা আছে, মেয়েমানুষ পেলে তার মাংস নিয়ে খেলতে তার আনন্দ হয়। এ তার হঠাৎ করে হয়ে যাওয়া কোনও ভুল নয়। নিজের জীবনের সব কথা যদি সে আগে খুলে বলত, আমি আমার জীবনটি তার সঙ্গে জড়াতাম না। কিন্তু সে বলেনি। ভুল সেখানে। ভুল তার নেশায় নয়। এ সম্পণূর্ ই তার ব্যক্তিগত নেশা। এ রকম নেশা মানুষের থাকে। তার নেশাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। দিচ্ছি তার প্রতারণাকে। এই প্রতারণার একটিই উত্তর, সেটি তাকে ত্যাগ করা। ভেরি সিম্পল।
ভিডিআরএল পজিটিভ।
আবারও ইনজেকশন নিতে হল। একদিন নয়। তিনদিন।
তিনদিন পর ময়মনসিংহে ফিরি। হোস্টেলে। কাউকে জবাব দিতে হয় না কোথায় ছিলাম, কার কাছে। একধরনের মুক্ত জীবন। অথচ এই জীবনটিকে রুদ্রর বিষাক্ত হাওয়ায় আমি উড়তে দিই না। একটি মুক্ত জীবনের সাধ ছিল কত, পেলে যেন ঢাকার সাহিত্য অঙ্গন সাংস্কৃতিক চত্ত্বর চষে বেড়াবো। কই! আমার তো একটওু ইচ্ছে করে না। আমি ফিরে আসি, রুদ্র পেছনে নিজের ওই ঘরে বসে লেখে,
বুকের ভেতরে জ্বলে, জ্বলে ওঠে নির্বাসন -শিখা।
পরান পোড়ায়ে আজ নির্বাসনে চলেছে সকাল
শরীর পোড়ায়ে আজ নির্বাসনে চলেছে সকাল
পৃথিবী আঁধার করে নির্বাসনে চলেছে সকাল..
কুসুমের মর্মমূল ছিঁড়ে গেছে গোপন-ঘাতক।
দখল নিয়েছে ঘণু আজ নীল নক্ষত্রের দেশে,
নিয়েছে রঙিন ঘুড়ি ছিঁড়ে ওই দিগন্তের গ্রাম,
ফিরে আসে ব্যথর্ সুতো, ফিরে আসে স্বপ্নভাঙা হিয়া।
বিষের পেয়ালা হাতে দাঁড়িয়েছে ঘাতক সময়—
নগ্ন এই দুই চোখে সর্বনাশা অপচয় জ্বলে,
সময় দিয়েছে তুলে এই হাতে অফুরন্ত ক্লেদ,
দিয়েছে রক্তে মাংসে জীবনের তপ্ত অন্ধকার।
ঘোর কৃষ্ণপক্ষ রাত, দুঃসাহসে ছুঁয়েছিল তবু
আধাঁরে পুড়েছে আজ স্বপ্ন তার নিভৃত নগর,
আধাঁরে পুড়েছে তার বিশ্বাসের সবুজ নিখিল।
স্বপ্নহীন পোড়া ভিটে, পোড়া ঘর—কে ফেরাবে তারে?
কেবল কবিতা নয়। রুদ্রর পর পর অনেকগুলো চিঠির উত্তর লিখতে বসি। ঘা সেরে যাওয়া রুদ্র এখন মরিয়া হয়ে সংসারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। ঘা সেরে যেতেই সে ভুলে গেছে আমাদের দুজনের মাঝখানে এখন একটি রোগ না থাক রোগের স্মৃতি আছে। মাঝখানে একটি দগদগে অবিশ্বাস আছে। আমার ভোলা হয় না।
অবকাশ
৪.১০.৮৩
রোদ,
বাসায় চলে এসেছি আজ দুপুরে। আসলে বাসা ছাড়া অন্য কোথাও আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। বড়জোর দুদিন কিম্বা তিনদিন। শেষ পর্যন্ত হোস্টেলেও থাকতে পারিনি। আসলে সারা জীবন যে পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, হঠাৎ করে তার পরিবর্তন সহ্য করা যায় না। শুধু বিছানায় শুয়ে, টেবিলে পড়ার বই পড়ে আমার জীবন এগোতে চায় না। প্রচুর আড্ডা আছে, আনন্দ আছে। কিন্তু জীবন এগোতে চায় না। আমার যখন ইচ্ছে যেমন ইচ্ছে পা ছড়িয়ে অথবা পা গুটিয়ে শুয়ে থাকব, একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে আমার বহুকিছু পড়ার আছে, করার আছে। আমার লিখতে হয়, আমার মাথার মথ্যে দুলক্ষ ভাবনা চিন্তুা এলোমেলো নাচানাচি করে একেবারে নিশব্দে আমাকে একা থাকতে হয়।
যাবতীয় ঝুটঝামেলা, একশ একটা কাজের কাজ ফেলে আমাকে উদাসীন হতে হয়— এ আমার চিরকেলে স্বভাব। তাই বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি না। এখানে আমার নিজস্ব একটাজট পাকানো আগোছালো সংসার আছে। আমি একাই এর অধিশ্বর। আমার এই নানান ধরণের বইয়ে কাগজে এলোমেলো ধুলোবালির বিছানায় খানিকটা কিনার করে শোয়ার জায়গা করে নিই, গভীর সুনিদ্রায় রাত্রি পেরোয়। অথচ সাজানো গোছানো পরিপাটি অন্য বিছানায় আমার একরত্তি ঘুম আসে না। অস্বস্তিতে এপাশ ওপাশ করে কষ্টের রাত্রি পেরোয়।
বইখাতার কোনো ঠিক নেই। কিচ্ছু ঠিকঠাক খুঁজে পাই না, একটি আকাশে তো আরেকটি পাতালে। একটি এ মাথায়, আরেকটি ও মাথায়। তবু পড়াশোনা হয়। খুব অল্প সময় গভীর মনোযোগে পড়তে পারি।
এটা ঠিক নয় যে বাড়িসুদ্ধ লোক সবাই আমাকে খুব ভালবাসে, স্নেহ করে, আমার প্রয়োজন আমার সুবিধে অসুবিধে একটু বিচার করেদেখে। তা কেউ করে না। সম্ভবত এ বাড়িতে আমি একটি অহেতুক অপ্রেয়োজনীয় মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকছি। এটা ঠিক যে আমি এখন মরে গেলেও এ বাড়ির কেউ একফোঁটা কাঁদবে না, এতে কারো কিছু যায় আসে না। আমি খুব বেশিরকম অপরাধি মানুষ বলে এ বাড়ির সকলে ভাবে। ইদানিং এসব আর গায়ে মাখি না। আদরিণী কন্যার মত এখন আর কারো কাছে কোনোকিছুর আবদার করি না। কোনো কিছু নিয়ে অনুযোগ করি না। আমার একা থাকার এবং ভাবনার রাজ্যে অবাধ বিচরণের সময়সীমা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমি এদের কাছে কৃতজ্ঞ। আসলে হোস্টেলের শাদামাটা গোছানো জীবনে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। যেন খাঁচা থেকে উড়াল দিয়ে বনের পাখি বনে পালাতে চাই।
তোমার ঘরেও অবিকল একই অবস্থা। আমার দম বন্ধ হয়ে যায়। পারি না। আমার ভাল লাগে না। বড়জোর দুদিন, এরপর সবকিছু অসহ্য লাগে আমার। এমনকি তোমাকেও, তোমার চালচলন, কথাবার্তা সব।
যে চরম পর্যায়ে আমাকে নিয়ে তুমি নিজেকে দমন করতে পারো, আমি পারি না। তাই অজান্তে ওই চরম ভুলটি হয়ে গেল। এতে এখন অবশ্য আমার একটি লাভ হয়েছে, তা হলো, এসবে চরম বিতৃষ্ণা এসেছে। আমি এখন খুব সহজেই স্বাভাবিক তৃষ্ণাগুলোকে অনায়াসে দমন করতে পারি। এ আমার জন্য খুব লাভ হল। কিন্তু লাভ ছাড়া যে ক্ষতিটা হয়ে গেল এবং অল্প কদিনের মধ্যে যা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাবো সে ক্ষতি থেকে আমাকে তুমি যে করেই হোক দয়া করে বাঁচিয়ো। অন্তত একটু নির্ভরতা থাকলে শান্তি পাবো।
ব্যস, আর কিছু চাই না। যে অসুখ টি যাচ্ছে না এবং যাবে না তা নিয়ে অযথা ঢাকা ময়মনসিংহ করে লাভ নেই। কারণ ও রোগ যাবে না। ও রোগ নাছোড়বান্দার মত আমার গায়ে সেঁটেছে। আমাকে বিনাশ করে তবেই ওর সুখ ।
সেই যে বলেছিলাম হুট করে আবেগে আবেগে কিছু একটা করে আমাকে সারাজীবন পস্তাতে হয়। ঠিক তাই। যদি উদাহরণ চাও বলব, তোমাকে চিঠি লিখেছি, তোমার সঙ্গে প্রেম করেছি, তোমাকে বিয়ে করেছি, তোমাদের বাড়িতে গিয়েছি, নিজেকে সমপর্ণ করেছি.. মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি নিজেকেই কার কাছে সমপর্ণ করেছি?: এর কি উত্তর আমি দেব? চারপাশ থেকে হা হা হাস্যধ্বনি ওঠে।
এর কোনো সদুত্তর আমি জানি না। লোকে বলে, অতি সোজা মানুষ যদি একবার বেঁকে বসে তখন আর রক্ষে থাকে না। একবার বেঁকে বসতে ইচ্ছে করে। একবার তছনছ করে, চুরমার করে ভাঙতে ইচ্ছে করে তোমার সাজানো স্বপ্ন। একবার জ্বালাতে ইচ্ছে করে তোমার সংসার। আমাকে যেমন ভেঙেছো, আমাকে যতটা কাঁদিয়েছো, ততটা তোমাকে কাঁদাতে ইচ্ছে করে। কষ্টের আগুনে পোড়াতে ইচ্ছে করে। কেন ইচ্ছে করবে না বলো? আমি তো মানুষ, দেবতা নই। দেবতা নেই বলে আমি তোমার ঘরে যাবো না। সুন্দর সাজানো গোছানো ব্যাপার স্যাপার, বাড়ি যাওয়া, বিয়ের অনুষ্ঠান, সামাজিকতা, দীর্ঘদিন থেকে খেয়ে বিশ্রাম নেওয়া, ঢাকায় প্রেসের কাজ, হাঁড়িকুড়ি কেনা, রান্নাবান্না, ঘরে খাওয়া, নিয়মমাফিক ঘরে ফেরা, রাত হলে বউকে নিয়ে শুয়ে থাকা—ইত্যাদি কোনোকিছুই আমি হতে দেব না। এতো সহজেই তোমার মত মানুষের হাতে সুখের পাখি ধরা দিক, তা আমি চাই না। তোমার জন্য কেন আমি বাড়ির সবাইকে ফাঁকি দিয়ে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাইকে ফাঁকি দিয়ে, আমার এই এতদিনকার প্রিয় আগোছালো জীবন থেকে চলে যাবো প্রেমে মত্ত উন্মাদিনীর মত? তুমি আমাকে কি দিয়েছো এবং কি দেবে? যার বিনিময়ে এমন করে তোমার সঙ্গে চলে যাওয়ার সাহস আমি করতে পারি! তুমি কি কারণ দেখাবে? ওই একটি সই করা বিয়ের কাগজ! ঠিক ওরকম একটি সই করা তালাকনামাও পাওয়া যায়! এ কথা নিশ্চয়ই জানো। যদি বলো এদ্দিনকার মেলামেশা! আমি বলব ভুল। শুরু থেকে সবটাই আমার ভুল। হুট করে আবেগে আবেগে কিছু একটা করে ফেলা।
আমি তো মানুষ, দেবতা নই। তাই ভুল করেছি। এবং ভুল থেকে নিজেকে মুক্ত করার সাহসও আছে। একটু সাহস তুমি আমার থাকতে দাও। তুমি তোমার পরিকল্পনাগুলো বাদ দিয়ে দাও। আমি আমার এই বিরুদ্ধ পরিবেশকে যথাসম্ভব মানিয়ে নিয়েছি। একা থাকতে আমার এখন ভাল লাগে। চারপাশের শত্রুতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখত দারুন একটা সুখ । এখানে আমি কারো সাতে পাঁচে নেই। আমার জন্য কেউ ভাবে না, আমি ও কারো জন্য ভাবি না। ব্যস সুন্দর কেটে যাচ্ছে।
প্রেম করে ঘর ছাড়ব, অতবড় প্রেমিক তুমি হতে পারোনি। লক্ষ্মী স্ত্রী হয়ে সংসারে মন দেব, অত বড় স্বামী তুমি হতে পারোনি। তোমার জন্য জীবন বাজি রেখে পৃথিবীসুদ্ধ তুলকালাম কাণ্ড বাঁধাবো, অতটুকু মানুষ তুমি হতে পারোনি।
তোমার ঘরের চেয়ে আমার এই ঘরে সুখ না থাক, শান্তি আছে। এখনো আমার সুনিদ্রা হয়। তোমার কাছ থেকে দূরে থেকে, আমার ভুলগুলোকে আমি ভুলে থাকতে পারবো। আর যেভাবেই আমি বেঁচে থাকি না কেন, ভাল থাকব। এটুকু নিশ্চয়তা তোমাকে আমি দিতে পারি। আমার কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি আমার ঘরে ফিরে এসেছি। আমি আমার মা বাবা ভাই বোনের কাছে ফিরে এসেছি—তা কিন্তু নয়। আমি আমার কাছেই ফিরে এসেছি। এবং বাকিটা জীবন আমি আমার কাছেই থাকব। পৃথিবীতে আমার চেয়ে বেশি আমাকে আর কেউ ভালবাসে না। আমি ছাড়া আমার সবচেয়ে আপন আর কেউ নেই।
তুমি আমাকে ভুলে যেও। অঘটন এ যাবৎ বহু ঘটেছে, আর ঘটাতে চেষ্টা কোরো না। দয়া করে আমাকে ভুলে যেয়ে আমাকে বাঁচাও।
আমি তো মানুষ। মানূষ বলেই বহুদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।
সকাল
আমি যখন বেঁচে থাকায় মন দিয়েছি, রুদ্র ময়মনসিংহে এল। এল কিন্তু কিছুই আর আগের মত নয়। আমাদের সেই আগের মত দেখা করা, আবার আগের মত ভালবাসার হাওয়ায় হাওয়ায় দোলা, চেয়ে থাকা দুজনের চোখে কথাহীন শব্দহীন কিছুই হয় না। মাসুদের বাড়িতে বসে যে কবিতাটি লেখে সে, ঢাকা ফেরত যাবার সময় আমাকে ডাকে পাঠিয়ে যায়। কবিতাটি যখন বাড়ির ছাদে বসে সূর্যাস্তের মুছে যেতে থাকা আলোয় পড়ছিলাম, হু হু করে ওঠে বুকের ভেতর। তার প্রতিটি শব্দ আমাকে স্পর্শ করে। একা আমি কাঁদি বসে, অনেকক্ষণ কাঁদি, নিজের জন্য কাঁদি, রুদ্রর জন্য কাঁদি।
তোমাকে ফেরাবে প্রেম, মাঝরাতে চোখের শিশির,
বুকের গহীন ক্ষত, পোড়া চাঁদ তোমাকে ফেরাবে।
ভালবাসা ডাক দেবে আশ্বিনের উদাসীন মেঘ,
তোমাকে ফেরাবে স্বপ্ন, পারিজাত, মাটির কুসুম।
তোমাকে ফেরাবে প্রাণ, এই প্রাণ নিষিদ্ধ গন্ধম,
তোমাকে ফেরাবে চোখ, এই চোখ শাণিত আগুন,
তোমাকে ফেরাবে হাত, এই হাত নিপুণ নির্মাণে,
তোমাকে ফেরাবে তনু এই তনু নিকষিত হেম।
তোমাকে ফেরাবে ওই নিশিথের নিদ্রাহীন পাখি,
বুকের বাপাঁশে জমা কালো এক কষ্টের কফিন,
তোমাকে ফেরাবে ফেনা, সমুদ্রের আদিগন্ত সাধ,
সৌরভের ভেজা চোখ, নীলমাছি ফেরাবে তোমাকে।
এই বিষ-কাঁটালতা ভালবেসে আগলাবে পথ,
ঝরা শেফালির শব পড়ে রবে পথের উপর,
নিভৃত অঙ্গার এক চিরকাল তোমাকে ফেরাবে,
অনুতপ্ত অন্ধকার মৃত্যু ছুঁয়ে ফেরাবে সকাল।
নির্বাসন আমার জন্য নয়। ট্রিপোনেমা পেলিডাম যত শক্তিমানই হোক, এর শক্তি নেই রুদ্রর জন্য আমার ভালবাসাকে এতটুকু মলিন করে। জীবনে মানুষ একবারই সম্ভবত ভালবাসতে পারে, বার বার পারে না। আর কারওর জন্য তো বুকের ভেতর এত কষ্ট জমে না, আর কারওর জন্য তো চোখের জল এমন ঝরে না! রুদ্রর ভালবাসাই আমাকে ফিরিয়েছে, আর কিছু নয়। আমি তার ভালবাসার কাছেই হেরে যেতে পারি। রুদ্রকে ঘৃণা করতে চেয়েছি প্রাণপণে, পারিনি। তার কবিতার প্রতিটি শব্দ আমার সেই চাওয়াকে দূরদূরান্তে উড়িয়ে দিয়েছে। সূর্যাস্তের দিকে জল-চোখে চেয়ে নতুন একটি দিনের কথা ভাবি। সব অন্ধকার ধুয়ে দিয়ে যে দিনটি কাল আসবে, সে দিনটি নিশ্চয় অন্যরকম হবে।