কিন্তু সোমনাথের ভাগ্যটা নিতান্তই পোড়া। নতুন কেমিক্যালসের নমুনা এবং চিঠিপত্তর নিয়ে কাছাকাছি চার-পাঁচ জায়গায় দেখা করলো সোমনাথ। সবাই টেলিফোন নম্বর পর্যন্ত লিখে নিলো। সোমনাথ প্রতিদিন সেনাপতির কাছে জানতে চায় কোনো ফোন এসেছিল কিনা। সেনাপতি বলে, কোথায় আপনার ফোন
ফোন আসে অনেক। কিন্তু সবই সুধাকর শর্মার। সুধাকর শর্মা কাজের চাপে হিমসিম খেয়ে যান।
অত কাজের মধ্যেও বিকেলের দিকে যার সঙ্গে টেলিফোনে সুধাকরবাবু কথা বলেন তাঁর নাম নটবর মিত্তির।
কয়েকবার নটবরবাবুকে দেখেছে সোমনাথ। সুধাকর শর্মা ওঁকে সঙ্গে নিয়ে আড়ালে চলে যান। দুজনেকী সব গোপন কথাবাত হয়।
এই বন্ধুহীন জগতে এখন আদকবাবুই একমাত্র সোমনাথের ভরসা। বিশুবাবু যে কোথায় উধাও হয়েছেন কেউ জানে না! সেনাপতির ধারণা, তিনি এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে বিজনেস-কামপ্লেজার ট্রিপে বেরিয়েছেন—গাড়িতে বিহার এবং উড়িষ্যা ঘুরবেন। বিশুবাবু থাকলে দুএকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা যেতো।
আদকবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কী ভাবছেন অতো, মিস্টার ব্যানার্জি।”
সোমনাথ বললো, “আপনি যদি না হাসেন, তাহলে একটা প্রশ্ন করি।”
“বলুন।” আদকবাবু সম্মতি দিলেন।
“আচ্ছা, একই ঘরে এতোগুলো লোক হাত গুটিয়ে চুপচাপ বসে আছে, অথচ সুধাকর, বাবুর এতো কাজ কী করে হয়?”
হাসলেন আদকবাবু। তারপর বললেন, “কেন মিছে কথা বলবো? শ্রম। এই দুনিয়াতে কপালটা বিধাতাপুরুষ দেন—কিন্তু শ্রম পরষে মানুষের নিজস্ব।”
সেই সময় যে নটবরবাবু ওখানে এসে পড়েছেন কেউ লক্ষ্য করেনি। নটবরবাবুর সঙ্গে আদকবাবুর পরিচয় আছে। নটবরবাবুর গোলগাল চেহারা। বুশ শার্টের তলায় পাঁচ নম্বর ফুটবলের মতো একটি ভুঁড়ি রয়েছে। মাথার মধ্যিখানে তিন ইঞ্চি ব্যাসের গোল টাক পড়েছে। ওখানকার ক্ষতিপূরণ হয়েছে অন্যত্র। দুই কানে বেশ কিছু বাড়তি চুল ভদ্রলোকের।
নটবরবাবু হুঙ্কার ছাড়লেন, “কী বললেন? ডাহা ভুল। ওসব ওয়ান্স-আপন-এ-টাইমের কথা বলে কেন এই ইয়ং ম্যানের টুয়েলভ-ও-ক্লক বাজাচ্ছেন? ‘শ্রম’ দিয়ে যদি কিছু হতো তাহলে কুলি এবং রিকশাওয়ালারাই কলকাতার সবচেয়ে বড়লোক হতো।”
সোমনাথ অবাক হয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকালো। নটবর বললেন, “বিজনেসের একমাত্র কথা হলো পি-আর।”
“সেটা আবার কী জিনিস?” আদকবাবু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
নটবর একগাল হেসে বললেন, “পাবলিক রিলেশন অর্থাৎ জনসংযোগ।”
সোমনাথ এখনও বোকার মতো তাকিয়ে আছে। নটবরবাবু বললেন, “এখনও বুঝতে পারলেন না? যেসব ক্ষমতাবান লোক আপনার কাছে মাল কিনবেন তাঁদের সঙ্গে আপনার সংযোগটা কি রকম তার ওপর নির্ভর করছে।”
সোমনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে অধৈর্য নটবর বললেন, “এখনও বুঝতে পারছেন না। অন্য জাতের ছেলেরা তো পেট থেকে পড়বার আগেই এই সব জেনে ফেলে!”
সুধাকরজী এখনও আসেননি। ওঁর টেবিলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নটবর মিত্তির বললেন, “এই শর্মাজীকেই দেখুন না কেন। মাল খারাপ, ওজন কম, দাম বেশি। তবু শর্মাজী পটাপট অর্ডার পাচ্ছেন এই জনসংযোগের জোরে। আর আপনি ঐ সব কোম্পানিতেই কম দামে ভালো মাল অফার করনে। এক আউন্স কেমিক্যাল বিক্রি করতে পারবেন না। যদি-বা বিক্রি করতে পারেন পেমেন্ট কিছুতেই পাবেন না। আট মাস ন’ মাস পরে পয়সার অভাকে আপনি ব্যবসা ড়ুকে তুলে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে যাবেন। অথচ ঠিক মতো জনসংযোগ করুন……”
কথায় বাধা পড়লো। সুধাকরজী এসে পড়লেন। নটবর মিত্তির বললেন, “ওঁর সঙ্গে জরুরী কথাবার্তা আছে। যদি এ-সব ব্যাপার শিখতে চান আসবেন এই গরীবের কাছে। এই বলে নিজের একখানা ভিজিটিং কার্ড সোমনাথের হাতে গড়ে দিয়ে নটবর মিটার সামনের টেবিলে চলে গেলেন। দু’ মিনিটের মধ্যে ওঁরা দুজনে আবার বেরিয়ে পড়লেন।
আদকবাবু এতোক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার বিরক্তভাবে বললেন, “লোকটা যেন কেমন ধরনের! সুধাকরবাবুর সঙ্গে গলায়-গলায়। আমার কিন্তু মোটেই ভালো লাগে না ওঁকে।”
কয়েক দিন পরে নটবর মিত্তিরের সঙ্গে রবীন্দ্র-সরণির ওপরেই দেখা হয়ে গেলো সোমনাথের। “ও মিস্টার ব্যানার্জি, শুনুন, শুনুন,” নটবর মিত্তির সোমনাথকে ডাকলেন।
সোমনাথ নমস্কার করলো নটবরকে। মিস্টার মিটার জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন হচ্ছে বিজনেস?”
সোমনাথ কিছু চেপে রাখলো না। বললো, “কয়েকটা কাপড়ের কল এবং কাগজের কলে পারচেজ অফিসারদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করছি। ভালো দু-একটা কেমিক্যালস আছে।’
“কিছু হচ্ছে?” মিস্টার মিটার একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন।
“চেষ্টা করছি।” সোমনাথ বললো।
এবার হা-হা করে হেসে উঠলেন নটবর মিটার। “ওই চেষ্টাই করে যাবেন। আর আপনার নাকের ডগায় অর্ডার নিয়ে যাবে সুধাকর কোম্পানি?”
পকেট থেকে কৌটা বার করে নস্যি নিলেন নটবর মিটার। “আপনি সন অফ দি সয়েল তাই বলছি। না-হলে আমার কী? আপনি হোল লাইফ ধরে ভেরেণ্ডা ফ্রাই করুন না, আমার কিছু এসে যাবে না। শুনুন মশাই, সোজা কথা—বড় বড় কোম্পানিরা আপনার কাছে মাল কিনবে না। তারা নামকরা কোম্পানির ঘর থেকে ডাইরেক্ট মাল নেবে! বিলিতী কোম্পানির কেমিক্যাল ছেড়ে তারা আপনার ওই মাওজী কোম্পানির মাল টাচ করবে না। ঠিক কিনা?”
সোমনাথকে একমত হতে হলো। নটবর মিটার বললেন, “তাহলে আপনাকে যেতে হবে মাঝারি এবং ছোট-ছোট কোম্পানিতে। ঠিক কিনা?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ,” সোমনাথ বললো।
নটবর মিটার মিটমিট করে হেসে বললেন, “ছোট-খাট কোম্পানিগুলো সব এখন ইন্ডিয়ানদের হাতে। গে’ড়াকলের সুবিধার জন্যে মালিকরা নিজেদের ভাইপো-ভাগে এবং গাঁয়ের লোকেদের এনে পারচেজ অফিসে বসিয়ে দিয়েছে। তারা মালিকদের সুবিধে দেখছে এবং সেই সঙ্গে নিজেদের সুবিধেও করছে।”
সোমনাথ চুপ করে আছে। নটবর মিটার বললেন, “সুতরাং আপনাকে বশীকরুণ মরটা আগে জানতে হবে, যেমন জানেন সুধাকরজী। আর না জানলে আমাদের মতো পাবলিক রিলেশন কলসালটেন্টদের কাছ থেকে শিখে নিতে হবে।”
নটবর মিটার বললেন, “ট্যাক্সি পাচ্ছি না বলেই আপনার এইভাবে সময় নষ্ট করতে পারছি। না হলে, আজ এ জনসংযোগ উপদেষ্টা আমি ভীষণ ব্যস্ত। অর্ডার সাপ্লাই লাইনে যারা পাকা লোক তারা জানে নটবর মিটারের দাম।”
নটবর মিটার আবার নস্যি নিলেন। বললেন, “যাকগে ওসব বাজে কথা—নিজের প্রশংসা নিজের মুখে মানায় না। আপনি পারচেজ দেবতাদের সন্তুষ্ট করবার মন্তর শিখুন। সুধাকরবাবু একটা সুন্দর কথা বলেন—যতক্ষণ না অফিসারের সঙ্গে ক্যাশের ব্যবস্থা হলো ততক্ষণ দুশ্চিন্তা থেকে যায়। যেমনি বুঝলাম, মাল খায়, টাকা নেয়, আর ভাবনা থাকে না। ঘরটা আমার পাকাপাকি হবার চান্স রইলো। নিজের স্বার্থেই অফিসার আমার স্বার্থটা দেখবেন।
সোমনাথের এসব কথা মোটেই ভালো লাগছে না। সে বললো, “নিজেকে ছোট করে কী লাভ, মিস্টার মিটার?”
আঁতকে উঠলেন নটবর মিটার। “ওরে বাবা! এ যে ফিজিক্সের কথা তুলে ফেললেন। স্যরি, ফিজিক্স নয়—ফিলজফি। এখানে মশাই, কেউ ফিলজফি করতে আসে না—ট-পাইস কামাতে আসে। তা ছাড়া আপনি নিজেকে ছোট করবেন কেন? প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই। তো দেবতা আছেন—গ্রেট বিবেকানন্দ সোয়ামী বলে গেছেন। মনে করুন, আপনি সাক্ষাৎ নারায়ণের সেবা করছেন, হোক না সে পারচেজ অফিসার।”
নটবর মিত্তির ঘড়ির দিকে তাকালেন। বললেন, “না মশাই, ট্যাক্সি পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আমি ট্রামে উঠে পড়বো এবার। তবে শুনে রাখন—জাত সেলসম্যানের কাছে। প্রত্যেক খদ্দের একটা চ্যালেঞ্জ! পৃথিবীতে এমন লোক জন্মায়নি যার দুর্বলতা নেই। বাইরে থেকে মনে হবে দভেদ্য দুর্গ, কিন্তু খোঁজ করলে দেখা যাবে কোথাও একটা দরজা খোলা আছে। আমার নেশা হলো, মানুষের এই ভেজানো দরজা খুঁজে বার করা। খুউব ভালো লাগে! আপনি মশাই, ফিলজফি-টফি ভুলে যান—মন দিয়ে জনসংযোগ করনে।”
সোমনাথ গম্ভীর হয়ে হাঁটতে লাগলো। চিৎপুর রোড থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ডালহৌসি স্কোয়ারে এসে হঠাৎ হীরালাল সাহার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। ভদ্রলোক হাঁ করে রাইটার্স বিল্ডিংসের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওঁর চোখে যে ছোটছেলের লোভ রয়েছে তা সোমনাথও বুঝতে পারছে। ধরা পড়ে গিয়ে হীরালালবাবু লজ্জা পেলেন। মুখে হাসি ফোটাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, “আপনাকে সত্যি বলছি, এই ভাঙা বাড়ির বিজনেস করে আমার অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে। কোনো পুরানো বাড়ি দেখুলেই হিসেব করতে ইচ্ছে হয় ভাঙলে কত কাঠ, কত লোহা, কত পাথর পাওয়া যাবে। কখন কোটেশন দিতে হয় কিছুই ঠিক নেই তো।”
“তা বলে আপনি এই রাইটার্স বিল্ডিংস-এর দিকে তাকাবেন?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করে।
হীরালালবাবু রেগে উঠলেন। “কেন? অন্যায়টা কী মশাই? চিরকাল তো আর এ-বাড়ি থাকবে না। একদিন না একদিন ভাঙতে হবেই।” হীরালালবাবু বললেন, “সায়েব বাড়ি বলেই আমার আগ্রহ। ইন্ডিয়ান আমলে রাইটার্স বিল্ডিং তৈরি হলে আমি সময় নষ্ট করতুম না। স্বাধীনতার পরে যেসব দেশলাই বাক্সের মতো নতুন বাড়ি হয়েছে আমি তো সেদিকে তাকিয়েও দেখি না। জানেন মিস্টার ব্যানার্জি, ভবিষ্যতে যাঁরা আমাদের এই বাড়িভাঙা লাইনে আসবে তারা একেবারে পথে বসবে। হাল আমলের বাড়িগুলোতে কিস্সু নেই। সায়েব বাড়িগুলো খতম হলেই কলকাতা খতম হয়ে গেলো।”
হীরালালবাবু তারপর বললেন, “এলগিন রোডের বাড়িটায় হাজার দুয়েক টাকা ঢালবেন নাকি? চার-পাঁচ দিনের মধ্যে লাভ পেয়ে যাবেন। আমার কিছু টাকা কমতি পড়েছে। ভাবলুম—কেন পাগড়ি পরা গুড়ের নাগরীগুলোর কাছে হাত পাতি। আপনি লোকাল লোক রয়েছেন।”