১৭-১৯. নবীন সন্ন্যাসীরা চলে গেছেন

নবীন সন্ন্যাসীরা চলে গেছেন। তাঁরা নাকি বদ্রীবিশালে যাবেন। সেখানে হরিদ্বার থেকে কোন সাধু গিয়ে নাকি কায়কল্প করছেন। নবীন সন্ন্যাসীদের গুরুজির গুরু সেখানে যাবেন। এমনিতেই সারা শীতকালই নাকি বরফের মধ্যে সমাধিস্থ থাকেন সেই সাধু। তাঁর বয়স হয়েছে একশ দশ। কায়াকল্প করে তিনি পুনর্জীবন লাভ করবেন। আবার নাকি যুবাপুরুষ হয়ে উঠবেন। এই পুরনো জীবনকে সাপের খোলসের মতন ছেড়ে দিয়ে ফিসে শুরু করবেন বাঁচা।

কলকাতা ছেড়ে এই দেবভূমিতে আসার পরে এতজনের মুখে এতরকম উদ্ভট উদ্ভট সব কথা শুনছে যে মস্তিষ্কই বিকৃত না হয়ে যায় চারণের।

জিষ্ণু মহারাজ চন্দ্রবদনীজির মন্দিরের কাছে প্রস্তরাশ্রয়ে বসে চোখ বুজেই চন্দ্রবদনী কী রঙের কম্বলের তলাতে শুয়ে কোন বই পড়ছে, তা অবলীলায় বলে দিতে পারেন। ওঁরা হয়তো সবাই বুজরুক, নয়তো চারণকে বাংলা পড়াচ্ছেন। অথচ এদের কারওই চারণের কাছ থেকে কিছুমাত্রই চাইবার নেই। নেই বলেই, ওঁদের অবিশ্বাস করতে, উড়িয়ে দিতে, মন সায় দেয় না।

সকালবেলায় তুরতি যে হালুয়াকচৌরি খেয়েছেন তার দামের যা অর্থমূল্য তা চারণের কাছে কতটুকু! কলকাতাতে ওবেরয় গ্রান্ড বা তাজ বেঙ্গল বা জারাং ও বা সিভিল-এ খেয়ে ওয়েটারদের একদিনেই যা বকশিস দিতে হয় তা দিয়ে তুরতিকে মাসভর নাস্তা করানো যায় প্রতিদিনই পেট পুরে। তাই কোনও অঙ্কতেই এই সবের ব্যাখ্যা সে খুঁজে পাচ্ছে না। বুজরুকি করে বা কারওকে ঠকিয়ে যদি কোনও লাভই না থাকে, তাহলে এরা মিছিমিছি মিথ্যে বলতেই বা যাবেন কেন? এই সরল প্রশ্নটিই বারেবারে তাকে বিদ্ধ করছে। অথচ চারণ আধুনিক এবং ইংরেজি শিক্ষাতে শিক্ষিত। ওর পক্ষে এসব মেনে নেওয়াও সহজ নয়। ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে ওর যা গুমোর ছিল তাও তুরতিই ভেঙে দিলেন আজ সকালেই। তুরতির ক্ষেমি বাঈজির মেয়েকে ব্যায়লা বাজানোর গল্পও বানানো বলেই এখন মনে হয় এবং সেই গল্পের গরুকে গাছে ওঠাতে জিষ্ণু মহারাজও যে সাহায্য করেছেন তাতেও সন্দেহ নেই। তুরতি চারণের চেয়ে একটুও খারাপ ইংরেজি জানেন না এবং একুটও কম শিক্ষিতও নয় কিন্তু সেটা সযতনে লুকিয়ে রেখেছিলেন এতদিন! আশ্চর্য!

কিন্তু কেন?

নবীন সন্ন্যাসীরা সকালেই চলে গেছেন কিন্তু তার বদলে তিনজন প্রবীণ সন্ন্যাসী এসে হাজির দুপুরবেলাতে। তাঁরা নাকি মায়াবতী থেকে আসছেন। এই মায়াবতীতে স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন। সেখানে রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমও আছে বলে শুনেছে চারণ। কিন্তু মায়াবতী তত কুমায়ু হিমালয়ে। এই নবীন-প্রবীণ সাধু সন্ন্যাসীরা কি অদৃশ্য হেলিকপ্টার বা পুষ্পক রথে চলা-ফেরা করেন? কুঁমায়ু হিমালয়ের আলমোড়া থেকে মায়াবতী যেতেই বেশ ঝক্কি পোয়াতে হয় সে কথা চারণ জানে। কুঁমায়ু হিমালয়ের অত্যন্ত গভীরে সে জায়গা অবস্থিত। আর ওরা কোন কৌশলে ঝুমায়ু হিমালয়ের গভীর থেকে গাড়োয়াল হিমালয়ের চন্দ্রবদনীতে চলে এলেন কে জানে! বাসে এলেও তো বেশ সময় লাগার কথা। কিসে এসেছেন তা জিজ্ঞেস করেনি অবশ্য চারণ তাঁদের। তাঁদের মুখে দীর্ঘ পথভ্রমণের কোনওরকম ক্লান্তির চিহ্ন নেই। বড় আনন্দময় তাঁদের মুখমণ্ডল।

সেই পক্ককেশ সন্ন্যাসীরাও নাকি জিষ্ণু মহারাজের সঙ্গে দেখা করতেই এসেছেন। তারপর ওঁরাও চলে যাবেন গুপ্তকাশী। সেখানে কিসের এক সম্মেলন আছে সন্ন্যাসীদের। তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের ওপরে অথরিটি একজন বৌদ্ধ লামা আসছেন সেখানে। সাতদিন বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্মের মিল-অমিল নিয়ে নাকি আলোচনা হবে। চারণেরা যাকে বলে সেমিনার। এয়ারকন্ডিশানড কনফারেন্স রুম থাকবে না, সুইমিং পুল-এর পাশে দুপুরে ককটেইলস অ্যান্ড লাঞ্চ থাকবে না। ভজনং যত্র তত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে।

চারণ ভাবছিল, এ যেন কোনও সামিট-মিটিং। সেমিনার করে ফিরিওয়ালারা।

বিষ্ণু মহারাজের এই প্রস্তরাশ্রয়ে সঙ্গে দেবপ্রয়াগের পাটনের গুরুর আশ্রমের বিশেষ কোনও তফাৎ নেই। পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকেই মানুষ আসছেনই অনবরত। এ যেন কোনও রেল স্টেশনের প্লাটফর্ম। আসে অনেকে, কিছু সময় থাকেও অনেকে, কিন্তু এই স্থানের ওপরে কারওরই দাবি নেই। পাঁচ-দশ বছর এক জায়গাতে বাস করেও কোনও অধিকার জন্মায় না কারোরই কোনও বিশেষ স্থান বা বাসস্থানের উপরে। না থিতু হয়ে বসা সন্ন্যাসীর কোনও দাবি জন্মায় তার স্বত্বে, না আগন্তুকের। এ ভারী এক আশ্চর্য পত্তন ব্যবস্থা। সারা পৃথিবীর সব বাড়ি-জমির ব্যাপারেই এই পাট্টা চালু থাকলে জমি নিয়ে এত মারামারিই থাকত না। সারা পৃথিবীই প্রকৃতার্থে কম্যুনিস্ট হয়ে যেত।

এখানে সাধু-অসাধু সবরকম মানুষই আসছে। অসাধু ছিলেন তাই সাধু হতে চান কেউ, আবার সাধুত্বে ইস্তাফা দিয়ে অসাধু জীবনে চলে যেতে চান কেউ। কেউ বা চারণের মতনই জীবনকে শুধুমাত্র চেখে দেখতে, জীবনের গন্তব্য শুধরাতে এখানে আসে, জীবনকে Sampling করতে।

একদিন চারণও ফিরে যাবে বেগবতী নদীতে অনেক দূর বেগে গড়িয়ে গিয়ে ঘর্ষণে ঘর্ষণে নিজের জ্ঞানবুদ্ধির শুকনো ধারণাকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দিয়ে, ঝাঁকিয়ে নিয়ে, অনেকদিন ব্যবহার না করা চানাচুরের বয়ামের মতন। ফিরে গিয়ে, গৃহী হবে। কিন্তু অন্ধ-গৃহী নয়। চোখ-খোলা গৃহী। অকারণ মন আশা কোরো না, অনিত্য সুখেতে মন মজো না তুরতির এই চমৎকার গানের বাণী সেই গৃহীর মাথার মধ্যে গুণগুণ করবে অবিরত।

সন্ধ্যের পরে পরেই তুরতি সিদ্ধির সরবত বানাতে লেগে গেলেন। কে সিদ্ধি যোগায়, কে মালাই, কেই বা চিনি? তা কে জানে!

আজ আলোচনা হচ্ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কি বোঝায় তা নিয়ে।

জিষ্ণু মহারাজ বললেন, শব্দটার প্রকৃত মানে বোঝেন আমাদের দেশের কম মানুষই। আর রাজনীতিকরা বুঝেও সেই মাননকে বিকৃত করেন।

প্রবীণদের মধ্যে যিনি কালো ও মোটা তিনি বললেন, কথাটা ঠিক। সাধারণ মানুষ তো বটেই অনেক সাধু-সন্ন্যাসীরাও বোঝেন না।

মোটা ও কালো অথবা ফর্সা-রোগা প্রবীণ সন্ন্যাসীদের কারওরই নাম জানার কোনও আগ্রহই ছিল না চারণের। সেকালের কুলীন জামাই-এর স্ত্রীসঙ্গ করারই মতন ওঁরাও ওই সৎসঙ্গে থাকবেন মাত্র একরাত। তারপরেই বিদায় হবেন। মিছিমিছি নাম জেনে লাভই বা কি?

দু-তিন পাত্তর করে সিদ্ধি খাওয়ার পরে নানা উচ্চমানের আলোচনা শুরু হল। তবে আজ আর চারণের পেট খালি নেই। নবীন সন্ন্যাসীরা এবং তুরতি মিলে দারুণ একচড়া বেঁধেছিলেন দুপুরে। সুগন্ধি আতপ চাল, তার মধ্যে আলু, কাঁচালঙ্কা আর সঙ্গে খাঁটি গাওয়া ঘি। এমন ঘি বহুকাল পরে খেল ও। কতদিন আগে সেই হাজারিবাগে খেয়েছিল। চমনলাল বলত, তুড়ি মারো না দাদাবাবু, মারো, দেখবে, পারবে না। আঙুল পিছলে যাবে। সত্যিই আঙুল পিছলেই যেত। সেই ঘি-এ তৈরি হালুয়া বা খিচুড়ি খাওয়ার বেশ কয়েকদিন পর পর্যন্ত তর্জনী বুড়ো আঙুলের সঙ্গে অসহযোগিতা না করত।

জিষ্ণু মহারাজের উল্লিখিত প্রসঙ্গে ফিরে এসে রোগা ও ফসা সন্ন্যাসী মুখ খুললেন। দুজনের মধ্যে ইনিই বয়োজ্যেষ্ঠ। সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়র মানুষ। ওর হিন্দিতে তামিল ভাষার প্রভাব পরিষ্কার বোঝা যায়। ইংরেজিতেও বোঝা যায়ই! মনে হল, ইংরেজিতে কথা বলতেই উনি হিন্দির চেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ। যদিও Not-কে নাট, Good-কে গুড়া উচ্চারণ করেন। উনি বললেন, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ পৃথিবীতে অনেকই আছে। যেমন ইউনাইটেড কিংডম, যেমন ইউনাইটেড স্টেটস, কানাডা। সে সব দেশে সমস্ত ধর্মাবলম্বী মানুষই যার যার নিজের ধর্মাচরণ করতে পারে বিনা বাধায়। নিদ্বিধায় করতে পারে, নিজেদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার নিজেদের চেষ্টাতে। রাষ্ট্র তাতে বাধা তো দেয়ই না বরং পারলে সাহায্যই করে।

তুরতি বললেন, বাধা দেওয়ার প্রশ্নটা আসছে কেন? ভারতবর্ষতেও কি কেউ বাধা দেয়? তবে এটাও তো দেখতে হবে যে, একের ধর্মাচরণ বা ধর্মের প্রতি আনুগত্যর আধিক্য যেন অন্যের পক্ষে পীড়াদায়ক না হয়ে ওঠে।

জিষ্ণু মহারাজ বললেন, আমাদের দেশের ব্যাপারটা আলাদা। কারণ, স্বাধীনতার প্রাক্কালে জিন্নাসাহেবরাই জিগির তুলেছিলেন লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান-এর। তাঁদের দাবি মেনে নিয়ে ইংরেজরা যখন ভারতবর্ষকে তাঁদের কুখ্যাত Divide and Rule Policy-র পরাকাষ্ঠা করে ধর্মের ভিত্তিতে কেটে দুভাগ করলেন–ধর্ম শব্দটা এই উপমহাদেশে এক নতুন অর্থ এবং প্রাধান্য পেল।– ধর্ম যেন আর নিভৃতে পালন করার বৃত্তি রইল না। অন্তরের সম্পদ রইল না আর তা। বহির্জগতের হাটে-বাজারের লেনদেন বা বিনিময়ের বা ক্ষমতার যুদ্ধের হাতিয়ার হল। এই ধর্মভিত্তিক দেশভাগের কারণে লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ এবং অনিচ্ছুক হিন্দু ও মুসলমানকেও নিজের নিজের ভিটেমাটি ছাড়তে হল চরম অপমান ও অসম্মানের সঙ্গে। তাই চল্লিশের দশক থেকেই এই উপমহাদেশে ধর্ম শব্দটি ভীতির উদ্রেক করল মানুষের মনে।

চারণ বলল, আচ্ছা, এসব আলোচনা তো আমরা শহরে সবসময়েই করে থাকি। বিশেষ করে, কলকাতাতে। কিন্তু আপনারাও করেন? রাজনীতি/দেশনীতি এইসব নিয়ে আলোচনা করলে আপনাদের মনের স্থিতি, ধ্যান, এসব বিঘ্নিত হয় না? চিন্তা করেন কি করে আপনারা এসব জিনিসে মন কলুষিত হয়ে গেলে?

মোটা ও কালো নবীন সন্ন্যাসী বললেন, দেশমাতাও কি মাতা নয়? স্বদেশ, স্বভূমি না থাকলে আমরা কোথায় বসে ঈশ্বরচিন্তা করব? আপনি বাঙালি হয়েও, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ পড়েও কি করে এ কথা বলছেন? আমরা তো ক্ষমতা চাই না। কখনওই চাইব না ইরানের খোমেইনির মতন, রাশিয়ার রাসপুটিনের বা আধুনিক লেনিন-স্তালিনের মতন, চায়নার মাও জেডং-এর মতনও।

আমাদের এক্তিয়ার শুধুমাত্র সাধারণের নৈতিক, ধার্মিক এবং পারমার্থিক বিষয়েই সীমিত। এসবই ব্যক্তিগত প্রেক্ষিতের ব্যাপার। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমরাও ভারতবাসী নই, এই দেশ আমাদের স্বদেশ নয়, এর ভাল-মন্দ নিয়ে আমাদের কোনওই মাথা ব্যথা নেই। এই দেশকে আমাদের চোখের সামনে বরবাদ করার অধিকার কারওই নেই। সে অধিকারকে মেনে নেওয়া কাপুরুষতারই নামান্তর, বীর্যহীনতার নামান্তর।

হচ্ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির প্রকৃত ব্যাখ্যা নিয়ে কথা। তাই না? আমরা কি তা থেকে অনেক দূরে সরে আসিনি?

জিষ্ণু মহারাজ বললেন।

–অনেক না হলেও, কিছুটা হয়তো এসেছি।

 তামিল সন্ন্যাসী বললেন, সেকুলারিজম-এর ব্যাখ্যা সম্ভবত ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের চেয়ে ভাল আর কেউই দেননি। একে তো উনি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রগাঢ় পণ্ডিত দার্শনিক, দ্বিতীয়ত উনি ছিলেন স্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি এবং যদি আপনারা কেউ কিছু মনে না করেন তো বলব, সবচেয়ে পণ্ডিত রাষ্ট্রপতি এবং সজ্জনও বটেন।

জিষ্ণু মহারাজ বললেন, যা সর্বতোভাবে সত্যি, সেই কথাতে মনে করার তো কারওই কিছু থাকার নেই।

তাহলে বলি, ড. আবিদ হুসেন-এর একটি বই এর সমালোচনা করতে বসে উনি লিখেছিলেন : It may appear somewhat strange that the government should be a secular one while our culture is rooted in spiritual values. Secularism here does not mean irreligion or atheism or even stress on material comforts. It claims that it lays stress on the unversatility of spiritual values which may be attainted by a variety of ways.

There is a difference between contact with reality and opinion about it. Between mystery of God and belief of God. This is the meaning of secular conception of the state though it is not generally understood.

তারপরে আরেকবার উনিশ-শ বাহাত্তরের ডিসেম্বরে মুসলমানদের শিয়া সম্মেলনের উদ্বোধন করতে গিয়ে উনিই বলেছিলেন, The ideal of secularism means that we abandon the inhumanity of fanaticism and give up the futile hatred of others.

তার মানে এই যে, ভারতবর্ষে ধর্মান্ধতা, কোনও ধর্মাবলম্বীদের ধর্মান্ধতাই, কোনওক্রমেই বরদাস্ত করার নয়। সে ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগুরুই হন, বা সংখ্যালঘু। পাকিস্তান তো ইসলামিক রাষ্ট্র। ভারত তো তা নয়। ভারত হিন্দু রাষ্ট্রও নয়। তার নিজস্ব ইচ্ছাতেই নয়। ইচ্ছা করলেই যদিও হতে পারত। ভারত ঔদার্যর চরম করে অন্যসব ধর্মাবলম্বীদেরও সমান মর্যাদা, সমান সুযোগ দিয়েছে। আমি তো এও বলব যে, রাজনীতিকেরা, যা সংবিধানে দেয় ছিল না, তাও তাঁদের দিয়েছেন। এখন সংখ্যালঘুদের ভয়ে কেন্দ্র এবং অধিকাংশ রাজ্য সরকারই সদাই কম্পমান। কারণ সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা যে ক্রমশই বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ভোটও তত বাড়ছে। সংখ্যালঘুদের প্রত্যেকেই যে নিরপেক্ষ, অন্ধ নন, মৌলবাদী নন, তার স্পষ্ট এবং অবিসংবাদী প্রমাণ এবারে সংখ্যালঘুদেরও দেবার সময় এসেছে।

–মুশকিল হল এই যে, সংখ্যালঘুরা এখনও ভারতীয় Mainstream-এ এসে মেলেননি। তবে এ কথা অবশ্যই বাঙালি মুসলমানদের বেলাতে প্রযোজ্য নয়। বাঙালির নিজ স্বার্থেই, দুই বাংলার বাঙালির স্বার্থেই সাম্প্রদায়িকতাকে পুরোপুরি বর্জন করা উচিত। এমনিতেই বাঙালির অস্তিত্ব এখন সংকটের মুখে। ভারতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে Parallel economy-এর মত রাজনীতিক ক্ষেত্রেও Parallel politics চলছে। মূল ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে অন্য ইচ্ছা, অন্য ধ্যানধারণা, অন্য আশা-আকাঙ্ক্ষা শুধু রোপিতই হয়নি, দিনে দিনে তা ক্রমশই মহীরূহর আকার ধারণ করেছে যা। ভারতের ভবিষ্যতের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক।

ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানই উনিশ-শ তেপান্নর ডিসেম্বর মাসে মীরাট কলেজের হীরকজয়ন্তী উৎসবে 67196070, When it is said that we are a secular state it does not mean that we have in indifference to tradition or treverence to religion. ধর্মনিরপেক্ষতা আর ধহীনতা, মিবিদ্বেষ বা ঈশ্বরে অবিশ্বাস কোনওদিনও সমার্থক ছিল না। পরম মূর্খরাই এমন ভাবতে পারেন।

মোটা ও কালো নবীন সন্ন্যাসী বললেন।

তুরতি বললেন, কে জানে! স্বাধীনতার পরেপরেই বারেবারে রাধাকৃষ্ণান সাহেবের ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটিকে ব্যাখ্যা করার এমন প্রবণতা দেখা গেছিল কেন? উনি হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি নিয়ে পরে অনেক জল ঘোলা হবে, এর কদৰ্থ করা হবে। এবং অসৎ মানুষেরা সেই ঘোলা জলে ছিপ ফেলবেন।

হতে পারে।

 তুরতি বললেন, শিক্ষিত হিন্দু এবং বিশেষ করে ইংরেজি-শিক্ষিত হিন্দুদের অধিকাংশেরই কাছে ধর্মপালন ব্যাপারটা এখন খুবই লজ্জাকর হয়ে গেছে। বাঙালিদের মধ্যে তো গেছেই। আমি ধর্ম মানি বা আমি ঈশ্বর মানি এই কথা বলতে শিক্ষিতদের রীতিমতন লজ্জা পেতে দেখি। অথচ ঠিক তখনই অন্য অনেক ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ধর্মর জিগির প্রবলতর হয়েছে।

চারণ বলল, উর্দু কবি সাহির লুধিয়ানবীর একটি শের পড়েছিলাম

ন তু হিন্দু বনে গা,
ন মুসলমান,
ইনসানকি অওলাদ হো,
তু ইনসানহি বনে গা।

বাঃ।

বলে উঠলেন সকলে।

জিষ্ণু মহাবাজ বললেন, এই তো কবির মতন কথা। কবির জাত নেই। কোনওকালেই ছিল।

ন তু হিন্দু বনেগা, ন মুসলমান,
 তু ইনসানকি আওলাদ হ্যায়,
তু ইনসানহি বনে গা।

বাঃ। বাঃ। বাঃ।

.

১৮.

দেখতে দেখতে এই চন্দ্রবদনীতেও প্রায় দশদিন হয়ে গেল। সময় ভারী হালকা হয়ে গেছে। ফুলের গন্ধের মতন, পাখির ডাকের মতন।

সেদিন খুব ভোরে উঠেছিল চারণ। প্রত্যেকটি ভোরই, যে কোনও জায়গার ভোরই, অনেক কিছু বয়ে আনে। রাতে যা কিছুই অদৃশ্য বা অস্পষ্ট থাকে তাই নতুন করে প্রভাতী আলোতে দৃশ্যমান হয়। মানুষের মস্তিষ্কও যেন রাতে অন্যরকম হয়ে যায়। নানা আজগুবি ভাবনা জাগে। অসংলগ্ন হয়ে পড়ে, ভয়ার্ত, কামার্ত, উদ্বিগ্ন। একটু উষ্ণতার কাঙাল। কেন যে এমন হয়, কে জানে।

ঝকঝক করছে শীত-সকালের রোদ। তখনও গাছগাছালি, পর্বত, নুড়ি পাথর সব শিশির-ভেজা। শিশিবে ভেজা পাখিদের পালক, ফুলের পাপড়ি। ঘাসফুল। তারই মধ্যে ধীরে ধীরে পথ বেয়ে কিছুটা হেঁটে গিয়ে তুরতির সেই চায়ের দোকানে পৌঁছল চারণ।

তুরতি আজ এখনও ঘুমোচ্ছন। গত রাতে এক কেলো করেছিলেন তিনি। জিষ্ণু মহারাজের প্রস্তরাশ্রয় থেকে চারণের সঙ্গে বেরিয়ে একটু ভোলা জায়গাতে দাঁড়িয়ে চাঁদিতে হিম লাগিয়ে, গঞ্জিকা এবং সিদ্ধির যুগপৎ সিদ্ধি থেকে একটু আলগা হবেন এমনই অভিপ্রায়ে। কিন্তু সিঁড়ি নেমে কিছুটা গিয়েই চাতালের ওপরে দুম করে গাছের ডালে বসা গুলি-লাগা পাখিরই মতন পড়ে গেছিলেন।

কী হল? কী হল? বলতেই, তিনি অস্ফুটে বললেন, হাওয়া মেলেনি।

কী?

চারণ বলেছিল অবাক হয়ে।

চার হাতে-পায়ে ভর দিয়ে তুরতি উঠে বসেই বলেছিলেন, কোনওদিন গাড়ির এঞ্জিন টিউনিং করেছেন?

নিজে হাতে? না।

 চারণ বলেছিল।

আমি করেছি। একসময়ে গাড়ির বড় সখ ছিল আমার। নিজে হাতে সব গাড়ির এঞ্জিনই টিউনিং করতাম।

এত গাড়িই যদি ছিল তবে ক্ষেমি বাঈজির বাড়ি বেহালা বাজাতেন কেন?

বেহালা নয়। বেহালা নয়। জিষ্ণু মহারাজ ব্যায়লা বললে কি হবে? আসলে সারেঙ্গি। বাঈজিরা কি ব্যায়লার সঙ্গে গান করেন নাকি? তাঁরা করেন গান সারেঙ্গিরই সঙ্গে। সব বাঈজিই।

ঠিক। চারণ বলল।

 হচ্ছিল তো গাড়ির এঞ্জিন টিউনিং-এর কথা।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম। গাড়ির এঞ্জিনের টিউনিং কখনও নিজের হাতে করলে জানতেন যে, খপাখপ করে চোত-বোশেখের জল-শুকিয়ে-যাওয়া পুকুরে পোলো ফেলে মাগুর মাছ ধরার মতনই হাওয়াও ধরতে হয়। হাওয়ার সঙ্গে এঞ্জিনের কমবাসসন মিলোতে পারলেই ধ্বজভঙ্গ কিন্তু কামাক্রান্ত আঁতেল পুরুষের ধ্বজার মতন এঞ্জিন ধ্বক করতে থাকে। ফুস ফুস শব্দ করতে করতে হাওয়া লিক করে যায়।

ওই সাংঘাতিক উপমা শুনে চারণের বাকরোধ হবার উপক্রম হল।

কিন্তু তবু মুখে বলল, এ কথার মানে ঠিক বুঝলাম না।

দোষ আপনার নয় চারণবাবু। দোষ আমারই। আমিই বোঝাতে পারিনি। আসলে সিদ্ধি আর গাঁজার নেশাটা ঠিকমতন মেলাতে পারিনি। Combustion আর Fuel supply-এর মধ্যে সাযুজ্য ছিল না। তাই পড়ে গেলাম।

বাবাঃ। সাযুজ্য-টাযুজ্য বলছেন দেখি। আপনি তো ইংরেজির মতন বাংলাটাও অত্যন্ত ভালই জানেন দেখছি।

না বলার কি আছে? তবে বঙ্গভূমে যে যত বড় খসসর তার ভাষাজ্ঞানও তত প্রখর। এই জন্যেই ওই জাতের কিসু হল না। বক্তব্যই যদি না থাকে কিছু, তবে শুধুমাত্র ভাষাজ্ঞান বা ব্যাকরণের জ্ঞান দিয়ে যে কিছুমাত্রই লাভ হয় না তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বাংলা সাহিত্য। তাই।… যা বললাম একটু আগে।

কি?

চারণ শুধোল।

হাওয়া মেলেনি। মেলে না। আমার মতন মুখ্যর গাঁজা আর সিদ্ধির নেশারই মতন হাওয়া মেলেনি বাঙালির।

এই মানুষটাও পাটনের মতন বা জিষ্ণু মহারাজেরই মতন গভীর রহস্যময়।

 ভাবছিল, চারণ।

এই পুরো দেবভূমিই যেন এক গোলকধাঁধা। কত আকাট যে এখানে মহাপণ্ডিত সেজে বসে

অর্ধনগ্ন হয়ে আছে আর কত মহাপণ্ডিত যে মহামুখ সেজে, তা বোঝা ভারী মুশকিল। উপরের ছাই সরিয়ে দেখতে গেলেই কোথাও হীরে বেরোবে আর কোথাও কয়লা। সত্যিই এই দেবধাম এক গোলকধাঁধা।

এই তুরতি মানুষটি অকারণে এমন খারাপ খারাপ কথা, খারাপ ভাষা যে কেন ব্যবহার করেন, তা ভেবে পায় না চারণ। নিজেকে অকারণে এমন degrade করার মধ্যে কোন বাহাদুরী যে উনি দেখেন তা বোঝে না চারণ সত্যিই। এও হয়তো একটি ভেক। পাছে অনন্য তাঁকে বোঝার কাছাকাছি আসে তাই হয়তো তাঁর চারদিকে অকথ্য-ভাষার এই দেওয়াল তুলে রাখা। এত এবং এতরকম ভেক ভেদ করে এঁদের কারও প্রকৃত সত্তাকে বোঝার মতো কঠিন কর্ম আর বুঝি বেশি নেই।

চা খেয়ে, তুরতির জন্যেও চা এবং কটি মাটির কুলহার নিয়ে উঠে আসার সময়ে চারণের গত রাতে দেখা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। এই স্বপ্নও গত তিরচারদিন ধরেই দেখছে। আশ্চর্য স্বপ্ন। অথচ এমনিতে কোনও স্বপ্নই ঘুম ভেঙে যাবার পরে স্পষ্ট মনে থাকে না। যা মনে থাকে, তা কিছু অসংলগ্ন কথা, অস্পষ্ট স্মৃতি। কিন্তু চন্দ্রবদনী যখন স্বপ্নে আসে, তখন চারণের সঙ্গে তার যা কথোপকথন হয় সে সব স্পষ্ট মনে থাকে চারণের। কিন্তু মনে থাকে, বেলা দশটা-এগারোটা অবধি। তারপরই ইচ্ছে করলেও আর মনে করতে পারে না।

স্বপ্নে চন্দ্রবদনী কোনওদিন আসে শাড়ি পরে। কোনওদিন সালোয়ার কামিজ। কোনওদিন বা নাইটিতে, লেসের ফ্রিল-লাগানো। কোনওদিন তাদের দেখা হয় শান্তিনিকেতনের ঘণ্টা তলাতে, কোনওদিন রুদ্রপ্রয়াগে, কোনওদিন বা দেবপ্রয়াগে। গতরাতে দেখা হয়েছিল এক অচেনা জায়গাতে। চারণের অচেনা। হয়তো চন্দ্রবদনীর চেনা। একটি অতি নির্জন স্থানের তুষারাবৃত মন্দিরের সামনে। সেই জায়গাতে একটিও পর্ণমোচী গাছ নেই। সবই চিরহরিৎ। সাদা বরফের জটাজুট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেইসব জলপাই-সবুজ গাছেরা। মৌনী সন্ন্যাসীদের মতন। কোন মন্দির তা কে জানে! তার বর্ণনা দিলে হয়তো জিষ্ণু মহারাজ বলতে পারবেন কোন তীর্থক্ষেত্র তা।

গতরাতের স্বপ্নে চারণের সঙ্গে চন্দ্রবদনী কথা বলতে বলতে কেবলই পেছন ফিরে দেখছিল আর হাত দিয়ে অদৃশ্য কাকে বা কাদের যেন ইসারা করছিল কিছু। হয়তো চুপ করতে বলছিল। অথবা হয়তো অনুরোধ করছিল একটু অপেক্ষা করতে। যদিও সেই অদৃশ্য এক বা একাধিক জনের গলার স্বর চারণ শুনতে পাচ্ছিল না। দেখতে তো পাচ্ছিল নাইই।

আগের দুরাতে হঠাৎই মুছে গেছিল সে। কিন্তু গত রাতেই প্রথমবার চন্দ্রবদনী চারণের স্বপ্নে অতি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। ফিল্মের নায়ক-নায়িকারা যেমন ছবিতে Fade-out করে যায়। আর Fade out করে যেতেই, যেখানে চন্দ্রবদনী দাঁড়িয়েছিল সেখানে পার্বত্য, ঝোড়ো শীতার্ত হাওয়া এসে বরফ কুচি নিয়ে খেলা করতে লাগল। যেমন করে সমতলের পর্ণমোচী বনে বসন্তের বা গ্রীষ্মের হাওয়া এসে ঝরাপাতা নিয়ে খেলা করে।

গত রাতে চন্দ্রবদনী অমন করে ফেড-আউট করে যাওয়াতে এবং তার আগে হাত তুলে অদৃশ্য সঙ্গী বা সঙ্গীদের কিছু বলাতে চারণের মনে বড়ই দুশ্চিন্তা হয়েছে। কারণ, ওর এক বাল্যবন্ধু বা যখন মারা যায় তখন ঠিক অমনি করে খোলা জানালার দিকে চাইছিল। ঘরে, ঘর ভর্তি মানুষ ছিলেন, বাছুর দাদারা, বৌদিরা, অবিবাহিত ওর বন্ধু বান্ধবেরা। খোলা জানালাতে চারণেরা কারওকেই দেখতে পায়নি কিন্তু বারেবারেই ও বলছিল হাত তুলে, যাচ্ছি। যাচ্ছি। একটু দাঁড়াও ভাই, একটু দাঁড়াও।

এই দৃশ্যর কথা এর আগেও চারণের মনে এসেছে ফিরে ফিরে। হয়তো ওর নিজের মৃত্যু পর্যন্ত সেই দৃশ্যর কথা থাকবে ওর মনে।

বাচ্চুর ক্যানসার হয়েছিল। কেমোথেরাপি চলেছিল অনেকদিন। এক ডাক্তারের চেম্বার থেকে অন্য ডাক্তারের চেম্বারে পিংপং বল-এরই মতন যাওয়া আসা করেছিলেন ওঁর আত্মীয়েরা পরম ধৈর্য সহকারে। কেমোথেরাপি করার জন্যে বীভৎস চেহারা হয়ে গেছিল বাচ্চুর। মাথাভর্তি কালো চুলের একটি চুলও অবশিষ্ট ছিল না। শীর্ণ, ক্লিষ্ট, একটি করুণ মলিন কাঠামোর মধ্যে এককালীন পরম রূপবান সুপুরুষ যেন নির্বাসিত হয়েছিল। বড় বড় অ্যালোপ্যাথিক ক্যানসার-স্পেশালিস্ট না করে দেওয়ার পরে ওর দাদারা হেকিম, বদ্যি, ওঝা, তারপর অমুক বাবা, তমুক মায়ের দোরে দোরে ঘুরেছিলেন অসহায়ের অপার উচ্চাশা নিয়ে। অর্থব্যয় হয়েছিল জলের মতন। আংটি, তাবিজ, মাদুলি কিছুরই কমতি ছিল না। ডাক্তারে আর ঈশ্বরে বিশ্বাসের ভাঁড়ার ক্রমাগত শূন্য থেকে শুন্যতর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাচ্চুকে ফেরানো যায়নি।

শহুরে ওঁদের সকলকে কাছ থেকে দেখে চারণের তখন মনে হয়েছিল যে, মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাসটা শুধুই পাওয়া নির্ভর। যে-বাবা যে-মা প্রার্থিত বস্তু, তা চাকরির উন্নতিই হোক, কী শত্রুর বিনাশই হোক, কী রোগের নিরাময়, তা পাইয়ে না দিতে পারেন তাঁরই কোনও প্রয়োজন নেই। বেকার দেবতা তিনি। এই দেবধামে এসেই প্রথম একদল গৃহত্যাগী মানুষদের দেখল চারণ, যারা ঈশ্বরকে নিজেদেব আনন্দর জন্যেই ভজনা করেন। তাদের কাছ থেকে কিছু চাইবার জন্য নয়।

বাচ্চুর চলে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে যারা জানালার পাশে ভিড় করেছিল তারা কারা? যমদূত কি? যমরাজ বলে কি সত্যিই কেউ আছেন? তিনি কি সত্যিই দূত পাঠান মানুষকে নিয়ে যাবার আগে? হিন্দু ও মুসলমানদের এত বিভিন্নরকম স্বর্গ ও নরকও কি সত্যিই আছে? মানুষ মরে যাবার পরে কি সত্যিই তার আত্মার বিনাশ হয় না?

এই সব জানতেই তো এসেছিল চারণ এখানে। কিন্তু জানা তো হল না। জানার আভাস মাত্র পেয়েছে। তাতে সম্ভবত তার অজ্ঞানবস্থা আরও ঘোরা হয়েছে।

চন্দ্রবদনী যে কেন অমন Fade-out করে গেল সেদিন এবং কে বা কাদের যে সে দাঁড়াতে বলছিল, অপেক্ষা করতে বলছিল, তা বুঝতে না-পেরেই চারণের দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে। মনে এইসব ভাবনা ভিড় করছে এসে। তাই সকালে ঘুম ভাঙার পরমুহূর্ত থেকেই ওর মন বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে আছে। সোনা রোদে ঝলমল করে-ওঠা এই সকালও তার বিষণ্ণতা একটুও কাটাতে পারেনি।

চারধারে কী অনাবিল, অপার্থিব নিস্তব্ধতা। এই নিস্তব্ধতা এক গভীর সমর্পণ-তন্ময়তা জন্মিয়ে দেয় বুকের মধ্যে। মন প্রাণ কাকে সমর্পণ করবে সেটা অবান্তর কিন্তু নিজেকে, নিজের শরীর-মনকে, নিবেদিত, সমর্পিত করার মধ্যেই যে এক গভীর গহন সুখানুভূতি, তার স্বাদের রকমটা সমর্পণ না করেও যেন বুঝতে পারছে ও। এই জন্যেই হয়তো যুগ-যুগান্ত থেকে উচ্চকোটির মানুষেরা-মহৎ প্রাণেরা এমন নির্জনতার কোরকের মধ্যে এসে বাস করতে ভালবাসেন।

জিষ্ণু মহারাজ একদিন চাপরাশ এর কথা বলেছিলেন। মনে আছে, চারণের। উনি হয়তো ঠিকই বলেছিলেন। একজন চাপরাশিই শুধু জানে চাপরাশ বইবার আনন্দ। সেই চাপরাশ ঈশ্বরেরই হোক, কী কোনও নারীর। অথবা কোনও গভীর বিশ্বাসের।

.

নেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ থাকে সে আনন্দ সস্তা আনন্দ। দেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ, সবকিছু থেকেও তা ছেড়ে দেওয়ার, ছেড়ে আসার যে কী আনন্দ, তা এই দেবভূমিতে এসে ভীমগিবি মহারাজ, ধিয়ানগিরি মহারাজ, দেবপ্রয়াগের মহারাজেরা এবং সবশেষে এই জিষ্ণু মহারাজ এবং তুরতির মতো অনেককে দেখেই বুঝেছে চারণ। বুঝে, নিজের এবং শহুরে নিজেদের নিজস্বার্থমগ্ন অশেষ সংকীর্ণতা এবং কূপমণ্ডুকতাকে ঘৃণা করতেও শিখেছে।

প্রস্তরাশ্রয়ে পৌঁছেই দেখল চারণ যে, ঘুম ভেঙে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে তুরতি পদ্মাসনে ধ্যানে বসেছেন। তাঁর ধ্যানভঙ্গ না করে তাঁর সামনে জোড়াসনে বসল চারণ।

কলকাতাতে আসন করে বসতেই পারত না পাঁচ মিনিটের বেশি। অথচ এই ক-মাসে সে এখন দিব্যি ঘণ্টার পর ঘণ্টা জোড়াসনে বসে থাকতে পারে।

চা-টা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে ভেবে কাল রাতের ধুনির ধিকিধিকি আগুনের ওপরে কমণ্ডলুটা বসিয়ে রাখল।

একটু পরেই চোখ খুললেন তুরতি।

শরীর ভাল তো? কাল রাতে কোথাও লাগে-টাগে নি তো? পাথরের ওপরে পড়ে যাওয়াতে?

 চারণ শুধোল।

শরীরের কথা শরীরই জানে।

ভীমগিরি মহারাজের মুখে শোনা সেই মারাঠী সন্ত তুকারামের গল্প মনে পড়ে গেল চারণের। তুরতিও সন্তই। তুরতি মহারাজ। মাত্রার ভেদ আছে শুধু সন্ত তুকারামের সঙ্গে।

চারণ ভেবেছিল ওর স্বপ্নের কথাটা জিষ্ণু মহারাজকেই বলবে। কারণ, মানবী চন্দ্রবদনীর কথা উনি জানেন। কিন্তু ওঁকে দেখতে পেল না। গত রাতে তো উনি বেশ ভাল ঘুমিয়েছিলেন প্রস্তরাশ্রয়েরই মধ্যে। তাই পাথরের চাতালে গিয়ে সকালে শুয়ে থাকার প্রয়োজন ছিল না কোনও। ওঁর কথা তুরতিকে জিগ্যেস করতেই তুরতি বললেন, উনি তো চলে গেলেন।

কোথায়?

 তা বলে যাননি। তবে উত্তরে গেছেন।

কখন?

এই তো একটু আগে।

কোন পথ দিয়ে গেলেন। আমি তো চায়ের দোকানে চা খেয়ে আপনার জন্যে চা নিয়ে উঠে আসছি। কই? ওঁকে তো দেখলাম না।

হাঃ।

হাসলেন তুরতি।

তারপর বললেন, ওঁর পথ আর আমাদের পথ কি এক নাকি? তাহলে তো আমিও জিষ্ণু মহারাজ হয়ে যেতাম। উনি কোথা দিয়ে কোথায় যান, কী করতে যান, আবার কোন পথে ফিরে আসেন কখন তা কি আমি জানি? আপনিও যেমন জানেন না, আমিও জানি না।

কি হেঁয়ালি করছেন আপনি?

হেঁয়ালি করছি না। বিশ্বাস করা-না-করা আপনারই ইচ্ছা। উনি যেখানে যাবার মন করেন সেখানেই চলে যান।

এসব বুজরুকি।

কে জানে। শুধু বুজরুকরাই বুজরুকির কথা জানে। আমি বুজরুক নই, অবিশ্বাসীও নই। আমি বিশ্বাসী, তাই বিশ্বাস করি। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।

বলেই বললেন, দিন, চা খাই।

তুরতি মহারাজের দিকে চায়ের কমণ্ডলু আর মাটির কুলহার এগিয়ে দিতে দিতে চারণ বলল, আপনি ঈশ্বরে একশভাগ বিশ্বাস করেন। তাই না?

হাসতে হাসতে তুরতি বললেন, না।

তার মানে? ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না তো কি জিষ্ণু মহারাজে বিশ্বাস করেন?

গুরু তো ঈশ্বরেরই অবতাব, আধার। তবে না বললাম এই জন্যে যে আমি ঈশ্বরে একশভাগ বিশ্বাস করি না, দুশো ভাগ করি। ঈশ্বর সবসময়ে আমার হাতে হাত রেখে চলেন। ওর হাতের পাতার উষ্ণতা আমি অনুভব করতে পারি।

সত্যি?

অবাক এবং অবিশ্বাসী গলাতে বলল চারণ।

 সত্যি।

কেমন সে পরশ?

প্রেমিকার হাতের পাতার মতন। উষ্ণ, নরম, সামান্য কুয়াশার মতন কামজনিত ঘামে ভেজা।

ঈশ্বরের পরশেও কাম?

থাকে বইকি। কামের কত রকম হয়। কামই তো মানুষের, সব প্রাণীর জীবনের Driving force। সৃষ্টির উন্মেষকারী। সৃষ্টি রক্ষাকারী আদিমতম অনুভূতি। কাম মাত্রই খারাপ হতে যাবে কেন?

তাই?

 তাই তো।

হঠাৎই তুরতি বললেন, কি ভাবছেন?

নাঃ।

তবে হঠাৎ চুপ করে গেলেন যে।

আপনারা দিনের পর দিন মাসের পর মাস চুপ করে থাকেন। চুপ করেই থাকবেন সারাটা শীতকাল। বাঁচাল আমি একটুক্ষণ চুপ করে থাকলেই কি দোষ?

হুঁ।

তারপরেই তুরতি বললেন, আপনি ওয়াল্ট হুইটম্যান পড়েছেন?

 চারণ চমকে উঠে বলল, আপনি হুইটম্যানও পড়েছেন নাকি?

তুরতি হেসে উঠলেন জোরে।

বললেন, আমাকে আপনি কি ভাবেন বলুন তো?

 আমি ক্ষেমি বাঈজির ব্যায়লা বাদক বলে কি হুইটম্যানে আমার অধিকার থাকতে পারে না?

একটু চুপ করে থেকে তুরতি বললেন, বুঝলেন মশাই, জীবিকাটা জীবনের এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। জীবিকা দিয়ে মানুষকে চিহ্নিত করা, বিভাজন করাটা জঘন্য অপরাধ। এই অপরাধেই হিন্দুধর্মাবলম্বী বহু মানুষ অন্য ধর্মাবলম্বী হয়ে গেছে। হিন্দুধর্মের সবচেয়ে বড় দোষই এই। তা বলে, আপনার মতন উচ্চশিক্ষিত মানুষও এখন অশিক্ষিতর মতন কথা বলবেন এটা প্রত্যাশার ছিল না।

হুইটম্যান-এর কথা শুধোলেন কেন? হঠাৎ?

আপনার কথার প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল, তাই। হঠাৎ বলে কোনও শব্দ নেই প্রকৃতিতে। হঠাৎ ভাবলেই হঠাৎ। বলেই, সুললিত কণ্ঠে চমৎকার ইংরেজিতে আবৃত্তি করলেন তুরতি।

I hear and behold God in every object. Yet understand God not in the least. Nor do I understand who there can be more wonderful than myself. Why should I wish to see God better than this day?

বলেই, তুরতি সামনের রৌদ্রকরোজ্জ্বল পাথরের চাতাল এবং চন্দ্রবদনীজির রৌদ্রস্নাত মন্দিরের দিকে তাকালেন।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, I see something of God each hour in the twenty-four and each moment then, In the faces of men and women I see God and in my own face in the glass.

I find the letters from God dropt in the street, and eyeryone is signd in Gods name.

And I leave them where they are, for I know that wherever I go. Others will punctually come for ever and ever.

বাঃ।

চারণ বলল।

চমৎকার নয়? হুইটম্যান, হুইটম্যান। রাশ্যার টলস্টয়, আমাদের রবীন্দ্রনাথ আর উত্তর আমেরিকার হুইটম্যান। এঁদের কোনও বিকল্প নেই।

এত মনে রাখেন কি করে?

মনে রাখার মতো হলে মনে থাকেই। আর মনে না-থাকার হলে চেষ্টা করলেও থাকে না।

পরক্ষণেই বললেন, জানেন মশাই এ জীবনে খুব বেশি পড়ার প্রয়োজন বোধহয় নেই। ভাল কিছু বইপড়া এবং ভাল করে পড়াটা জরুরি। তাই যথেষ্ট। পেপারব্যাক বইয়ের Blurb পড়েই যাঁরা নিজেদের পণ্ডিত বলে জাহির করেন তেমন পণ্ডিতেই দেশ ছেয়ে গেছে।

চারণ বলল, রবীন্দ্রনাথও এই জন্যেই বলতেন, যাঁহারা সমস্তই পণ্ড করেন তাঁহারাই পণ্ডিত।

হুইটম্যান থেকে একবার আবৃত্তি করতে শুরু করলে আর থামতে ইচ্ছা করে না। হুড়হুড় করে বানের জলের মতন মাথা থেকে সব বেরিয়ে আসে।

তুরতি বললেন।

আমি যে ঈশ্বরে টু হান্ড্রেড বিশ্বাস করি বলছিলাম না…

হা। বলছিলেনই তো। সেই প্রসঙ্গে বলি, আপনি কি তলস্তয়ের WHAT MEN LIVE BY গল্পটি পড়েছেন?

না। চারণ বলল।

আমিও পড়িনি। আমার মা যখন চলে গেলেন তখন বাবার এক বন্ধু, যাঁর সঙ্গে আমার মায়ের একটি মাখো-মাখো সম্বন্ধ ছিল, এই বইটি বাবাকে পড়তে দেন।

নিজের মায়ের সম্বন্ধে এই রকম করে কথা বলা কি উচিত?

চারণ বলল, কিন্ডারগার্টেন স্কুলের দিদিমণি শিশুদের যেমন করে বলেন, তেমন করে।

 তুরতি বললেন, আপনি মশাই একটি রিয়্যাল বোকা–ড্যাশ।

ঠিক আছে। বলুন, যা বলছিলেন।

শুনুন তবে। তুরতি বললেন। Zar-এর রাশ্যাতে এক প্রত্যন্ত প্রদেশের ছোট্ট গ্রামে একজন ভারী গরিব মুচি ছিল। সাইমন তার নাম।

তারপর?

সাইমন আর তার স্ত্রী অতি কষ্টে সংসার চালায়। একটিই মাত্র ওভারকোট। ঝরনা থেকে জল আনতে যাবার সময়ে সাইমনের স্ত্রী সেই কোটটি পরে যায় আবার সাইমন যখন তাগাদাতে যায় বাকি পয়সা আদায় করতে, তখন সাইমনও সেই কোটটিই পরে যায় এ গ্রামে সে গ্রামে। এতই গরিব ছিল তারা।

একদিন ঘরে কিছুই নেই বলে সাইমনের স্ত্রী প্রায় জোর করেই সাইমনকে তাগাদাতে পাঠাল। অনেক রুবল পাওনা আছে। ধারে জুতো বানাবার সময়ে বানাবে আর টাকা দেওয়ার সময়ে মনে থাকে না মানুষের। যত রুবল পাওনা আদায় হবে তা থেকে কত রুবল-এর ময়দা কিনবে, কতর সবজি, এবং আরও কি কি সে সবেরই ফর্দ করে দিল সাইমনের বউ। বাড়িতে ময়দা নেইই বলতে গেলে। যাওয়ার সময়ে বউ বলে দিল বেলা বেলি বাড়ি ফিরে আসবে।

সকাল সকাল বেরিয়ে তো পড়ল সাইমন।

তারপর?

তারপরে যা হয়। টাকা প্রাপ্য থাকলে কী হয়, পুরোটা আর কে দেয় একসঙ্গে? যে যত টাকার মালিক সেই তত বেশি ঘোরায়।

সারাদিন ঘুরে-ঘুরে যা প্রাপ্য তার অতি সামান্যই আদায় করতে পারল সে। মনের দুঃখে তাই শুড়িখানাতে গিয়ে ভদকা খেয়ে মাতাল হয়ে গেল। সব দেশের গরীবদেরই একই হাল। এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে, বরফ পড়তে শুরু করেছে। ওভারকোটের কলারটা দিয়ে ঘাড় ঢেকে সেটা কান অবধি তুলে দিয়ে সাইমন টলতে টলতে তার গ্রামের দিকে চলতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে। সামনে মৃত্যু শীতল ঘোর রাত্রি।

তারপর?

চারণ বলল।

সাইমন দেখল সামনেই পথে একটি বাঁক। সেই বাঁক ঘুরেই অবাক হয়ে গেল সে। দেখল যে পথের ওপরে এক সুন্দর যুবক সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে ওই আসন্ন সন্ধ্যাতে, তুষারপাতের মধ্যে।

তাকে দেখেই তো সাইমনের বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল। কে বা কারা কাকে খুন করে ফেলে রেখে গেছে কে জানে তা! ঝামেলাতে জড়িয়ে পড়তে হবে হয়তো তাকেই। সব দেশের পুলিশই তো সমান।

ওই ভেবে চলেই যাচ্ছিল সে। পরমুহূর্তেই ভাবল যে, মানুষটি যদি মৃত না হয়, তবে এই ভাবে তুষারপাতের মধ্যে নগ্নাবস্থাতে পড়ে থাকলে তো এমনিতেই মরে যাবে ঠাণ্ডাতে। তারপর ভাবল, দেখাই যাক, মরে গেছে কি বেঁচে আছে! কাছে গিয়ে নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখল উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে এবং আশ্চর্য মানুষটির শরীর তখনও গরমই আছে। তার মানে, সে অতি স্বল্পক্ষণ হয় এখানে এসেছে বা কেউ তাকে ফেলে গেছে। তার শরীরে কোনও ক্ষত চিহ্নও নেই। কোথাওই নেই। আশ্চর্য ব্যাপার!

সাইমন আবারও চলে যাবার জন্যে পা বাড়াল কিন্তু ওর বিবেক বলল, ও যদি মানুষটাকে পথে ফেলে যায় তবে তো সে ঠাণ্ডাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই মরে যাবে। অথচ সে খালি হাতে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরছে। বাড়িতে নিজেদের খাবার মতনও কিছু নেই। তার উপরে বাড়তি বোঝা এই উলঙ্গ অপরিচিতকে নিয়ে বাড়ি ঢুকলে তার স্ত্রী তুলকালাম কাণ্ড বাধাবে। কিন্তু সব ভেবেও সাইমন মানুষটিকে ফেলে রেখে যেতে পারল না। তাকে হাত ধরে টেনে তুলল। তুলতেই লোকটি সাইমন-এর মুখে চেয়ে এক অদ্ভুত হাসি হাসল।

তারপর?

তার দুচোখে ঘোলা দৃষ্টি। যেন কিসের ঘোর কাটেনি তখনও। কোথা থেকে এসেছে জানে না সে, কোথায় যাবে জানে না।

সাইমন নিজের ওভারকোটটা তার গায়ে পরিয়ে দিল। নিজের গায়ে তাও তো একটি শতচ্ছিন্ন কোট ছিল। তারপর লোকটির হাত ধরে গ্রামের দিকে এগোল।

তোমার নাম কি?

মানুষটি চুপ করে রইল।

তোমার বাড়ি কোথায়?

তবুও সে নিরুত্তর।

 তুমি কি কর? তোমার পেশা কি?

 তাও কোনও জবাব নেই।

লোকটা বোবা না কি।

ভাবল, সাইমন।

ভারী বিপদেই পড়ল যা হোক।

বাড়িতে আসতেই বাইরের তুষার ঝড় যেন বাড়ির মধ্যেই ঢুকে পড়ল। অত গঞ্জনা-লাঞ্ছনা সত্ত্বেও লোকটি কিন্তু বসার আর খাবার ঘরের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে মাটিতে বসে রইল লজ্জায় ও অপমানে দুহাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে।

বাড়িতে ময়দা যতটুকু ছিল, না থাকারই মতন, তা দিয়ে রুটি আর বাঁধাকপি দিয়ে একটি স্যুপ মতন বানিয়ে, খাবার টেবল-এ লাগিয়ে যখন সাইমনের স্ত্রী তার স্বামী ও ছেলেমেয়েদের খেতে ডাকল তখন সেই আগন্তুককেও কিন্তু ডাকল।

সেই প্রথমবার লোকটি দুহাঁটুর মধ্যে থেকে মাথাটি তুলে সাইমনের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একবার হাসল। তারপর খেতে এল।

পরদিন, সাইমন কোনও কাজই না-জানা সেই লোকটিকে জুতো সেলাই করতে শিখিয়ে দিল এবং আশ্চর্য হয়ে দেখল যে একবার দেখাতেই সে পাকা মুচির মতো জুতো সেলাই করে ফেলল। তখন সাইমন ভাবল এই লোকটি ঈশ্বর প্রেরিত। ও বাড়িতে থেকে জুতো সেলাই করবে আর সাইমন ঘুরে ঘুরে কাজ জোগাড় করে আনবে এবং টাকা আদায় করবে। চমৎকার হবে।

দেখতে দেখতে সাইমনের অবস্থা ফিরে গেল। তার নামডাকও দেখতে দেখতে বহুগুণ বেড়ে গেল। মানুষটির হাতের কাজের গুণে। খুবই সচ্ছল অবস্থা এখন সাইমনের।

কিন্তু আশ্চর্য! মানুষটি কোনও কথাই বলে না কারও সঙ্গে একটিও সারাদিনে। শুধু ঘাড় গুঁজে কাজ করে যায়। খাওয়ার সময়ে ডাকলে উঠে খেতে আসে দুবেলা আর খাওয়া হয়ে গেলেই আবারও কাজ করে। কাজের ঘরেই শুয়ে থাকে রাতে।

 একদিন সকাল বেলা হঠাই অনেক ঘোড়ায় টানা এক ঝুমঝুমিবাজানো গাড়িতে ZAR পরিবারের একজন রাজপুরুষ এলেন সাইমনের দোকানে। দুষ্প্রাপ্য একটি হরিণের চামড়া দিয়ে বলে গেলেন শিকারের একটি বুট তৈরি করতে।

এও বলে গেলেন যে যদি বুটটি ঠিকমতন না হয় তবে আমার হাতের হান্টার পড়বে তোমার মুখে।

বলে আবার ঝুমঝুমি বাজিয়ে তিনি চলে গেলেন।

যখন রাজপরিবারের, মানুষটি কথা বলছিলেন সাইমনের সঙ্গে তখনই সেই লোকটি একবার মুখ তুলে হাসল।

যেদিন সেই বুট ডেলিভারি দেবার কথা সেদিনই সকালে আতঙ্কিত চোখে সাইমন দেখল যে, সেই হরিণের চামড়াটিকে বুট-এর মাপে না কেটে চটির মাপে কেটে ফেলেছে লোকটি।

তারপর? তারপর আর কি? হায়! হায়! করে উঠল সাইমন। লোকটিকে গালমন্দ করতে লাগল। এখন কী বিপদ ঘনিয়ে আসবে কে জানে! যখন তার বিপদের কথা আলোচনা করছে সাইমন এবং লোকটিকে তিরস্কার করছে এমন সময়ে বাইরে সেই বহু ঘোড়ায় টানা ঝুমঝুমি বাজাল গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। গাড়ি এসে থামল সাইমনের বাড়ির দোরগোড়াতে। গাড়ি থেকে সেই রাজপুরুষের ভ্যালে নেমে দৌড়ে এসে বলল, মাই মাস্টার ইজ ডেড। বুট লাগবে না। একটি চটি বানিয়ে দিতে হবে। কফিনে পরে শোবার জন্যে।

সাইমন বলল, তাই হবে। বিকেলে এসে নিয়ে যেও চটিজোড়া। তারপর আশ্চর্য চোখে চেয়ে রইল সেই লোকটির দিকে নিবাকে। কিন্তু সেই মানুষটির মুখে তখনও কোনও কথা নেই। সে মুখ নিচু করে তার কাজ করে যাচ্ছিল মনোযোগ সহকারে।

এই অবধি বলে, থামলেন তুরতি।

চারণ বলল, তারপর? এ সবের মানে কি?

 শুনুন বলছি। অত অধৈর্য হন কেন?

আরও অনেকদিন চলে গেল। এখন সাইমন রীতিমতন কেউকেটা হয়ে উঠেছে। বড়লোক। দেমাকে তার স্ত্রীর পা পড়ে না মাটিতে।

এমনই সময়ে একদিন একজন অত্যন্ত ধনী মহিলা তাঁর ফুটফুটে দুটি ছোট সুবেশা মেয়েকে নিয়ে এলেন জুতোর মাপ দিতে সাইমনের দোকানে। দুটি মেয়ের মধ্যে একটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। সাইমনের স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ওর পায়ে কি হয়েছে? মহিলা বললেন, ও জন্মাবার সময়ই একটি পা ভেঙে গেছিল। ওরা যমজ। ওর জন্মদাত্রী মা ওর পায়ের ওপরে গড়িয়ে গেছিলেন।

সে কী! আপনি ওদের নিজের মা নন?

না। তবে এখন নিজের মা-ই হয়ে গেছি। ওরাই আমার সব।

কীরকম! কী ব্যাপার বলুন তো শুনি।

আমরা খুবই গরিব ছিলাম। আমাদের গ্রামে আমাদের চেয়েও গরিব এক কাঠুরে থাকত। প্রচণ্ড এক দুর্যোগের রাতে সেই কাঠুরে গাছ কাটতে গিয়ে তার নিজেরই কাটা গাছে চাপা পড়ে মারা গেল। আর সেই রাতেই তার আসন্নপ্রসবা স্ত্রী যমজ মেয়ে প্রসব করল। প্রসবকালে প্রসব বেদনাতে ছটফট করতে করতে সে একটি নব জাতিকার উপরে উঠে যাওয়াতে তার পাটি খোঁড়া হয়ে গেল। সেই যমজ কন্যা প্রসব করার পরই সেই কাঠুরের স্ত্রীও সেই রাতেই মারা গেল।

তারপর?

মহিলা বলল।

তারপর আর কি? মেয়েটি তো মারাই যেত কিন্তু আমার কদিন আগেই একটি কন্যা সন্তান জন্মেছিল, তাই আমার স্তনে দুধ ছিল। গ্রামের সবাই সালিশী করে সাব্যস্ত করল যে আমারই স্তন্যপান করিয়ে আমার মেয়ের সঙ্গে ওদের আমি বড় করে তুলতে পারি। এবং তাই করতে হবে। তাই হল। কিন্তু কিছুদিন বাদে আমার নিজের মেয়েটা মারা গেল। তখন এই মাতৃপিতৃহীন এরা দুজন আমার কন্যাসম হয়ে উঠল।

ইতিমধ্যে আমার স্বামী ব্যবসাতে খুব উন্নতি করেছেন। দেখতে দেখতে আমাদের অবস্থা ফিরল এবং পড়শির এই যমজ কন্যাও বড়লোকের মেয়েদেরই মতন স্বচ্ছলতার মধ্যে বড় হয়ে উঠতে লাগল। আজকে আমাদের যেমন কোনও অভাব নেই ঈশ্বরের দয়াতে এদেরও নেই। আমরা খুব খুশি। আমার মেয়েরাও খুব খুশি। অভাব কাকে বলে তা আমরা জানিই না।

ভদ্রমহিলা যখন এই গল্প বলছিলেন তখন সাইমন যাকে হাত ধরে নিয়ে এসেছিল একদিন, সেই লোকটি মুখ তুলে হাসল আর একবার।

এবারে সে হাসল ঐ ভদ্রমহিলার কথা শুনে।

ভদ্রমহিলা এবং তাঁর মেয়েরা জুতোর মাপ দিয়ে সাইমন-এর স্ত্রীর সঙ্গে গল্পগুজব করে চলে যেতেই সাইমন তাকে চেপে ধরল। বলল আজ তোমাকে বলতেই হবে তুমি কে? কি তোমার পরিচয়?

লোকটি এই প্রথম মাথা উঁচু করে তাকাল সাইমন-এর দিকে। তার মুখমণ্ডল এক আশ্চর্য হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে গেল। সে যখন কথা বলতে শুরু করল তখন মনে হল সে এই ইহজগতের কেউ নয়। দেবলোকেরই কেউ।

সে বলল, আজ বলব, সবই বলব, কারণ আমি আজ ফিরে যাব আমি যেখান থেকে এসেছিলাম সেখানেই। আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে।

কি শিক্ষা?

সাইমন এবং তার স্ত্রী সমস্বরে শুধোল।

সে আত্মস্থ হয়ে স্থির নিষ্কম্প গলাতে বলে চলল, আমি ছিলাম একজন যমদৃত। ঈশ্বর আমাকে একদিন একটি আত্মা আনতে পৃথিবীতে পাঠালেন। সেদিন বড়ই দুর্যোগ পৃথিবীতে। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি ও বজ্র-বিদ্যুৎ। যেন প্রলয়কাল উপস্থিত হয়েছে। একজন নারীর প্রাণ আনতে এসেছিলাম আমি। তার কাঠুরে স্বামীর আত্মা সেদিনই সকালে আমারই এক সহকর্মী নিয়ে যে এসেছে, তা আমি জানতাম। সেই দুর্যোগের মধ্যে উপস্থিত হয়ে আমি দেখলাম যে, সেই নারী সদ্য দুটি যমজ সন্তান প্রসব করেছে। ভগ্নপ্রায় কুটিরে সে একা। বললামই তো যে তার স্বামীর প্রাণ সেই সকালেই নিয়ে এসেছে আমারই এক সহকর্মী। আমি ভাবলাম, আমি যদি এখন সেই নারীর প্রাণটিও নিয়ে যাই তবে সদ্যোজাত শিশু দুটির কি হবে? তাদের মৃত্যুও তো অনিবার্য। আমার মন বিদ্রোহ করে উঠল। ঠিক করলাম যে আমার দ্বারা অমন নিষ্ঠুর কাজ করা সম্ভব নয়। সব জেনে শুনেও সেই মায়ের প্রাণ আমি আনতে পারব না। তাই আমি স্বর্গে ফিরে গেলাম।

ঈশ্বর বললেন, এনেছ প্রাণ?

আমি বললাম, না। পারিনি। ও প্রাণ আনলে সদ্যজাত শিশুটির কি হবে?

 ঈশ্বর বললেন, তুমি একটু বেশি বুঝেছ। তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি এখনও। বলেই উনি আমার ডানা দুটি কেটে দিলেন।

সাইমন বলল তারপর?

তারপর সেই ডানাকাটা অবস্থাতে পৃথিবীতে যেখানে এসে পড়লাম আমি তখনই আপনি আমাকে দেখতে পান পথে। তখন তুষারপাত আরম্ভ হয়ে গেছিল। আপনি যদি সেই মুহূর্তে না আসতেন তবে আমিও তো নগ্নাবস্থাতে পথেই শীতে মরে থাকতাম মরা পাখিরই মতো। আমি ভেবেছিলাম, ঈশ্বর বোধহয় তাঁর কথা অমান্য করার জন্যে আমাকে মৃত্যুদণ্ডই দিলেন। কিন্তু আপনার নিজের তেমন গরম পোশাক না থাকা সত্ত্বেও, আপনি অত্যন্তই গরিব তা সত্ত্বেও আপনি চলে যেতে গিয়েও ফিরে দাঁড়ালেন।

আমাকে হাত ধরে টেনে তুললেন।

 তখন আপনি হাসলেন কেন?

সাইমন সেই যমদূতকে প্রশ্ন করল।

 হাসলাম, এ কথা বুঝে যে, ঈশ্বর মানুষকে অন্য মানুষের জন্যে সহমর্মিতা দিয়েছেন। সে হাসি আবিষ্কারের হাসি। ঈশ্বরের ক্রিয়াকাণ্ড বোঝার ক্ষমতা যে আমার নেই সে কথা হৃদয়ঙ্গম করা হাসি।

আমার স্ত্রী যখন তোমাকে খেতে ডাকলেন তখন তুমি দ্বিতীয়বার হেসেছিলে। কেন?

তখনও দারুণ অভাবী সংসারে ন্যায্য কারণেই অত্যন্ত বিরক্ত আপনার স্ত্রী সব অভাব ও বিরক্তি সত্ত্বেও আমাকে ডেকে খেতে বসিয়েছিলেন। সেই মুহূর্তে আবারও বুঝেছিলাম যে, সহমর্মিতা দিয়েছেন ঈশ্বর মানুষকে।

ZAR পরিবারের রাজপুরুষ যখন আমার সঙ্গে হাতের হান্টার নেড়ে নেড়ে কথা বলছিলেন তখন তুমি হেসেছিলে কেন?

সাইমন আবার জিজ্ঞেস করল।

হেসেছিলাম, কারণ, আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যে তার পেছনে আমার সহকর্মীরা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে নিয়ে যেতে এসেছে তারা। সে জানত না যে, ওই চামড়াতে বানানো শিকারের জুতো আর তার পায়ে উঠবে না। তার যা প্রয়োজন তা কফিনে শোওয়ার জন্যে একজোড়া চটি।

তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সেই মানুষটি বলল, সেই মুহূর্তেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, ঈশ্বর মানুষকে অনেক কিছুই দিয়েছেন কিন্তু জানতে দেননি পরমুহূর্তে কি ঘটবে। জানতে দেননি, তার মৃত্যু কোনক্ষণে এসে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। মানুষের সব জ্ঞানবুদ্ধিই এই ক্ষেত্রে বিফল। তাই সেই মুখ রাজপুরুষের ঔদ্ধত্য দেখে হেসেছিলাম। বুঝেছিলাম যে, ঈশ্বর কখন কি করেন, কেন করেন, সে সব শুধু তিনিই জানেন। আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছিল।

তারপর তুরতি বললেন, ওই সব কথা যখন সেই অনামা আগন্তুক সাইমনকে বলছিল তখন হঠাই তার ঘরের ছাদ সরে গেল। সাইমন, তার স্ত্রী এবং তার সন্তানেরা স্তব্ধ বিস্ময়ে দেখল যে, সেই সরে-যাওয়া ছাদের গহ্বর দিয়ে সেই আগন্তুক ঊর্ধলোকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

চারণ বলল, এত গোঁজাখুরি গল্প বলে মনে হচ্ছে।

হয়।

হাসলেন তুরতি।

বললেন, গাঁজা তো খাই আমরা। সাহেবরাই তো আমাদের ভগবান। সাদা চামড়া যাদের, যারা আর্য, সভ্য, শিক্ষিত তাদের দেশের এক সত্যদ্রষ্টা ঋষিতুল্য মানুষ, আমাদের রবীন্দ্রনাথেরই মতন, তিনিও গাঁজাখুরি গল্প লিখবেন? ডসটয়েভস্কি, চেখভ, তুর্গেনিভ এমন কি মায়াকোভস্কি লিখলেও না হয় অবিশ্বাস করা যেত। তা বলে, টলস্টয়? না। গাঁজাখুরি নয়। ভুলে যাবেন না যিনি War and peace লিখেছিলেন তিনিই What men live by লিখেছিলেন। মানুষ কিসে বাঁচে, কি নিয়ে বাঁচে? তা বলতে চেয়েছিলেন। যে সব মহামুখ মানুষ মনে করে যে, তারাই তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ এর নিয়ন্তা, তাদের অঙ্গুলি হেলনেই এই পৃথিবী নিয়ন্ত্রিত হয়, তাদের জানা উচিত ঈশ্বরের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা। তারা প্রকৃতার্থে কার দয়াতে, কার করুণাতে এখানে আসে এবং বাঁচে। ঈশ্বরবোধ ব্যাপারটা ডিফারেনসিয়াল ক্যালকুলাস নয়, কমপিউটারে ডাটা ফিড করলেই ঈশ্বরের চেহারা ফুটে ওঠে না। এটা বিশ্বাসের ব্যাপার। এই বিশ্বাস জানাতেও মানুষ হিসেবে উচ্চকোটীর হতে হয়। যারা তেলাপোকা বা ব্যাঙের জন্মের পরে মনুষ্যজন্ম পায় ঈশ্বরবোধ তাদের জন্যে নয়। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদুর।

চারণ বলল, টলস্টয়ের এই লেখার কথা, আশ্চর্য! শুনিনি কখনও।

অনেকেই শোনেননি।

 নামটা যেন কি বললেন?

 What men live by

তুরতি বললেন।

তুরতির গল্প শুনতে শুনতে বেলা গড়িয়ে যেল। মন্দিরের ছায়া পড়েছে চাতালে। বেলা প্রায় দশটা-টশটা হবে।

জিষ্ণু মহারাজ নেই তাই আজ যেন তুরতির কোনও তাড়াও নেই। দু-একজন সাধু-সন্ন্যাসী আসছেন এদিকে। তীর্থযাত্রী এখন খুবই কম। ঘুরেঘুরে দেখছেন। প্রস্তরাশ্রয়ের পাশে দাঁড়ালে তুষারাবৃত একাধিক শৃঙ্গ দেখা যায়।

তুরতি বললেন, গ্রীষ্মকালে আমি ওই চাতালেই ধ্যানে বসি।

 তাই?

চারণ বলল।

তা ধ্যানে বসে কি ধ্যান করেন আপনি?

সে কি বলা যায়?

হেসে বললেন, তুরতি।

একজনের ভাবনা কি অন্যকে দেখানো যায়? আপনি নিজে যদি ধ্যানে বসেন তবে নিজেই জানবেন। ধ্যান এর গোড়ার কথা হচ্ছে মনকে শান্ত, সমাহিত করা। এই যুগে মনকে শান্ত করাটাই সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। জানেন, আমার মনে হয়, এই আধুনিক যুগে কমুনিকেশনানের যতই উন্নতি ঘটেছে, মানুষের মনের শান্তি ততই বিঘ্নিত হয়েছে। মানুষ যা কিছুকেই আজ উন্নতি বলে জানছে একদিন তার সবকিছুকেই আত্মঘাতী অবনতি বলেই জানবে। কিন্তু ততদিনে খুবই দেরি হয়ে যাবে। তখন মানুষকে, মানে, এই প্রজাতিকেই আর বাঁচানো যাবে না।

আপনার কথার মানে বুঝলাম না।

বুঝলেন না? তাহলে কী করে বোঝাই বলুন?

কমুনিকেশন বলতে আপনি কি বোঝাচ্ছেন?

সব কিছুই। পথঘাট, ফোন, টেলেক্স, টেলিফ্যাক্স, ই-মেইল, সেলুলার ফোন, টিভি, ভিসি আর, টিভি-টেলিফোন, এরোপ্লেন। এবং মিডিয়া। কাল সকালের খবর কাগজ খুললে, যদি এখানে কাগজ পেতেন, তাহলে দেখতেন হয়তো কামাচকাটকাতে বিধ্বংসী আগুন লেগেছে। অথবা আফগানিস্তানের তালিবানরা বোরখার নীচে মেয়েদের গোড়ালি দেখা গেছে বলে তাদের বেধড়ক চাবকেছে, অথবা ভি পি সিং বা নরসিংহ রাও-এর গুহ্যপ্রদেশে কর্কট রোগ হয়েছে, অথবা নিমপাতা সেন নামের এক বাঙালি মেয়ে মিস জায়রে হয়েছে, অথবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার কোনও খাতা নর্দমাতে পাওয়া গেছে, অথবা জ্যোতি বসু বা শারদ পাওয়ার বা লালুপ্রসাদ যাদব (যবতক সামোসামে আলু রহেগা, তবতক বিহার মে লাল্লু রহেগা) কোনও অনুষ্ঠানে ফিতে কাটছেন এবং তেড়ে বক্তৃতা করছেন।

তাতে কি হয়েছে? এগুলো কি খবর নয়?

না, তা নয়। খবর অবশ্যই। কিন্তু এইসবের কোনও একটা খবরেও কি আপনার নিজের সত্যিই কোনও প্রয়োজন ছিল? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার খাতার ওই হাল তো বহুদিন থেকেই অমনই। এই সব না জানলে, এই সব ছবি না দেখলে, আপনার বুদ্ধিমত্তা এবং প্রকৃত জ্ঞানের কি কিছুমাত্রই ঘাটতি বা অবনতি ঘটত? তবে এটা ঠিক যে, আপনার আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট মূল্যবান সময়ই নষ্ট হত। টেনশান বাড়ত। মনোসংযোগের ক্ষমতা কমত। এই ধরাধামে আপনি কোন কাজ নিয়ে এসেছেন, জীবনে আপনার ব্রত কিছু ছিল কি, আপনি দিনের পর দিন এই অকারণ Exsercise in futility-তে তাই ভুলে যেতেন। যদি কোনও বিশেষ কাজ নিয়ে নাও এসে থাকেন (সকলেরই যে তা আসতে হবে এখন ভাবনা পাগলেই ভাবে) তবেও আপনি ঠ্যাং-এর ওপরে ঠ্যাং তুলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঠ্যাং দোলাতে দোলাতে কাকেঁদের ঝগড়া বা চড়াই পাখির আদর দেখার নিখরচার এবং অনাবিল আনন্দে বুঁদ হয়ে যেতে পারতেন। নিজের পছন্দর বই পড়তে পারতেন। প্রিয় গান শুনতে পারতেন। আপনি কোন প্রয়োজনে কষ্টার্জিত গ্যাঁটের কড়ি করচ করে দুনিয়ার এই আবর্জনাকে নিজের মাথায় ঢোকাবেন তা, বলতে পারেন?

তা ঠিক।

চারণ বলে।

টিভির সামনে যাঁরা বসে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁদের হাতে যে অঢেল সময় এমনও তো নয়। করার মতো অনেক কিছুই তাঁদের আছে। অথচ তবু নিছকই অভ্যাসের বশেই যে সব আনন্দের তাঁরা কখনও শরিক হতে পারবেন না, যেসব শোকে সান্ত্বনা দিতে পারবেন না, যে সব ভোগে বা ত্যাগে কোনওদিনও সামিল হতেও পারবেন না সেই সবেরই মধ্যে সেঁটে যাবেন তাঁরা। তাতে কোন উপকার হয়? চোখ খারাপ হওয়া ছাড়া? খবরের কাগজ আর টিভি না দেখে, বই পড়া ভাল। বই পড়লে, মনোসংযোগ কমে না, উলটে মনোসংযোগ বাড়ে। বই আপনি আপনার ইচ্ছেমতন রুচিমতন নির্বাচনও করে পড়তে পারেন। তা করে আপনার ইন্টারেস্টের কোনও বিশেষ বিষয়ে জ্ঞান গভীরতর করতে পারেন। অন্যে যা গেলাবে তাই গিলতে হবে না আপনাকে।

তারপরে একটু থেমে বললেন, চারণবাবু, আচ্ছা, আপনি একটা কথা আমাকে বলুন তো? এখন তো প্লেনের দৌলতে আট দশ ঘণ্টাতেই পশ্চিমী দেশে পৌঁছে যাচ্ছেন যে কেউই। কিন্তু বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মুখাগ্নি কবতে কতজন ছেলে দেশে আসছে? আপনার জানাশোনা আত্মীয়পরিজনেরা বা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেকেই নিশ্চয়ই বিদেশে আছে। তাঁরা আসছেন কি?

ঠিক বলতে পারব না।

আদৌ নয়। ফোন করে তাঁর সদ্য-বিধবা মাকে বলছেন, মা। গিয়ে আর কী করব? পাঁচুকে বোলো, মুখে আগুন দিতে। আমার বড্ড কাজ।

মা জীবিত না থাকলে ভাইকে বলছেন : ও সব ঘাস্টলি রিচুয়ালস-এ বিশ্বাস করি না আমি। বাবা চলেই যখন গেছেন তখন গিয়ে আর কি করব? সিলি সেন্টিমেন্টস যসব। মানুষ জন্মালেই তো মরেই একদিন। আমার অ্যানুয়াল ভেকেশান বুক করা হয়ে গেছে। বারমুডাতে স্কুবা-ডাইভিং করতে যাব। আই অ্যাম ডাইং ফর আ হলিডে। পঞ্চাশ ডলার পাঠিয়ে দিচ্ছি। শ্রাদ্ধর খরচ হিসেবে।

একটু থেমে তুরতি বললেন, তাহলেই দেখুন। কমুনিকেশানস-এর উন্নতির নিট ফল তো এই! মানুষ স্বার্থপর হয়েছে। চক্ষুলজ্জাহীন হয়েছে। আত্মমগ্ন। তার সার্বিক আত্মিক অবনতি হয়েছে। লোভী হয়েছে। টাকা চিনেছে। শুধুই টাকা। মা মৃত্যুশয্যায় থাকলে জেট প্লেন যদি ছেলেকে কাছেই আনতে না পারে, বাবার শ্রাদ্ধতেও যদি সেই ছেলে না আসতে পারে, তবে এই দ্রুতগামী যানবাহনের প্রয়োজন কি ছিল? টাকা আরও টাকা রোজগার করার জন্যেই কি শুধু? এক জায়গার থেকে আরেক জায়গার দূরত্ব নস্যাৎ যেমন করেছে শব্দর চেয়েও দ্রুতগামী যানবাহন, তেমনই নস্যাৎ করেছে মানুষের সঙ্গে মানুষের চিরন্তন সম্পর্ককে। প্রেম, দাম্পত্য, অপত্যকে। দ্রুত ছুটে চলেছে মানুষ। কিন্তু কোথায় যে চলেছে, তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথাই নেই। এই ছোটাছুটি মানুষকে মনুষ্যেতর জীবে পর্যবসিত করেছে। তবে কেন এই ছোটাছুটি? আর্থিক সাচ্ছল্য আর আত্মিক দীনতারই জন্যে? মনুষ্যত্বই যদি বিকৃত হয়ে যায় তবে কত দূরের পথ কত কম সময়ে অতিক্রম করা যায় তা দিয়ে মানুষের কি হবে? সেলুলার ফোন দিয়ে কি হবে?

চারণ একটু চুপ করে থেকে বলল, আপনি হয়তো একটু বাড়িয়ে বলছেন। তবে আপনার কথাটা যে পুরোপুরি মিথ্যা এখনও বলতে পারি না।

তুরতি আবারও বললেন কি না? ভেবে দেখুন আপনি চারণবাবু, কোটি কোটি মাইল সড়ক পৃথিবীর সব জায়গার শান্তি নষ্ট করে দিয়েছে কিনা। আমাদের এই জীবনে, এই পৃথিবীতে রহস্য বলে কিছু ছিল, আবু ছিল, কল্পনার অবকাশ ছিল, এখন আর নেই। মুজাফফরপুরের মানুষ এখন লিচু খেতে পান না, বাংলাদেশের মানুষ ইলিশ মাছ খেতে পান না, মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙার মানুষে কুমড়ো কিনতে পাবেন না। এত দাম! বহরমপুরেও পাঁঠা নেই, মানুষের মধ্যে হয়তো কিছু আছে, কিন্তু অজগগাষ্ঠীর মধ্যে নেই। মেদিনীপুরের সমুদ্রপোকুলে বাগদা চিংড়ি নেই। মালদাতে আম নেই। সুন্দরবনের বাদার মানুষ কাঁকড়া খেতে পায় না, সব রপ্তানি হয়ে যায় দেশে কী বিদেশে।

একটু থেমে তুরতি বললেন, রপ্তানি যে হয়, আমদানি কারা করে? যাদের অনেক টাকা আছে শুধুমাত্র তারাই। রপ্তানি কারা করে? পয়সাওয়ালা মানুষেরা। ফড়েরা, এক্সপোটাররা। আরও টাকার রোজগারের জন্যে। তাতে স্থানীয় জিনিস স্থানীয় মানুষেই পান না। কম্যুনিকেশনস-এর উন্নতির একমাত্র উদ্দেশ্য যদি হয় বড়লোকদের আরও বড়লোক করা, তাহলে আমার কিছুই বলার নেই। আমাদের দেশে, বিশেষ করে এই সব আধুনিক উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি, দেশের সাধারণ মানুষের অপকার ছাড়া উপকার করেনি কোনও। সিনেমা, টিভির জন্যে আর ভিডিও পালারের জন্যে দেশের মানুষের স্বভাব, চরিত্র, মানসিকতা সবই নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে পুরোপুরি। যে-দেশের আমজনতা আজও রামায়ণ মহাভারত আর কোরাণের শিক্ষাতে শিক্ষিত সেই দেশে এই সব অন্যবোপিত উন্নতি এই দেশের সাধারণের আত্মিক, এবং পারমার্থিক সর্বনাশকে সুনিশ্চিত করেছে।…

আপনি খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। সাধুসন্তদের এমন উত্তেজনা মানায় না।

চারণ বলল, তুরতিকে।

সন্ত তো হতে পারিনি এখনও। হলে, উত্তেজিত হতাম না। কঠিন বাস্তবের এই সব কথাই তাহলে মহারাজেরই মতো হাসতে হাসতেই বলতে পারতাম।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, আমার জন্যে প্রার্থনা করুন চারণবাবু একদিন যেন সন্ত হয়ে উঠতে পারি। সন্ত যদি হয়ে উঠতে পারি আমার জীবদ্দশায়, তবে যে-দেশের মানুষেরা আমাদের এবং শুধু আমাদেরই নয়, সারা পৃথিবীরই এমন ক্ষতি করে যাচ্ছে, সর্বনাশ করে যাচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই, সেই আমেরিকানদের আমার পায়ের কাছে বসিয়ে শেখাতাম বড়লোক শব্দটার মানে। অর্থ, কোনওদিনই কোনও মানুষের মতন মানুষকে প্রকৃতার্থে বড়লোক করতে পারেনি। ডলার-সর্ব ওরা, এ সব কথার অর্থ কী বুঝবে?

আজ যে বহু আমেরিকান এই দেবভূমির পাহাড়ে-করে ন্যাংটো ও আধন্যাংটো সাধুসন্ন্যাসীদের পায়ের কাছে এসে বসেছেন তাতে আপনার খুব আনন্দ হয়, না?

না। হয় না। কারণ, যাঁরা আসেন তাঁরা সকলেই উচ্চমার্গের মানুষ। তাঁরা এমনিতেই আসতেন। এঁরা নয়, কবে নিম্নবর্ণের মানুষও আসবেন তাই ভাবি আমি।

আচ্ছা! বলুন তো জিষ্ণু মহারাজ আমাকে এমন করে ডেকে নিলেন কেন? আমি তো কেউই নই। কী উদ্দেশ্য ওঁর?

ভয় নেই আপনার। উনি ডেকেছেন বটে, তবে বেঁধে রাখার জন্যে ডাকেননি। উনি মানুষকে চেনেন বলেই ডেকেছেন।

আমাকেও কি আপনারই মতো চেলা বানাবেন? আপনি তো প্রগাঢ় পণ্ডিত। আমার কোন যোগ্যতা আছে? আমি তো আপনার পায়ের নখের যোগ্যও নই।

কার কী যোগ্যতা, তা সে নিজে কি কখনও জানে? তা ছাড়া কথায় বলে না? গুরু মিলে লাখ লাখ, চেলা মিলে এক। তবে এ কথা ঠিক যে, আমি মুখখিস্ত্যানন্দ বাবা। আমার ধারে কাছে আপনি তো দূরস্থান, এই দেবভূমির আর কেউই আসতে পারবে না এই গুণপণাতে।

চারণ হাসল, তুরতির কথা শুনে।

তুরতি বললেন, আপনার ভোগ কি শেষ হয়েছে?

মানে?

মানে, কামনা বাসনার নিরসন কি হয়েছে?

জানি না। বোধহয় নয়।

আমারও তাই মনে হয়।

কী করে মনে হল?

বুঝিয়ে বলতে পারব না। কিন্তু হয়। Its a matter of feeling.

আপনার?

 চারণ উলটে প্রশ্ন করল।

দুটি হাত দুদিকে প্রসারিত করে তুরতি বললেন, বিলকুল। ভোগের নিবৃত্তি না হলে এই অমৃতর স্বাদ তো পাওয়া যায় না। মনটা আর শরীরটা কেবলই পড়শির বেড়ালেরই মতন ঠুক ধুক করে, কেবলই জানালার গরাদ গলে এসে মাছটা-দুধটা খেয়ে যেতে চায়।

আপনি কি গৃহী ছিলেন?

চারণ শুধোল তুরতিকে।

গৃহে বাস করতাম ঠিকই। গৃহ না বলে তাকে প্রাসাদ বলাই ভাল। এসব পুবাশ্রমের কথা। আমি তো এখনও সন্ত হইনি, তাই বলছি। তবে গৃহী বলতে যদি সংসারী বোঝন তা হলে বলতে হয়, সংসার আমি করিনি। কখনওই নয়।

আশ্চর্য। সংসার করলেন না আর ভোগের নিবৃত্তি হল কি করে?

চারণের এই কথাতে খুব জোরে হেসে উঠলেন তুরতি।

বললেন, সংসারীরা তো একই জায়ার সঙ্গে সংসার করে। যে সুদর্শন বুদ্ধিমান যুবকের পকেট-ভর্তি টাকা থাকে, শিক্ষাও থাকে, বংশমর্যাদা থাকে, তার জায়ার অভাব কি?

মানে?

আমার ভোগের নিবৃত্তি অবশ্যই হয়েছে। জনপদবধুরা যেমন করে পুরুষের কামের নিবৃত্তি ঘটাতে জানেন তেমন করে হয়তো কম জায়ারাই পারেন। এই সত্য যদিও খুবই দুঃখের।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, শরীরটা যে ওঁদের কাছে মন্দির। মনোমন্দিরে প্রবেশাধিকার নেই, তা জানেন বলেই ওঁরা শরীরকেই মন্দির করে তুলে পরম শুচিতার সঙ্গে পুণ্যার্থীকে গ্রহণ করেন। অনেকই শিখেছি চারণবাবু ওঁদের কাছে। শুধু শরীরের ভালবাসাই যে পেয়েছি তাই নয়। মিথ্যে বলব না, মনের ভালবাসাও পেয়েছি। শ্রীকান্ত যেমন পেয়েছিলেন তার রাজলক্ষ্মীর কাছ থেকে। ওঁরা যখন ভালবাসেন তখন…কী বলব কী করে বোঝাব জানি না, যেন, যেন, কুকুরীর মতন নিঃস্বার্থভাবে, আন্তরিকভাবে, সমস্ত মনপ্রাণ দিয়েই ভালবাসেন। একজন কুকুরী মনিবকে ঠিক যে রকমের ভালবাসা বাসে তেমন ভালবাসা কি কোনও স্ত্রী কোনওদিনও কোনও স্বামীকে ভালবাসতে পারেন?

চারণ, তুরতির এই অভাবনীয় এবং ধাক্কা-দেওয়া কথাতে অবাক হয়ে বলল, কী জানি। আমার তো স্ত্রী হয়নি। বলতে পারব না তাই।

বিবাহিতা স্ত্রী তো আমারও ছিল না তা বলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হতে পারে, তা না বোঝার কি আছে? আমি তো আর এঁড়ে গরু নই।

তুরতি বললেন।

এই আরম্ভ হল বোধহয়।

 মনে মনে ভয় পেয়ে গেল চারণ।

ও ভাবছিল, তুরতি বোধহয় সব জানেন না। একটি দাম্পত্যর মধ্যে যে কি থাকে তা দম্পতিরাই শুধু জানেন। বড় গঢ় রহস্য। বাইরে থেকে জানা অত সহজ নয়। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।

পরক্ষণেই তুরতি বললেন, আপনি বিবাহ তো করেননি, কিন্তু নারী-সংসর্গও কি করেননি কখনও? Orgasm শব্দটার মানে জানেন কি? বইপড়া বা শোনা বিদ্যা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতায়?

বলেই বললেন, মিথ্যে বলবেন না কিন্তু। আমাকে মিথ্যে বলবেন না।

জানি।

অবিবাহিতর নারী-সংসর্গ কি উপায়ে হয়েছিল? পরকীয়া? না জনপদবধু?

 পরকীয়া।

এক? না একাধিক?

 এক। সম্পর্ক একই মাত্র।

কতবার সঙ্গম করেছেন?

 বার কয়েক মাত্র। একই রমণীর সঙ্গে। বললামই তো।

লজ্জিত এবং বিব্রত চারণ মুখ নামিয়ে বলল।

তবে তো জানেনই Orgasm-এর মানে। নিঃশেষে জরায়ুতে বীর্যপাতের পরে যেমন ভারশূন্য মনে হয় পুরুষের নিজেকে, (হয়তো নারীরও হয়, নারী নই বলেই বলতে পারব না তাঁদের কথা), যেমন অপার আনন্দ আসে মনে, যেমন সেই চরম পুলকের মুহূর্তে সব পাজি, ক্ষতিকারক, ঈর্ষাকাতর, নীচ মানুষের সমস্ত অপরাধই ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে যায়, ঠিক তেমন…

তেমন কি?

আমি শারীরিক অবস্থার বা অবস্থানের বর্ণনাই দিলাম মাত্র। শরীরেরই মতন আপনার মনের অবস্থাও যেদিন চরমপুলকের পরের অমন আনন্দময়, ভারশূন্য, ক্ষমাময়, গান গাইবার জন্যে উৎসুক হয়ে উঠবে সেদিনই শুধু তৈরি হবেন আপনি। সেদিনই শুধু এই সাধনমার্গে সাধনা শুরু করার যোগ্যতার উন্মেষ হবে আপনার মধ্যে।

কামই কি একমাত্র রিপু নাকি? আপনার দেখছি কামময় জগৎ।

চারণ একটু শ্লেষের সঙ্গেই বলল।

মোটেই নয়। রিপু তো অনেকই। কে না জানে? কামের চেয়েও বড় রিপু ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্য, ভয়। সব রিপুকেই জয় করতে হবে। একটাকে সম্পূর্ণ জয় করতে পারলেই অন্যরাও আস্তে আস্তে তার অনুগামী হবে। আমার মতো হাড়ে-হারামজাদা, লাপায়রা, মাগিবাজ হোপলেস কেস যদি পায়ে পায়ে এতদূরে এসে এই চন্দ্রবদনীর মন্দিরে পৌঁছে জিষ্ণু মহারাজের চরণে ঠাই পেতে পারেন তাহলে আপনিও বা পাবেন না কেন? তাছাড়া, সকলকেই যে সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হতেই হবে তারই বা কি মানে আছে? সংসারে থেকেও যাঁরা সন্ন্যাসী, তাঁরাই তো সবচেয়ে বড়মাপের সন্ন্যাসী। মহারাজকে জিগ্যেস করবেন। আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয়।

বিশ্বাস না হওয়ার কি আছে।

চারণ বলল।

আপনি বিয়ে করুন ফিরে গিয়ে।

তুরতি বললেন, কাকে?

আরে! এত মহা ন্যাকাখোকা দেখছি।

চারণ জোরে হেসে উঠল। না-হেসে পারল না বলে।

 বলল, সত্যি। আপনি incorigible।

তুরতি বললেন, সম্পত্তির মধ্যে তো এখন শুধু মুখটিই আছে। আর সবই তো গেছে। সেটুকু নিয়ে একটু খেলা করব, তাতেও আপত্তি? How mean are you!

তারপর বললেন, যাকে খুশি তাকেই বিয়ে করুন। বিয়ে করুন, আর নাই করুন, জীবনকে ভোগ করুন। ঊ্যলিসীসের মতন বলুন I will drink life to the Lees। আর শুধু বলেই ক্ষান্ত হবেন না। Please do it! ত্যাগেরই মতন ভোগও মহান। দুইই সমান পুণ্যের। দুইই কষ্ট করে শিখতে হয়। তবে ভোগ করবেন কিন্তু কই-মাগুরের মতন জীবন যাপন করে ভোগ করবেন না। জলে থেকেও, কাদা-দলদলি থেকে সবকিছু নিয়েও, জলজ কুমুদিনী যেমন করে জলের ওপরে মাথা উচিয়ে হাসে, চাঁদকে, পাখিকে ভালবাসে, তেমন করেই ভোগ করবেন। ভোগের মধ্যে আবিলতা আনবেন না কখনও।

বাঃ।

চারণ বলল, আপনি যেমন বাংলা বলেন, আপনি তো লেখকও হতে পারতেন স্বচ্ছন্দে।

 কোন দুঃখে মহায়? বেশ আছি। খাসা আছি।

তা ঠিক। তবে আপনি হয়তো পারতেন ইচ্ছে করলেই, লেখক হতে।

 চারণ বলল।

ইচ্ছে করলে! ইচ্ছে করলে তো নিত্যভামা অপেরার কচু খেকো যাত্রার বিবেকও হতে পারতাম। অথবা রাজ্য সরকারের কোনও মন্ত্রী-টন্ত্রী। যে নিজে রাজা, সে মন্ত্রী হতে যাবে কোন দুঃখে? আপনিই বলুন।

বলেই বললেন, খাবেন তো একচড়া? নাকি নীচের দোকানে যাবেন?

রোজ রোজ দোকানের খাবার না খাওয়াই ভাল। কী তেল-ঘি দিয়ে রাঁধে কে জানে! আজ আমিই রাঁধি।

চারণ বলল।

 একচড়া আবার রাঁধবেন কি?

তবু।

প্রবল আপত্তি তুলে তুরতি বললেন বউ কেমন রান্না করবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই বলে এ শর্মা জীবনে বিয়ে পর্যন্ত করল না, আর শেষে আপনার মতন পুংলিঙ্গর হাতের রান্না খেয়ে নরকে যাবার মধ্যে আমি একেবারেই নেই। স্ত্রীলিঙ্গ ছাড়া অন্য কারও হাতের রান্না আমি খাই না। যাই উঠি। যোগাড় যন্তর করি গিয়ে।

আপনি একজন মেল-শভিনিস্ট।

চারণ বলল।

 অনেকই তো বেলা হল জিষ্ণু মহারাজ এখনও ফিরলেন না।

 কী হল বলুন তো তাঁর?

চারণ, জিগ্যেস করল তুরতিকে, শীতে জবুথবু হয়ে আগুনের পাশে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে।

এখন সকাল এগারোটা, কিন্তু চারধার আঁধার করে আছে। কাল সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি এখন নেই কিন্তু একটা ঝোড়ো হাওয়া আছে। হিমশীতল এবং আর্দ্র। বরফের কুঁচি উড়ছে যেন হাওয়াতে।

তুরতি বলছিলেন, প্রতিবছরই ডিসেম্বরের শেষে এমন বৃষ্টি হয় আর ঝাঁপ দেয় নীচে। দাঁতে দাঁতে ঠকঠক করে অথচ এবই মধ্যে শুধু চন্দ্রবদনীতেই বা কেন কেদারনাথ বদ্রীবিশাল এবং চীনের সীমান্ত অবধি কত গুহাতে-করে-প্রস্তরাশ্রয়ে কত নগ্ন অর্ধনগ্ন সাধু-সন্ত নির্বিকাব থাকেন তা বলার নয়। এহ বাহ্য আগে কহ আর। বাইরের সুখ দুঃখ আরাম কষ্ট কিছু নয়, কিছু নয়।

তুরতি বললেন, যখন খুশি হবে ফিরে আসবেন। এই হঠাৎ অন্তর্ধানের পেছনে কোনও গঢ় রহস্য আছে বলে মনে হয়। এ বছরে এমন কিন্তু কখনওই হয়নি যে, আমাকেও না বলে তিনি চলে গেছেন। জানি না কি তাঁর উদ্দেশ্য।

যদি ফিরে না আসেন? উদ্বিগ্ন গলাতে চারণ বলল।

যদি উনি ফিরে না আসতে চান, তবে আমাদের কোন শক্তি আছে যে তাঁকে ফিরিয়ে আনব? তা ছাড়া তা চাইবই বা কেন? তাই যদি চাইব তবে এত বছর তাঁর পায়ের কাছে বসে শিখলাম কি?

সত্যি! আশ্চর্য মানুষ সব আপনারা!

স্বগতোক্তি করল চারণ!

হ্যাঁ। আরও আশ্চর্য আপনি।

 কেন?

 এই আশ্চর্য, দুবোধ্য মানুষদের সান্নিধ্যেই কাটিয়ে দিলেন কতকগুলো মাস। অথচ নোঙর বেঁধে এসেছেন কুটিল কলকাতাতে।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, ফেরার পথ তো প্রথম ক্ষণ থেকেই খোলা রেখেছেন আপনি। কিন্তু আমরা কোথাও ফেরার কথা বা ফেরা-না-ফেরা নিয়ে ভাবাভাবিই করি না। যে যার মনে যায়, যার মনে ফিরে আসে, অথবা আসে না। তার খোঁজে ঘন ঘন ফোনের ঘণ্টা বাজে না, যায় না ফ্যাক্স মেসেজ, তাকে হন্যে হয়ে খুঁজি না আমরা সেলুলার ফোনেও। তিনিও যদি হারাতে চান তবে নিঃশেষেই হারিয়ে যাবেন। কোনও রেশ রেখে যাবেন না। রেশ রেখে যিনি বা যাঁরাই যান তাঁরাই আসলে সত্যি সত্যি হারাতে চান না।

হয়তো তাই।

চারণ বলল। আমি কী করব তাই ভাবছি। ফিরেই কি যাব? ধিয়ানগিরি মহারাজও তো দেহ রেখেছেন শুনলাম। ভীমগিরি মহারাজও কি আর বসে আছেন আমার জন্যে?

মহারাজের অভাব কি? মহারাজ, সাধু-সন্তরা আসেন যান। হৃষীকেশ-এর গঙ্গার ঘাট, বা কোনও তীর্থস্থানই তো আর ফাঁকা থাকে না। যে ফাঁক, যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা অচিরেই পূরিত হয়ে ওঠে।

আমাকে রেশ রেখে যেতে বলছেন কেন তবে?

 বলছি এই জন্যে, যাতে ইচ্ছে করলেই আবার ফিরে আসতে পারেন। আমরা তো বনবাসে নেই। বিয়ে করলে, সস্ত্রীকও আসতে পারেন। সব তীর্থ ঘুরিয়ে নিয়ে যাবেন। ট্রাভেলিং ইজ এডুকেশন।

যদি তাঁর আপনাদের কারওকে পছন্দ না হয়?

তবে পত্রপাঠ বিদায় নেবেন। তাঁকে নিয়ে তো আর আমাদের সঙ্গে থাকার প্রশ্ন ওঠে না। আপনি কোথায়, কাদের সঙ্গে কাটিয়ে গেলেন অনেকগুলি দিন, সেই সব জায়গা, সেই সব মানুষদের দেখাতে আনবেন। বিবাহিত মানুষদের তো কোনও স্বাধীনতা থাকে না। তার নিজের একার ইচ্ছাতে কোনও কিছুই ঘটে না এ সংসারে। ঘটাতে গেলেই সম্পর্কের ছন্দটা নড়ে যায়। এই কারণেই তো বিয়ের কথা আমি ভাবিনি পর্যন্ত। তাছাড়া…

তাছাড়া কি?

চারণ শুধোল।

বিয়ে ব্যাপারটা, মানে এই বন্দোবস্তটা তো এখনও তেমন দানাও বাধে নি।

তুরতি বললেন।

সে কি? কি বলতে চান আপনি?

 উদ্দালকের নাম শুনেছেন? ঋষি উদ্দালক?

না তো!

উদ্দালক একজন বিখ্যাত ঋষি।

তাই?

হ্যাঁ। ওর আসল নাম ছিল আরুণি। কিন্তু ওঁর গুরু আমোদধৌম-এর বরে উনি উদ্দালক বলে পরিচিত হন। উদ্দালকের ছেলের নাম ছিল শ্বেতকেতু। একদিন শ্বেতকেতু যখন তাঁর বাবার কাছে বসেছিলেন, তখন তাঁর উপস্থিতিতেই এক ব্রাহ্মণ পুরুষ এসে তাঁর মা এবং উদ্দালকের স্ত্রীকে সদ্যোগ করার বাসনা প্রকাশ করেন এবং শ্বেতকেতুর মাকে তাঁর হাত ধরে গায়ের জোরেই নিয়ে যান। তা দেখে, স্বাভাবিক কারণেই ষেতকেতু প্রচণ্ড রেগে তাঁর বাবাকে বলেন, এ কী ব্যাপার? আপনি প্রতিবাদ করলেন না?

উদ্দালক পুত্রকে শান্ত করে বলেন, পুত্র, তুমি রাগ কোরো না। এটাই সনাতন ধর্ম। গাভীদেরই মতন স্ত্রীরাও অরক্ষিতা। গাভী এবং স্ত্রীলোককে ভোগ করার অধিকার সকলেরই আছে।

শ্বেতকেতু এ কথা শুনে অত্যন্তই বিচলিত হন এবং তিনিই স্ত্রী-পুরুষের দাম্পত্যজীবন সম্বন্ধে এই নিয়মের প্রবর্তন করেন যে, একজন পুরুষ একজন রমণীর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হবে এবং পতি ছাড়া যে বিবাহিত রমণী অন্য পুরুষের সংসর্গ করবে এবং যে পুরুষ পতিব্রতা স্ত্রীকে ত্যাগ করে অন্য স্ত্রীতে আসক্ত হবে, তারা উভয়েই সৃণহত্যার পাপে বিদ্ধ হবে। সেই থেকেই আমাদের সমাজে বিবাহ প্রথা প্রথম চালু হল।

তাই?

হ্যাঁ। তবে সর্ষের মধ্যেই ভূত ঢুকে রইল।

তার মানে?

 মানে, পরবর্তীকালে, বিবাহপ্রথা পত্তনকারী এই শ্বেতকেতুই নন্দীর হাজার অধ্যায়ের কামশাস্ত্রকে ছোট করে পাঁচশ অধ্যায়ের কামশাস্ত্র রচনা করেন।

তাই?

অবশ্যই।

এই শ্বেতকেতু কিন্তু আদৌ কাল্পনিক চরিত্র নয়। তৈত্তিরীয়সংহিতা, ছান্দোগ্যোপনিষৎ এবং বৃহদারণ্যকোপনিষৎ-এ শ্বেতকেতু সম্বন্ধে আরও অনেক কাহিনী আছে। কিন্তু সবচেয়ে মজারই বলুন বা দুঃখেরই বলুন কথা হচ্ছে এই যে, বিবাহিতা স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষার সুব্যবস্থা করার পরও এদেশে যত কামশাস্ত্র রচিত হল তার প্রায় সমস্ত শাস্ত্রেই একটা করে অধ্যায় থাকলো, যার নাম পারদারিক।

তার মানে?

চারণ শুধোল।

তার মানে, অন্যের স্ত্রীকে কী করে বশ করতে হয় এবং পরস্ত্রীকে কী করে অধিকার করা যায় তার সম্যকজ্ঞানের শাস্ত্র তা।

সত্যি?

বিস্মিত হয়ে চারণ বলল।

অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্রেও একটি বিশেষ অধ্যায় আছে, যার নাম, পারদরিকাধিকরণস্য। পরস্ত্রীকে কি ভাবে অধিকার করা যায় সেই বিদ্যার শাস্ত্র।

বলেন কি আপনি? অবাক হওয়ার কিছু নেই এতে?

 নেই।

শুধু বিবাহই নয়, মানুষ-মানুষীর কোনও ব্যক্তিগত সম্পর্কই Water tight নয়। সব সম্পর্কই নড়বড়ে। তবে আমার একটা কথা প্রায়ই মনে হয়।

কি কথা?

দাম্পত্যর ঘর অটুট থাকতে পারে চিরদিনই যদি তা দমবন্ধ করা না হয়, যদি তাতে আলো বাতাস খেলে। যদি ঘরের লাগোয়া একটা বারান্দা থাকে। কাহলিল জিব্রান তাঁর Couples-এ যাকে Space বলে চিহ্নিত করেছিলেন। মাঝে মাঝে এই বারান্দাতে এসে স্ত্রীরা দাঁড়াতে পারেন। বিপরীত লিঙ্গর কারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেন, পেতে পারেন, শুনতে পারেন পাখির ডাক, পেতে পারেন ফুলের গন্ধ, দেখতে পারেন নীলাকাশ। এই বারান্দা থাকাটা সব দাম্পত্যেই খুবই জরুরি।

চারণ বলল, সত্যি! আপনি যে কেন লেখেন না জানি না। আপনার মতন সুন্দর করে কথা বলতে খুব কম মানুষই পারেন।

হাঃ!

চারণ বাইরে চেয়ে বলল, দুর্যোগ কাটছে। বিকেলের দিকে রোদ উঠতেও পারে।

উঠবে না। এমনই চলবে তিনদিন। শীত আরও বাড়বে। দুপুর-দুপুরই ধুনির জন্যে কাঠ জোগাড় করে আনতে হবে।

ঠিক আছে। আমিও যাব আপনার সঙ্গে।

 তারপর বলল, একটা কথা জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করছে আপনাকে।

 কি কথা?

আপনি যে সেদিন কার্ল মার্কস-এর লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি দিলেন সেটি আমার দারুণ লেগেছিল। আপনি কি দর্শনের ছাত্র ছিলেন, না অর্থনীতির? না রাজনীতির?

আমি দর্শনেরই ছাত্র ছিলাম বরাবর।

মানে?

মানে, কোনও রমণীকে নববর্ষে বা পুজোতে শাড়ি উপহার দিয়ে আমি কখনও বলিনি যে একদিন পরে দেখিও। বলেছি, একদিন না-পরে দেখিও।

খুব জোরে হেসে উঠল চারণ। বলল, সত্যিই আপনি incorrigibility-র সংজ্ঞা। এমন মানুষ সত্যিই আর দেখিনি। আপনি একটি paradox!

তুরতিও হাসছিলেন।

চারণ বলল, বলুনই না।

বলব কি? আমি তো কলেজেই যাইনি কখনও।

তুরতি বললেন, মার্কস তো এখন পুরোনো হয়ে গেছেন। Wolf-Callari-Roberts (WCR) ফর্মুলেশন মার্কস-এর তত্ত্বকে নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছে।

চারণ একটু চুপ করে থেকে বলল, জাক দেরিদা সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা? তিনি নাকি কলকাতার বইমেলাতে আসবেন পরের বছর?

তাই? তা আমার ধারণা দিয়ে কি হবে?

আমি জানতে চাই।

দেরিদা তো Hegel আর Althusser-এর অনুগামী। দেরিদার তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করার মতো পাণ্ডিত্য বা ইচ্ছা আমার নেই তবে তাঁকে একবার শুনেছিলাম প্যারিসে। ভদ্রলোককে বড় বাগাড়ম্বর-প্রিয় বলে মনে হয়েছিল। উনি ইংরেজি ভাষাতে বলেন ভালই তবে সেই সওয়াল বটতলার উকিলের মতন। কথার খেলা খেলেন তিনি। ইচ্ছে করলে নতুন ইংরেজি Theasurus সংকলন করতে পারতেন Roget-এর পরে। তবে কমুনিস্টদের অধিকাংশদেরই যা দোষ, তাঁরও সেই দোষ। বক্তব্যের চেয়ে ভাষার বিন্যাসই তাঁকে আকৃষ্ট করে বেশি।

তাই?

তাই তো মনে হয়েছিল আমার। আমি আর কতটুকু বুঝি?

 চারণ চুপ করে এই তুরতি নামক ক্ষেমি বাঈজির বাড়ি ব্যায়লা বাজানো মানুষটিকে বোঝার চেষ্টা করছিল।

পরনে একটি মোটা কাপড়ের গেরুয়া লুঙ্গি। হাতে বোনা, মোটা গরম কাপড়ের পাঞ্জাবি। গেরুয়া রঙা। তার ওপর কালোর উপরে সাদা চেকচেক একটি খুব মোটা দেহাতি কম্বল। কাঁচাপাকা গোঁফ দাড়ি। কিন্তু মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। রং একসময়ে অত্যন্তই ফসা ছিল। এখন তামাটে দেখায়। নাকটা একটু চাপা কিন্তু মুখমণ্ডলে এমনই এক আভিজাত্য আছে যে হাজার মানুষের মধ্যে সেই মুখে চোখ পড়লেও বোঝা যাবে যে তিনি অন্যদের মতন নন। একেবারে আলাদা। সব মিলিয়ে দারুণ এক ধাঁধা। এমন কত Quiz যে ছড়িয়ে আছে এই দেবভূমিতে তা কে জানে!

খুবই শীত করছিল চারণের। ও উঠে গেল ভিতরে, একটি ফুল-হাতা পোলো-নেক সোয়েটার ছিল তার থলেতে, সেটি চাপিয়ে আসতে। আরও একটা বাঁদুরে টুপি আছে।

ভাবছে সেটিকেও, যেটি পরে আছে তার ওপরে চাপিয়ে আসবে।

ভিতর থেকে যখন বাইরে এল, মানে, প্রস্তরাশ্রয়ের বাইরের অংশটিতে তখন হঠাৎই চোখ পড়ল পাটন আসছে। তার পরনে জিনস, ট্রাউজার এবং জামা। তার ওপরে একটা ঢোলা সোয়েটার। না টুপি আছে, না মাফলার। পায়ে একজোড়া রাবারের হাওয়াই চটি।

কাছে এসে পৌঁছলে, চারণ বলল, হঠাৎ। তুমি! কোত্থেকে?

বলেই তুরতির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে গেল। দিতে গিয়েই বুঝল, ওরা পরস্পরকে চেনে।

চারণ শুধোল, জিষ্ণু মহারাজকে কি দেখেছ?

দেখেছি।

উনি ফিরে আসছেন?

না।

তারপরেই বলল, না মানে, আসবেন। তবে ফেব্রুয়ারি-মার্চ-এর আগে নয়।

 গেছেন কোথায়?

উত্তরে।

মানে?

উত্তরে।

তুমি রুদ্রপ্রয়াগ থেকে আসছ?

না।

ওদের সব খবর ভাল?

ওদের মানে?

মানে, চন্দ্রবদনীদের।

কী করে বলব! যাইনি তো।

কোথায় ছিলে এতদিন? আন্দোলন কি এখনও চলছে?

 জানি না।

কেন? তোমার বন্ধু পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার পরেই কি উদাসীন হয়ে গেলে এই ক-সপ্তাহেই।

না, তা নয়। সব আন্দোলনের চালই বিষাক্ত সাপেরই মতন। এঁকেবেঁকে চলে। কখনও দেখা যায়, কখনও বা গহ্বরবাসী হয়ে যায়। তাছাড়া আমাকে ওরা Disown করেছে।

কেন?

হয়তো আমি সমতলবাসী বলেই।

এখন তো তুমি পাহাড়িই।

ওরকমই হয়।

যাকগে এক কথা থেকে অন্য কথাতে এসে গেলাম। আমি আজ বিকেলেই হৃষীকেশ-এ নেমে যাব। তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে চারণদা? তুমি কলকাতাতে ফিরবে না? হাইকোর্ট যে তোমার জন্যে কাঁদছে, কাঁদছে তোমার মক্কেল-বিকেলরাও। তোমার সখের Wanderings কি এখনও শেষ হয়নি? অনেকদিন তো হল সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসী খেলার।

তারপরই বলল, চলুন, তুরতি বাবা, গরম গরম পুরী-হালুয়া আর আলুর তরকারি আর পর পর কয়েক ভাঁড় চা খেয়ে আসি। ভাল শীত পড়েছে আজ।

তুমি তো ন্যাংটো হয়েই আছ প্রায়। তোমার শীত করবে না তো কার করবে? চলল, সকলেই যাই। তবে এই আবহাওয়াতে হৃষীকেশে আজ নাই বা গেলে! রাতটা থেকে, তোমার চারণদাকে নিয়ে নেমে যেও। অধঃপতনে যখন যাবেই তখন তোমাকে ঠেকাবে কে?

তুরতি বললেন।

পাটন হাসল।

বলল, পতন তো চিরকাল অধঃলোকেই হয় তুরতি কাকা। কে আর কবে ঊর্ধ্বলোকেই পড়েছে বলো?

চারণ বলল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুই পুরুষের ডায়ালগ চুরি করলে তো?

 ইয়েস। বলল, পাটন।

.

১৯.

চারণ বাসের জানালার পাশে বসেছিল। ওর পাশে পাটন। ভিতরের দিকে। এখন তীর্থযাত্রীরা থাকলে কী হয়, বাসে ভিড় কিছু কম নেই। সব সিটই ভর্তি। দু-একজন দাঁড়িয়ে আছেন।

তীর্থযাত্রীরা যখন আসেন তখন বাসের সংখ্যা বেড়ে যায় প্রচুর। এই সময়ে বাস কম কিন্তু পথের গাড়োয়াল হিমালয়ের পরতের পর পরতের কোরকে যে স্থানীয় মানুষের অগণ্য বসতি আছে পাহাড়ের গায়ে, মালভূমিতে, উপত্যকাতে, সেই সব বসতির মানুষজনেরাই যাত্রী।

বাসের ভিতরটা গরম। মানুষের গায়ের গরমে গরম, গরম জামার গরম, মাথার টুপির গরমে গরম। তার সঙ্গে বিড়ির এবং চুট্টার গন্ধ।

কারা যে বলেন, বিড়ি খেলে ক্যানসার হয়! যুগযুগান্ত থেকে গরিব ভারতীয়রা বিড়ি খেয়ে আসছেন এমন করেই। আর ক্যানসার ধরা পড়লেই বা কী হয়। ডাক্তারদের পিংপং বল হয়ে এদিক থেকে ওদিকে ঘুরে, সর্বান্ত, ক্লান্ত এবং বিরক্ত হয়ে তারপর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওর সেই বন্ধু বাছুরই মতন কেমোথেরাপির শিকার হয়ে মৃত্যুর আগেই মৃততর হয়ে যায় মানুষে। মৃত্যুর মতন অবিসংবাদী সত্য তো আর কিছুই নেই। প্রত্যেক মানুষের জন্ম-মুহূর্তেই তো মৃত্যু দাঁড়িয়ে থাকে আঁতুড় ঘরের দরজায়, রান্নাঘরের সামনে বেড়ালনির মতন। তবুও মরতে যে মানুষের এত ভয় কেন, কে জানে!

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে একজনকে বলেছিলেন যে, The fear of life increases in direct proportion with the money one possesses. এই জন্যেই বোধহয় অর্থসর্বস্ব বলেই অ্যামেরিকানদের আর মাড়োয়ারিদের এত মৃত্যুভয়! সেদিন ওই কথাই বলছিলেন তুরতি মহারাজ।

গরিবদের অত মৃত্যুভয় নেই।

জানলার কাঁচ দিয়ে বাইরের শীতার্ত সিক্ত পার্বত্য-প্রকৃতির দিকে চেয়ে চারণের রবীন্দ্রনাথের সেই গানটির কথা মনে পড়ল। আজকাল বড় কম শুনতে পায় এই গান।

কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়, জয় অজানার জয়।
 দু দিন দিয়ে ঘেরা ঘরে/তাইতে যদি এতই ধরে
চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শুন্যময়?
জয়! অজানার জয়!

 চারণ ভাবছিল যে ও সত্যি সত্যিই এবারে এই দেবভূমি থেকে বিদায় নিচ্ছে। তুরতির কথাতে বললে বলতে হয় হয়তো অধঃপাতেই যাচ্ছে। কলকাতাতেও ফিরে যাবে দু-একদিনের মধ্যেই। সেই দমবন্ধ কলুষিত নগরে, ঈশ্বরচিন্তাবিহীন খাই-খাই, চাই-চাই-এর জঘন্য প্রতিবেশে। মনটা খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। অথচ ওর আপন জন বলতে কলকাতাতে যেমন কেউই নেই, এখানেও অবশ্য ছিল না।

জিষ্ণু মহারাজের সঙ্গে ফিরে যাবার আগে দেখা হল না। পাটন আসার পর আরও একদিন অপেক্ষা করেছিল। পাটন বাজে কথা বলবে না। চন্দ্রবদনীর সঙ্গে দেখা করে যাওয়া হল না বলেও মনটা খুব খারাপ লাগছে। অথচ তাঁরাও চারণের কেউই নন। আপনজন, প্রকৃতার্থে আপনজন, একজনের জীবনে কজন মানুষই বা হয়ে ওঠেন।

Out of sight out of mind বলে একটা কথা আছে। চন্দ্রবদনী কি তাকে ভুলে যাবে? না কি ইতিমধ্যেই ভুলে গেছে? চন্দ্রবদনীর ভাবনা তাকে প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে রুদ্রপ্রয়াগ ছেড়ে আসার পর থেকেই অথচ তার সঙ্গে তার পরিচিতি কদিনেরই বা! এই সাধু সন্ন্যাসীরা যেমন করে বলেন, পূর্বজন্মে কি কোনও সম্পর্ক ছিল তার সঙ্গে চন্দ্রবদনীর? না কি পরজন্মে হবে? না হলে, মন এত উদ্বেল হয় কী করে!

বাসের মধ্যে চারণের এই বিরাট, স্বরাট, বৈচিত্র্যে ভরা নানা ভাষা, নানা মত নানা পরিধানের ভারতবর্ষের নানা মানুষ কথা কইতে কইতে চলেছে। একটা ঘোর লাগে এমন মাটির কাছের, পর্বতের কাছের, নদীর কাছের দেশজ স্বার্থগন্ধহীন মানুষদের গাঢ় প্রতিবেশে। ইদানীং প্রায়ই চারণের খুব গর্ব হয় ও ভারতীয় বলে। এই গরিমার অনুভূতি হুগলির দ্বিতীয় সেতু বা মেট্রো-রেল দেখে কখনওই হয় না, হত না। এমন সেতু, অগণ্য ফ্লাইওভার বা মেট্রো রেল তো পৃথিবীর সব বড় শহরেই আছে। কিন্তু এইরকম দেবভূমি, হিন্দু এই জিষ্ণু মহারাজ, তুরতি মহারাজ, ধিয়ানগিরি মহারাজ, দেবপ্রয়াগের সন্ন্যাসীরা, তিব্বতী-বৌদ্ধ চন্দ্রবদনীর ঠাকুর্দা, চন্দ্রবদনীর মতো আধুনিকা অথচ বহু হাজার বছর পুরোনো হিন্দুত্ব ও বৌদ্ধত্বে সমাহিত যুবতী, হৃষীকেশ-এর মাত্রীর মতো নিবেদিত প্রাণ যুবতী, রওনাক সিং-এর মতন দার্শনিক কর্মী, পৃথিবীর অন্য কোথাওই আছে বলে জানে না চারণ।

ও আর কিছুদিনের মধ্যেই ভারতদর্শনে বেরোবে। তার স্বদেশ, স্বজনকে জানতে বুঝতে বেরিয়ে পড়বে, কলকাতা ছেড়ে আসমুদ্রহিমাচল-এর উদ্দেশ্যে। ঘুরে ঘুরে দেখবে, মিশবে, জানবে তার এই সুন্দর, বৈচিত্র্যময়, পরস্পরবিরোধী সত্তার দেশ, দেশের সুন্দর সাধারণ ভাল মানুষদের, গ্রামীণ মানুষদের।

পাশে বসা পাটন স্বগতোক্তির মতন হঠাৎই বলল, মানুষটা মহা গোলমেলে আছে।

কে?

ওই তুরতি বাবা।

 কেন? গোলমেলে কেন?

 ওঁর মধ্যে অতি ডেঞ্জারাস এক চৌম্বকত্ব আছে। মানুষটাকে জানার চেষ্টা করেছি অনেক। আমি তো এখানেই প্রথমে উঠেছিলাম স্টেটস থেকে এসে। দেড়বছর ছিলাম জিষ্ণু মহারাজেরই কাছে। সত্যিই মহাপুরুষ। তুরতি বাবার জ্ঞান দেখেই হয়তো তুমি অজ্ঞান হয়ে গেছ। এত স্বল্পপরিচিতদের কাছে স্বমহিমায় স্বল্পদিনে প্রকাশিত হন না জিষ্ণু মহারাজ। অতি সাধারণ হয়ে মেশেন তোমার আমার মতন সাধারণের সঙ্গে। ওঁদের চিনতে হলে, লাথি-ঝাঁটা, সবরকম শীত উপেক্ষা সয়েও ওদের পায়ের কাছে পড়ে থাকতে হয়। জিষ্ণু মহারাজ সম্ভবত কখনই নিজের সস্তা গোলকটি থেকে বাইরে আসেন না। তাঁর জ্ঞান তো নয়, কচ্ছপের গলা। নিজের ইচ্ছাতে বার না করলে কারওরই সাধ্য নেই যে তাকে টেনে বার করেন। এদের দেখে আমার মনে হয়েছে যে, মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি যখন একটা সীমা অতিক্রম করে যায় তখনই সেই মানুষকে সম্ভবত অজ্ঞ বলে মনে হয় আমাদের মতন সাধারণ জ্ঞানহীনদের চোখে। এই জিষ্ণু মহারাজকে, তুরতি বাবাকে দেখেই আমি এ কথা জেনেছি। এই অঞ্চলে কম সাধু সন্ন্যাসীদের তো দেখলাম না। দেবপ্রয়াগের ওঁদের কথাও বলতে হয় অবশ্যই।

তা ঠিক!

 অন্যমনস্ক গলাতে বলল, চারণ। তা

রপর বলল, তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে তুমি প্রথমেই আমাকে এখানে নিয়ে এলে না কেন? দেবপ্রয়াগে নিয়ে গেলে কেন?

পাটন বলল, সাধনমার্গের যেমন বিভিন্ন ধাপ আছে, তেমনই সাধুসঙ্গেরও বিভিন্ন ধাপ আছে। তাই। তাছাড়া দেবপ্রয়াগে না আনলে তো চন্দ্রবদনীর সঙ্গে দেখা হত না। সে যে তোমার প্রেমে, এখানে তোমার খুব কাছে আসার অনেক আগে থাকতেই ডুবে ছিল। আমি কী আর জানিনি। সত্যি! চন্দ্রবদনীর মতন সম্ভ্রান্ত যুবতী দেশে-বিদেশে আমি কোথাওই দেখিনি। সম্ৰান্ততার সংজ্ঞাই যেন ছিল সে। চারণ ভাবছিল, ভালবাসা সোজা কিন্তু একজন আধুনিক মানুষ বা মানুষীর পক্ষে আমি তোমাকে ভালবাসি এই কথাকটি মুখ ফুটে বলা ভারী মুশকিল। গুমোরে জিভ বুঝি ভারী হয়ে থাকে। আগে যদি জানত চারণ।

এই ছিল শব্দটি খট করে কানে লাগল চারণের। কিন্তু এই খটকাটা সম্বন্ধে কিছু জিগ্যেস করার আগেই পাটন বলল, চলো, আমাকেও একবার কলকাতাতে যেতে হবে।

তাই?

হুঁ।

আর এখানে ফিরে আসবে না?

নিশ্চয়ই আসব।

তাহলে যাবে কেন?

মানুষটার সম্পত্তির সব বিলিবন্দোবস্ত করেই ফিরে আসব। দেখি, উইল করে মরল, না intestate মরল? কোথায় কত ইল্লেজিটিমেট ছেলে পয়দা করে গেছে কে জানে।

মানুষটা মানে?

মানে আমার জন্মদাতা সেই বাস্টার্ডটা।

ধাক্কাটা সামলে নিয়ে চারণ বলল, সে সব নেই। থাকলে বুঝতাম তোমার বাবা জীবনকে ভালবাসতেন। তাঁর অর্জিত অর্থ ভোগ করতে জানতেন। ত্যাগ করার চেয়ে ভোগ করা বিন্দুমাত্র কম কঠিন কাজ বলে ভেবো না। নাঃ! আমি তো তাঁকে ভাল করেই জেনেছি। টাকাকে ছাড়া আর কিছুকেই, কারওকেই ভালবাসার ক্ষমতাই ছিল না তোমার বাবার।

তারপরই, হঠাৎ বলল, তাছাড়া উইলের কথা উঠছে কেন? তিনি তো আর দেহ রাখেননি।

হাঃ। এমন করে বলছ যেন সে কোনও মহাপুরুষ। সে তো টেসে গেছে। টেসে গেছে বলেই তো কদিনের জন্যে আমাকে কলকাতাতে যেতে হচ্ছে।

সে কী? কবে?

খবর পেলাম গতরাতে। গেছে বৃহস্পতিবার। লক্ষ্মীর অতবড় উপাসক। যাবার দিনটাতেও দেখেশুনেই গেছে, লক্ষ্মীবারে।

অমন করে কথা বলছ কেন? আফটার অল উনি তো তোমার বাবাই ছিলেন। তাছাড়া, চলেই যখন গেছেন তখন আর রেগে কি করবে বলে? কিন্তু হয়েছিলটা কি?

বড়লোকদের যা হয়।

কি?

আসলে কিছুই হয় না। কিন্তু সব সময়েই মনে হয় কী যেন হয়েছে! কী যেন হয়েছে। কী যেন হল! বুকে একটু মাস পেন হল তো ছুটল ভ্যাবল সেনের কাছে।

তিনি কে? ভ্যাবল সেন?

তিনি এক বিরাট ডাক্তার। বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা না-জানা বাংলাদেশী পেশেন্টদের সঙ্গেও তিনি ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষাতে কথা বলেন না। নিজেই নানারকম হ্যাঁঙ্গ-আপস-এর রোগী বলেই হয়তো। খ্যাঁচা কল স্পেশালিস্ট। তাঁর নার্সিংহোেম-এ একজন রোগীর বেড খালি হলেই তিনি রোগী খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন। আর তাঁর ওখানে বেড শুধু খালি হয় রোগীর পর রোগী টেসে গিয়েই। এই সব ডাক্তারদের যোগ্য পেশেন্ট আমার জন্মদাতার মতো মানুষেরাই। রতনে রতন চেনে। যাই বলল আর তাই বলো, কলকাতার অনেক ডাক্তারেরাই কসাই। নানারকম র‍্যাকেট চালনা করেন তাঁরা। ব্যতিক্রম অবশ্য আছে। নকশাল ছেলেগুলো যে কোথায় গেল? তাদের আবার ফিরে আসা দরকার। অনেক কারণেই দরকার।

তা, কী রোগে তিনি গেলেন আলটিমেটলি?

তা জানি না।

নিজের বাবা কিসে মারা গেলেন তাও জানো না?

বাবা ছিল না সে লোকটা। জন্মদাতা আর বাবা কি এক? অনেক দিন আগে একটা ছোট গল্প পড়েছিলাম কোনও পুজোবার্ষিকীতে। গল্পটার নাম ছিল বাবা হওয়া।

কার লেখা?

অত মনে নেই। গল্পটা মনে আছে। পারলে যোগাড় করে পড়ে দেখো। তুমিও যদি কিছু হতে, মানে আমার মায়ের সঙ্গের অ্যাফেয়ারে, তবে জন্মদাতাই হতে। মদ্দা কুকুর থেকে যাড় সকলেই জন্মদাতা হতে পারে কিন্তু বাবা হওয়া অত সোজা নয়।

চারণ চুপ করে রইল। পাটনের সঙ্গর অভিঘাতও বড় সহজ অভিঘাত নয়। ওর ব্যক্তিত্ব বড়ই ডিস্টার্ব করে, পারটার্ব করে অন্য মানুষকে। বিশেষ করে চারণকে। তুলির সঙ্গে সম্পর্কটার জন্যেই হয়তো

পথপাশের গঙ্গা ঝরঝর শব্দে বয়ে চলেছে। এই দুদিনেই বৃষ্টিপাত (এবং তুষারপাতও অবশ্য হয়েছে ওপরে)। নদীর জলে তোড় বেড়েছে। আধো-অন্ধকার হয়ে আছে চারদিক। যদিও এখন দুপুর। চুপ করেই ছিল চারণ। চুপ যদিও করে ছিল কিন্তু খুব ইচ্ছে করছিল যে, পাটনকে জিগ্যেস করে চন্দ্রবদনীর কোনও খোঁজ সে জানে কি না?

তারপর, সাত-পাঁচ ভেবে বলল, চুকারদের বাড়ি কি গেছিলে শিগগির?

নাঃ।

সংক্ষিপ্ত এবং রুক্ষ উত্তর দিল পাটন।

 চারণ চুপ করেই রইল।

বেশ কিছুক্ষণ পর বাসটা যখন ভিয়াসির কাছাকাছি এসেছে, পাটন বলল, কী শিখলে চারণদা এই কমাসে?

শেখার মত শিখিনি কিছুই। তবে শিখব হয়তো। ফিরে আসি।

আর ফিরেছ। একবার কলকাতার গোলকধাঁধাতে পড়লে কেউ কি আর ফিরে আসতে পারে? আমি লিখে দিতে পারি যে, তুমি পারবে না?

তুমি যদি পারো তবে আমিই বা পারব না কেন? চারণ বলল।

আমি আর তুমি কি এক চারণদা? কেউই কি অন্য কারও মতন এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের মধ্যে? এই তো সৃষ্টিকর্তার বাহাদুরী। তাছাড়া, আমার যা বয়স, এই বয়সে নিজের জন্মদাতার রেখে যাওয়া চার কোটি টাকার সম্পত্তি কি তুমি দান করে দিতে পারতে?

চার কোটি টাকা? নাঃ। হয়তো পারতাম না।

স্বোপার্জিত সম্পত্তি দান করা সহজ কিন্তু পরার্জিত সম্পত্তিতে বড়ই আঠা থাকে। বিনা পরিশ্রমে পায়ের উপরে পা তুলে সারাজীবন মহানন্দে, বিনা-চিন্তাতে কাটানোর লোভ কি সবাই সামলাতে পারে?

পরার্জিত বলছ কেন? তোমার বাবা কি তোমার পর?

 আবার বললে বাবা। বাবা হলে, ভেবে দেখতাম। মানুষটা যে নিছকই জন্মদাতা।

সম্পত্তি মানেই বিপত্তি পাটন। সারাজীবন পয়সাওয়ালা মানুষ নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি বলেই ও কথা জানি। তবে, তুমি যদি এখানে ফিরে আসতে পারো তত আমিও পারব।

দেখা যাবে।

পাটন অবিশ্বাসী গলাতে বলল।

তারপর বলল, বেস্ট অফ লাক। মে গড ব্লেস উ্য টু বী হিজ সার্ভেন্ট।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে পাটন বলল, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল চারণদা। ভেবেছিলাম, কোনও নির্জন স্থানে বসে তোমাকে কথাটা বলব। অন্তত এমন কোনও জায়গাতে, যেখানে আমার তোমার পরিচিত জন কেউ নেই। সেই জন্যেই তো তোমাকে চন্দ্রবদনীর মন্দিরের কাস্তে ঐ প্রস্তরাশ্রয় থেকে নামিয়ে চায়ের দোকানে নিয়ে আসছিলাম। তা, তুরতিবাবা পিছু নিল। তবে আমি বলি আর নাই বলি তুরতি বাবা সবই বুঝেছেন।

কি? কি বুঝেছেন?

হঠাৎ মনের মধ্যে কু ডাকছিল চারণের। বুকের মধ্যেখানটাতে কে যেন চেপে বসল। একেবারেই চুপ করে গেল চারণ।

পাটন বলল, এই ভিড়ের মধ্যে নির্জনতা না থাকলেও, আড়াল থাকে, প্রাইভেসি থাকে একধরনের, এর মধ্যেও যে কথা বলার, তা বলা যায়।

কথাটা বলোই না। চারণ অধৈর্য গলাতে বলল।

কথাটা, পরে বললেও চলবে। হৃষীকেশের ঘাটে ধুনির পাশে বসেও বলতে পারি। তুমি অধৈর্য হলে কি হবে? যে কথাটা বলব, তার নিজের তত তাড়া নেই কোনও।

মানে? কেন?

সে যে অতীত কাল হয়ে গেছে। পাস্ট-টেন্স-এর তাড়া থাকে না কখনই। তাড়া থাকে, শুধু বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এরই।

চারণ বিরক্ত হয়ে চুপ করে রইল জানালার দিকে চেয়ে। এত কথা যেন ভাল লাগছিল না ওর।

 পাটন বলল, তুমি চুকারের বাড়ির খবরের খোঁজ করছিলে না?

 হুঁ। হুঁ-টা স্বগতোক্তির মতন শোনাল চারণের নিজেরই কানে।

 আসলে চন্দ্রবদনীর খোঁজ করছিলে তো?

 হুঁ। ভনিতা না করেই চারণ বলল, পাটনের দিকে মুখ ফিরিয়ে।

গতকাল ভোর পাঁচটাতে চন্দ্রবদনী চলে গেছে তার প্রিয় ভাই চুকারের কাছে।

বোমা ফাটানোরই মতন খবরটা ফাটাল পাটন চারণের কানের কাছে।

স্তব্ধ হয়ে গেল চারণ কথাটা শুনে। বাসের মধ্যের অত মানুষের নানা উঁচু-নিচু গ্রামে বলা কথাবার্তাও যেন ওর কানের মধ্যে ফ্রিজ করে গেল। চলমান বাসে বসে চারণ সেদিন শেষরাতে দেখা স্বপ্নটিকে মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। ফেড-আউট হয়ে যাওয়া চন্দ্রবদনীকে স্মৃতির ফ্রেমে আবারও ধরার চেষ্টা করতে লাগল খুবই। কিন্তু পারল না।

জিষ্ণু মহারাজ পৌঁছেছিলেন তার আগের রাতে। ওঁকে চুকারদের বাড়ির কেউই চিনতেন না। আমিই একমাত্র চিনলাম। গেছিলেন কিন্তু মাত্র ঘণ্টাখানেক ছিলেন। ওই ঠাণ্ডাতে বাইরে বসে নানা গান গাইলেন। তারপর চন্দ্রবদনীকে একবার দেখতে চাইলেন। আমিই ওর দাদুর অনুমতি নিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম ঘরে। জিষ্ণু মহারাজ চন্দ্রবদনীর কপালে হাত ছোঁয়ালেন। ফিরে যাবার সময়ে ওর ঠাকুর্দাকে ডেকে বাইরে দাঁড়িয়ে কী সব কথাবার্তা বললেন।

উনি চলে গেলে, চন্দ্রবদনীর ঠাকুর্দা ফিরে এসে উপাসনাতে বসলেন। আমি ঠাকুর্দার কথা মতন ভোরে উঠে প্রথম বাস ধরে বুয়াজিকে খবর দিয়ে নিয়ে আসার জন্যে যখন বেরবো রুদ্রপ্রয়াগ বাজারের দিকে ঠিক তখনই চন্দ্রবদনী চলে গেল। তোমাকে কী বলব চারণদা, যাবার আগে আমার হাতটা এমন করে দুহাতের পাতাতে আঁকড়ে ধরল। মনে হল, ও যেন খুবই ভয় পেয়েছে। বিশ্বাস করবে কি না জানি না তুমি, একবার তোমার নামোচ্চারণও করল। অস্ফুটে। তারপরেই মাথাটা বালিশে ঢলে পড়ল।

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে, গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে চারণ বলল, কী হয়েছিল?

জ্বর। অল্প জ্বর। কিন্তু খুবই মাথাব্যথা ছিল। আমি বদ্রীবিশাল থেকে যেদিন রুদ্রপ্রয়াগে ফিরি, ফিরেই ওদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে শুনলাম যে, গত তিনদিন ধরেই জ্বর। তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না, ওখানেই চুকারের মৃত্যু সংবাদের কথা জানি। যদিও যাবার আগে জানতাম যে, অমন অঘটন ঘটতে পারে।

বদ্রীবিশালেও খবরটা পাওনি?

না। আমার প্রতিবেশে শুধু ঈশ্বর আর তাঁর সেবকদেরই বাস। রাজনীতি অর্থনীতির সেবকদের কোনও প্রভাব পড়ে না আমার উপরে।

ডাক্তার দেখায় নি?

দেখিয়েছিল বইকি। মিলিটারি হাসপাতাল থেকে ডাক্তার এসে দেখে গেছিলেন। বললেন, ভাইরাল ফিভার। ভোগ আছে দিন সাতেক। জ্বর বাড়লে কি কি ওষুধ দিতে হবে তাও বলে গেলেন। আর বলে গেলেন, চিন্তার কিছু নেই। তারপর রাত আটটাতে আমরা যখন খেতে বসেছি তখনই হঠাৎ ছটফটানি শুরু হল। আয়া এসে আমাদের খবর দিল।

পাটন চুপ করে রইল অনেকক্ষণ। বাসটা ভিয়াসি পেরিয়ে গেল। একটু পরেই হৃষীকেশে পৌঁছবে। দিনের বেলাতেই অন্ধকার নেমেছে তখন চারদিকে।

চারণ বলল, হাসপাতালে নিয়ে গেলে না কেন?

যখন জিষ্ণু মহারাজ এসে পৌঁছলেন অপরিচিত ওঁদের কাছে তখনই বুঝেছিলাম যে সময় হয়েছে। যাকে উপরওয়ালা ডাকেন, তাকে আটকাবে কোন নীচওয়ালা। জন্ম-মৃত্যু সবই প্রি-ডেস্টিনড চারণদা।

পাটনের মতন অল্পবয়সী যুবকের মনে এসব কথা অল্পবয়সী কমুনিস্টের মুখের গালভারী তত্ত্ব আউড়ানোর মতন মনে হল। দুইই পরম পাকামি।

মুখে কিছুই না বলে চুপ করেই ছিল ও।

একসময়ে চারণ বলল, দাহ কোথায় করলে?

সবাই যেখানে করে। হিন্দুরা। ওঁর ঠাকুর্দা তাঁর ধর্ম জোর করে চাপাননি কারো উপরেই। অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর সঙ্গমের কাছে দাহ করা হল। একটা চাঁপারঙা বেনারসী পরেছিল আর কী সুন্দর করে যে সাজিয়ে দিয়েছিল ওকে প্রতিবেশীরা, কী বলব চারণদা তোমাকে। যেন বিয়ের সাজ পরেছিল সে।

চারণ ভাবছিল, স্বর্গ থেকে নেমে এসেছিল বুঝি দেবী চন্দ্রবদনী, যেন রক্তমাংসের চেহারা নিয়ে তার ভোরের স্বপ্নে। আবার স্বপ্নেরই মধ্যেই স্বর্গে চলে গেল সে। বড় কষ্ট পেয়ে গেল অত ছোট্ট জীবনে। মা, স্বামী, ভাই একে একে সবাই ছেড়ে চলে গেল। এক-এক জনের যাওয়াটা এক-একরকম যদিও। তারপর নিজেও গেল। কষ্ট কি সত্যিই পেল? না কি সুখ? সেই সুখ-অসুখের স্বরূপ চারণ জানে না। তাই এমন ভাবছে। কে জানে!

ভাবছিল, কুঞ্জাপুরীর মন্দিরে কুঁবারসিংজীর সঙ্গে দেখা না হলে তো চন্দ্রবদনীর মন্দির এবং শৃঙ্গর কথা ও জানতেও পেত না। হৃষীকেশে ভীমগিরি মহারাজ এবং কৃষ্ণার কাছ থেকে মানুষী চন্দ্রবদনীর কথা শোনার পর থেকেই তাকে সশরীরে দেখার এক তীব্র বাসনা জন্মেছিল চারণের মধ্যে। তারই পরিণতি দেবপ্রয়াগে গঙ্গা আর অলকানন্দার শারীরিক মিলনেরই মতন তাদের মনোমিলন।

তার কিছুদিন পরেই তো মাত্র দুটি দিন এবং একটি রাতের সান্নিধ্য। তারই মধ্যে, মনের মধ্যে, শুধু কি তারই একার মনের মধ্যে? হয়তো চন্দ্রবদনীর মনের মধ্যেও কত কী নিঃশব্দ বিস্ফোরণ ঘটে গেল।

একজন মানুষ যখন অন্য মানুষের মনের খুব কাছে আসে তখন নিঃশব্দেই আসে। ঘোড়ার গাড়িতে জরির পোশাকে সেজে, গ্যাসের বাতি জ্বেলে, ড্রাম বাজিয়ে সেই আসা ঘোষিত হয় না। শিউলি ফুল ঝরে পড়ার মতন নিঃশব্দে মন ঝরে অন্য মনের মধ্যে। বড় আশ্চর্য এই মনের জগৎ। গোপনে এবং নিঃশব্দে এর যাওয়া আসা!

কত কীই না কল্পনা করেছিল চারণ চন্দ্রবদনীকে ঘিরে, মনে মনে। স্বপ্নের পোলাউ রাঁধতে বসে ঘি ঢালতে কষী করেনি কিছুমাত্র। কী ভেবেছিল! আর কী হল।

Man proposes God disposes! এই জন্যেই বলে!

 প্রিয়জন চলে গেলে তখনই মনে প্রশ্ন জাগে, পরজন্ম আছে কি নেই? যে গেল, সে কোথায় গেল? আত্মা বলে কি সত্যিই কিছু আছে? সত্যিই আছে কি স্বর্গ বা নরক? বেহেস্ত বা দোজখ? তুরতি বাবা একদিন বলেছিলেন, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদুর। সুরের গবাক্ষও কি আছে? জিষ্ণু মহারাজ বলেছিলেন। ও কি সত্যিই সব ছেড়ে দিয়ে গান গাইবে?

আমি জানি, তোমার মনে এখন কি হচ্ছে চারণদা। তুমি যে তাকে ভালবেসেছিলে। তুমি আমার মা, তুলিকেও ভালবেসেছিলে। সেটা কোনও বড় কথা নয়। অনেকেই অনেককে ভালবাসে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা এই যে, চন্দ্রবদনীও তোমাকে আমার মায়েরই মতন ভালবেসেছিল। কথাটা বোধহয় ঠিক বললাম না। কারও ভালবাসাই অন্য কারও ভালবাসার মতন নয়। প্রত্যেকটি ভালবাসার রকমই আলাদা। অথচ কত সামান্য তোমাদের দুজনের পরিচয়।

একটু চুপ করে থেকে বলল পাটন, তোমার নাম যখন যাবার আগে অফুটে উচ্চারণ করল ও, তখন আমি কিন্তু অবাক হইনি একটুও। তোমাদের দুজনের সঙ্গে দুজনের প্রথম দেখা হওয়ার দিনই সে কথা বুঝতে পেরেছিলাম। পচাগলা মৃতদেহের গন্ধ যেমন লুকোনো যায় না, তেমন ভালবাসার গন্ধও নয়। প্রকাশ হয়ে পড়েই! তারপর পাটন বলল, মুখে তোমাকে বললাম বটে যে, তুমি এখানে আর ফিরে আসবে না, মানে আসতে পারবে না, কিন্তু মানুষী চন্দ্রবদনীকেও ভালবেসেছিলে বলেই হয়তো দেবী চন্দ্রবদনীর কাছে তোমাকে বারেবারেই ফিরে আসতে হবে। এলে তো ভালই। কলকাতাতে তুমি আমার মতন মানুষ, চ্যাংড়া-ছৈাড়া অনেকই পাবে কিংবা আমার জন্মদাতার মতন সাকসেসফুল মানুষ, কেলকাটা ক্লাবের মেম্বারও। আমার অশিক্ষিত জন্মদাতা ক্যালকাটা উচ্চারণ করতে পারত না, বলত কেলকাটা। অনেকই পাবে কিন্তু এই তুরতি বাবার মতন ছুপা-পণ্ডিত, জিষ্ণু মহারাজের মত সন্ত কোথায় পাবে?

তারপর বলল, এখানে এসে চিরদিন থাকতে বলছি না তোক। সংসারে থেকে সন্ন্যাসী হও। যদি তা হতে পারো তাহলে তো কথাই নেই। আর যদি না পারো, তবে বছরে অন্তত একবার করে এসো। চন্দ্রবদনী যে তোমাকে ভালবেসেছিল। সে তো যেমন তেমন মেয়ে নয়। তার স্মৃতি মনে রেখেই না হয় এসো।

চারণ পাটনকে মুখে কিছুই বলল না। ভাবছিল, ওকে যে মেয়েই ভালবাসে, তুলিরই মতন, সেই মরে যায়। সে কি অভিশপ্ত? তারপরই মনে হল ওর, চন্দ্রবদনী তো মানুষী ছিল না। দেবীরাও কি মানুষীর রূপ ধরে সত্যি সত্যিই আসেন এখানে? মানুষী আর দেবী কি একই মানুষকে ভালবাসতে পারেন?

বাসটা আর কিছুক্ষণ পরেই হৃষীকেশে পৌঁছে যাবে। বাস থেকে নেমেই ঘাটে যাবে একবার। ত্রিবেণী ঘাট, বাসটা ভিয়াসির কাছে আসার পর থেকেই ডাকছে তাকে।

কিন্তু কার কাছে যাবে ঘাটে? ধিয়ানগিরি মহারাজ তো চলেই গেছেন। ভীমগিরি মহারাজের সঙ্গে দেখা হবে কি না তাও বা কে বলতে পারে? তিনিও হয়তো নেই। অথবা অন্যত্র চলে গেছেন। মাত্রীর সঙ্গে কি দেখা হবে? এই অন্ধকার দুর্যোগের দিন এখুনি মিশে যাবে হয়তো অন্ধকার রাতের সঙ্গে। তবুও দু-একজন পুণ্যার্থী নিশ্চয়ই প্রিয়জনের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষাতে তাড় পাতার দোনাতে বসিয়ে প্রদীপ ভাসাবে পুণ্যতোয়া গঙ্গার জলে।

ভাবছিল চারণ, যে বেনারসের দশাশ্বমেধঘাটে, হৃষীকেশের ত্রিবেণী ঘাটে কত শত মানুষকেই না এমন করে প্রদীপ ভাসাতে দেখেছে। চারণের প্রিয়জন বলতে তেমন কেউই ছিল না, যার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় সে প্রদীপ ভাসায়। আজও নেই। কিন্তু তবুও মনে মনে ঠিক করল যে, আজকে চন্দ্রবদনীর আত্মার মঙ্গলকামনাতেই প্রদীপ ভাসাবে চারণ একটি। মন্দিরে মন্দিরে ঘণ্টাধ্বনি হবে। ভজন শোনা যাবে তিনদিক থেকে। ধূপ, ধুনোর গন্ধ উঠবে। আর ফুলের গন্ধ। ত্রিবেণীঘাটের শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ভগীরথ-আনীত এই গঙ্গার হিমশীতল জলে পা ডুবিয়ে চারণ নিচু হয়ে প্রদীপ জ্বলা দোনাটি ফুল-সাজিয়ে ভাসিয়ে দেবে। পাটনকে বলবে, তার চলে যাওয়া মা তুলির আত্মার উদ্দেশ্যেও একটি প্রদীপ ভাসাতে।

তখন অদৃশ্য থেকে ধিয়ানগিরি মহারাজের গাওয়া গান ভেসে আসবে। আর তাঁর বর্ণিত কালান্দার এই পৃথিবীকে বাঁদরের মতন নাচিয়ে বেড়াবেন। সেই নাচ দেখার ক্ষমতা কোনও নশ্বরেরই নেই। স্বর ঈশ্বর, তাল ব্ৰহ্ম আর লয় কি? লয়? জিগ্যেস করা হয়নি ধিয়ানগিরি মহারাজকে।

দেখতে দেখতে পৌঁছে গেল বাস হৃষীকেশের বাজারে। আজ বাজার জনবিরল। বাস থেকে নেমে সত্যি সত্যিই ত্রিবেণীঘাটের দিকে পাটনের পাশে পাশে পায়ে হেঁটে প্রায় জনহীন পথে যেতে যেতে চারণ ভাবছিল, উদ্ধত সবজান্তা, সচ্ছল এবং হয়তো সামান্য দাম্ভিক যে ব্যারিস্টারটি আজ থেকে কয়েক মাস আগে হৃষীকেশের এই ত্রিবেণীঘাটে প্রথমবার এসে দাঁড়িয়েছিল কাড়োয়া চওথ-এর আলোকোজ্জ্বল সন্ধেতে, তার সঙ্গে আজকের এই মানুষটির, অনেকই পার্থক্য রচিত হয়ে গেছে।

সেদিন সে হুকুম দেনেওয়ালা ছিল। আজ সে হুকুম-পালনকারী হয়েছে। চাপরাশী হয়েছে।

বহুদিন আগেই জবাহরলাল নেহরুর The Discovery of India পড়েছিল কিন্তু আজ চারণের মনে হচ্ছে, ও ওর এই শাশ্বত, মহান, হিন্দুপ্রধান অথচ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষকে পুনরাবিষ্কার করেছে। ধর্ম কাকে বলে? পূজা-পার্বণের মাহাত্ম্য কি? তার নিজের মা বাবার যে ধর্ম, সেই ধর্মাবলম্বী বলে পরিচয় দিতে লজ্জিত বা কুণ্ঠিত হওয়া যে নীচতাই শুধু নয়, কাপুরুষতাও, তা সে আজ হৃদয়ে বুঝেছে।

A. L. Basham সাহেব যেমন করে ভারতবর্ষকে আবিষ্কার করে তাঁর অসামান্য গ্রন্থটি লিখেছিলেন, The Wonder, That was India এই ক-মাস উদ্দেশ্যহীনভাবে এই দেবভূমিতে ঘুরে বেড়ানোতে তার ভিতরেও যেন তেমন এক নতুন বোধের জন্ম হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই দেশের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে সে নতুন করে অবহিত হয়েছে।

আরও বহুবার এই দেবভূমিতে এসে, আরও অনেক জানাশোনার পরে, নির্জনে অনেক একা ভাবনাচিন্তার পরে ও হয়তো কোনওদিন তার আবিষ্কারকে তার দেশবাসীর সামনে আনতে পারবে। নেহরু সাহেবের মতন, ব্যাশাম সাহেবের মতনই। তবে সময় লাগবে। অনেকই সময়। সেও লেখক হবে। একদিন। সময়কে তার প্রাপ্য সময় তো দিতে হবেই।

নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতে এ জীবনে চারণ আর কখনওই লজ্জিত হবে না। যার ধর্ম নেই সে তো মনুষ্যেতর জীব। ধর্ম হি তেষাম অধিকোবিশোষোর,/ধর্মে না হীণা পশুভিসমানাঃ।

বাস থেকে নেমে, পাটনের সঙ্গে পায়ে পায়ে হেঁটে একসময়ে ত্রিবেণীঘাটে এসে দাঁড়াল। কালিকমলিওয়ালার আশ্রমের দিক থেকে নারী কন্ঠে কে যেন ভজন পাইছিলেন মীরাবাঈ-এর ম্যায়নে চাকর রাখখো, চাকর রাখখো, চাকর রাখখো জি। জিষ্ণু মহারাজের কথা মনে পড়ে গেল চারণের।

তাড়পাতার দোনাতে বসানো ওদের দুজনের প্রদীপ সেই অন্ধকার দুর্যোগময় রাতে গঙ্গার বুক বেয়ে টলতে টলতে ক্রমশ দুরে চলে যেতে লাগল অন্ধকারতর দিগন্তের দিকে। তারপরে একসময়ে হারিয়েও গেল। যেমন, সব প্রদীপই হারায়।

হঠাৎই চারণের বুকটা পাথরের মতন ভারী হয়ে এল। তারপর অব্যক্ত যন্ত্রণার মতন চ-ন্দ্র-ব-দ-নী এই পাঁচটি অক্ষর তার বুক ঠেলে বেরিয়ে এল। এবং পরক্ষণেই বড় হালকা লাগতে লাগল ওর। কে যেন পাশ থেকে ওর কানের পাশে চন্দ্রবদনীরই গলাতে বলে উঠল,

প্রেমের আনন্দ থাকে শুধু স্বল্পক্ষণ
প্রেমের বেদনা থাকে সমস্ত জীবন।

পাশে তাকিয়ে দেখল, একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে, ঘাঘরা পরা, নাকে পেতলের নোলক, মাথায়। ঘোমটা দেওয়া, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার মায়ের প্রদীপ ভাসানো দেখছে।

পাটন বলল, চলো চারণদা।

 সিঁড়ি চড়তে লাগল ওরা দুজনে।

পাটন বলল, তুমি কি কাল আমার সঙ্গেই যাবে?

হ্যাঁ। দিল্লি অবধি। একটি গাড়ি নিয়ে যাব সোজা এয়ারপোর্ট। ক্রেডিট কার্ড সঙ্গে আছে। তুমিও আমার সঙ্গে চল পাটন।

পাটন বলল, পরের বারে যদি আসো এখানে, তবে আর ক্রেডিট কার্ড-টার্ড এনো না। এ এন জেড, গ্রিন্ডলেজ, সিটি ব্যাঙ্ক, ডাইনার্স সিলভার কার্ড, গোল্ডকার্ড। এখানে অন্য ক্রেডিট-এর দরকার। ব্যাঙ্ক ব্যালান্স-এর নয়। ওই সবরকম ক্রেডিটই এখানে ডিসক্রেডিট।

ঠিকই বলেছ। ফেলেই দেব গিয়ে।

কয়েকটা সিঁড়ি উঠে, পাটন দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, কিছু কি পেলে এখানে এসে চারণদা? শিখলে কি কিছু?

নিশ্চয়ই। সিঁড়ি উঠতে উঠতে বলল, চারণ।

কি?

তোমাকে পেলাম, এই পাটনকে। পেলাম, চন্দ্রবদনীকে, আর শিখলাম চাপরাশ শব্দটির মানে। এই বা কম পাওয়া কি? কম শেখা কি?

তারপর একটু ভেবে বলল, বড় এক আনন্দমিশ্রিত দুঃখ বুকে করে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি পাটন। কত কী জানলাম, কত মানুষকে চিনলাম কাছ থেকে, মানুষের মতন সব মানুষ। এত অল্প দিনে এ কী কম পাওয়া! আবারও আসব আমি। বারে বারেই আসব।

দ্যাখো, দ্যাখো, বলে, তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাটন আকাশের দিকে আঙুল তুলে দেখাল।

 আশ্চর্য! এই অন্ধকার আর দুর্যোগের রাতেও জ্বলজ্বল করছে একটি তারা। দিগন্তে। সন্ধ্যাতারা কি?

 তীব্র, স্নিগ্ধ দ্যুতিতে দীপিত জ্বলজ্বল করছে তারাটি।

তাকিয়ে রইল চারণ সেই দিকে অনেকক্ষণ। একটি দীর্ঘশ্বাস উঠল তার বুকের ভিতর থেকে।

অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর সঙ্গমে দাহ করা চন্দ্রবদনীর শরীরের ভস্ম কি এখনও ভেসে চলেছে এই পতিতপাবনী গঙ্গা দিয়ে? সেই তারাটির ছায়াটি কি কাঁপছে নির্জন নদীর সুদুর জলেও? পরক্ষণেই হঠাৎই চারণের মনে হল যে, ওই তারাটি চেয়ে আছে তার আর চন্দ্রবদনীর অপূর্ণ সব ইচ্ছেগুলিরই দিকে।

ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি! একজন সাধু বললেন পাশ থেকে, জল ছিটোতে ছিটোতে।

 চারণের মনে পড়ল, এই দেবভূমিতে এসে ও এই ত্রিবেণীঘাটেই প্রথম সন্ধেতে দাঁড়িয়ে ছিল। কাড়োয়া চওথ ছিল সেদিন। দেওয়ালির আগের কৃষ্ণা-চতুর্থী। কত সুন্দরী সুবেশা সালংকার সব নারীরা তাঁদের স্বামীদের মঙ্গলকামনা করে প্রদীপ ভাসাচ্ছিলেন জলে। আর আজ চারণ সেই দেবভূমি ছেড়ে চলে যাবার আগের সন্ধের এই ঘোর ক্রন্দনরতা বিধুর প্রকৃতির মধ্যে সেই ঘাটেই দাঁড়িয়ে আছে। তার জীবনের একটি বিশেষ পর্বের পবিত্র ফুল ও ধূপ-গন্ধময় এই গানখানি যেন সম-এ এসে দাঁড়াল, অয়ন সম্পূর্ণ করে। সেই ত্রিবেণীঘাটেই।

একটু আগেই যখন ঘাটে নেমে এসেছিল তখন চন্দ্রবদনীর কারণে মনটা বড়ই বিষাদমত হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য। এখন ঘাটের চাতাল বেয়ে ফিরে যাবার সময়ে এক ব্যাখ্যাহীন আনন্দে ওর মন ভরে উঠল কানায় কানায়। চারণের দুটি চোখ আনন্দ ও বেদনার এক অভূতপূর্ব, অভাবনীয় মিশ্রণে জলে ভরে উঠল। একটি একটি করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে, ও নিরুচ্চারে গাইতে লাগল সেই গানটি, যে গানটি সে বহু বছর আগে কুমায়ুঁ পাহাড়ের আলমোড়ার এক আশ্রমে অন্ধ গায়ক সদুনবাবুর গলাতে শুনেছিল আর যার ভুলে-যাওয়া বাণী পূরিত করেছিলেন ধিয়ানগিরি মহারাজ এই ত্রিবেণী ঘাটেই, এক রাতে।

খোঁজে খোঁজে তুমহে কনহাইয়া
মুঝে নায়না ধারে।
মোরে মন্দির অবল্যে নেহি আয়ে
কওনসি ভুলভঁয়ি মেয়ো আলি।
প্রেম পিয়া বিনা আঁখিয়া তরস রহি
উনবিনে জিয়া ভরমায়ে।
খোঁজে খোঁজে তুমহে কনহাইয়া
মুঝে নায়না ধারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *